বড় দরজাটা দিয়ে ঢোকার পর দেখা গেল, দুপাশে বিশাল উঁচু দেওয়াল, তার মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি। পাহাড়টা কেটে-কেটে দুর্গ বানানো হয়েছে, কিন্তু দূর থেকে শুধু পাহাড় বলেই মনে হয়।
পাহাড়ের ওপরটা পর্যন্ত ঘুরে আসতে কতক্ষণ লাগবে? বড়জোর এক ঘন্টা।
জোজো বলল, চল সন্তু, যাবি?
সন্তু কাকাবাবুর দিকে তাকাল।
কাকাবাবু বললেন, সিঁড়ি আর পাহাড়, এই দুটোই আমাকে বড় জব্দ করে দেয়। আমি যাব না, তোরা ঘুরে আয় ওপর থেকে।
রঞ্জন বলল, আমারও পাহাড়ে চাপার শখ নেই, আমিও ওপরে যাব না। ততক্ষণ গাছের ছায়ায় একটু ঘুমিয়ে নেব।
রিঙ্কু বলল, তোমরা কিন্তু এক ঘন্টার মধ্যে ঠিক ফিরে আসবে। ঠিক তিনটের সময় আমরা স্টা…স্টা….স্টা…ইয়ে, যাত্রা শুরু করব।
আরও একটু ওপরে ওঠার পর একটা জায়গায় বড়বড় কয়েকটা গাছের তলায় চমৎকার সবুজ ঘাস। রঞ্জন সেখানে শুয়ে পড়েই চোখ বুজল।
রিঙ্কু বলল, মোহন সিং-এর গাড়িটা নীচে দেখা যাচ্ছে। ওরা এখনও যায়নি।
কাকাবাবু বললেন, ওরা ওপরের মন্দিরে পুজো দিতে গেছে। ওদের একজনের হাতে শালপাতায় মোড়া ফুলটুল দেখেছিলুম।
রিঙ্কু বলল, তা হলে তো সন্তুদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ওই বিচ্ছিরি লোকটা যদি ওদের সঙ্গে গণ্ডগোল করে?
কাকাবাবু বললেন, সেজন্য চিন্তা নেই। সন্তু ওরকম লোক অনেক দেখেছে।
রঞ্জন চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল, ওই সন্তু বিচ্ছুটা চলে গেছে? তা হলে এখন একটু প্রাণ খুলে ইংরেজি বলা যাক। হা, কী ইংরেজি বলব? কিছু মনে পড়ছে না যে?
রিঙ্কু বলল, সত্যি, আমাদের এমন অভ্যেস হয়ে গেছে যে, ইংরেজি শব্দ বাদ দিয়ে কথাই বলতে পারি না। অন্য সময় খেয়ালই থাকে না।
রঞ্জন বলল, এখন তো তুমি দিব্যি বাংলা বলছ, রিঙ্কু। একটু আগে স্টার্ট বলে ফেলতে গিয়ে স্টাস্টাস্টা বলে এমন তোতলাতে শুরু করলে! তোমার অনেক ফাইন হয়ে গেছে এরই মধ্যে। রিঙ্কু বলল, তোমারও কম হয়নি। কাকাবাবু বললেন, সন্তু কিন্তু এ পর্যন্ত একটাও ইংরেজি বলেনি। রঞ্জন বলল, ফাইন দেবার ভয়ে সন্তু তো কথাই বলছে না প্রায়। আজ রাত্তিরে যেখানে থাকব সেখানে বসে হিসেবটিসেব কষে, প্রত্যেকের ফাইন চুকিয়ে দিয়ে এ-খেলাটা শেষ করে দিতে হবে।
রিঙ্কু বলল, আমরা আজ রাত্তিরে কোথায় থাকব? তুঙ্গভদ্রা ড্যামের গেস্ট হাউসে?
রঞ্জন বলল, গিয়ে দেখা যাক। সেখানে জায়গা না পাওয়া গেলে কোনও হোটেল-টোটেল খুঁজতে হবে। এই রে, হোটেল কথাটা আবার সন্তুর কাছে উচ্চারণ করা যাবে তো? হোটেলের বাংলা কী, সরাইখানা?
কাকাবাবু বললেন, হোটেল আর ট্যাক্সি, এই কথা দুটো এখন সারা পৃথিবীতে চলে। এর আর বাংলা করার দরকার নেই।
রিঙ্কু বলল, এই জায়গাটা কী শান্ত আর নির্জন লাগছে। এক সময় এখানে কত সৈন্য-সামন্ত যাতায়াত করত, এখানে কত যুদ্ধ হয়েছে, এখন কিছু বোঝাই যায় না।
রঞ্জন বলল, রি, তুমি যেখানে বসে আছ, ওইখানেই যুবরাজ বিক্রম মাণিক্য, ইয়ে, খুন হয়েছিল। হ্যাঁ, চারজন বিদ্রোহী তার দেহটাকে টুকরো-টুকরো করে ফেলে, তার মুণ্ডুটা এখানে পড়েছিল অনেকদিন?
রিঙ্কু একটু চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, কাকাবাবু, রঞ্জন কিন্তু যখন-তখন এই রকম ইতিহাস বানায়। ওর কথা বিশ্বাস করবেন না।
রঞ্জন বলল, এই, আমি ক্লাস নাইন, মানে নবম শ্রেণীতে ইতিহাস পরীক্ষায় ফাস্ট, মানে প্রথম হয়েছিলুম না?
