মণিকরণে এক সময় গুরু নানক এসেছিলেন, তাই এটা শিখদের তীর্থস্থান। গুরুদ্বার ও মস্ত বড় অতিথিশালা আছে। এ ছাড়া আছে আরও অনেক মন্দির। অনেক তীর্থযাত্রী আসে, উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করার জন্যও আসে অনেকে। সেইসব লোকের ধারণা, এই গরম জলে স্নান করলে সব অসুখ সেরে যায়।
যেখানে-সেখানে মাটি খুঁড়ে বেরোচ্ছে গরম জল।
এক এক জায়গায় জল এত গরম যে, হাঁড়িতে চাল রেখে দিলে আপনিই ভাত হয়ে যায়।
প্রচুর লোকজন, প্রচুর দোকানপাট।
কাকাবাবু ভিড় পছন্দ করেন না। জায়গাটা এমনি সুন্দর, কিন্তু যেখানে-সেখানে দোকানপাট আর বাড়িঘর গজিয়ে ওঠার জন্য ঘিঞ্জি হয়ে গেছে।
একটুখানি ঘোরাঘুরি করেই কাকাবাবু একটা চায়ের দোকানে বসলেন। দোকানের বাইরে বেঞ্চ পাতা, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, দেখা যায় উলটো দিকের পাহাড়।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, জোজো, আমি এখানেই বসছি। তোমাদের যদি ইচ্ছে হয় তোমরা মন্দিরগুলো দেখে আসতে পারো।
সন্তু বলল, আমরা মণিকরণ ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যেতে পারি না? ওদিকে কি আরও এরকম জায়গা আছে?
কাকাবাবু বললেন, যতদূর জানি, এদিকে আর কোনও তীর্থস্থান কিংবা বড় জায়গা নেই। রাস্তাটা উঠে গেছে ওপরদিকে। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম। ঠিক আছে, আমরা ঘুরে আসব খানিকটা। চা খেয়ে নিই।
এখানে চা বানায় পুরোটাই দুধ দিয়ে। দুধের মধ্যে চা-পাতা ফেলে দিয়ে ফোটায়। অন্যরকম স্বাদ। গেলাসে সেই চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন কাকাবাবু।
জোজো বলল, ওইদিকে গরম গরম জিলিপি ভাজছে, সন্তু একটা টেস্ট করবি নাকি?
সন্তু রাজি হয়ে মাথা নাড়ল।
দুখানা করে জিলিপি খাওয়ার পর জোজো বলল, ঠিক স্বাদটা বোঝা যাচ্ছে। আরও দুটো টেস্ট করা দরকার।
জোজো মোট সাতটা জিলিপি টেস্ট করে ফেলল।
তারপর বলল, সন্তু, ওগুলো কীরে, লাড্ডু? টেস্ট করবি নাকি?
সন্তু আর খাবে না। জোজো টেস্ট করল তিনটে লাড্ড! তারপর চারখানা কচুরি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই এত খাচ্ছিস কী করে রে জোজো?
জোজো বলল, মুড এসে গেছে। রোজ কি আর খাই? এক-একদিন খাওয়ার মুড হয়। এখানকার টাটকা বাতাসে খুব খিদেও পাচ্ছে।
সন্তু বলল, অনেক সাহেব-মেম ঘুরছে, তারাও খুব জিলিপি পছন্দ করে দেখছি।
কাকাবাবুর কাছে ফিরে এসে দেখল, কাকাবাবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন রাস্তার উলটো দিকে। সেখানে একটা বাড়ির দেওয়ালে একটা বড় পোস্টার সাঁটা। একজন বিদেশি যুবকের ছবির ওপর লেখা—Reward, Ten Thousand dollars. তার তলায় লেখা আছে আরও কিছু।
কাকাবাবু বললেন, ওই পোস্টারে কী লেখা আছে, সব পড়তে পারছি না। তোরা কাছে গিয়ে দেখে আয় তো!
