বাসার সবাই যখন নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত তখন তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে এলো। তারা যেখানে থাকে সেটা একটা গ্রামও না আবার শহরও না। তিতুনি অবশ্য শহর খুব বেশি দেখে নাই, তাই শহর কী রকম হয় ভালো করে জানে না। শহর বলতে সে শুধু ঢাকা শহরকে দেখেছে-মানুষের ভিড়, একটার পাশে আরেকটা ঘিঞ্জি বিল্ডিং একবার দেখেই তার শহর দেখার শখ মিটে গেছে। তিতুনিদের বাসাটা ফাঁকা একটা জায়গায়, বাসার পিছনে বড় বড় গাছ, বলা যায় রীতিমতো জঙ্গল। এই জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নাই কিন্তু অনেক পাখি আছে। গাছে কাঠবিড়ালী আছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা ফাজিল টাইপের বানর আসে। রাত্রে মাঝে মাঝে শেয়াল ডাকে। সে যখন স্কুলে যায় তখন উঁচু একটা সড়ক ধরে হেঁটে যায়। সড়কটার দুই পাশে বড় বড় গাছ। স্কুলে বিশাল মাঠ, পিছনে বিরাট দিঘি। তিতুনি বড় হয়েছে খোলা জায়গায় গাছপালার ভেতরে। সে গাছে উঠতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, খালি পায়ে ধান ক্ষেতে দৌড়াতে পারে।
তিতুনি বাসা থেকে বের হয়ে ঘুরে বাসার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে দেখল কেউ তাকে লক্ষ করছে কি না। যখন দেখল কেউ তাকে দেখছে না তখন সে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের মতো জায়গাটায় ঢুকে গেল। কেউ দেখলেও অবশ্য কোনো সমস্যা নেই, সবাই জানে তিতুনি একা একা এই জায়গাটাতে অনেক সময় কাটায়। একটা গাছ থেকে সে দড়ি দিয়ে দোলনা ঝুলিয়েছে সেখানে দোল খায়। লটকনের সময় একটা লটকন গাছে বসে বসে জংলি টক লটকন খায়। বৃষ্টি হলে একটু কাদা হয়ে যায়, আগাছা বেড়ে যায়, জোঁক বের হতে থাকে, তখন সে এখানে বেশি ঢুকে না। এখন বৃষ্টি নেই, শুকনো আবহাওয়া, নিচে শুকনো পাতা, পায়ের নিচে কুড়মুড় শব্দ করে পাতাগুলো যখন গুঁড়ো হয়ে যায়, তিতুনির তখন কেমন জানি আনন্দ হয়।
তিতুনি সাবধানে হেঁটে যেতে যেতে চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মোটামুটি কোন জায়গাটাতে উল্কা পড়েছে সে বাসার ছাদ থেকে দেখেছে। যেভাবে পুরো এলাকাটা কেঁপে উঠেছে তাতে মনে হয় জায়গাটা খুঁজে বের করতে কোনো সমস্যা হবে না।
সত্যি সত্যি তিতুনি জায়গাটা পেয়ে গেল, মাটিতে একটা গর্ত এবং সেই গর্তের চারপাশে ফাটল। পুরো মাটিটা একেবারে ঝলসে গেছে, গাছ, লতাপাতা গরমে পুড়ে গেছে, আগুন যে ধরে যায়নি। সেটাই আশ্চর্য।
তিতুনি হেঁটে হেঁটে গর্তটার কাছে গেল, মনে হলো আশেপাশের মাটিটা পুড়ে একেবারে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল গাছের ডালপালা ভেঙে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে গেছে। তিতুনি গর্তটার কাছে গিয়ে অবাক হয়ে গেল, গর্তটার মুখের কাছে পুরো মাটিটা ঝলসে কাঁচের মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ছোট-বড় কাঁচের টিক দিয়ে কেউ একজন অনেক যত্ন করে এটা তৈরি করেছে। তিতুনি গর্তটার ভেতরে উঁকি দিল, অনেক গভীর গর্ত, বাইরে থেকে ভেতরে কিছু দেখা যায় না। একটা টর্চ লাইট নিয়ে এলে ভেতরে আলো ফেলে দেখা যেত। তিতুনি গর্তের ভেতরে হাত দিয়ে দেখে, গোল গর্তটার পুরোটা প্রচণ্ড তাপে মসৃণ কাঁচের মতো হয়ে গেছে। গর্তটা এখনো গরম। তিতুনি অবাক হয়ে গর্তটার ভেতরে তাকিয়ে রইল।
ঠিক তখন হঠাৎ খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। তিতুনির মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব অনুভূতি যে তিতুনি মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল, দেখার চেষ্টা করল কেউ সত্যি সত্যি তার দিকে তাকিয়ে আছে কি না। কেউ কোথাও নেই, চারিদিকে শুধু লম্বা লম্বা গাছ, বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই। তিতুনির কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে। সকালবেলা চারিদিকে দিনের আলোতে ঝলমল করছে, এর মাঝে ভয় পাবার কিছু নেই কিন্তু তারপরও তিতুনির কেমন জানি ভয় ভয় করে। কী নিয়ে ভয় সেটাও সে বুঝতে পারছে না, সেটাই সবচেয়ে অবাক ব্যাপার। তিতুনি কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ করে তার মনে হলো এখানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তার এখানে থাকা ঠিক হবে না। তার এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত কিন্তু সে নড়তে পারছিল না। তার কেন জানি মনে হতে থাকে সামনে মাটি চৌচির করে ফেটে তৈরি হওয়া গর্তটার ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসবে, ভয়ংকর কোনো একটা প্রাণী, যেটা এখন গর্তের ভেতরে ঘাপটি মেরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিতুনির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।
