বুধবার রাত্রি বেলা ভয়ংকর একটা শব্দে আমাদের ছোট শহরটা কেঁপে উঠল–কিসের শব্দ কোথায় শব্দ কেমন করে শব্দ কিছুই আমরা জানতে পারলাম না। শব্দটা মনে হয় দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে এছাড়া কিছুই টের পাওয়া গেল না। যখন কোনো কিছু জানা না যায়, তখন নানা রকম গুজব ডালপালা ছড়ায়, তাই এবারেও নানারকম গুজব শুনতে পেলাম। সবচেয়ে পানশে গুজব হচ্ছে কাছাকাছি একটা ট্রান্সফর্মার ফেটে গেছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ গুজবটা হল চীন আর আমেরিকার মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, আমেরিকা থেকে চীনের দিকে একটা মিসাইল ছুঁড়েছে, পুরোটা যেতে পারে নাই মাঝখানে আমাদের শহরের ওপর পড়েছে। শহরের দক্ষিণ দিকটা পুরো বাতাস হয়ে উড়ে গেছে।
আমি একটু দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল শহরের দক্ষিণ দিকে, সেই স্কুল বাতাস হয়ে উড়ে গেলে আমাদের কী লাভ? আমাদের স্কুল শহরের উত্তরে, যদি উত্তর দিক বাতাস হয়ে উড়ে যেতো আমাদের কিছু একটা লাভ হত।
পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম বগা এক কপি দৈনিক মহব্বত নিয়ে এসেছে, সেই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে হেড লাইন “প্রচণ্ড বিস্ফোরণে অক্সব্রীজ স্কুল বিধ্বস্ত। স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ ঘোষণা।” ভিতরে ছোট ছোট করে লেখা আনুমানিক রাত আটটা তিরিশ মিনিটে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুলের মূল ভবনটি ধ্বসে পড়েছে। কোথায় কেন কীভাবে সেটি ঘটেছে কেউ জানে না। অনুমান করা হচ্ছে স্কুলের ল্যাবরেটরিতে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। স্কুলের গার্ড বলেছে, সে রাত আটটার দিকে দশ বারো বছরের একটি ছেলেকে দোতালার বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছে। ল্যাবরেটরির দায়িত্বে থাকা বিজ্ঞান শিক্ষককে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ল্যাবরেটরির একটা চাবির কোনো হদিস নেই। অনেক বড় বিস্ফোরণ হলেও কোনো মানুষ আহত হয়নি কিংবা মারা যায়নি।
খবরটা পড়ে আমাদের খুব দুঃখ হল। ঘটনাটা যদি অক্সব্রীজ স্কুলে না হয়ে আমাদের স্কুলে হতো তাহলে কী মজাই না হতো, অনির্দিষ্ট কালের জন্যে স্কুল বন্ধের আনন্দটাই অন্যরকম–আমি লিখে দিতে পারি অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা কোনোদিন এই আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। বরং তাদের নিশ্চয়ই মন খারাপ যে তারা স্কুলে যেতে পারছে না।
পরের কয়েকদিন আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে দৈনিক মহব্বত পড়লাম, সেখানে একটা রহস্যময় বালকের কথা লেখা হল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ধামাচাপা দিয়ে রাখল। আমরা একদিন অক্সব্রীজ স্কুলটা দেখে এলাম, তাদের সুন্দর বিল্ডিংয়ের বড় অংশ এখনো ধ্বসে পড়ে আছে। কবে সেই স্কুল আবার দাড়া হবে কে জানে।
এর দুইদিন পর আমাদের স্কুলে একটা নূতন ছেলে ভর্তি হল। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেহেতু লেখাপড়া করে না তাই কখনো তাদের চোখ খারাপ হয় না। সেজন্যে আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েদের কারো চোখে চশমা নেই। আমাদের স্কুলে যে নূতন ছেলেটা ভর্তি হল তার চোখে চশমা এবং দেখেই বুঝতে পারলাম তার চশমার অনেক পাওয়ার। ছেলেটার জামা কাপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শুধু তাই না আমরা দেখলাম তাকে একটা গাড়ী থেকে নামিয়ে দেয়া হল। স্কুলে ঢোকার আগে গাড়ী থেকে নেমে একজন মহিলা নিশ্চয়ই ছেলেটার মা— অনেকক্ষণ ছেলেটার সাথে কথা বললেন। দূর থেকে কথা শোনা যাচ্ছিল না, আমরা শুধু অনুমান করতে চেষ্টা করলাম কী বলছেন। ঝুম্পা বলল, “বলছেন, এই বাদমাইস পাজীর পা ঝাড়া একটান দিয়ে তোর কল্লা ছিড়ে ফেলব, ঘুষি মেরে তোর ভূড়ি ফাঁসিয়ে দেব। তোর মতো অপদার্থ বেজন্যাকে জন্ম দেওয়ার কারণে আজকে আমার এতো বড় অপমান, মহব্বতজান স্কুলে তোকে ভর্তি করাতে হচ্ছে, চৌদ্দ গুষ্ঠির সামনে আমি মুখ দেখাতে পারব না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ!”
ফারা বলল, “উহু, মায়ের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মা এরকম খারাপ খারাপ কথা বলতে পাবেন না। আমার মনে হয় মা বলছেন, আমি তোকে নিয়ে আর পারি না। বাবা তুই আর আমাকে কতো জ্বালাতন করবি? তোর অন্য ভাইবোন তো তোর মতো না। তারা ঠিকমত লেখাপড়া করে ভালো ব্যবহার করে। তুই কেন এরকম? এই শহরে কী আরো এক ডজন ভালো স্কুল নাই? তাহলে তোকে কেন মহব্বতজান স্কুলে ভর্তি করতে হচ্ছে?”
বগা বলল, “আমার কী মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় মা বলছেন, তোর চেহারা দেখে কেউ অনুমান করতে পারবে তুই এতো দুষ্টু? ভালোমানুষের মত চেহারা, আর তলায় তলায় এতো দুষ্টুমি? তোকে কোনো ভদ্র স্কুল নিতে রাজী হচ্ছে না–শেষ পর্যন্ত মহব্বতজান স্কুলে এনে ভর্তি করতে হচ্ছে? আমি এখন কোথায় যাব?”
আমি কিছু বললাম না, ছেলেটাকে দূর থেকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। মা যখন তার সাথে কথা বলছে তখন তাকে দেখে মনে হলো কথাগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো মনে হয় সে শুনছেই না কিংবা শুনলেও বুঝছে না। ছেলেটা কেমন যেন উদাস উদাস ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝেই ডান হাতটা তুলে বুকের কাছে নিয়ে আসছে। মনে হয় পকেটে কিছু একটা আছে যেটা একটু পরে পরে হাত দিয়ে দেখছে সেটা আছে না চলে গেছে। মা বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন তখন ছেলেটা স্কুলের দিকে এগিয়ে এল। সে কোন ক্লাশে ভর্তি হবে আমরা তখনো জানি না, তাই তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করতে লাগলাম।
মহব্বতজান স্কুলের কোনো ছিরি ছাদ নাই, কোনটা কোন ক্লাশ সেটা কোথাও লেখাও নাই। শুধু তাই না, ক্লাশ রুম গুলো সাজানোও নাই, ক্লাশ গ্রীয়ের পাশে ক্লাশ এইট, সেভেনে পাশে টেন এরকম। কেউ যদি না জানে কোনোভাবেই সে তার ক্লাশ খুঁজে পাবে না। আমাদের স্যার ম্যাডামেরাও খুঁজে পান না, তাই তারা মাঝে-মধ্যে ভুলভাল ক্লাশে এসে বসে থাকেন, কিন্তু তারা যেহেতু কোনো কিছু পড়ান না কারো কোনো সমস্যা হয় না। একবার জলীল স্যার আমাদের বেদম পিটাচ্ছিলেন, আমি স্পষ্ট শুনলাম স্যার বিড়বিড় করে বলছেন, “এতো বড় বড় ছেলেমেয়ে এখনো ক্লাশ ফ্রীতে পড়ে!” আমরা তখন ক্লাশ এইটে পড়ি।
যাই হোক ছেলেটাকে খুবই বিভ্রান্ত দেখা গেল, তখন হঠাৎ সে আমাদেরকে দেখতে পেল। সে আবার ডান হাতটা তার বুকের কাছে ধরে বুক পকেটের জিনিসটা পরীক্ষা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, কাছাকাছি এসে চশমার ফাঁক দিয়ে আমাদেরকে এক নজর দেখে বলল, “ক্লাশ এইট কোনটা বলতে পার?”
বগা জিজ্ঞেস করল, “তুমি ক্লাশ এইটে পড়?”
ফারা বলল, “তোমাকে যে নামিয়ে দিলেন, উনি কী তোমার আম্মু? যা সুইট!”
ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
আমি বললাম, “তোমার পকেটে কী?”
ছেলেটা ঝট করে সোজা হয়ে গেল, তারপর কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বোঝাই যাচ্ছে পকেটে যে জিনিষটা আছে সেটার কথা সে কাউকে জানাতে চায় না। আমি ছেলেটার চোখের দিকে তাকালাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা না বলে শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়েও কথা বলা যায়, আমি তখন চোখের দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটাকে বললাম, “আমি জানি তোমার পকেটে যে জিনিষটা আছে সেটা গোপন এবং মনে হয় বেআইনী। কিন্তু তোমার কোনো ভয় নাই, তুমি আমাদেরকে সেটা বলতে পার। আমরা কাউকে বলব না।”
ছেলেটি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চোখে প্রথমে এক ধরণের ভয় দেখা গেল আস্তে আস্তে ভয়টা একটু কমে এল। তখন সে বগার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ক্লাশ এইটে পড়ি।” তারপর সে ঘুরে ফারার দিকে তাকাল, বলল, “হ্যাঁ আমার মা আমাকে নামিয়ে দিয়েছে। তারপর সে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল, সেটাকে একটা দীর্ঘশ্বাসের মত শোনাল। বলল, “সবার ধারণা আম্মু খুব সুইট আসলে আম্মুর মেজাজ খুবই গরম! আমাকে ঝাড়ি দেওয়া হচ্ছে আম্মুর হবি।” কথা শেষ করে সে ঝুম্পার দিকে তাকাল, বলল, “আমার নাম মিঠুন”। সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আমার পকেটে কিছু একটা আছে সেটা তুমি কেমন করে বুঝতে পেরেছ?”
আমি বললাম, “না বোঝার কি আছে? তোমার চালুক চুলুক ভাব দেখলেই বোঝা যায়।”
“চালুক চুলুক?”
“হ্যাঁ। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা বেআইনী জিনিষ আছে–লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছ।”
মিঠুন নামের ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ।” বলে সে শীষ দেওয়ার মত একটা শব্দ করল, আমি ভাবলাম এখন সে বলবে তার পকেটে কী আছে। কিন্তু সে বলল না চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী আছে তোমার পকেটে?”
ছেলেটা বলল, “আমি জিনিষটা তোমাদের দেখাতে পারি, কিন্তু জিনিষটা কী তোমাদের বলতে পারব না।”
“কেন?” “কারণ আমি জানি না জিনিষটা কী।”
“তুমি জান না কী কিন্তু জিনিষটা পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
আমরা ছেলেটার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আমাদের সাথে যারা কথা বলে তাদের বেশির ভাগের কথারও মাথা মুণ্ডুও আমরা বুঝতে পারি না। আমরা কথা শোনার সময় শুধু মাথা নেড়ে যাই। অন্যেরাও আমাদের কথার মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারে না। আমরা একটা জিনিষ বলি তারা অন্য একটা জিনিষ বুঝে বসে থাকে। তাই চশমা পরা এই মূতন ছেলেটার কথা শুনে আমি বেশি অবাক হলাম না! সে পকেটে কী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখার আমার খুব কৌতূহল হল, তাই বললাম, “জিনিষটা দেখাও।”
ছেলেটা আমাদের সবার মুখের দিকে তাকাল তারপর থমথমে গলায় বলল “কাউকে কিন্তু এটার কথা বলতে পারবে না।”
“বলব না।”
“জিনিষটা অসম্ভব গোপন। এটার জন্যে আমার লাইফের সবকিছু ওল্টাপাল্টা হয়ে গেছে।”
“ঠিক আছে।”
“তোমরা কিন্তু জিনিষটা নেয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি করবে না। আমি ধরে রাখব, তোমরা শুধু দেখবে।”
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, “ঠিক আছে বাবা! ঠিক আছে। বক্তৃতা শেষ করে এখন দেখাও।”
ছেলেটা এবারে খুব সাবধানে তার বুক পকেট থেকে কী একটা যেন বের করল, আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম জিনিষটা একটা ছোট শিশি। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মিষ্টি মিষ্টি ট্যাবলেট দেওয়ার জন্যে যেরকম ছোট শিশি থাকে অনেকটা সেরকম। শিশির ভিতরে কী আছে সেটা দেখার জন্যে আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম এবং দেখলাম কিছুই নাই। শিশিটা পুরোপুরি ফাঁকা।
জিজ্ঞেস করলাম, “কী আছে শিশির ভিতরে?”
“জানি না।”
বগা বলল, “কিছু তো নাই।”
“আছে।”
“তাহলে দেখা যায় না কেন?”
“জানি না।।
এবারে আমার সন্দেহ হল ছেলেটা নিশ্চয়ই আমাদের সাথে মশকরা করছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় না আসলে সে নিশ্চয়ই খুবই ফাজিল টাইপের ছেলে, আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। আমি একটু গরম হয়ে বললাম, “তুমি আমাদের সাথে ফাজলেমী করছ?”
ছেলেটা খুবই ঠাণ্ডা গলায় বলল, “না ফাজলেম করব কেন?”
“শিশিতে কিছু নাই, কিছু দেখা যায় না, কী আছে সেটা জান না, কেন দেখা যায় না সেটা জান না আবার বলছ আছে–এটা যদি ফাজলেমী না হয় তাহলে ফাজলেমী কী?”
ছেলেটা খুব গম্ভীরভাবে শিশিটা তার পকেটে রেখে বলল, “আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম, আমি জিনিষটা দেখাতে পারি কিন্তু জিনিষটা
কী সেটা বলতে পারব না।”
“জিনিষটাও তো দেখা গেল না।”
“দেখা না গেলে সেটা কী আমার দোষ?”
ঝুম্পা আমাকে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে ইবু, তোর আর ঝগড়া করতে হবে না। ধরে নে শিশিটাই হচ্ছে দেখার জিনিষ। শিশিটা তো দেখেছিস?”
আমি কিছু বললাম না। ছেলেটা বলল, “ক্লাস এইটটা কোনদিকে বলবে প্লীজ?”
ঝুম্পা বলল, “কোনো একটা ক্লাশ রুমে বসে যাও।”
মিঠুন নামের নতুন এই ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলল, “কোনো একটা ক্লাশ রুমে বসে যাব মানে?”
“এই স্কুলে ক্লাশ রুমের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। স্যারেরা ক্লাশে আসে না। আসলেও পড়ায় না। তাই তুমি কোন ক্লাশে বস তাতে কিছু আসে যায় না। একেকদিন একটা ক্লাশে বসে দেখ কোনটা ভালো লাগে।”
আমি ভেবেছিলাম এই কথাটা শুনে ছেলেটা খুবই ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু সে মোটেও ঘাবড়ালো না, বরং তার চোখ মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক!”
এবারে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক?”
“হ্যাঁ। আমি সব সময় এরকম একটা স্কুলে পড়তে চেয়েছিলাম যেখানে স্যার ম্যাডামেরা উৎপাত করবে না। আমরা নিজেরা নিজেরা ইচ্ছামতন লেখাপড়া করব।”
বগা বলল, “ইচ্ছামতন লেখাপড়া? কোনোদিন কোনো ছেলেমেয়ে ইচ্ছামতন লেখাপড়া করে? বেত দিয়ে না চাবকালে কেউ পড়তে চায়?”
মিঠুন তার চশমাটা ঠিক করে বলল, “কেউ কোনোদিন সেই এক্সপেরিমেন্ট করেছে? করে দেখলে বোঝা যাবে তোমার কথা সত্যি না মিথ্যা।”
মিঠুন তার গলার স্বর গম্ভীর করে বলল, “তুমি জান পৃথিবীর অনেক দেশে লেখাপড়ার মাঝে কোনো পরীক্ষা নাই।”
ফারা চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি? সত্যি? কোন দেশ? আমাদেরকে সেই দেশে নিবে? আমরা সেই দেশ থেকে লেখাপড়া করে আসতে পারি?”
মিঠুন বলল, “সেইটা আমি জানি না। বড় না হওয়া পর্যন্ত তোমার কথা কোনোদিন কেউ শুনবে না।” মিঠুনের মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে যায়
সে মাথা নেড়ে বলল, “মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“মনে হয় যদি একটা টাইম মেশিন তৈরী করে এক ঘণ্টার মাঝে বড় হয়ে যেতে পারতাম।”
ফারা বলল, “কী মেশিন?”
“টাইম মেশিন।”
“সেইটা আবার কী?”
“যে মেশিন দিয়ে সময়ের আগে পিছে যাওয়া যায়।”
“সময়ের আগে পিছে যাওয়া যায়?” ফার ভুরু কুঁচকে বলল, “সেইটা আবার কীভাবে করবে?”
বগা মুখ শক্ত করে বলল, “অসম্ভব।”
মিঠুন বলল, “তাড়াতাড়ি বড় হওয়া খুবই সম্ভব। আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিতে পরিষ্কার বলা আছে। টাইম ডাইলেশান বলে একটা ব্যাপার আছে”।
মিঠুন তখন আরো কিছুক্ষণ বকর বকর করে বৈজ্ঞানিক কথা বলল যার একটা শব্দও আমরা বুঝতে পারলাম না। শুধু টের পেলাম এই ছেলেটা আজব। তাকে বেশী ঘাটানো ঠিক না, ঘাটালেই সে বৈজ্ঞানিক কথা বলে আমাদের মাথা খারাপ করে দেবে। আমি তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ঠিক করেছ কোন ক্লাশ রুমে তুমি বসতে চাও?”
মিঠুন বলল, “তোমরা যেখানে বসবে আজকে আমি সেখানে বসতে চাই।”
ফারা বলল, “ভেরি গুড়।”
মিঠুন জানতে চাইল, “কেন? ভেরি গুড কেন?”
“আমাদের ক্লাশে একজনও চশমা পরা ছেলে মেয়ে নাই। এখন একজন হয়েছে।”
মিঠুন মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না, ভুরু কুঁচকে ফারার দিকে তাকাল। ফারা বলল, “ক্লাশে চশমা পরা ছেলেমেয়ে থাকলে ক্লাশের একটা ভাব হয়। সেইজন্যে।”
আমরা যখন হেঁটে হেঁটে মিঠুনকে আমাদের ক্লাশ রুমে নিয়ে যাচ্ছি তখন সে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোন ক্লাশে পড়?”
“এইট।”
“এইট?” শুনে মনে হল তার একটু মন খারাপ হল, সে ভাবছিল সে অন্য একটা ক্লাশে বসতে পারবে।
আমি বললাম, “মন খারাপ করো না। আমরা তোমাকে অন্য অন্য ক্লাশেও নিয়ে যাব।”
ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তুমি এর আগে কোন স্কুলে ছিলে?”
