০২. নামহীন গ্রহ

নামহীন গ্রহ

লাইনা চোখ খুলে দেখতে পায় তার মাথার কাছে চতুষ্কোণ স্বচ্ছ একটা নীল আলো। এই আলোটা সে আগেও কোথাও দেখেছে কিন্তু কোথায় দেখেছে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। তার চেতনা এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়, সে নিদ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের অবস্থায় থেকে আবার ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে জাগিয়ে তোলে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চোখ খোলা রেখে লাইনা মনে করার চেষ্টা করে সে কে, কোথায় শুয়ে আছে এবং কেন তার জেগে ওঠা উচিত। উপরের নীল আলোটা সে আগে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করতে করতে তার চেতনা আরেকটু সজীব হয়। তখন সে এক ধরনের কম্পন অনুভব করে, কান পেতে সে চাপা একটা গুমগুম শব্দ শুনতে পায়। এই শব্দটিও সে আগে কোথাও শুনেছে কিন্তু এখন কিছুতেই মনে করতে পারে না।

লাইনা চোখ খুলে নিজেকে দেখার চেষ্টা করে। তার দুই হাত উপাসনার ভঙ্গিতে ভাজ করা। সমস্ত শরীর অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের নিও পলিমার দিয়ে ঢাকা। ডান হাতটা একটু উপরে তুলতেই সে দেখতে পায়, তার কজিতে একটা সেন্সর লাগানো। তখন হঠাৎ করে তার সব মনে পড়ে যায়।

সে লাইনা, একজন মহাকাশচারী মহাবিশ্বে নতুন বসতি খোজার জন্যে সে এবং আরো তিরিশ জন মহাকাশচারী মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিল। প্রথম দুই বছর পার হওয়ার পর তারা একে একে সবাই শীতলঘরে ঘুমিয়ে গেছে। কতদিন পার হয়েছে তারপর? সে এখন জেগে উঠেছে কেন? তার অর্থ কি মানুষের বাস করার উপযোগী একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে? এখন কি সেই গ্রহে নামবে তারা?

এক ধরনের উত্তেজনায় লাইনার বুকে হঠাৎ রক্ত ছলাৎ করে ওঠে। ঘুম ভেঙে পরিপূর্ণভাবে জেগে উঠেছে সে। উপরের হালকা নীল আলোটিও তখন চিনতে পারল সে— একটি মনিটর। তার শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অংশের খুঁটিনাটি তথ্য দেখাচ্ছে সেখানে। তার রক্তচাপ, তার তাপমাত্রা, তার শ্বাসযন্ত্র, পরিপাকতন্ত্রের অবস্থা, তার মস্তিকের কম্পন। উপরে ডান দিকে আজকের তারিখটি জ্বলছে এবং নিভছে। কী আশ্চর্য! এর মাঝে পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে? পঞ্চাশ বছর? অর্ধ শতাব্দী? সে গত অর্ধ শতাব্দী থেকে এই শীতলঘরে ঘুমিয়ে আছে? পৃথিবীতে সে তার যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়পরিজনকে রেখে এসেছে তারা এখন বার্ধক্যে জরাগ্রস্ত? বুকের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে লাইনা। সে আবার নীল স্ক্রিনটার দিকে তাকাল, তার শরীর দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠছে। শীতল গ্রহে সমস্ত জৈবিক প্রক্রিয়া স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাই তার কাছে গত অর্ধ শতাব্দী কয়েক ঘণ্টার বেশি মনে হওয়ার কথা নয়। নীল স্ক্রিনটায় তাই দেখাচ্ছে। সে ইচ্ছে করলে এখন উঠে দাঁড়াতে পারে, উপরের ঢাকনা খুলে বের হতে পারে। কিন্তু তবু সে উপাসনার ভঙ্গিতে দুই হাত বুকের উপরে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল।