তিতুনি নিজেকে বোঝাল পুরোটাই নিশ্চয়ই একটা কল্পনা, এখানে ভয় পাবার কিছু নেই। তারপরেও তিতুনি ঠিক করল সে এখন চলে যাবে। দরকার হলে একটু পরে বড় মানুষদের নিয়ে আসবে। কিন্তু হঠাৎ করে তার মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল, মনে হলো সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। সে কাছাকাছি একটা গাছকে ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। তিতুনির মনে হতে থাকে তার মাথার ভেতরে যেন হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে কথা বলছে, সে সবার কথা শুনছে কিন্তু কারো কথাই বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ঝাঁপসা হয়ে যায়, তার মনে হতে থাকে, সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল তখন, খুব ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। তিতুনি আবার চারিদিকে তাকাল। চারিদিকে সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। শক্ত পুড়ে যাওয়া মাটি, গোল একটা গর্ত, সেখান থেকে চৌচির হয়ে যাওয়া মাটি, গর্তের মুখে ছোট-বড় স্বচ্ছ স্ফটিক। কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তিতুনি গর্তের ভেতর তাকিয়ে রইল, তখন হঠাৎ করে মনে হলো গর্তের ভেতর কিছু একটা যেন নড়ে উঠল। তিতুনির আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, একটা চিৎকার দিয়ে সে ছুটে যেতে চাইল, কিন্তু কী আশ্চর্য-সে নড়তে পারল না। চোখ বড় বড় করে সে গর্তটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে স্পষ্ট শুনতে পেল গর্তটার ভেতরে একটা খচমচ শব্দ হচ্ছে, স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ভেতর থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসছে।
প্রথমে একটা হাত বের হয়ে এলো, ঠিক মানুষের হাত, দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা বড় মানুষের হাত না, কম বয়সী একটা বাচ্চার হাত। তারপর আরেকটা হাত বের হয়ে গর্তটার মুখটা ধরে নিজেকে টেনে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে মাথার কালো চুল, তারপর হ্যাঁচকা টান দিয়ে বাচ্চাটা তার শরীরের অর্ধেকটা বের করে আনে। তিতুনি অবাক হয়ে দেখল ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে, তার দিকে পিছনে ফিরে বসেছে বলে চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটা আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রায় পুরো শরীরটা বের করে গর্তের উপরে বসে পড়ল, পা দুটো শুধু গর্তের মাঝে ঝুলে আছে। তারপর মেয়েটা ঘুরে তিতুনির দিকে তাকাল। তিতুনির মুখটা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়, গর্ত থেকে যে মেয়েটা বের হয়ে এসেছে সেই মেয়েটা আরেকটা তিতুনি। তিতুনির মতো দেখতে একটি মেয়ে নয়, পুরোপুরি তিতুনি। সে নিজে।
তিতুনির মনে হলো সে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিবে, কিন্তু সে এত অবাক হয়েছে যে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল, গলা থেকে কোনো শব্দ হলো না। গর্তে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ শান্ত দৃষ্টি, তিতুনিকে দেখে সে মোটেও অবাক হচ্ছে না।
তিতুনি নিঃশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে থাকে। একটু পিছিয়েই সে এক দৌড়ে বাসায় চলে যাবে। বড় একটা গাছের কাছে এসে সে গাছটার আড়ালে লুকিয়ে গেল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে সে আরো একবার উঁকি দিয়ে তাকাল। তিতুনি মনে মনে আশা করছিল যে সে দেখবে আসলে গর্তটার উপরে কেউ বসে নেই, সব তার চোখের ভুল। কিন্তু তিতুনি দেখল গর্তটার উপরে পা ঝুলিয়ে এখনো সেই তিতুনিটা বসে আছে। তার চোখে চোখ পড়তেই পা ঝুলিয়ে বসে থাকা তিতুনিটা একটু হাসার চেষ্টা করল, ঠিক তিতুনি যে রকমভাবে হাসে।
তিতুনি একটা দৌড় দিতে গিয়ে থেমে গেল, আবার মেয়েটার দিকে তাকাল, মেয়েটা এখনো শান্তভাবে বসে পা দোলাচ্ছে, মাথা তুলে গাছগুলো দেখছে। তিতুনি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর একটা খুব সাহসের কাজ করে ফেলল, জিজ্ঞেস করল, “এই, তুমি কে?”
তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা মাথা ঘুরে তাকাল, বলল, “কে? আমি?” গলার স্বর হুবহু তিতুনির মতো।
তিতুনি বলল, “হ্যাঁ। তুমি।”
মেয়েটা বলল, “কেন, আমি তিতুনি!”
ঠিক কী কারণ জানা নেই মেয়েটার কথা শুনে তিতুনির ভয়টা কেটে কেমন যেন একটু রাগ উঠে যায়। সে গলা উঁচিয়ে বলল, “না। তুমি তিতুনি না। আমি তিতুনি।”
মেয়েটা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। একটু মাথা চুলকে বলল, “তাহলে আমি কে?”
মেয়েটাকে এ রকম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতে দেখে তিতুনির সাহস আরেকটু বেড়ে গেল, গলা আরেকটু উঁচিয়ে বলল, “আমি কেমন করে বলব তুমি কে? তুমি বলো তুমি কে?”
তিতুনির মতো মেয়েটাকে বেশ চিন্তিত দেখাল, তিতুনি যেভাবে কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করে ঠিক সেভাবে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আগে তুমি শুধু একা তিতুনি ছিলে। এখন আমি আর তুমি দুইজনেই তিতুনি। দুইটা তিতুনি।”
তিতুনি রেগে উঠে বলল, “না। দুইজন তিতুনি হয় না। একজন মানুষ কখনো দুইটা হয় না।”
“হয় না?”
“না।”
“কিন্তু এই যে হলো, তুমি এক তিতুনি আমি আরেক তিতুনি।”
তিতুনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাবধানে বড় গাছটার পিছন থেকে বের হয়ে এলো। সাবধানে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “তুমি বলো তুমি কে? বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?”
মেয়েটা খানিকক্ষণ মাথা চুলকাল, তারপর খানিকক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “আমি ভেবেছিলাম আমিও তিতুনি। কিন্তু তুমি বলছ আমি তিতুনি না। তাহলে এখন আমি জানি না আমি কে।”
“তাহলে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?” আস্তে আস্তে তিতুনির সাহস বেড়ে যেতে থাকে। তিতুনি যেটাই বলছে মেয়েটা সেটাই মেনে নিচ্ছে, তাই তার ভয়টাও কমে গিয়ে কৌতূহল বাড়তে থাকে।
মেয়েটা কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন একটু অস্বস্তি নিয়ে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তিতুনি আবার বলল, “বলো, তুমি কোথা থেকে এসেছ?”
মেয়েটা হাত তুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, “ওই তো ওখান থেকে।”
“ওখান থেকে মানে? আকাশ থেকে?”
“বলতে পারো।”
“বলতে পারো মানে?”
তিতুনি আরো এক পা এগিয়ে এলো, বলল, “পরিষ্কার করে বলো তুমি কোথা থেকে এসেছ?”
তিতুনির মতো মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “পরিষ্কার করে বললে তুমি কিছুই বুঝবে না। তুমি তোমার সৌরজগতের গ্রহগুলো ছাড়া আর কিছুই জানেন না। গ্যালাক্সির নাম শুনেছ কিন্তু সেটা কী তুমি জানো না। আকাশের তারাগুলো তুমি দেখেছ কিন্তু সেগুলো সম্পর্কে তুমি কিছু জানো না। আমি কোথা থেকে এসেছি তোমাকে বোঝানো সম্ভব না।”
তিতুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি এলিয়েন?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি বলল, “কিন্তু এলিয়েনরা দেখতে আমার মতন হয় না।”
“কী রকম হয়?”
