০২. পত্রাবলী ১১-২০

১১

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

সিমলা, কলিকাতা
১৪ জুলাই, ১৮৮৯

পূজ্যপাদ মহাশয়,
মহাশয়ের পত্র পাইয়া পরম প্রীত হইলাম। এরূপস্থলে অনেকেই সংসারের দিকে টলিতে উপদেশ দেন। মহাশয় সত্যগ্রাহী এবং বজ্রসারসদৃশ হৃদয়বান্—আপনার উৎসাহবাক্যে পরম আশ্বাসিত হইলাম। আমার এ স্থানের গোলযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে ৺কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।
আপনি ২০৲ টাকার এক কেতা নোট পাঠাইয়াছিলেন। আপনি অতি মহৎ; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য—মহাশয়ের প্রথমোদ্দেশ্য পালনে আমার মাতা ভ্রাতাদির সাংসারিক অহঙ্কার প্রতিবন্ধক হইল; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অর্থাৎ আমার কাশী যাইবার জন্য ব্যবহার করিয়া চরিতার্থ হইব। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১২

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

বরাহনগর, কলিকাতা
৭ অগষ্ট, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
প্রায় এক সপ্তাহের অধিক হইল আপনার পত্র পাইয়াছি, সেই সময়ে পুনরায় জ্বর হওয়ায় উত্তরদানে অসমর্থ ছিলাম, ক্ষমা করিবেন। মধ্যে মাস দেড়েক ভাল ছিলাম, কিন্তু পুনরায় ১০|১২ দিন হইল জ্বর হইয়াছিল, এক্ষণে ভাল আছি। গুটিকতক প্রশ্ন আছে, মহাশয়ের বিস্তৃত সংস্কৃতশাস্ত্রজ্ঞান—উত্তর দিয়া বাধিত করিবেন।—

১। সত্যকাম জাবালি এবং জনশ্রুতির কোন উপাখ্যান ছান্দোগ্য উপনিষদ্ সওয়ায়৬ বেদের অন্য কোন অংশে আছে কি না?

২। শঙ্করাচার্য বেদান্তভাষ্যে অধিকাংশ স্থলেই স্মৃতি উদ্ধৃত করিতে গেলেই মহাভারতের প্রমাণ প্রয়োগ করেন। কিন্তু বনপর্বে অজগরোপাখ্যানে এবং উমামহেশ্বর-সংবাদে, তথা ভীষ্মপর্বে, যে গুণগত জাতিত্ব অতি স্পষ্টই প্রমাণিত, তৎসম্বন্ধে তাঁহার কোন পুস্তকে কোন কথা বলিয়াছেন কি না?

৩। পুরুষসূক্তের জাতি পুরুষানুগত নহে—বেদের কোন্ কোন্ অংশে ইহাকে ধারাবাহিক পুরুষানুগত করা হইয়াছে?

৪। আচার্য, ‘শূদ্র যে বেদ পড়িবে না’—এ প্রকার কোন প্রমাণ বেদ হইতে দিতে পারেন নাই। কেবল ‘যজ্ঞেঽনবকঌপ্তঃ’ ইহাই উদ্ধৃত করিয়া বলিতেছেন যে, যখন যজ্ঞে অধিকার নাই, তখন উপনিষদাদি পাঠেও অধিকার নাই। কিন্তু ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’—এস্থলে ঐ আচার্যই বলিতেছেন যে, অথ শব্দ ‘বেদাধ্যয়নাদনন্তরম্’—এ প্রকার অর্থ নহে, কারণ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ না পড়িলে যে উপনিষদ্ পড়া যায় না, ইহা অপ্রামাণ্য; এবং কর্মকাণ্ডের শ্রুতি এবং জ্ঞানকাণ্ডের শ্রুতিতে কোন পূর্বাপর ভাব নাই। অতএব যজ্ঞাত্মক বেদ না পড়িয়াই উপনিষদ‍্‍পাঠে ব্রহ্মজ্ঞান হইতে পারে। যদি যজ্ঞে ও জ্ঞানে পৌর্বাপর্য না থাকিল, তবে শূদ্রের বেলা কেন ‘ন্যায়পূর্বকম্’ ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা আচার্য আপনার বাক্যকে ব্যাহত করিতেছেন? কেন শূদ্র উপনিষদ্ পড়িবে না?

মহাশয়কে একখানি—কোন খ্রীষ্টিয়ান সন্ন্যাসীর লিখিত—’Imitation of Christ’ নামক পুস্তক পাঠাইলাম। পুস্তকখানি অতি আশ্চর্য। খ্রীষ্টিয়ানদিগের মধ্যেও এ প্রকার ত্যাগ বৈরাগ্য ও দাস্যভক্তি ছিল দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়। বোধ হয় আপনি এ পুস্তক পড়িয়া থাকিবেন, না পড়িয়া থাকেন তো পড়িয়া আমাকে চিরকৃতার্থ করিবেন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৩

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

বরাহনগর
১৭ অগষ্ট, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের শেষ পত্রে—আপনাকে উক্ত অভিধান দেওয়ায় কিছু কুণ্ঠিত হইয়াছেন! কিন্তু তাহা আমার দোষ নহে, মহাশয়ের গুণের। পূর্বে এক পত্রে আপনাকে লিখিয়াছিলাম যে, মহাশয়ের গুণে আমি এত আকৃষ্ট যে, বোধ হয় আপনার সহিত জন্মান্তরীণ কোন সম্বন্ধ ছিল। আমি গৃহস্থও বুঝি না, সন্ন্যাসীও বুঝি না; যথার্থ সাধুতা এবং উদারতা এবং মহত্ত্ব যথায়, সেই স্থানেই আমার মস্তক চিরকালই অবনত হউক—শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। প্রার্থনা করি, আজিকালিকার মানভিখারী, পেটবৈরাগী এবং উভয়ভ্রষ্ট সন্ন্যাসীশ্রমীদের মধ্যে লক্ষের মধ্যেও যেন আপনার ন্যায় মহাত্মা একজন হউন। আপনার গুণের কথা শুনিয়া আমার সকল ব্রাহ্মণজাতীয় গুরুভ্রাতাও আপনাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত জানাইতেছেন।
মহাশয় আমার প্রশ্ন-কয়েকটির যে উত্তর দিয়াছেন, তাহার মধ্যে একটি সম্বন্ধে আমার ভ্রম সংশোধিত হইল। মহাশয়ের নিকট তজ্জন্য আমি চিরঋণবদ্ধ রহিলাম। আর একটি প্রশ্ন ছিল যে, ভারতাদি পুরাণোক্ত গুণগত জাতি সম্বন্ধে আচার্য কোন মীমাংসাদি করিয়াছেন কি না? যদি করিয়া থাকেন, কোন্ পুস্তকে? এতদ্দেশীয় প্রাচীন মত যে বংশগত, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই, এবং স্পার্টানরা যে প্রকার হেলট্ [দের উপর ব্যবহার করিত] অথবা মার্কিনদেশে কাফ্রীদের উপর যে প্রকার ব্যবহার হইত, সময়ে সময়ে শূদ্রেরা যে তদপেক্ষাও নিগৃহীত হইত, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আর জাত্যাদি সম্বন্ধে আমার কোন পক্ষে পক্ষপাতিত্ব নাই। কারণ আমি জানি, উহা সামাজিক নিয়ম—গুণ এবং কর্ম-প্রসূত। যিনি নৈষ্কর্ম ও নিগুর্ণত্বকে প্রাপ্ত হইতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার জাত্যাদি ভাব মনে আনিলেও সমূহ ক্ষতি। এই সকল বিষয়ে গুরুকৃপায় আমার এক প্রকার বুদ্ধি আছে, কিন্তু মহাশয়ের মতামত জানিলে কোন স্থানে সেই সকলকে দৃঢ় এবং কোন স্থানে সংশোধিত করিয়া লইব। চাকে খোঁচা না মারিলে মধু পড়ে না—অতএব আপনাকে আরও কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব; আমাকে বালক এবং অজ্ঞ জানিয়া যথাযথ উত্তর দিবেন, রুষ্ট হইবেন না।

১। বেদান্তসূত্রে যে মুক্তির কথা কহে, তাহা এবং অবধূত-গীতাদিতে যে নির্বাণ আছে, তাহা এক কি না?

২। ‘সৃষ্টিবর্জ’—সূত্রে এই ভাবের পুরো ভগবান্‌ কেহই হয় না, তবে নির্বাণ কি?

৩। চৈতন্যদেব পুরীতে সার্বভৌমকে বলিয়াছিলেন যে ব্যাসসূত্র আমি বুঝি, তাহা দ্বৈতবাদ; কিন্তু ভাষ্যকার অদ্বৈত করিতেছেন, তাহা বুঝি না—ইহা সত্য নাকি? প্রবাদ আছে যে, চৈতন্যদেবের সহিত প্রকাশানন্দ সরস্বতীর এ বিষয়ে অনেক বিচার হয়, তাহাতে চৈতন্যদেব জয়ী হন। চৈতন্যের কৃত এক ভাষ্য নাকি উক্ত প্রকাশানন্দের মঠে ছিল।

৪। আচার্যকে তন্ত্রে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলিয়াছে। ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ নামক বৌদ্ধদের (মহাযান) গ্রন্থের মতের সহিত আচার্য-প্রচারিত বেদান্তমতের সম্পূর্ণ সৌসাদৃশ্য আছে। ‘পঞ্চদশী’কারও বলিতেছেন যে, বৌদ্ধ [দের] শূন্য ও আমাদিগের ব্রহ্ম একই ব্যাপার—ইহার অর্থ কি?

৫। বেদান্তসূত্রে বেদের কোন প্রমাণ কেন দেওয়া হয় নাই? প্রথমেই বলা হইয়াছে, ঈশ্বরের প্রমাণ বেদ এবং বেদ প্রামাণ্য ‘পুরুষ-নিঃশ্বসিতম্’ বলিয়া; ইহা কি পাশ্চাত্য ন্যায়ে যাহাকে argument in a circle বলে, সেই দোষদুষ্ট নহে?

৬। বেদান্ত বলিলেন—বিশ্বাস করিতে হইবে, তর্কে নিষ্পত্তি হয় না। তবে যেখানে ন্যায় অথবা সংখ্যাদির অণুমাত্র ছিদ্র পাইয়াছেন, তখনই তর্কজালে তাহাদিগকে সমাচ্ছন্ন করা হইয়াছে কেন? আর বিশ্বাসই বা করি কাকে? যে যার আপনার মতস্থাপনেই পাগল; এত বড় ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ’, তিনিই যদি ব্যাসের মতে অতি ভ্রান্ত, তখন ব্যাস যে আরও ভ্রান্ত নহেন, কে বলিল? কপিল কি বেদাদি বুঝিতেন না?

৭। ন্যায়-মতে ‘আপ্তোপদেশবাক্যঃ শব্দঃ’; ঋষিরা আপ্ত এবং সর্বজ্ঞ। তাঁহারা তবে সূর্যসিদ্ধান্তের দ্বারা সামান্য সামান্য জ্যোতিষিক তত্ত্বে অজ্ঞ বলিয়া আক্ষিপ্ত কেন হইতেছেন? যাঁহারা বলেন—পৃথিবী ত্রিকোণ, বাসুকি পৃথিবীর ধারয়িতা ইত্যাদি, তাঁহাদের বুদ্ধিকে ভবসাগরপারের একমাত্র আশ্রয় কি প্রকারে বলি?

৮। ঈশ্বর সৃষ্টিকার্যে যদি শুভাশুভ কর্মকে অপেক্ষা করেন, তবে তাঁহার উপাসনায় আমার লাভ কি? নরেশচন্দ্রের একটি সুন্দর গীত আছে—

‘কপালে যা আছে কালী, তাই যদি হবে, (মা)
জয় দুর্গা শ্রীদুর্গা বলে কেন ডাকা তবে॥’

৯। সত্য বটে, বহু বাক্য এক-আধটির দ্বারা নিহত হওয়া অন্যায্য। তাহা হইলে চিরপ্রচলিত মধুপর্কাদি প্রথা৮ ‘অশ্বমেধং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্’ ইত্যাদি৯ দুই-একটি বাক্যের দ্বারা কেন নিহত হইল? বেদ যদি নিত্য হয়, তবে ইহা দ্বাপরের, ইহা কলির ধর্ম ইত্যাদি বচনের অর্থ এবং সাফল্য কি?

১০। যে ঈশ্বর বেদ-বক্তা, তিনিই বুদ্ধ হইয়া বেদ নিষেধ করিতেছেন। কোন্ কথা শুনা উচিত? পরের বিধি প্রবল, না, আগের বিধি প্রবল?

১১। তন্ত্র বলেন—কলিতে বেদমন্ত্র নিষ্ফল; মহেশ্বরেরই বা কোন্ কথা মানিব?

১২। বেদান্তসূত্রে ব্যাস বলেন যে, বাসুদেব সঙ্কর্ষণাদি চতুর্ব্যূহ উপাসনা ঠিক নহে—আবার সেই ব্যাসই ভাগবতাদিতে উক্ত উপাসনার মাহাত্ম্য বিস্তার করিতেছেন; ব্যাস কি পাগল?

আরও এই প্রকার অনেক সন্দেহ আছে, মহাশয়ের প্রসাদে ছিন্নদ্বৈধ হইব আশা করিয়া পরে সেগুলি লিখিব। এ সকল কথা সাক্ষাৎ না হইলে সমস্ত বলা যায় না এবং আশানুরূপ তৃপ্তিও হয় না। গুরুর কৃপায় শীঘ্রই ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইয়া সমস্ত নিবেদন করিবার বাসনা রহিল। ইতি
শুনিয়াছি, বিনা সাধনায় শুদ্ধ যুক্ত্যাদি-বলে এ সকল বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না, কিন্তু কতক পরিমাণে আশ্বস্ত হওয়া প্রথমেই বোধ হয় আবশ্যক। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৪

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়

বাগবাজার, কলিকাতা
২ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
মহাশয়ের দুইখানি পত্র কয়েক দিবস হইল পাইয়াছি। মহাশয়ের অন্তরে জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সম্মিলন দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইয়াছি। আপনি যে তর্কযুক্তি পরিত্যাগ করিতে উপদেশ দেন, তাহা অতি যথার্থ বটে এবং প্রত্যেক জীবনেরই উদ্দেশ্য তাহাই—‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ’ ইত্যাদি ১০। তবে কি না আমার গুরুমহারাজ যে প্রকার বলিতেন যে, কলসী পুরিবার সময় ভকভক ধ্বনি করে, পূর্ণ হইলে নিস্তব্ধ হইয়া যায়, আমার পক্ষে সেইরূপ জানিবেন। বোধ হয়, দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব—ঈশ্বর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করুন। ইতি

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৫

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

বাগবাজার, কলিকাতা
৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
অনেকদিন আপনার কোন পত্রাদি পাই নাই; ভরসা করি, শারীরিক ও মানসিক কুশলে আছেন। সম্প্রতি আমার দুইটি গুরুভ্রাতা ৺কাশীধামে যাইতেছেন। একটির নাম রাখাল ও অপরটির নাম সুবোধ। প্রথমোক্ত মহাশয় আমার গুরুদেবের অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং সর্বদা তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। যদি সুবিধা হয়, ইঁহারা যে কয়েকদিন উক্ত ধামে অবস্থান করেন, কোন সত্রে বলিয়া দিয়া অনুগৃহীত করিবেন। আমার সকল সংবাদ ইঁহাদের নিকট পাইবেন। আমার অসংখ্য প্রণামের সহিত।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

পুঃ—গঙ্গাধর এক্ষণে কৈলাসাভিমুখে যাইতেছেন। পথে তিব্বতীরা তাঁহাকে ফিরিঙ্গীর চর মনে করিয়া কাটিতে আসে, পরে কোন কোন লামা অনুগ্রহ করিয়া ছাড়িয়া দেয়—এ সংবাদ তিব্বতযাত্রী কোন ব্যবসায়ী হইতে পাইয়াছি। লাসা না দেখিলে আমাদের গঙ্গাধরের রক্ত শীতল হইবে না। লাভের মধ্যে শারীরিক কষ্টসহিষ্ণুতা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাইয়াছে—একরাত্রি তিনি অনাচ্ছাদনে বরফের উপর শয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতেও বিশেষ কষ্ট হয় নাই ।

ইতি
নরেন্দ্র

১৬

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

বরাহনগর, কলিকাতা
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
আপনার পত্র পাইয়া সবিশেষ অবগত হইলাম—পরে রাখালের পত্রে তাঁহার আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাহাও জানিলাম। আপনার রচিতpamphlet (পুস্তিকা) পাইয়াছি। Theory of Conservation of Energy (শক্তির নিত্যতা—এই মতবাদ) আবিষ্কারের পর হইতে ইওরোপে এক প্রকার Scientific (বৈজ্ঞানিক) অদ্বৈতবাদ প্রচারিত হইতেছে, কিন্তু তাহা পরিণামবাদ। আপনি ইহার সহিত শঙ্করের বিবর্তবাদের যে পার্থক্য দেখাইয়াছেন, তাহা অতি উত্তম। জার্মান Transcendentalist-দের১১ উপর স্পেন্সারের যে বিদ্রূপ উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা বুঝিলাম না; তিনি স্বয়ং উহাদের প্রসাদভোজী। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী গাফ্ (Gough) সম্যক‍্‍রূপে হেগেল বুঝেন কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যাহা হউক, আপনার উত্তর অতি pointed (তীক্ষ্ণ) এবং thrashing (সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষযুক্তি-খণ্ডনকারী)।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৭

[শ্রীযুক্ত বলরাম বসুকে লিখিত]

রামকৃষ্ণো জয়তি

বৈদ্যনাথ
২৪ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

নমস্কারপূর্বকম্—
বৈদ্যনাথে পূর্ণবাবুর বাসায় কয়েকদিন আছি। শীত বড় নাই, শরীরও বড় ভাল নহে—হজম হয় না, বোধ হয় জলে লৌহাধিক্যের জন্য। কিছুই ভাল লাগিল না—স্থান, কাল ও সঙ্গ। কাল কাশী চলিলাম। দেওঘরে অচ্যুতানন্দ ‘—’র বাসায় ছিল। সে আমাদের সংবাদ পাইয়াই বিশেষ আগ্রহ করিয়া রাখিবার জন্য বড় জিদ করে। শেষে আর একদিন দেখা হইয়াছিল—ছাড়ে নাই। সে বড় কর্মী, কিন্তু সঙ্গে ৭।৮ টা স্ত্রীলোক বুড়ী, ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ই অধিক—রুচি ভাল, শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গের মহিমা! তাহার কর্মচারীরাও আমাদের অত্যন্ত ভক্তি করে। তাহারা কেহ কেহ উহার উপর বড় চটা, তাহারা তাহার নানাস্থানের দুষ্কর্মের কথা কহিতে লাগিল।

প্রসঙ্গক্রমে আমি ‘—’র কথা পাড়িলাম। তোমাদের তাঁহার সম্বন্ধে অনেক ভ্রম বা সন্দেহ আছে, তজ্জন্যই বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া লিখিতেছি। তাঁহাকে এখানকার বৃদ্ধ কর্মচারীরাও বড় মান্য ও ভক্তি করে। তিনি অতি বালিকা-অবস্থায় ‘—’র কাছে আসিয়াছিলেন, বরাবর স্ত্রীর ন্যায় ছিলেন। এমন কি, ‘—’র মন্ত্রগুরু ভগবানদাস বাবাজীও জানিতেন যে, তিনি উহার স্ত্রী। তাহারা বলে, উঁহার মা তাঁহাকে ‘—’র কাছে দিয়া গিয়াছিল। যাহা হউক, তাঁহার এক পুত্র হয় ও মরিয়া যায় এবং সেই সময়ে ‘—’কোথা হইতে একটা ‘জয় রাধে কৃষ্ণ’ বামনী আনিয়া ঘরে ঢোকায়, এই সকল কারণে তিনি তাহাকে ফেলিয়া পলান। যাহা হউক, সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তাঁহার চরিত্রে কখনও কোন দোষ ছিল না, তিনি অতি সতী বরাবর ছিলেন এবং কখনও স্ত্রী-স্বামী ভিন্ন ‘—’র সহিত অন্য কোন ব্যবহার বা অন্য কাহারও প্রতি কু-ভাব ছিল না। এত অল্প বয়সে আসিয়াছিলেন যে, সে সময়ে অন্য পুরুষ-সংসর্গ সম্ভবে না। তিনি ‘—’র নিকট হইতে পলাইয়া যাইবার পর তাহাকে লেখেন যে, আমি কখনও তোমাকে স্বামী ভিন্ন অন্য ব্যবহার করি নাই, কিন্তু বেশ্যাসক্ত ব্যক্তির সহিত আমার বাস করা অসম্ভব। ইহার পুরাতন কর্মচারীরাও ইহাকে শয়তান ও তাঁহাকে দেবী বলিয়া বিশ্বাস করে ও বলে, ‘তিনি যাবার পর হইতেই ইহার মতিচ্ছন্ন হইয়াছে।’

এ সকল লিখিবার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁহার বাল্যকালসম্বন্ধী গল্পে আমি পূর্বে বিশ্বাস করিতাম না। এ সকল ভাব, সমাজে যাহাকে বিবাহ বলে না, তাহার মধ্যে এত পবিত্রতা—আমি romance (কাল্পনিক) মনে করিতাম, কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানিয়াছি, সকল ঠিক। তিনি অতি পবিত্র, আবাল্য পবিত্র, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ঐ সকল সন্দেহের জন্য আমরা সকলেই তাঁহার নিকট অপরাধী। আমি তাঁহাকে অসংখ্য প্রণাম করিতেছি ও অপরাধের জন্য ক্ষমা চাহিতেছি। তিনি মিথ্যাবাদিনী নহেন। তাঁহার ধর্মে ঐকান্তিকী আস্থাও চিরকাল ছিল, এ কথাও শুনিলাম। এক্ষণে ইহাই শিখিলাম, ঐ প্রকার তেজ মিথ্যাবাদিনী ব্যাভিচারিণীতে সম্ভবে না।

আপনার পীড়া এখনও আরাম হইতেছে না। এখানে খুব পয়সা খরচ না করিতে পারিলে রোগীর বিশেষ সুবিধা বুঝি না। যাহা হয় বিবেচনা করিবেন। সকল দ্রব্যই অন্যত্র হইতে আনাইয়া লইতে হইবে।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৮

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

বৈদ্যনাথ
২৬ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
বহু দিবস চেষ্টার পর বোধ হয় এতদিনে ভবৎসমীপে উপস্থিত হইতে সমর্থ হইলাম। দুই-এক দিনেই ৺কাশীধামে ভবৎ-চরণসমীপে উপস্থিত হইব।

এ স্থানে কলিকাতার একজন বাবুর বাসায় কয়েক দিবস আছি, কিন্তু কাশীর জন্য মন অত্যন্ত ব্যাকুল।

ইচ্ছা আছে, তথায় কিছুদিন থাকিব এবং আমার মন্দ ভাগ্যে বিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা কি করেন, দেখিব। এবার ‘শরীরং বা পাতয়ামি, মন্ত্রং বা সাধয়ামি’ প্রতিজ্ঞা করিয়াছি—কাশীনাথ সহায় হউন।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

১৯

[বলরামবাবুকে লিখিত]

রামকৃষ্ণো জয়তি

এলাহাবাদ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

শ্রীচরণেষু,
গুপ্ত১২ আসিবার সময় একটা শ্লিপ ফেলিয়া আসিয়াছিল এবং পরদিবসে একখানি যোগেনের পত্র পাইয়া সমস্ত অবগত হইয়া তৎক্ষণাৎ এলাহাবাদে যাত্রা করি। পরদিবস পৌঁছিয়া দেখিলাম, যোগেন ১৩ সম্পূর্ণ আরোগ্য হইয়াছে। পানিবসন্ত (দুই-একটা ‘ইচ্ছা’ ও ছিল) হইয়াছিল। ডাক্তারবাবু অতি সাধু ব্যক্তি এবং তাঁহাদের একটি সম্প্রদায় আছে। ইঁহারা অতি ভক্ত ও সাধুসেবাপরায়ণ। ইঁহাদের বড় জিদ—আমি এ স্থানে মাঘ মাস থাকি, আমি কিন্তু কাশী চলিলাম। গোলাপ-মা, যোগীন-মা এখানে কল্পবাস করিবেন, নিরঞ্জনও১৪ বোধ হয় থাকিবে, যোগেন কি করিবে জানি না। আপনি কেমন আছেন?

ঈশ্বরের নিকট সপরিবার আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করি। তুলসীরাম, চুনীবাবু প্রভৃতিকে আমার নমস্কারাদি দিবেন। কিমধিকমিতি—

দাস
নরেন্দ্রনাথ

২০

[প্রমদাবাবুকে লিখিত]

ঈশ্বরো জয়তি

৺প্রয়াগধাম
১৭ পৌষ
৩০ ডিসেম্বর, ১৮৮৯

পূজ্যপাদেষু,
দুই-এক দিনের মধ্যে কাশী যাইতেছি বলিয়া আপনাকে এক পত্র লিখিয়াছিলাম, কিন্তু বিধাতার নির্বন্ধ কে খণ্ডাইবে? যোগেন্দ্র নামক আমার একটি গুরুভ্রাতা চিত্রকূট ওঙ্কারনাথাদি দর্শন করিয়া এস্থানে আসিয়া বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়াছেন সংবাদ পাই, তাহাতে তাঁহার সেবা করিবার জন্য এস্থানে আসিয়া উপস্থিত হই। আমার গুরুভাই সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়াছেন। এখানের কয়েকটি বাঙালী বাবু অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও অনুরাগী, তাঁহারা আমাকে অত্যন্ত যত্ন করিতেছেন এবং তাঁহাদিগের বিশেষ আগ্রহ যে, আমি এই স্থানে মাঘ মাসে ‘কল্পবাস’ করি। আমার মন কিন্তু ‘কাশী কাশী’ করিয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছে এবং আপনাকে দেখিবার জন্য মন অতি চঞ্চল। দুই-চারি দিবসের মধ্যে ইঁহাদের নির্বন্ধাতিশয় এড়াইয়া যাহাতে বারাণসীপুরপতির পবিত্র রাজ্যে উপস্থিত হইতে পারি—তাহার বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। অচ্যুতানন্দ সরস্বতী নামক আমার কোন গুরুভ্রাতা সন্ন্যাসী যদি আপনার নিকটে আমার তত্ত্ব লইতে যান, বলিবেন যে শীঘ্রই আমি কাশী যাইতেছি। তিনি অতি সজ্জন এবং পণ্ডিত লোক, তাঁহাকে বাধ্য হইয়া বাঁকীপুরে ফেলিয়া আসিয়াছি। রাখাল ও সুবোধ কি এখনও কাশীতে আছেন? এ বৎসর কুম্ভের মেলা হরিদ্বারে হইবে কি না, ইহার তথ্য লিখিয়া অনুগৃহীত করিবেন। কিমধিকমিতি।

অনেক স্থানে অনেক জ্ঞানী, ভক্ত, সাধু ও পণ্ডিত দেখিলাম, অনেকেই অত্যন্ত যত্ন করেন, কিন্তু ‘ভিন্নরুচির্হি লোকঃ’, আপনার সঙ্গে কেমন প্রাণের টান আছে—অত ভাল আর কোথাও লাগে না। দেখি কাশীনাথ কি করেন।

দাস
নরেন্দ্রনাথ

ঠিকানা—ডাক্তার গোবিন্দচন্দ্র বসুর বাটী, চক, এলাহাবাদ।