“অক্সব্রীজ। অক্সব্রীজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।”
আমরা চারজন এক সাথে চিৎকার করে বললাম, “অক্সব্রীজ?”
“হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না না, কিছু হয় নাই। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“তুমি অক্সব্রীজ থেকে মহব্বতজানে কেন এসেছ?”
“অক্সব্রীজ থেকে আমাকে টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছে।”
“টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছে? কেন?”
“সেইটা অনেক লম্বা স্টোরি।”
ঝুম্পা বলল, “বল তোমার স্টোরি। লম্বা স্টোরি ছোট করে বল।”
মিঠুন মাথা নাড়ল, “ছোট করে বললে তুমি বুঝবে না।”
“বুঝব। ঝুম্পা মুখ শক্ত করে বলল, “আমরা অনেক চালু। চোখের ঝিলিক দেখে আমরা মানুষের মুখের কথা বুঝে যাই।“ ঝুম্পা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, ঝুম্পার কথা সত্যি, চোখের ঝিলিক দেখে আমরা কথা বুঝে যাই।
মিঠুন বলল, “ঠিক আছে। তারপর কিছুক্ষণ উপর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর একজন একজন করে সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর আরেকটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার এক্সপরিমেন্টের জন্য যখন অক্সব্রীজ স্কুলের সায়েন্স বিল্ডিংটা উড়ে গেল—”
আমরা চিল্কার করে উঠলাম, “কী? কী বললে?”
বগা বলল, “তুমি সেই রহস্যময় ছেলে?”
ঝুম্পা বলল, “তুমি স্কুল বিল্ডিং উড়িয়ে দিয়েছ?”
ফারা বলল, “কেমন করে উড়িয়েছ?”
আমি বললাম, “আমাদেরটা উড়াবে? প্লীজ?”
আমরা চারজনই একসাথে চিৎকার করে কথা বলেছি তাই মিঠুন কারো কথাই শুনতে পেল না। সে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঝুম্পা আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমরা তোর পুরা লম্বা স্টোরি শুনতে চাই।”
ঝুম্পা খেয়ালও করল না সে মিঠুন নামের এই নতুন ছেলেটাকে হঠাৎ করে তুই বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমাদের সাথে যেহেতু থাকবে আগে হোক আর পরে হোক তুই করে বলতেই হবে, তাই আমরা এখনই শুরু করে দিলাম, বললাম, “হ্যাঁ, তোর পুরা স্টোরি শুনতে চাই। দাড়ি কমা সহ।”
মিঠুন মনে হয় একটু ভ্যাবেচেকা খেয়ে গেল, বলল, “পুর স্টোরি?”
“হ্যাঁ।”
বগ বলল, “তোকে দেখে বোঝাই যায় না তুই আসলে এরকম ডেঞ্জারাস। আমরা ভেবেছিলাম তুই বুঝি ভ্যাবলা টাইপের।”
ফারা বলল, “আমি মোটেও ভাবি নাই ভ্যাবলা টাইপের। যে ছেলে চশমা পরে সে ভ্যাবলা টাইপ হতেই পারে না। তুই অনেক বই পড়িস না?”
“পড়ি। সায়েন্সের বই। সায়েন্স আর ম্যাথমেটিক্স।”
ফারা বলল, “দেখেই বুঝেছিলাম তুই জ্ঞানী টাইপ। আমাদের স্কুলেই কোনো জ্ঞানী টাইপ ছাত্রছাত্রী নাই। তুই হবি প্রথম।”
“প্রথম?”
ঝুম্পা বলল, “এবং শেষ।”
মিঠুন ভ্যাবেচেকা খেয়ে সবার দিকে তাকাল। বলল, “শেষ?”
আমরা সবাই মাথা নাড়লাম।