পুলিস-ফাইল অনুসন্ধান করে দেখা গেল—মিঃ চিদাম্বরমের মাথার ওপর একটা বিপদ যে কয়েকদিন আগে হতেই খাঁড়ার মত ঝুলছিল তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে তার কাছে একখানা চিঠি আসে। চিঠিখানার ওপরেই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল—তার খামখানা খুব বড় আকারের, আর ঠিকানাটা খুব বড় বড় লাল কালিতে লেখা।
মিঃ চিদাম্বরমের স্বভাব ছিল—সব চিঠি তিনি নিজেই খুলতেন। খুলে প্রয়োজন বোধ করলে তিনি তার প্রাইভেট সেক্রেটারীর হাতে দিতেন, নতুবা নিজেই সেগুলির জবাব দিয়ে ছিড়ে ফেলে দিতেন।
অন্যদিনের অভ্যাসমত সেদিনের চিঠি তিনি নিজের হাতে খোলেন—সকলের আগেই খুললেন সেই লাল চিঠিখানা। কিন্তু চিঠিখানা পড়ামাত্র তার মুখের ওপর কে যেন একরাশ ছাই ঢেলে দিল-মুখ তার শুকিয়ে গেল।
সেই থেকে সর্বদাই তিনি অন্যমনস্ক থাকতেন, আর একটা দুশ্চিন্তা ও নিরুৎসাহ ভাব যেন তাকে অভিভূত করে রেখে দিত।
এই ভাবে গেল আরও সাত-আট দিন। তারপর এল আরেকখানা চিঠি। এবারকার চিঠিখানার ঠিকানাটা লাল কালিতে লেখা না হলেও কি যেন একটা বৈশিষ্ট্য তার ভিতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছিল।
মিঃ চিদাম্বরম্ চিঠিখানা খুলে পড়লেন। পড়তে পড়তে স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি কাপছেন। প্রাইভেট সেক্রেটারী রামানুজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, চিঠিতে কোন দুঃসংবাদ আছে কি?
তিনি সংক্ষেপে জবাব দিলেন, হুঁ।
যাহোক, পড়ে চিঠিখানা তিনি একটি পাথর চাপা দিয়ে টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন, আর তখনই শাবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
সেদিন দুবার তিনি কেবল কফি চেয়ে খেয়েছিলেন। রাত আটটার সময় বাবুর্চি শেষবার যখন তাকে কফি দিয়ে যায়, সে গিয়ে মিঃ রামানুজকে বলেছিল, কর্তার ঘরে বেশ মিষ্টি অথচ একটা উগ্র গন্ধ পাওয়া গেল। গন্ধটা কিসের জানি না। কিন্তু কর্তা তো মনে হল জেগেই রয়েছেন। আমার যেন কি রকম মনে হচ্ছে।
সেক্রেটারী মিঃ রামানুজম কেমন যেন একটু সন্দিহান হয়ে ঘরে ঢুকতেই মিঃ চিদাম্বরম তাকে গম্ভীর ভাবে আদেশ করলেন, আমি একটু একা থাকতে চাই, মিঃ রামানুজম। আমাকে একা থাকতে দিন।
তাঁর কথায় তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। রামানুজমের জবানবন্দি থেকে জানা যায়-ঘরের সেই গন্ধটা রামানুজমকেও আকৃষ্ট করেছিল। এবং সেটা কোন দুর্গন্ধ বা আপত্তিকর গন্ধ ছিল না। কাজেই রামানুজম্ পরক্ষণেই তা ভুলে গিয়েছিলেন, মনে রাখবার বা অনুসন্ধান করবার মত প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।
চিদাম্বরমের পাশের ঘরেই থাকতেন রামানুজম।
অনুমান রাত একটার সময় চিদাম্বরমের শোবার ঘরের ভিতর একবার যেন মৃদু খসখসানি শব্দ শোনা যায়। শব্দ শুনে মিঃ রামানুজম বিছানায় একবার উঠে বসেছিলেন। তারপর কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি ফের শুয়ে পড়েন ও ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু ঘণ্টাখানেক যেতে-না-যেতেই আবার একটা শব্দ শুনে তিনি জেগে ওঠেন। তখন তার মনে হয়েছিল কারা যেন মিঃ চিদাম্বরমের ঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছেন আর কাদের কথাবার্তার চাপা আওয়াজ যেন শোনা যাচ্ছিল।
মিঃ রামানুজ তখনই ঘর থেকে বের হয়ে ব্যাপারটা কি দেখবেন বলে দরজা টানতেই বুঝলেন তার নিজের ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। মিঃ রামানুজ তখন ঘরের ভিতর থেকেই আঁকডাক করতে থাকেন। কিন্তু অত রাত্তিরে সকলেই ঘুমিয়ে ছিল; কাজেই বাড়ির লোকজন ছুটে এসে তাকে বের করতে সময় গেল অনেকটা।
মিঃ রামানুজ মুক্তি পেয়ে তার মনিবের ঘরে এসে দেখেন—ঘর খালি। মিঃ চিদাম্বরম্ কোথাও নেই।
দেখা গেল—ঘরের জিনিসপত্র সবই ঠিক আছে, কিছুই তছনছ হয়নি। সেই উগ্রগন্ধী চিঠিখানার খামটি তখনও টেবিলের ওপরে পড়ে আছে, কিন্তু ভিতরে চিঠিখানি নেই, তার বদলে খামের ভিতরে রয়েছে একটুকরো সাদা কাগজ-তাতে রক্তমুখী ড্রাগনের একটা ছবি আঁকা।
পরের দিন সংবাদ পেয়ে মিঃ রামিয়া তার দলবল নিয়ে অকুস্থানে এসে অনুসন্ধান করে দেখতে পেলেন যে, মিঃ চিদাম্বরমের ঘরখানির উপরদিকের একটা স্কাইলাইট থেকে একগাছা সুতো ঝুলছে আর তার ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজার সামনে কতকগুলো পায়ের দাগ রয়েছে। তার মধ্যে একজোড়া পায়ের ছাপ খুবই ছোট ছোট-মানুষের পায়ের ছাপ বলে মনে হয় না। আর পাওয়া গিয়েছিল মিঃ চিদাম্বরমের ডাইরীটা তার লেখার টেবিলের ড্রয়ারে।
পুলিস এরপর এখানে সেখানে নানা জায়গায় খানাতল্লাশ করেছিল এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল; কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়েছে।
সিংহলের পুলিস এর বেশী আর কিছু করতে পারেনি।
পুলিস তো পারেনি, কিন্তু কিরীটী রায় যে পারবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? ব্যাপারটা এত ঘোরালো, আর এমন সুনিপুণ ভাবে কাজটা হাসিল করা হয়েছে যে, তদন্তের সূত্র কোথায়ও যেন কিছুমাত্র নেই।
কি ভাবছেন মিঃ রায়?
দুটো দিন আমাকে ভাবতে দিন মিঃ রামিয়া।
কিরীটী রামিয়ার কাছ থেকে অতঃপর বিদায় নিল।
কিরীটী সুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবার পথে গাড়ির মধ্যে বসে তন্ময় হয়ে কেবল তাই ভাবছিল।
হঠাৎ চলতে চলতে গাড়িটা একবার যেন একটু কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার বিদ্যুৎবেগে ব্রেক কষে গাড়িখানা দাঁড় করিয়ে ফেলল, আর চিৎকার করে কাউকে গাল দিয়ে উঠল, এই শুয়ার।
কিরীটীর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ মুখ বাড়িয়ে বলল, কি ব্যাপার ড্রাইভার?
ড্রাইভার তেমনি ঋজালো কণ্ঠে বলল, একটা ছোকরা কোত্থেকে যেন গাড়ির সুমুখে লাফিয়ে পড়েছিল। লোকটা মরতে মরতে বেঁচে গেছে!
কিরীটী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল।
কিন্তু কি আশ্চর্য! যাকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ছোকরাটা চট করে মাটি থেকে উঠে পড়েই কিরীটীর কাছে এগিয়ে এল। তারপর কিরীটী কোন কিছু বোঝবার আগেই সে হাত বাড়িয়ে তাকে একখানি চিঠি দিয়ে বলল, আপনার একখানি চিঠি স্যার, এই নিন।
চিঠিখানি সে কিরীটীর হাতে একরকম গুঁজে দিয়েই, পরমুহূর্তে রাস্তার অপর পাশে ছুটে গেল যেন।
কিরীটী দেখতে পেল, ছোট একখানা মোটরগাড়ি রাস্তার উল্টোদিকে অপেক্ষা করছিল। ছোকরাটি তাড়াতাড়ি গাড়ির ভিতর উঠে বসতেই গাড়িটা যেন বায়ুবেগে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী আবার নিজের গাড়িতে উঠে বসল, ঐ ঘোট গাড়িখানাকে তাড়া করে অনুসন্ধান করা সম্পূর্ণ বৃথা—এই সহজ সত্যটা স্পষ্ট অনুভব করে ড্রাইভারকে আবার গাড়ি চালাতে বলল।
ড্রাইভার জীবনবাবুর বাড়ির দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল। সুব্রত বললে, চিঠিখানা পড়লে না কিরীটী? কিরীটী জবাব দিল, ও আমি দেখে নিয়েছি তক্ষুনি। চিঠিখানায় আমাকে একটু শাসানো হয়েছে। দেখতে চাও? দেখ।
কিরীটী চিঠির ভাঁজখানা খুলে ফেলল। সুব্রত দেখল, চিঠিতে লেখা রয়েছে–
মিঃ রায়,
তুমি সুচতুর গোয়েন্দা জানি। তবু তোমাকে অনুরোধ করছি—এসব ব্যাপারে তুমি নিজেকে জড়িত করো না। আরো একটা কথা, তোমার বোধ হয় জানা ভাল-তুমি যার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে যাচ্ছ, সে আর কেউ নয়—সে রক্তমুখী ড্রাগন। এর পরেও যদি তুমি চিদাম্বরমের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে যাও, তবে জেনে রেখো রক্তমুখী ড্রাগন তোমাকেও ক্ষমা করবে না।
সুব্রত খানিকটা চিন্তিতভাবে বলল, তাহলে কি করবি?
গাড়ি তখন দোরগোড়ায় এসে পড়েছিল। কিরীটী নামতে নামতে বলল, ভয় পেলি নাকি সুব্রত? তুই তাহলে বাড়ি ফিরে যা!
সুব্রত লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল।