বৈদিক সংস্কৃতি ও নৃতত্বের জ্ঞান
কিন্তু নৃতত্বের দিক থেকে প্রাচীন সাহিত্যকে বোঝবার বিরুদ্ধে আধুনিক মনের একটা বাধাও আছে; সে-বাধার কথা শুধুমাত্র আমাদের দেশের প্রাচীন সাহিত্য সম্বন্ধেই প্রযোজ্য নয়।
প্রাচীন রোমের আধুনিক ইতিহাস প্রসঙ্গেও অধ্যাপক জর্জ টম্সন(২১) মন্তব্য করছেন, এ-সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিকদের নিয়ে মুস্কিল এই যে, ট্রাইব্যালসমাজ বলতে ঠিক কী বোঝায়, সে-প্রশ্ন না তুলেই এঁরা প্রাচীন রোমের ট্রাইব্যাল সংগঠনগুলির ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন।
এর কারণ, ট্রাইব্যাল-সমাজকে সম্যকভাবে চেনবার বিরুদ্ধে আধুনিক মনের প্রতিবন্ধ। কেননা, সে-সমাজের অকৃত্রিম রূপটি হলো প্রাক্-বিভক্ত সাম্য-সংগঠন। সেখানে আধুনিক অর্থে পরিবার-জীবন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রশক্তির পরিচয় নেই; অথচ আধুনিক মনের কাছে এগুলিই পবিত্রতম সমাজ-উপকরণ। আজীবন গবেষণার ফলে মর্গান ট্রাইব্যাল-সমাজের স্বরূপ আবিষ্কার করেছেন। তাঁর গবেষণা যুগান্তকারী হলেও আধুনিক বিদ্বানসমাজে স্বীকৃত হয়নি।
গ্রীক-পুরাণে দেবী এথিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ণ রণসাজে সজ্জিতা অবস্থায়। কিন্তু বাস্তব পৃথিবীতে কোনো মানবীই এ-সুযোগ পায় না। তেমনি, বাস্তব ইতিহাসে মানবজাতির কোনো শাখাও সভ্য ও উন্নত অবস্থায় আবির্ভূত হবার সুযোগ পায়নি। আধা-জানোয়ারের মতো অবস্থা থেকে শুরু করেই কয়েক লক্ষ বছরের প্রচেষ্টায় মানুষ নানা পর্যায় পার হয়ে শেষ পর্যন্ত সভ্যতার আঙিনায় এসে পৌঁছেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধেও এই কথা। বৈদিক আর্যদের সম্বন্ধেও এই কথাই। এ-কথা ভাবতে আমাদের হয়তো কিছুটা ক্ষুন্ন হয়; কিন্তু প্রাচীন-সমাজকে সম্যকভাবে চেনবার বিরুদ্ধে আসল বাধাটা এই রকম মান-অভিমানের(২২) ব্যাপার নয়। কেননা, আমাদের আরো সুদূর পূর্বপুরুষেরা বনমানুষ ছিলেন—এ-কথা স্বীকার করায় অভিমান আহত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি হলেও জীবজগতের ক্রমবিকাশের কাহিনী শুনতে আমাদের আটকায় না। কিন্তু প্রাচীন-সমাজের প্রকৃত কাহিনী শুনতে আটকায়। তার কারণ, মানব-ইতিহাসের ওই অতীত অধ্যায়গুলি মৃত ও মূক অতীতমাত্র নয়; ভবিষ্যতের উপর থেকেও সেগুলি যবনিক উত্তোলনের আয়োজন করে।
এই কারণেই মর্গানের গবেষণার বিরুদ্ধে আধুনিক সমাজের এতোখানি প্রতিবন্ধ। এবং সে-প্রতিবন্ধের দরুন প্রাচীন ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ই আমাদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে আছে। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা প্রাচীন যুগ প্রসঙ্গে ট্রাইব বা ট্রাইব্যাল সমাজ প্রভৃতি কথা যতো সহজে ব্যবহার করেন, তার অনুপাতে এ-সমাজের প্রকৃত রূপটিকে চেনবার ও স্বীকার করবার উৎসাহ প্রদর্শন করেন না।
বৈদিক সাহিত্য-বিচারের ভূমিকায় এই কথাগুলি তোলা বিশেষ প্রয়োজন। কেননা, আধুনিক বিদ্বানদের রচনায় বৈদিক সমাজ প্রসঙ্গে ট্রাইব শব্দের ব্যবহার দুর্লভ নয়; কিন্তু ট্রাইব্যাল-সমাজ বলতে ঠিক কী বোঝায় সে-আলোচনা দুর্লভ। অথচ, তা বাদ দিয়ে কী ভাবে বৈদিক সাহিত্য বোঝা যেতে পারে? কেননা, বৈদিক সাহিত্যে যদি ট্রাইব্যাল-সমাজ বা তার স্পষ্ট স্মারক পাওয়া যায় তাহলে নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলতে হবে, ট্রাইব্যালসমাজ বলতে ঠিক কী বোঝায় এবং ঠিক কোন দিক থেকে সে-সমাজের সঙ্গে আধুনিক সভ্য সমাজের প্রভেদ? ভারততত্ত্ববিদেরা কিন্তু এ-প্রশ্ন তোলেন না। তার বদলে এমন কি অনেক সময় তারা অসভ্য মানুষ সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট, অবাস্তব ও খেয়ালী ধারণার উপরই নির্ভর করেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে অধ্যাপক উইন্টারনিৎস্-এর রচনারই উল্লেখ করা যায়। Aryan Tribes প্রভৃতি শব্দ তাঁর গ্রন্থে দুর্লভ নয়। অথচ, বৈদিক আর্যদের এই ট্রাইব্যাল অবস্থার বর্ণনায় তিনি শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত যে,
