বিষয়বস্তু (উপনিষদ)
গবেষকরা মনে করেন যে, দীর্ঘতম দুটি উপনিষদই প্রাচীনতম, ব্যাপকতম এবং সর্বাধিক তাৎপৰ্যপূর্ণ এবং উভয়ই ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের নিরবিচ্ছিন্ন ধারারূপে গদ্যে রচিত; এরা হল বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য। শুক্ল যজুর্বেদের অন্তর্গত বৃহদারণ্যকে প্রবর্গ্য অনুষ্ঠান সম্পর্কে তিনটি প্রাথমিক আরণ্যক বৈশিষ্ট্যযুক্ত অধ্যায় রয়েছে; এর দুটি উপনিষদ-ধর্মীয় অধ্যায়ের মধ্যে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়কে যথার্থ উপনিষদের উপাদানযুক্তরূপে গ্ৰহণ করা যায়। প্ৰথম অধ্যায় প্রাণ, মৃত্যু ও পুরুষের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছে; উপদেশমূলক ক্ষুদ্র আখ্যান ও সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্রাণের শ্ৰেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে গার্গ্য ও অজাতশত্রুর সংলাপ। এখানে আমরা যাজ্ঞবল্ক্য ও দধ্যঙঅথর্বণের মতো বিখ্যাত ঋষির সঙ্গে পরিচিত হই; এতে রয়েছে বাণপ্রন্থে উদ্যত যজ্ঞবল্ক্য ও তার জ্ঞানপিপাসু পত্নী মৈত্রেয়ীর সুপরিচিত সংলাপ। তৃতীয় অধ্যায়ে রাজা জনকের সভায় সমবেত দার্শনিকদের সঙ্গে যাজ্ঞবাল্ক্যের ও চতুর্থে জনক ও যাজ্ঞবাল্ক্যের সংলাপ। পঞ্চম অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রেততত্ত্ব ও নীতিবিদ্যার মতো জটিলতর বিষয় বর্ণিত। শেষ অধ্যায়ে পাওয়া যায় পরস্পর-অসম্পৃক্ত বিবিধ বিষয়বস্তু। যথার্থ আধ্যাত্মিক বিষয়, যেগুলি উপনিষদের ভাবকেন্দ্ৰ গঠন করেছে, সেগুলি প্রথম ও শেষ দুটি অধ্যায়ে সম্ভবত পূর্বগঠিত রচনার সঙ্গে সংযোজিত হয়েছিল।
সামবেদের অন্তর্গত ছান্দোগ্য উপনিষদের ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন; এখানে প্রকৃত উপনিষদের অংশটি রয়েছে শেষ তিনটি অধ্যায়ের উপসংহারে। প্রথম তিনটি অধ্যায় সম্পূর্ণত ব্ৰাহ্মণ্য বৈশিষ্ট্যযুক্ত; এতে যজ্ঞানুষ্ঠান বিধি ও তৎসম্পর্কিত মতবাদগুলি আলোচিত হয়েছে; এতে একটি সংক্ষিপ্ত সৃষ্টিতত্ত্বমূলক অংশ ও একটি অধ্যাত্মবাদী বিবরণ রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা একটি প্রতীকী তাৎপর্যযুক্ত দেবকাহিনী পাই, যাতে সূর্যকে বিশাল মধুচক্র ও পৃথিবীকে বিরাট মঞ্জুষা রূপে বর্ণনা করে সূর্যের উৎস ও উপাসনা আলোচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে রৈক্ক, জবাল ও উপকৌশলের প্রতি সত্যকামের উপদেশ বিবৃত। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে জৈবলির আলোচনা; এর সঙ্গে বৃহদারণ্যক উপনিষদের অনুরূপ বিবৃতির নিবিড় সাদৃশ্য চোখে পড়ে। ছ’জন দার্শনিক সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা ব্যক্তি করার পর, উপসংহারে জৈবলি এদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। প্রকৃত অধ্যাত্মবাদী অংশের সূচনা ষষ্ঠ অধ্যায়ে যেখানে উপনিষদের মহাবােক্যরূপে পরিচিত ভাবনাটি-“তৎ ত্বম অসি” বা ‘তুমি-ই সেই’ অভিব্যক্ত হয়েছে। শতপথ ব্ৰাহ্মণে প্রখ্যাত ঋষিদের অন্যতম আরুণি তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে গূঢ়বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। প্রসঙ্গত বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, বৃহদারণ্যক উপনিষদে অধিকতর অতীন্দ্ৰিয়বাদী সত্যের উপস্থাপয়িতা। যাজ্ঞবল্ক্য এই আরুণিরই শিষ্য ছিলেন। সপ্তম অধ্যায়ে নারদ ও সনৎকুমারের সংলাপে প্রধানত ধ্যানের মনস্তত্ত্ব ও ভূমার কথা আলোচিত হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে ব্রহ্মোলব্ধি অর্জনের উপায় ও ব্রহ্মের প্রকৃতি সম্পর্কে নির্দেশ রয়েছে। এক্ষত্রে প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ের বিবিধ বিষয়বস্তুই যেন ক্ৰমে শেষ তিনটি অধ্যায়ে নিহিত মৌলিক উপনিষদীয় ভাবনায় পরিণতি লাভ করেছে। পরবর্তীকালে যজুর্বেদের উপনিষদগুলি সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল; তাই মহাকাব্যগুলি তাদের মধ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃতি চয়ণ করেছে।
শুক্ল যদুর্বেদের অন্তর্গত ঈশোপণিষদ এই শ্রেণীর রচনার মধ্যে ক্ষুদ্রতম; এতে মাত্র আঠারটি শ্লোক রয়েছে। এই রচনায় কর্ম ও জ্ঞানের দ্বৈতবোধকে উন্নততর আধ্যাত্মিকপ্ৰাপ্তির স্তরে সমন্বিত করার চেষ্টা রয়েছে; সেইসঙ্গে প্ৰথম আমরা ক্ষুদ্র একটি বর্ণনীয় দার্শনিক স্থৈৰ্যসম্পন্ন পুরুষ অর্থাৎ স্থিতধীর সাক্ষাৎকার লাভ কবি, পরবর্তীকালে যার ভাবরূপ ভগবদ্গীতায় বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল।
সামবেদের কোনোপনিষদে যে চারটি অধ্যায় আছে, তাদের মধ্যে প্রথম দুটি ছন্দে রচিত এবং তাতে সৃষ্টিতত্ত্ব ছাড়াও ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার মৌল প্রেরয়িতারূপে আত্মার ভূমিকা বিবৃত হয়েছে। শেষ অংশটিতে আত্মার জ্ঞানতত্ত্ব রহস্যগৃঢ়ভাবে আলোচিত হয়েছে। গদ্যে রচিত শেষ দুটি অধ্যায়ে পরমাত্মা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য দেবতাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বর্ণিত; পরমাত্মা বিষয়ক জ্ঞান লাভে পর পর সবকটি দেবতার ব্যর্থতার পর উমা হৈমবতী ঘোষণা করলেন, এই হ’ল ব্ৰহ্ম।
ঋগ্বেদের ঐতরেয় উপনিষদে তিনটি অধ্যায় আছে। প্রথমটিতে বিরাজের মাধ্যমে আত্মা থেকে সৃষ্টি ও সেইসঙ্গে সৃষ্টির বিভিন্ন উপাদান এই প্ৰথমবার বিবৃত; উপনিষদের মৌলিক মতবাদগুলির অন্যতম যে অণুবিশ্ব ও ব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে সাযুজ্যবোধ–তা এখানে প্রতিফলিত। সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় অধ্যায়ে মানুষের ত্ৰিবিধ জন্ম-গর্ভাধান, স্বাভাবিক জন্ম ও পুত্রের মধ্যে আত্মসম্প্রসারণে যে জন্ম, তা আলোচিত হয়েছে। শেষ অধ্যায়ে আত্মার ইন্দ্ৰিয়াতীত প্ৰকৃতি ও বুদ্ধির সঙ্গে তার সম্পর্ক বামদেব ব্যাখ্যা করেছেন।