কাকাবাবু বললেন, এইসব দুর্গে ওরকম খুনোখুনি হওয়া অসম্ভব কিছু তো নয়। আমরা যেখানে যাচ্ছি…।
কাকাবাবুর কথা শেষ হবার আগেই পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে দুবার দুমদুম শব্দ হল। ঠিক যেন বোমা ফাটার আওয়াজ। অনেকগুলো কাক একসঙ্গে ডেকে উঠে ছড়িয়ে গেল আকাশে।
রিঙ্কু সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী হল? সন্তু আর জোজো গেছে ওদিকে। রঞ্জন, চলো আমরা গিয়ে দেখি!
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আওয়াজটা বেশি দূরে হয়নি। সন্তু আর জোজোর এর মধ্যে আরও উঠে যাবার কথা।
রঞ্জন বলল, খুব সম্ভবত ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটাচ্ছে। নতুন রাস্তা-টাস্তা বানাবে।
রিঙ্কু বলল, আমি দেখে আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে সে ছুট লাগাল। রঞ্জন কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভাবছেন তো যে, আমার বউ একা-একা গেল, আমারও ওর সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিল? রিঙ্কুকে আপনি ভাল করে চেনেন না। ও একাই তিনশো!
পাহাড়ের সিঁড়িটা এঁকেবেঁকে উঠেছে, একটু দূরেই একটা বাঁক নিয়েছে বলে ওপরের দিকটা দেখা যায় না। রিঙ্কুও তরতর করে ছুটতে ছুটতে সেদিকে মিলিয়ে গেল।
কাকাবাবু পেছন ফিরে বললেন, মোহন সিংগাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা এর মধ্যেই নেমে এসেছে।
রঞ্জন বলল, গাড়িতে একটা বায়নোকুলার আছে, সেটা নিয়ে আসা উচিত ছিল। মোহন সিংরা নামল কোন্ দিক দিয়ে? দেখতে পেলাম না তো।
কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই আর একটা রাস্তা আছে অন্যদিক দিয়ে।
একটু পরেই দেখা গেল রিঙ্কু আর সন্তু-জোজো একসঙ্গে নেমে আসছে। সন্তুর হাতে একটা পাতাওয়ালা গাছের ডাল, তার ডগায় কয়েকটা হলুদ রঙের ফুল। ওরা গল্প করতে করতে নামছে আস্তে-আস্তে।
সেদিকে তাকিয়েই রঞ্জন বলল, কাকাবাবু, শিগগির নেমে চলুন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওদের জন্য অপেক্ষা করবে না?
রঞ্জন বলল, ওদের দেখেই তো বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ওরা কোনও বিপদে পড়েনি। এবার ওরা একটু আমাদের খোঁজাখুঁজি করুক!
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি নামতে লাগলেন। রঞ্জন দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলল, তারপর কাকাবাবু এসে পৌঁছতেই তাঁকে তুলে নিয়ে স্টার্ট দিল।
বাজারের কাছে পেট্রোল-পাম্প। সেখানে মোহন সিংদের গাড়িটাও থেমে আছে। সামনের সিটে জানলার ধারে বসে আছে মোহন সিং, রঞ্জনকে দেখে সে ঘুরিয়ে নিল মুখখানা।
রঞ্জনই গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেয়া সিংজি, আপলোগও কি হামপি যাতা হ্যায়?
মোহন সিং রঞ্জনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল, কোনও কথা বলল না।
রঞ্জন আবার বলল, আরে আপ রাগ করতা হ্যায় কাঁহে? আমি তো ইচ্ছে করে আপনাকে ফেলে দিইনি, ব্যালান্স সামলাতে পারিনি। আপনি কী কাজ দেবার কথা বলছিলেন, আমাকে দিন না।
পেছন থেকে মোহন সিং-এর এক সঙ্গী রঞ্জনের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, আপনা কাম করো। ইধার ঝঞ্ঝাট মাত করো।
তারপর সে রঞ্জনকে আস্তে করে ঠেলে দেবার একটা ভাব দেখাল। লোকটার গায়ে অসম্ভব জোর, সেইটুকু ঠেলার চোটেই রঞ্জন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, গাড়িটাকে ধরে সামলে নিল। লোকটি হেসে উঠে বলল, মোহন সিংজির সঙ্গে এবার থেকে সমঝে কথা বলবে।
রঞ্জন একটুও রাগ না করে বলল, উঃ, আপনার তো খুব গায়ের জোর! রোজ ব্যায়াম করেন বুঝি? আপনার নাম কী?
লোকটি বলল, বিরজু সিং। রঞ্জন বলল, আপনারা দুজনেই সিং। বাঃ বাঃ! তা হলে হামপিতে আবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে?