সন্তু পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে সেদিকে চলে গেল।
ফিরে এসে বলল, একজন লোক এখান থেকে হারিয়ে গেছে। তার নাম চার্লস শিরাক। পোস্টারটা লাগিয়েছেন ওর মা। তিনি ছেলেকে খুঁজতে এসেছিলেন এখানে। কোনও সন্ধান পাননি। তাই লিখে দিয়েছেন, কেউ তাঁর ছেলেকে খুঁজে দিতে পারলে তাকে দশ হাজার ডলার পুরস্কার দেবেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোন দেশের লোক?
সন্তু বলল, কানাডার।
জোজো বলল, দশ হাজার ডলার! অনেক টাকা। খুঁজে দেখব নাকি?
কাকাবাবু বললেন, চেষ্টা করে দ্যাখো না।
জোজো বলল, যদি আমরা খুঁজে দিতে পারি, তা হলে শুধু দশ হাজার ডলার নয়, ওই লোকটির মা নিশ্চয়ই আমাদের কানাডায় নেমন্তন্ন করবে। আমি অবশ্য কানাডায় সাতবার গেছি। সন্তু তো যায়নি।
সন্তু বলল, আমি ডিসকভারি চ্যানেলে কানাডা দেখেছি।
চায়ের দোকানের মালিক গেলাসগুলো নিতে এসে বাংলায় কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সাহেব কি কলকাতা থেকে আসছেন?
এখানে অনেক বাঙালি ভ্রমণকারী আসে বলে দোকানদাররা কিছু কিছু বাংলা বলার চেষ্টা করে। এই লোকটির উচ্চারণ বেশ পরিষ্কার।
কাকাবাবু বললেন, কলকাতা থেকে এসেছি বটে, কিন্তু আমি তো সাহেব নই, বাঙালি।
লোকটি চওড়াভাবে হাসল।
কাকাবাবু বললেন, এখানে অনেক সাহেব-মেম ঘুরছে। আমাদের আর সাহেব বানাবার দরকার নেই। আপনি এত ভাল বাংলা শিখলেন কোথায়?
লোকটি বলল, আমি সাত বছর কলকাতায় ছিলাম, বড়বাজারে কাজ করেছি। আপনাদের কলকাতাতেও অনেকে অফিসের বাবুদের সাহেব বলে। বড়সাহেব, ছোটসাহেব!
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক! সারা দেশেই এরকম বলে। আপনার দোকান কেমন চলছে? এখানে তো অনেক লোক আসে দেখছি।
লোকটি বলল, শীতকালে তবু কম আসে। গরমকালে এসে দেখবেন, হাজার লোক আসে। বাঙালিও অনেক আসে। শীতকালে সাহেব-মেম আসে বেশি।
লোকটির নাম সুরেশকুমার। মোটাসোটা চেহারা। বেশ গল্প করতে ভালবাসে। তার নিজের বাড়ির উঠোনেও একটা গরম জলের ফোয়ারা মাটি খুঁড়ে উঠেছে, সেই ফোয়ারাটাও সে লোকদের স্নান করবার জন্য ভাড়া দেয়। তাতেও রোজগার হয় ভালই।
কাকাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ওই যে সাহেবটির ছবির পোস্টার রয়েছে সামনের বাড়ির দেওয়ালে, ওকে আপনি দেখেছেন?
