প্রশ্নোত্তরে আলোচনা
১৮৯৬ খৃঃ ২৫শে মার্চ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (U.S.A) গ্রাজুয়েট ফিলজফিক্যাল সোসাইটির সভায় বেদান্তদর্শন সম্বন্ধে বক্তৃতার পর শ্রোতাদের সহিত স্বামীজীর নিম্নলিখিত প্রশ্নোত্তর অনুসারে আলোচনা হইয়াছিল :
প্র। ভারতে দার্শনিক চিন্তা বর্তমানে কিরূপ ক্রিয়াশীল, তাহার কিছু জানিতে ইচ্ছা করি। এ-সকল বিষয় আজকাল কতটা আলোচিত হইয়া থাকে?
উ। পূর্বেই বলিয়াছি, ভারতের অধিকাংশ লোকই প্রকৃত পক্ষে দ্বৈতবাদী অতি অল্পসংখ্যকই অদ্বৈতবাদী। তাহাদের প্রধান আলোচনার বিষয়—মায়াবাদ ও জীবতত্ত্ব। আমি এদেশে আসিয়া দেখিলাম, এখানকার শ্রমজীবীরা বর্তমান রাজনীতিক অবস্থার সহিত বিশেষ পরিচিত, কিন্তু যখন তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ধর্ম বলিতে তোমরা কি বোঝ, অমুক অমুক সম্প্রদায়ের ধর্মমত কি প্রকার?’—তাহারা বলিল, ‘আমরা জানি না, তবে গির্জায় যাই।’ ভারতে কিন্তু কোন কৃষককে যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘তোমাদের শাসনকর্তা কে?’—সে বলিবে, ‘তা জানি না; তবে খাজনা দিয়া থাকি।’ কিন্তু যদি তাহাকে তাহার ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি, সে অমনি বুঝাইয়া দিবে—সে দ্বৈতবাদী, এবং সে মায়া ও জীবতত্ত্ব সম্বন্ধে তাহার ধারণা বিস্তারিতভাবে বলিতে প্রস্তুত হইবে। সে লিখিতে পড়িতে জানে না, কিন্তু এ-সকল সে সন্ন্যাসীদের নিকট হইতে শিখিয়াছে এবং ঐ-সব বিষয়ে আলোচনা করিতে খুব ভালবাসে। সারাদিন কাজের পর কৃষকেরা গাছতলায় বসিয়া ঐ-সব তত্ত্ব আলোচনা করিয়া থাকে।
প্র। ‘গোঁড়ামি’ বলিতে হিন্দুগণ কি বুঝেন?
উ। বর্তমান কালে আহার পান ও বিবাহ সম্বন্ধে তিনিগত বিধিনিষেধগুলি প্রতিপালন করাকেই ‘গোঁড়ামি’ বলে। তারপর হিন্দু যে-কোন মতে বিশ্বাস করুক, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। ভারতে কখন সংঘবদ্ধ ধর্মমণ্ডলী বা চার্চ ছিল না, সুতরাং গোঁড়া বা খাঁটি হিন্দুমত গঠিত ও বিধিবদ্ধ করিবার জন্য একদল লোক কোন কালেই ছিল না। মোটামুটিভাবে আমরা বলিয়া থাকি, যাহারা বেদবিশ্বাসী, তাহারাই গোঁড়া বা খাঁটি হিন্দু; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখিতে পাই, দ্বৈতবাদী সম্প্রদায়সমূহের অনেকেই বেদ অপেক্ষা পুরাণেই বেশী বিশ্বাস করিয়া থাকেন।
প্র। আপনাদের হিন্দুদর্শন গ্রীকদের স্টোয়িক১ (stoic) দর্শনের উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল?
উ। খুব সম্ভবতঃ আলেকজান্দ্রিয়া-বাসিগণের মধ্য দিয়া হিন্দুদর্শন উহারম উপর কিছু প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। পিথাগোরাস যে সাংখ্যমতের দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিলেন, এরূপ সন্দেহ করিবার কারণ আছে। যাহাই হউক, আমাদের ধারণা—সাংখ্যদর্শনই বেদ-নিবদ্ধ দার্শনিক-তত্ত্বসমূহকে যুক্তিবিচার দ্বারা সমন্বয় করিবার প্রথম চেষ্টা। এমন কি বেদেও ‘কপিল’ নামের উল্লেখ দেখিতে পাই : ঋষিং প্রসূতং কপিলং যস্তমগ্রে২ … অর্থাৎ যিনি পূর্বে জাত সেই কপিল ঋষিকে জ্ঞানে পূর্ণ করিয়াছিলেন।
প্র। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সহিত এই মতের কি বিরোধ?
উ। কিছুমাত্র বিরোধ নাই, বরং আমাদের সহিত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সামজ্ঞস্য আছে।আমাদের পরিনামবাদ এবং আকাশ ও প্রাণতত্ত্ব ঠিক আপনাদের আধুনিক দর্শনের সিদ্ধান্তের মতো। আপনাদের পরিণামবাদ বা ক্রমবিকাশ আমাদের যোগ ও সাংখ্যদর্শনের ভিতর রহিয়াছে। যথা, পতঞ্জলি প্রকৃতির আপূরণের দ্বারা এক জাতির অন্য জাতিতে পরিণত হইবার কথা বলিয়াছেন।—’জাত্যন্তরপরিণামঃ প্রকৃত্যাপূরাৎ।’৩ তবে ইহার কারণ সম্বন্ধে পতঞ্জলির সহিত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের মতভেদ আছে। তাঁহার পরিণামের ব্যাখ্যা আধ্যাত্মিক। তিনি বলেন, ক্ষেত্রে নিকটবর্তী জলাশয় হইতে জলসেচনের জন্য যেমন কৃষককে কেবল জলাবরোধটি তুলিয়া ফেলিতে হয়—’নিমিত্তমপ্রয়োজকং প্রকৃতীনাং বরণভেদস্তু ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ’৪—সেইরূপ সকল মানবই পূর্ব হইতেই অনন্তশক্তিসম্পন্ন, কেবল এই-সকল বিভিন্ন অবস্থাচক্ররূপ প্রতিবন্ধক বা বাধা তাহাকে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেইগুলি সরাইয়া ফেলিলেই তাহার সেই অনন্ত শক্তি মহাবেগে বাহির হইয়া অভিব্যক্ত হইয়া থাকে। ইতর প্রাণীর ভিতর মনুষ্যভাব অবরুদ্ধ রহিয়াছে; যখন সুযোগ উপস্থিত হয়, তখনই সে মানুষরূপে অভিব্যক্ত হয়। আবার যখন উপযুক্ত সুযোগ ও অবসর উপস্থিত হয়, তখনই মানবের মধ্যে যে-ঈশ্বরত্ব বর্তমান, তাহা অভিব্যক্ত হয়। সুতরাং আধুনিক নূতন মতবাদসমূহের সহিত আমাদের বিবাদ করিবার বিশেষ কিছু নাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুন, ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি-ব্যাপারে সাংখ্য মতের সহিত আধুনিক শারীর-বিজ্ঞানের (Physiology) পার্থক্য অতি অল্প।
———-
১। খৃঃ পূঃ ৩০৮ গ্রীক দার্শনিক জেনো (Zeno) কর্তৃক এই দর্শন প্রচারিত হয়। এই মতে সুখ-দুঃখে ভাল-মন্দে সমভাবসম্পন্ন হওয়া এবং সহ্য করিয়া যাওয়াই মানবজীবনের পরম পুরুষার্থ।
২। শ্বেতাশ্বতর উপ., ৫/২
৩। যোগ সূত্র, কৈবল্যপাদ, ২
৪। ঐ, ৩
প্র। কিন্তু আপনাদের জ্ঞানার্জনের প্রণালী কি ভিন্ন?
