২য় অধ্যায়
ভীমার্জ্জুনের প্রচ্ছন্নভাব বিনির্ণয়
তখন ভীমসেন কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! আমি স্থির করিয়াছি যে, মহারাজ বিরাটের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া আমি পৌরগব [পাচকশালার অধ্যক্ষ-পাচকদিগের সর্দ্দার], আমার নাম বল্লব’, এই বলিয়া পরিচয় প্রদান করিব। হে রাজন! আমি পাকাকাৰ্য্যে সাতিশয় সুনিপুণ। বিরাট-রাজভবনে নানাবিধ সূপ প্রস্তুত করিব। পূর্ব্বে সুশিক্ষিত পাচকগণ রাজার নিমিত্ত যে সমুদয় উত্তমোত্তম ব্যঞ্জন প্রস্তুত করিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর ব্যঞ্জনসকল প্রস্তুত ও অপরিমিত কাষ্ঠভার আহরণ করিয়া মহারাজের প্রীতিসম্পাদন করিব। তদর্শনে তিনি পরম পরিতুষ্ট হইয়া অবশ্যই আমাকে নিযুক্ত করিবেন সন্দেহ নাই। হে ধর্ম্মরাজ! আমি তথায় এরূপ অলৌকিক কাৰ্য্য করিব যে, বিরাটরাজের অন্যান্য কিঙ্করগণ আমাকে রাজার ন্যায় সম্মান করিবে। আমি সকলের অন্ন-পান-প্রদানের কর্তী হইব। মহাবলিষ্ঠ হস্তী বা বৃষভগণকে নিগ্ৰহ করিতে হইলে অনায়াসে তাহা সম্পাদন করিব। সমাজে যাহারা আমার সহিত বাহুযুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইবে, আমি রাজার প্রীতিবর্দ্ধনের নিমিত্ত তাহাদিগকে প্ৰহার করিয়া ধরাতলে পতিত করিব; কিন্তু সংহার করিব না। লোকে জিজ্ঞাসা করিলে, “আমি ইতিপূর্ব্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অন্নসংস্কারক, পশুনিগৃহীতা, সূপকর্ত্তা ও মল্লযোদ্ধা ছিলাম” বলিয়া আত্মপরিচয় প্ৰদান করিব এবং সতত স্বয়ং আত্মরক্ষায় যত্নবান হইব। হে মহারাজ! আমি এইরূপে অজ্ঞাতবাস করিতে সঙ্কল্প করিয়াছি।”
তৎপরে যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, “অগ্নি খাণ্ডবকানন দগ্ধ করিবার মানসে ব্রাহ্মণবেশ ধারণপূর্ব্বক স্বয়ং যাঁহার সমীপে আগমন করিয়াছিলেন, যিনি কৃষ্ণসমভিব্যাহারে এক রথে আরোহণপূর্ব্বক পন্নগ ও রাক্ষসগণকে পরাজয় করিয়া খাণ্ডবারণ্য দাহনপূর্ব্বক হুতাশনকে পরিতৃপ্ত করিয়াছিলেন, যিনি সর্পরাজ বাসুকির ভগিনীকে হরণ করিয়াছিলেন, সেই সর্ব্বধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য অর্জ্জুন কিরূপে অজ্ঞাতবাস করিবেন? যেমন প্রতাপশালীদিগের মধ্যে সূৰ্য্য, দ্বিপদের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, সর্পের মধ্যে আশীবিষ, তেজস্বীদিগের মধ্যে অগ্নি, আয়ুধের মধ্যে বজ্র, গোসমূহের মধ্যে কুকুদ্মান [কাকুৎযুক্ত ষণ্ড—ঝুঁটিওয়ালা ষাঁড়], হ্রদের মধ্যে পর্জ্জন্য, নাগের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র, হস্তীর মধ্যে ঐরাবত, প্রিয়তমের মধ্যে পুত্র ও সুহৃদের মধ্যে ভাৰ্য্যা, তদ্রুপ ধনঞ্জয় সমুদয় ধনুৰ্দ্ধরগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই গাণ্ডীবধন্বা অর্জ্জুন ইন্দ্র ও নারায়ণের তুল্য প্রভাব-সম্পন্ন। ইনিই পঞ্চ বর্ষ ইন্দ্রভবনে বাস করিয়া স্বীয় বীৰ্য্যপ্রভাবে অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত ও দিব্যাস্ত্ৰ সমুদয় প্ৰাপ্ত হইয়াছেন। ইঁহাকে দ্বাদশ রুদ্র, ত্ৰয়োদশ আদিত্য, নবম বসু ও দশম গ্ৰহ বলিয়া জ্ঞান করা যায়। ইঁহার বাহুদ্বয় সম, দীর্ঘ ও জ্যাঘাতকঠিন [ছিলার ঘর্ষণে শক্ত]। ইনি উভয় হস্তেই সমানরূপে বাণ নিক্ষেপ করিতে পারেন। যেমন হিমালয় সমুদয় পর্ব্বত অপেক্ষা, সমুদ্র নদীগণ অপেক্ষা, ইন্দ্র দেবগণ অপেক্ষা, অগ্নি বসুগণ অপেক্ষা, শার্দ্দুল মৃগগণ অপেক্ষা ও গরুড় অন্যান্য পক্ষিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তদ্রূপ এই ধনঞ্জয় সমুদয় বীরগণ অপেক্ষা প্রধান। ইনি কিরূপে অজ্ঞাতবাস করিবেন?”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! আমি বিরাটভবনে গমন করিয়া ‘আমি ক্লীব’ বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিব। আমার ভুজন্দ্বয়সংলগ্ন জ্যাঘাতচিহ্ন গোপন করা দুষ্কর। আমি বলয় দ্বারা উহা আচ্ছাদিত করিব। কৰ্ণে কুণ্ডল, করে শঙ্খ ও মস্তকে বেণী ধারণপূর্ব্বক আমার নাম ‘বৃহন্নলা’ বলিয়া আত্মপরিচয় প্রদান করিব। পুনঃ পুনঃ স্ত্রীজনসূলভ আখ্যায়িকা পাঠ করিয়া রাজা ও তাঁহার অন্তঃপুরবাসিনী রমণীগণের মনোরঞ্জন করিব। বিরাটরাজের পুরস্ত্রীগণকে বিবিধ গীত, নৃত্য ও বাদ্য শিক্ষা করাইব। সতত লোকের আচার-ব্যবহার কীর্ত্তন করিয়া মায়াপূর্ব্বক আত্মগোপন করিব। রাজা পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে বলিব যে, আমি ইতিপূর্ব্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের ভবনে দ্ৰৌপদীর পরিচর্য্যা করিতাম। হে ধর্ম্মরাজ! আমি এইরূপে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির ন্যায় আত্মগোপনপূর্ব্বক বিরাটরাজভবনে সুখে বিহার করিব।”
পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন এই বলিয়া তুষ্ণীম্ভুত হইলেন। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির অন্য ভ্রাতাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন।