বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে নেই, তাই অনেক সময়ই কারও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। আর বিল্টুর মতো কেউ যদি আসে, তা হলে এক মুহূর্তে বাড়ি একেবারে সরগরম হয়ে ওঠে!
এসেই বিল্টু প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে দুমদাম শব্দ করে উঠে এল তিনতলায়। খয়েরি হ্যাফপ্যান্ট আর লাল শার্ট পরা।
সন্তু পড়াশোনা করছে, তার ঘরের দরজা ভেজানো। সেই দরজা এক ধাক্কায় খুলে বিল্টু বলল, সন্তুদাদা, টুকি!
বই থেকে চোখ তুলে বিলুকে দেখেই খুশি হল সন্তু। সে বলল, আয়, আয়, ভিতরে আয়।
বিন্দু বলল, না, ভিতরে যাব না। তুমি আমার সঙ্গে কম্পিটিশন দেবে, কে আগে সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামতে পারে?
সন্তু বলল, না, তোর সঙ্গে কম্পিটিশন দেব না। তুই তো চুরি করিস! তুই আমার সামনে এসে দুহাত ছড়িয়ে আমাকে আটকে দিস।
বিল্টু বলল, তুমি কেন একলাফে তিনটে সিঁড়ি যাও?
সন্তু বলল, বেশ করি। তুই কেন রেলিং-এ চড়ে সরসরিয়ে যাস?
বিন্দু হি হি করে হেসে উলটো দিকে ফিরল। তারপর একছুটে নেমে গেল। দোতলায়।
কাকাবাবু রকিং চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে একটা বই পড়ছেন আর একটু একটু দুলছেন। তিনি পরে আছেন একটা খয়েরি-সাদা ডোরাকাটা ড্রেসিং গাউন।
বিল্টু বলল, কাকাদাদু, হোয়াট আর ইউ ড়ুয়িং?
কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, রিডিং। তারপর বললেন, কাকাদাদু কী রে ব্যাটা! মনে হয়, জাপানি নাম। শুধু কাকাবাবু বলবি।
বিল্টু বলল, আমার মা বলেন কাকাবাবু, আর আমিও বলব কাকাবাবু?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাই বলবি। সকলে আমাকে কাকাবাবু বলে।
বিল্টু বলল, বাবু তো বলতে হয় অচেনা লোকদের!
কাকাবাবু বললেন, কাকাবাবুটাই আমার নাম। শুধু কাকা কিংবা কাকু বলে না কেউ।
বিল্টু বলল, আমার একখানা মামা আছে, তাকে আমি মামাবাবু বলি না, বলি শুধু মামু।
কাকাবাবু বললেন, তা বেশ করিস! কিন্তু মামা তো একখানা হয় না।
বিল্টু বলল, কেন? হি ইজ মাই ওনলি মামা।
কাকাবাবু বললেন, বাংলায় একখানা জামা, একখানা বই, একখানা মাউথ অর্গান হয়। কিন্তু জ্যান্ত মানুষ সম্পর্কে বলতে হয় একজন। একজন মামা, একজন কাকা।
বিল্টু বলল, আমার তিনখানা কাকা, নো, নো, তিনজন কাকা।
কাকাবাবু বললেন, রাইট! এই তো ঠিক বলেছিস। শোন বিন্দু, তুই হারমোনিকা বাজাতে ভালবাসিস?
বিল্টু বলল, কখনও তো বাজাইনি। হারমোনিকা কাকে বলে?
কাকাবাবু বললেন, মাউথ অর্গান। তোকে আমি একটা সুন্দর হারমোনিকা কিনে দেব।
বিল্টু চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন কিনে দেবে?
কাকাবাবু বললেন, তুই অল ইন্ডিয়ার মধ্যে ছবি আঁকায় ফার্স্ট হয়েছিস। সেইজন্য আমাদের খুব আনন্দ হয়েছে, গর্ব হয়েছে।
বিল্টু অবহেলার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, ও তো সবাই ফার্স্ট হতে পারে!
কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, সবাই কী করে ফার্স্ট হবে? ফার্স্ট কথাটার মানেই তো যে সবার উপরে।
বিল্টু বলল, ফাস্টেরও উপরে কিছু হয় না?
কাকাবাবু বললেন, না। বিল্টু একটু চিন্তিতভাবে বলল, মনে করো, ঝিল্লি…ঝিল্লিকে চেনো তো, আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে, আমার চেয়ে মোটে দুবছরের বড়, সেই ঝিল্লি যদি আরও ভাল একটা ছবি এঁকে ফেলে, তা হলে সে কী হবে?
