[লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা]
মানবজাতির ভাগ্যগঠনের জন্য যতগুলি শক্তি কার্য করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে, ঐ সকলের মধ্যে ধর্মরূপে অভিব্যক্ত শক্তি অপেক্ষা কোন শক্তি নিশ্চয়ই অধিকতর প্রভাবশালী নয়। সর্বপ্রকার সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পশ্চাতে কোথাও না কোথাও সেই অপূর্ব শক্তির কার্যকারিতা বিদ্যমান এবং সকল ব্যষ্টিমানবের মধ্যে সংহতির মহত্তম প্রেরণা এই শক্তি হইতেই উদ্ভূত। ইহা আমরা সকলেই স্পষ্টভাবে জানি যে, অগণিত ক্ষেত্রে ধর্মের বন্ধন—জাতি, জলবায়ু, এমন কি বংশের বন্ধন অপেক্ষাও দৃঢ়তর। ইহা সুবিদিত সত্য যে, যাহারা একই ঈশ্বরের উপাসক, একই ধর্মে বিশ্বাসী, তাহারা একই বংশজাত লোকদের, এমন কি ভ্রাতাদের অপেক্ষাও অধিকতর দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সহিত পরস্পরের সাহায্য করিয়াছে। ধর্মের উৎস আবিষ্কার করিবার জন্য বহু প্রকার চেষ্টা হইয়াছে। যে-সকল প্রাচীন ধর্ম বর্তমান কালাবধি টিকিয়া আছে, ঐগুলির এই একটি দাবী যে, তাহারা সকলেই অতিপ্রাকৃত; তাহাদের উৎপত্তি যেন মানুষের মস্তিষ্ক হইতে হয় নাই; বাহিরের কোন স্থান হইতে ধর্মগুলি আসিয়াছে।
আধুনিক পণ্ডিত সমাজে এ সম্বন্ধে দুইটি মতবাদ কিঞ্চিৎ স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে—একটি ধর্মের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব, অপরটি অনন্ত ঈশ্বরের ক্রমবিকাশ। একপক্ষ বলেন, পিতৃপুরুষদের উপাসনা হইতেই ধর্মীয় ধারণার আরম্ভ; অপর পক্ষ বলেন, প্রাকৃতিক শক্তিসমূহে মানবধর্মের আরোপ হইতেই ধর্মের সূচনা। মানুষ তাহার মৃত আত্মীয়স্বজনের স্মৃতিরক্ষা করিতে চায় এবং ভাবে যে, মৃত ব্যক্তিদের দেহনাশ হইলেও তাহারা জীবিত থাকে, এবং সেইজন্যই সে তাহাদের উদ্দেশে খাদ্যাদি উৎসর্গ করিতে এবং কতকটা তাহাদের পূজা করিতে ইচ্ছা করে। এই ধারণার পরিণতিই আমাদের নিকট ধর্ম নামে অভিহিত হইয়াছে।
মিশর, ব্যাবিলন ও চীনবাসীদের এবং আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের বহু জাতির প্রাচীন ধর্মসমূহ আলোচনা করিলে পিতৃপুরুষের পূজা হইতেই যে ধর্মের আরম্ভ, তাহার স্পষ্ট নিদর্শন আমরা দেখিতে পাই। প্রাচীন মিশরীয়দের আত্মা সম্বন্ধে সর্বপ্রথম ধারণা ছিল—প্রত্যেক দেহে তদনুরূপ আর একটি ‘দ্বিতীয়’ চেতন-সত্তা থাকে। প্রত্যেক মানুষের দেহে প্রায় তাহারই অনুরূপ আর একটি সত্তা থাকে; মানুষের মৃত্যু হইলে এই দ্বিতীয় সত্তা দেহ ছাড়িয়া যায়, অথচ তখনও সে বাঁচিয়া থাকে। যতদিন মৃতদেহ অটুট থাকে, শুধু ততদিনই এই দ্বিতীয় সত্তা বিদ্যমান থাকিতে পারে। সেইজন্যই এই দেহটাকে অক্ষত রাখিবার জন্য মিশরীয়দের এত আগ্রহ দেখিতে পাই। এইজন্যই তাহারা ঐ-সব সুবৃহৎ পিরামিড নির্মাণ করিয়া ঐগুলির মধ্যে মৃতদেহ রক্ষা করিত। কারণ তাহাদের ধারণা ছিল যে, মৃতদেহের কোন অংশ নষ্ট হইলে দ্বিতীয় সত্তারও অনুরূপ অংশটি নষ্ট হইয়া যাইবে। ইহা স্পষ্টতই পিতৃপুরুষের উপাসনা। প্রাচীন ব্যাবিলনবাসীদের মধ্যেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে এই দ্বিতীয় জীবসত্তার ধারণা প্রচলিত ছিল। তাহাদের মতে—মৃত্যুর পর দ্বিতীয় জীবসত্তায় স্নেহবোধ নষ্ট হইয়া যায়। সে