পার্থ বাজার থেকে ফেরামাত্র টুপুর উগরে দিল ফোনের কথাটা। শুনে পার্থ তো হাঁ, উৎপল ক্রিস্টোফার ফোন করেছিল? উৎপল তোর মাসিকে খুঁজছিল?
টুপুর উত্তেজিত মুখে বলল, হ্যাঁ গো। তাই তো বললেন।
মিতিন জানলার পরদা বদলাচ্ছে। পেলমেট-রডে রিং পরাতে পরাতে ঘাড় ঘোরাল, তোমার বন্ধুটি কেমন?
তুৎ, থোড়াই বন্ধু! জাস্ট ব্যাচমেট ছিল। আমাদের সঙ্গে তেমন মিশত না। ওর সার্কলটা ছিল আলাদা। ব্যাটার ফিজিকটা ছিল দেখার মতো। ইয়া চওড়া কাঁধ, ভি-শেপ কোমর। শুধু হাইটটাই যা একটু শর্ট। মেরেকেটে পাঁচ-ছয়। রেগুলার ওয়েট ট্রেনিং করত, জিমনাস্টিকস কম্পিটিশনে নাম দিয়ে প্রাইজটাইজও পেয়েছিল অনেক। ফাইনাল পরীক্ষাটা দেয়নি, হুট করে একটা সার্কাস কোম্পানিতে কাজ জুটিয়ে পাকাপাকি ওই লাইনেই চলে গেল।
তা সে তোমার ফোন নম্বর পেল কোত্থেকে?
মাঝে ওর সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল। এই মাস পাঁচ-ছয় আগে। মল্লিকবাজারে একটা মোটরপার্টসের দোকানে বিল ভাউচার ছাপানোর পেমেন্ট আনতে গেছি, তখনই হঠাৎ মুখোমুখি। বলল, এখন নাকি সার্কাসটাকাস ছেড়ে দিয়ে কোনও একটা জিমনাসিয়ামে ইনস্ট্রাকটার হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের ট্রেনিং দেয়। সেদিনই আমি ওকে আমার কার্ডটা দিয়েছিলাম।
এবং আমার প্রফেশান নিয়েও গপ্পো করেছিলে?
এতে অন্যায়টা কী আছে? বরং আমাকে তোমার ক্রেডিট দেওয়া উচিত। আমার পাবলিসিটির গুণে তোমার শুখা মরশুমে কেমন হেঁটে হেঁটে কেস আসছে। বলেই পাৰ্থ চোখ টিপল, আমার বন্ধু বলে ছাড়টাড় দিয়ো না কিন্তু। পুরো পাওনাগণ্ডা বুঝে নেবে। আর, টাকা পেলে আমার কমিশনটা চাই। ফিটি পারসেন্ট। নিদেনপক্ষে ফরটি-সিক্সটি।
আহা, কী জন্যে আসছে তার ঠিক নেই, আদৌ আমাকে দিয়ে তার কাজ হবে কি না জানি না, এখনই কালনেমির লঙ্কা ভাগ শুরু হয়ে গেল।
মুফতে কোনও পরামর্শও দেবে না। তার জন্যও ফি চার্জ করবে।
আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবেখন। তা তোমার এই উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস থাকেন কোথায়?
কলেজে পড়ার সময়ে তো এক্সট্রিম সাউথ থেকে আসত। কেওড়াপুকুর না ঠাকুরপুকুর, কোথায় যেন থাকত। এখন মল্লিকবাজারের কাছেই বাসা নিয়েছে বলল। জোড়া গির্জার দিকটায়। বলেই পার্থ টুপুরের দিকে ফিরে চোখ নাচাল, অ্যাই, জোড়াগির্জা চিনিস?
খুব চিনি। আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডে।
আগে যেটা ছিল লোয়ার সার্কুলার রোড। আরও আগে যেখানটায় ছিল মারহাট্টা ডিচ ক্যানাল। বর্গি আক্রমণ রুখতে শহরে ওই খাল কাটা হয়েছিল। বর্গি, মানে মরাঠাদের সেনাপতি ছিল ভাস্কররাম কোলহাতকর। ইতিহাসে যাঁর নাম ভাস্কর পণ্ডিত। লোকটা মহাদুষ্ট ছিল। ভীষণ লুটপাট চালাত। তাকে সামলাতেই একুশ হাত চওড়া, সাত মাইল লম্বা পরিখা খোঁড়ার প্ল্যান করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এন্টালি অবদি খালটা খোঁড়ার পর ভাস্কর পণ্ডিত খতম হয়ে গেল মুস্তাফা খাঁ নামে এক আফগান সৈনিকের হাতে। পরে মরাঠারা আর-একবার অ্যাটাক করেছিল। তখন খালটাকে এন্টালি থেকে বেকবাগান অবদি বাড়ানো হয়। ওই খাল বুজিয়েই সার্কুলার রোড।
টুপুর অপ্রসন্ন মুখে বলল, আমাদের কিন্তু জোড়াগির্জা নিয়ে কথা হচ্ছিল মেসো।
তোকে বলেছি না, যা জানবি, ডিটেলে জানবি?
আহ্, বলো না জোড়াগির্জার কথা।
তার আগে তুই বল দেখি নামটা জোড়াগির্জা কেন?
দুটো চার্চ আছে, তাই।
তোর মাথা। ওখানে একটাই গির্জা। সেন্ট জেমস চার্চ।
আর-একটা সেন্ট জেমস চার্চ ছিল বললে না? লেবুতলায়?
সেটাই তো এটা। ন্যাড়া গির্জার ছাদ ভেঙে পড়ার পাঁচ-ছ বছরের মধ্যেই নতুন করে চাৰ্চটা বানানো হয় এই সার্কুলার রোডে। আগের চার্চে একটাও চুড়ো ছিল না, এখানে বানানো হল দু-দুটো চুড়ো। ওই দেখেই লোকে চাৰ্চটাকে ডাকতে লাগল জোড়াগির্জা বলে। ওই চার্চের পাশের জমিতে ছিল চিৎপুরের নবাব মহম্মদ রেজা খাঁ-র বংশধর নবাব সৌলদ জং-এর বাগানবাড়ি। এখন যেটা হয়েছে নোনাপুকুর ট্রামডিপো। নোনাপুকুর নামটা আবার এসেছে..
ফের তুমি ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে বসলে? মিতিন কাজ থামিয়ে চোখ পাকাল।
বন্ধ করতে পারি, যদি জমিয়ে এক কাপ কফি খাওয়াও।
ইতিহাস, উৎপল ক্রিস্টোফার, সবই আপাতত চাপা পড়ে গেল। পার্থমেসোর কল্যাণে টুপুরেরও কফি জুটল এক কাপ। বাজার থেকে আরও তিনখানা খবরের কাগজ কিনে এনেছে পার্থমেসো, কফিতে চুমুক দিতে-দিতে ফের মজেছে শব্দ খোঁজার খেলায়। বুমবুমের জন্য কার্টুন চ্যানেল চলছে, সে এখন শোওয়ার ঘরে টিভিতে মগ্ন। এ-বাড়িতে ড্রইংরুমে টিভি থাকে না, পাছে মিতিনমাসির কাছে লোকজন এলে কথাবার্তায় অসুবিধে হয়।
টুপুরও কাপ হাতে বুমবুমের পাশে গিয়ে বসল। রোড রানার শো চলছে। দেখতে মজাই লাগে। কিন্তু এখন মন বসছে না, বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ঘড়ির দিকে। সময় যেন আর কাটেইনা, এগারোটা আর বাজেই না। এল এগারোটা, পেরিয়েও গেল। শুরু হল সেই চিরপরিচিত টম অ্যান্ড জেরি। এখনও উৎপল ক্রিস্টোফারের দেখা নেই কেন?
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। ডোরবেলে ডিং ডং। পাক্কা এগারোটা আঠাশে।
ভারতী দরজার দিকে যাচ্ছিল, তাকে টপকে আগেই পৌঁছে গেছে টুপুর। এবং ল্যাচ খুলেই চমক। সামনে এক শ্যামলা রং স্বাস্থ্যবান ভদ্রলোক, কিন্তু তিনি একা নন। পাশে এক মহিলা। পরনে দেশীয় পোশাক। সবুজ জংলাছাপ শিফন শাড়ি। তবে চেহারায় খাটি বিদেশিনী। টুকটুকে লাল গায়ের রং, নীল চোখ, মুখের আদলটিও ইউরোপিয়ান ধাঁচের। মাথার চুলটাই যা কুচকুচে কালো। মহিলা বেশ লম্বাও। হাইহিল পরা আছে বলে যেন আরও বেশি ঢ্যাঙা দেখাচ্ছে।
পার্থও এসেছে টুপুরের পিছন-পিছন। সাদরে অভ্যর্থনা জানাল, আয় আয়। আমরা তোর জন্যই ওয়েট করছি।
উৎপল অপ্ৰতিভ মুখে বলল, সরি। একটু লেট হয়ে গেল। তোদের এখন বোধহয় লাঞ্চ টাইম…
ধুৎ, আমাদের এখনও রান্নাই চড়েনি। ছুটির দিনে আমরা দুপুর দুটোর আগে খেতে বসি না।
উৎপল ভেতরে এল। সঙ্গে-সঙ্গে মহিলাও সোফায় পাশাপাশি বসেছে দুজনে। মিতিন আসামাত্র দুজনেই উঠে দাঁড়াল।
উৎপল হাতজোড় করে নমস্কার করল মিতিনকে। বিনীতভাবে বলল, আমি কে সে তো বুঝতেই পারছেন। উৎপল ক্রিস্টোফার বিশ্বাস। আর ইনি আমার মিসেস। মির্না বিশ্বাস।…মির্না, ইনিই ফেমাস ডিটেকটিভ প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি।
মিতিন স্মিত মুখে বলল, ফেমাস-টেমাস কিছু নয়। পেটের ধান্দায় লোকে চাকরি বাকরি করে, আমি করি গোয়েন্দাগিরি। বলেই হাত বাড়িয়ে টুপুরকে দেখাল, এ আমার বোনঝি। ঐন্দ্ৰিলা। টুপুর। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট।
টুপুর প্রায় গলে গেল। মিতিনমাসি তাকে বাইরের লোকের সামনে সহকারীর স্বীকৃতি দিচ্ছে! খুশি-খুশি মুখে বলল, আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, আপনারা চা খাবেন তো? না কফি?
উৎপল ঈষৎ সংকুচিত, থ্যাঙ্কস। কিছু লাগবে না। এত বেলায় আপনাদের জ্বালাতে এসেছি…
সে কী কথা! পুরনো বন্ধুর বাড়ি প্রথম দিন এলেন…
তা হলে কফি। শুধু কফি কিন্তু। আমারটা চিনি-দুধ ছাড়া। মির্নার নরমাল।
মিতিন ভারতীকে নির্দেশ দিয়ে এসে বসার আগেই পাৰ্থ কথা শুরু করে দিয়েছে, হঠাৎ তোর হলটা কী? এমন হাঁকপাক করে ছুটে এলি?
একটা সিরিয়াস প্রবলেমে পড়ে গেছি ভাই।
কী প্রবলেম?
আজকের ইংলিশ ডেলিতে একটা নিউজ দেখেছিস হাউস কোলাপসড অ্যাট লেবুতলা?
বাংলা কাগজেও আছে। মিতিন বলল, ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মারা গেছেন।
ওই নিউজটাই আমাদের বাধ্য করেছে ছুটে আসতে।
ভদ্রলোক আপনাদের কেউ হন বুঝি?
না না, আমাদের সঙ্গে কোনও রিলেশন নেই। কিন্তু খবরটা আমার মিসেসকে খুব টেনশনে ফেলে দিয়েছে। স্পেশ্যালি, ডেথ অফ দ্যাট ওল্ড ম্যান।
পরিষ্কার হল না। একটু খুলে বলুন।
এক সেকেন্ড। উৎপল সামান্য দম নিল। তারপর সসংকোচে বলল, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?
তুই সিগারেট খাস? পার্থ অবাক, কলেজে আমরা সিগারেট খেলে তুই তো নাক টিপে সরে যেতিস!
এখনও তেমন একটা খাই না। তবে মাঝেমাঝে…ওই মাথাটা যখন খুব জ্যাম হয়ে যায়..
বুঝলাম। চাপে আছিস। পার্থ নিজের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল, আমার থেকে নে। রিলাক্সড মুডে বল কী হয়েছে।
খানিকটা ধোঁয়া গিলে একটু বুঝি থিতু হল উৎপল। সেই ফাঁকে বুঝি মনে-মনে বক্তব্যটাকেও সাজিয়ে নিল। বলল, আমার স্ত্রীকে দেখে নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছিস ও আমার মতো বাঙালি খ্রিস্টান নয়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। আমার শ্বশুরবাড়ি ইলিয়ট রোডে। মেন রাস্তা থেকে একটু গলিতে ঢুকতে হয়। ব্লাইন্ড লেন। বাড়িটা। একতলা, তবে মোটামুটি বড়ই। চারপাশে খানিকটা জমি আছে। জমি আর বাড়ি মিলিয়ে কম-বেশি দেড় বিঘা মতন জায়গা। একশো চল্লিশ বছর বয়স হয়েছে বাড়িটার। ওই বাড়ি আর বাড়িকে কেন্দ্র করে আমার ফাদার-ইন-ল আমাদের উদ্বেগের কারণ।
বুঝলাম। তোদের বাড়িটাও গ্রাস করার জন্যে প্রোমোটাররা ছোঁক-ছোঁক করছে। এবং তোর শ্বশুরমশাই বাড়ি ভাঙার বিপক্ষে।
ঠিক তাই। অলরেডি দু-তিনজন প্রোমোটার নজর ফেলেছে। তার মধ্যে একজন তো খুবই পাওয়ারফুল। ভেরি ওয়েল কানেকটেড, হাতে মাসলম্যান আছে। অলরেডি একবার হানা দিয়ে লোকটা প্ৰেশারও তৈরি করে গেছে। ফোনও করছে মাঝে-মাঝে। আমরা ভয় পাচ্ছি দুম করে লেবুতলার মতো কোনও অঘটন না ঘটে যায়?
প্রোমোটার কি গ্রেট করছে?
তা ঠিক নয়। তবে রিসেন্টলি একটা স্ট্রেঞ্জ ইনসিডেন্ট ঘটতে শুরু করেছে বাড়িতে। সেটা কোনও প্রোমোটারই করাচ্ছে, না অন্য কিছু, আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
কী রকম?
আমার শ্বশুরবাড়িতে একটা রুমে কিছু অ্যান্টিক ফার্নিচার রাখা আছে। রুমটা এমনিতে আন্ডার লক অ্যান্ড কি থাকে, মাঝেমধ্যে ঝাড়পোঁছ করার জন্য খোলা হয়। রিসেন্টলি আমি কয়েকটা স্পেয়ার ফার্নিচার, মানে কিছু চেয়ার টেবিল, ওই ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর থেকেই কী বিদঘুটে কাণ্ড! মাঝরাতে ওই ঘরে বিশ্রী আওয়াজ হতে শুরু করেছে। মনে হয়, কেউ যেন ঠেলে চেয়ারটাকে ফেলে দিল, টেবিল নড়াচ্ছে….
বলিস কী? পাৰ্থ সোজা হয়ে বসল, আপনা-আপনি হচ্ছে?
