নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল। আকাশ নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিন। নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ কী মনে করে সে নিজেকে কোনোমতে টেনে জানালার ওপর উঠে বসে।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, নিকি, তুমি ঠিক কী করতে চাইছ?
বাইরে যাব।
মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে যায় না। মানুষ দরজা খুলে বাইরে যায়।
জানালা দিয়ে বাইরে গেলে কী হয়?
কিছু হয় না। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে যেতে হলে তোমাকে লাফিয়ে নামতে হবে। দরজা খুলে বের হতে হলে তুমি হেঁটে হেঁটে বের হতে পারবে।
নিকি তার দাঁতগুলো বের করে হাসল, বলল, কিন্তু আমি হেঁটে বের হতে চাই না। আমি লাফিয়ে বের হতে চাই। আমার লাফাতে খুব ভালো লাগে।
আমি সেটি লক্ষ করেছি। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই তুমি লাফাতে পছন্দ করো।
আমি এখনো মিক্কুর মতো লাফাতে পারি না।
তুমি কখনোই মিরুর মতো লাফাতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর আর তুমি মানুষ।
নিকি একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও যদি বানর হতাম তাহলে খুব মজা হতো, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি চাপ অনুভব করে। চাপটি কমিয়ে সে বলল, না। তুমি বানর হলে বেশি মজা হতো না।
নিকি মাথা নেড়ে বলল, হতো।
হতো না।
কেন হতো না?
কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা বানরের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি। যার বুদ্ধিমত্তা যতো বেশি সেততো বেশি উপায়ে মজা করতে পারে।
নিকি মুখ সুচালো করে কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইলতারপর জিজ্ঞেস করল, বুদ্ধিমত্তা কী?
তোমার চারপাশে যা কিছু আছে সেটি দেখে বোঝার ক্ষমতা এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই।
কে বলেছে নেই?
আমি জানি।
কেমন করে জান?
এই যে তুমি কঠিন কঠিন জিনিম বলেছ আমি সেগুলো করতে পারিনা।
বুঝিনা।
তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে।
আমি বুঝতে চাইনা।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি মিষ্ণুর সাথে এক গাছ থেকে আরেকাছে লাফ দিতে চাই।
যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের শুধু এক গাছ থেকে আরেকাছে মাফ দিয়ে জীবন কাটাতে হয়না। তাদের আরো বড় কাজ করতে হয়।
নিকি কিছুক্ষন চিন্তা করল, তারপর বলন, জমির বুদ্ধিমত্তা ভালো লাগে।
না।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি ক্রিনিটির দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে ক্রিনিটি বলল, নিকি।
বল।
তুমি ঘরের বাইরে যাচ্ছ কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই।
আজকে অনেক সুন্দর রোদ। বাইরে ঠাণ্ডা নেই তাই আমার কাপড় পরারও কোনো দরকার নেই।
ক্রিনিটি কৃত্রিমভাবে তার গলার স্বরটি একটুখানি গভীর এবং থমথমে করে নিয়ে বলল, মানুষ শুধুমাত্র শীত থেকে বাঁচার জন্যে কাপড় পরে না। মানুষ হচ্ছে একটি সভ্য প্রাণী। মানুষকে সবসময় কাপড় পরতে হয়।
নিকি বলল, কিন্তু মিক্কু তো কাপড় পরে না।
মিক্কু মোটেও সভ্য প্রাণী নয়। মিক্ক একটি বানর। কিকি কাপড় পরে না! কিকি একটি পাখি।
নিকির চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি কোনো কাপড় পর না।
আমি একটি যন্ত্র। যন্ত্রদের কাপড় পরতে হয় না। তুমি মানুষ তোমাকে কাপড় পরতে হবে। সবসময় অন্ততপক্ষে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডেকে একটি কাপড় পরতে হবে।
নিকি যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে না পেরে অন্যপথে গেল। মুখ শক্ত করে বলল, আমি মানুষ হতে চাই না।
ক্রিনিটি বলল, না চাইলেও কিছু করার নেই, তুমি এখন অন্য কিছু হতে পারবে না। তোমাকে মানুষ হয়েই থাকতে হবে।
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, কেন মানুষ হলে কাপড় পরতে হবে?
