০২. বুদ্ধিমান প্রাণী?

০২. বুদ্ধিমান প্রাণী?

সবাই আবার বড় মনিটরটি ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। সবার চোখেমুখেই একই সাথে ক্লান্তি এবং ভয়-ধরানো একটা উত্তেজনার তাব। লু হাইপারভাইভের ম্যানুয়েল দেখে সিডিসির সাথে একদান দাবা খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার চেহারায় ঘুম থেকে ওঠা সতেজ ভাবটা নেই। তার ঘুমটা কেটেছে কাটা কাটা দুঃস্বপ্ন দেখে, এখনো মাথায় সেগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে তার ছোট বক্তৃতা দিয়ে তার আলোচনা শুরু করে, সকালে তোমাদের কাজকর্ম ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেকটুকু গুছিয়ে নিয়েছ। কি বল?

উপস্থিত কাউকে খুব উৎসাহী দেখা গেল না। লু একটু হেসে বলল, ঠিক আছে, সবার রিপোর্ট শোনা যাক। পল কম আর সুশান তোমাদের দিয়ে শুরু করি।

পল কুম হাত উন্টে বলল, কি বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা যত রকম পরীক্ষা করা সম্ভব সব করেছি, এবং পরীক্ষাগুলির ফল থেকে একটামাত্র সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব, সেটা হচ্ছে, এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে। কিন্তু মুশকিল কী, জান?

কী?

অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রাণী বা তাদের আবাসস্থল কোনো কিছুর দেখা পেলাম না। এক হতে পারে খুব নিচুস্তরের প্রাণী, আকারেও খুব ছোট, মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা সম্ভব না, সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে একটা স্কাউটশিপ পাঠিয়ে ট্রাইটনের উপর থেকে কিছু মাটি তুলে আনতে হবে। কিন্তু সেটা করার প্রয়োজন আছে কি নেই সে সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে।

লু সুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কিছু বলার আছে?

না। পল কুম ঠিকই বলেছে যে, আমরা প্রাণীগুলিকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে প্রাণীগুলি সবসময়েই আমাদের লক্ষ করছে।

লু জোর করে একটু হাসির ভান করে বলল, আপাতত যেটার কোনো প্রমাণ নেই, সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তোমরা যদি জোর দিয়ে বলতে পার এখানে কোনো উন্নত প্রাণী নেই, আমরা তাহলে ঘন্টা দুয়েকের মাঝে ফিরে যেতে পারি।

সুশান মাথা নেড়ে বলল, না লু, জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না, সবগুলি পরীক্ষা বলেছে, এখানে কোনো-না-কোনো ধরনের প্রাণী আছে। কিন্তু সেটি কত উন্নত আমরা জানি না।

লু চিন্তিতভাবে কিম জিবানকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কিছু বলার আছে কি?

অনেক কিছু। কোথা থেকে শুরু করব?

অনেক কিছু বলার সময় নেই, তোমাকে অল্প কথায় সারতে হবে।

কিম তার হাতের একতাড়া কাগজ দেখিয়ে বলল, এইসব অল্প কথায় সারব?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। কিম একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এটা একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক গ্রহ। কোনোভাবেই এটাকে কোনো দলে ফেলা গেল না।

কেন ফেলা গেল না সেটা অন্তত বল।

প্রথমত গ্রহটা প্রচণ্ড পরিবর্তনশীল, ঘনত্ব খুবই খাপছাড়া ধরনের, প্রথমে ভেবেছিলাম ভিতরটা বুঝি ফাঁপা, যেখানে কিলবিলে মাকড়সার মতো প্রাণী থাকে। পরে দেখা গেল তা ঠিক নয়, কিন্তু ঘনত্বটার পরিবর্তন হচ্ছে। এরকম গ্রহ টিকে থাকা সম্ভব নয়, বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা; কিন্তু এটা শুধু যে টিকে আছে তাই নয়, বেশ ভালোরকম টিকে আছে। তা ছাড়া উপরে যে গোল গোল গর্তগুলি আছে, সেগুলি ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। দেখে মনে হয়—কিম জিবান হঠাৎ থেমে গেল।

কি?

না, কিছু না।

শুনি।

দেখে মনে হয়, ওগুলি বড় বড় চোখ, আর ড্যাবড্যাব করে সেই চোখ দিয়ে। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিম জিবান ভেবেছিল তার কথা শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠবে, কিন্তু কেউ হাসল না, রু-টেক পর্যন্ত কেমন একটা গম্ভীর মুখে বসে রইল। লু শুধু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ভালোই বলেছ। পুরো গ্রহটা হচ্ছে কারো মাথা, আর গর্তগুলি হচ্ছে তার চোখ! যাই হোক, এবারে নীষা বল তুমি কি দেখলে। গ্ৰহটাতে কি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে?

