০২. বল্টু

২. বল্টু

ছোট খালার বড় ছেলের নাম বল্টু। ভালো একটা নাম আছে, শাহনাওয়াজ খান না বি যেন, কিন্তু সবাই তাকে বল্টু বলেই ডাকে। বল্টু কারো নাম হয় আমি জানতাম না কিন্তু তাকে দেখে মনে হল বল্টু নামটা তার জন্যে একেবারে মানানসই। গাট্টাগোট্ট শরীর, মাথাটা ধড়ের উপর বসানো। বয়সে আমার সমান কিন্তু লম্বায় আমার থেবে

অন্তত আধহাত ছোট। আমাকে প্রথমবার দেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এইটা কে?

ছোট খালা বললেন, বিলু, ভোর খালাতো ভাই।

যার বাবা পাগল?

ছোট খালা ধমক দিয়ে বললেন, ছিঃ। এইভাবে বলে না।

বল্টু মুখ গোঁজ করে জিজ্ঞেস করল, কতদিন থাকবে?

ছোট খালা বললেন, ছিঃ বল্টু। এইভাবে কথা বলে না।

তার মানে অনেক দিন। বল্টু মুখ লম্বা করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, কোন ক্লাসে পড়ে?

আমি উত্তর দিলাম, বললাম, সেভেন।

রোল নাম্বার কত?

এক।

সাথে সাথে বল্টুর মুখটা কালো হয়ে গেল। প্রথমে দেখা হওয়ামাত্র কাউকে তার রোল নাম্বার জিজ্ঞেস করা মনে হয় ঠিক না। কিন্তু আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছে, আমি কেন করব না। কারো রোল নাম্বার তো আর এক থেকে কম হতে পারে না! জিজ্ঞেস করলাম, তোমার রোল নাম্বার কত?

বল্টু উত্তর দেবার আগেই তার ছোটজন মিলি একগাল হেসে বলল, ভাইয়া পরীক্ষায় লাডড়া গাডড়া! সব সাবজেক্টে রসগোল্লা।

বলামাত্র বল্টু তার ছোট বোনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দিল।

আমি বুঝতে পারলাম, এই বাসায় বল্টু হবে আমার শত্রুপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী মিলি হওয়া উচিত মিত্রপক্ষ, কিন্তু এসব ব্যাপারে কিছু জোর দিয়ে বলা যায় না।

 

রাতে খাবার টেবিলে ছোট খালুর সাথে দেখা হল। অনেক দিন আগে জার্মানি না আমেরিকা থেকে একটা রঙিন ছবি পাঠিয়েছিলেন। সেই ছবিতে ছোট খালু সারা গায়ে জ্বাৰ্বজোৰ্ব জড়িয়ে একটা শাবল দিয়ে বাসার সামনে বরফ পরিষ্কার করছিলেন। ধবধবে সাদা বরফের সামনে তাকে দেখাচ্ছিল বেগুনি রঙের। মানুষের রং বেগুনি হয় কেমন করে সেটা নিয়ে আমার সবসময়েই একটু কৌতূহল ছিল। আজ দেখলাম রংটা বেগুনি নয়, তবে একটু কালোর দিকে। আমার সাথে ছোট খালুর একটু কথাবার্তা হল। জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির সবাই ভালো?

জ্বি।

তোমরা তো চার ভাই-বোন?

জ্বি।

শিউলি, রানু, তারপর তুমি। তোমার পরে একজন ভাই।

জ্বি।

ভাইয়ের নাম যেন কি?

লাবু। ভালো নাম আতাউল করিম।

ও আচ্ছা। বেশ বেশ। ছোট খালু খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, শিউলির তো বয়স বেশি না, এর মাঝে বিয়ে হয়ে গেল?

জ্বি।

পড়াশোনাটা শেষ করলে হত।

ছোট খালা নাক দিয়ে ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস বের করে বললেন, গ্রামের ব্যাপার, ঢ্যাঙা একটা মেয়েকে স্কুলে পাঠাবে কেমন করে?

ছোট খালু বললেন, পড়াশোনায় তো ভালো ছিল, তাই না?