মানুষ সভ্য প্রাণী। যখন তোমার সাথে অন্য মানুষের দেখা হবে তখন তোমার শরীরে কাপড় না থাকলে তারা তোমাকে অসভ্য ভাববে।।
নিকি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। যদি আমার সাথে কখনো অন্য মানুষের দেখা হয় তখন আমি দৌড় দিয়ে কাপড় পরে নেব।
ক্রিনিটি বলল, না। কাপড় পরা একটি অভ্যাসের ব্যাপার। যার সেই অভ্যাস নেই সে কখনো দৌড়ে কাপড় পরতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জান?
কী?
মানুষের সাথে কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক তোমাকে কাপড় পরে থাকতে হবে।
নিকি মুখ গোঁজ করে বলল, কেন?
তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমাকে দেখে শুনে রেখে বড় করি। সেজন্যে আমার তোমাকে ঠিক করে বড় করতে হবে। সভ্য মানুষের মতো বড় করতে হবে।
নিকি এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মা-কে সে খুব ভালোবাসে। ক্রিনিটির কাছে তার মায়ের যে হলোগ্রাফিক ছবি আছে সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকবার সে তার মা-কে ধরতে গিয়ে দেখেছে সেটি সত্যি নয়। তার খুব ইচ্ছে করে একদিন সে ধরতে গিয়ে দেখবে সেটি সত্যি তখন তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। ক্রিনিটি তাকে বলেছে যে এটি কখনো হবে না, তবুও সে আশা করে আছে যে কোনো একদিন হয়তো এটি হয়ে যাবে।
নিকি ঘরের ভেতর ফিরে গেলো, এক টুকরো কাপড় নিয়ে সেটি তার। কোমরে বেঁধে নিল, তারপর ক্রিনিটিকে বলল, এখন আমি বাইরে যাই?
যাও।
নিকি দরজা খুলে বাইরে যেতেই কক কক শব্দ করে একটি পাখি তার দিকে উড়ে আসে, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে সেটি তার ঘাড়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। নিকি তার হাতটি বাড়িয়ে দিতেই পাখিটি সেখানে বসে নিকির দিকে তাকিয়ে আবার কক কক শব্দ করে ডাকল। নিকি পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি মোটেও দেরি করতে চাইনি। ক্রিনিটি আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছে।
পাখিটির গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখ দুটি লাল, সে ডানা ঝাঁপটিয়ে আবার কক কক শব্দ করল। নিকি বলল, উঁহু। ক্রিনিটি মোটেও দুই নয়। ক্রিনিটি হচ্ছে রোবট! রোবটেরা অন্যরকম হয়।
কিকি নিকির কথা বুঝে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে আবার শব্দ করে আকাশে উড়ে গেল, নিকি তখন তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। এটি তাদের একরকম খেলা, প্রতিদিনই সে কিকির পেছনে পেছনে ছুটে যায়, সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। দিনের শেষে কিকি তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
কিকির পেছনে পেছনে ছুটে ছুটে নিকি বনের ভেতর একটি হৃদের তীরে এসে দাঁড়াল। সেখানে অনেকগুলো বুনো পশু পানি খাচ্ছে, নিকিকে একনজর। দেখে তারা আবার পানি খেতে থাকে।
একটি বড় ঝাপড়া গাছের ডালে হঠাৎ একটি হুঁটোপুটি শোনা যায় সেদিকে না তাকিয়েই নিকি বুঝতে পারে এটি মিকু, ছোট একটি বানরের বাচ্চা, তার সাথে খেলতে এসেছে। নিকি ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, আর মিক্কু গাছের উপর থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়ল, তাল সামলাতে না। পেরে নিকি নিচে পড়ে যায়, মিক্কু তখন তার শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে। নিকি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে হি হি করে হাসতে থাকে আর মিক্কু তখন নিকিকে ঘিরে লাফাতে থাকে। নিকি মিক্কুর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, মিকু, তোমার বুদ্ধিমত্তা আছে?
মিক্কু কিচিমিচি শব্দ করে একটি লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসে তারপর সেখান থেকে নেমে তার কাপড়টা টানতে থাকে। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। এই কাপড়টা খোলা যাবে না। আমার মা বলেছে আমাকে সবসময় কাপড় পরে থাকতে হবে।
মিকু কথাটা বোঝার মতো ভঙ্গি করল, নিকি তখন মিক্কুকে কাছে টেনে এনে বলল, তুমি বানর। আমি মানুষ। বানরের বুদ্ধিমত্তা নেই। মানুষের আছে। বুদ্ধিবৃত্তি কী জান?
মিকু মাথা নাড়ল। নিকি বলল, আমিও জানি না। ক্রিনিটি আমাকে বলেছে আমি বুঝিনি। তুমিও বুঝবে না। বোঝার দরকার নেই। চল আমরা খেলি।
মিকু কথাটা বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করে, তার পিছু পিছু নিকি। ছুটতে ছুটতে তারা বালুবেলায় আছড়ে পড়ে, গড়াগড়ি খেতে থাকে। তাদের মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি উড়তে থাকে, কিচিমিচি শব্দ করে তারা নিকির আশপাশে নেমে এসে খেলায় যোগ দেয়। নিকি হাত বাড়িয়ে পাখিগুলো ধরার চেষ্টা করে—একটি-দুটি ধরা দেয় অন্যগুলো সরে গিয়ে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
বেলা গড়িয়ে এলে নিকি নরম বালুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে পরম শান্তিতে বালুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাছাকাছি একটি গাছে বসে কিকি তার দিকে নজর রাখে, একটু দূরে একটি গাছে মিক্কু পা দুলিয়ে বসে থাকে।
ঠিক তখন নিঃশব্দে একটি চিতাবাঘ হেঁটে হেঁটে আসে। হ্রদের পানিতে পা ভিজিয়ে সে চুক চুক করে পানি খায়। তাকে দেখে হরিণের পাল সরে গেল, বুনো পাখিরা কর্কশ শব্দ করে উড়ে গেল।
চিতাবাঘটি মাথা তুলে তাকাল, একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ করে নিকিকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সেটি সতর্ক পদক্ষেপে নিকির দিকে এগুতে থাকে। কাছাকাছি এসে সেটি খুঁড়ি মেরে বসে তারপর বিদ্যুৎগতিতে। নিকির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাছের ডালে বসে থাকা কিকি আর মিক্কু তার স্বরে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
নিকি চমকে উঠে চিতাবাঘটির দিকে তাকাল এবং মুহূর্তে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু! দুষ্টু চিতা! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন?
চিতাবাঘটি মুখ দিয়ে ঠেলে নিকিকে নিচে ফেলে দিয়ে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিকি উঠে দাঁড়িয়ে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষে বলল, কোথায় ছিলে তুমি? কোথায়?
চিতাবাঘটি তার বুকের ভেতর থেকে ঘরঘর করে শব্দ করে, বন্ধুর সাথে। ভাব বিনিময়ের গভীর ভালোবাসার একধরনের শব্দ।
ক্রিনিটি নিকির প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, তোমার এখন বাড়ন্ত শরীর। এখন তোমাকে খুব হিসেব করে খেতে হবে। মানুষের শরীর তো আর যন্ত্র নয় যে একটি ব্যাটারি লাগিয়ে দিলাম আর সেটি চলতে থাকল। মানুষকে খেতে হয় খুব হিসেব করে।
নিকি এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে স্যুপে ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল, হিসেব করে না খেলে কী হয়?
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। শরীরে রোগজীবাণু বাসা বাঁধে।
তুমি বলেছ আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। সেই জন্যে সবাই মরে গেছে কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। সেটি সত্যি। কিন্তু রোগজীবাণুর কী শেষ আছে। পৃথিবীতে কত রকম রোগজীবাণু আছে তুমি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, না জানি না। জানতেও চাই না।
না জানলে হবে না। মানুষকে সবকিছু জানতে হয়।
আমি তোমাকে বলেছি আমি মোটেও মানুষ হতে চাই না?
না চাইলেও লাভ নেই। তোমার মানুষ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ক্রিনিটি তার প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, এইটুকু শেষ করে ফেল। তাহলে তোমার খাওয়াটা সঠিক হবে।
নিকি খাবারগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ঠিক আছে, আমি খেতে পারি কিন্তু একশর্তে।
কী শর্ত? তুমি আমাকে আজকে গণিত পড়াতে পারবে না।
তুমি এখন বড় হচ্ছ। প্রতিদিন তোমাকে কিছু না কিছু পড়তে হবে। মানুষকে অনেক কিছু জানতে হয়।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না ক্রিনিটি আমি আজকে কিছু পড়তে চাই না।
তাহলে কী করতে চাও?
নিকি লাজুক মুখে বলল, আমি আমার মা-কে দেখতে চাই।
ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
একটু পরেই দেখা গেল নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে, সামনের শূন্য জায়গাটিতে তার মা কথা বলছেন। হলোগ্রাফিক ছবি, দেখে মনে হয়। জীবন্ত কিন্তু নিকি জানে এটি জীবন্ত নয়। সে অনেকবার তার মা-কে ধরার। চেষ্টা করেছে, ধরতে পারেনি। যতবার ধরতে গিয়েছে দেখেছে সেখানে কিছু নেই।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তাকে একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিড়ারের সামনে বসে। মাদুলিটির ভেতর থেকে ছোট ক্রিস্টালটা বের করে সে ক্রিস্টাল রিডারের ভেতর ঢুকিয়ে সেদিকে তাকায়। আজ সারাদিন নিকি কী কী করেছে সব এখানে রেকর্ড করা আছে।
ক্রিনিটি খানিকক্ষণ দৃশ্যগুলো দেখে তারপর ছোট একটি মাইক্রোফোন কাছে টেনে এনে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। রোবটের একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে ক্রিনিটি বলে, আমি ক্রিনিটি। নিকি নামের মানবশিশুটির দায়িত্বে আছি। আমার দৈনন্দিন দায়িত্ব হিসেবে আজকের দিনের ঘটনাগুলো ভিডি মাধ্যমে উপস্থাপন করছি।
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার পক্ষে এই দায়িত্ব নেয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে আমি দায়িত্বটি নিতে বাধ্য। হয়েছিলাম। আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা আমি সেটি এখনো জানি না। নিকির মা আমাকে বলেছিল আমি যেন ভালোবাসা দিয়ে নিকিকে বড় করি। আমি তৃতীয়। মাত্রার রোবট, ভালোবাসা বিষয়টি কী আমি জানি না। একজন মা যখন তার সন্তানের সাথে কথা বলার সময় কিছু অর্থহীন শব্দ করে, কিছু অর্থহীন কাজকর্ম করে সেগুলো সম্ভবত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমি সেই শব্দগুলো উচ্চারণ এবং সেই কাজকর্মগুলো করার চেষ্টা করে দেখেছি সেগুলো প্রকৃত অর্থেই অর্থহীন এবং হাস্যকর কাজকর্মে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমি সেই বিষয়টি পরিত্যাগ করেছি।
আমার মনে হয়েছে আশপাশে কোনো মানুষ না থাকলেও অনেক পশুপাখি আছে এবং সেইসব পশুপাখিদের মাঝে একধরনের ভালোবাসা। আছে। মানুষ অনেক সময়ই পশুপাখিকে পোষ মানিয়েছে এবং তাদের সাথে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আমি খুব সতর্কভাবে নিকির সাথে কিছু পশুপাখির সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কাজটি আমাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়েছে, প্রয়োজনে যেন তাকে ঘিরে একটি শক্তি বলয় তৈরি হয় এবং কোনো পশু যেন তার ক্ষতি করতে না পারে, গোড়াতে আমি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও নিকির প্রাণের ওপর কোনো ঝুঁকি আনিনি। এখনও আমি তাকে সতর্কভাবে রক্ষা করি। তার গলার মাদুলিটি একটি শক্তিশালী ট্রাকিওশান। মূল তথ্য কেন্দ্রের সাথে এটি যোগাযোগ রাখে এবং তাকে রক্ষা করে।
বনের কিছু পশুপাখির সাথে নিকির একধরনের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছে এবং আমার ধারণা নিকি ভালোবাসা গ্রহণ করতে এবং প্রদান। করতে শিখেছে। নিকির মা আমাকে প্রথম যে দায়িত্বটি দিয়েছিল আমি সেটি পালন করতে পেরেছি।
নিকির মায়ের দ্বিতীয় দায়িত্বটি অনেক কঠিন। সারা পৃথিবী খুঁজে আমার দেখতে হবে আর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে গিয়েছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তাহলে তার কাছে নিকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি সে জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এখন তার বয়স মাত্র সাত বছর কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা দশ থেকে বারো বছরের বালকের মতো। তাই তাকে নিয়ে আমি বের হতে পারি। আমার ধারণা নিকি এখন এই ব্যাপারটির মুখোমুখি হতে পারবে।
ভূমিকা পর্ব শেষ হয়েছে। আমি এখন আজকের সারাদিনের সংক্ষিপ্ত দিনলিপি সংরক্ষণ করতে চাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর নিকি শরীরে কাপড় রাখা নিয়ে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে। বিষয়টিকে আমার গুরুত্ব নিয়ে দেখতে হয়…
ক্রিনিটি তার একঘেয়ে যান্ত্রিক গলায় দিনলিপিটি সংরক্ষণ করে যায়। নিকির মা মারা যাবার পর থেকে প্রতিদিন সে এটি করে আসছে।