নীষা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, বলা যায়, নেই।

লু নীষার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মনে হয় পুরোপুরি নিশ্চিত নও।

না, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। আজ সারাদিন আমি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর চিহ্ন পাই নি, তবে

তবে কি?

একবার–মাত্র একবার একটা সিগন্যাল ফিরে এসেছে।

লু মাথা নেড়ে বলল, বুঝিয়ে বল, একটু বুঝিয়ে বল।

বুঝিয়ে বলার কিছু নেই, আমি প্রায় নিঃসন্দেহ যে, ব্যাপারটা একটা যান্ত্রিক গোলযোগ। কারণ যেটা ঘটেছে সেটা ঘটা সম্ভব না।

কি হয়েছে?

তোমরা সবাই জান বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান পাওয়ার অনেকগুলি কোড় আছে, কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেখানে এই কোড পাঠানো হয়। আশা করা হয় প্রাণীগুলি সেই কোডটার মর্মোদ্ধার করে তার উত্তর পাঠাবে। প্রাণীগুলি কত বুদ্ধিমান তার উপর নির্ভর করে তারা কত তাড়াতাড়ি সেটার মর্মোদ্ধার করতে পারবে। আমি আজ সারাদিন চেষ্টা করে গেছি, যতগুলি কোড আমার কাছে ছিল একটা একটা করে পাঠিয়ে গেছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাই নি। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক আগে একটা কোড পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে।

মানে?

একটা খুব জটিল সিগন্যাল আছে, প্রাইম সংখ্যা দিয়ে তৈরী। সেই সিগন্যালটা হঠাৎ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে।

রু–টেক জিজ্ঞেস করল, তুমি বলছ সিগন্যালটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী সেটার মর্মোদ্ধার করে ফেরত পাঠিয়েছে।

নীষা একটু ইতস্তত করে বলল, তা হলে আমাদের এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত।

কেন?

কারণ এই কোডটার মর্মোদ্ধার করা অসম্ভব, এর জন্যে প্রায় সবগুলি প্রাইম সংখ্যা জানতে হয়। সবগুলি প্রাইম সংখ্যা কারো পক্ষে জানা সম্ভব না, মানুষ এখনো জানে না। কাজেই আমার ধারণা, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এটা ফেরত পাঠায় নি, এটা নিজে থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে। সিগন্যাল ড্রাইভারের ই. এম. টি. চীপের বায়াস যদি বারো মাইক্রোভোল্টের কম হয়, এ ধরনের ব্যাপার হতে পারে।

একটা তর্ক শুরু হতে যাচ্ছিল, লু হাত তুলে থামিয়ে দেয়। রু-টেকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের নিরাপত্তার সবকিছু ঠিক আছে?

হ্যাঁ। ট্রাইটন থেকে কোনো কিছু যদি আমাদের দিকে উঠে আসে সাথে সাথে সেটা শেষ করে দেয়া সম্ভব। সেকেন্ডে একটা করেও যদি পাঠানো হয়, এক ঘন্টা পর্যন্ত আটকে রাখতে পারব। মহাকাশকেন্দ্রে খবর দেয়া আছে, সেই এক ঘন্টার ভিতরে পুরো দল চলে আসবে। আমি রিজার্ভ ট্যাংকে জ্বালানি সরিয়ে রেখেছি, দরকার হলে তুমি হাইপারডাইভ দিতে পারবে। সবকিছু বিবেচনা করে দেখলে আমার ধারণা, ভৌতিক কিছু না ঘটলে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ। সিডিসিরও তাই ধারণা।

চমৎকার! লু তার কফিতে চুমুক দিয়ে চুপ করে যায়।

সুশান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, লু।

কি?

আমাদের দায়িত্ব কি শেষ? আমরা কি এখন ফিরে যাব?

আমার খুব ইচ্ছে করছে ফিরে যেতে, কিন্তু একটা-কিছু সিদ্ধান্তে না পৌঁছে ফিরে যাই কেমন করে? বিজ্ঞান আকাদেমিকে গিয়ে কী বলব?

কী করবে তাহলে?