সুরেশকুমার বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সিরাপসাহেব তো, অনেকবার দেখেছি।
কাকাবাবু বললেন, সিরাপ নয়, শিরাক।
সুরেশকুমার বলল, আমরা বলতাম, সিরাপসাহেব। আমার দোকানে একটা লাল শরবত হয়, সাহেব সেটা ভালবাসত খুব, দিনে তিন-চার গেলাস খেত। একটু পাগলা পাগলা ছিল। একদিন কী কাণ্ড হয়েছিল জানেন? আমার দোকানের ঠিক সামনেই, এই রাস্তার ওপরে হঠাৎ দুটো লোক ওই সিরাপসাহেবকে জাপটে ধরল, জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সিরাপসাহেব প্রথমে ঠিক বুঝতে না পারলেও একটু পরেই গা ঝাড়া দিল, যেন লাফিয়ে উঠে গেল ওপরে, তারপরই দমাদ্দম ঘুসি। খুব ভাল লড়তে জানত, দুটো লোকই মার খেয়ে পালাল।
দুটো লোক ওকে ধরতে এসেছিল কেন?
তা জানি না। তোক দুটো পালাবার পর অনেকে সাহেবকে ঘিরে ধরে ওই কথা জিজ্ঞেস করেছিল। সাহেব কোনও উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার দোকানে ঢুকে এসে বলল, এক গেলাস শরবত দাও!
এ যে দেখছি সিনেমার নায়কের মতন! সেই সাহেব গেল কোথায়?
মরে গেছে নিশ্চয়ই। ছমাস হয়ে গেল, কোনও পাত্তা নেই।
মরে গেছে, তুমি জানলে কী করে?
একদিন কাঁধে ব্যাগ বেঁধে ট্রেকিং করতে চলে গেল। যাওয়ার আগে এই দোকানে বসেছিল। আমায় বলল, এই পার্বতী নদী কোথা থেকে বেরিয়েছে, সেই পাহাড়ের গুহাটা দেখতে যাবে। অনেক সাহেবই তো এরকম যায়। কিন্তু দলবেঁধে যায়। ওই সাহেব গেল একা। কোথায় পা পিছলে টিছলে পড়ে গেছে।
মৃতদেহ পাওয়া গেছে?
নাঃ, তা পাওয়া যায়নি অবশ্য। পুলিশ অনেক খুঁজেছে। মিলিটারি থেকে সার্চ পার্টি গেছে। যাওয়া-আসা ছদিনের রাস্তা, কত পাহাড়ের খাঁজ, কোথায় পড়ে আছে, কে জানে! সাহেবের মা এসেছিল কানাডা থেকে। কী কান্না! একমাত্র ছেলে! ভদ্রমহিলার এখনও আশা যে, তার ছেলে বেঁচে আছে।
তা হতেও পারে। ডেডবডি যখন পাওয়া যায়নি, হয়তো সাধু হয়ে গেছে।
সন্তু আর জোজো মন দিয়ে শুনছিল। জোজোর পক্ষে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা মুশকিল।
এবার সে বলে উঠল, সাহেবের কুষ্ঠিটা পেলে আমি বলে দিতে পারতাম, বেঁচে আছে কি না!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কুষ্ঠি বিচার করতে পারিস?
জোজো বলল, বাবার কাছে শিখেছি। জন্ম তারিখ জানলে কুষ্ঠি তৈরি করতেও পারি।
সন্তু বলল, ওই পোস্টারে শিরাকসাহেবের মায়ের ঠিকানা লেখা আছে। ওই ঠিকানায় চিঠি লিখে জন্ম তারিখটা জেনে নিতে পারিস।
কাকাবাবু বললেন, আপাতত ওঠা যাক। চলো, একটু গ্রামের দিকে ঘুরে আসি।
সুরেশকুমারের কাছে বিদায় নিয়ে কাকাবাবু ব্রিজটার দিকে এগোলেন। গাড়ি রাখা আছে ওপারে।
জোজো বলল, কাকাবাবু, আমার মন বলছে, চেষ্টা করলে আমরা ওই শিরাক সাহেবকে খুঁজে বের করতে পারব, তা হলে দশ হাজার ডলার রোজগার হয়ে যাবে!
কাকাবাবু বললেন, তুমি আর জোজো চেষ্টা করে দ্যাখো। আমি তো আর পাহাড়ে ওঠাউঠি করতে পারব না!