মহাকাশযানের শক্তিশালী ইঞ্জিনের গুমগুম শব্দটি সে কান পেতে শুনতে থাকে। শব্দটি অনেকটা হৃৎস্পন্দনের মতো। শব্দটি সবাইকে মনে করিয়ে দেয় মহাকাশযানটি বেঁচে আছে, মহাকাশচারীরা বেঁচে আছে, সব কম্পিউটার বেঁচে আছে, মহাকাশযানের ক্রায়োজেনিক ঘরে মানুষের তিন সহস্র ভ্রণ বেঁচে আছে, বৃক্ষ লতাপাতার বীজ, পশুর শুক্রাণু বেঁচে আছে। মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে তারা একটি দায়িত্ব নিয়ে মহাবিশ্বে পাড়ি দিয়েছে। কে জানে হয়তো সেই দীর্ঘ অভিযান এখন সমাপ্ত হয়েছে। লাইনা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, লক্ষ্মী মেয়ে লাইনা, তুমি ওঠ। তোমার এখন নতুন জীবন শুরু হবে।

লাইনা উঠে বসতেই ঢাকনাটা শব্দ করে খুলে গেল। পাশাপাশি অনেকগুলো ক্যাপসুল। সবগুলোর ওপর একটি করে সবুজ আলো। আস্তে আস্তে জ্বলছে এবং নিভছে। এক জন এক জন করে সবাই উঠবে এখন। সবচেয়ে আগে উঠছে মহাকাশযানের দলপতি কিরি। তারপর সে। সেরকমই কথা ছিল।

ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রেখে উঠে দাঁড়াল সে। তার নিরাভরণ সুঠাম দেহের উপর সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ একটি নিও পলিমারের কাপড়। কপালের দুই পাশ থেকে দুটি সেন্সর খুলে সে একটু এগিয়ে যায়। ঘরের দেয়ালে উঁচু আয়না, একটু সামনে যেতেই সেখানে নিজের প্রতিবিম্বের উপর চোখ পড়ল তার। না, গত অর্ধ শতাব্দীর কোনো চিহ্ন নেই তার শরীরে। কুচকুচে কালো চুল মাথার উপর বাধা, হাত দিয়ে খুলে দিতেই ঢেউয়ের মতো নিচে নেমে এল। সে আয়নায় আবার নিজের দিকে তাকাল। কোমল মসৃণ ত্বক ভরাট ঠোঁট, উজ্জ্বল কালো চোখ, সেই চোখে স্বচ্ছ ছবি। সূক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে তার সুগঠিত বুক, সুঠাম সজীব দেহ।

লাইনা সামনে এগিয়ে যায়। দেয়ালে তার নাম লেখা বোতামটি স্পর্শ করতেই ঘরঘর শব্দ করে একটা দরজা খুলে গেল। তার ঘরে গিয়ে এখন তাকে প্রস্তুত হতে হবে। কন্ট্রোলরুমে কিরি নিশ্চয় তার জন্যে অপেক্ষা করছে এখন।

 

২.

সমস্ত মহাকাশযানে কন্ট্রোলরুমটি সবচেয়ে বড়। উপর থেকে হালকা একটা আলোতে ঘরটি আলোকিত রাখা হয়। দেয়ালের চারপাশে বড় বড় স্ক্রিনে নানা ধরনের ছবি। ঘরের ঠিক মাঝখানে মহাকাশযানের মূল নিয়ন্ত্রণ। তার ঠিক সামনে একটি নরম চেয়ারে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে কিরি বসে আছে। তার পা দুটি সে তুলে দিয়েছে কন্ট্রোল প্যানেলের উপর। লাইনা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই শব্দ শুনে কিরি তার দিকে ঘুরে তাকাল। তার কোমল মুখটি সাথে সাথে এক ধরনের সহৃদয় হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্যানেল থেকে পা নামিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কিরির দীর্ঘ ঋজু দেহ। কপালের দুই পাশে চুলে একটু রুপালি রং ছাড়া সারা দেহে বয়সের কোনো চিহ্ন নেই। হাত বাড়িয়ে বলল, এস, লাইনা এস। ভালো ঘুম হয়েছে। তোমার?

হ্যাঁ। কেউ যদি একটানা পঞ্চাশ বছর ঘুমিয়ে থাকে সেটাকে ভালো না বললে কোনটাকে ভালো বলবে?

তা তো বটেই।

তুমি কখন উঠেছ?

কিরি লাইনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর তোমাকে দেখাচ্ছে লাইনা! এত সুন্দরী একটা মেয়েকে মহাকাশযানের মতো ছোট একটা জায়গায় রাখা ঠিক নয়। সৌন্দর্যের অপচয় হয় এতে। এই সৌন্দর্য আরো অনেক বেশি মানুষের জন্যে।

লাইনা মাথা নেড়ে বলল, তুমি দলপতি হয়ে মহাকাশযানের নীতিমালার একটা আইন ভঙ্গ করলে। মহাকাশযানের পুরুষ ও মহিলাকে আলাদা করে দেখার নিয়ম নেই।

কিরি মাথা নেড়ে বলল, মনে থাকে না লাইনা! তোমাকে দেখলে আরো বেশি গোলমাল হয়ে যায়।

লাইনা কিরির স্তুতিবাক্যটি গায়ে মাখল না। হেঁটে নিজের ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। গত পঞ্চাশ বছর এখানে কেউ বসে নি কিন্তু কোথাও সেই চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয়, মাত্র গত রাত্রিতে সে এখান থেকে উঠে গেছে। নরম চেয়ারটিতে বসে সে নিজের যোগাযোগ মডিউলের বোতামটি চেপে ধরে বলল, মহাকাশযানের কী খবর কিরি? আমরা কি থামছি কোথাও?

হ্যাঁ।

কোথায়?

সাত দশমিক তিন চার অবলিক আট দশমিক নয়…

লাইনা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক, আর বলতে হবে না।

কিরি হেসে বলল, আমরা গিনিস ক্ষেত্রে একটা গ্রহে নামছি লাইনা।

গ্রহটির কী নাম?

এর কোনো নাম নেই লাইনা। শুধু পরিচয়। সংখ্যা দিয়ে পরিচয়।

কী আশ্চর্য! আমরা নামহীন একটা গ্রহে নামছি?

হ্যাঁ। মহাজাগতিক সময়ে মেলা বছর আগে এখানে আরেকটি মহাকাশযান নামার চেষ্টা করেছিল। নামতে পারে নি।

লাইনা শঙ্কিত মুখে বলল, কেন পারে নি?

মহাকাশযানের জ্বালানি নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। একটি নক্ষত্রের মহাকর্ষ বল থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন এই গ্রহটি তারা দেখতে পায়। গ্রহটির সাথে পৃথিবীর অনেক মিল, মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত না হলে মহাকাশচারীদের বেঁচে যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।

পৃথিবীর সাথে মিল?

হ্যাঁ। কিরি তার সামনে একটা সুইচ স্পর্শ করতেই দেয়ালের বিশাল স্ক্রিনে একটা গ্রহের ছবি ফুটে ওঠে। কিরি সেটাকে আরো স্পষ্ট করতে করতে বলল, গ্ৰহটার সাথে পৃথিবীর মিল খুব বিস্ময়কর। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ, প্রাণের বিকাশ

প্রাণের বিকাশ?

হ্যাঁ। কিরি হাসিমুখে বলল, এই গ্রহটায় প্রাণের বিকাশ হয়েছে। যতদূর মনে হয় এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।

লাইনা তার চেয়ার থেকে উঠে দেয়ালে স্ক্রিনটার কাছাকাছি এগিয়ে যায়। ধূসর গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তাপমাত্রা কত? জলীয় বাষ্পের পরিমাণ?

গ্রহটির উত্তর ভাগে কিছু কিছু অংশে তাপমাত্রা পৃথিবীর কাছাকাছি। জলীয় বাষ্প কম বলতে পার, পৃথিবীর মরু অঞ্চলের মতো। এখনো ছবি নেয়া হচ্ছে, যেটুকু তথ্য আছে তাতে মনে হচ্ছে গ্রহটা দেখতে খুব খারাপ নয়। তাপমাত্রা আর জলীয় বাষ্প নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মনে হয় পৃথিবীর গাছপালা জন্ম দেয়া যাবে। মনে হয় চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। তবে–

তবে কী?

গ্রহটা দুটি নক্ষত্রের কাছাকাছি। কক্ষপথের কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে মাঝে মাঝে এটাকে দুই সূর্যের গ্রহ মনে হবে! চিন্তা করতে পার আকাশে একসাথে দুটি সূর্য?

তাপমাত্রা? তখন তাপমাত্রা কত হবে?

অসহ্য মনে হতে পারে, এখনো জানি না। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

লাইনা দীর্ঘ সময় গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নামহীন ধূসর একটি গ্রহ। কে জানে হয়তো এই গ্রহে সে তার জীবন কাটিয়ে দেবে। মানুষ তাদের পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। তেজস্ক্রিয় বাতাস, অনুর্বর প্রাণহীন মাটি, বিষাক্ত পানি। তাদেরকে বেঁচে থাকার জন্যে এখন অন্য কোনো গ্রহ খুঁজে বের করার কথা ভাবতে হচ্ছে। বাইরে বসতি স্থাপন করার দায়িত্ব নিয়ে গত শতাব্দীতে যে অসংখ্য মহাকাশযান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মহাকাশযানটি ঠিক সেরকম একটি মহাকাশযান। তারা কি সত্যি খুঁজে বের করতে পারে একটি গ্রহ, যেখানে পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে তাদের জীবন শুরু করতে পারবে? লাইনা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলল, তার বিশ্বাস হয় না।

যোগাযোগ মডিউলে চাপা একটি শব্দ শুনে লাইনা সেদিকে এগিয়ে যায়। মহাকাশযানের দ্বিতীয় দলনেত্রী হিসেবে তার পত্বি অনেক। সে দ্রুত অভ্যস্ত হাতে মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারে কিছু সংখ্যা প্রকাশ করায়, কাছাকাছি মাইক্রোফোনে নিচু গলায় কথা বলে। স্ক্রিনের ছবিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করে যোগাযোেগ ব্যবস্থা চালু করে দেয়। ধীরে ধীরে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে মহাকাশধানের তথ্য ফুটে উঠতে থাকে। গত পঞ্চাশ বছরে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে নি। ক্রায়োজেনিক ঘরে তিন সহস্র মানুষের জ্বণ, পশুর শুক্রাণু, ডিম্বাণু, কয়েক লক্ষ গাছের বীজ, জীবিত প্রাণীর ক্লোন তৈরি করার প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের কম্পিউটার, রবোট, নির্ভুল নিয়ন্ত্রণবিধি সবকিছু ঠিক ঠিক আছে। লাইনা মহাকাশযানের জ্বালানির পরিমাণ, যন্ত্রপাতির অবস্থা দেখে সৌর ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ, তাদের নিজেদের রসদ, বাতাসে অক্সিজেন পরীক্ষা করে পৃথিবীর খবর নেয়ার জন্যে নির্দিষ্ট মডিউলটি চালু করে দেয়।

লাইনা, তুমি সত্যিই পৃথিবীর কথা জানতে চাও?

লাইনা একটু অবাক হয়ে পিছনে তাকাল। কিরি নিঃশব্দে হাঁটতে পারে, কখন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কে জানে।

কিরি আবার বলল, সত্যি জানতে চাও?

হ্যাঁ।

কেন লাইনা? খবর জেনে তো শুধু মন খারাপই হয় লাইনা।

কিন্তু কী করব বল?

মানুষ কেমন করে এটা করল লাইনা? বাতাসে তেজস্ক্রিয়তা। মহাদেশের পর মহাদেশ রুক্ষ প্রাণহীন মরুভূমি। নদী হ্রদ সমুদ্র মহাসমুদ্রে বিষাক্ত কেমিক্যাল। মানুষ বেঁচে আছে মাটির নিচে। রোগ শোক মহামারী। বিভীষিকা। বিশ্বাস হয় লাইনা?