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় উপনিষদেও তিনটি অধ্যায় আছে। ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা দিয়ে শুরু হয়ে পরে অতিজাগতিক, জ্যোতির্বিদ্যাগত, বোধিগত, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের মধ্যে প্রায় অতীন্দ্ৰিয় সম্পর্ক বিবৃত করেছে। এতে রয়েছে ত্রিশঙ্কুর দুটি নিগূঢ় রহস্যপূর্ণ বিবৃতি। শেষ অধ্যায়ে বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে ব্ৰহ্মাকে উপমিত করা হয়েছে; এগুলি হল অন্ন, প্রানবায়ু, মন, জ্ঞান ও আনন্দ; বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে প্রশ্ন। শেষ অধ্যায়ের বিভিন্ন অংশে আরণ্যক ও ব্ৰাহ্মণের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
ঋগ্বেদের কৌষীতকি উপনিষদে যে চারটি অধ্যায় রয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটিতে পিতৃযান ও দেবযান আলোচিত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত বিবিধ বিষয়গুলির রচয়িতারূপে কৌষীতকি, পৈঙ্গ্য ও শুষ্কভূঙ্গারের নাম উল্লিখিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে তাতে বহু সমসাময়িক সামাজিক রীতিনীতিও প্রতিফলিত হয়েছে। ঋগ্বেদীয় উপনিষদ ব’লেই কৌষীতকির সঙ্গে ইন্দ্ৰ সম্বন্ধে দেবকাহিনীগুলির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে; ইন্দ্রকে তার পূর্বতন অভিযানের জন্য দম্ভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এখানে বলা হয়েছে যে, ইন্দ্ৰকে জানা-ই সর্বোত্তম কল্যাণের কারণ। তৃতীয় অধ্যায়ে প্ৰাণের মহিমা কীর্তিত; শেষ অধ্যায়ে বালাকি-অজাতশত্রুর কাহিনী পুনরাবৃত্ত হয়েছে যা ইতিপূর্বে বৃহদারণ্যকে উপনিষদে কথিত। শেষ অধ্যায়ে স্বপ্নের বিশ্লেষণও গুরুত্ব পেয়েছে, তবে তার প্রধান বর্ণনীয় বিষয় হ’ল প্রেততত্ত্ব, আরো স্পষ্টভাবে বলা যায়, পুনর্জন্মবাদ।
কঠ, মুণ্ডক ও শ্বেতাশ্বতর অর্বাচীনতর, পদ্যে গ্রথিত উপনিষদ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাববস্তুর বিচারে পরস্পরের নিকটবর্তী। এদের মধ্যে কঠোপনিষদের দুটি অধ্যায় আছে, তবে এটা স্পষ্ট যে, মূল বচনাটি তিনটি অংশে বিন্যস্ত প্ৰথম অধ্যায়েই সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে প্ৰথম অধ্যায়ে উত্থাপিত একটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে। তাই মনে হয় যে, প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যবর্তী অংশ পরবর্তীকালে প্ৰক্ষিপ্ত হয়েছিল।