একটা স্কাউটশিপ পাঠাতে হবে।

সুশান একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। সে মনে মনে এই ভয়টাই করছিল, হয়তো লু আরো একদিন থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে।

লু রু-টেকের দিকে তাকিয়ে বলল, রু, তুমি একটা স্কাউটশিপ পাঠানোর ব্যবস্থা কর, ঘন্টাখানেকের মাঝে যেন রওনা দিয়ে দেয়, খুব ধীরে ধীরে নামাবে, গ্রহে কোনো প্রাণী থাকলে তারা যেন দেখে ভয় না পায়। নীষা, তুমি কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কোড দিয়ে দাও সবগুলি যেন বলতে থাকে, আমরা বন্ধুত্ব চাই, শান্তি চাই বা এই ধরনের কোনো একটা গালভরা কথা। স্কাউটশিপটা ট্রাইটনে নেমে যেন ভিন্ন ভিন্ন স্তর থেকে খানিকটা করে মাটি তুলে আনে। ফিরে এসে স্কাউটশিপটাকে সিসিয়ানে সোজাসুজি চলে আসতে দিও না, শ’খানেক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করাবে। সুশান আর পল কুম, তোমরা ঠিক কর স্কাউটশিপের ভিতরে আর কি দেয়া যায়, ট্রাইটনে নেমে ঠিক কী ধরনের পরীক্ষা করা দরকার।

সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, কেউ কি যাবে এই স্কাউটশিপে করে?

লু হেসে বলল, আরে না! মাথা খারাপ তোমার? মানুষ হচ্ছে অমূল্য সম্পদ, তাদের নিয়ে কখনো ঝুঁকি নেয়া যায় না।

টেবিল থেকে উঠে গিয়ে স্বচ্ছ জানালার পাশে দাঁড়াল। গ্রহটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, কিম, তুমি ঠিকই বলেছ, গ্রহটাকে দেখলে মনে হয় এটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কী বীভৎস ব্যাপার!

সবাই ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকায়, কেউ কিছু বলে না। লু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি তোমাদের ভয় দেখাতে চাচ্ছি না, মনে হল তাই বললাম। একটু থেমে যোগ করল, আমি আমার ঘরে সিডিসির সাথে দাবাটা শেষ করে ফেলি, কিছু দরকার হলে আমায় ডেকো।

 

বুঝলে সিডিসি, দাবা হয়তো তুমি মন্দ খেল না, কখনো তোমাকে আমি হারাতে পারি নি, লু হাতিটা এক ঘর পিছিয়ে এনে বলল, কিন্তু তোমার সাথে দাবা খেলে আরাম নেই। তুমি বড় চিন্তা করে খৈল, কখনো ভুল কর না।

উত্তরে বিপবিপ শব্দ করে সিডিসি কিছু একটা বলল, লু সেটা বুঝতে পারল না, বোঝার খুব-একটা ইচ্ছে আছে সে-রকম মনেও হল না। মন্ত্রীটা এগিয়ে দেবে কি না চিন্তা করতে করতে বলল, তোমার সাথে কথা বলে মজা আছে, আমার কিছু শুনতে হয় না, শুধু বলে গেলেই হয়।

আবার বিপবিপ করে একটা শব্দ হল।

দাবা খেলা কে আবিষ্কার করেছিল জান?

বিপবিপ।

নিশ্চয়ই জান, কম্পিউটার জানে না এরকম জিনিস কি কিছু আছে? এক দেশে থাকত এক রাজা আর এক মন্ত্রী। সেই মন্ত্রী ভদ্রলোক দাবা খেলা আবিষ্কার করে রাজাকে সেটা উপহার দিলেন। রাজা এক দান দাবা খেলে ভারি খুশি, মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী পুরস্কার চাও? মন্ত্রী বললেন, কিছু চাই না মহারাজা লু একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, জান নাকি গল্পটা?

উওরে সিডিসি একটা ধাতব শব্দ করে, যার অর্থ বোঝা মুশকিল। লু সেটা অগ্রাহ্য করে বলল, বলি তবু গল্পটা, ভালো গল্প দু বার শুনলে ক্ষতি নেই কিছু মন্ত্রী *ললেন, কিছু আমি চাই না মহারাজা, রাজা তবু কিছু একটা উপহার দেবেনই, রাজাদের খেয়াল, বুঝতেই পারছ। মন্ত্রী আর কী করবেন, বললেন, ঠিক আছে, কিছু একটা যদি দিতেই চান, তা হলে এই দাবার ছকটা ভরে কিছু শস্যদানা দিন। প্রথমটায় একটা, দ্বিতীয়টাতে দুইটা, তৃতীয়টাতে চারটা, চতুর্থটাতে আটটা এভাবে।