লাইনা মাথা নাড়ল, না, হয় না।

মানুষ কেমন করে নিজের অস্তিত্বে নিজে আঘাত করে? আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি লাইনা। তোমরা, মানুষেরা গত পঞ্চাশ বছর যখন শীতলঘরে ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। আমি এই চেয়ারে গত পঞ্চাশ বছর চুপ করে বসে ছিলাম–

কী বললে? লাইনা চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি?

হ্যাঁ লাইনা, তোমরা কেউ জান না। আমি মানুষ নই লাইনা। আমি একজন রবোট। দশম প্রজাতির রবোর্ট।

রবোট? তুমি রবোট?

হ্যাঁ লাইনা।

লাইন বিস্ফারিত চোখে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই হৃদয়বান বুদ্ধিদীপ্ত দর্শন মানুষটি একটি রবোট? তার বিশ্বাস হয় না। মাথা নেড়ে বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিরি।

কিরি লাইনার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে আর হঠাৎ সে অবাক হয়ে দেখে, কিরির চোখ দুটি সবুজাভ হয়ে আসে, আর সেখান থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো বের হয়ে আসে। লাইনার এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে, শক্ত করে চেয়ারটি ধরে বলল, না কিরি, না। না।

কিরির চোখ দুটি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল, আবার সেই চোখে সহৃদয় একটি হাসিখুশি মানুষ উঁকি দিতে থাকে।

লাইনা অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি মানুষ নও! তুমি রবোট!

কিরি নরম গলায় বলল, তোমার কি আশাভঙ্গ হল তাইনা?

লাইনা মাথা নিচু করে বলল, আমি জানি কিরি।

মনে হয় হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে একটা জিনিস বলি। আমি দশম প্রজাতির রবোট। সব মিলিয়ে আমার মতো রবোর্ট রয়েছে দশ কি বারটি। আমাদের সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। এই মহাকাশযানের দলপতি একজন মানুষকে না করে একজন রবোটকে করা হয়েছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে।

হ্যাঁ। লাইনা মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

সেই কারণটা কী?

আমি জানি না।

গত পঞ্চাশ বছর তোমরা সবাই যখন শীতলঘরে বসে ছিলে তখন আমি সেটা নিয়ে ভেবেছি। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ সময়। মানুষের জন্যে দীর্ঘ, আমার জন্যেও দীর্ঘ। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি এই প্রশ্নের একটা উত্তর খুঁজে পেয়েছি।

সেটা কী?

একজন মানুষ খুব সহজে নিজেকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে হয়তো করে না কিন্তু তার খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমি সেটা করব না। আমি কখনো মানুষকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাব না।

কিন্তু তুমি একটু আগে বলেছ তুমি মানুষের মতো।

হ্যাঁ।

মানুষের যেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে তোমারও সেরকম দুঃখ কষ্ট হাসি কান্না আছে?

আছে। ঈর্ষা আছে? হিংসা আছে? ক্রোধ? অপরাধবোধ? দম্ভ?

কিরিকে একটু বিচলিত দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি যতদূর জানি, আছে। কিন্তু সেইসব অনুভূতি প্রকাশ পাওয়ার একটা কারণ থাকতে হয়। সেরকম কারণ এখনো হয় নি। তাই আমি জানি না কত তীব্র আমার ঈর্ষা বা হিংসা, ক্রোধ বা দত্ত।

লাইনা চুপ করে থেকে বলল, যদি দেখা যায় সেটা ভয়ঙ্কর তীব্র? তুমি যদি হঠাৎ অমানুষ হয়ে যাও?