অথর্ববেদের অন্তৰ্গত মুণ্ডক উপনিষদ সম্ভবত কোনো মুণ্ডিত-মস্তক সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের দ্বারা বা তাদের জন্য রচিত হয়েছিল; গদ্যে ও পদ্যে গ্রথিত এই উপনিষদের সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রক্রিয়ার নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও এতে প্রচুর অতীন্দ্ৰিয়-প্রবণতা নিহিত রয়েছে। মুণ্ডক এবং কেন–এই উভয় রচনাতেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এবং সেই সঙ্গে শৈব প্রবণতার অভিব্যক্তি স্পষ্ট। তিনটি অধ্যায়যুক্ত মুণ্ডক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে বিবৃত আনুষ্ঠানিক প্রতীকায়নের প্রবণতা সত্যের বহু প্রতীকী উপস্থাপনার মাধ্যমে অধ্যাত্মবাদে উপনীত হয়েছে। শেষ অধ্যায়টি চরিত্রগত বিচারে অধিকতর অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী এবং তা ব্ৰহ্মের স্বভাব ও পরম উপলব্ধির জন্য ব্ৰহ্ম-সান্নিধ্য লাভের উপায় বর্ণনা করেছে।
অথর্ববেদের জন্য একটি উপনিষদ–মাণ্ডুক্য মাত্ৰ বারোটি সংক্ষিপ্ত বিভাগের মধ্যে পরবর্তীকালের বেদান্ত দর্শনের মৌলিক মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্য গ্রথিত গদ্যে এই উপনিষদ ব্ৰহ্মা সম্পর্কে উপদেশ প্রচার করেছে; অন্তর্বস্তুর বিন্যাসের ক্ষেত্রে রচনাটি অধিকতর নিগূঢ় রহস্যদ্যোতক।
কৃষ্ণ যদুর্বেদের অন্তৰ্গত শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শৈব বিষয়বস্তু লক্ষণীয়; গ্রন্থের দুটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথমটিই সম্ভবত মৌলভাবকেন্দ্ৰকে ধারণ করেছে, কারণ তাতে কেন্দ্রীয় বাক্যাংশটি পুনরাবৃত্ত হয়েছে, যা রচনার সমাপ্তিসূচক। এই অধ্যায়ে সমসাময়িক মতবাদগুলি পর্যালোচিত–এমনকি তৎকালীন ক্রমবিবর্তিত আত্মতত্ত্বও এর মধ্যে আছে–কিন্তু বিচারে প্রত্যেকটি মতবাদ যেহেতু অপর্যাপ্ত বিবেচিত হয়েছে, তাই শেষ পর্যন্ত সুস্পষ্ট সাংখ্য-প্রবণতাযুক্ত শৈব মতবাদই এতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এর ঈশ্বরভাবনায় বেদান্তের ব্ৰহ্মা যেন সাংখ্যের পুরুষের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সমীপবর্তী যোগতত্ত্বকে লক্ষ্যপ্ৰাপ্তির উপায়রূপে আলোচনা করা হয়েছে। পরবর্তী তিনটি অধ্যায়ে সাংখ্য-যোগ মতবাদ ব্যাপকতরভাবে বিশ্লেষিত। ষষ্ঠ অধ্যায়ে সরূপ ঈশ্বরের অভিব্যক্তিরূপে এমন দেবতাকে উপস্থাপিত করা হয়েছে যিনি পরবর্তীকালে গুরুবাদ ও ভক্তিবাদ-সংশ্লিষ্ট পূজা-পদ্ধতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। অবশ্য তখনো পর্যন্ত অস্পষ্ট ধারণার স্তরে বিরাজমান সাংখ্য মতবাদ ‘প্রধান’কে বিমূর্ত তত্ত্বরূপে উপস্থাপিত না করে দেবতারূপেই তুলে ধরেছে; তেমনি প্রারম্ভিক স্তরে বিদ্যমান বেদান্ত দর্শনের ‘মায়া’ এখানে সাংখ্যে কথিত প্ৰকৃতিরূপে উপস্থিত। পুরুষ, প্রকৃতি ও তিনগুণের মতো মৌলিক সাংখ্য উপাদানগুলি এখানে পাওয়া যাচ্ছে; সৃষ্টি ও বিবর্তনরূপে বৰ্ণিত এবং মনস্তত্ত্ব ও অধ্যাত্মবিদ্যার প্রতি সাংখ্য দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