সিডিসি ক্রমাগত বিবিপ করে শব্দ করতে থাকে। লু থেমে একনজর তাকিয়ে বলল, এই জন্যে কম্পিউটারদের গল্প বলে মজা নেই, সবকিছু আগেই বুঝে ফেলে! একজন মানুষকে যদি বলতাম, সে যখন জানত দাবার ছক এভাবে শস্যদানা দিয়ে ভরতে সারা পৃথিবীর কয়েক শ’ বছরের শস্য লেগে যাবে, সে কী অবাক হত! তা হলে গল্পটাও আরো অনেক গুছিয়ে বলা যেত, রাজা কীভাবে তখন তখনি একজনকে বললেন এক বস্তা শস্য নিয়ে আসতে, কীভাবে সেই শস্যদানা গুনে গুনে রাখা হল—লু কথা থামিয়ে হঠাৎ দাবার ছকের দিকে তাকায়, সিডিসি তাকে একটা কঠিন পাচে ফেলার চেষ্টা করছে। মন্ত্রীটাকে দুঘর পিছিয়ে এনে সে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।

প্রায় আধ ঘন্টা পর সিডিসি হঠাৎ শব্দ করতে থাকে, দাবা খেলায় কোনো একটা চাল যদি তার পছন্দ হয়, তা হলে সেটার উপর বক্তৃতা দেয়ার তার একটা বাতিক আছে, লু অবশ্যি কখনো তাকে সে সুযোগ দেয় না, এবারেও দিল না। সিডিসি খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তার ঘোড়াটাকে দুঘর পিছিয়ে আনে।

লু চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি ঘোড়াটাকে ওখানে দিচ্ছ মানে? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? কম্পিউটার হয়ে জন্ম হয়েছে বলে মনে কর ইচ্ছে চাল দিয়ে বেঁচে যাবে তুমি?

বিপ বিপ বিপ।

ধেত্তেরি তোমার বিপ বিপ বিপু, ঘোড়াটা খেয়ে খেলা শেষ করতে গিয়ে থেমে গেল লু। সিডিসি তে ভুল করার পাত্র নয়, তা হলে কি ভুল চাল চেলে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে? হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে সিডিসিকে কথা বলার সুযোগ করে দিল লু।

ধন্যবাদ মহামান্য লু, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি ভুল চালটি কি জন্যে দিয়েছি বুঝতে আপনার চার সেকেন্ডের বেশি সময় লেগেছে। একটি জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, আপনার কিছু করার নেই, কিন্তু তবু আপনি হয়তো জানতে চাইবেন।

কি হয়েছে?

সিসিয়ান থেকে যে-স্কাউটশিপটি ট্রাইটনে পাঠানো হয়েছে, সেটার গতিবেগ দ্রুত কমে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব গত নয় মিনিটে আটাত্তর দশমিক চার ভাগ বেড়ে গিয়েছে। কারণ এখনো জানা নেই। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এরকম থাকলে স্কাউটশিপটি বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা, আমি স্কাউটশিপের গতিপথ পরিবর্তন করে দিচ্ছি যেন স্কাউটশিপটি ধ্বংস না হয়। এ প্রসঙ্গে আপনাকে স্মরণ করানো যায় যে, তেইশ শত বাইশ সালে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে

লু সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে সিডিসির মতো কম্পিউটার সন্দেহ করছে যে স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হতে পারে। গত শতাব্দীতে হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু এই শতাব্দীতে? লু দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে কন্ট্রোল রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। একটা-কিছু গণ্ডগোল আছে কোথাও।

লুকে দেখে কিম জিবাল এগিয়ে আসে, লু, তুমি জান কী হয়েছে?

লু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, সিডিসি বলেছে আমাকে।

কি বলেছে?

ট্রাইটনে বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে গিয়েছে বলে স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হতে পারে।

বিধ্বস্ত হতে পারে নয়, হয়ে গেছে।

লু চমকে উঠে কিম জিবানের দিকে তাকায়, তার নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না, কী বললে তুমি!

বলেছি, স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

সিডিসি কি করল, বাঁচাতে পারল না? একটা বাড়তি গ্রাস্ট দিয়ে প্রজেকশান অ্যাঙ্গেল সাত ডিগ্রী বাড়িয়ে দিত—

চেষ্টা করেছিল, পারে নি। কিম জিবান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, লু চল আমরা পালাই, হাইপারডাইভ দিয়ে দিই।

সত্যি দিতে চাও?

