একটু থেমে বামদেব আবার বলতে লাগলেন।
অনিলদা আমার পিতামহের কাছেই মানুষ হতে লাগল। দীর্ঘ ষোল বৎসর পরে পিসেমশাই আবার একদিন আমাদের ওখানে ফিরে এলেন, এখনো তিনি বেঁচে আছেন। পরে অবশ্য এ গল্প তাঁর মুখেও আমার শোনা।
এই পর্যন্ত বলে বামদেব অধিকারী চুপ করলেন।
কিরীটীও স্তব্ধ।
বাইরে নিযুতি রাত্রি।
তারপর? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আজ পর্যন্ত পিসিমার হাতের সেই কঙ্কনটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কেনই বা পিসিমা আত্মহত্যা করলেন আর কি করেই বা পিসিমার হাত হতে কঙ্কনটি চুরি হয়ে গেল—আজও সে রহস্য উদঘাটিত হল না। যা হোক, অপহৃত সে কঙ্কনটির কথা সকলে ভুলেই গিয়েছিল পিসিমার মৃত্যুর ব্যাপারের সঙ্গে সঙ্গে এবং এতদিন পর্যন্ত সে কঙ্কনটির কথা আর কারো মনেও পড়েনি। কিন্তু মাত্র মাসখানেক আগে আমাদের বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা বিক্রির কথাবার্তা শুরু হবার পর হতেই আমাদের কলকাতায় এই বাড়িতে ঘন ঘন চোরের উপদ্রব শুরু হলো-?
চোরের উপদ্রব? বিস্মিত কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ এই গত মাসখানেক ধরে পাঁচ-সাতবার চোর এসেছে এই বাড়িতে এবং প্রত্যেক বারই আমার স্ত্রীর ঘরে। আমাদের কোন সন্তানসন্ততি নেই। একমাত্ৰ আছে আমাদের এক পালিতা পিতৃমাতৃহীন বন্ধু কন্যা সুজাতা। সুজাতা ও আমার স্ত্রী এক ঘরেই শোয়। কারবারের কাজে মধ্যে মধ্যে আমাকে কলকাতার বাইরে যেতে হয়। দেখেছি। আমি বাইরে গেলেই বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হয়। সাধারণত—
আচ্ছা একটা কথা! কিরীটী প্রশ্ন করে।
কি?
চোর এসেছে কিন্তু কিছু চুরি যায়নি?
সেটাই আশ্চর্য; চোর এসেছে বটে কিন্তু কিছুই চুরি যায়নি।
কি রকম?
তাই। প্রথমটায়। তাই ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি, পরে হঠাৎ একটা কথা মনে হয় ভাবতে ভাবতে—
কি?
চোর এসেছে বার বার আমার স্ত্রীর হাতের ঐ কঙ্কনটির লোভে।
বল কি। কিন্তু—
সেই কথাই বলছি। বামদেব বলতে লাগল, শেষবার চোর এসে প্রথমে আমার স্ত্রীর ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত থেকে কঙ্কনটি খুলে নেবার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থকাম হয়, তখন কঙ্কনটা আমার স্ত্রীর হাতসমেতই কেটে নিয়ে যাবার মতলবে ছিল বোধ হয়। শেষ পর্যন্ত কিন্তু অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ধারাল অস্ত্রের কোপটা পাশের বালিশে পড়তেই স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। পরের দিনেই সকালবেলা আমি ফিরে আসি। প্রথমটায় আমরা ধারণাও করতে পারিনি যে চোরের লক্ষ্য ঐ কঙ্কনটির উপরেই। পরে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শেষবারের ঐ চেষ্টার পর অমঙ্গলের সম্ভবনা সত্ত্বেও আমার স্ত্রীর হাত হতে কঙ্কনটি খুলে বাধ্য হয়ে সিন্দুকে তুলে রাখি, কিন্তু তাতেও রেহাই নেই, গতরাত্রেও আবার চোর এসেছিল। এবং লোহার সিন্দুকটাই ভাঙবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জামান সিন্দুক খুলতে পারেনি। এতে আরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে, চোরের লক্ষ্য ঐ হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনই। তোমার কি মনে হয় কিরীটী? বামদেব কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।
সেই রকম বলেই তো মনে হচ্ছে তোমার মুখে সব শুনে। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
কিন্তু একটা কথা আমি বুঝে উঠতে পারছ না কিরীটী, আমার স্ত্রীর আরো বহু টাকার স্বর্ণালঙ্কার আছে কিন্তু চোরের এই কঙ্কনটির ওপরেই কেবল নজর কেন?