খাদ্য, পানীয় এবং নানারূপ সাহায্যের জন্য জীবিত মনুষ্যদিগকে ভয় দেখায়। এমন কি, সে নিজ সন্তান-সন্ততি এবং স্ত্রীর প্রতিও সমস্ত স্নেহ-মমতা হারাইয়া ফেলে। প্রাচীন হিন্দুদের ভিতরেও এই প্রকার পূর্বপুরুষদের পূজার নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়। চীনজাতির মধ্যেও এই পিতৃগণের পূজাই তাহাদের ধর্মের মূলভিত্তি বলা যাইতে পারে এবং এখনও এই বিশ্বাস ঐ বিরাট দেশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রচলিত। বলিতে গেলে প্রকৃতপক্ষে একমাত্র পিতৃ-উপাসনাই সমগ্র চীনদেশে ধর্মাকারে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে। সুতরাং এক দিক্ দিয়া দেখিতে গেলে যাঁহারা এই মতবাদ বিশ্বাস করেন যে, পিতৃপুরুষের উপাসনা হইতেই ধর্মের উৎপত্তি হইয়াছে, তাঁহাদের ধারণা সুষ্ঠুভাবে সমর্থিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়।
পক্ষান্তরে এমন অনেক মনীষী আছেন, যাঁহারা প্রাচীন আর্য সাহিত্য (শাস্ত্র) হইতে দেখান যে, প্রকৃতির উপাসনা হইতেই ধর্মের সূচনা। যদিও ভারতবর্ষের সর্বত্র পূর্বপুরুষের পূজার প্রমাণ পাওয়া যায়, তথাপি প্রাচীনতম শাস্ত্রে তাহার কোন চিহ্নও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আর্যদের প্রাচীনতম শাস্ত্রগ্রন্থ ঋগ্বেদ-সংহিতাতে আমরা ইহার কোন নিদর্শন পাই না। আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে ঋগ্বেদে প্রকৃতির উপাসনাই দেখিতে পাওয়া যায়; সেখানে মানবমন যেন বহির্জগতের অন্তরালে অবস্থিত বস্তুর আভাস পাওয়ার জন্য চেষ্টিত বলিয়া বোধ হয়। ঊষা, সন্ধ্যা, ঝঞ্ঝা—প্রকৃতির অদ্ভুত ও বিশাল শক্তিসমূহ ও সৌন্দর্য মানবমনকে আকর্ষণ করে। সেই মানবমন প্রকৃতির পরপারে যাইয়া সেখানে যাহা আছে, তাহার কিঞ্চিৎ পরিচয় পাইতে আকাঙ্ক্ষা করে। এই প্রচেষ্টায় তাহারা প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে আত্মা ও শরীরাদি দিয়া মানবীয় গুণরাশিতে ভূষিত করে। এগুলি তাহাদের ধারণায় কখনও সৌন্দর্যমণ্ডিত, কখনও বা ইন্দ্রিয়ের অতীত। এই-সব চেষ্টার অন্তে এই প্রাকৃতিক অভিব্যক্তিগুলি তাহাদের নিকট মানবধর্মে ভূষিত হউক বা না হউক, নিছক ভাবময় বস্তুতে পরিণত হয়। প্রাচীন গ্রীকদের মধ্যেও এই প্রকার ধারণা দেখিতে পাওয়া যায়; তাহাদের পুরাণসমূহ কেবল এই ভাবময় প্রকৃতির উপাসনায় পূর্ণ। প্রাচীন জার্মান, স্কাণ্ডিনেভীয় এবং অন্যান্য আর্যজাতিদের মধ্যেও অনুরূপ ধারণা দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং এই পক্ষেও সুদৃঢ় প্রমাণ উপস্থাপিত করা হইয়াছে যে, প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে চেতন ব্যক্তিরূপে কল্পনা করা হইতেই ধর্মের উৎপত্তি হইয়াছে।
এই মতদ্বয় পরস্পর-বিরোধী মনে হইলেও তৃতীয় এক ভিত্তি অবলম্বনে উহাদের সামঞ্জস্য-বিধান করা যাইতে পারে; আমার মনে হয়, উহাই ধর্মের প্রকৃত উৎস এবং ইহাকে আমি ‘ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রমণের চেষ্টা’ বলিতে ইচ্ছা করি। মানুষ একদিকে তাহার পিতৃপুরুষগণের আত্মার অথবা প্রেতাত্মার অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়, অর্থাৎ শরীর-নাশের পর কি অবশিষ্ট থাকে, তাহার কিঞ্চিৎ আভাস পাইতে চায়; কিংবা অপর