উ। হাঁ। আমরা দাবি করি, মনের শক্তিসমূহকে একমুখী করাই জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায়। বহির্বিজ্ঞানে বাহ্য বিষয়ে মনকে একাগ্র করিতে হয়—আর অন্তর্বিজ্ঞানে মনের গতিকে আত্মাভিমুখী করিতে হয়। আমরা মনের এই একাগ্রতাকে ‘যোগ’ আখ্যা দিয়া থাকি।
প্র। একাগ্র অবস্থায় কি এই-সকল তত্ত্বের সত্যতা স্বতঃসিদ্ধ হইয়া পড়ে?
উ। যোগীরা এই একাগ্রতা-শক্তির ফল অতি মহৎ বলিয়া বর্ণনা করিয়া থাকেন। তাঁহারা দাবি করেন, মনের একাগ্রতার দ্বারা জগতের প্রত্যেক সত্য—বাহ্য ও আন্তর সকল সত্য করামলকবৎ প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে।
প্র। অদ্বৈতবাদী সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে কি বলেন?
উ। অদ্বৈতবাদী বলেন : এই-সব সৃষ্টিতত্ত্ব ও অন্যান্য যাহা কিছু, সবই মায়ার—এই আপাতপ্রতীয়মান প্রপঞ্চের অন্তর্গত। প্রকৃতপক্ষে উহাদের অস্তিত্ব নাই। তবে আমরা যতদিন মায়াবদ্ধ, ততদিন আমাদিগকে এই-সকল দৃশ্য দেখিতে হয়। এই দৃশ্যজগতে ঘটনাবলী কতকগুলি নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে ঘটিয়া থাকে। উহাদের বাহিরে আর কোন নিয়ম ও ক্রম নাই, সেখানে মুক্তি—স্বাধীনতা।
প্র। অদ্বৈতবাদ কি দ্বৈতবাদের বিরোধী?
উ। উপনিষদ্ প্রণালীবদ্ধভাবে লিখিত নয় বলিয়া দার্শনিকেরা যখন কোন মতবাদ গঠন করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা উপনিষদের মধ্য হইতে নিজদের অভিপ্রায় অনুযায়ী বচনাবলী বাছিয়া লইয়াছেন। সেই কারণে সকল দর্শনকারই উপনিষদ্কে প্রমানরূপে গ্রহণ করিয়াছেন, নতুবা তাঁহাদের দর্শনের কোনরূপ ভিত্তিই থাকিতে পারিত না। তথাপি প্রকৃতপক্ষে উপনিষদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তাপ্রণালীর ভিত্তি দেখিতে পাই, আমাদের সিদ্ধান্ত এই যে, অদ্বৈতবাদ দ্বৈতবাদের বিরোধী নয়। আমরা বলি, সত্য বা ধর্ম লাভের তিনটি প্রয়োজনীয় সোপানের মধ্যে দ্বৈতবাদ অন্যতম সোপান মাত্র; প্রথমটিই দ্বৈতবাদ। তারপর মানুষ আরও উচ্চতর অবস্থায় উপস্থিত হয়—উহা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। অবশেষে সে দেখিতে পায়, সে বিশ্বের সহিত অভিন্ন। সুতরাং এই তিনটি পরস্পর-বিরোধী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক।
প্র। মায়া বা অজ্ঞান আছে কেন?
উ। কার্যকারণ-সংঘাতের সীমার বাহিরে ‘কেন’ এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে না। মায়ার ভিতরেই কোন বস্তু সমন্ধে ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করা যাইতে পারে। সুতরাং আমরা বলি, প্রশ্নটিকে ন্যায়শাস্ত্র-সঙ্গতভাবে প্রকাশ করিতে পারিলেই আমরা উহার উত্তর দিব। তৎপূর্বে দিবার অধিকার আমাদের নাই।
প্র। সগুণ ঈশ্বর কি মায়ার অন্তর্গত?
উ। হাঁ, এই সগুণ ঈশ্বর মায়ার মধ্য দিয়া দৃষ্ট সেই নির্গনণ ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছু নন। মায়া বা প্রকৃতির অধীন হইলে সেই নির্গুণ ব্রহ্মকে ‘জীমাত্মা’ বলে এবং মায়াধীশ বা প্রকৃতির নিয়ন্তারূপে সেই নির্গুণ ব্রহ্মই ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্ম। যদি কোন ব্যক্তি সূর্য দেখিবার জন্য এখান হইতে যাত্রা করে, সে প্রথমে সূর্যকে ছোট দেখিবে; যতদিন না আসল সূর্যের নিকট পৌছিতেছে, ততদিন ইহাকে ক্রমশঃ বড় হইতে বড় দেখিবে। যতই সে অগ্রসর হয়, ততই সে ভিন্ন ভিন্ন সূর্য দেখিতেছে বলিয়া মনে করিতে পারে, কিন্তু সে যে এক সূর্যই দেখিতেছে, তাহাতে আমাদের কোন সন্দেহ নাই। এইভাবে আমরা যাহা কিছু দেখিতেছি, সবই সেই নির্গুণ ব্রহ্ম-সত্তারই বিভিন্ন রূপমাত্র, সুতরাং সেই হিসাবে তাহারা সত্য। ইহাদের মধ্যে কোনটিই মিথ্যা নয়, তবে আমরা এইটুকু বলিতে পারি, এগুলি নিম্নস্তরের অবস্থা মাত্র।
প্র। সেই পূর্ণ নিরপেক্ষ সত্তাকে জানিবার বিশেষ প্রণালী কি?
উ। আমরা বলি, দুইটি প্রণালী আছে। একটি ইতিবাচক প্রবৃত্তিমার্গ, অপরটি নেতিবাচক নিবৃত্তিমার্গ। প্রথমোক্ত মার্গে সমগ্র জগৎ চলিতেছে—ইহা প্রেমের পথ। যদি প্রেমের পরিধি অনন্তগুণ বাড়াইয়া দেওয়া যায়, তবে আমরা সেই এক সর্বজনীন উপনীত প্রেমে হই। অপর পথ ‘নেতি, নেতি’ অর্থাৎ ইহা নয়, ইহা নয়—এইরূপ সাধন দ্বারা চিত্তের যে যে তরঙ্গ মনকে বহির্মুখী করিতে চেষ্টা করে, তাহাকেই নিবারণ করিতে হয়। পরিশেষে মনের যেন মৃত্যু হয়, তখন সত্য স্বয়ং প্রকাশিত হইয়া থাকে। আমরা এই অবস্থাকে সমাধি বা জ্ঞানাতীত অবস্থা বা পূর্ণ জ্ঞানের অবস্থা বলিয়া থাকি।
প্র। ইহা তাহা হইলে বিষয়ীকে (জ্ঞাতা বা দ্রষ্টাকে) বিষয়ে (জ্ঞেয় বা দৃশ্যে) নিমজ্জিত করার অবস্থা?
