উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

২. বদ্রীবাবুর কথা শুনে

আমরা চারজন বদ্রীবাবুর কথা শুনে পরোটার মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, আর টেনিদার উঁচু নাকটা ঠিক একটা ডিম-ভাজার মতো হয়ে গেল। বদ্রীবাবু আমাদের ঠাট্টা করছেন কি না বুঝতে পারলুম না। কিন্তু অমন হাঁড়ির মতো যাঁর মুখ আর বিতিকিচ্ছিরি তিরিক্ষি যাঁর মেজাজ—এই ঝুপসি প্রেসটার ভেতরে একটা হুতোম প্যাঁচার মতো বসে বসে আর কচর মচর করে করে মুড়ি চিবুতে চিবুতে তিনি আমাদের ঠাট্টা করবেন, এটা কিছুতেই বিশ্বাস হল না।

ঠিক সেই সময় প্রেসের দিকে, বদ্রীবাবুর রান্নাঘর থেকে কড়া রসুন আর লঙ্কার ঝাঁঝের সঙ্গে উৎকট গন্ধ ভেসে এল একটা, খুব সম্ভব শুঁটকী মাছ। সেগন্ধ এমনি জাঁদরেল যে আমরা চার জন্যেই এক সঙ্গে লাফিয়ে উঠলুম—আমাদের ঘোর কেটে গেল।

টেনিদা একবার মাথা চুলকে বললেন, আপনি ঠিক বলছেন স্যার, কম্বল চাঁদেই—

বদ্রীবাবু বললেন, আই অ্যাম শিয়োর।

ক্যাবলা তার চশমার ভেতর দিয়ে প্যাট প্যাট করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। গত বছর চশমা নেবার পর থেকেই ওকে খুব ভারিক্কি গোছের দেখায়। মুরুবিয়ানার ভঙ্গিতে বললে, আপনি এত শিয়োর হলেন কী করে, জানতে পারি কি? যেচাঁদে রাশিয়ানরা এখনও যেতে পারল না, আমেরিকানরাও আজ পর্যন্ত–

ওরা না পারলেও কম্বল পারে-সংক্ষেপে জবাব দিলেন বদ্রীবাবু।

রান্নাঘর থেকে শুঁটকী মাছের সেই বিকট গন্ধটা আসছিল, তাতে নাক টাক কুঁচকে বেজায় রকম একটা হাঁচতে যাচ্ছিল হাকুল। কী কায়দায় যে ও হচিটাকে সামলে নিলে আমি জানি না। বিচ্ছিরি মুখ করে কেমন একটা ভুতুড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলে : ডানা আছে বুঝি কম্বলের? উইড়া যাইতে পারে?

আমি ঠিক বলতে পারব না। বদ্রীবাবু ভাবুকের মতো ঘাড় নাড়তে লাগলেন : তবে ও যা ছেলে, ওর এত দিনে যে ডানা গজায়নি এ কথাও আমি বিশ্বাস করি না। খুব সম্ভব জামার তলায় ওর ডানা লুকনো থাকত—আমি দেখতে পাইনি।

তা হলে আপনি বলছেন, টেনিদা খাবি খেয়ে বললে, সেই ডানা মেলে কম্বল পরীদের মতো উড়ে গেছে?

এগজ্যাকটলি।

ক্যাবলা বিড়বিড়িয়ে বললে, গাঁজা। ক্লিন গাঁজা।

তুমি ওখানে হুড়মুড় করে কী বলছ হে ছোকরা? বদ্রীবাবুর চোখ চোখা হয়ে উঠল, বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন : কী বকছ—অ্যাাঁ?

কিছু না স্যার কিছু না। হাবুল সেন চটপট সামলে নিলে : কইতাছিল—আহা, কী মজা।

মজা বই কি, দারুণ মজা, বদ্রীবাবু প্যাঁচার মতো প্যাঁচালো মুখে এবার এক টুকরো হাসি দেখা দিল : জানো, ছেলেবেলা থেকেই ওর চাঁদের দিকে ঝোঁক। পাঁচ বছর বয়সে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে চাঁদ খাব, চাঁদ খাব বলে পেল্লায় চিক্কার জুড়ল রাত দুটো পর্যন্ত পাড়ার লোকে ঘুমুতে পারে না। শেষে পুরো একখানা পাটালি খাইয়ে ওকে থামাতে হয়। বারো বছরের সময় চাঁদ ধরবার জন্যে একটা নিমগাছে উঠে বাদুড়ের ঠোকর খেয়ে পানা পুকুরের ভেতরে পড়ে গিয়েছিল—ভাগ্যিস বেশি জল ছিল না, তাই রক্ষে। তারপর বড় হয়ে চাঁদা আদায় করতে ওর কী উৎসাহ! সরস্বতী পুজো হোক, ঘেঁটু পুজো হোক আর ঘণ্টাকর্ণ পুজোই। হোক—চাঁদার নাম শুনলেই স্রেফ নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। সেই জন্যেই বলছিলুম, চাঁদ সম্পর্কে ওর বরাবরই একটা ন্যাক আছে।