“সবুজ রঙের হয়। চোখগুলো বড় বড় হয়। মাথাটা অনেক বড় থাকে। হাত-পাগুলো সরু হয়। আঙুলগুলো লম্বা হয়। এক হাতে তিনটা করে আঙুল থাকে।”
তিতুনির মতো মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ জানি।”
“জানো?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে তুমি আমার মতো কেন?”
“আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি সে জন্যে তোমার মতো হয়েছি।” তিতুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “আরেকজনকে প্রথমে দেখলে তার মতো হতে?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি বলল, “তাহলে তুমি যে রকম ইচ্ছা সে রকম হতে পারো?”
তিতুনির মতো মেয়েটা তার মাথা আর ঘাড় এমন করে নাড়ল, যার অর্থ হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে। তিতুনি যখন কোনো কিছু ঠিক করে বলতে চায় না তখন ঠিক এইভাবে মাথা নাড়ে-এই মেয়েটা কীভাবে জানি সেটা জেনে গেছে। তিতুনি বলল, “তুমি যখন একটা এলিয়েন তাহলে তুমি কেন আমার মতো হয়েছ? এলিয়েনের মতো হয়ে যাও।”
“নাহ্।” মেয়েটা মাথা নাড়ল।
“কেন না?”
“তোমার মতনই ভালো। এলিয়েনদের কী করতে হয় আমি জানি। তুমি হলে কী করতে হয় জানি।”
তিতুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি হলে কী করতে হয় তুমি জানো?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে জানো?”
মেয়েটা একটু লজ্জা পাবার ভান করে বলল, “তোমার মাথার ভেতরে ঢুকে দেখেছি।”
তিতুনি প্রায় চিৎকার করে বলল, “তুমি কী বললে? আমার মাথার ভেতরে ঢুকে দেখেছ?”
“হ্যাঁ।”
“আ-আ-আমার মাথার ভেতরে?” তিতুনির এখনো কথাটা বিশ্বাস হয় না। “তু-তুমি আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছ?”
মেয়েটা একটু অপরাধীর মতো ভঙ্গি করে বলল, “হ্যাঁ।”
“এই একটু আগে যে আমার মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল, কেমন যেন মনে হলো মাথার ভেতরে কী হচ্ছে-তখন তুমি আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছিল?”
“হ্যাঁ।” মেয়েটা প্রায় মাথা নিচু করে ফেলল, তাকে দেখে মনে হলো যেন সে খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে।
তিতুনি তখন আরো গরম হয়ে বলল, “তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার অনুমতি না নিয়ে আমার মাথার ভেতরে ঢুকেছ? আমার মাথায় যদি এখন কোনো সমস্যা হয় তাহলে তোমার খবর আছে বলে রাখলাম।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “সমস্যা হবে না। আমি কিছু ধরি নাই, কিছু ওলটপালট করি নাই। খালি দেখেছি।”
“কী দেখেছ?”
“এই তো তুমি কে, কী করো, কী চিন্তা করো-এই সব।”
তিতুনি বলল, “সব দেখেছ?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“বলো দেখি আমার ভাইয়ের নাম কী?”
“টোটন।”
“বলো দেখি আজকে সকালে কী হয়েছিল?”
“নাশতা খাবার সময় আমি যখন পানি খেতে যাচ্ছিলাম তখন ভাইয়া আমাকে ধাক্কা দিয়েছে, আর তখন হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গেছে। তখন–”
তিতুনি হাত তুলে বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি কী বললে, আমি?”
“হ্যাঁ আমি। আমি যখন পানি খেতে–”
তিতুনি গরম হয়ে বলল, “মোটেও তুমি পানি খেতে যাচ্ছিলে না, তুমি হচ্ছ এলিয়েন-তুমি তখন কোথায় ছিলে আমি জানি না। আমি পানি খেতে যাচ্ছিলাম।” তিতুনি বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি।”
“একই কথা।” তিতুনির মতো মেয়েটা বলল, “আমি আর তুমি একই কথা। এখন তুমি যা আমিও তাই। আমি তোমার মগজের দশ হাজার সাতশ’ বার কোটি সাতাত্তর লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাঁচশ ছেচল্লিশটা নিউরন কপি করে আমার মগজে রেখে দিয়েছি।”
তিতুনি কিছুক্ষণ হাঁ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “কয়টা নিউরন?”
মেয়েটা আবার পুরো সংখ্যাটা বলল। তিতুনি বলল, “তুমি আমার মাথার ভেতরের সবগুলো নিউরন গুনেছ?”
“হ্যাঁ। না গুনলে কপি করব কীভাবে!”
তিতুনি কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কেন দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে নিজেও বুঝতে পারল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কাজটা ঠিক হলো না।”
“কোন কাজটা ঠিক হলো না?”
“এই যে তুমি আমি হয়ে গেলে। যদি এখন কেউ তোমাকে দেখে ফেলে তখন কী হবে?”
মেয়েটা মাথা চুলকে বলল, “কী আর হবে? প্রথমে একটু অবাক হবে, তারপর মেনে নেবে। না মেনে উপায় কী? কখনোই তো বুঝতে পারবে না কে তুমি কে আমি। দুইজনেই তো হুবহু এক রকম।”
তিতুনি গরম হয়ে বলে, “কিন্তু তুমি এলিয়েন। এক্স-রে করলে দেখবে তোমার ভেতরে কিলবিল কিলবিল করছে ড়ওয়ালা জিনিসপত্র। তোমাকে কাটলে সাদা রঙের রক্ত বের হবে, চুল ধরে টান দিলে পুরো চামড়া খুলে ভেতরে ভয়ংকর এলিয়েন বের হয়ে যাবে। আমি জানি।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “আমিও জানি। কিন্তু আমি সে রকম এলিয়েন না। আমার ভেতর কিলবিল করা কিছু নাই। আমি ঠিক তোমার মতো।”
“তুমি কেন আমার মতন হলে সত্যিকারের কিউট একটা এলিয়েনের চেহারা নাও, তাহলে তোমাকে আমি বাসায় নিয়ে যাব, স্কুলে নিয়ে যাব। তুমি যদি চাও তাহলে তোমাকে টেলিভিশনে টক শোতে নিয়ে যাব।”
“টক শোতে?”
“হ্যাঁ। সেখানে তুমি কোথা থেকে এসেছ, কেমন করে এসেছ, সেগুলো বলতে পারবে। সবাই তোমাকে দেখার জন্যে ভিড় করে আসবে। তোমার সাথে সেলফি তুলবে।”
“সেলফি?”
“হ্যাঁ। ছোট বাচ্চারা তোমার অটোগ্রাফ নিবে।”
“অটোগ্রাফ?”
“হ্যাঁ।” তিতুনি গলায় জোর দিয়ে বলল, “তুমি এখন তোমার চেহারা পাল্টে ফেলো, কিউট একটা এলিয়েন হয়ে যাও।”
তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “নাহ! আমি কিউট এলিয়েন হতে চাই না। আমি তিতুনিই থাকতে চাই।” তারপর কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল, হাত দুটো উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল, ঠিক তিতুনি যে রকম করে।
তিতুনি একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “তুমি এখন কোথায় যাবে?”
“তোমাদের পৃথিবীতে এসেছি, পৃথিবীটা একটু ঘুরে দেখি।”
“ঘুরে দেখবে? পৃথিবী?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি বাসায় যাবে না তো?”
মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হবে বাসায় গেলে?”
তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না। খবরদার তুমি বাসায় যাবে না। তুমি বাসায় গেলে অনেক ঝামেলা হবে।”
“কী ঝামেলা?”
“যখন বুঝতে পারবে তুমি এলিয়েন তখন পুলিশ-র্যাব এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। রিমান্ডে নিবে। তারপর কেটে-কুটে দেখবে।”
সবকিছু বুঝে ফেলেছে সে রকম ভাব করে মেয়েটা মাথা নাড়ল। তিতুনি একটু সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুমি যখন পৃথিবীটা দেখতে চাচ্ছ একটু দেখো। দেখা শেষ হলে চলে যেও। পৃথিবীতে থাকলেই কিন্তু ঝামেলা।”
“ঠিক আছে।” মেয়েটা এবারে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে। তিতুনি তখন একেবারে হা হা করে উঠল, বলল “সর্বনাশ! তুমি করছ কী?”
“কী হয়েছে?”
“তুমি আমার বাসার দিকে যাচ্ছ কেন? বাসার লোকজন কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
“তাহলে কোন দিকে যাব?”
“এই জঙ্গলের দিকে যাও। জঙ্গল পার হলে ধান ক্ষেত। ধান ক্ষেত পার হলে নদী। নদীর তীরে হাঁটলে তোমার খুব ভালো লাগবে।”
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।” তারপর জঙ্গলের দিকে হাঁটতে লাগল। তিতুনি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে আরো একজন তিতুনি হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। কে জানে তার সাথে আর দেখা হবে কি না!