বিষয়বস্তু (আরণ্যক)
ঐতরেয় আরণ্যকের প্রথম ও শেষ অধ্যায়গুলিতে মহাব্ৰত অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে, যা চরিত্রগতভাবে ব্ৰাহ্মণের সঙ্গে তুলনীয়। চতুর্থ অধ্যায়ে অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত নয়টি ঋক (শাকির ও মহানামী) বিবৃত হয়েছে; বিষয়বস্তুর বিচারে অন্তত এই অংশটি ব্রাহ্মণতুল্য। শুধু দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়কেই যথার্থ আরণ্যক লক্ষণযুক্ত বলে গ্ৰহণ করা যায়। গভীরতর বিচারে দেখা যায় যে, এই আরণ্যক বস্তুত ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের অন্তৰ্গত উপবিভাগ বা কাণ্ডমাত্র। যথার্থ ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী পাঁচটি অধ্যায়ের মধ্যে তিনটিতে যজ্ঞানুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে, নিতান্ত প্ৰসঙ্গক্রমে তাতে কাল্পনিক ব্যুৎপত্তি ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়। চিত্রকল্পগুলিতে ব্যবহৃত ব্যাকরণত অনুপুঙ্খাসমূহের সঙ্গে পরিচিতির ইঙ্গিত থাকায় ঐতরেয় আরণ্যকের অর্বাচীনতা স্পষ্ট।
ঋগ্বেদের অপর আরণ্যকের নাম শাখায়ন বা কৌষীতকি আরণ্যক, এর পনেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম দুটিতে মহাব্ৰত অনুষ্ঠান বিবৃত হয়েছে এবং তা ব্ৰাহ্মণ অংশেরই অন্তর্গত। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে যজ্ঞানুষ্ঠানের তাৎপর্য সম্পর্কে চিত্রগার্গ ও শ্বেতকেতুর মধ্যে সংলাপ। চতুর্থ অধ্যায়ে কৌষীতকি পৈঙ্গেয় ও শুষ্কতৃঙ্গারের মধ্যে একটি সংলাপে একটি সাধারণ বিষয়বস্তু–প্রাণ ও ইন্দ্ৰিয়সমূহের প্রতিযোগিতা চিত্রিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে প্ৰতর্দন ও ইন্দ্রের সংলাপ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে গাগ্য ও অজাতশত্রুর সংলাপ। শেষ অধ্যায়ের একটি অংশে এই আরণ্যক স্পষ্টত নতুন সাহিত্যাদর্শের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছে। প্রতীকী বিশ্লেষণের প্রতি প্রবণতার মধ্যে। বিষয়বস্তুর মধ্যেও ঔপনিষদিক ভাবধারার উন্মেষের আভাস পাওয়া যায়; সপ্তম অধ্যায়ে বিবিধ বিবায়বস্তু, অষ্টম ও নবমে প্ৰাণের উপাসনা, দশমে আপ্তাত্মিক অগ্নিহোত্র এবং একাদশে প্রজাপতি কর্তৃক পুরুষের মধ্যে দেবতাদের প্রতিষ্ঠা বিবৃত হয়েছে। শেষোক্ত অধ্যায়ে সেই সঙ্গে স্বপ্ন ও অশুভ লক্ষণসমূহ আলোচিত হয়েছে বলে এর পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে আশীর্বাদ ও সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা পুরণের জন্য অনুষ্ঠান আলোচিত হয়েছে। ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের নির্দেশ রয়েছে ত্রয়োদশ অধ্যায়ে। চতুর্দশ অধ্যায়ে বেদাধ্যয়নের মহিমা বৰ্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলাকারীর উদ্দেশে নিন্দাবাদও বধিত হয়েছে। পঞ্চদশ অধ্যায়ে বহুপ্রজন্ম-ব্যাপী শিক্ষকদের নামের এক সুস্পষ্ট তালিকা আছে। বহু অংশেই আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণসমূহ এবং পরলোক ও প্রেততত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।
প্রচলিত আরণ্যকগুলির মধ্যে তৃতীয় ও শেষ রচনা হল : তৈত্তিরীয় আরণ্যক; স্বভাববৈশিষ্ট্যই এটি ভিন্ন, কারণ এতে এমন কিছু উপাদান আছে যা এই শ্রেণীভুক্ত অন্য দুটি গ্রন্থে পাওয়া যায় না। দশ অধ্যায়ে বিন্যস্ত গ্রন্থটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নানাধরনের বিষয়বস্তু বিবৃত করেছে। বিভিন্ন প্রকারের নামের দীর্ঘ তালিকা, প্রতিশব্দ, নৈসৰ্গিক বস্তুর শ্রেণীবিভাজন এবং স্বাস্থ্য, ধন, সন্তান, পরমায়ু, বিজয় ও স্বৰ্গলাভের জন্য সংহিতার দেবতাদের কাছে অসংখ্য সংহিতা-জাতীয় প্রার্থনা। এছাড়া এতে ধর্মসূত্রের উপযোগী বিষয়বস্তুও খুঁজে পাওয়া যায়। এটা আরও স্পষ্ট, কারণ ইতোমধ্যে জাতিভেদ প্ৰথা স্বীকৃত সামাজিক সত্য হয়ে উঠেছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যক তিনটি ভিন্ন বর্ণের জন্য এমন সব ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম গ্রথিত করেছে, যার মধ্যে ধর্মসূত্রের প্রত্যক্ষ পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে বহু ম্রোত্র এবং ঋগ্বেদ ও অথর্ববেদের কিছু কিছু সম্পূর্ণ সূক্ত খুঁজে পাওয়া যায়। এমন কি যজুৰ্বেদীয় ধারার জাদুবিদ্যা সূচক পুনরাবৃত্তিপূর্ণ বহু গীতিও এতে আছে।