মোহন সিং পিচ করে মাটিতে থুতু ফেলল। তাই দেখাদেখি বিরজু আরও থুতু ফেলে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, হুঁ।
ওদের গাড়িতে তেল ভরা হয়ে গিয়েছিল, ওরা, বেরিয়ে গেল আগে। রঞ্জন। নিজের গাড়ির চাবি পাম্পের লোকের হাতে দিয়ে কাকাবাবুর কাছে এসে বলল, হামপিতে গিয়ে বেশ মজা হবে মনে হচ্ছে। ঠিক যেন একটা গল্পের মতন শুরু।
কাকাবাবু বললেন, এবার শুধু বেড়াতে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও গল্প-টল্পর দরকার নেই। জলের বোতলটা ভরে নাও।
পেট্রোল নিয়ে বেরিয়ে রঞ্জন কিছু কলা আর পেয়ারাও কিনে ফেলল। তখনই দেখা গেল রিঙ্কুরা জোরে হেঁটে আসছে এদিকে। গাড়িটা নজরে পড়তেই ওরা থেমে গিয়ে কী যেন বলাবলি করতে লাগল।
রঞ্জন বলল, আমাদের দেখতে না পেয়ে ওরা অনেক দৌড়োদৌড়ি করেছে, কিন্তু সেকথা স্বীকার করবে না, বুঝলেন তো! আসলে কিন্তু বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, রিঙ্কুর বুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। সে তো এত সহজে ঘাবড়াবার মেয়ে নয়।
রিঙ্কুরা কাছে এসে গাড়িতে উঠে পড়ে বলল, আমরা এক ঘন্টার বেশি সময় নিইনি। এবার চলো।
রঞ্জন বলল, তোমরা আমাদের খুঁজতে কোথায়-কোথায় গিয়েছিলে?
রিঙ্কু খুব অবাক হয়ে বলল, খুঁজব কেন? তোমরা গাড়ির তেল নেবে, এ তো জানা কথাই! আমরা ভাল মিষ্টি কিনে আনলুম এই ফাঁকে। নিজেরা কয়েকটা খেয়েও এসেছি।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, পাহাড়ের ওপর আওয়াজটা হয়েছিল কিসের?
রিঙ্কু পালটা প্রশ্ন করল, বলো তো কিসের? আন্দাজ করো!
রঞ্জন বলল, আমি তো কাকাবাবুকে আগেই বলে রেখেছি। ডিনা.. এই সন্তু, আমি কিন্তু ডিনামাইটের বাংলা বলতে পারব না। ডিনামাইট দিয়ে পাথর ফাটাচ্ছিল।
রিঙ্কু বলল, মোটেই না।
রঞ্জন বলল, তবে কি কেউ সত্যিকারের বোমা ছুঁড়েছিল? সন্তু, বোমা কথাটা কিন্তু বাংলা! আমি তো বম্ব বলিনি!
রিঙ্কু বলল, না, এবারও হল না। ওখানে একটা চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ হচ্ছিল।
কী হচ্ছিল? চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণ! তার মানে? সিনেমার শুটিং!
সন্তু আর জোজো দুজনেই হাততালি দিয়ে উঠল। রিঙ্কু হাসতে হাসতে বলল, আমরা ঠিক জানতুম, রঞ্জন ইংরেজি করে বলবেই।
রঞ্জন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আসল ব্যাপারটা কী হয়েছে, তাই বলে না!
সন্তু বলল, ওখানে একটা চলচ্চিত্র তোলা হচ্ছে। দুদলের ডাকাতের মারামারির দৃশ্যে বন্দুকের গুলির শব্দ হল। ওখানে প্রচুর লোকের ভিড়।
জোজো বলল, ওখানে মোহন সিংকেও দেখলুম। সে ডাকাতের সদার হয়েছে। আমি যে ওকে চম্বলের ডাকাত বলেছিলুম, সেটা খুব ভুল ছিল না!
রিঙ্কু বলল, আমি আগেই ওকে চলচ্চিত্রের খলনায়ক বলেছিলুম।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু মোহন সিংকে যে একটু আগে এখানে দেখা গেল? এর মধ্যেই সে নেমে এল কী করে?
সন্তু বলল, আর একটা লোককে মোহন সিং-এর মতন সাজিয়েছে। তারও প্রায় ওইরকম চেহারা। আসল মারামারির দৃশ্যগুলো ওই নকল মোহন সিং করবে।
জোজো বলল, ওদের বলে স্টান.. স্টান… থাকগে, ওর বাংলা করা যাবে না।
গাড়িটা আবার ছুটতে লাগল বড় রাস্তা দিয়ে। রঞ্জন বলল, এখন কিন্তু কেউ ঘুমোবে না, তা হলে আমারও ঘুম পেয়ে যাবে।
সে এক টিপ নস্যি নিল নাকে।
রিঙ্কু ম্যাপটা বিছিয়ে বলল, রঞ্জন, হামপির আগে হস্পট বলে একটা জায়গা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে এটা একটা বড় জায়গা।
কাকাবাবু বললেন, ওই হসপেটেই আমাদের থাকতে হবে। হামপিতে কোনও থাকার জায়গা নেই।
সন্তু বলল, আমরা যে তুঙ্গভদ্রা নদীর ধারে অতিথিশালায় থাকব ঠিক ছিল? তুঙ্গভদ্রা নামটা কী সুন্দর।
কাকাবাবু বললেন, ওখানে বড় জোর রাতটা থাকা যাবে। ওখান থেকে হামপি বেশ দূর হবে, যাওয়া-আসা করা যাবে না।
জোজো হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আমরা যে হামপি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে কী আছে?
সন্তু বলল, হামপিতে হামপি আছে। জোজো বলল, ও!
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তুই যে গম্ভীরভাবে ও বললি, হামপি মানে তুই কী বুঝলি রে, জোজো? পাহাড়, জঙ্গল, না সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ?
জোজো বলল, আমি একবার আমার ছোটমামার সঙ্গে কোকোডিমা বলে একটা দ্বীপে গেসলুম। সেই দ্বীপটা কোথায় তোমরা বলতে পারো?