হ্যাঁ।

তারপর বিজ্ঞান আকাদেমিকে কী বলবে? তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে, যে, এখানে আমাদের বিপদের আশঙ্কা আছে?

দেখছ না স্কাউটশিপটা কী ভাবে শেষ করে দিল। আমাদের শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে?

স্কাউটশিপ কোনো প্রাণী ধ্বংস করে নি কিম, বাতাসের ঘনত্ব হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে গতিবেগ কমে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। কোনো প্রাণী একটা গ্রহের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন করতে পারে না।

লু আর কিম জিবানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অন্যেরা ওদের কথা শুনছিল, রু-টেক একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা কথা বলি লু?

বল।

বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় গতিবেগ কমে গেলে সেটার দায়িত্ব নেয়া খুবই সহজ ব্যাপার, স্কাউটশিপের ছোট একটা কম্পিউটারই সেটার দায়িত্ব নিতে পারত, কিন্তু স্কাউটশিপের দায়িত্বে ছিল সিডিসির মতো একটা কম্পিউটার, এর পরও যখন স্কাউটশিপ ধ্বংস হয়েছে, তার মানে ব্যাপারটি এত সহজ নয়।

লু মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমার সাথে পুরোপুরি একমত রু–টেক, ব্যাপারটি সহজ নয়, কিন্তু তার মানে এই না যে ব্যাপারটি একটা বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ। একটা প্রাণী কী ভাবে কয়েক হাজার মাইল এলাকায় বাতাসের ঘনত্ব পাল্টাতে পারে?

পল কুম বলল, তুমি ধরে নিচ্ছ বুদ্ধিমান প্রাণী হলেই সেটার ক্ষমতা তোমার দেখা অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর সমান হবে, তার বেশি হতে পারে না?

লু একটু হেসে বলল, কি হতে পারে আর কি হতে পারে না সেটা কেউ জানে না। তাই আমাদের যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেটুকু জানি সেটার উপরেই নিতে হয়, আমাকে ধরে নিতে হবে বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থাকে সেটা আর অন্য দশটা বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো হবে।

পল কুম আপত্তি করে কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, লু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, পল, তুমি যেটা বলতে যাচ্ছ, সেটা কি তর্কের খাতিরে বলছ, না সত্যি বিশ্বাস কর?

পল একটু থতমত খেয়ে থেমে যায়, এক মুহূর্ত কী—একটা ভেবে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ঠিকই ধরেছ, তর্ক করার জন্যে বলছিলাম।

তাহলে এখন বলো না, এমনিতেই আমার একটা-কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বারটা বেজে যাচ্ছে।

সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, তাহলে কী ঠিক করা হল, এটা কি একটা দুর্ঘটনা, নাকি উন্নত কোনো প্রাণীর কাজ?

লু গম্ভীর গলায় বলল, আপাততঃ ধরে নেয়া হচ্ছে এটা একটা দুর্ঘটনা। আমি এখন সিডিসিকে নিয়ে বসব, স্কাউটশিপ থেকে পাঠানো সব ছবি, খবরাখবর বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এর পিছনে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাত আছে কি না।

সবকিছু বিশ্লেষণ করতে অনেকক্ষণ লেগে গেল। স্কাউটশিপটি ধ্বংস হয়েছে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বের তারতম্যের জন্যে, সিডিসি কেন সেটাকে বাঁচাতে পারে নি, তার কারণ খুব সহজ। স্কাউটশিপে কোনো একটা নির্দেশ পাঠালে সেটাকে কার্যকর করতে যতক্ষণ সময় লাগে, বাতাসের ঘনত্ব তার আগেই পাল্টে যায়। লু অনেক চেষ্টা করল স্কাউটশিপ থেকে পাঠানো ছবিগুলিতে কোথাও কোন ধরনের মহাকাশযান বা কোন ধরনের প্রাণী দেখা যায় কি না দেখতে, কিন্তু কিছু দেখা গেল না।

লু যখন সিডিসির সাথে বসে খবরাখবরগুলি বিশ্লেষণ করছিল, অন্যেরা তখন কন্ট্রোল-রুমে বসে। সুশান বসেছে জানালার পাশে, একটু পরপর হটাকে দেখছে, ভিতরে কেমন একটা আতঙ্ক, শুধু মনে হচ্ছে গ্রহটা থেকে হঠাৎ করে কোনো একটা প্রাণী ছুটে আসবে তাদের দিকে। নীষা তার ব্যক্তিগত কম্পিউটারে টুকটুক করে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করাচ্ছিল, নুতন একটা ভাষা তৈরি করছে সে, তার কোনো কাজ না থাকলেই সে একটা নুতন ভাষা তৈরি করা শুরু করে। এটা তার চৌদ্দ নম্বর ভাষা। কিম জিবান পুরনো একটা হাসির বই বের করে পড়ে শোনানোর চেষ্টা করছে, কারো শোনার ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না, হাসির জায়গাগুলিতে ভদ্রতা করেও কেউ হাসছে না, কিন্তু কিম জিবানের সেটা নিয়েও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। হঠাৎ সিডিসি একটা জরুরি সংকেত দিল। সিডিসি কথা বলার চেষ্টা করলে কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, কিন্তু জরুরি সংকেত হচ্ছে অনা ব্যাপার, সবাই তখন একসাথে ছুটে আসে। কি হয়েছে সবার আগে বুঝতে পারে রু-টেক, রবোট বলে সে মাইক্রোসেকেন্ডে সিডিসির সাথে খবর বিনিময় করতে পারে। পল কুম রু-টেককে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে রু-টেক?

রু-টেক এক মূহুর্ত ইতস্তত করে বলল, সিডিসি বলছে যে স্কাউটশিপটা ট্রাইটনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেটা–

সেটা কী?

সেটা নাকি আবার উঠে আসছে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। সবচেয়ে আগে কথা বলল সুশান, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কেউ আছে? কোনো প্রাণী?

না। ভিতরে নূতন কিছু নেই, আমরা যা পাঠিয়েছিলাম তাই আছে। রু-টেক একটু  থেমে যোগ করল, সিডিসি তাই বলছে।

ঘটনার চমকটা কাটতেই সিসিয়ানে প্রথমবার একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। সবাই মিলে স্কাউটশিপের নানারকম খবরাখবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিম জিবান বড় মনিটরটিতে স্কাউটশিপের ছবিটাকে ফুটিয়ে তোলে, ঠিক যেভাবে পাঠানো হয়েছিল সেভাবেই ফিরে আসছে, দু’পাশের অত্যন্ত ভঙ্গুর দু’টি এন্টেনা পর্যন্ত আগের মতো আছে। লু ঠোঁট কামড়ে বলল, ট্রাজেক্টরিটা বের কর।

কিম জিবান কয়েকটা বোতাম টিপে মনিটরে কী-একটা পড়ে বলল, চার দশমিক দুই, এপিসেন্টার তিন ডিগ্রী।

আমরা যে-পথে পাঠিয়েছিলাম সেই পথে ফিরে আসছে?

হ্যাঁ।

লু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, স্কাউটশিপটা আসলে ধ্বংস হয় নি, আমাদের ধোঁকা দেয়া হয়েছিল।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলে না। পল কুম চিন্তিত মুখে বলল, সিডিসি, তোমার কী ধারণা?

সিডিসি জানাল, স্কাউটশিপ থেকে যেসব তথ্য এসেছে সেটা থেকে প্রায় নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় স্কাউটশিপটি ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু যেহেতু সেটি আবার উঠে আসছে, তার মানে আসলে সেটি ধ্বংস হয় নি, স্কাউটশিপে পাঠানো খবরাখবরে কোনো একটা জটিল ত্রুটি ছিল, সেটি কী, সিডিসি এখন বের করার চেষ্টা করছে।

লু গম্ভীর গলায় বলল, পল আর সুশান, তোমরা দু’জন স্কাউটশিপটিকে যা করতে পাঠিয়েছিলে সেটা করা হয়েছে কি না দেখ। আর জিবান, তুমি হাইপারডাইভের সার্কিটটা চালু করে রাখ।

সুশান আর পল কুম নিজেদের ল্যাবরেটরিতে বসে স্কাউটশিপে পাঠানো বিভিন্ন জৈবিক পদার্থগুলি পরীক্ষা করতে থাকে। স্কাউটশিপের কম্পিউটারে কোনো সমস্যা নেই, নির্দেশ পাঠানোমাত্রই সেটি সিডিসির সাহায্য নিয়ে তার কাজ শুরু করে দেয়। একটি একটি করে সবগুলি জিনিস পরীক্ষা করে দেখা হয়, কোনোটাতে কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই। যখন মাত্র দু’টি জিনিস পরীক্ষা করা বাকি তখন হঠাৎ পল কুমের ভুরু কুঁচকে ওঠে। সুশান এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে পল?

