এরূপ কহিয়া পুনঃ কহে ব্যাসমুনি।
ধৈর্য্য হও নরপতি ইতিহাস শুনি।।
যথায় সংযোগ হয় রিপুজ্ঞান কর।
মরিয়া সকলে তারা গেল স্বর্গপুর।।
জন্মিলে অবশ্য রাজা আছয়ে মরণ।
অহঙ্কারে অবশ্য ত আছয়ে পতন।।
অহঙ্কার করি সবে অল্পায়ু হইল।
অধর্ম্ম করিয়া তারা আপনি মরিল।।
তার সাক্ষী দেখ তুমি আপন সমীপে।
ধর্ম্মে পরমায়ু বাড়ে আর বাড়ে জপে।।
এই বসি আছেন মার্কণ্ড মুনিবর।
ইহার পরমায়ু ছিল দ্বাদশ বৎসর।।
অল্পকালে সর্ব্বশাস্ত্র পড়িল মার্কণ্ডে।
সরস্বতী বশ কৈল আপনার তুণ্ডে।।
বিচারি জ্যোতিষ শাস্ত্র আপনি গণিল।
দ্বাদশ বৎসর আয়ু গণিয়া পাইল।।
তবে মনে ভাবিয়া মার্কণ্ড তপোধন।
ত্যজিয়া ত গৃহবাস তপে দিল মন।।
তাঁর সম তপস্যা না করে কোন জন।
মৃত্যু খণ্ডাইল সেই তপের কারণ।।
তবে রাজা যুধিষ্ঠির পুছিল ব্যাসেরে।
মৃত্যু খণ্ডাইল মুনি কিমত প্রকারে।।
ব্যাস কহে, শুন রাজা কহি যে তোমারে।
যেই মতে মৃত্যু খণ্ডে সংসার ভিতরে।।
তপ করে মার্কণ্ডেয় নাহি জানে আর।
হেনমতে গেল বর্ষ সহস্র হাজার।।
সমাধি লাগিল সেই মুনির শরীরে।
উই ঢিপি জন্মি তবে বেড়িল তাহারে।।
তাহার উপরে বৃক্ষ বড়ই হইল।
মৃগ পশু ব্যাঘ্র আদি তথায় বঞ্চিল।।
নানা জাতি পক্ষী থাকে বৃক্ষের উপর।
বটবৃক্ষ হয় সেই বহুত বিস্তার।।
পুরাতন লোক কেহ বলিতে না পারে।
কত কাল বটবৃক্ষ বনের ভিতরে।।
এই মত আছে মুনি মাটীর ভিতর।
তপ ব্রতে গেল ষাটি হাজার বৎসর।।
তার পর বহু মুনি সনে পদ্মাসন।
সেই পথে মুনি সনে করিয়া গমন।।
হাসিতে লাগিল ব্রহ্মা সেই স্থান দেখি।
মনেতে হইলা ব্রহ্মা অতিবড় সুখী।।
তবে মুনিগণ সব পুছিল ব্রহ্মারে।
কি লাগি হাসিলে তুমি কহত সবারে।।
ব্রহ্মা বলে, হাসিলাম যাহার কারণ।
সেই কথা কহি শুন তাহে দেহ মন।।
মৃত্তিকার ভিতরে মার্কণ্ড মুনি তায়।
দ্বাদশ বৎসর আয়ু ষাটি হাজার যায়।।
শিষ্যগণে বলে ব্রহ্মা শুনহ এখনে।
দেখিব মার্কণ্ড মুনি আছেন কেমনে।।
তবে ব্রহ্মা কমণ্ডলু জল ঢালি দিল।
মাটী ফাটি দুই দিকে তখন পড়িল।।
মহাশব্দে দুই বৃক্ষ মাটিতে পড়িল।
মাটিতলে মুনি আছে দেখিতে পাইল।।
মহাতেজোবন্ত মুনি সূর্য্য সম সর।
দেখিয়া ত ব্রহ্মদেব করিলা উত্তর।।
অতঃপর উঠ তুমি কার্য্য নাহি তপে।
তোমার সাক্ষাতে যম আদি প্রাণ কাঁপে।।
মুনি বলে, কবে মোর হইবে মরণ।
তাহা কহ মোর আগে শুনি বিবরণ।।
ব্রহ্মা বলে, ব্রহ্মাণ্ডে যবে অগ্নি ইচ্ছা হবে।
কহিনু তোমারে তুমি তখনি মরিবে।।
যাহ সদ্য বিচারিয়া করহ পুরাণ।
এত বলি ব্রহ্মা গেল আপনার স্থান।।
তবে মুনি উঠিলা করিতে গঙ্গাস্নান।