জোজোর কথা ঘোরাবার ক্ষমতা দেখে কাকাবাবু পর্যন্ত একটু হেসে উঠলেন।
গল্প করতে করতে অনেকটা রাস্তা চলে আসা গেল। বিকেল হয়ে এল আস্তে। এখনও গরম কমবার নাম নেই! শ্চিমের আকাশটা লাল হয়ে উঠেছে।
একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে রঞ্জন গাড়িটা থামাল। এরপর কোনদিকে যেতে হবে, রিঙ্কু ঠিক বুঝতে পারছে না ম্যাপ দেখে।
রঞ্জন বলল, নেমে তা হলে জিজ্ঞেস করা যাক। কয়েকটা চায়ের দোকানও রয়েছে। ইচ্ছে করলে এখানে চা খাওয়া যেতে পারে।
সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পাশাপাশি তিনটে চায়ের দোকান। লম্বা-লম্বা বেঞ্চ আর খাটিয়া পাতা আছে বাইরে। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি লরি আর একটি সাদা রঙের গাড়ি।
একটি খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছেন একজন বৃদ্ধ, তাঁর মাথার চুল, মুখের দাড়ি সব ধপধপে সাদা। বৃদ্ধটি বেশ অসুস্থ মনে হয়। তাঁর মাথার কাছে বসে একটি খুব সুন্দরী মেয়ে হাওয়া করছে পাখা দিয়ে। একজন মাঝবয়েসী লোক বৃদ্ধটিকে খাইয়ে দিচ্ছে চা।
কাকাবাবু অন্য একটি দোকানে বসলেন। বৃদ্ধটিকে একবার দেখে তাঁর ভুরু একটু কুঁচকে গেল। তার চেনা কোনও একজন মানুষের সঙ্গে ওই বৃদ্ধটির মুখের মিল আছে, কিন্তু কার সঙ্গে যে মিল তা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। তবে তা নিয়ে তিনি আর মাথা ঘামালেন না।
একটু পরে সেই বৃদ্ধটিকে ধরাধরি করে তোলা হল সাদা গাড়িটিতে। সেখানেও তিনি বসতে পারলেন না, শুয়ে পড়লেন মেয়েটির কোলে মাথা দিয়ে।
রঞ্জন কয়েকজনকে জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে এসে বলল, কাকাবাবু, রাস্তা পেয়ে গেছি, আর বেশি দূর নেই, বড়জোর এক ঘন্টা। তবে তুঙ্গভদ্রা গেস্ট হাউসে নাকি এখন অনেক লোক। ওই যে থুরথুরে বুড়ো লোকটিকে দেখছেন, উনিও দলবল নিয়ে সেখানেই যাচ্ছেন শুনলুম।
রিঙ্কু বলল, অত বুড়োলোকের বেড়াবার শখ কেন? দেখে তো মনে হয় যখন-তখন মরে যাবে! আমাদের তো টেলিফোন করা আছে, আমরা তুঙ্গভদ্রা গেস্ট হাউসেই থাকব।
সন্তু পকেট থেকে খাতা বার করল। রিঙ্কু বলল, এই, এই, টেলিফোন বলব না তো কী বলব রে।
সন্তু বলল, শুধু বাংলা বলতে চাইলে এইভাবে বলা যায়। আমাদের তো দূরভাষে বলা আছে, আমরা তুঙ্গভদ্রা অতিথি নিবাসে থাকব?
রিঙ্কু বলল, ধ্যাত, এইরকমভাবে কেউ কথা বলে? আমাদের বাড়ির একজন পুরুতঠাকুর এইভাবে কথা বলতেন।
সন্তু বলল, মোটে তো একদিন। কাল থেকে আবার যে-যার নিজের মতন কথা বলবে। রঞ্জনদা, তোমারও একটা ফাইন হয়েছে।
রঞ্জন প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, অ্যাই, অ্যাই, পেয়েছি! সন্তু ফাইন বলেছে! সন্তুরও এবার জরিমানা। তুই নিজেরটা লেখ সন্তু!
জোজো বলল, আচ্ছা সন্তু, আমি যদি পুরো ফরাসি ভাষায় কথা বলি, তাতে ৩৮৮
তো কোনও আপত্তি নেই? আজ তো শুধু ইংরিজি বলা চলবে না!
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তুই ফরাসি জানিস বুঝি?
জোজো বলল, খুব ভাল জানি। আমি যখন বাবার সঙ্গে চার মাস প্যারিসে ছিলুম, তখন গড়গড় করে ফ্রেঞ্চ বলতে শিখেছি। চোখ বুজে বলতে পারি।
শুনবে?
রঞ্জন বলল, শুনি, শুনি?
জোজো সত্যি চোখ বুজে বলল, উই, উই, পারদোঁ ম্যাসিও, ম্যার্সি বকু, জ্য ন পার্ল পা ফ্রাঁসে!
রঞ্জন বলল, হুঁ, ফ্রেঞ্চ ভাষা চোখ বুজেই বলতে হয়।
কাকাবাবু বললেন, চমৎকার বলেছে! কিন্তু জোজো, তোমার এই ভাষা যে আমরা কেউ বুঝতে পারব না!
