০২. পদার্থবিদ মহামতি ফিহা

পদার্থবিদ মহামতি ফিহা কাগজে বড় বড় করে লিখলেন, কফি পান করে তৃপ্তি পেয়েছি। নিচে নাম সই করলেন। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলেন কমিউন অফিসের দিকে। কমিউন কৰ্মাধ্যক্ষ মারলা লির সঙ্গে তাঁর আজ দেখা করার কথা। এপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল এগারোটায়। এখন বাজছে সাড়ে এগারো। আধ ঘণ্টা দেরি। তার জন্যে মারলা লি বিরক্ত হবেন না। বরং মধুর ভঙ্গিতে হাসবেন। মারলা লি একজন মেন্টালিস্ট। মেন্টালিস্টরা কখনো বিরক্ত হয় না। আজ পর্যন্ত শুনা যায়নি কোনো মেন্টালিস্ট উঁচু গলায় কথা বলেছে বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের বিরক্ত হবার প্রয়োজন নেই।

ফিহাকে সরাসরি মারলা লির ব্যক্তিগত ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরটা অন্ধকার। জানালার ভারি পর্দা টান টান করে বন্ধ করা। দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। সে আলো যথেষ্ট নয়। ফিহা লক্ষ করেছেন সব মেন্টালিস্টদের ঘরই খানিকটা অন্ধকার। সম্ভবত এরা আলো সহ্য করতে পারে না। কিংবা এদের আলোর তেমন প্রয়োজন নেই।

ফিহা বললেন, আমি বোধহয় একটু দেরি করে ফেললাম।

মারলা লি হাসলেন। মেন্টালিস্টদের মধুর হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বিনয় এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন।

আপনি এসেছেন এতেই আমি ধন্য। আপনার জন্যে খাঁটি কফি তৈরি করা আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের স্বাদহীন কফি নয়, ভালো কফি।

আমি কফির প্রয়োজন বোধ করছি না।

ফির মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মেন্টালিস্টদের সামনে বসলেই এরকম হয়। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। জিভ হয়ে যায় কাগজের মতত। এটা তাঁর একার হয় না সবারই হয়, তা তিনি জানেন না। তিনি প্রচণ্ড রকম ক্ৰোধ এবং ঘৃণা নিয়ে মারলা লির দিকে তাকালেন। মানুষটা শান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে অথচ এর মধ্যেই জেনে গেছে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি খেয়ে এসেছেন। মেন্টালিস্টরা তার মাথা থেকে যাবতীয় তথ্য কত সহজে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তিনি তাদের কিছুই জানতে পারছেন না। মারলা লি এই মুহূর্তে কি ভাবছে তা তিনি জানেন না। অথচ সে জানে তিনি কি ভাবছেন। এরা মেন্টালিস্ট। এদের কাছ থেকে কিছুই গোপন করা যায় না। এরা কোনো এক বিচিত্র উপায়ে অন্যের মাথার ভেতর থেকে সমস্ত তথ্য বের করে নিতে পারে। পদ্ধতিটি টেলিপ্যাথিক। তা কি করে কাজ করে ফিহা জানেন না।

মারলা লি বললেন, মহামতি ফিহা, আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?

আমি চিন্তিত কি-না তা প্রশ্ন করে জানার দরকার নেই। আপনি কি আমার মাথার ভেতরটা খোলা বই-এর মতো পড়ে ফেলতে পারছেন না?

মারলা লি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ধারণা সঠিক নয়। মহামতি ফিহা। আমরা সারাক্ষণ অন্যের মাথার ভেতর বসে থাকি না। অন্যের ভুবনে প্রবেশ করা স্বাধীনতা হরণ করার মতো। আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি আপনাকে কথা দিতে পারি যে এখানে আসার

পর থেকে আমি আপনার মাথা থেকে কিছু জানার চেষ্টা করিনি।

কিছু জানার চেষ্টা করেন নি?