কৃষ্ণ-যজুর্বেদের মৈত্রায়ণীয় বা মৈত্রী উপনিষদ ব্ৰাহ্মণ-শৈলীর গদ্যময় বাক্যে রচিত ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থ। উপনিষদগুলির মধ্যে অর্বাচীনতম এই রচনাটি সাতটি প্ৰপাঠকে সম্পূর্ণ, তবে স্পষ্টতই এটি বহিরাগত উপাদানের দ্বারা ক্রমাগত পরিবর্ধিত হয়েছিল। ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিবিধ বিষয়বস্তু উপস্থাপিত হয়েছে, যা প্রসঙ্গত সেই যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে যথেষ্ট আলোকপাত করে। সাংখ্য ও যোগ যেমন প্ৰধান্য পেয়েছে, তেমনি ত্রয়ী দেবতা-ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তাদের ত্ৰিবিধ গুণ ও তিনটি ভিন্ন ধরনের অতিজাগতিক ক্রিয়াকলাপসহ উপস্থাপিত হয়েছেন। দ্বিতীয় অংশে অর্বাচীনতার লক্ষণ পাওয়া যায়,–জ্যোতির্বিদ্যা প্রণোদিত অনুমান, সূর্যপূজা, সামাজিক নৈতিকতা, হঠযোগ ও যোগ্যভাসের সময়ে ধ্যানরত ব্যক্তি যে সাত প্রকার অতীন্দ্ৰিয় ধ্বনি শোনেন, তার বর্ণনা ইত্যাদি। স্পষ্টতই এগুলি উপনিষদ বহির্ভূত বিষয়বস্তু, যাদের মধ্যে লোকায়াত ধর্মের ও বিশ্বাসেব নানাবিধ উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটেছে; তখন সর্বজনগ্রাহী ধর্মীয় ভাবনায় এসব ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। সহজেই অনুমান কবা যায় যে, আলোচ্য উপনিষদটি রচিত হওয়ার পিছনে নানাবিধ পূর্বাগত অরক্ষণশীল, অব্রাহ্মণ্য ধর্মমতেব অপ্রতিরোধ্য প্রভাব ছিল, যদিও রচনায় সেসব প্রত্যাখ্যান করার ক্ষীণ ও বিশৃঙ্খল প্ৰয়াস লক্ষ্য করা যায়। ফলে আমরা পুঞ্জীভূত পরস্পর অসম্পূক্ত, পারস্পর্যহীন ও অস্পষ্ট কলেবর একটি রচনা পেয়েছি। মৈত্ৰায়ণীর উপনিষদের অর্বাচীনতাব প্রমাণ হিসাবে তাব মধ্যে বহু দেবকল্পনার উল্লেখের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়; এদিক দিয়ে তা প্ৰধান উপনিষদগুলি অপেক্ষা আস্তিক্যবাদী উপনিষদ অর্থাৎ শ্বেতাশ্বতরের বেশি কাছাকাছি।
কৃষ্ণ-যদুর্বেদের মহানারায়ণীয় বা বৃহন্নারায়ণীয় উপনিষদ প্রকৃতপক্ষে তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম অধ্যায়। পদ্যে গ্রথিত ও পাঁচটি অধ্যায় বিনাস্ত এই গ্ৰন্থ বহু পরবর্তী কালে রচিত। এতে পরবর্তীকালে সৃষ্ট মহাকাব্যিক ছন্দ অনুষ্টুপ-এর একটি অনিয়ন্ত্রিতরূপ এবং মিশ্র উপজাতি ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যথাৰ্থ ব্ৰাহ্মণ্য রীতি অনুযায়ী এ গ্রন্থ সৃষ্টিশীল পরম সত্তারূপে প্ৰজাপতিকে মহিমাম্বিত করে তাঁর সৃষ্টিকে বিবৃত করেছে। দেবসঙ্ঘও এখানে অর্বাচীনতায় প্রমাণ বহন করছে, শিব, সূৰ্য, বিষ্ণু ও কার্তিকেয়ার মতো অধিকাংশই অর্বাচীন। মহাকাব্য-পুরাণ-বৃত্তের দেবতা ছাড়াও বিভিন্ন নামে দুৰ্গাকেও উপস্থাপিত কবেছে এবং