জ্বি।

খালু চুকচুক শব্দ করে বললেন, মেয়েদের পড়াশোনাটা খুব দরকার, খুব দরকার।

ছোট খালু মানুষটাকে দেখে রাগী রাগী মনে হয়, কিন্তু আসলে মনে হয় রাগী নয়। মনটা খুব ভালো। একবার মনে হল সত্যি কথাটি বলে দিই, যে, বাবা পাগল বলে বড় বুবুর বিয়ের কোনো প্রস্তাবই আসছিল না। তাই যখন বিয়ের একটা প্রস্তাব এসেছে, তাড়াহুড়ো করে সবাই মিলে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি কিছু বললাম না, বাবার পাগলামি নিয়ে কোনো কথা বলতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।

 

রাত্রে ঘুমানোর সময় একটা সমস্যা দেখা দিল, আমি কোথায় ঘুমাব সেটি ঠিক করা হয় নি। মিলি আর বল্টুর আলাদা ঘর, দু’জনের জন্যে দুটি আলাদা বিছানা ছোট খালা আমাকে বল্টর সাথে শোওয়ার কথা বলামাত্রই সে নাক ফুলিয়ে এরকম ফোঁস ফেীস জাতীয় শব্দ শুরু করে দিল। ছোট খালু কড়া স্বরে বল্টুকে কী-একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তাঁকে থামিয়ে বললাম, খালু, আমি কি নিচে শুতে পারি?

নিচে? মেঝেতে?

জ্বি। একটা বালিশ আর একটা চাদর হলেই হবে।

ছোট খালু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, আমার আসলে একলা শোয়াই ভালো।

কেন?

আমি নাকি ঘুমের মাঝে শুধু উল্টাপাল্টা করি। রাঙাবুবু বলেছে। আমি অবশ্যি টের পাই না। কিন্তু যে আমার সাথে ঘুমায় সে টের পায়।

মিলি বলল, কিন্তু ভাইয়ার মতো তো আর তুমি বিছানায় পি—

বল্টু একটা হুঙ্কার দিল বলে মিলি কথা শেষ করতে পারল না, কিন্তু শব্দটা নিশ্চয়ই ‘পিশাব’-ই হবে।

আমাকে সে-রাতের মতো মেঝেতে বিছানা করে দেয়া হল। নিচে তোশক তৈরি করা হয়েছে একটা লেপ ভাজ করে। মশারিটাও টানাতে হয়েছে খুব কায়দা করে, তিনটি কোনা উঁচু, কিন্তু চার নাম্বার কোনাটি ঝুলে পড়ে সেটাকে একটা কালবোশেখির ঝড়ে ভেঙেপড়া বাসার মতো দেখাতে লাগল।

রাতে একা-একা বিছানায় শুয়ে রইলাম। বাড়িতে আমি আর লাবু রাঙাবুবুর সাথে ঘুমাই। ঘুমানোর আগে লাবু বলে, রাঙাবুবু, একটা গল্প বল।

আমি কিছু বলি না, এত বড় হয়ে গেছি, গল্প বলার কথা বলি কেমন করে? রাঙাবুবু প্রথমে বলে, ঘুমা ঘুমা, কত রাত হয়েছে দেখেছিস?

লাবু তখন ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে, তখন আমিও বলি, বল্-না একটা গল্প, রাঙাবুবু।

আমি শুনতে চাইলে রাঙাবুবু খুব খুশি হয়, তখন বলে, কোনটা শুনবি?

আমি কোনোদিন বলি রবিনসন ক্রুসো, কোনোদিন বুলি যখের ধন। সব বই আমিও পড়েছি, রাঙাবুবুর জন্যে বই তো আমিই আনি লাইব্রেরি থেকে! সব আমার জানা গল্প, তবু রাঙাবুবুর মুখ থেকে শুনতে এত ভালো লাগে! সব যেন একেবারে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে যায়!

রাঙাবুবু যখন গল্প শুরু করে, কী ভালোই না তখন লাগে।

আজকে আমি একা। ঘরে কি সুন্দর একটা নীল বাতি জ্বলছে, সবকিছু আবছা আবছা দেখা যায়, মনে হয় ঘরের ভিতর যেন জোছনা হয়েছে। কেমন জানি অবাস্তব মনে হয় সবকিছু। ঘুমের মাঝে বল্টু নড়াচড়া করছে, শুনলাম দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বলছে, ফাটিয়ে ফেলব, একেবারে ফাটিয়ে ফেলব।

কে জানে আমাকে লক্ষ করেই বলছে কি না!