এই দেখ।

সুশন নিরীহ গোছের একটা গ্রাফের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, এটা তো আমরা পাঠাই নি।

না।

কোথা থেকে এল?

আসার কথা নয়। প্রচণ্ড রেডিয়েশনে মিউটেশান হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আর কোথাও তো মিউটিশানের চিহ্ন নেই।

তা হলে?

এক হতে পারে কোনো ধরনের আঘাতে ক্রোমোস্কোপের ক্যালিব্রেশান যদি নষ্ট হয়ে থাকে।

লু’য়ের সাথে কথা বলবে?

ডাক।

লুয়ের সাথে সাথে পুরো দলটি হাজির হয়। লু একটু শঙ্কিত স্বরে বলল, কিছু হয়েছে পল?

বলা মুশকিল, সবগুলি পরীক্ষার ফল বলছে গ্রহটিতে উন্নত কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। শুধু একটি পরীক্ষা বলছে অন্যরকম।

সেইটি কী বলছে?

পল অস্বস্তির সাথে মাথা চুলকে বলল, ঠিক করে বলা মুশকিল। অন্যান্য জিনিসের সাথে আমরা খানিকটা জটিল জৈবিক পদার্থ পাঠিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল যদি কোনো উন্নত প্রাণীর কাছাকাছি আসে, সেটাতে একটা কম্পন ধরা পড়বে, মেগাসাইকেল রেঞ্জের কম্পন।

দেখা গেছে?

না, কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার হয়েছে। কি?

জৈবিক পদার্থটি পাল্টে গেছে, আমরা যেটা পাঠিয়েছিলাম সেটা আর নেই, অন্য একটা কিছু আছে।

লু ভুরু কুঁচকে বলল, অন্য কিছু?

হ্যাঁ।

অন্য কিছু কোথা থেকে আসবে?

আসার কথা নয়, সেটাই হচ্ছে ধাঁধা। এক হতে পারে শক্ত কোনো আঘাতে ক্যালিব্রেশানটি নষ্ট হয়ে গেছে, খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব নয়। ট্রিনিটিতে একবার হয়েছিল বলে শুনেছিলাম।

অন্য কোনোভাবে হতে পারে?

না। সুশান, তুমি কী বল?

সুশান চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে, এক হতে পারে যে কেউ এসে এটা পাল্টে দিয়ে গেছে। কিন্তু কে এসে স্কাউটশিপে ঢুকে এরকম একটা কাজ করবে যে আর কোথাও তার কোনো চিহ্ন থাকবে না?

লু চিন্তিতভাবে নিজের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। গ্রহটির সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে। ছোট ছোট অনেকগুলি ঘটনা ঘটল, যার প্রত্যেকটা রহস্যময়, মনে হয় অসাধারণ কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ, কিন্তু সবগুলিতেই কেমন জানি সন্দেহ রয়ে গেছে, সবগুলিকে মনে হয় ছোট ছোট দুর্ঘটনা।

লু সুশান আর পল কুমের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ, তোমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পার কিনা। যদি প্রমাণ করতে পার এখানে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই, তা হলে আমরা চলে যেতে পারি, আবার যদি প্রমাণ করতে পার এখানে অসাধারণ বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী আছে, তা হলেও আমরা চলে যেতে পারি।

 

স্কাউটশিপটা ফেরত এসে সিসিয়ান থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দুরে এসে দাঁড়ায়, সে-রকমই কথা ছিল। ট্রাইটন থেকে যেসব জিনিসপত্র তুলে এনেছে সেগুলি আরো সুচারুভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, সিলিকনের নানা ধরনের অনু, বিচিত্র ধরনের পলিমার, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নেই। পল কুম নানাভাৰে তার সবকিছু পরীক্ষা করে দেখল, কিন্তু সেই অস্বাভাবিক জৈবক পদার্থটির কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না।

ঘন্টা দুয়েক পর পল কুম একটা আশ্চর্য প্রস্তাব করে, সে স্কাউটশিপে গিয়ে জৈবিক পদার্থটি পরীক্ষা করে দেখে আসতে চায়।

লু এক কথায় তার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়, নিরাপত্তার খাতিরে সে কাউকে সিসিয়ানের বাইরে যেতে দেবে না। পল বেশি অবাক হল না,লু তাকে যেতে দেবে, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে নি।