রিঙ্কু বলল, আর দেরি করে কী হবে, এইবার চলো। চা খাওয়া তো হয়ে গেছে। চা-টা একেবারে অখাদ্য।
এদিকটায় ছোট ছোট পাহাড়ের গা দিয়ে রাস্তা। তুঙ্গভদ্রার বাঁধ অনেকটা উঁচুতে। সেই বাঁধের গায়ে বেশ বড় আর পুরনো আমলের দোতলা অতিথিশালা। সামনে আরও তিনখানা গাড়ি দাঁড়ানো। তার মধ্যে সেই সাদা গাড়িটাও রয়েছে। একতলা-দোতলায় অনেক লোকজনের ব্যস্ততা।
একজন কেয়ারটেকারকে খুঁজে বার করা গেল। সে রঞ্জনের কোনও কথায় পাত্তাই দিতে চায় না। প্রথম থেকেই বলতে লাগল, জায়গা নেই, জায়গা নেই! রঞ্জন বারবার জানাবার চেষ্টা করতে লাগল যে, বাঙ্গালোর থেকে টেলিফোন করা হয়েছে ঘর রাখবার জন্য, তবু লোকটি গ্রাহ্য করল না।
রঞ্জন বলল, আপনি বলতে চান এত বড় ডাকবাংলোতে একটা ঘরও খালি নেই? এখন আমাদের হোটেল খুঁজতে যেতে হবে?
লোকটি বলল, একটাই মাত্র রুম রাখা আছে। সেটা রাজা রায়চৌধুরী নামে একজন ভি আই পির জন্য।
রঞ্জন বলল, উফ, আপনাদের নিয়ে আর পারা যায় না, মশাই! নিন, খুলুন, খুলুন। এতক্ষণ আমার নাম জিজ্ঞেস করেছেন? আমিই তো রাজা রায়চৌধুরী।
লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে জিভ কেটে বলল, আরে ছি ছি, সে কথা বলেননি কেন? আপনাদের জন্য দোতলায় ভাল ঘর রাখা আছে। তিনখানা খাট। আসুন, আসুন! আমি চাবি আনছি!
রঞ্জন সন্তুকে বলল, এখানকার লোকগুলো কী রকম সৎ দেখলি? কাউকে অবিশ্বাস করে না। যে-কেউ এসে নিজের নাম রাজা রায়চৌধুরী বললেই ঘর খুলে দিত।
কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে বললেন, আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন বন্ধুও এখানে রয়েছে দেখছি।
কাকাবাবুর কথা শুনে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দোতলার বারান্দায় একজন তোক রেলিং-এ ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে মুখটা দেখা না গেলেও কোনও সন্দেহ নেই, সে মোহন সিং।
কাকাবাবু বললেন, ভালই হল, ওর সঙ্গে এবার ভাল করে আলাপ করা যাবে।
ডাকবাংলোর দুজন আদালি এসে মালপত্র ওপরে নিয়ে গেল। কেয়ারটেকার ঘরের চাবি খুলে দিয়ে বলল, আপনারা রাত্তিরে খাবেন তো? খাবার অর্ডার এখনই দিয়ে দেবেন?
রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল, কী কী পাওয়া যাবে?
লোকটি বলল, ভাত-রুটি, মুরগি, সবজি, ডাল, ডিমের কারি।
রঞ্জন বলল, কফি আছে আপনাদের?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, কফি পাবেন।
রঞ্জন বলল, এখন আমাদের কফি আর ডিমের ওমলেট দিতে বলুন। রাত্তিরে আমরা মাংস-ভাত খাব।
রিঙ্কুর দিকে ফিরে সে বলল, আমরা তো ওবেলা নিরামিষ খেয়েছি, তাই আগে ডিম খেয়ে সেটা মেক-আপ করে নেওয়া যাক, তারপর মাংস হবে। ঠিক আছে?
রিঙ্কু বলল, সন্তু তুই লিখেনে, রঞ্জন আমাকে শুধু-শুধু মেক-আপ বলেছে।
রঞ্জন বলল, তাই তো! মুখ দিয়ে অটোমেটি…না, না, বলিনি, বলিনি, পুরোটা বলিনি, মুখ দিয়ে ফস করে এক-একটা ইংরেজি কথা বেরিয়ে আসে। ওর বদলে আমার কী বলা উচিত ছিল?
রিঙ্কু বলল, মিটিয়ে। মিটিয়ে বলা যেত।
রঞ্জন বলল, ডিম খেয়ে মিটিয়ে? যাঃ, এটা কীরকম যেন শুনতে লাগে!
জোজো বলল, ইয়ে বলতে পারতে, রঞ্জনদা! বাংলায় এই একটা চমৎকার শব্দ আছে, ইয়ে, এই ইয়ে দিয়ে সব কিছু বোঝানো যায়। এভরিথিং?
সন্তু বলল, হুঁ! এভরিথিং শব্দটা কি ফরাসি?
লম্বা বারান্দাটা এখন খালি, মোহন সিংকে ঘরটায় আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পাশের ঘরটির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, একদম কোণের ঘরটায় অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটি নোক সে-ঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এদিকে আসতে আসতে সন্তুদের ঘরের সামনে থমকে দাঁড়াল!
রঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন!
রঞ্জন এমনভাবে লোকটিকে ডাকল যেন অনেক দিনের চেনা।
লোকটি ঘরের মধ্যে না ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, একটা কথা জানতে চাই, আপনাদের মধ্যে কি কেউ ডাক্তার আছে?
রঞ্জন বলল, না, পাশ করা ডাক্তার কেউ নেই, তবে আমার স্ত্রী আমার ওপরে প্রায়ই নানারকম ডাক্তারি করেন।
লোকটি বলল, আপনাদের কাছে থার্মোমিটার আছে?
রঞ্জন বলল, ইশ, খুব দুঃখিত। বেড়াতে বেরোবার সময় থার্মোমিটার আনার কথা আমাদের মনেই পড়েনি। আনা উচিত ছিল নিশ্চয়ই?
লোকটি বেশ নিরাশ হয়ে বলল, আমাদের সঙ্গের একজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে একশো পাঁচ ডিগ্রি টেম্পারেচার উঠে গেছে। ইনি খুব নামকরা, সম্মানিত লোক।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, কী নাম?
লোকটি বলল, ভগবতীপ্রসাদ শর্মা।
রঞ্জন বলল, আমি আবার এত মুখ্যু যে, অনেক বিখ্যাত লোকদেরই নাম শুনিনি।
কাকাবাবু ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে নদী দেখবার চেষ্টা। করছিলেন, হঠাৎ চমকে পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম বললেন? ভগবতীপ্রসাদ শর্মা? মানে, হিস্টোরিয়ান?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব বড় হিস্টোরিয়ান। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। আমি তাঁর ভাইয়ের ছেলে, আমি চাচাকে প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছি, এখন যদি কিছু একটা বিপদ হয়ে যায়…
কাকাবাবু বললেন, ভগবতীপ্রসাদ শর্মার তো অনেক বয়েস! প্রায় পঁচাশি-ছিয়াশি হবেই। আমি একবার তাঁকে দেখতে যেতে পারি?
সেই লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ, যান না। আমি দেখি, নীচে কেয়ারটেকারের কাছে খোঁজ করে কোনও ডাক্তার পাওয়া যায় কি না?
লোকটি চলে যেতেই কাকাবাবু নিজের হাতব্যাগটা খুলে রিভলভার বার করলেন। স্টোর চেম্বার খুলে দেখে নিলেন ভেতরে গুলি আছে কি না! তারপর সেটার ডগায় কয়েকবার ফুঁ দিয়ে পকেটে ভরলেন।
রঞ্জন আর জোজো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কাকাবাবু হেসে ওদের বললেন, ও ঘরে খুব সম্ভবত মোহন সিং আছে। লোকটা রেগে আছে আমাদের ওপর। তোমরা একটু সাবধানে থেকো।
ক্রাচ খটখট করে কাকাবাবু বারান্দা পেরিয়ে এলেন কোণের ঘরটার কাছে। দরজা ভেজানো। তিনি আস্তে ঠেলে দরজাটা খুললেন।
অতি বৃদ্ধ ভগবতীপ্রসাদ একটা খাটে শুয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর মাথায় জলপট্টি। তিন-চারজন লোক ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে খাটের দুপাশে। তাদের মধ্যে একজন মোহন সিং, তার হাতে একটা টেপ রেকর্ডার, সেটা সে ধরে আছে অসুস্থ বুড়ো লোকটির একেবারে মুখের কাছে।
কাকাবাবুকে ঢুকতে দেখেই মোহন সিং কুটিলভাবে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
কাকাবাবু সেদিকে গ্রাহ্য না করে এগিয়ে এলেন।
মোহন সিং জিজ্ঞেস করল, আপ ডাগদার হ্যায়? আপকো ইধার কেয়া চাইয়ে?
কাকাবাবু সে কথার উত্তর না দিয়ে ক্রাচ দুটো খাটের পাশে দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধলোকটির একটি হাত ধরলেন! তারপর মোহন সিং-দের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, আপনারা এঁর কথা রেকর্ড করছেন, অথচ ইনি কী বলছেন, তা বুঝতে পারছেন না?
মোহন সিং-এর পাশের লোকটি বলল, ইনি পণ্ডিত লোক, জ্বরের ঘোরে ইনি যে-সব কথা বলছেন, সব রেকর্ড করে রাখছি। পরে ভাল করে শুনব। এখন বোঝা যাচ্ছে না?
কাকাবাবু বললেন, ইনি ওষুধ চাইছেন! সরবিট্রেট!
লোকটি বলল, এখানে আমরা কোথায় ওষুধ পাব? সেইজন্যই তো ডাক্তার ডাকতে গেছে একজন।
কাকাবাবু বললেন, এঁর ব্যাগ কোথায়? সেটা খুব ভাল করে দেখুন। এঁর এত বয়েস হয়েছে, নিশ্চয়ই সঙ্গে কিছু ওষুধ রাখেন।
ওরা দু-তিনজনে মিলে একসঙ্গে ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল। তারপর প্রায় চার-পাঁচরকম ওষুধ বার করে আনল। কাকাবাবু তার মধ্য থেকে একটা শিশি নিয়ে খুব ছোট্ট একটা ট্যাবলেট বার করলেন, সেটাকে আবার ভেঙে আদ্ধেক করলেন। তারপর খুব যত্ন করে সেই টুকরোটা ঢুকিয়ে দিলেন বৃদ্ধের জিভের তলায়।
তারপর মুখ তুলে কাকাবাবু বললেন, আপনারা মাথার কাছ থেকে সরে যান। জানলা খুলে হাওয়া আসতে দিন।
বৃদ্ধের বিড়বিড় করা বন্ধ হয়ে গেল, এক মিনিট পরেই তিনি চোখ মেলে তাকালেন। প্রথমেই কাকাবাবুকে দেখতে পেয়ে তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তুম কৌন?
কাকাবাবু বললেন, শর্মাজি, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। অনেকদিন আগে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল দেরাদুনে। আপনি আমাকে চিঠিও লিখেছেন কয়েকটা।
ভগবতীপ্রসাদ শর্মা কয়েক মুহূর্ত অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন কাকাবাবুর মুখের দিকে।
তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, তুমি…তুমি রাজা রায়চৌধুরী? তুমি মহারাজ কণিষ্কের মুণ্ডু খুঁজে পেয়েছিলে, তাই না?