উ। বিষয়ীকে বিষয়ে নয়, বিষয়কে বিষয়ীতে লীন করা। বাস্তবিক এই জগৎ লোপ পায়, কেবল আমি থাকি—একমাত্র আমিই বর্তমান।
প্র। আমাদের কয়েকজন জার্মান দার্শনিকের মত—ভারতের ভক্তিবাদ খুব সম্ভবতঃ পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল।
উ। আমি ইঁহাদের সহিত একমত নই, এরূপ অনুমান মুহূর্তমাত্রও টিকিতে পারে না। ভারতীয় ভক্তি পাশ্চাত্য ভক্তির মতো নয়। ভক্তি সম্বন্ধে আমাদের মুখ্য ধারণা এই যে, উহাতে ভয়ের ভাব আদৌ নাই—কেবল ভগবান্কে ভালবাসা।
ভয়ে উপাসনা হয় না, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সর্বদা শুধু ভালবাসার ভিতর দিয়াই উপাসনা সম্ভব। দ্বিতীয়তঃ এইরূপ অনুমান সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। ভক্তির কথা অতি প্রাচীন উপনিষদ্সমূহেও রহিয়াছে; ঐ উপনিষদ্গুলি খ্রীষ্টানদের বাইবেল অপেক্ষা অনেক প্রাচীন। সংহিতার মধ্যেও ভক্তির বীজ রহিয়াছে। ‘ভক্তি’ শব্দটিও পাশ্চাত্য শব্দ নয়। বেদ-মন্ত্রে উল্লিখিত ‘শ্রদ্ধা’ শব্দ হইতে ক্রমশ ভক্তিবাদের উদ্ভব হইয়াছিল।
প্র। খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে ভারতবাসীর কিরূপ ধারণা?
উ। খুব ভাল বলিয়াই ধারণা। বেদান্ত সকলকেই গ্রহণ করিয়া থাকে। ধর্মশিক্ষা সম্বন্ধে অন্যান্য দেশ অপেক্ষা ভারতে একটি বিশেষত্ব আছে। মনে করুন, আমার একটি ছেলে আছে। আমি তাহাকে কোনপ্রকার ধর্মমত শিক্ষা দিব না—তাহাকে প্রাণায়াম শিখাইব, মনকে একাগ্র করিতে শিখাইব, এবং একটু সামান্য প্রার্থনা শিখাইব—আপনারা প্রার্থনা বলিতে যেরূপ বুঝেন, তাহা নহে, কেবল কতকটা এইভাবের প্রার্থনা শিখাইব :
যিনি এই জগদ্ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করিয়াছেন, আমি তাঁহাকে ধ্যান করি—তিনি আমার মনকে জ্ঞানালোকে আলোকিত করুন’১ তাহার ধর্মশিক্ষা এইরূপ চলিবে, তারপর সে বিভিন্নমতাবলম্বী দার্শনিক ও আচার্যগণের মত শুনিতে থাকিবে। সে ইঁহাদের মধ্যে যাঁহার মত নিজের সর্বাপেক্ষা উপযোগী বলিয়া মনে করিবে, তাঁহাকেই গ্রহণ করিবে—তিনি তাহার গুরু হইবেন, সে শিষ্য হইবে। সে তাঁহাকে বলিবে, ‘আপনি যে দর্শন প্রচার করিতেছেন, তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট, অতএব ইহা আমাকে শিখাইয়া দিন।’ আমাদের মূল কথাটা এই যে, আপনার মত আমার উপযোগী হইতে পারে না, আবার আমার মত আপনার উপযোগী হইতে পারে না। প্রত্যেকের সাধনপথ ভিন্ন ভিন্ন। আমার কন্যার সাধনপথ এক প্রকার, আমার পুত্রের অন্য প্রকার, আমার আবার সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে। সুতরাং প্রত্যেকেরই ইষ্ট বা নির্বাচিত পথ ভিন্ন হইতে পারে—এবং এই সাধনপথের বিষয় প্রত্যেকেই নিজ নিজ অন্তরে গোপন করিয়া থাকেন। ঐ পথের বিষয় আমি জানি ও আমার গুরু জানেন, আর কাহাকেও আমরা উহা জানাই না; কারণ আমরা লোকের সঙ্গে অনর্থক বিবাদ করিতে চাই না। উহা অপরের নিকট প্রকাশ করিলে তাহার কোন উপকার হইবে না; কারণ প্রত্যেককেই নিজ নিজ পথ বাছিয়া লইতে হইবে। এই জন্য সাধারণের নিকট কেবল সর্বজন-সম্মত দর্শন ও সাধনপ্রণালীসমূহই শিক্ষা দেওয়া যাইতে পারে। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি—অবশ্য দৃষ্টান্তটি শুনিলে হাসি পাইবে। এক পায়ে দাঁড়াইয়া থাকিলে হয়তো আমার উন্নতি হইতে পারে। এখন উহা আমার পক্ষে উপযোগী হইলেও আমি যদি সকলকে এক পায়ে দাঁড়াইতে উপদেশ দিই, সকলে আমার কথা শুনিয়া হাসিবে। এরূপ হওযা খুব সম্ভব যে, আমি হয়তো দ্বৈতবাদী, আমার স্ত্রী অদ্বৈতবাদী। আমার শেন পুত্র ইচ্ছা করিলে খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদের উপাসক হইতে পারে, তিনিই তাহার ইষ্ট। অবশ্য তাহাকে জাতিগত সামাজিক নিয়ম প্রতিপালন করিতেই হইবে।
———-
১ গায়ত্রী-মন্ত্রের সরলার্থ
প্র। সকল হিন্দুই কি জাতিবিভাগে বিশ্বাসী?
উ। বাধ্য হইয়া জাতিগত নিয়ম মানিতে হয়। আস্থা না থাকিলেও সামাজিক নিয়ম তাহাদের মানিতেই হয়।
প্র। এই প্রাণায়াম ও একাগ্রতার অভ্যোস কি সর্বসাধারণে করিয়া থাকে?