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসে বলল, তাহলে তো কঙ্কন-রহস্যই আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল বামদেব। আমার সব শুনে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই এই সুবর্ণ কঙ্কনের পশ্চাতে এমন কোন গোপন ইতিহাস আছে যেটা চোরকে বিশেষভাবে কঙ্কনটির প্রতিই লালায়িত করে তুলেছে।
আমার স্ত্রীও অবিশ্যি সেই কথাই বলছিল, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পুরাতন দিনের আর অবিশ্যি পিসেমশাই ব্যতীত কেউ বেঁচে নেই, কিন্তু এমন কোন ইতিহাস ঐ কঙ্কনের সঙ্গে জড়িত থাকলে অন্ততঃ পিসেমশাইও কি সেকথা জানতেন না।
না জানতেও তো তিনি পারেন। সর্বদা তো তিনি বহির্বাটিতে জপতপ নিয়েই থাকতেন। শুনলাম?
হ্যাঁ। সংসারে থাকলেও কোনদিন তিনি সংসারী ছিলেন না।
আচ্ছা একটু আগে তুমি যে বলেছিলে, বহরমপুরের পৈতৃক বাড়িটা তোমার বিক্রির কথাবার্তা হচ্ছে!
হ্যাঁ, ওই বাড়িটা অৰ্থাৎ ‘রত্নমঞ্জিলে’র বিক্রির কথাবার্তা চালাচ্ছি। একপ্রকার পাকাই হয়ে গিয়েছে বলা যায়, বায়না নেওয়া হয়েছে।
বাড়িটা অনেক দিনের না?
হ্যাঁ। আমাদের পূর্বপুরুষ নবাব সরকারের চাকরি করতেন। আসলে আমরা চট্ য্যে, অধিকারী আমাদের বংশের নবাব-প্রদত্ত খেতাব। নবাব সরকারে ঐ চাকরির সময়েই বহরমপুরে তিনি একখানা গৃহ নির্মাণ করেন, পরে পূর্ববঙ্গ হতে এসে পরবর্তী পুরুষ বসবাস করতে শুরু করেন এবং ক্রমে জমিদারীও ক্রয় করেন। তারপর একদিন আমার পিতৃদেব কলকাতায় এই বাড়ি করে চলে আসেন। এখানে এবং সেই হতে বহরমপুরের বাড়িটা প্রায় খালিই পড়ে ছিল কিন্তু বাড়িটার মাল-মশলা খুব ভাল থাকায় ও গঠনকৌশল সেকেলে এবং মজবুত থাকায় বাড়িটা পুরাতন হয়ে গেলেও এখনও অটুট আছে। বাড়িটা দেখতে অনেকটা পুরাতন কেল্লার মত গঙ্গার একেবারে ধারে এবং গঙ্গাও মজে গিয়েছে এবং বহুদিনের অব্যবহারে চারিপাশে এখন ঘন জঙ্গল হয়ে গিয়েছে।
বাড়িটা মানে তোমাদের ঐ রত্নমঞ্জিল কিনছে কে?
এক গুজরাটি ভদ্রলোকে। নাম রতনলাল রাণা।
লোকটার অবস্থা কেমন-নিশ্চয়ই ধনী?
তা তো নিশ্চয়ই!
তা হঠাৎ অমন জায়গায় একটা অতদিনকার পড়ে পুরনো বাড়ি কেনবার তাঁর সখ হল যে!
শুনেছি কাঁসার জিনিসপত্র তৈরির একটা ফ্যাক্টরী নাকি খুলবেন তিনি।
হুঁ—দাম? তাও আশাতীত।
কি রকম?
পঞ্চান্ন হাজার টাকা।
বল কি!
কিরীটীর মনের মধ্যে তখন বহরমপুরে গঙ্গার ধারে নবাবী আমলের এক পুরাতন কেল্লাবাড়ি রত্নমঞ্জিল ছায়াছবির মত আকার নেবার চেষ্টা করছে। নবাবী আমলের পুরাতন কেল্লা বাড়ি।
সামনে টেবিলের ওপর রক্ষিত টাইমপিসটা একঘেয়ে টিকটিক শব্দ জাগিয়ে চলেছে নিযুতি রাতের স্তব্ধতার সমুদ্রে।
পুলিসেই সংবাদ দেওয়ার আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কিরীটী ব্যাপারটা এমন ধোঁয়াটে— পুলিস হয়ত বিশ্বাসই করবে না, কিন্তু চুপচাপ বসেও আর থাকতে পারলাম না—তাই তোমার শরণাগত হয়েছি। বামদেব আবার বললে।
কিরীটির মাথার মধ্যে তখনও রত্নমঞ্জিল ঘোরাফেরা করছে।
বহরমপুর! রত্নমঞ্জিল!
এখন তুমি কি পরামর্শ দাও কিরীটী?
একটু আমায় ভেবে দেখতে হবে। তবে প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, কাল সকালেই সর্বাগ্রে কোন ব্যাঙ্কে গিয়ে ঐ কঙ্কনটি তাদের সেফ কাস্টিডিতে তোমাকে রেখে আসতে হবে।
বেশ, তাই করব।
আচ্ছা আজ তাহলে আমি উঠি।
এস।
ভাল কথা, কত বায়না নিয়েছ, বলছিলে না বড়িটার জন্য?
নিয়েছি—দশ হাজার টাকা। কথা আছে সামনের মাসে দশ তারিখে বিক্রয়-কোবালা রেজিষ্ট্রি হবে।