We hear in the hymns of the Rigveda of incest, seduction, conjugal unfaithfulness, the procuring of abortion, theft and robbery. All this, however, proves nothing against the antiquity of the Rigveda. Modern ethnology knows nothing of “unspoiled children of nature” any more than it regards all primitive peoples as rough savages or cannibal monsters. The ethnologist knows that a step-ladder of endless gradations of the most widely differing cultural conditions leads from the primitive peoples to the half-civilized peoples, and right up to the civilized nations. We need not therefore imagine the people of the Rigveda either as an innocent shepherd people, or as a horde of rough savages, nor, on the other hand as a people of ultra-refined culture.(২৩)
এ-মন্তব্যে আধুনিক নৃতত্ত্বের প্রতি মৌখিক অমুরাগের পরিচয় যতোখানিই থাকুক না কেন, প্রকৃত বৈজ্ঞানিক নিষ্ঠার চিহ্নমাত্র নেই। কেননা, নৃতত্ত্বের শিক্ষা নিশ্চয়ই এই নয় যে, আদিম মানুষেরাও আধুনিক মানুষদের মতোই চুরি, ডাকাতি, গর্ভপাত, প্রবঞ্চনা প্রভৃতিতে অভ্যস্ত ছিলো। বরং ঠিক তার উল্টোই। ঋগ্বেদের অংশবিশেষে যদি সত্যিই এ-জাতীয় আচরণের পরিচয় পাওয়া যায় তাহলে শুধু এইটুকুই প্রমাণিত হবে যে, ঋগ্বেদের ওই অংশগুলি সমাজ-বিকাশের এমন একটা পর্যায়ে রচিত হয়েছিলো যখন বৈদিক আর্যর প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত ট্রাইব্যাল সমাজের পরিধি ছেড়ে শ্রেণীসমাজের দিকে অনেকখানিই অগ্রসর হয়েছিলেন। ট্রাইব্যাল সমাজ থেকে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের দিকে অগ্রগতির বর্ণনায় এঙ্গেল্স্(২৪) বলছেন,
The power of these primordial communities had to be broken, and it was broken. But it was broken by influences which from the outset appear to us as a degradation, a fall from the simple moral grandeur of the ancient gentile society. The lowest interests—base greed, brutal sensuality, sordid avarice, selfish plunder of common possessions—usher in the new civilized society, class society; the most outrageous means–theft, rape, deceit, treachery—undermine and topple the old classless gentile society.
বিশাল বৈদিক সাহিত্য এক-আধবছরের রচনা নয়। আধুনিক বিদ্বানদের বিচারে এক ঋগ্বেদেরই প্রাচীনতম ও অর্বাচীনতম অংশগুলির রচনা-কালের মধ্যে দু’হাজার বছরের ব্যবধান থাকা অসম্ভব নয়। এই সুদীর্ঘ যুগ ধরে বৈদিক মানুষদের সমাজ নিশ্চয়ই একই পর্যায়ে থেমে থাকেনি। বৈদিক সাহিত্য-বিচারে আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে এঙ্গেল্স্ ট্রাইব্যাল সমাজ ভেঙে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের আবির্ভাব প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করছেন, বৈদিক সাহিত্যের আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকেই তা বহুলাংশে সমর্থিত হয়। এবং বর্তমান পরিচ্ছেদে আমাদের মূল যুক্তি হবে, সমাজ বিবর্তনের এই মৌলিক পরিবর্তনটির প্রতিবিম্ব হিসেবেই বৈদিক মানুষদের চেতনায় প্রাক্-অধ্যাত্মবাদী ধ্যানধারণার ধ্বংসস্তুপের উপর অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী ধ্যানধারণার আবির্ভাব হয়েছিলো। বস্তুত, ট্রাইব্যাল-সমাজের সঙ্গে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের কথা মনে না রাখলে বৈদিক সংস্কৃতির সুদীর্ঘ ইতিহাস বোঝা যায় না এবং এইকারণেই বৈদিক সাহিত্য-বিচারে নৃতত্ত্বের জ্ঞান শুধু প্রয়োজনীয় নয়, অপরিহার্যও। অধ্যাপক উইণ্টারনিৎস একটি পাদটীকায়, নেহাতই আনুষঙ্গিক মন্তব্য হিসেবে, বৈদিক আর্যদের সঙ্গে আধুনিক আফ্রিকার ট্রাইবদের অর্থনৈতিক জীবনের সাদৃশ্যের উল্লেখ করেছেন; কিন্তু এই আধুনিক যুগের পশুপালনজীবী ট্রাইবদের সঙ্গে বৈদিক আর্যদের সাদৃশ্য-বিচার থেকে বৈদিক সাহিত্যের আলোচনায় আমাদের পক্ষে আরো কীভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব সে-প্রশ্ন তোলেননি। ট্রাইব্যাল-সমাজকে সম্যকভাবে চেনবার বিরুদ্ধে আধুনিক মনের প্রতিবন্ধ এর কারণ হতে পারে।
———————
২১. G. Thomson SAGS 97.
২২. S. Freud GISA25. ফ্রয়েডের মতে কোপার্নিকাস ও ডারউইনের মতোই তাঁর আবিষ্কারও মানবাত্মার সনাতন অভিমানকে আহত করে বলেই এর বিরুদ্ধে মানবমনের স্বাভাবিক প্রতিবন্ধ জাগে। সমালোচনা—দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ; ফ্রয়েড-প্রসঙ্গে, ১-২৩ ।
২৩. M.. Winternitz op. cit. 67-8.
২৪. F. Engels OFPPS 163.