ব্রিজের এপারে এসে গাড়ির কাছে পৌঁছবার আগেই ঝড়ের বেগে আর-একটা বড় গাড়ি এসে থামল। পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাক পরা একজন লোক সেই জিপ থেকে নেমেই দৌড়ে এসে কাকাবাবুকে বলল, আপনিই নিশ্চয়ই রাজা রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু মাথা নাড়লেন।
পুলিশটি ইংরিজিতে বলল, আমার নাম অরুণ ভার্গব। আমি এখানকার এস পি। আপনাকে দারুণভাবে খোঁজা হচ্ছে। আপনাকে এক্ষুনি মাণ্ডিতে যেতে হবে।
কাকাবাবু চোয়াল কঠিন করে বললেন, আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। সকালে আরও দুজন লোক এসে আমাকে এই কথা বলেছে। আমি এখানে
বেড়াতে এসেছি। কোথায় যাব না যাব, তা আমি নিজে ঠিক করব। পুলিশের কথামতন আমাকে মাণ্ডু যেতে হবে কেন? আমি দুঃখিত, এই জায়গাটাই আমাদের ভাল লাগছে, মাণ্ডিতে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে এখন নেই।
অরুণ ভার্গব বললেন, ওখানে একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটে গেছে। আপনার সাহায্যের খুব দরকার। প্লিজ চলুন।
কাকাবাবু বললেন, আমি আপনাদের কীভাবে সাহায্য করব? আমি পুলিশে চাকরি করি না, চোর ধরা কিংবা খুনের তদন্ত করা আমার কাজ নয়। আমার কাছে
এসেছেন কেন?
অরুণ ভার্গব বললেন, প্লিজ ভাববেন না, আমরা আপনার ওপর জোর করতে এসেছি। খুব বিপদে পড়েই সাহায্য চাইতে এসেছি আপনার কাছে।
কাকাবাবু বললেন, আপনি আমার কথা জানলেন কী করে? আমি তো এখানে কাউকে কিছু খবর দিয়ে আসিনি। আর দেখছেন তো, আমি একজন খোঁড়া মানুষ, আমার কি সাহায্য করার ক্ষমতা আছে?
অরুণ ভার্গব এবার কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, সত্যি কথা বলছি মিস্টার রায়চৌধুরী, আমি আপনার কথা আগে কিছু শুনিনি, এখনও আপনার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। আমার কাছে অর্ডার এসেছে, যেমন করে থোক, বুঝিয়ে সুঝিয়ে আপনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাণ্ডিতে নিয়ে যেতে হবে। আপনি নরেন্দ্র ভার্মাকে চেনেন?
এবারে কাকাবাবুর ভুরুদুটো সোজা হয়ে গেল। তিনি বললেন, হ্যাঁ চিনি, নরেন্দ্র ভার্মা আমার বিশেষ বন্ধু।
অরুণ ভার্গব বললেন, নরেন্দ্র ভার্মা এখন সিমলায় আছেন। আমাদের এই বিপদের ব্যাপারটা ওঁকে ফোনে জানানো হয়েছিল। উনিই বলেছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে। আপনার সাহায্য আমাদের খুব কাজে লাগবে।
কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। এখানে আসবার পথে তিনি দিল্লিতে দুদিন ছিলেন। সেখানে নরেন্দ্র ভার্মার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। নরেন্দ্র ভার্মা অনেকদিনের বন্ধু, একসঙ্গে দুজনে অনেক অভিযানে গেছেন। ওঁর অনুরোধ অগ্রাহ্য করা যায় না।
অরুণ ভার্গব বললেন, চলুন, প্লিজ চলুন, ওখানে ভাল গেস্ট হাউস আছে, আপনাদের থাকাটাকার ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হবে না। এখানকার ডিভিশনাল কমিশনার একজন বাঙালি, খুব কাজের লোক, তাঁর সঙ্গে আলাপ হলে আপনার ভাল লাগবে!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ওখানে কী হয়েছে?
