প্রকৃতিতে আমরা সর্বত্রই প্রেমের বিকাশ দেখিতে পাই। সমাজের মধ্যে যাহা কিছু সুন্দর ও মহৎ—সবই প্রেমপ্রসূত; আবার কুৎসিত এবং পৈশাচিক ব্যাপারগুলিও সেই একই প্রেমশক্তির বিকার মাত্র। যে চিত্তবৃত্তি হইতে পতিপত্নীর বিশুদ্ধ দাম্পত্যপ্রেম উদ্ভূত, অতি নীচ কামবৃত্তিও সেই খনি হইতে সঞ্জাত। ভাব সেই একই, তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উহার প্রকাশ বিভিন্ন। এই একই প্রেম কাহাকেও ভাল কাজে প্রেরণা দেয় এবং সে দরিদ্রকে সর্বস্ব অর্পণ করে আবার কেহ বা ইহারই প্রভাবে নিজ ভ্রাতার গলা কাটিয়া তাহার যথাসর্বস্ব অপহরণ করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি নিজেকে যেমন ভালবাসে, প্রথম ব্যক্তি অপরকে সেইরূপ ভালবাসে। দ্বিতীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রেম ভ্রান্ত পথে চালিত; কিন্তু প্রথম ক্ষেত্রে উহা ঠিক পথে প্রযুক্ত। যে-অগ্নিতে আমাদের খাদ্য প্রস্তুত হয়, তাহাই আবার একটি শিশুকে দগ্ধ করিতে পারে। ইহাতে অগ্নির কিছু দোষ নাই, ব্যবহারে ও ফলে তারতম্য হয়। অতএব যে-প্রেমকে দুই ব্যক্তির প্রবল আসঙ্গস্পৃহা বলা যায়, তাহাই আবার অবশেষে উচ্চনীচ সর্বপ্রাণীর সেই এক স্বরূপে বিলীন হইবার ইচ্ছারূপে সর্বত্র প্রকাশিত।
ভক্তিযোগ প্রেমের এই উচ্চতম বিকাশের বিজ্ঞানস্বরূপ। উহা আমাদিগকে নিয়ন্ত্রিত করিবার, প্রেমকে যথার্থ পথে পরিচালনা করিবার, উহাকে একটি নূতন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিবার এবং উহা হইতে শ্রেষ্ঠ ফল—আধ্যাত্মিক শান্তি ও আনন্দ লাভ করিবার উপায় প্রদর্শন করে। ভক্তিযোগ বলে না—ত্যাগ কর বা ছাড়িয়া দাও; শুধু বলে—ভালবাসো, সেই উচ্চতম আদর্শকে ভালবাসো। যাহার প্রেমের আস্পদ ঐরূপ, সর্বপ্রকার নীচভাব স্বভাবতই তাহার মন হইতে অন্তর্হিত হইবে।
‘তোমার সম্বন্ধে আমি আর কিছু বলিতে পারি না, শুধু বলিতে পারিঃ তুমি আমার প্রেমাস্পদ। তুমি সুন্দর, আহা! অতি সুন্দর, তুমি স্বয়ং সৌন্দর্যস্বরূপ!’—হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে ভক্তেরা চিরকাল এইরূপ বলেন। ভক্তিযোগে আমাদের শুধু এইটুকু করিতে হইবে—সুন্দরের প্রতি আমাদের যে স্বাভাবিক আকর্ষণ, তাহা ভগবানের দিকে চালিত করিতে হইবে। প্রাণের সহিত ভালবাস। মানুষের মুখে, আকাশে, তারায় অথবা চন্দ্রে যে সৌন্দর্যের বিকাশ দেখা যায়, তাহা কোথা হইতে আসিল? উহা সেই ভগবানের সর্বব্যাপী সৌন্দর্যের আংশিক প্রকাশ মাত্র। শ্রুতিতে বলা হইয়াছে, ‘তাঁহারই প্রকাশে সকলের প্রকাশ।’১ ভক্তির এই উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান হও। উহা একেবারে তোমাদের ক্ষুদ্র আমিত্ব ভুলাইয়া দিবে। জগতের ক্ষুদ্র স্বার্থপর আসক্তিসমূহ ত্যাগ কর। কেবল মানুষকেই তোমার সাধারণ বা তদপেক্ষা উচ্চতর কার্যপ্রবৃত্তির একমাত্র লক্ষ্য মনে করিও না। সাক্ষিরূপে অবস্থিত হইয়া প্রকৃতির সমুদয় ব্যাপার পর্যবেক্ষণ কর। মানুষের প্রতি আসক্তিশূন্য হও। দেখ, জগতে এই প্রবল প্রেমের ভাব কিরূপে কার্য করিতেছে। কখনও কখনও হয়তো একটা ধাক্কা আসিল; উহাও সেই পরমপ্রেমলাভের চেষ্টার আনুষঙ্গিক ব্যাপার মাত্র। হয়তো কোথাও একটু দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ ঘটিল, হয়তো কাহারও পদস্খলন হইল—এ-সবই সেই প্রকৃত উচ্চতর প্রেমে আরোহণ করিবার সোপানমাত্র। সাক্ষিস্বরূপ একটু দূরে দাঁড়াইয়া দেখ, কিভাবে এই দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ মানুষকে প্রকৃত প্রেমের পথে আগাইয়া দেয়। যখন কেহ এই সংসার-প্রবাহের মধ্যে থাকে, তখন সে ঐ সংঘর্ষগুলি অনুভব করে। কিন্তু যখনই উহার বাহিরে আসিয়া কেবল সাক্ষিরূপে পর্যবেক্ষণ করিবে, তখন দেখিবে—অনন্ত প্রণালীর মধ্য দিয়া ভগবান্ নিজেকে প্রেমরূপে প্রকাশিত করিতেছেন।
‘যেখানেই একটু আনন্দ দেখিতে পাওয়া যায়, সেখানে সেই অনন্ত আনন্দস্বরূপ স্বয়ং ভগবানের অংশ রহিয়াছে, বুঝিতে হইবে।’২ অতি নিম্নভাবের আসক্তিতেও ভগবৎপ্রেমের বীজ অন্তর্নিহিত আছে। সংস্কৃত ভাষায় ভগবানের একটি নাম ‘হরি’। ইহার অর্থ এই—তিনি সকলকেই নিজের কাছে আ-হরণ করিতেছেন বা আকর্ষণ করিতেছেন। বাস্তবিক তিনিই আমাদের ভালবাসার একমাত্র উপযুক্ত পাত্র। এই যে আমরা নানাদিকে আকৃষ্ট হইতেছি, কিন্তু আমাদিগকে টানিতেছে কে? তিনিই আমাদিগকে তাহার দিকে ক্রমাগত টানিতেছেন। প্রাণহীন জড়—সে কি কখনও চৈতন্যবান্ আত্মাকে টানিতে পারে? কখনই পারে না, কখনও পারিবেও না। একখানি সুন্দর মুখ দেখিয়া একজন উন্মত্ত হইল। গোটাকতক জড় পরমাণু কি তাহাকে পাগল করিল? কখনই নয়। ঐ জড়-পরমাণুসমূহের অন্তরালে নিশ্চয়ই ঐশ্বরিক শক্তি ও ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা বিদ্যমান। অজ্ঞ লোকে উহা জানে না, তথাপি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সে উহা দ্বারাই—কেবল উহা দ্বারাই আকৃষ্ট হইতেছে। সুতরাং দেখা গেল, অতি নিম্নতম আসক্তিও ঈশ্বর হইতে শক্তি সংগ্রহ করে।—‘হে প্রিয়তমে, পতির জন্য কেহ পতিকে ভালবাসে না, আত্মার জন্যই পত্নী পতিকে ভালবাসে।’ প্রেমিকা পত্নীগণ ইহা জানিতে পারে, না জানিতেও পারে, তথাপি তত্ত্বটি সত্য। ‘হে প্রিয়তমে, পত্নীর জন্য পত্নীকে কেহ ভালবাসে না, আত্মার জন্যই পত্নী প্রিয়া হয়।’৩
এইরূপ কেহই নিজের সন্তানকে অথবা আর কাহাকেও তাহাদেরই জন্য ভালবাসে না, আত্মার জন্যই ভালবাসিয়া থাকে। ভগবান্ যেন একটি বৃহৎ চুম্বক-প্রস্তর, আমরা যেন লৌহচূর্ণের ন্যায়। আমরা সকলেই সদাসর্বদা তাঁহার দ্বারা আকৃষ্ট হইতেছি। আমরা সকলেই তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করিতেছি। জগতে এই যে নানাবিধ চেষ্টা—এই-সকলের একমাত্র লক্ষ্য কেবল স্বার্থ হইতে পারে না। অজ্ঞ ব্যক্তিগণ জানে না, তাহারা কি করিতেছে। বাস্তবিক তাহারা জীবনের সকল চেষ্টার মধ্য দিয়া ক্রমাগত সেই পরমাত্মা-রূপ বৃহৎ চুম্বকের নিকটবর্তী হইতেছে। আমাদের এই কঠোর জীবন-সংগ্রামের লক্ষ্য—তাঁহার নিকট যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত তাঁহার সহিত একীভূত হওয়া।
ভক্তিযোগীই এই জীবন-সংগ্রামের অর্থ জানেন ও উহার উদ্দেশ্য বুঝেন, তিনি এই সংগ্রাম অতিক্রম করিয়া আসিয়াছেন; সুতরাং তিনি জানেন, উহার লক্ষ্য কি, এই জন্য তিনি সর্বান্তঃকরণে এগুলি হইতে মুক্তি পাইতে ইচ্ছা করেন। এ-সকল এড়াইয়া তিনি সকল আকর্ষণের মূলকারণ হরির নিকট একেবারে যাইতে চান। ইহাই ভক্তের ত্যাগ—ভগবানের প্রতি এই প্রবল আকর্ষণ তাঁহার আর সকল আসক্তিকে নাশ করিয়া দেয়। এই অনন্ত প্রেম তাঁহার হৃদয়ে প্রবেশ করে, অন্যান্য আসক্তির সেখানে স্থান হয় না। ইহা ছাড়া আর কি হইতে পারে? ঈশ্বর-রূপ প্রেমসমুদ্রের জলে ভক্তি তখন ভক্তের হৃদয় পরিপূর্ণ করিয়া দেয়। সেখানে ছোটখাটো ভালবাসার স্থান আর নেই। ইহাই ভক্তের ত্যাগ বা বৈরাগ্য। তাৎপর্য এইঃ ভগবান্ ভিন্ন সমুদয় বিষয়ে ভক্তের যে বৈরাগ্য, তাহা ভগবানের প্রতি পরম অনুরাগ হইতে উৎপন্ন।
পরাভক্তি-লাভের জন্য এইভাবে প্রস্তুত হওয়াই আবশ্যক। এই বৈরাগ্য-লাভ হইলে পরাভক্তির উচ্চতম শিখরে উঠিবার দ্বার যেন খুলিয়া যায়। তখনই আমরা বুঝিতে আরম্ভ করি, পরাভক্তি কি। আর যিনি পরাভক্তির রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, একমাত্র তাঁহারই বলিবার অধিকার আছে, ধর্মানুভূতির জন্য তাঁহার পক্ষে প্রতিমাপূজা বা অনুষ্ঠানাদি নিষ্প্রয়োজন। তিনিই কেবল সেই পরম প্রেমাবস্থা লাভ করিয়াছেন, যেখানে সকল মানবের ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা সম্ভব; অপরে কেবল ইহা লইয়া বৃথা বাক্যব্যয় করে। তিনি তখন আর কোন ভেদ দেখিতে পান না; মহান্ প্রেমসমুদ্র তাঁহার অন্তরে প্রবেশ করিয়াছে; তখন তিনি আমাদের মত মানুষ পশু তরু লতা সূর্য চন্দ্র তারা দেখেন না, তিনি সর্বত্র সব কিছুর মধ্যে তাঁহার প্রিয়তমকে দেখিতে পান। যাহার মুখের দিকে তিনি তাকান, তাহারই ভিতর তিনি হরির প্রকাশ দেখিতে পান। সূর্য বা চন্দ্রের আলোক তাঁহারই প্রকাশমাত্র। যেখানেই তিনি কোন সৌন্দর্য বা মহত্ত্ব দেখিতে পান, সেখানেই তিনি অনুভব করেন—সবই সেই ভগবানের। এরূপ ভক্ত জগতে এখনও আছেন, জগৎ কখনই এরূপ ভক্ত-বিরহিত হয় না। এরূপ ভক্ত সর্পদষ্ট হইলে বলে—আমার প্রিয়তমের নিকট হইতে দূত আসিয়াছিল। এইরূপ ব্যক্তিরই কেবল বিশ্বজনীন ভ্রাতৃভাব সম্বন্ধে কিছু বলিবার অধিকার আছে। তাঁহার হৃদয়ে কখনও ক্রোধ বা ক্ষোভের সঞ্চার হয় না। বাহ্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ তাঁহার নিকট হইতে চিরকালের জন্য অন্তর্হিত। যখন প্রেমবলে অতীন্দ্রিয় সত্যকে তিনি সর্বদা দেখিতে পান, তখন কি করিয়া তিনি ক্রুদ্ধ হইবেন?