একে এত বৃদ্ধ, তার ওপর এমন অসুস্থ, তবু তাঁর এরকম স্মৃতিশক্তি দেখে কাকাবাবু একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ৩৯২
বৃদ্ধের চোখ দুটি হঠাৎ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি ঘরের অন্য সকলের দিকে তাকালেন, মোহন সিংকে জিজ্ঞেস করলেন, শিবপ্রসাদ কোথায়?
মোহন সিং বলল, তিনি ডাক্তার ডাকতে গেছেন। আপনি কেমন আছেন, একটু ভাল বোধ করছেন কি?
বৃদ্ধ চুপ করে রইলেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, শর্মাজি, আপনি এই বয়েসে এতদূর এসেছেন কেন? আপনার বাড়িতে এখন বিশ্রাম নেওয়াই উচিত।
মোহন সিং বলল, আমরা ওনাকে নিয়ে এসেছি। আমরা ওঁর দেখভাল করব। এখনই ডাক্তার এসে যাবে। আপনি ওনাকে বেশি কথা বলবেন না।
বৃদ্ধ নিজের কম্পিত হাত তুলে কাকাবাবুর একটা হাত চেপে ধরে অন্যদের বললেন, তোমরা সবাই ঘরের বাইরে যাও! রাজা রায়চৌধুরী, শুধু তুমি থাকো!
মোহন সিং বলল, চাচাজি, আমরা আপনার সেবা করব। এখন আপনি বেশি কথা বলবেন না।
বৃদ্ধ আবার বললেন, তোমরা সবাই বাইরে যাও। রাজার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
খুব অনিচ্ছের সঙ্গে মোহন সিং আর তার দলবল বাইরে চলে গেল। বৃদ্ধ কাকাবাবুকে ইঙ্গিত করলেন, দরজাটা বন্ধ করে দেবার জন্য।
মোহন সিং টেপ রেকর্ডারটা চালু করে বিছানার ওপর রেখে গেছে। বৃদ্ধ নিজেই এবার উঠে বসে সেটা বন্ধ করে দিলেন। কাকাবাবুকে খুব কাছে ডেকে বললেন, একটা বিশেষ কাজে এসেছি এখানে, রাজা। এই শরীর নিয়ে আমার এখানে আসা উচিত ছিল না। কিন্তু এটাই হবে আমার শেষ আবিষ্কার। যদি আমি হঠাৎ মরে যাই, তবে তোমাকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। তুমি ঠিক পারবে।
কাকাবাবু বললেন, আপনি উঠছেন কেন, শুয়ে থাকুন। আর কোনও ওষুধ খাবেন?
বৃদ্ধ বললেন, না, এখন একটু ভাল বোধ করছি। শোনো, আগে কাজের কথা বলি। তুমি তোমার কানটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসো, যেন আর কেউ শুনতে না পায়! তোমার কানে কানে বলব।
কাকাবাবু মাথাটা ঝুকিয়ে আনলেন।
সেই বৃদ্ধ চোখের নিমেষে বালিশের তলা থেকে একটা রিভলভার বার করে কাকাবাবুর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, সাবধান! একটু নড়লেই তোমার জীবন শেষ! এইবার বলো তো, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি আমাকে ফলো করে এখানে এসেছ কেন? তোমার কী মতলব?
কাকাবাবু মাথা সরালেন না। কিন্তু সেই অবস্থাতেই হেসে বললেন, এ তো ভারী মজার ব্যাপার দেখছি! আমি আপনাকে ফলো করব কেন? আপনি একটা দলবলের সঙ্গে এখানে এসেছেন, আর আমিও কয়েকজনকে নিয়ে এখানে বেড়াতে এসেছি। আমরা আলাদা আলাদাভাবে আসতে পারি না?
বৃদ্ধ বললেন, তুমি সত্যি বেড়াতে এসেছ, না অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? তুমি তো এমনি-এমনি কোথাও যাও না!
কাকাবাবু বললেন, আমি এমনি কোথাও যাই না! আমি কি ইচ্ছেমতন বেড়াতে পারব না? আমি আজকাল আর অন্য লোকের কাজ নিই না। বেড়াতেই ভালবাসি।
সত্যি কথাটা বলো। নইলে, আমি ঠিক গুলি করব।
গুলি করুন! আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করতে পারব না যে প্রোফেসর ভগবতীপ্রসাদ শর্মা মানুষ খুন করতে পারেন।
সত্যি দেখতে চাও গুলি করতে পারি কি না? আমি বলব, তুমি আমার গলা টিপে ধরতে এসেছিলে, তাই আমি সেলফ ডিফেন্সে গুলি করেছি।
আমি আপনার গলা টিপে ধরতে যাব কেন? একটা কিছু মোটিভ তো। থাকা দরকার। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনার গায়ে হাত তোলার কথা আমি চিন্তাই করি না। আপনার হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নেওয়া কি আমার পক্ষে খুব শক্ত হত?
বৃদ্ধ ফিসফিস করে বললেন, রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি ভাল করেই চিনি, দরজার আড়াল থেকে মোহন সিংরা দেখছে, তাই আমি এই অভিনয় করছি। মোহন সিং-এর দল তোমাকে দেখে চিন্তায় পড়ে গেছে। আমি এখন তোমাকে যে কয়েকটা কথা বলছি, তা খুব মন দিয়ে শোনো। আর কেউ যেন জানতে না পারে। আমি হঠাৎ মরে গেলে তুমি আমার কাজটা সম্পূর্ণ করবে।
এরপর বৃদ্ধ আরও আস্তে-আস্তে কয়েকটা কথা বললেন, শুনতে-শুনতে কাকাবাবুর কপাল কুঁচকে গেল।
তারপর আবার গলা চড়িয়ে বৃদ্ধ বললেন, এবার তোমায় ছেড়ে দিলাম। যদি প্রাণের মায়া থাকে, তা হলে খবদার আমার সামনে তুমি আর আসবে না।
এই সময় দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা পড়ল। একজন কেউ চেঁচিয়ে বলল, ডাক্তার আ গয়া। খোলিয়ে, খখালিয়ে!
বৃদ্ধ চোখ টিপে বললেন, মনে রেখো, আমার কথাগুলো।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন।
শর্মাজির ভাইপো কোথা থেকে একজন ডাক্তার জোগাড় করে এনেছে।
সবাই বৃদ্ধের খাটের দিকে এগিয়ে গেল। শুধু মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধটা খামচে ধরে বলল, রায়চৌধুরী, প্রোফেসর-সাহেব তোমাকে কী কথা বললেন? সাফ খুলে বলো!
কাকাবাবু বললেন, বলছি, তুমি বারান্দার ওই কোণে চলল। খুব জরুরি কথা।
মোহন সিং কাকাবাবুর কাঁধটা ছাড়ল না, প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলল। একটা ক্রাচ পিছলে গিয়ে কাকাবাবু প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন একবার। তবু রিভলভারটা বার করলেন না। তাঁর ক্রাচ দুটো খসে পড়ে গেল মাটিতে।
বারান্দার এই কোণটা বেশ অন্ধকার মতন। দিনের বেলা এখান থেকে তুঙ্গভদ্রা নদীর বাঁধ দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু এখন সবকিছুই ঝাপসা।
কাকাবাবু শান্ত গলায় বললেন, তোমাদের প্রোফেসর সাহেবের সঙ্গে আমার অনেক দিনের চেনা। তিনি আমার কানে কানে বললেন, তুমি ওই মোহন সিংকে একটু ভদ্রতা শিখিয়ে দিও তো! ও সবসময় নিজেকে সিনেমার ভিলেইন মনে করে।
মোহন সিং ধমক দিয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে মজা মারছ, ঠিক করে বলো।
কাকাবাবু বললেন, ভদ্রলোকের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে নেই, জানো? হাত সরাও!
মোহন সিং আরও কিছু বলতে গেল, তার আগেই হঠাৎ কাকাবাবু একটু নিচু হয়ে তার ডান চোখে খুব দ্রুত একটা ঘুসি চালালেন। মোহন সিং একটা আর্ত চিৎকার করে কাকাবাবুর কাঁধ ছেড়ে দিয়ে দু হাতে চোখ চাপা দিল।
কাকাবাবু এবার মোহন সিং-এর কাঁধটা ধরে এক ঝটকায় তার শরীরটা উলটে দিলেন। মোহন সিং বারান্দার রেলিং-এর ওপারে শূন্যে ঝুলতে লাগল। এতই ভয় পেয়ে গেছে সে যে, মুখ দিয়ে শুধু আঁ-আঁ শব্দ করছে, আর কোনও কথা বলতে পারছে না। তার অত বড় শরীরটা যে কাকাবাবু অবলীলাক্রমে তুলে ফেলতে পারবেন, তা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
কাকাবাবু বললেন, এবার আমি তোমাকে নীচে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু ভদ্রলোকেরা মানুষকে চট করে এত কঠিন শাস্তি দেয় না। আর কখনও নিজের বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্য কারও কাঁধে হাত দিয়ে কথা বোলো না। আর দু নম্বর হল, ইন্ডিয়া ইজ আ ফ্রি কান্ট্রি, যার যেখানে খুশি যেতে পারে। আমি হামপি-তে যাব কি যাব না, তা নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
মোহন সিং দু হাত দিয়ে রেলিংটা ধরার চেষ্টা করছে। কাকাবাবুর মুঠি একটু আলগা হয়ে গেলেই সে পড়ে যাবে। এর মধ্যেই সে একবার চেঁচিয়ে উঠল, বিরজু, বিরজু!
কাকাবাবু বললেন, তোমার ওই বিরজু লোকটা পেট্রোল পাম্পে আমাদের রঞ্জনকে অকারণে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। তাকেও বলে দিও যেন যখন তখন সে গায়ের জোর না দেখায়।
খুব জোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তিনি মোহন সিংকে ফিরিয়ে আনলেন বারান্দায়। সেখানে তাকে ঠেসে ধরে কাকাবাবু আবার বললেন, ভগবতীপ্রসাদ শর্মা আমার গুরুর মতন। উনি হুকুম করলে আমি ওঁর পা-ধোওয়া জলও খেতে পারি। উনি বুঝেছেন যে, আমরা শুধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছি, আমাদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। আমরা তোমাদের কোনও ব্যাপারে ডিসটার্ব করব না। তোমরাও আমাদের ডিসটার্ব কোরো না।
মোহন সিংকে ছেড়ে দিয়ে কাকাবাবু ক্রাচ দুটো তুলে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন পেছন ফিরে।
মোহন সিং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সে যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে, কাকাবাবুর হাতে এত জোর। তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে।