মুনি বলে অবধান করহ রাজন।
বহুবিধ বিলাপিয়া অম্বিকা নন্দন।।
অনেক কান্দিয়া শোক ত্যজি নরপতি।
সঞ্জয়েরে জিজ্ঞাসিল করিয়া মিনতি।।
কহত সঞ্জয় তুমি বড় বিচক্ষণ।
কোন্ কর্ম্ম কৈল কুরু-পাণ্ডুর নন্দন।।
কিরূপে ভারতযুদ্ধ হৈল আরম্ভণ।
কার সনে কার যুদ্ধ কহ বিবরণ।।
সঞ্জয় বলিল, রাজা কর অবধান।
কৌরব পাণ্ডব দুই বীরের প্রধান।।
ভীষ্ম সম মহাবীর নাহি দুই দলে।
ভীষ্মে সেনাপতি কৈল কুরু-মহীপালে।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।
মনেতে করিয়া তবে গঙ্গার নন্দন।।
ধর্ম্মের সভায় দূত পাঠায় তখন।
ধর্ম্মেরে কহিবে এই আমার বচন।।
বিপক্ষ জানিয়া তুমি কর মহারণ।
উপরোধ জ্ঞান না করিবে কদাচন।।
ন্যায়যুদ্ধ করিবে অন্যায় না করিবে।
ভীতজনে কদাচিত অস্ত্র না মারিবে।।
বাক্যযুদ্ধে কদাচন অস্ত্র না ধরিবে।
ন্যায়যুদ্ধে অন্য জনে নাহিক ঘাতিবে।।
রথী রথী যুঝিবেক পদাতি পদাতি।
মল্লে মল্লে যুঝিবেক করি ধর্ম্মনীতি।।
আসোয়ারে আসোয়ারে করিবেক রণ।
গজে গজে যুঝিবেক পত্তি পত্তি জন।।
গদা গদা যুঝিবেক রাউতে রাউতে।
খড়্গে খড়্গে যুঝিবেক মাহুতে মাহুতে।।
পলায়িত জনে না করিবে অস্ত্রাঘাত।
যে জন বর্জ্জিত অস্ত্র না মারিবে তাত।।
শ্রমযুক্তে না মারিবে দূতে কদাচন।
অস্ত্রহীন জন সঙ্গে বর্জ্জিবেক রণ।।
না মারিবে যে জন বিমুখ-পলায়ন।
এক সঙ্গে যুঝি অন্যে না মারিবে বাণ।।
শক্তিহীন জনে অস্ত্র করিবে বর্জ্জিত।
শরণাগতে অস্ত্র না মারিবে কদাচিত।।
যে জন যোগায় অস্ত্র না মারিবে তারে।
কদাচিৎ অস্ত্র না মারিবে বাদ্যকর।।
এইরূপ কহি ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
চর পাঠাইয়া দিল ধর্ম্মের সদন।।
চর গিয়া যুধিষ্ঠির রাজারে কহিল।
শুনি ধর্ম্মপুত্র তবে স্বীকার করিল।।
এই মত স্বীকার করিয়া দুইদলে।
হরিষ-বিষাদ-মতি হইল সকলে।।
ধর্ম্ম-ন্যায়যুদ্ধ শুনি সাধু রাজগণ।
আনন্দে বিভোলচিত্ত হৈল সর্ব্বজন।।
এই মত সম্মত হইয়া দুই দলে।
সংগ্রামে প্রবৃত্ত হৈল বাদ্য-কোলাহলে।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পৃথিবী পূরিল।
দুই দলে কোলাহল অনেক হইল।।
একাদশ অক্ষৌহিণী-পতি দুর্য্যোধন।
সাত অক্ষৌহিণী-পতি ধর্ম্মের নন্দন।।
সবে মহাবীর্য্যবন্ত সবে মহাশূর।
দুইদলে সিংহনাদ কাঁপে তিনপুর।।
পূর্ব্ব ও পশ্চিম ভাগে রহে সৈন্যগণ।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ গঙ্গার নন্দন।।
ভেরী শঙ্খ দুন্দুভি অনেক বাদ্য বাজে।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল সর্ব্বরাজে।।
রথী মহারথীপতি করে সিংহনাদ।
দুইদলে বাদ্য বাজে জয় জয় বাদ।।
দুঃশাসনে আজ্ঞা তবে কৈল দুর্য্যোধন।
শীঘ্রগতি আন রথ করিয়া সাজন।।
বিচিত্র রথেতে শোভা পাইল কুরুনাথে।
সারি সারি শ্বেতছত্র আশ্চর্য্য দেখিতে।।
কনক সদৃশ দিব্য শোভা কলেবর।
কনক কিরীট মাথে দেখিতে সুন্দর।।