না।

তাহলে কেন বললেন যে আপনার কাছে ভালো কফি আছে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাজে কফি না। এটা বলতে হলে আপনাকে জানতে হবে যে কিছুক্ষণ আগেই আমি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বাজে কফি খেয়েছি।

মহামতি ফিহা, এটা বলার জন্যে আপনার মস্তিষ্কে ঢােকার প্রয়োজন পড়ে না। রেস্টুরেন্টগুলিতে এখন ভূমধ্যসাগরীয় কফি ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। কমিউন কৰ্মাধ্যক্ষ হিসেবে আমি জানি কখন কোথায় কি পাওয়া যায়। আপনার কাছে কি আমার কথা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে?

ফিহা চুপ করে রইলেন, কারণ কথাগুলি তাঁর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। মারলা লি চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, আপনাকে আরেকটা কথা বলি। আপনি খুব ভালো করেই জানেন যে মেন্টালিস্টরা সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। আপনি আমার অফিসে ঢুকলেন প্রচণ্ড রাগ নিয়ে। আমি ইচ্ছা করলেই মানসিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনার রাগ কমিয়ে দিতে পারতাম। তা কি আমি করেছি? করি নি।

ফিহা বললেন, এই প্ৰসঙ্গ থাক। কি জন্যে আমাকে তলব করা হয়েছে বলুন। আমার হাতে সময় বেশি নেই।

আপনাকে তলব করা হয়নি মহামতি ফিহা। এত স্পৰ্ধা আমার নেই। আমি নিজেই যেতাম আপনার কাছে। কিন্তু আপনি জানিয়ে দিয়েছেন আপনার বাড়ির এক হাজার গজের ভেতর যেন কোনো মেন্টালিস্ট না যায়। আমরা আপনার ইচ্ছাকে আদেশ বলে মনে করি। সে কারণেই প্রয়োজন হলেও আপনার কাছে যাই না। অতি বিনীত ভঙ্গিতে আপনাকে আসতে বলি। আশা করি আমাদের এই ধৃষ্টতা আপনি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন।

ক্লান্তিকর দীর্ঘ বিনয় বাক্য আমার পছন্দ নয়। যা বলতে চান বলুন।

বলছি। তার আগে একটু কফি দিতে বলি?

বলুন।

কফি চলে এল। মারলা লি নিজের হাতে পট থেকে কফি ঢাললেন। ভালো কফি বলাই বাহুল্য। কফির গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। মারতা লি কফির কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেন্টালিস্টরা সাধারণ মানুষের অকারণ ঘৃণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি সাধারণ মানুষ নন। আপনি হচ্ছেন মহামতি ফি। বলা হয়ে থাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ। আপনিও যদি সাধারণ মানুষের মতো ভাবেন তাহলে কি করে হয়?

এসব থাক, কাজের কথায় আসুন।

কফি শেষ হোক, তারপর আমরা কাজের কথায় আসব। যদিও এখন যেকথা বলছি তা আপনার কাছে অকাজের কথা হলেও, আমার কাছে কাজের কথা। ফিহা, আপনার কোটের পকেটে আজকের একটা খবরের কাগজ দেখা যাচ্ছে। আপনি কি কাগজটা পড়েছেন?

হ্যাঁ।

তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন একটা খবর ছাপা হয়েছে। ক্রুদ্ধ জনতার হাতে কুড়ি বছর বয়েসী একজন তরুণী এবং তার চার বছর বয়েসী কন্যার মৃত্যু। এদের অপরাধ—এরা মেন্টালিস্ট। মহামতি ফিহা, ক্ষিপ্ত মানুষের হাতে অসংখ্য মেন্টালিস্টের মৃত্যু ঘটেছে; কিন্তু আপনি একটি উদাহারণও পাবেন না যেখানে মেন্টালিস্টদের হাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

ফিহা কফির কাপ নামিয়ে রেখে শান্ত গলায় বলল, কফি শেষ হয়েছে। এখন বলুন কি বলবেন।

শুনতে পাই আপনি চতুর্মাত্রিক সময় সমীকরণের সমাধান করেছেন?

কোথায় শুনতে পান? শুনতে পাই বললে ভুল হবে, অনুমান করছি।

অনুমানের ভিত্তি কি?