দিকে এই বিশাল জগৎপ্রপঞ্চের অন্তরালে যে শক্তির ক্রিয়া চলিতেছে, তাহার স্বরূপ জানিতে সচেষ্ট হয়। এই উভয়ের মধ্যে মানুষ যে উপায়ই অবলম্বন করুক না কেন, ইহা সুনিশ্চিত যে, সে তাহার ইন্দ্রিয়সমূহের সীমা অতিক্রম করিতে চায়। ইন্দ্রিয়ের গণ্ডীর মধ্যেই সে সন্তুষ্ট থাকিতে পারে না, অতীন্দ্রিয় অবস্থায় যাইতে চায়। এই ব্যাপারের ব্যাখ্যাও রহস্যপূর্ণ হওয়ার প্রয়োজন নাই। আমার নিকট ইহা খুব স্বাভাবিক বলিয়া বোধ হয় যে, ধর্মের প্রথম আভাস স্বপ্নের ভিতর দিয়াই আসে। অমরত্বের প্রথম ধারণা মানুষ স্বপ্নের ভিতর দিয়া অনায়াসে পাইতে পারে। এই স্বপ্ন কি একটা অত্যাশ্চর্য অবস্থা নয়? আমরা জানি যে, শিশুগণ এবং অশিক্ষিত ব্যক্তিরা তাহাদের জাগ্রৎ ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যে অতি অল্প পার্থক্য অনুভব করে। স্বপ্নাবস্থায় দেহ মৃতবৎ পড়িয়া থাকিলেও মন যখন ঐ অবস্থায়ও তাহার সমুদয় জটিল কার্য চালাইয়া যাইতে থাকে, তখন অমরত্ব-বিষয়ে ঐ-সব ব্যক্তি যে সহজলভ্য প্রমাণ পাইয়া থাকে, উহা অপেক্ষা অধিকতর স্বাভাবিক যুক্তি আর কি থাকিতে পারে? অতএব মানুষ যদি তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্ত করিয়া বসে যে, এই দেহ চিরকালের মত নষ্ট হইয়া গেলেও পূর্ববৎ ক্রিয়া চলিতে থাকিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? আমার মতে অলৌকিক তত্ত্ব-বিষয়ে এই ব্যাখ্যাটি অধিকতর স্বাভাবিক এবং এই স্বপ্নাবস্থার ধারণা অবলম্বনেই মানব-মন ক্রমশঃ উচ্চতর তত্ত্বে উপনীত হয়। অবশ্য ইহাও সত্য যে, কালে অধিকাংশ মানুষই বুঝিতে পারিয়াছিল, জাগ্রদবস্থায় তাহাদের এই স্বপ্ন সত্য বলিয়া প্রতীত হয় না, এবং স্বপ্নাবস্থায় যে মানুষের কোন অভিনব অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তাহাও নয়; পরন্তু সে তখন জাগ্রৎ-কালীন অভিজ্ঞতাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে মাত্র।
কিন্তু ইতোমধ্যে মানব-মনে সত্যানুসন্ধিৎসা অঙ্কুরিত হইয়া গিয়াছে এবং উহার গতি অন্তর্মুখে চলিয়াছে। মানুষ এখন তাহার মনের বিভিন্ন অবস্থাগুলি আরও গভীরভাবে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল এবং জাগরণ ও স্বপ্নের অবস্থা অপেক্ষাও উচ্চতর একটি অবস্থা আবিষ্কার করিল। ভাবাবেশ বা ভগবৎপ্রেরণা নামে পরিচিত এই অবস্থাটির কথা আমরা পৃথিবীর সকল সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মের মধ্যেই পাই। সকল সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মেই ঘোষিত হয় যে, তাহাদের প্রতিষ্ঠাতা—অবতারকল্প মহাপুরুষ বা ঈশদূতগণ মনের এমন সব উচ্চতর অবস্থায় উপনীত হইয়াছিলেন, যাহা নিদ্রা ও জাগরণ হইতে ভিন্ন এবং সেখানে তাহারা অধ্যাত্ম-জগৎ নামে পরিচিত এক অবস্থাবিশেষের সহিত সম্বন্ধযুক্ত অভিনব সত্যসমূহ সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। আমরা জাগ্রদবস্থায় পারিপার্শ্বিক অবস্থাসমূহ যেভাবে অনুভব করি, তাঁহারা পূর্বোক্ত অবস্থায় পৌঁছিয়া সেগুলি আরও স্পষ্টতররূপে উপলব্ধি করেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ ব্রাহ্মণদের ধর্মকে লওয়া যাক। বেদসমূহ ঋষিদের দ্বারা লিপিবদ্ধ বলিয়া উল্লিখিত হয়। এই-সকল ঋষি কতিপয় সত্যের দ্রষ্টা