কিরি শব্দ করে হেসে ফেলল, তারপর বলল, না লাইনা, আমি কখনো অমানুষ হব না। রবোট অমানুষ হতে পারে না। শুধুমাত্র মানুষ অমানুষ হতে পারে।

কিরি হেঁটে হেঁটে ঘরের মাঝখানে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে আস্তে আস্তে বলল, আমি যে একজন রবোট সেটা আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। কথাটা গোপন রাখার কথা ছিল। কিন্তু আমি সেটা গোপন রাখি নি। আমি সেটা তোমাকে বলেছি। কেন বলেছি জান?

কেন?

আমি তোমাদের দলপতি হতে চাই না। মানুষের একটি দলের দলপতি হবে একজন মানুষ।

কিন্তু তুমি দশম প্রজাতির রবোট। দশম প্রজাতির একজন রবোট মানুষের এত কাছাকাছি যে, মানুষের সাথে তার কোনো পার্থক্য নেই। পৃথিবীর মানুষ যদি তোমাকে দলপতি করতে পারে আমি সেটা মেনে নিতে পারি। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। কিরি।

কিরি খানিকক্ষণ লাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ লাইনা। তুমি আমার বুক থেকে একটা পাথর সরিয়ে দিলে। নিজেকে মানুষের মাঝে লুকিয়ে রাখতে আমার খুব খারাপ লাগছিল। তোমাকে বলতে পেরে আমার বুকটা হালকা হয়ে গেছে।

 

০৩.

আঠার ঘণ্টা পর মহাকাশযানের মূল চতুরটুকুতে একটা আনন্দমুখর উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ঘুম ভেঙে তিরিশ জন মহাকাশচারী উঠে এসেছে। ভন্টে রাখা অনেকগুলো রবোটকে বের করে আনা হয়েছে। সবাই চেঁচামেচি করে কথা বলছে। চারদিকে খাবার এবং পানীয়ের ছড়াছড়ি। অর্থহীন কথাবার্তা, হাসি-তামাশা, হইহুল্লোড় দেখে মনে হতে পারে, এদের জীবনে সত্যিকারের কোনো সমস্যা নেই। মনে হয়, আনন্দমুখর একটি বিশাল পরিবারের সবাই বুঝি হঠাৎ করে একত্র হয়েছে।

হইচই যখন চরমে উঠেছে তখন কিরি একটা চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

কিরিকে একাধিকবার কথাটি উচ্চারণ করতে হল এবং শেষ পর্যন্ত সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে ঘুরে তাকাল। কিরি সবাইকে এক নজর দেখে বলল, তোমরা সবাই জান, আমরা আগামী কয়েক ঘণ্টার মাঝে এই গ্রহটিতে নামতে যাচ্ছি।

সবাই একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল। কিরি শব্দটাকে থেমে যাওয়ার সময় দিয়ে বলল, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ তথ্য রয়েছে সেটা দেখে মনে হয়, এই গ্রহটি মানুষের জন্যে চমৎকার একটা বসতি হতে পারে। নতুন একটা পৃথিবীর জন্ম দেব এখানে।

সবাই দ্বিতীয়বার একটা আনন্দধ্বনি করল, এবারে আগের থেকে জোরে এবং দীর্ঘস্থায়ী। কিরি হাসিমুখে বলল, আমি তোমাদের দলপতি। আমাকে যেরকম কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ঠিক সেরকম কিছু দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমি চেষ্টা করব আমার দায়িত্ব যতটুকু সম্ভব নিখুঁতভাবে পালন করতে। কিন্তু তার আগে আমি তোমাদেরকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।

টকটকে লাল রঙের পানীয়ের একটা গ্লাস হাতে নিয়ে লাইনা কিরির দিকে ঘুরে তাকাল। কী বলতে চায় কিরি?

কিরি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যদি এখন তোমাদের বলা হয়, আমি মানুষ নই, আমি একজন রবোট, তাহলে তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?

উপস্থিত সবাই চুপ করে যায়। কমবয়সী একজন তরুণ, লাল চুলের ক্রিকি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু তুমি তো মানুষ!

না, আমি মানুষ নই।

তুমি মানুষ নও?