চাঁদার ব্যাপারে ন্যাক অনেকেরই থাকে, সেটা কিছু নতুন কথা নয়—টেনিদা একবার গলাখাঁকারি দিলে : কিন্তু আমরা যদি কম্বলকে খুঁজে বের করতে পারি, আপনার কোনও আপত্তি আছে বদ্রীবাবু?

খুঁজে বের করতে পারলে আপত্তি নেই, না পারলেও আপত্তি নেই। বদ্রীবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু পয়সাকড়ি কিছু দিতে পারব না। তোমরা যে গোয়েন্দাগিরির ফী চেয়ে বসবে সেটি হচ্ছে না। সেইটে বুঝে তাকে চাঁদ থেকেই ধরে আনন, কিংবা চাঁদোয়ার ওপর থেকেই টেনে নামাও।

আজ্ঞে কিছুই দিতে হবে না, টেনিদা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না আপনাকে। শুধু একটু সাহায্য করতে হবে অন্য ভাবে।

পয়সা খরচ না হলে আমি সব রকম সাহায্যেই রাজি আছি তোমাদের। এবার বেশ উৎসাহিত দেখা গেল বদ্রীবাবুকে : বলল, কী করতে হবে?

টেনিদা একবার ক্যাবলার দিকে তাকাল। বললে, ক্যাবলা।

ইয়েস লিডার।

আমরা বদ্রীবাবুর কাছ থেকে কী সাহায্য পেতে পারি?

ক্যাবলা বললে, উনি আমাদের কিছু দরকারি ইনফর্মেশন দিতে পারেন।

জেনে নাও। টেনিদা এর মধ্যেই বদ্রীবাবুর সামনে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়েছিল। এবারে গম্ভীর হয়ে পা নাচাতে লাগল।

ক্যাবলা তার চশমাপরা ভারিক্কি মুখে এমন ভাবে চারদিকে তাকাল যে ঠিক মনে হল, যেন ইনসপেক্টর স্কুল দেখতে এসেছেন। তারপর মোটা গলায় বললে, আচ্ছা বদ্রীবাবু!

হুঁ।

নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে আপনি কোনও রকম ভাবান্তর লক্ষ করেছিলেন কম্বলের?

ক্যাবলার সেই দারুণ সিরিয়াস ভঙ্গি আর মোটা গলা দেখে আমার তাজ্জব লেগে গেল। হাঁ, পুলিশে ঠিক এমনি ভাবেই জেরা-টো করে বটে। এমন কি, বদ্রীবাবুও যেন ঘাবড়ে গেলেন খানিকটা।

ইয়ে-ভাবান্তর—মানে হ্যাঁ, একটু ভাবান্তর হয়েছিল বই কি। অমন একখানা জাঁদরেল মাস্টার দেখলে কেই বা খুশি হয় বলো। তার একটা ঘুষিতেই কম্বল তেঁতুলের অম্বল হয়ে যেত।

আমি জিজ্ঞেস করলুম, তা হলে ঘুষি কম্বল খায়নি?

খেপেছ তুমি। বদ্রীবাবু মুখ বাঁকালেন : খেলে কি আর চাঁদে যেত? স্বর্গে পৌঁছুত তার আগে। আসলে মাস্টার প্রথম দিন এসে খুব শাসিয়ে গিয়েছিল। বলেছি, কাল এসে যদি দেখি যে পড়া হয়নি, তা হলে পিটিয়ে তোকে ছাতু করে দেব।

হাবুল বললে, অবুঝেছি। পলাইয়া আত্মরক্ষা কোরছে।

তা, ওভাবেও বলতে পারো কথাটা। পালিয়েছে মাস্টারের ভয়েই, তাতে সন্দেহ নেই।

বদ্রীবাবু হাবুলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন : এবং পালিয়ে সে চাঁদে গেছে।

টেনিদা দারুণ বিরক্ত হয়ে বললে, দেখুন বদ্রীবাবু, সব জিনিসের একটা লিমিট আছে। চাঁদে গেলেই হল—ইয়ার্কি নাকি? আর এত লোক থাকতে কম্বল? সব জিনিস পাটালি খাওয়া নয়, তা মনে রাখবেন।

বদ্রীবাবু বললেন, আমি প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না।

বটে—আমার ভারি উৎসাহ হল : কী প্রমাণ পেয়েছেন? টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদের ভেতরে কম্বলকে লাফাতে দেখেছেন নাকি?