ইচ্ছামতো দানব, যক্ষ ও পিশাচদের উল্লেখ করেছে। বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশে স্ত্ৰোত্রগুলিব সঙ্গে মহাকাব্য-পুরাণ বৃত্তের বিষয়গুলির যেমন নিবিড় সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে জনপ্রিয় হয়ে-ওঠা যজ্ঞানুষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রেও এই সাযুজ্য চোখে পড়ে। স্পষ্টতই এই গ্ৰন্থ সংহিতার সুক্তিগুলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ইচ্ছামতো পূর্বতন রচনাসমূহ থেকে ঋণ গ্ৰহণ করেছে এবং সবগুলি প্ৰধান উপনিষদের সঙ্গে এটি পরিচিত। পৌরাণিক রীতি অনুযায়ী ধ্যানের নির্দেশ দিয়ে, যজ্ঞে ক্ৰটির জন্যে সমাজচ্যুতির দণ্ড বিধান করে, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়ার সুপ্রচুর অতীন্দ্ৰিয়বাদী ব্যাখ্যা দিয়ে ও নারায়ণের জন্য যথার্থ পৌরাণিক বিধি অনুযায়ী পূজার ব্যবস্থা করে, গ্রন্থটি পৌরাণিক শাস্ত্রের অধিকতর নিকটবর্তী হয়েছে। এব। সঙ্গে প্রধান উপনিষদসমূহের একটা সাধারণ ব্যবধান রচিত হয়েছে। এর প্রত্নকথা ও উপাখ্যানগুলি সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী-চরিত্রযুক্ত হওয়াতে এই সিদ্ধান্তই অনিবাৰ্য হয় যে, শ্বেতাশ্বতর ও মহানারায়ণীর একটি পৃথক শ্রেণীর রচনা; বস্তুত, এদের প্রাচীনতম সাম্প্রদায়িক উপনিষদরূপে গণ্য করা চলে। পরবর্তীকালে এই প্রবণতা অসংখ্য শৈব ও বৈষ্ণব উপনিষদের মধ্যে অব্যাহত ছিল; এসব যদিও প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক পুরাণগুলিরই সমসাময়িক, এধরনের গ্রন্থগুলি নিজেদের উপনিষদরূপে পরিচয় দিতে যত্নবান ছিল, কেননা এই নামের সঙ্গে তখনো আধ্যাত্মিক গৌরব সংশ্লিষ্ট ছিল।
মহানারায়ণীয় উপনিষদ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল; তবে শঙ্করাচার্য এই গ্রন্থের কোনো ভাষ্য প্রণয়ন করেন নি। সম্ভবত, নারায়ণভক্তদের জন্য প্রার্থনাপুস্তকরূপে এটি রচিত হয়েছিল ব’লেই নারায়ণের উদ্দেশ্যে বহু সূক্ত এতে নিবেদিত হয়েছে। বৌধায়ন-ধর্মসূত্রেও এই ঐতিহ্য জাগরকে ছিল এবং বৈখানস স্মার্ত সূত্রকে এর প্রত্যক্ষ উত্তরসূরী বলে মনে হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এই রচনা নারায়ণীয় চৰ্যার অস্তিত্বকে প্রতিফলিত করেছে এবং শেষপর্যন্ত বিশিষ্ট সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তু-সম্পন্ন পৃথক একটি ধারার তাৎপর্য অর্জন করে।
অথর্ববেদের অন্তর্গত ও ছ’টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত প্রশ্ন উপনিষদে সুপরিকল্পিত রচনা লক্ষ্য করা যায়; ছ’জন ঋষি পিপ্পলাদ ঋবির কাছে ছটি প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেসব প্রশ্নের উত্তর এই উপনিষদের অবয়ব নির্মাণ করেছে। এই প্রশ্নগুলির মধ্যে তৎকালে প্রচলিত দার্শনিক অনুসিন্ধৎসার প্রকৃতি অভিব্যক্ত হয়েছে।