সেইজন্যই তো অদ্ভূত লাগছে। মাঝে-মাঝে আওয়াজটা কী জোর হয় তুই ভাবতে পারবি না। দুম দাম ধপাস। ও-ঘরে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো আছে, একদিন তো পিয়ানোটাও ঝং করে বেজে উঠল। সেদিন মির্না ও-বাড়িতে ছিল, আওয়াজটা শুনে ও তো প্রায় সেন্সলেস হওয়ার জোগাড়।
পার্থ বলল, ঘটনাটা ঘটার সময়ে দরজা খুলে দেখা হয় না?
হয়েছে। কোনও রাত্রে আমি যদি ওবাড়িতে থেকে যাই, আমি খুলেছি। কিছু পাওয়া যায়নি। থরো সার্চ করে দেখেছি, ইঁদুর-টিঁদুরও নেই তেমন।
এ যে দেখি ভূতুড়ে কাণ্ড!
অ্যাপারেন্টলি তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। আমার ধারণা এটা প্রোমোটারেরই কারসাজি। ড্যাডিকে ভয় দেখানোর জন্য।
তোর শ্বশুরমশাই ভয় পাচ্ছেন?
কিছুটা নার্ভাস তো হয়েছেনই। তবে ড্যাডি মনে করেন প্রোমোটার-টোমোটার নয়, কাণ্ডটা ভূত করছে। ওই ঘরে বহুকাল আগে একটা আনন্যাচারাল ডেথ হয়েছিল, তাঁর আত্মা নাকি রাত্তিরে আসেন ওখানে। এবং তিনিই নাকি কোনও কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
মির্না এই প্রথম মুখ খুলল। আড়ষ্ট বাংলায় বলল, কাজটা যদি কোনও প্রোমোটারেরই কনসপিরেসি হয়, তা হলে সে সামডে অর আদার আরও মারাত্মক কিছু তো ঘটাতে পারে। লেবুতলার ইনসিডেন্টটার মতো।
আপনার ড্যাডি এখন কী ভাবছেন? ভূতের ভয়ে বাড়ি বেচে দেবেন?
প্রশ্নই আসে না। কোনও অবস্থাতেই ড্যাডি বাড়ি বেচবেন না।
মিতিন চুপচাপ শুনছিল। হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ল, কতদিন ধরে চলছে এই ভূতের ইনসিডেন্ট?
তা ধরুন, সপ্তাহদুয়েক।
রোজই হচ্ছে?
না। ছ-সাত দিন হয়েছে এর মধ্যে।
সেই প্রোমোটারটি কবে এসেছিল আপনাদের বাড়ি?
মাস দেড়েক আগে। তবে বললাম না, ফোন করে। মাঝে মাঝেই।
ঘটনাটা শুরু হওয়ার পরেও ফোন এসেছে?
না। সুরজমল এখন অদ্ভুত রকম সাইলেন্ট। আর সেইজন্যই তো আমার সন্দেহ হচ্ছে।
প্রোমোটারের নাম বুঝি সুরজমল?
সুরজমল অগ্নিদেব। রিগাল প্রপার্টিজের মালিক। ক্যামাক স্ট্রিটে অফিস। কলকাতার অনেক পুরনো বাড়ি ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়েছে।
কফি এসে গেছে। সঙ্গে আলুর চিপস্, বিস্কুট আর সন্দেশ। টুপুর হাতে হাতে কাপ তুলে দিয়ে আবার বসল মিতিনের পাশটিতে। মোড়ায়। উৎপল মির্না কী ধরনের সাহায্য চাইতে এসেছে তার মাথায় ঢুকছে না। প্রোমোটার ভয় দেখাচ্ছে, তো মিতিনমাসি কী করবে? এ-সব কেসে তো পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত। আর ভূত তাড়ানোও তো মিতিনমাসির কাজ নয়। তার জন্য বাজারে অজস্র ফেরেব্বাজ ওঝা আছে।
পার্থ মুঠোয় চিপস তুলে নিয়েছে। চিবোচ্ছে কচরমচর। মিতিন কফির কাপে চুমুক দিল। উৎপলকে জিজ্ঞেস করল, আপনার শ্বশুরমশাই কি একাই থাকেন?