টেলিস্কোপ আমার নেই। বদ্রীবাবু হাই তুলে বললেন, কিন্তু যা আছে তা এই প্রমাণই যথেষ্ট বলে বদ্রীবাবু একটুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিলেন আমাদের সামনে।

একসারসাইজ বুকের পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার ওপর শ্রীমান কম্বল তাঁর দেবাক্ষর সাজিয়েছেন। প্রথমে মনে হল, কতগুলো ছাতারে পাখি এঁকেছে বোধহয়। তারপরে ক্রমে ক্রমে পাঠোদ্ধার করে যা দাঁড়াল, এই রকম :

আমি নিরুদ্দেশ। দূরে বহু দূরে চলিলাম। লোটা কম্বলও লইলাম না! আর ফিরিব। ইতিকম্বলচন্দ্র।

এই চিঠির নীচে আবার কতকগুলো সাংকেতিক লেখা :

চাঁদ—চাঁদনি–চক্রধর। চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বর। নিরাকার মোষের দল। ছল ছল খালের জল। ত্রিভুবন থর-থর। চাঁদে চড়—চাঁদে চড়।

সেগুলো পড়ে আমরা তো থ।

বদ্রীবাবু মুচকি হেসে বললেন, কেমন, বিশ্বাস হল তো? চাঁদে চড়—চাঁদে চড়, নির্ঘাত চড়ে বসেছে। এমন কি, ইতি লিখে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে নামের আগে, দেখতে পাচ্ছ না? তার মানে কী? মানে-স্বর্গীয় হয়নি, চন্দ্রলোকে—

ক্যাবলা বললে, হুঁ, নিশ্চয় চন্দ্রলোকে। তা আমরা এই লেখাটার একটা কপি পেতে পারি?

নিশ্চয়-নিশ্চয়। তাতে আর আপত্তি কী!

ক্যাবলার হাতের লেখা ভালো, সেই ওটা টুকে নিলে। তারপর উঠে দাঁড়াল টেনিদা।

তা হলে আসি আমরা। কিছু ভাববেন না বদ্রীবাবু। শিগগিরই কম্বলকে আপনার হাতে এনে দেব।

এনে দিতেও পারো, না দিলেও ক্ষতি নেইবদ্রীবাবু হাই তুললেন : সত্যি বলতে কী, ওটা এমনি অখাদ্য ছেলে যে আমার ওর ওপরে অরুচি ধরে গেছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞেস করব! তোমরা কম্বলকে খুঁজে বের করতে চাও কেন? সে কি তোমাদের কারও কিছু নিয়ে সটকান দিয়েছে?

টেনিদা বললে, আজ্ঞে না, কিছুই নেয়নি। আর নেবার ইচ্ছে থাকলেও নিতে পারত না—আমরা অত কাঁচা ছেলে নই। কম্বলকে আমরা খুঁজতে বেরিয়েছি নিতান্তই নিঃস্বার্থ পরোপকারের জন্যে।

পরোপকারের জন্যে! এ-যুগেও ওসব কেউ করে নাকি? বদ্রীবাবু খানিকক্ষণ হাঁ করা কাকের মতো চেয়ে রইলেন আমাদের দিকে : তোমরা তো দেখছি সাংঘাতিক ছেলে। তা ভবিষ্যতে গুড ক্যারাক্টারের সার্টিফিকেট দরকার থাকলে এসো আমার কাছে, আমি খুব ভালো করে লিখে দেব।

আজ্ঞে, আসব বই কি–ক্যাবলা খুব বিনীতভাবে একথা বলবার পর আমরা বদ্রীবাবুর প্রেস থেকে বেরিয়ে এলুম। রাস্তায় নেমে কেলব কয়েক পা হেঁটেছি, এমন-সময়—

বোঁ-ও-ও

টেনিদার ঠিক কান ঘেঁষে কামানের গোলার মতো একটা পচা আম ছুটে বেরিয়ে গেল—ফাটল গিয়ে সামনে ঘোষেদের দেওয়ালে। খানিকটা দুর্গন্ধ কালচে রস পড়তে লাগল দেওয়াল বেয়ে। ওইটে টেনিদার মাথায় ফাটলে আর দেখতে হত না—নির্ঘাত নাইয়ে ছাড়ত।

তক্ষুনি আমরা বুঝতে পারলুম, কম্বলের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছন আছে কোনও গভীর চক্রান্তজাল, আর এরই মধ্যে আমাদের ওপর শত্রুপক্ষের আক্রমণ শুরু হয়েছে।