উ। হাঁ, তবে কেহ কেহ অতি অল্পমাত্রই অভ্যাস করিয়া থাকে—যতটুকু না করিলে ধর্মশাস্ত্রের আদেশ লঙ্ঘন করা হয়, ততটুকুই করিয়া থাকে। ভাতরের মন্দিরগুলি এখানকার চার্চের মতো নয়। আগামী কালই সমুদয় মন্দির অন্তর্হিত হইতে পারে, লোকে উহার একান্ত অভাববোধ করিবে না। স্বর্গকাম বা পুত্রকাম হইয়া অথবা ঐরূপ অন্য কিছুর জন্য লোকে মন্দির নির্মাণ করায়। কেহ হয়তো খুব একটা বড় মন্দির প্রতিষ্ঠা করাইল এবং পূজার জন্য কয়েকজন পুরোহিত নিযুক্ত করিয়া দিল, কিন্তু আমার সেখানে যাইবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কারণ আমার যা-কিছু পূজা-পাঠ, তাহা আমার ঘরেই হইয়া থাকে। প্রত্যেক বাড়িতেই আলাদা একটি ঘর থাকে, তাহাকে ঠাকুরঘর বা পূজাগৃহ বলে। দীক্ষাগ্রহণের পর প্রত্যেক বালক-বালিকার জীবনে কর্তব্য—প্রথমে স্নান, তারপর পূজা করা। আর তাহার পূজা বা উপাসনা—এই প্রাণায়াম ও ধ্যান এবং বিশেষ একটি ‘নাম’ জপ করা। আর একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখিতে হয়—সাধনের সময় শরীরটাকে সোজা করিয়া রাখিতে হয়। আমাদের বিশ্বাস—মনের শক্তির দ্বারা শরীরটাকে সুস্থ রাখা যাইতে পারে। একজন এইরূপ পূজা করিয়া উঠিয়া গেল , আর একজন আসিয়া সেই আসনে বসিয়া পূজা করিতে লাগিল—সকলেই নিস্তব্ধভাবে নিজের নিজের পূজা করিয়া চলিয়া গেল। সময়ে সময়ে এক ঘরে তিন-চার জন বসিয়া উপাসনা করে, কিন্তু প্রত্যেকেরই উপাসনা-প্রণালী হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। এইরূপ পূজা প্রত্যহ অন্ততঃ দুইবার করিয়া করিতে হয়।
প্র। আপনি যে অদ্বৈত অবস্থার কথা বলেন, উহা কি কেবল আদর্শমাত্র, না কেহ ঐ অবস্থা সত্যই লাভ করিয়াছেন?
উ। আমরা বলি, উহা প্রত্যক্ষের অন্তর্গত ব্যাপার—ঐ অবস্থা উপলব্ধি করিবার বিষয়। যদি উহা কেবল কথার কথা হইত, তবে তো উহা কিছুই নয়। বেদ ঐ তত্ত্ব উপলব্ধি করিবার জন্য তিনটি উপায়ের কথা বলেন : শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন। এই আত্মতত্ত্ব প্রথম শুনিতে হইবে, শুনিবার পর ঐ বিষয় বিচার করিতে হইবে—যেন অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা হয়; বিচার করিয়া জানিয়া শুনিয়া যেন বিশ্বাস করা হয়, এইরূপে নিজ স্বরূপ বিচার করিয়া তবে উহার ধ্যানে নিযুক্ত হইতে হইবে—তখন উহার সাক্ষাৎ উপলব্ধি হইবে। এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধিই যথার্থ ধর্ম। শুধু বিশ্বাস করা ধর্মের অঙ্গ নয়। আমরা বলি, এই সমাধি বা জ্ঞানাতীত অবস্থাই ধর্ম।
প্র। আপনি যদি কখন এই সমাধি-অবস্থা লাভ করেন, তবে আপনি কি উহার সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারিবেন?
উ। না, কিন্তু সমাধি-অবস্থা বা পূর্ণ জ্ঞানভূমি যে লাভ হইয়াছে, তাহা আমরা জীবনের উপর উহার ফলাফল দেখিয়া জানিতে পারি। একজন মূর্খ নিদ্রিত হইল—নিদ্রাভঙ্গে সে যে মূর্খ , সেই মূর্খই থাকিবে, হয়তো আরও খারাপ হইতে পারে। কিন্তু কেহ সমাধিস্থ হইলে সমাধিভঙ্গের পর—সে একজন তত্ত্বজ্ঞ, সাধু মহাপুরুষ হইয়া দাঁড়ায়। তাহাতেই বুঝা যায়, এই দুই অবস্থা কতদূর ভিন্ন।
প্র। আমি অধ্যাপক—র প্রশ্নের অনুসরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিতে চাই, আপনি এমন সব লোকের বিষয় জানেন কি না, যাঁহারা আত্ম-সম্মোহনতত্ত্বের (Self-hypnotism) কোনরূপ আলোচনা করিয়াছেন। অবশ্য প্রাচীন ভারতে নিশ্চয় এই বিদ্যার খুব চর্চা ছিল, এখন আর ততদূর নাই। আমি জানিতে চাই, যাঁহারা এখন উহার চর্চা করেন, তাঁহারা ঐ তত্ত্ব সম্বন্ধে কি মত ব্যক্ত করিয়াছেন এবং উহার কিরূপ অভ্যাস বা সাধন করিয়াছেন।
উ। আপনারা পাশ্চত্য দেশে যাহাকে সম্মোহনবিদ্যা(hypnotism) বলেন, তাহা আসল ব্যাপারের সামান্য অঙ্গমাত্র। হিন্দুরা উহাকে আত্মসম্মোহ-দূরীকরণ(self-de-hypnotization) বলেন। তাঁহারা বলেন, আপনারা তো সম্মোহিতই (hypontized) রহিয়াছেন—এই সম্মোহিত ভাবকে দূর করিতে হইবে বিগতমোহ (de-hypnotized) হইতে হইবে।
‘ন তত্র সূর্যো ভাতি না চন্দ্রতারকম্ নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।।’১
———-
১ কঠ উপ., ২/২/১০; শ্বেঃ উঃ, ৬/১১ মুঃ উঃ ২/২/১০
সেখানে সূর্য প্রকাশ পায় না, চন্দ্রতারাও নয়; বিদ্যুৎও সেখানে প্রকাশ পায় না, এই সামান্য অগ্নির আর কথা কি? তিনি প্রকাশ পাইতেছেন বলিয়াই সমুদয় প্রকাশিত হইতেছে।
ইহা তো সম্মোহন (hypnotization) নয়—মোহ দূরীকরণ বা অপসারণ (de-hypnotization)। আমারা বলিয়া থাকি, অন্য সকল ধর্মই এই প্রপঞ্চের সত্যতা শিক্ষা দেয়, অতএব তাহারা একপ্রকার সম্মোহন প্রয়োগ করিতেছে। কেবল অদ্বৈতবাদীই সম্মোহিত হইতে চান না। একমাত্র অদ্বৈতবাদীই অল্পবিস্তর বুঝিয়া থাকেন যে, সর্বপ্রকার দ্বৈতবাদ হইতেই সম্মোহন বা মোহ আসিয়া থাকে। কিন্তু অদ্বৈতবাদী বলেন, এমন কি বেদকেও ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দাও, সগুণ ঈশ্বরকেও ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দাও, এই জগদ্বহ্মাণ্ডটাকেও ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দাও, এমন কি তোমার নিজের দেহ-মনকেও ফেলিয়া দাও—কিছুই যেন না থাকে, তবেই তুমি সম্পূর্ণরূপে মোহমুক্ত হইবে।
‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।
আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান্ ন বিভেতি কদাচন।।’১
—মনের সহিত বাক্য তাঁহাকে না পাইয়া যেখান হইতে ফিরিয়া আসে, সেই ব্রহ্মের আনন্দকে জানিয়া আর কোন ভয় থাকে না। ইহাই মোহ অপসারণ।
‘ন পুণ্যং ন পাপং ন সৌখ্যং ন দুঃখং ন মন্ত্রো ন তীর্থং ন বেদা ন যজ্ঞাঃ।
অহং ভোজনং নৈব ভোজ্যং ব ভোক্তা চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্।।’২
—আমার পুণ্য নাই, পাপ নাই, সুখ নাই, দুঃখ নাই; আমার মন্ত্র, তীর্থ, বেদ বা যজ্ঞ কিছুই নাই; আমি ভোজন, ভোজ্য বা ভোক্তা কিছুই নই। আমি চিদানন্দরূপ শিব—আমিই শিব (মঙ্গলস্বরূপ)।
আমরা সম্মোহন বিদ্যার সমুদয় তত্ত্ব অবগত আছি। আমাদের যে মনস্তত্ত্ব-বিদ্যা আছে, তাহা পাশ্চাত্য দেশ সবে জানিতে আরম্ভ করিয়াছে ;তবে দুঃখের বিষয় এখনও সম্পূর্নরূপে জানিতে পারে নাই।
———-
১ তৈত্তি. উপ., ২/৯
২ নির্বাণষট্কম্—শঙ্করাচার্য
প্র। আপনারা আতিবাহিক দেহ (astral body)কাহাকে বলেন?