না। মির্নার ভাই থাকে সঙ্গে। তবে ডিক, আই মিন রিচার্ড, চাকরি করে হোটেলে। টেলিফোন অপারেটার। বেশির ভাগ দিনই তার নাইট শিফট থাকে। রাত্তিরে বাড়িতে ড্যাডি একাই।
মির্না তাড়াতাড়ি বলে উঠল, অবশ্য আমরাও এখন প্রায়ই কেউ-না-কেউ রাতে ও-বাড়িতে রয়ে যাচ্ছি। হয় আমি, নয় উৎপল।
আপনাদের বাড়ি কি কাছেই?
মিনিট দশেকের রাস্তা। মুজফফর আহমেদ স্ট্রিটে। আমরা কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে ড্যাডির কাছাকাছিই আছি।
পার্থ বলল, আপনারা মানে? আপনি কি উৎপলের সার্কাসের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতেন?
মির্নার হয়ে উৎপলই উত্তর দিল, মির্নাও সার্কাসেই ছিল। আমার সঙ্গে ট্রাপিজের খেলা দেখাত।
তাই বল। তোরা দুজনেই সার্কাস প্লেয়ার? জীবনেও জুটি, সার্কাসেও জুটি…! দারুণ।
মিতিন মৃদু হেসে বলল, তা আপনারা তো আলাদা থাকেন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার শাশুড়িও নেই?
মাম্মি আট বছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বিয়ের পর পরই। ক্যানসার।
ও। …তার মানে আপনার শ্বশুরমশাইয়ের সংসারে এখন আপনার শ্বশুরমশাই আর আপনার শ্যালক?
হ্যাঁ ম্যাডাম।
শ্যালক বিয়ে করেননি?
এখনও না।
সংসারের দেখভাল কে করেন? আই মিন রান্নাবান্না?
আছেন একজন মহিলা। মিসেস জোনস। মির্নার মাম্মির অসুখের সময় থেকেই তিনি কিচেনের চার্জে। রুমগুলোর ডাস্টিং ক্লিনিং-ও তিনিই করেন। তিনিও কাছেই থাকেন। তেত্রিশ নম্বর রিপন লেনে। মর্নিং-এ আসেন, সন্ধেয় চলে যান। হাজব্যান্ড অসুস্থ, রাতে থাকা তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
বুঝলাম। মিতিন সন্দেশের প্লেট উৎপল মির্নার দিকে বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আমি আপনাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
আপনি কাইন্ডলি মিস্ট্রিটা সলভ করে দিন। মানে ওই ভূতুড়ে আওয়াজের। যদি প্রমাণ করে দিতে পারেন কাজটা প্রোমোটারের, তা হলে ড্যাডিরও ভূতের আতঙ্কটা কেটে যাবে, আমরাও সহজে পুলিশের কাছে প্রসিড করতে পারব, সুরজমলও আর ট্যাঁফোঁ করার সুযোগ পাবে না।
মনে হচ্ছে আপনারাও বাড়ি ভাঙার বিপক্ষে?
ড্যাডি যখন চান না, তখন তাঁর জীবৎকালে ও বাড়ি নয় নাই ভাঙা হল। সেন্টিমেন্ট বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।
ডিকও কি বাড়ি ভাঙা চায় না?
ডিক হ্যাঁ-তেও নেই, না-তেও নেই। তবে এখন তার অভিমত, অযথা প্রবলেমে না গিয়ে বাড়িটার একটা এপার ওপার করে ফেলাই ভাল।
তার মানে ডিক এখন বাড়ি ভাঙার পক্ষে?