কমণ্ডলু হাতে করি করিলা পয়াণ।।
গঙ্গা আদি করিয়া যতেক তীর্থজল।
সকল শুকাল, মুনি হইলা বিকল।।
সর্ব্ব নদীগণ দেখে সব বালিময়।
দীঘি পুষ্করিণী সব জল নাহি তায়।।
সপ্ত সাগর মুনি করিলা ভ্রমণ।
ব্রহ্মার মায়াতে জল না পায় তখন।।
তবে মুনি ভাবিতে ভাবিতে পথ যায়।
হাড়িপাড়া নামে তথা এক গ্রাম পায়।।
এক হ্রদ আছে তথা বিপর্য্যর জল।
তাহাতে বিস্তর আছে শূকরের পাল।।
বৃষ্টিময় জল তাহে শূকরে বেষ্টিত।
তাহা দেখি মহামুনি হৈলা আনন্দিত।।
অপ্ নারায়ণ বলি মুনি নামে জলে।
উপনীত হৈল গিয়া শূকরের পালে।।
মাথা তুলি দেখেন শূকর গেল দূর।
কর্দ্দম সদৃশ জল বিকশিত ফুল।।
নীলোৎপল পদ্মগণ সুধাময় নীর।
শূকর নাহিক দেখি হংসময় তীর।।
স্নান দান কৈলা মুনি আনন্দিত হৈয়া।
জল লইলেন কমণ্ডলুতে পূরিয়া।।
বিপ্র-পাদোদক লাগি মহামুনি ফিলে।
বিপ্র-নাহি পায় মুনি সকল সংসারে।।
সপ্তদ্বীপ পৃথ্বী মুনি করিলা ভ্রমণ।
তথাপিহ না পাইল একটী ব্রাহ্মণ।।
পাদোদক বিনা মুনি জল খাইতে নারে।
ব্রাহ্মণ চাহিয়া মুনি ফিরে দ্বারে দ্বারে।।
এইমতে উপনীত হৈল হাড়িপাড়া।
হাতে কমণ্ডলু মুনি তথা হৈল খাড়া।।
দেখিল হাড়িনী এক, দুই পুত্র হয়।
বড় দুগ্ধ হেতু কান্দে ছোট পুত্রে দেয়।।
বড় পুত্র দুগ্ধ চাহে খাইতে না পায়।
ছোট পুত্রে দুগ্ধ দিয়া খাটেতে শোয়ায়।।
তবেত সে হাড়িনী ধুইল দুই স্তন।
বড় পুত্রে কোলে করি লইল তখন।।
তবে সে হাড়িনী তারে দুগ্ধ খাওয়াইল।
তাহা দেখি মুনিবর তখন পুছিল।।
স্তন কেনে ধুইলে তুমি কহত আমারে।
এই দুই পুত্র কার সহ সারোদ্ধারে।।
হাড়িনী কহিল, গোসাঞি করি নিবেদন।
যুবাকালে স্বামী ছিল একই ব্রাহ্মণ।।
তার তেজে পুত্র এই প্রথম হইল।
শেষ পুত্র এই মোর হাড়ি জন্মাইল।।
উচ্ছিষ্ট দুগ্ধ পুত্রে নাহি যায়।
তেকারণে স্তন ধুইনু শুন মহাশয়।।
মুনি বলে, তবে আমি যাইব কোথায়।
কমণ্ডলু জল দিল সেই শিশু পায়।।
হাড়িনী কহিল, গোসাঞি কি করিলে তুমি।
পাদোদক নিলে তুমি কি কহিব আমি।।
তুমি মহা তেজোময় দেখি সূর্য্যসম।
হাড়িজাতি কর্ম্ম মোর পরম অধম।।
মুনি বলে, চিন্তা নাহি শুনি মোর কথা।
বিপ্রপুত্র হয় এই না করিহ চিন্তা।।
এইমত পাদোদক মুনি পাইয়া যায়।
আপনি আসিয়া ব্রহ্মা কহিলা তাহায়।।
অমর হইলা তুমি শুনি মহামুনি।
নাহিক মরণ তব কহিলাম আমি।।
তপোবলে মার্কণ্ডেয় হইল অমর।
ধর্ম্ম বড় কেহ নহে শুন মুনিবর।।
মার্কণ্ডেয় উপাখ্যান যেই জন শুনে।
আয়ুবৃদ্ধি হয় তার বিধির লিখনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।