না। এখানে লাইনা ছাড়া আর কেউ সেটা জানে না। লাইনা জানে, কারণ আমি তাকে গতকাল বলেছি। সে বিশ্বাস করতে চায় নি। তখন আমি তাকে প্রমাণ দেখিয়েছি।

সবাই ঘুরে লাইনার দিকে তাকাল, লাইনা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কিরি আবার বলল, আমি একজন রবোর্ট। দশম প্রজাতির রবোট।

সারা ঘরে হঠাৎ বিস্ময়ের ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। রিশা নামের সোনালি চুলের একটা মেয়ে কাঁপা গলায় বলল, দ-দ-দশম প্রজাতি?

হ্যাঁ।

তোমার কপোট্রন ক্লিও লিয়ামের? টেটরা রিজম?

হ্যাঁ, টেটরা রিজম।

নিউরাল নিক্সি?

হ্যাঁ।

এ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে মাত্র দশটি?

সঠিক সংখ্যাটি কেউ জানে না, তবে এর কাছাকাছি।

রিশা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জন্যে আমরা কেউ কখনো ধরতে পারি নি।

কী আশ্চর্য!

তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। বল, তোমরা কি আমার নেতৃত্ব মেনে নেবে?

মধ্যবয়স্ক ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সত্যি কথা বলতে কী, তোমার কথা শুনে আমার নিজের মাঝে এখন এক ধরনের হীনমন্যতা জন্মে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মানুষ না হয়ে একজন দশম প্রজাতির রবোট হয়ে জন্ম নিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।

ঘরে হালকা হাসির একটা শব্দ শোনা যায়। লাইনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিরি, তুমি মহাকাশযানের নীতিমালা লঙ্ন করছ। তোমার সাথে একজন মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। তুমি নিজে থেকে না বললে কেউ কোনোদিন এই জিনিসটি জানতে পারত না। তোমার এই তথ্যটি গোপন রাখার কথা ছিল। তুমি কেন বলেছ?

আমি সম্ভবত মানুষের খুব কাছাকাছি। মানুষের ভিতরে যেরকম অনুভূতি কাজ করে আমার ভিতরেও অনেকটা সেরকম অনুভূতি কাজ করে। গত পঞ্চাশ বছর তোমরা–মানুষেরা যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে ভেবে মনে হয় আমি আরো পরিণতবুদ্ধি মানুষে—কিংবা রবোটে পরিণত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, আমার তোমাদের জানিয়ে দেয়া প্রয়োজন আমি মানুষ নই, আমি রবোট।

সোনালি চুলের রিশা বলল, সেটা মনে হয় তুমি ভালোই করেছ—কিন্তু তোমাকে কি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে?

কী প্রশ্ন?

তুমি কি মানুষের মতো ভালবাসাবাসি করতে পার?

সারা ঘরে উচৈঃস্বরে একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। কিরি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রশ। তুমি যদি নিরিবিলি কখনো আমাকে এই প্রশ্ন কর, আমি তার উত্তর দেব। এখানে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। সেটি মহাকাশযানের নীতিমালায় ষষ্ঠ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হবে।

জীববিজ্ঞানী কুডিও বলল, তোমার কি খিদে পায়?

পায়।

তোমার কি কখনো বিশেষ খাবার খেতে ইচ্ছে করে? আমার যেরকম এখন ইচ্ছে করছে। দুটি বড় কলার মাঝখানে এই এতখানি কেক, তার উপরে ঘন করে ক্রিম

সবাই আবার হো হো করে হেসে ওঠে। কিরি বলল, হ্যাঁ, আমারও মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ খাবার খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি তোমাদের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছি। আমি জানতে চাই—

তোমার কি কখনো অসুখ করে? টেকনিশিয়ান রিও শব্দ করে নিজের নাক পরিষ্কার করে বলল, সর্দিকাশি? জ্বর?

হ্যাঁ। প্রচলিত কিছু ভাইরাস এবং রোগজীবাণু আমার শরীরে অসুখের মতো উপসর্গ তৈরি করতে পারে। আমি তোমাদের এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। এখন আমি যেটা জানতে চাই সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি জানতে চাই

কমবয়সী কিকি হাত তুলে বলল, একটা শেষ প্রশ্ন।

কী?