উ। আমরা উহাকে লিঙ্গশরীর বলিয়া থাকি। যখন এই দেহের পতন হয়, তখন অপর দেহপরিগ্রহ কিরূপে হয়? শক্তি কখন জড়পদার্থ ব্যতীত থাকিতে পারে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই যে, দেহত্যাগের পরে সূক্ষ্মভূতের কিয়দংশ আমাদের সঙ্গে থাকিয়া যায়। অভ্যন্তরবর্তী ইন্দ্রিগণ ঐ সূক্ষ্মভূতের সাহায্য লইয়া আর একটি দেহ গঠন করে, কারণ প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেহ গঠন করিতেছে—মনই শরীর গঠন করিয়া থাকে। যদি আমি সাধু হই, তবে আমার মস্তিষ্ক জ্ঞানী সাধুর মস্তিষ্কে পরিণত হইবে। আর যোগীরা বলেন, এই জীবনেই তাঁহারা নিজ দেহকে দেবদেহে পরিণত করিতে পারেন।
যোগীরা অনেক অদ্ভুত ব্যাপার দেখাইয়া থাকেন। রাশি রাশি মতবাদ অপেক্ষা সামান্য একটু অভ্যাসের মূল্য অনেক অধিক।সুতরাং আমি নিজে এটা-ওটা হইতে দেখি নাই বলিয়া সেগুলি মিথ্যা, এ-কথা বলিবার অধিকার আমার নাই। যোগীদের গ্রন্থে আছে, অভ্যাসের দ্বারা সর্বপ্রকার বিস্ময়কর ফল পাওয়া যায়। নিয়মিত অভ্যাসের দ্বারা অতি অল্পকালের ভিতর অল্প স্বল্প ফল পাওয়া যায়—তাহাতে জানিতে পারা যায়, এ ব্যাপারের ভিতর কোন ভণ্ডামি নাই। আর সর্বশাস্ত্রেই যে-সকল অলৌকিক ব্যাপারের উল্লেখ আছে, এই যোগীরা সেইগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন। প্রশ্ন এই : প্রত্যেক জাতির ভিতর এইসব অলৌকিক কার্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে কিরূপে? যে বলে—এ সমুদয় মিথ্যা, এগুলির ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নাই, তাহাকে যুক্তিবাদী বা বিচারপরায়ণ বলিতে পারা যায় না। যতদিন না সেগুলিকে ভুল বলিয়া আপনি প্রমাণ করিতে পারিতেছেন, ততদিন সেগুলিকে অস্বীকার করিবার অধিকার আপনার নাই। আপনাকে প্রমাণ করিতে হইবে যে, এগুলির কোন ভিত্তি নাই, তবেই আপনি ঐগুলি অস্বীকার করিবার অধিকারী হইবেন। কিন্তু তাহা তো আপনারা করেন নাই। অন্য দিকে যোগীরা বলিতেছেন, সেগুলি বাস্তবিক অলৌকিক ব্যাপার নয়, তাঁহারা এখনও ঐ-সব করিতে পারেন বলিয়া দাবি করেন। ভারতে আজ পর্যন্ত অনেক অদ্ভুত ব্যাপার সাধিত হইয়া থাকে, কিন্তু উহাদের কোনটিই অপ্রাকৃত শক্তির দ্বারা সাধিত হয় না। এই বিষয়ে অনেক গ্রন্থ আছে। কেবল মনস্তত্ত্ব-আলোচনার বৈজ্ঞানিক চেষ্টা ব্যতীত যদি এ-বিষয়ে আর কিছুই সাধিত না হইয়া থাকে, তবে উহার সমুদয় গৌরব যোগীদেরই প্রাপ্য।
প্র। যোগীরা কি কি ব্যাপার দেখাইতে পারেন, তাহার কোন দৃষ্টান্ত দিতে পারেন কি?
উ। অন্যান্য বিজ্ঞানের চর্চা করিতে হইলে তাহার উপর যতটা বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়, যোগী তাঁহার যোগ-বিদ্যার উপর তাহা অপেক্ষা অধিক বিশ্বাস করিতে বলেন না। কোন বিষয় গ্রহণ করিয়া তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য ভদ্রলোকে যতটুকু বিশ্বাস করিয়া থাকে, যোগী তাহা অপেক্ষা অধিক বিশ্বাস করিতে বলেন না। যোগীরা আদর্শ অতি উচ্চ। মনের শক্তি দ্বারা যে-সব ব্যাপার সাধিত হইতে পারে, তাহাদের মধ্যে নিম্মতর বিষয়গুলি আমি দেখিয়াছি, সুতরাং উচ্চতর ব্যাপারগুলি যে হইতে পারে, এ-বিষয়ে অবিশ্বাস করিবার অধিকার আমার নাই। যোগীর আদর্শ—সর্বজ্ঞতা ও সর্বশক্তিমত্তার সহায়তায় শাশ্বত শান্তি ও প্রেমের অধিকারী হওয়া। আমি একজন যোগীকে জানি, তাঁহাকে গোখুরা সাপে কামড়াইয়াছিল, দংশনমাত্র তিনি অচৈতন্য হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন, সন্ধ্যার সময় তাঁহার আবার চৈতন্য হয়। যখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কি হইয়াছিল?’ তিনি বলিলেন, ‘আমার প্রিয়তমের নিকট হইতে দূত আসিয়াছিল।’ এই যোগীর সমুদয় ঘৃণা, ক্রোধ ও হিংসার ভাব একেবারে দগ্ধ হইয়া গিয়াছে। কিছুতেই তাঁহাকে প্রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত করিতে পারে না। তিনি সর্বদা অনন্ত প্রেমস্বরূপ হইয়া রহিয়াছেন, প্রেমের শক্তিতে তিনি সর্বশক্তিমান্। এইরূপ ব্যক্তিই যথার্থ যোগী। আর এইসব অলৌকিক শক্তির প্রকাশ গৌণমাত্র। ঐগুলি লাভ করা যোগীর প্রকৃত লক্ষ্য নহে। যোগীরা বলেন, যোগী ব্যতীত আর সকলেই দাসবৎ—খাদ্যের দাস, বায়ুর দাস, নিজ স্ত্রীর দাস, নিজ পুত্রকন্যার দাস, টাকার দাস, স্বদেশীয়দের দাস, নামযশের দাস, এবং এই জগতের সহস্র সহস্র বিষয়ের দাস! যে ব্যক্তি এ-সকল বন্ধনের কোন বন্ধনে আবদ্ধ নন, তিনিই যথার্থ মানুষ, যথার্থ যোগী।
‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো ষেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ।।’১
———-
১ গীতা, ৫/১৯
এখানেই তাঁহারা সংসারকে জয় করিয়াছেন, যাঁহাদের মন সাম্যভাবে অবস্থিত। যেহেতু ব্রহ্ম নির্দোষ ও সমভাবাপন্ন, সেই হেতু তাঁহারা ব্রহ্মে অবস্থিত।
প্র:যোগীরা কি জাতিভেদকে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন?
উ। না; জাতিবিভাগ অপরিণত মনের শিক্ষালয় মাত্র।
প্র। এই অতিচেতন ভাবের (সমাধিতত্ত্বের) সহিত ভারতের গ্রীষ্মের কি কোন সম্বন্ধ নাই?
উ। কোন সম্বন্ধ আছে বলিয়া তো আমার বোধ হয় না। কারণ, সমুদ্র-পৃষ্ঠের পনর হাজার ফিট উপরে প্রায় মেরুপ্রদেশের আবহাওয়ায় হিমালয় পর্বতে এই যোগবিদ্যার উদ্ভব হইয়াছিল।
প্র। ঠাণ্ডা জলবায়ুতে কি যোগবিষয়ে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব?
উ। খুব সম্ভব, এবং জগতের মধ্যে ইহা যেমন কার্যে পরিণত করা সম্ভব, তেমন আর কিছুই নয়। আমরা বলি, আপনারা—আপনাদের মধ্যে প্রত্যেকেই—জন্ম হইতেই বৈদান্তিক। জীবনের প্রতিমুহূর্তেই আপনারা জাগতিক সকল বস্তুর সহিত নিজেদের একত্ব ঘোষণা করিতেছেন। যখনই আপনাদের হৃদয় সমগ্র জগতের কল্যাণের দিকে ধাবিত হয়, তখনই আপনারা অজ্ঞাতসারে প্রকৃত বেদান্তবাদী। আপনারা নীতিপরায়ণ, কিন্তু কেন নীতিপরায়ণ, তাহা জানেন না। বেদান্ত-দর্শনই নীতিতত্ত্বের বিশ্লেষণ করিয়া মানুষকে জ্ঞানতঃ নীতিপরায়ণ হইতে শিখাইয়াছে। বেদান্ত সকল ধর্মের সার।
প্র। আপনি কি বলেন যে, আমাদের—পাশ্চাত্য জাতিদের ভিতর এমন একটা অসামাজিক ভাব আছে, যাহা আমাদিগকে এত বহুত্ববাদী (pluralistic)করিয়াছে, আর প্রাচ্য দেশীয় লোক কি আমাদের অপেক্ষা অধিকতর সহানুভূতিসম্পন্ন?
উ। আমার মতে পাশ্চাত্য জাতি অধিকতর নিষ্ঠুরস্বভাব, আর প্রাচ্য-দেশীয় ব্যক্তিগণ সর্বভূতের প্রতি অধিকতর করুণাসম্পন্ন। কিন্তু তাহার কারণ শুধু এই যে, আপনাদের সভ্যতা খুব আধুনিক। কোন স্বভাবকে দয়াবৃত্তির প্রভাবে আনিতে কিছু সময়ের আবশ্যক। আপনাদের শক্তি যথেষ্ট, কিন্তু শক্তি-সংগ্রহ যে পরিমাণে চলিয়াছে, সেই পরিমাণে হৃদয়ের শিক্ষা চলে নাই, বিশেষতঃ মনঃসংযমের শক্তিও খুব অল্প পরিমাণেই অনুশীলন করা হইয়াছে। আপনাদিগকে সাধু ও ধীরপ্রকৃতি করিতে অনেক সময় লাগিবে। কিন্তু ভারতের প্রত্যেক রক্তবিন্দুতে এই ভাব প্রবাহিত। যদি আমি ভারতের কোন গ্রামে গিয়া সেখানকার লোককে রাজনীতি শিখাইতে চাই, তাহারা বুঝিবে না; কিন্তু যদি তাহাদিগকে বেদান্ত উপদেশ করি, তাহারা অমনি বলিবে ,হাঁ স্বামিন্ ,এখন আপনার কথা বুঝিতেছি- আপনি ঠিক বলিতেছেন।’ আজ পর্যন্ত ভারতের সর্বত্র সেই বৈরাগ্য বা অনাসক্তির ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা এখন খুবই পতিত, কিন্তু এখনও বৈরাগ্যের প্রভাব এত অধিক বিদ্যমান যে, রাজারাজড়া পর্যন্ত রাজ্য ত্যাগ করিয়া বিনা সম্বলে দেশের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ান।
কোন কোন স্থানে সাধারন গ্রাম্য বালিকাও চরকায় সূতা কাটিতে কাটিতে বলিয়া থাকে : আমাকে দ্বৈতবাদের কথা বলিও না; আমার চরকা ‘সোহহং, সোহহং—আমি সেই ব্রহ্ম, আমিই সেই ব্রহ্ম’ বলিতেছে। এইসব লোকের সহিত গিয়া কথা বলুন, এবং জিজ্ঞাসা করুন : তাহারা এইরূপ বলিয়া থাকে, অথচ ঐ পাথরটাকে প্রণাম করে কেন? তাহারা বলিবে, ‘আপনারা ধর্ম বলিতে শুধু মতবাদ বুঝিয়া থাকেন, কিন্তু আমরা ধর্ম বলিতে বুঝি—প্রত্যক্ষ অনুভূতি।’ তাহাদের মধ্যে কেহ হয়তো বলিয়া উঠিবে, ‘আমি তখনই যথার্থ বেদান্তবাদী হইব, যখন আমার সম্মুখ হইতে সমগ্র জগৎ অন্তর্হিত হইবে এবং আমি সত্যদর্শন করিব। যতদিন না তাহা হইতেছে, ততদিন আমার সহিত সাধারণ অজ্ঞ ব্যক্তির কোন প্রভেদ নাই। সেই জন্যই আমি এইসব প্রস্তরমূর্তির উপাসনা করিতেছি, মন্দিরে যাইতেছি, যাহাতে আমার প্রত্যক্ষানুভূতি হয়। আমি বেদান্ত শ্রবণ করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি সেই বেদান্তপ্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বকে দেখিতে—প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে ইচ্ছা করি’।
‘বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্।
বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে।।’১
———-
১ বিবেকাচূড়ামণি, ৬০—শঙ্করাচার্য
অনর্গল সদ্বাক্যযোজনা, শাস্ত্রব্যাখ্যা করিবার বিভিন্ন কৌশল—এ-সব কেবল পণ্ডিতদের আমোদের জন্য, উহার দ্বারা মুক্তিলাভের কোন সম্ভাবনা নাই।
যদি আমরা ব্রহ্মসাক্ষাৎকার করিতে পারি, তবেই মুক্তিলাভ করিব।
প্র। আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বসাধারণের এই স্বাধীনতার সহিত জাতিভাদপস্বীকারের কি সামঞ্জস্য আছে?
উ। কখনই নাই। লোকে বলিয়া থাকে, জাতিভেদ থাকা উচিত নয়। এমন কি যাহারা বিভিন্ন জাতিভুক্ত তাহারাও বলে, জাতিবিভাগ একটা খুব উঁচুদরের জিনিস নয়। কিন্তু তাহারা সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলে যে, আমাদের ইহা অপেক্ষা ভাল অন্য কোন জিনিস দাও, আমরা ইহা ছাড়িয়া দিব তাহারা বলে, তোমরা ইহার বদলে আমাদিগকে কি দিবে? জাতিভেদ কোথায় নাই? তোমরাও তো তোমাদের দেশে ক্রমাগত এইরূপ একটা জাতিবিভাগ গড়িবার চেষ্টা করিতেছে। কোন ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেই বলিয়া বসে, কয়েক শত ধনীর মধ্যে আমিও একজন। আমরাই কেবল একটা স্থায়ী জাতিবিভাগ গৃঠন করিতে সমর্থ হইয়াছি। অপরে উহার জন্য চেষ্টা করিতেছে, কিন্ত সফল হইতেছে না। আমাদের সমাজে অবশ্য যথেষ্ট কুসংস্কার ও মন্দ জিনিস আছে। আপনাদের দেশের কুসংস্কার ও মন্দ জিনিসগুলি আমাদের দেশে চালাইয়া দিতে পারিলেই কি সব ঠিক হইয়া যাইবে? জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ কোটি লোক এখনও খাইবার এক টুকরা রুটি পাইতেছে। অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আপনারা পড়িবার জন্য একখানি সংস্কৃত বইও পাইতেন না। এই জাতিবিভাগের দ্বারা এমন একটি দৃঢ় প্রাচীরের সৃষ্টি হইয়াছিল যে, উহার উপর বহিরাক্রমণের শত প্রকার তরঙ্গাঘাত আসিয়া পড়িয়াছে, অথচ কোনমতেই উহাকে ভাঙিতে পারে নাই। এখনও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে। সাত শত বর্ষ পূর্বে যেরূপ জাতিবিভাগ ছিল,এখন আর সেরূপ নাই। যতই উহার উপর আঘাত লাগিয়াছে, ততই উহা দৃঢ়তর আকার ধারণ করিয়াছে। এটি কি লক্ষ্য করিয়াছেন যে, একমাত্র ভারতই কখন পররাষ্ট্র-বিজয়ে নিজ দেশের বাহিরে যায় নাই? মহামতি সম্রাট্ অশোক বিশেষ করিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার উত্তরাধিকারীরা কেহ যেন পররাষ্ট্র-বিজয়ের চেষ্টা না করে। যদি অপর জাতি আমাদের নিকট শিক্ষক পাঠাইতে চায় পাঠাক, কিন্তু তাহারা যেন আমাদের বাস্তবিক সাহায্য করে, আমাদের জাতীয় সম্পত্তিরূপ ধর্মভাবের অনিষ্ট সাধন না করে। এইসব বিভিন্ন জাতি হিন্দুজাতিকে জয় করিতে আসিল কেন? হিন্দুরা কি অপর জাতির কোন অনিষ্ট করিয়াছিল? তাহারা যতটুকু সাধ্য জগতের উপকারই করিয়াছিল। তাহারা জগৎকে বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম শিখাইয়াছিল এবং পৃথিবীর অনেক অসভ্য জাতিকে সভ্য করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা প্রতিদানে পাইয়াছিল শুধু হত্যা, অত্যাচার ও ‘অবিশ্বাসী বদমাশ’—এই আখ্যা। বর্তমানকালেও পাশ্চাত্য ব্যক্তিদের লিখিত ভারত সমন্ধে গ্রন্থাবলী এবং ভারত ভ্রমনকারীদের লিখিত গল্পগুলি পড়ুন; কোন্ অনিষ্টের প্রতিশোধ লইবার জন্য ভারতবাদীদের এখনও এইরূপ কটুবাক্য বর্ষণ করা হইয়া থাকে?
[প্র। সভ্যতা সম্বন্ধে বৈদান্তিক ধারণা কিরূপ?]
উ। আপনারা দার্শনিক, আপনাদের মতে অবশ্য একতোড়া টাকা থাকা-না-থাকা লইয়া মানুষে মানুষে কখনও প্রভেদ হইতে পারে না। এইসব কলকারখানা ও জড়বিজ্ঞানের মূল্য কি? উহাদের একটি মাত্র ফল এই যে, উহারা জ্ঞান বিস্তার করিয়া থাকে। আপনারা অভাব বা দারিদ্র-সমস্যা পূরণ করিতে পারেন নাই, বরং অভাবের মাত্রা আরও বাড়াইয়াছেন। কলকব্জায় কখন দারিদ্র্য-সমস্যার সমাধান হইতে পারে না। উহাদের দ্বারা কেবল সংগ্রামই বাড়িয়া যায়, প্রতিযোগিতাই তীব্রতর হইয়া থাকে। জড় প্রকৃতির কি স্বতন্ত্র কোন মূল্য আছে? কোন ব্যক্তি যদি তারের মধ্য দিয়া তড়িৎপ্রবাহ চালাইতে পারে, আপনারা অমনি তাহার স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করিতে উদ্যোগী হন কেন? প্রকৃতি কি লক্ষ লক্ষ বার এই ব্যাপারে সাধন করিতেছে না? প্রকৃতিতে কি পূর্ব হইতেই এ-সব বিদ্যমান নাই? উহা পাইলে আপনার বিশেষ কি লাভ হইল? উহা তো পূর্ব হইতেই সেখানে রহিয়াছে। উহার একমাত্র মূল্য এই যে, উহা আমাদের উন্নতি সাধন করে। এই জগৎটা একটি ব্যায়মাগারের মতো; এখানে জীবাত্মা কর্ম দ্বারা উৎকর্ষ সাধন করিতেছে, এবং এই উৎকর্ষ-সাধনের ফলেই আমরা দেবতা হই। সুতরাং কোন্ বিষয় ভগবানের কতটা প্রকাশ তাহা জানিয়াই প্রত্যেক বিষয়ের মূল্য বা সারবত্তা নির্ধারণ করিতে হইবে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরত্বের এইরূপ প্রকাশই সভ্যতা।
প্র। বৌদ্ধদের কি কোন জাতিবিভাগ আছে?
উ। বৌদ্ধদের কখনই বড় বিশেষ জাতিবভাগ ছিল না, এবং ভারতে বৌদ্ধসংখ্যা অতি অল্প। বুদ্ধ একজন সমাজসংস্কারক ছিলেন। তথাপি আমি বৌদ্ধ দেশসমূহে দেখিয়াছি, সেখানে জাতিবিভাগ সৃষ্টি করিবার জন্য প্রবল চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু ঐ চেষ্টা সফল হয় নাই। বৌদ্ধদের জাতিবিভাগ কার্যতঃ কিছুই নয়, কিন্তু তাহারা মনে মনে নিজেদের উচ্চ জাতি বলিয়া গর্ব করিয়া থাকে।
বুদ্ধ অন্যতম বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি একটি নূতন সম্প্রদায় স্থাপন করিয়াছিলেন ,যেমন আজকালও অনেক নূতন সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে। যে-সব ভাব এখন বৌদ্ধধর্ম বলিয়া অভিহিত, সেগুলি তাঁহার নিজের নয়। সেগুলি অতি প্রাচীন। তিনি একজন মহাপুরুষ ছিলেন, এবং ভাবগুলির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করিয়াছিলেন। বৌদ্ধধর্মের নূতনত্ব উহার সামাজিক ভাগ। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরাই চিরদিন আমাদের আচার্যের আসন অধিকার করিয়া আসিয়াছেন; অধিকাংশ উপনিষদ্ই ক্ষত্রিয়গণের লেখা এবং বেদের কর্মকাণ্ড ব্রাহ্মণদের কীর্তি। সমগ্র ভারতে আমাদের যে-সকল বড় বড় আচার্য হইয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষত্রিয় ছিলেন; তাঁহাদের উপদেশও উদার ও সর্বজনীন, কিন্তু দুইজন ছাড়া ব্রাহ্মণ আচার্যগণের মধ্যে সকলেই অনুদারভাবাপন্ন। ভগবানের অবতার বলিয়া পূজিত রাম, কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ইঁহারা সকলেই ক্ষত্রিয় ছিলেন।
প্র। সম্প্রদায়, অনুষ্ঠান, শাস্ত্র—এ-সকল কি তত্ত্ব-সাক্ষাৎকারের সহায়ক?
উ। তত্ত্ব-সাক্ষাৎকার হইলে মানুষ সব ছাড়িয়া দেয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়, অনুষ্ঠান ও শাস্ত্র যতটা সেই অবস্থায় পৌঁছিবার উপায়-স্বরূপ হয়, ততটা উহাদের উপকারিতা আছে। কিন্তু যখন উহাদের দ্বারা ঐ সহায়তা না পাওয়া যাইবে, তখন অবশ্য উহাদিগের পরিবর্তন সাধন করিতে হইবে।
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্।।১
———-
১ গীতা, ৩/২৬
সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।
কুর্যাদ্ বিদ্বান্ তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।।১
—জ্ঞানী ব্যক্তি অজ্ঞানীদের অবস্থার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিবেন না, আর তাহাদের নিজ নিজ সাধনপ্রণালীতে তাহাদের বিশ্বাস নষ্ট করিবেন না, কিন্তু যথার্থভাবে তাহাদিগকে পরিচালিত করিবেন, এবং তিনি স্বয়ং যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় পৌঁছিবার পথ প্রদর্শন করিবেন।
প্র। আমিত্ব ও চারিত্রনীতি—বেদান্ত কিরূপ ব্যাখ্যা করিয়া থাকে?
উ। প্রকৃত আমিত্ব সেই পূর্ণব্রহ্ম—মায়া দ্বারাই উহা পৃথক্ পৃথক্ ব্যক্তির আকার ধারণ করিয়াছে। আপততঃ এইরূপ বোধ হইতেছে মাত্র, প্রকৃত-পক্ষে উহা সদাই সেই পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে এক সত্তাই বর্তমান—মায়া দ্বারাই উহা বিভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হইতেছে। মায়াতেই এইরূপ ভেদবোধ হইয়াছে। কিন্তু এই মায়ার ভিতরেও সর্বদাই সেই একের দিকে ফিরিয়া যাইবার চেষ্টা রহিয়াছে। প্রত্যেক জাতির চারিত্রনীতির ভিতর ঐ চেষ্টাই অভিব্যক্ত হইয়াছে, কারণ ইহা জীবাত্মার প্রকৃতিগত প্রয়োজন। সে ঐরূপ চেষ্টায় ঐ একত্ব লাভ করিতেছে আর একত্বলাভের এই চেষ্টাকেই আমরা চারিত্রনীর্তি-নামে অভিহিত করিয়া থাকি। অতএব আমাদের সর্বদা নীতি-পরায়ণ হওয়া আবশ্যক।
প্র। চারিত্রনীতির অধিকাংশই কি বিভিন্ন ব্যক্তির সম্বন্ধ লইয়াই ব্যাপৃত নয়?
উ। চারিত্রনীতির সবটাই ঐ। পূর্ণব্রহ্ম কখন মায়ার গণ্ডির ভিতর আসিতে পারে না।
প্র। আপনি বলেন, ‘আমি’ই সেই পূর্ণব্রহ্ম; আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলাম : এই ‘আমি’র জ্ঞান আছে কি না?
উ। ‘আমি’টা সেই পূর্ণব্রহ্মের প্রকাশস্বরূপ, আর এই ব্যক্ত অবস্থায় তাহাতে যে প্রকাশ-শক্তি কার্য করে, তাহাকেই আমরা ‘জ্ঞান’ বলি। অতএব সেই পূর্ণব্রহ্মের জ্ঞানস্বরূপে ‘জ্ঞান’ শব্দের প্রয়োগ যথাযথ নয় , কারণ পূর্ণবস্থা আপেক্ষিক জ্ঞানের অতীত।
প্র। আপেক্ষিক জ্ঞান কি পূর্ণ জ্ঞানের অন্তর্গত?
উ। হাঁ, একভাবে আপেক্ষিক জ্ঞানকে পূর্ণ জ্ঞানের অন্তর্গত বলিতে পারা যায়। যেমন একটা মোহর ভাঙাইয়া তাহা হইতে পয়সা সিকি দুয়ানি টাকা প্রভৃতি সর্বপ্রকার মুদ্রা প্রস্তুত করিতে পারা যায়, সেইরূপ ঐ পূর্ণ অবস্থা হইতে সর্বপ্রকার জ্ঞান লাভ করা যাইতে পারে। উহা অতিচেতন, জ্ঞানতীত বা পূর্ণ জ্ঞানাবস্থা – সাধারন জ্ঞান অজ্ঞান উভয়ই ইহার অর্ন্তগত। যে, ব্যক্তি ঐ অবস্থা লাভ করে, আমাদের পরিচিত ‘জ্ঞানবস্থা’টিও তাহার সম্যক্রূপে থাকে। যখন সে জ্ঞানের ঐ অপর অবস্থা অর্থাৎ আমাদের সাধারণ জ্ঞানাবস্থার ন্যায় অবস্থা অনুভব করিবার ইচ্ছা করে, তখন তাহাকে একধাপ নামিয়া আসিতে হয়। এই সাধারণ জ্ঞান একটি নিম্নগর অবস্থা—মায়ার ভিতরেই কেবল এইরূপ জ্ঞান হওয়া সম্ভব।
———-
১ গীতা, ৩/২৫