অন্তত ড্যাডির মতো ডেড এগেন্স্টে নয়। তবে সে-ও খুব ভূতে বিশ্বাস করে। তারও ধারণা আত্মাফাত্মাই ফার্নিচার ফেলছে।
কথার মাঝেই মির্না হঠাৎ বলে উঠল, তুমি কিন্তু আর একটা কথা ওঁদের এখনও বলো নি উৎপল।
কী বলো তো?
ওই মিথের ব্যাপারটা।
ও হ্যাঁ, উৎপল গলা ঝাড়ল, মিথ ঠিক নয়। একটা গুজবের মতো। আমার শ্বশুরমশাই ইলিয়ট রোডের বাড়িটা পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের সূত্রে। এই বাড়ির যিনি প্রতিষ্ঠাতা, সিপাই বিদ্রোহের সময়ে তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ফৌজে। সিপাই বিদ্রোহের কোনও এক নেতা নাকি যুদ্ধে তাঁর হাতে নিহত হন। প্রবাদটা হল এই, সিপাই বিদ্রোহের সেই নেতার কোনও একটি বহুমূল্য সম্পদ তিনি হস্তগত করেছিলেন। সেটিও নাকি ওই বাড়ির কোথাও একটা লুকোনো আছে। একশো তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে অনেকেই নাকি সেটি খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাড়ির আদি মালিক কোথায় যে সেটি রেখে গেছেন, কেউ তার সন্ধান পায়নি। এখন প্রায় ধরেই নেওয়া হয়েছে ওটা একটা গালগল্প।
মিতিন একবার আড়চোখে মির্নাকে দেখে নিয়ে বলল, কিন্তু গুজব রটারও তো একটা কোনও কারণ থাকে?
মির্না বলল, তাঁর উইলে নাকি এ ব্যাপারে কী একটা লেখা ছিল। আমি এই জিনিস রেখে গেলাম, যে এটা পাওয়ার চেষ্টা করবে তাকে মরতে হবে…. এই ধরনের কিছু। ডিটেলটা ড্যাডি ভাল বলতে পারবেন। ইন ফ্যাক্ট, ড্যাডির বিশ্বাস, জিনিসটা এখনও বাড়িতেই আছে। এবং তাঁর আত্মা সেটিকে পাহারা দেয়।
ইন্টারেস্টিং? আপনাদের বাড়ি তো তাহলে একবার যেতেই হয়।
প্লিজ আসুন। রহস্য সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে যদি জিনিসটাও উদ্ধার করে দিতে পারেন তো নাথিং লাইক ইট, উৎপল সোৎসাহে ঝুঁকল, কবে আসছেন?
দেখি। ফোন নাম্বার আর অ্যাড্রেস রেখে যান। আমি জানিয়ে দেব।
উৎপল মির্না চলে যাওয়ার পর পার্থ হাঁ হাঁ করে উঠল, কেটা এমনি এমনি নিয়ে নিলে? একটা অ্যাডভান্স চাইলে না?
মিতিন মুচকি হেসে বলল, গোড়াতেই টাকার কথা বললে দাম কমে যায় স্যার।
টুপুর চকচকে চোখে বলল, সেটা বেশ জমবে মনে হয়, তাই না মিতিনমাসি? একদিকে ভূত, একদিকে অগ্নিদেব, সঙ্গে আবার বহুমূল্য সম্পদও রয়েছে?
মিতিন বলল, এতক্ষণ যা যা শুনলি সব মগজে গেঁথে নিয়েছিস তো?
অবশ্যই।
আজই আমায় পয়েন্ট বাই পয়েন্ট নোট করে দেখাবি। আর তোর মেসোকে বল এখন আর কায়দা করে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। মাংস আর চিংড়িমাছ আমিই রেঁধে ফেলছি।
টুপুর খুশিতে ডগমগ। একই দিনে কেস, আর মিতিনমাসির রান্না—এ যে মণিকাঞ্চন যোগ।