এই বিষয়টি নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। পড়াশোনা করছেন। আপনার কাজের ধরন আমরা জানি। যখন কিছু শুরু করেন অন্য কোনো দিকে তাকান না। কাজটা যখন শেষ হয় তখন আনন্দিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ান। পাবলিক কফি শপে কফি খেতে যান। এই সময় আপনি রঙচঙে কাপড় পড়তে ভালবাসেন। এইসব লক্ষণ থেকে মনে হচ্ছে…

মনে হচ্ছে আমি সময় সমীকরণের সমাধান করেছি।

হ্যাঁ। বড় কোনো কাজ শেষ হলে আপনি বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গে সব রকম যোগাযোগ বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখেন। তাদের নির্দেশ দিয়ে দেন তারাও যেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ না করে। গত একুশ দিন ধরে বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই। এই থেকেই অনুমান করছি সমীকরণটির সমাধান আপনি করেছেন।

যদি করেই থাকি তাতে আপনার আগ্রহের কারণ কি?

আমি বিজ্ঞান তেমন জানি না। যতটুকু জানি তার থেকে বলতে পারি আপনার সমীকরণ পরীক্ষা করার জন্যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। থিওরি এক জিনিস, থিওরির ইনজিনিয়ারিং প্রয়োগ অন্য জিনিস। আমরা প্রয়োগের দিকটি দেখতে চাই। আমরা আপনাকে বলতে চাই যে অর্থ কোনো সমস্যা নয়।

শুনে সুখী হলাম। আপনি শুনে দুঃখিত হবেন যে আমি সময় সমীকরণের সমাধান বের করতে পারি নি।

পারেন নি?

না পারি নি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আমার মাথার ভেতর ঢুকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন? আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। আরেকটু কফি কি দিতে বলব?

না।

ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। মধুর ভঙ্গিতে বললেন, কষ্ট করে এসেছেন সে জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। মহামতি ফিহা, এই সামান্য উপহার কি আপনি গ্রহণ করবেন?

মারলা লি বড় একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।

ফিহা বললেন, কি আছে এখানে?

কফি বিনম্। প্রথম শ্রেণীর কফি। অনেক ঝামেলা করে আপনার জন্যে জোগাড় করেছি। গ্রহণ করলে আনন্দিত হব।

ফিহা প্যাকেটটা হাতে নিলেন। উপহার পেয়ে তিনি যে খুব আনন্দিত হয়েছেন তা মনে হল না। প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে পারলে তিনি সবচে আনন্দিত হতেন। তা সম্ভব নয়। মেন্টালিস্টরা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারবে। তার ফলাফল শুভ হবে না।

আচ্ছা কফির এই প্যাকেটটা লাইব্রেরির মেয়েটাকে দিয়ে দিলে কেমন হয়? বেচারিকে তিনি কিছুটা হলেও আহত করেছেন। কফির প্যাকেট পেলে খুশি হবে। মেয়েটার কাছ থেকে অতিপ্রাকৃত গল্পের বইটাও চেয়ে নেয়া যায়। একটা গল্প পড়লে কিছু যায় আসে না।

ফিহা লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। যোগাযোগ হাঁটতে হাঁটতেই করা গেল। পকেটে রাখা ক্যুনিকেটর তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল। ফিহাকে পরিচয় দিতে হল না। যে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির কমুনিকেটর তিনি ব্যবহার করেন তা সবারই মোটামুটি পরিচিত।

লাইব্রেরির ডিরেক্টর খানিকটা ভীত গলায় বলল, কি ব্যাপার স্যার?

কোনো ব্যাপার না। আপনাদের একজন ক্যাটালগারের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তার নামটা কি বলবেন?

ফিহার ভুরু কুঞ্চিত হল। নামটা তাঁর মনে পড়ছে না। নাম মনে রাখার চেষ্টা করেন নি বলেই মনে নেই। অপ্রয়োজনীয় কিছু মনে রাখার চেষ্টা করে মস্তিষ্ক ভারাক্রান্ত করার তিনি কোনো কারণ দেখেন না।

নাম মনে পড়ছে না। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে। অতিপ্রাকৃত গল্প পছন্দ করে। কফি খেতে ভালবাসে।

স্যার, আপনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন তার নাম কি নুহাশ?

হ্যাঁ নুহাশ।

স্যার, আমি তাকে ডেকে দিচ্ছি, একটু ধরুন স্যার। এক মিনিট।

তিনি কম্যুনিকেটরের বোতাম চেপে রাখলেন। এক মিনিট অপেক্ষা করার কথা, এক মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের মাথায় লাইব্রেরির ডিরেক্টরের গলা পাওয়া গেল–

স্যার, একটি ক্ষুদ্র সমস্যা হয়েছে। মেয়েটি বাড়ি চলে গেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছে। ক্যাটালগ সেকশনে গিয়ে জানতে পারলাম কি একটা কারণে খুব মন খারাপ করে আজ সে লাইব্রেরিতে এসেছিল। একটা বই ছিড়ে কুটিকুটি করেছে। বইটা হল অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ। তারপর বাসায় চলে গেছে। স্যার আমি কি বেশি কথা বলছি?

তা বলছেন।

ক্ষমা প্রার্থনা করছি স্যার। মেয়েটা থাকে সাধারণ আবাসিক প্রকল্পের ১১৮নং কক্ষে। তাকে আনার জন্যে লোক পাঠাচ্ছি।

তার কোনো প্রয়োজন নেই।

মেয়েটির কম্যুনিকেটরের সুবিধা নেই, থাকলে এক্ষুণি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতাম। অত্যন্ত দুঃখিত স্যার।

আপনার এত দুঃখিত হবার কিছু নেই।

তাকে কি কিছু বলতে হবে?

কিছুই বলতে হবে না। ধন্যবাদ।

ফিহা কম্যুনিকেটরের সুইচ বন্ধ করে দিলেন। তিনি অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে এগুচ্ছেন। পা ফেলছেন অতি দ্রুত। তবে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন না। বাড়ি ফিরতে কেন জানি ইচ্ছা করছে না। তার মাথায় সিনথেটিক ফারের টুপি, টুপিতে চেহারা ঢাকা পড়েছে। অন্তত তাঁর তাই ধারণা। কফির প্যাকেটটা ফেলে দিতে হবে। কোনো ডাস্টবিন পাচ্ছেন না। এই জিনিস ডাস্টবিন ছাড়া কোথাও ফেলা যাবে না। ফিহা কফির প্যাকেটটা ছুড়ে ফেললেন। তাঁর লক্ষ ভালই। প্যাকেটটা ডাস্টবিনে পড়ল।

ফিহা আকাশের দিকে তাকালেন।

সূর্য দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢাকা পড়েছে। আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে। প্রাচীন মানুষ সূর্যকে পূজা করত। চন্দ্রকে পূজা করত। গ্রহ-নক্ষত্রকেও পূজা দেয়া হত। আকাশকে করত না কেন? পূজা পাওয়ার যোগ্যতা আকাশের চেয়ে বেশি আর কার আছে? ঈশ্বরকে সীমার ভেতর কল্পনা করা অনুচিত। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র সবই সীমায় আবদ্ধ। একমাত্র আকাশই সীমাহীন।

স্যার! ফিহা চমকে তাকালেন।

দীর্ঘদেহী সবুজ পোশাক পরা যুবকটি বলল, আপনাকে কি সাহায্য করতে পারি?

আমাকে একমাত্র আমিই সাহায্য করি। অন্য কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারে না। আপনি কে?

আমি স্যার টহল পুলিশ।

ও আচ্ছা, টহল পুলিশ। আপনার গায়ের সবুজ পোশাক দেখেই আমার অনুমান করা উচিত ছিল।

আপনি কি কোনো ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে কি কেউ ঠিকানা খোঁজে?

আপনি আকাশের দিকে তাকিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। আমি অনেকক্ষণ ধরেই আপনাকে অনুসরণ করছি। লক্ষ করছি আপনি রাস্তার নাম্বার পড়তে পড়তে এগুচ্ছেন।

অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে অনুসরণ করছেন কেন?

আমাদের উপর নির্দেশ আছে যে কেউ উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটলেই তাকে অনুসরণ করতে হবে। আপনাকেও সেই কারণে অনুসরণ করছি। আপনি যে মহামতি ফিহাতা মাত্র কিছুক্ষণ আগে বুঝতে পেরেছি।

অটোগ্রাফ চাইলে অটোগ্রাফ নিতে পারেন।

স্যার, আপনি কি আমার উপর বিরক্ত হয়েছেন?

না, বিরক্ত হইনি।

আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, আপনি যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব।

এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা করছে আকাশের দিকে যেতে, আপনার গাড়িতে চড়ে সেই ইচ্ছা মেটানো সম্ভব নয়। আমরা এখন আছি কোথায়?

আপনি স্যার শহরের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। আর মাত্র দশ গজ। গেলেই নিষিদ্ধ এলাকায় চলে যাবেন।

মেন্টালিস্টদের এলাকা?

জি স্যার।

মেন্টালিস্টদের এলাকা কতটুকু?

আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় স্যার। ঐ এলাকা আমার জন্যেও নিষিদ্ধ।

কতজন মেন্টালিস্ট এ শহরে আছে তা জানেন?

তাও জানি না। তাদের সংখ্যা কখনো প্রকাশ করা হয় না। তবে এ শহরে। সাধারণ মানুষ এই মুহূর্তে আছে নব্দুই হাজার সাতশ এগারো জন।

গত বছরেও জনসংখ্যা ছিল এক লাখ কুড়ি হাজারের মতো। কমে গেল কেন?

আমার জানা নেই স্যার।

আপনার সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হচ্ছে তা মেন্টালিস্টরা বুঝতে পারছে? পারছে স্যার। পুলিশের উপর এদের সরাসরি নিয়ন্ত্ৰণ আছে।

মেন্টালিস্টদের আবাসিক এলাকা কি একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ না সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে?

এরা বাস করে ভূগর্ভস্থ শহরে। সেই শহর কত বড়, কতটুকু ছড়ানো তা আমরা জানি না স্যার। আগে কেউ কেউ বাইরে থাকত, এখন নেই বললেই চলে।

আপনার নাম কি?

এরিন।

এরিন, আপনি কি কখনো ভেবেছেন যে আমরা মানুষ হিসেবে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছি? একদল থাকছে মাটির উপরে, একদল চলে গিয়েছে মাটির নিচে।

এইসব নিয়ে আমি ভাবি না স্যার।

কেউই ভাবে না। কেন ভাবে না বলুন তো?

জানি না স্যার।

ফিহা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমাদের ভাবতে দেয়া হয় না। আমাদের ভাবনা, আমাদের কল্পনা নিয়ন্ত্রিত। আমরা কি ভাবব মেন্টালিস্টরা তা ঠিক করে দেয়। যখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের সুখী হওয়া উচিত, আমরা সুখী হই। যখন ভাবে আমাদের অসুখী হওয়া উচিত, আমরা অসুখী হই।

কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি কিন্তু স্বাধীনভাবেই চিন্তা করছেন।

হ্যাঁ তা করছি এবং অবাক হচ্ছি। আপনি আপনার গাড়ি নিয়ে আসুন, আমি একটা জায়গায় যাব। সাধারণ আবাসিক প্রকল্প। ১১৮ নম্বর কক্ষ। একটি অল্পবয়স্ক মেয়ের সঙ্গে কথা বলব বলে ভাবছি, মেয়েটির নাম নুহাশ।

এরিন লম্বা লম্বা পা ফেলে গাড়ি আনতে রওনা হল। ফিহা দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশস্ত রাস্তার এক পাশের ফুটপাতে। পনেরো মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয় ট্রাম যাচ্ছে, এ ছাড়া রাস্তায় যানবাহন বা লোক চলাচল নেই। প্রাণহীন একটি শহর। সারাদিন হেঁটেও তিনি কোনো শিশুর দেখা পান নি। শিশুসদনগুলি শহরের বাইরে। বাবা-মার সঙ্গে শিশুদের রাখা হয় না। তারা বড় হয় শিশুসদনে। বছরে একবার অল্পকিছু সময়ের জন্যে বাবা-মারা শিশুদের দেখতে যেতে পারেন।

আচ্ছা, মেন্টালিস্টদের শিশুরা কোথায় বড় হয়। তাদের শিশু সনদগুলি কোথায়? তিনি জানেন না। ফিহা ক্লান্ত বোধ করছেন। শীত লাগছে। আজ কত তারিখ, কি বার তিনি কিছুই জানেন না। তিনি ছুটি ভোগ করছেন। ছুটির সময় কিছুই মনে রাখতে চান না। ছুটি কাটান শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, অরণ্য কিছুই দেখতে ইচ্ছা করে না।

তাঁর বয়স পঞ্চাশ। অনেকখানি সময়ই তিনি পার করে দিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কেন মনে হল না বাইরে যেতে? মেটালিস্টরা সেই ইচ্ছা জাগতে দেয় নি। তিনি বিয়ে করেন নি। কখনো কোনো তরুণীর প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন নি। নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। কেন করেছেন? মেন্টালিস্টরা কি তাকে প্রভাবিত করেছে? শুধু তিনি একা নন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিটি বিজ্ঞানীই চিরকুমার। তিনি একা হলে ব্যাখ্যা হয়তো অন্য রকম হত। তিনি তো একা নন।

মেন্টালিস্টরা বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করছে। কারণ বিজ্ঞানীদের কাজ তাদের প্রয়োজন। এই কাজ তারা আদায় করে নেবে। বিজ্ঞানীরা তাদের কাছে রোবট ছাড়া কিছুই নয়। একদল পুতুল, যে-পুতুলের সুতা মেন্টালিস্টদের হাতে।

মেন্টালিস্টরা এক সূক্ষ্মভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে তা ভেবে ফিহা অতীতে অসংখ্যবার বিস্মিত হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো হবেন। কিন্তু এখন আর বিস্মিত হতে ইচ্ছা করে না।

একবার গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়লেন। বিষয়টির উপর তাঁর তেমন দখল নেই। অথচ সময় সমীকরণে গ্রেগরিয়ান এ্যানালাইসিস অসম্ভব জরুরি। নতুন করে এই জিনিস শিখতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তায় বাধা পড়বে। এই অবস্থায় হঠাৎ খবরের কাগজে দেখলেন গেরিয়ান এ্যানালাইসিসের বিখ্যাত পণ্ডিত অধ্যাপক শরমন তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে এখানে আসছেন। তাঁর শরীর অসুস্থ। তিনি এখানে এসে শরীর সারাবেন।

এই ব্যবস্থা কি মেন্টালিস্টরা করে দিল না?

সব কিছুই তারা করে দিচ্ছে। সব কিছু এগুচ্ছে তাদের পরিকল্পনায়। তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়া কি খুব অসম্ভব? যা তাঁর ইচ্ছা করছে না সেই কাজটি করলে কেমন হয়?

তাঁর শহর ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না, শহর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? নারীসঙ্গ তাঁর প্রিয় নয়, তিনি যদি এখন নুহাশ নামের মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলেন তাহলে কেমন হয়? অবশ্যি মেয়েটির তাতে মত থাকতে হবে। মত না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা স্বামী হিসেবে মোটেই আকর্ষণীয় নয়।

ফিহা আকাশের দিকে তাকালেন। তাঁর হাসি পাচ্ছে। হো হো করে খানিকক্ষণ হাসা যেতে পারে। না কি মেন্টালিস্টরা তাকে হাসতেও দেবে না?

এরিন গাড়ি নিয়ে এসেছে। সে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু দেরি হল স্যার। অনেকদূর যেতে হবে তাই নতুন সেল লাগিয়ে নিয়ে এসেছি।

অনেক দূর যেতে হবে কি? জি স্যার। শহরের অন্যপ্রান্তে। চল, রওনা হওয়া যাক।