তোমার কখনো ঘুম পায় না?

পায়। মানুষের মতো আমার ঘুম পায়। এবং তোমরা দেখেছ আমি তোমাদের মতো ঘুমাই। বিশেষ প্রয়োজন হলে আমি দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে পারি। এবার যেরকম জেগেছিলাম।

তুমি যখন ঘুমাও তখন তুমি কি স্বপ্ন দেখ?

কিরি একটু হেসে বলল, আমি এখন এই প্রশ্নের উত্তর দেব না, কারণ তাহলে সাথে সাথে তোমরা এটা নিয়ে আরো এক শ-টি প্রশ্ন করবে। আগে তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি–

রিশা আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি কখনো প্রেমে পড়েছ?

সারা ঘরে হাসির শব্দ শোনা যায়। কিরি একটু বিষণ্ণ মুখে লাইনার দিকে তাকাল। লাইনা একটু হেসে বলল, কিরি, আমার ধারণা তুমি যে মানুষ নও, এবং তুমি যে একজন দশম প্রজাতির রবোট সেটা অনেক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তোমার সাথে আমাদের সবার যে সম্পর্ক তার কোনো পরিবর্তন হয় নি। তোমার নেতৃত্বে আমাদের পুরোপুরি আস্থা রয়েছে।

আমি যদি কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই, তোমাদের মানুষের কাছে সেটা যদি অযৌক্তিক বা কখনো অমানবিক মনে হয়, তোমরা কি সেটা মেনে নেবে?

কিরির গলায় কিছু একটা ছিল যার জন্যে সবাই একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। লাইনা মৃদুস্বরে বলল, তুমি কখনো কোনো অযৌক্তিক বা অমানবিক সিদ্ধান্ত নেবে না কিরি, আমার সেই বিশ্বাস আছে। কিন্তু যদি কখনো নাও, অন্যদের কথা জানি না, আমি কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেব।

সবাই মাথা নাড়ল। ইঞ্জিনিয়ার গ্রুসো এগিয়ে এসে বলল, সোজাসুজি বললে স্তুতিবাক্য হয়ে যায়, তবু বলছি। তুমি চমৎকার একজন মানুষ। খাটি মানুষ। তোমার নেতৃত্ব চমৎকার। আমরা চোখ বুজে মেনে নেব।

জীববিজ্ঞানী ক্লডিও বলল, সিদ্ধান্ত নিতে তুমি যদি কখনো ভুল কর, করবে। মানুষও ভুল করে। আমাদের কাছে সেটা যদি অযৌক্তিক মনে হয়, যদি অমানবিক মনে হয়, আমরা তখন প্রতিবাদ করব, চিৎকার করব, চেঁচামেচি করব। কিন্তু তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। কারণ তুমি আমাদেরই একজন। তোমার ভিতরে সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

সোনালি চুলের রিশা বলল, কখনো যদি বিয়ের কথা ভাব আমাকে জানিও, আমি এখনো কুমারী।

সারা ঘরে আবার হাসির শব্দ শোনা যায়।

 

০৪.

দুই ঘণ্টা পর মহাকাশযানটি নামহীন গ্রহটিতে অবতরণ করল কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই। মহাকাশযানটি অবতরণ করার জন্যে যে জায়গাটি বেছে নিয়েছিল তার থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযানের ইঞ্জিনঘরে সুহান তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তার পায়ের কাছে মূর্তির মতো বসেছিল ট্ৰিনি। স্থির চোখে তাকিয়েছিল সুহানের ঘুমন্ত মুখের দিকে। দেখে মনে হতে পারে বুঝি গভীর ভালবাসায়।

কিন্তু ট্ৰিনি দ্বিতীয় প্রজাতির রবোট। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় প্রজাতির রবোটের বুকে কোনো ভালবাসা নেই।