অরুণ ভার্গব বললেন, গাড়িতে উঠুন। হোটেল থেকে আপনাদের জিনিসপত্রগুলো তুলে নিতে হবে। যেতে যেতে সব বলব।
হোটেলে এসে জিনিসপত্র সব ভরা হল পুলিশের গাড়িতে। ম্যানেজার বিল বানাতে দেরি করছিল, অরুণ ভার্গব তাকে ধমক দিয়ে বললেন, শিগগির, শিগগির করুন। সময় নষ্ট করছেন কেন?
টাকাপয়সা মিটিয়ে দিয়ে সবাই মিলে ওঠা হল এক গাড়িতে।
নদীটার দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছিল। খুব ইচ্ছে ছিল, নিরিবিলিতে এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার।
অরুণ ভার্গব বললেন, বুঝতেই পারছেন, খুবই একটা বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে বলেই আপনাকে বিরক্ত করা হচ্ছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা এবার শোনা যাক।
অরুণ ভার্গব বললেন, একটু খুলে বলতে হবে। তবে ব্যাপারটা খুবই গোপন, বাইরের কেউ এখনও কিছু জানে না।
তিনি সন্তু আর জোজোর দিকে তাকালেন।
কাকাবাবু বললেন, ওরা ঠিক আছে। আলাপ করিয়ে দিই, একজন আমার ভাইপো সন্তু, আর একজন তার বন্ধু জোজো। ওদের গুণপনা ক্রমশ জানতে পারবেন।
জোজো বলল, কাকাবাবু, শুধু গুণপনা কেন বললেন? আমাদের কোনও দোষ নেই বুঝি?
কাকাবাবু হাসলেন।
সন্তু বলল, জোজো, আগে ঘটনাটা শুনতে দে!
অরুণ ভার্গব বললেন, পরশুদিন শিবরাত্রির পুজো জানেন নিশ্চয়ই?
কাকাবাবু বললেন, শিবরাত্রি? না, জানতাম না।
অরুণ ভার্গব বললেন, শিবরাত্তিরে এখানে বিরাট মেলা হয়। সেই উপলক্ষে গ্রাম থেকে দেবতারা নেমে আসেন। দূর দূর পাহাড়ের ওপর যেসব গ্রাম, সেখান থেকেও দেবতারা আসেন।
কাকাবাবু খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, দেবতারা নেমে আসেন মানে?
জোজো বলল, দেবতারা কি উড়তে উড়তে আসেন? না, রথে চেপে?
অরুণ ভার্গব বিরক্তভাবে তাকালেন জোজোর দিকে। সন্তু তার কাঁধে চিমটি কেটে বলল, চুপ করে শোন না!
অরুণ ভার্গব বললেন, দেবতা মানে দেবতার মূর্তি। সব গ্রামেই মন্দির আছে, আলাদা আলাদা দেবতা আছেন। এখানে কেউ মূর্তি বলে না, শুধু দেবতাই বলে। মাণ্ডিতে সেই দেবতাদের নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। পুরুতরা কাঁধে করে দেবতার সিংহাসন বয়ে নিয়ে যান। অনেক দূর দূর থেকে আসতে হয়, বৃষ্টি হতে পারে, রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই শিবরাত্রির দু-তিনদিন আগেই অনেক দেবতা পৌঁছে যান। এখানকার মন্দিরে তাঁদের ভাগ ভাগ করে রাখা হয়। প্রায় তিনশোসাড়ে তিনশো দেবতা। এর মধ্যে লাল পাথুরে নামে একটা খুব বড় গ্রামের দেবতার নাম ভূতেশ্বর। খুব জাগ্রত। খুব নাম। সেই ভূতেশ্বর দেবতা চুরি হয়ে গেছে।
কাকাবাবু বললেন, দেবতা চুরি? শুনতে কীরকম অদ্ভুত লাগে। অর্থাৎ দেবতার মূর্তি চুরি। খুব দামি বুঝি?
ভার্গব বললেন, দামি মানে সোনা কিংবা রুপোর নয়। পঞ্চ ধাতুতে তৈরি। খুব বেশি দামি নয়, আবার শস্তাও নয়। সেজন্য কেউ চুরি করবে না। মূর্তিটা অন্তত আড়াইশো বছরের পুরনো, সেইদিক থেকে দাম আছে, যাকে বলে অ্যান্টিক ভ্যালু। অনেক সময় এইসব মূর্তি বিদেশে পাচার হয়ে যায়। তা ছাড়া, অন্য গ্রামের লোকও চুরি করতে পারে।
জোজো বলল, ভূতেশ্বর মানে কি ভূতদের দেবতা?
কাকাবাবু বললেন, এসব নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে নেই, জোজো। মানুষের বিশ্বাসের ব্যাপার। ভূতেশ্বর মানে শিব। শিবের আর-এক নাম ভূতনাথ।
জোজো বলল, ও হ্যাঁ, তাই তো! আমার এক জ্যাঠামশাইয়ের নামও ভূতনাথ। আমরা বলি, ভুতুজ্যাঠা। খুব ভয় পাই তাঁকে।
ভার্গব এমনভাবে জোজোর দিকে তাকালেন যে, মনে হল, কাকাবাবু না থাকলে এক্ষুনি তিনি জোজোকে একটা চড় কষাতেন।
কাকাবাবু বললেন, দেবতার মূর্তি চুরি গেছে, তাতে আমি কী করব বলুন তো? চোর ধরা তো পুলিশের কাজ। আমি কোনও দিন পুলিশের চাকরি করিনি। চোর কী করে ধরতে হয়, তাও জানি না।
ভার্গব বললেন, মূর্তিটা যে চুরি গেছে, এটাই এখনও কাউকে জানানো হয়নি। জানাজানি হয়ে গেলেই দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে। পুলিশ খোঁজখবর নিতে গেলেই লোকের সন্দেহ হবে। সেইজন্য আমরা এগোতে পারছি না। মাপ করবেন, মিস্টার রায়চৌধুরী। আমি আপনার পরিচয় ঠিক জানি না। আমাদের ওপর অর্ডার এসেছে আপনার সাহায্য নেওয়ার জন্য।
কাকাবাবু বললেন, দেখছেনই তোত আমি খোঁড়া মানুষ। চোরের পেছনে ছোটাছুটি করা কি আমার পক্ষে সম্ভব?
জোজো বলল, কাকাবাবু, একটা কাজ করলে হয় না? এই কেসটা সন্তু আর আমাকে দিয়ে দিন। আমরা ঠিক ভূতেশ্বর ঠাকুরকে খুঁজে বের করে নেব। আমাদের কেউ সন্দেহও করবে না।
ভার্গব চোখ দিয়ে জোজোকে ভস্ম করে দিতে চাইলেন।
কাকাবাবু বললেন, এটা মন্দ প্রস্তাব নয়। তোমরাই চেষ্টা করে দ্যাখো। তোমরা ছোটাছুটিও করতে পারবে।
ভার্গব খুবই অসন্তুষ্টভাবে বললেন, আপনারা প্লিজ ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবেন না। এটা সাধারণ চুরির ব্যাপার নয়। এখানকার মানুষ দেবতার মূর্তি ছুতেই সাহস করে না। চোরেরাও মন্দিরে ঢুকতে ভয় পায়। আজ পর্যন্ত এ রাজ্যে কখনও কোনও দেবতার মূর্তি কিংবা কোনও মূর্তির গায়ের গয়না চুরি যায়নি।
কাকাবাবু বললেন, অন্য রাজ্যের লোক এসে চুরি করতে পারে। ভার্গব সাহেব, আপনি বললেন, মূর্তিচুরির কথা এখনও কেউ জানে না। যে পুরোহিতরা মূর্তিটি বয়ে এনেছে গ্রাম থেকে, তারা নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে?
ভার্গব বললেন, দুজন পুরোহিত শুধু জানে। কিন্তু তারা আর কাউকে জানাতে পারবে না। দুজনকেই খুব কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু পরশুদিন শিব রাত্রির মিছিলে তো অন্য দেবতাদের সঙ্গে ভূতেশ্বরের মূর্তি বের করতেই হবে। হাতে মাত্র দু দিন সময়।
কাকাবাবু বললেন, এই দু দিনের মধ্যে ওরকম আর-একটা মূর্তি বানিয়ে ফেলা যায় না?
ভার্গব বললেন, আড়াই শো বছরের একটা পুরনো মূর্তির সঙ্গে একটা নতুন মূর্তির তফাত বোঝা যাবে না? তা ছাড়া মূর্তিটা ঠিক কীরকম দেখতে, তাও তো আমরা জানি না। ছবি তুলে রাখা হয়নি।
কাকাবাবু এবার হেসে ফেলে বললেন, এই রে, মূর্তিটা কী রকম দেখতে, আপনারা জানেন না। আমিও তো জানি না। না জেনে একটা জিনিস খুঁজব কী করে?
ঠিক উত্তর দিতে না পেরে ভার্গব চুপ করে গেলেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, নরেন্দ্র কি সিমলা থেকে আসছে এখানে?
ভার্গব বললেন, হ্যাঁ। সন্ধের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছেন আমাদের সঙ্গে।
জোজো বলল, দ্যাখ সন্তু, এখানে পার্বতী নদী আর একটা বড় নদীর সঙ্গে মিশেছে।
সন্তু বলল, এটা বিয়াস নদী। নামটা কী করে হয়েছে জানিস?
জোজো বলল, বিয়াস, মানে বাংলায় আমরা যাকে বলি ব্যাস। ব্যাস নামে একজন ঋষি ছিলেন না? তিনিই তো মহাভারত লিখেছেন।
কাকাবাবু বললেন, ব্যাসদেব মহাভারত লিখেছেন ঠিকই। কিন্তু এই নদীর নাম তাঁর নামে হয়নি।
ভার্গব বললেন, হ্যাঁ, বিয়াস মুনির নামেই এই নদী। এখানেই তাঁর আশ্রম ছিল।
কাকাবাবু বললেন, এখন লোকে তাই ভাবে, কিন্তু এই নামের আসল মানে অন্য। এ নদীর নাম ছিল বিপাশা। সেই বিপাশা থেকে বিয়াস হয়ে গেছে। বিপাশার সঙ্গে ব্যাসদেবের সম্পর্ক নেই। এখানে তো বশিষ্ঠ মুনিরও আশ্রম আছে, তাই না?
ভার্গব বললেন, হ্যাঁ, মানালিতে আছে। এই নদীরই ধারে।
কাকাবাবু বললেন, বশিষ্ঠ মুনিই এই নদীর নাম দিয়েছিলেন বিপাশা। বশিষ্ঠ মুনির একশোটি ছেলেকে এক রাক্ষস মেরে ফেলেছিল। মনের দুঃখে তিনি আত্মহত্যা করতে চাইলেন। অনেক রকম চেষ্টা করেও তিনি মরতে পারছিলেন না কিছুতেই। শেষকালে তিনি সারা গায়ে দড়ি জড়িয়ে বেঁধে ঝাঁপ দিলেন এক নদীতে। হাত-পা বাঁধা থাকলে তো সাঁতার কাটা যায় না, ড়ুবে মরতেই হয়। কিন্তু বশিষ্ঠ মুনিকে সবাই দারুণ শ্রদ্ধা করত। তাই নদীটিও তাকে মরতে দিল না, সেই দড়ির বাঁধন খুলে দিল। পাশ মানে বন্ধন, সেই থেকে নদীর নাম হল বিপাশা। তুই এই গল্পটা জানতিস না সন্তু?