কাকাবাবু বললেন, তা হলে ঝিল্লিই হবে ফার্স্ট আর তুই হবি সেকেন্ড!
বিল্টু বলল, ও। তারপরই সে বিষয় পালটে বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, বলো তো, টিনটিন আর অ্যাসটেরিক্সের মধ্যে কার বেশি বুদ্ধি?
কাকাবাবু বললেন, আমি টিনটিনের কথা জানি, কিন্তু অ্যাসটেরিক্সের গল্প পড়িনি।
বিল্টু বলল, আমি তোমায় পড়তে দেব।
আবার সে অন্য কথা শুরু করল।
কাকাবাবু মজা লাগল দেখে যে, বিল্টু এত বড় একটা প্রতিযোগিতায়। ফার্স্ট হয়েছে, তা নিয়ে তার কোনও ক্ষেপই নেই। আর-একটু বেশি বয়সের ছেলে হলে সে কত গর্ব করত।
কাকাবাবু বললেন, তুই তো পুরস্কার আনতে প্লেনে চেপে দিল্লি যাবি। এই প্রথম তোর প্লেনে চাপা হবে।
বিল্টু বলল, প্লেন তো মেঘের উপর দিয়ে যায়, তাই না?
কাকাবাবু বললেন, অনেক উপর দিয়ে।
বিল্টু বলল, প্লেন যখন মেঘের মধ্যে দিয়ে উঠবে, তখন জানলা খুলে মুখ বাড়িয়ে একটুখানি মেঘ খেয়ে নেওয়া যায় না?
কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, দুর বোকা! প্লেনের জানলা খোলা যায় নাকি? তা হলেই সর্বনাশ।
বিল্টু বলল, কেন খোলা যাবে না? আমি খুলব?
সন্তু নেমে এসে বিল্টুর পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খুলবি তুই?
কাকাবাবু বললেন, দ্যাখ না, ও বলছে, প্লেনের জানলা খুলে মেঘ খাবে!
সন্তু বলল, প্লেনের জানলা তো খোলা যায় না। তবে গ্যাংটকে গেলেই তো মেঘ খাওয়া যায়। গায়ের উপর দিয়ে মেঘ চলে যায়।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, তুমি খেয়েছ?
সন্তু বলল, কতবার? বিল্টু আবার জিজ্ঞেস করল, কীরকম খেতে?
সন্তু বলল, গ্যাংটকের মেঘ টক টক!
কাকাবাবু বললেন, বৃষ্টি পড়লে মিষ্টি হয়ে যায়।
বিল্টু বলল, আমি হলে গ্যাংটক যাব। আমায় নিয়ে চলো না!
সন্তু বলল, এখন তো হবে না। আগে তোকে দিল্লি যেতে হবে।
বিল্টু বলল, না, আমি দিল্লি যাব না। আমি গ্যাংটক যাব।
সন্তু বলল, সে কী রে! দিল্লিতে তোকে ফার্স্ট প্রাইজ দেবে। অনেক টাকা পাবি।
বিল্টু বলল, আমার অনেক টাকা আছে। আমি জমিয়েছি। দেখবে? হাফপ্যান্টের পকেট থেকে সে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করল। সেটার মুখ খুলে হাতে ঢেলে দেখাল কয়েকটা এক টাকা-দুটাকার নোট আর বেশ কিছু খুচরো পয়সা।
বিল্টু গম্ভীরভাবে বলল, থার্টি ওয়ান রুপিজ।
সন্তু বলল, সত্যিই তো অনেক টাকা!
কাকাবাবু বললেন, এই একত্রিশ টাকার দাম পঁচিশ হাজারের চেয়েও বেশি। কারণ, এই টাকাটা ও নিজে জমিয়েছে।
সন্তু বিন্দুকে বলল, তোর নিজের টাকা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তোর প্রাইজের টাকাটাও নিতে হবে।
বিল্টু বলল, কেন? এই টাকায় গ্যাংটক যাওয়া যাবে না?
কাকাবাবু বললেন, যত দিন মানুষ টাকার হিসেব না বোঝে, তত দিনই সে আসলে সুখী!
রিনি উপরে এসে বলল, অ্যাই বিল্টু, তোকে জ্যাঠামণি একবার ডাকছেন। চল, নীচে চল।
সন্তুর বাবা পা মচকে বিছানায় শুয়ে আছেন। সকলে মিলে চলে এল তাঁর ঘরে।
বুলবুলিপিসি বললেন, ও মা, এইটুকু ছেলে ছবি আঁকায় ফার্স্ট হয়েছে?
রিনি বলল, এইটুকু আবার কী! ও ফার্স্ট হয়েছে ছোটদের গ্রুপে। সকলে ওর মতোই ছোট।
বুলবুলিপিসি বললেন, তবু অতজনের মধ্যে ফার্স্ট হওয়া কি সোজা কথা? ওর নিশ্চয়ই খুব বুদ্ধি!
সন্তু বলল, ওর মাথায় অনেক দুষ্টুবুদ্ধি আছে বটে, কিন্তু বুদ্ধি থাকলেই ছবি আঁকা যায় না। ছবি আঁকা শিখতে হয়। ও যে ধৈর্য ধরে ছবি আঁকা শিখেছে, সেটাই আশ্চর্যের!
কাকাবাবু বললেন, শিখলেও সকলে শিল্পী হতে পারে না। আঁকার হাত থাকা দরকার। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার হাতে ছবি একেবারেই আসে না।
মা চাবি দিয়ে একটা দেওয়াল-আলমারি খুললেন। তার থেকে একটা নীল রঙের ভেলভেটের বাক্স বের করে দিলেন বাবার হাতে।
বাবা বললেন, বিল্টুবাবু, গভর্নমেন্ট তো তোমাকে পুরস্কার দিচ্ছেই। তার আগে আমরা তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। একবার আমি একটা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে এই মেডেলটা পেয়েছিলাম। এটা এখন তোমার। বাক্সটা খুলে দেখালেন। বেশ বড় একটা গোল সোনার মেডেল। বিল্টু গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করল, এটা নিয়ে আমি কী করব? বাবা বললেন, বাড়িতে রেখে দেবে। এরপর তুমি নিশ্চয়ই আরও অনেক মেডেল পাবে। তার মধ্যে এটাই হবে প্রথম। আমি বুড়ো হয়েছি, আমি আর মেডেল দিয়ে কী করব?
বিল্টু তবু জিজ্ঞেস করল, তুমি এটা সন্তুদাদাকে দাওনি কেন?
বাবা বললেন, সন্তুকে? সন্তু তো কিছুতে ফার্স্ট টাস্ট হয়নি।
বিল্টু বলল, হ্যাঁ, সন্তুদাদা সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামায় ফার্স্ট হয়!
সকলে হেসে উঠল।
বাবা বললেন, সে জন্য না হোক, অন্য কোনও কারণে ওর কাকাবাবু ওকে কী সব পুরস্কার-টুরস্কার দেন মাঝে মাঝে। সন্তু, তুই বোধহয় একবার অল বেঙ্গল সুইমিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিলি, তাই না?
সন্তু বলল, ফার্স্ট না, সেকেন্ড।
বাবা বললেন, সে যাই হোক, বিল্টুবাবু, তুমি আমার একটা ছবি এঁকে দেবে?
বিল্টু বলল, আমি তো মানুষের ছবি আঁকতে পারি না। দিদি পারে।
বাবা বললেন, তোমার দিদি তো ভাল ছবি আঁকে জানিই। সন্তুর একটা চমৎকার ছবি এঁকে দিয়েছে। তুমি মানুষের ছবি আঁকো না কেন?
বিল্টু বলল, মানুষগুলো যে সব আলাদা আলাদা।
বাবা বললেন, তা ঠিক। তুমি যে বাঘের ছবি আঁকলে, বাঘ দেখলে কোথায়? চিড়িয়াখানায়?
বিল্টু বলল, বাঘ তো ইচ্ছে করলেই সব সময় দেখা যায়।
বাবা বললেন, কী করে? কী করে? ছবিতে?
বিল্টু বলল, না, না। তুমি চোখ বোজো, তারপর মনে মনে ভাবলা, বাঘ বাঘ! অমনই বাঘ দেখতে পাবে। চোখ বুজে যে-কোনও জিনিসের কথা ভাবলেই সেটা দেখা যায়!
কাকাবাবু বিল্টুর পিঠ চাপড়ে বললেন, বাঃ বাঃ! এ যে একেবারে পাক্কা আর্টিস্টের মতো কথা। এ ছেলে অবশ্যই ভবিষ্যতে খুব বড় আর্টিস্ট হবে।
বিন্দু জিজ্ঞেস করল, ভবিষ্যৎ মানে ফিউচার?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। বি জিজ্ঞেস করল, কতদিনে ফিউচার হয়?
কাকাবাবু বললেন, একদিন পরেও ফিউচার, আবার একশো বছর পরেও! তবে তোর সম্পর্কে যা বলছি, তা আরও দশ-বারো বছর পরেই বোঝা যাবে।
বিল্টু বলল, মাই গড। আমার ফিউচার এত দূরে?