যুদ্ধস্থানে উপনীত হৈল কুরুনাথ।
একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের সহিত।।
নানাবাদ্য কোলাহল সাজে সৈন্যগণ।
বাদ্যের শবদে কম্প হৈল ত্রিভুবন।।
বিবিধ প্রকারে সাজে সব সৈন্যগণ।
নানাবিধ অলঙ্কার অঙ্গেতে শোভন।।
গজ বাজি রথ ধ্বজ পতাকা সুন্দর।
কাঞ্চন রচিত সব রথ মনোহর।।
বিবিধ পতাকা শোভে বিদ্যুৎ ঝলমল।
কনক-মণ্ডল কর্ণে কনক-কুণ্ডল।।
অঙ্গে অলঙ্কার সব সুন্দর সুবেশ।
সংগ্রামের স্থানে সবে করিল প্রবেশ।।
একাদশ অকৌহিণী সিংহের গর্জ্জন।
ভীষ্ম তাহে সেনাপতি বিক্রমে ভীষণ।।
দুর্য্যোধন নরপতি সাজাইল দলে।
চন্দ্রের উদয় যেন সমুদ্রের জলে।।
রচিল বিচিত্র ব্যূহ গঙ্গার কুমার।
চক্রাকার শবব্যূহ পরম সুন্দর।।
ব্যূহে নিয়োজিল মহা মহাযোদ্ধাগণ।
বাম শৃঙ্গেতে ব্রহ্মা কৈল নিয়োজন।।
অশ্বত্থামা ভূরিশ্রবা প্রতীপ-নন্দন।
দক্ষিণ শৃঙ্গের দিকে কৈল নিয়োজন।।
ব্যূহের অগ্রেতে হৈলা দ্রোণ মহাশয়।
মধ্যেতে রহিল ভীষ্ম সংগ্রামে দুর্জ্জয়।।
ব্যূহ-অভ্যন্তরেতে রহিল দুর্য্যোধন।
চতুর্দ্দিকে বেষ্টিত সকল রাজগণ।।
ডাক দিয়া বলে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
সাবধানে শুনহ যতেক বীরগণ।।
হিত উপদেশ কহি না হও বিমুখ।
সংগ্রামের মুখ্য ধর্ম্ম ক্ষত্রিয়ের সুখ।।
প্রাণ উপেক্ষিয়া সবে করিবে সংগ্রাম।
সংগ্রামে বিমুখ হৈলে নাহি যশ নাম।।
সম্মুখ সংগ্রামে যেই না হয় বিমুখ।
চিরকাল স্বর্গে রহে ব্রহ্মার সম্মুখ।।
অনিত্য সংসার নিত্য নহে কদাচন।
ক্ষত্রকুলে জন্মি ক্ষিতি করিবে শাসন।।
পরাণে কাতর নাহি হবে কদাচন।
ক্ষত্র হৈয়া সংগ্রামে পলায় যেই জন।।
শুনহ তাহার কথা যত বিবরণ।
অন্তকালে নরকেতে হয়ত গমন।।
ইহা জানি বিমুখ না হৈবে কদাচন।
প্রাণ আশা ছাড়ি সবে কর মহারণ।।
ভীষ্মের বচন শুনি যত রাজগণ।
সাধু সাধু বলি প্রশংসিল সর্ব্বজন।।
ক্ষত্রশিরোমণি ভীষ্ম সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞাতা।
যে কহিলা মহাশয় না হয় অন্যথা।।
এতেক বলিয়া সবে কৈল সিংহনাদ।
নানাবিধ বাদ্য বাজে জয় জয় বাদ।।
শঙ্খ দুন্দুভি বাজে পটহ মাদল।
অনেক মৃদঙ্গ বাজে বহুত কল্লোল।।
দুর্য্যোধনে কহে তবে গঙ্গার নন্দন।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা মোর শুনহ রাজন।।
যাবৎ থাকিব আমি রণে যোদ্ধাপতি।
কর্ণ অস্ত্র না লবে না হবে সেনাপতি।।
শুনি দুর্য্যোধন রাজা দিল অনুমতি।
সংগ্রামে সাজিল তবে ভীষ্ম যোদ্ধাপতি।।
আরবার কহে ভীষ্ম কৌরব-ঈশ্বরে।
দশদিন ভার মম হইল সমরে।।
নিজ সৈন্য রক্ষা করি অন্যেরে নাশিব।
রথী দশ সহস্রেক প্রত্যহ মারিব।।
অর্জ্জুন সহিত যুদ্ধে শ্রীহরি সাক্ষাৎ।
রথী দশ সহস্রেক করিব নিপাত।।
ব্যূহের অগ্রেতে গেলা করিয়া সাজন।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে পূরিল গগন।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।।