সিসিয়ানে আরো ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল, কোনো কিছুই ঠিক করে জানা নেই, সবার ভিতরে একটা অনিশ্চয়তা, একটা অস্থিরতা। সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক রেখে কী ভাবে গ্রহটা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, লু বা অন্য কেউ ভেবে পাচ্ছিল না।

পল আরো কয়েকবার লুয়ের কাছে স্কাউটশিপে যাবার অনুমতি চাইল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। পলের যুক্তি কিন্তু খুব সহজ, সিসিয়ানে থেকে তারা সন্দেহাতীতভাবে ট্রাইটনে কোনো উন্নত প্রাণীর চিহ্ন পায় নি। একটি মাত্র প্রমাণ থাকতে পারে স্কাউটশিপে, যদি সেটি সত্যি দেখা যায় তা হলে বুঝতে হবে এখানে সত্যি অসাধারণ বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তা হলে সবাই ফিরে যেতে পারে। আবার যদি দেখা যায় জিনিসটি একটা যান্ত্রিক গোলযোগ, তাহলেও তারা ফিরে যেতে পারে, কারণ গ্রহটিতে বুদ্ধিমান বা বোকা কোনো প্রাণই নেই। জিনিসটি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার একটিমাত্র উপায়, সিসিয়ান থেকে কোনাস নামে একটি জটিল যন্ত্র নিয়ে স্কাউটশিপে যাওয়া। স্কাউটশিপে কোনাস দেয়া হয় নি, কারণ এটার প্রয়োজন হতে পারে, কারো জানা ছিল না।

লু রাজি না হলে স্কাউটশিপে যাওয়া সম্ভব না, তবু পল কুম সিডিসিকে এরকম। একটা যাত্রায় বিপদের ঝুঁকির একটা পরিমাপ করতে আদেশ দিল। সিডিসির হিসেব দেখে লু শেষ পর্যন্ত একটু নরম হয়, কারণ সিডিসির মতে স্কাউটশিপের ভিতর আর সিসিয়ানের ভিতরে বিপদের ঝুঁকি প্রায় এক সমান। স্কাউটশিপে যাওয়া ব্যাপারটিতে খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু তার পরিমাণ এখানে এক দিন বেশি থাকার অনিশ্চয়তা থেকে কম। কাজেই পল কুম স্কাউটশিপে গিয়ে যদি সবাইকে নিয়ে এক দিন আগে ফিরে যেতে পারে, সেটা সবার জন্যে ভালো। তবে সিডিসি জানিয়ে দিল, পল যে পোশাক পরে যাবে সেটা সে সিসিয়ানে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সেটি এমন কিছু জটিল ব্যাপার নয়, রুটিনমতো অনেকবার করা হয়েছে।

লু শেষ পর্যন্ত রাজি হল, কিন্তু পলকে সে একা যেতে অনুমতি দিল না, রু-টেককে সাথে নিয়ে যেতে হবে। কাজটি একজনের কাজ, কিন্তু রু-টেক থাকবে নিরাপত্তার জন্যে। রু-টেক রবোট বলে তার কর্মক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ থেকে অনেক গুণ বেশি।

পল কুম বিশেষ পোশাক পরে সাথে সাথে প্রস্তুত হয়ে নেয়, রু-টেকের বিশেষ পোশাকের প্রয়োজন নেই, কয়েকটা সুইচ টিপে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। পল কুমের পিঠে ক্রুকোলাস নামের সেই বিশেষ যন্ত্রটি, রু-টেকের পিঠে একটা অ্যাটমিক ব্লাস্টার; প্রয়োজনে সেটা দিয়ে একটা ছোটখাটো উপগ্রহ উড়িয়ে দেয়া যায়। দু’জন হাতে দুটি ছোট জেট নিয়ে বিশেষ ডকে এসে হাজির হয়। উপর থেকে ঢাকা দিয়ে ঢেকে তাদের আলাদা করে ফেলার আগে কিম জিবান পল কম আর রু-টেকের হাত ধরে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সাবধানে থেকো।

পল কুম হেসে বলল, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ করো না।

কয়েক মিনিটের ভিতরে ডকের সব বাতাস সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে একটা গোল গর্ত দিয়ে সিসিয়ানের বাইরে বের করে দেয়া হয়। দু জন তাদের জেটগুলি চালু করে দিতেই মাথায় লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। সিসিয়ানের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে পল কুম আর রু-টেক দ্রুত তাদের থেকে সরে যাচ্ছে।

তখনো কেউ জানত না তাদের পরবর্তী দুঃস্বপ্নের সেটা ছিল শুরু।