সন্তু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে আর আমি বলতে গেলাম কেন? তোরই বলা উচিত ছিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমরা বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম দেখতে যাব না?
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়া, আগে ভূতেশ্বরের মূর্তি উদ্ধারের ব্যাপারে কী করা যায় দেখা যাক। নরেন্দ্র যে কী ঝামেলাই চাপাল!
সমস্ত রাস্তাটাই বিয়াস নদীর ধার দিয়ে। আরও ঘণ্টাখানেক পরে ওরা পৌঁছে গেল মাণ্ডিতে।
মাণ্ডি রীতিমতন শহর। নদীর ধারেই বাজার, অনেক হোটেল, কয়েকটা মন্দির আর প্রচুর বাড়ি। ভার্গব অবশ্য ওদের যেখানে নিয়ে গেল, সে জায়গাটা ঘিঞ্জি নয়। একটা ছোট্ট টিলার ওপরে সুন্দর বাগান-ঘেরা একটা সাদা রঙের বাড়ি। সামনে অনেকখানি চওড়া একটা ঢাকা বারান্দা।
এখান থেকে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। চতুর্দিকে ছোট ছোট টিলা, বরফঢাকা বড় পাহাড় এদিকে নেই।
দূরের কোনও মন্দির থেকে অনবরত ঘণ্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ওরা পৌঁছবার একটু পরেই আর-একটা গাড়িতে চলে এলেন কয়েকজন অফিসার। তাঁদের মধ্যে একজনের বেশ জবরদস্ত মিলিটারির মতন চেহারা। তিনি পুলিশের বড়কর্তা, তাঁর নাম ভূপিন্দার সিং। চুরির ব্যাপারটা বোঝাতে বোঝাতে তিনি এক সময় কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, দেবতার মূর্তিটা খুঁজে বের করার একটা কিছু উপায় আপনাকে বাতলাতেই হবে। নরেন্দ্র ভার্মা বলেছেন, আপনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন।
কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র আমার নামে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলেছে। আগে তো আমি কখনও চোর ধরিনি।
ভূপিন্দার সিং বললেন, চোর ধরা পড়ুক বা না পড়ুক, মূর্তিটা পেলেই হল।
কাকাবাবু বললেন, চলুন, যেখান থেকে মূর্তিটা চুরি গেছে, সেই জায়গাটা আগে দেখে আসি।
ভূপিন্দার সিং বললেন, আমরা তো যেতে পারব না। আমাদের সবাই চেনে। আমাদের ওখানে যেতে দেখলেই লোকে কিছু একটা সন্দেহ করবে। আপনি টুরিস্ট, আপনি মন্দির দেখার ছুতো করে সেখানে চলে যান। ড্রাইভার আপনাকে নিয়ে যাবে। মন্দিরের বাইরে দেখবেন তিনজন গ্রামের লোক বসে আছে। বিড়ি খাচ্ছে, খৈনি খাচ্ছে। তারা কিন্তু আসলে গ্রামের লোক নয়, সাদা পোশাকের পুলিশ। ওই মন্দিরে যাতে এখন আর কেউ যেতে না পারে। তাই ওরা পাহারা দিচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার ওকে আপনার কথা বুঝিয়ে দেবে। ভেতরের পুরুত দুজন এখনও ঘুমোচ্ছে। সন্ধের আগে তাদের জাগবার কোনও সম্ভাবনা নেই।
কাকাবাবু বললেন, তারপর কি ওদের আবার ঘুম পাড়িয়ে রাখবেন? ওরা খাবেটাবে না?
ভূপিন্দর সিং বললেন, সন্ধের পর কী করা হবে, তা তখন ভেবে দেখা যাবে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। তা হলে মন্দিরটা ঘুরে আসা যাক।