মহাপুরুষ ছিলেন। সংস্কৃত ‘ঋষি’ শব্দের প্রকৃত অর্থ মন্ত্রদ্রষ্টা অর্থাৎ বৈদিক স্তুতিসমূহের বা চিন্তারাশির প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা। ঋষিগণ বলেন, তাঁহারা কতকগুলি সত্য অনুভব করিয়াছেন বা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, যদি ‘অতীন্দ্রিয়’ বিষয় সম্পর্কে ‘প্রত্যক্ষ’ কথাটি ব্যবহার করা চলে। এই সত্যসমূহ তাঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। এই একই সত্য য়াহুদী এবং খ্রীষ্টানদের মধ্যেও বিঘোষিত হইতে দেখা যায়।
বৌদ্ধ-মতাবলম্বী ‘হীনযান’ সম্প্রদায় সম্বন্ধে কথা উঠিতে পারে। জিজ্ঞাস্য এই যে, বৌদ্ধেরা যখন কোন আত্মা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তখন তাহাদের ধর্ম কিরূপে এই অতীন্দ্রিয় অবস্থা হইতে উদ্ভূত হইবে? ইহার উত্তর এই যে, বৌদ্ধেরাও এক শাশ্বত নৈতিক বিধানে বিশ্বাসী এবং সেই নীতি-বিধান আমরা যে অর্থে ‘যুক্তি’ বুঝি, তাহা হইতে উৎপন্ন হয় নাই। কিন্তু অতীন্দ্রিয় অবস্থায় পৌঁছিয়া বুদ্ধদেব উহা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ও আবিষ্কার করিয়াছিলেন। আপনাদের মধ্যে যাঁহারা বুদ্ধদেবের জীবনী পাঠ করিয়াছেন, এমন কি ‘এশিয়ার আলো’ (The Light of Asia) নামক অপূর্ব কাব্যগ্রন্থে নিবদ্ধ অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণও পাঠ করিয়াছেন, তাঁহাদের স্মরণ থাকিতে পারে, বুদ্ধদেব বোধিবৃক্ষমূলে ধ্যানস্থ হইয়া অতীন্দ্রিয় অবস্থায় পৌঁছিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশসমূহ এই অবস্থা হইতেই আসিয়াছে, বুদ্ধির গবেষণা হইতে নয়।
অতএব সকল ধর্মেই এই এক আশ্চর্য বাণী ঘোষিত হয় যে, মানব-মন কোন কোন সময় শুধু ইন্দ্রিয়ের সীমাই অতিক্রম করে না, বিচারশক্তিও অতিক্রম করে। তখন এই মন এমন সব তথ্য প্রত্যক্ষ করে, যেগুলির ধারণা সে কোন কালে করিতে পারিত না এবং যুক্তির দ্বারাও পাইত না। এই তথ্যসমূহই জগতের সকল ধর্মের মূল ভিত্তি। অবশ্য এই তথ্যগুলি সম্বন্ধে আপত্তি উত্থাপন করিবার এবং যুক্তির কষ্টিপাথরে পরীক্ষা করিবার অধিকার আমাদের আছে; তথাপি জগতের সকল প্রচলিত ধর্মমতেই দাবী করা হয় যে, মানব-মনের এমন এক অদ্ভুত শক্তি আছে, যাহার বলে সে ইন্দ্রিয় ও বিচারশক্তির সীমা অতিক্রম করিতে পারে; অধিকন্তু তাহারা এই শক্তিকে একটি বাস্তব সত্য বলিয়াই দাবী করে।
সকল ধর্মেই স্বীকৃত এই-সকল তথ্য কতদূর সত্য, তাহা বিচার না করিয়াও আমরা তাহাদের একটি সাধারণ বিশেষত্ব দেখিতে পাই। উদাহরণস্বরূপ পদার্থবিজ্ঞান দ্বারা আবিষ্কৃত স্থূল তথ্যগুলির তুলনায় ধর্মের আবিষ্কারগুলি অতি সূক্ষ্ম, এবং যে-সকল ধর্ম অতি উন্নত প্রণালীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সেগুলি সবই এক সূক্ষ্মতম তত্ত্ব স্বীকার করে; কাহারও মতে উহা হয়তো এক নিরপেক্ষ সূক্ষ্ম সত্তা, অথবা সর্বব্যাপী পুরুষ, অথবা ঈশ্বর-নামধেয় স্বতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষ, অথবা নৈতিক বিধি; আবার কাহারও মতে উহা হয়তো সকল সত্তার অন্তর্নিহিত সার সত্য। এমন কি আধুনিক কালে মনের অতীন্দ্রিয় অবস্থার উপর নির্ভর না করিয়া ধর্মমত-প্রচারের যত প্রকার চেষ্টা করা হইয়াছে, তাহাতেও প্রাচীনদের স্বীকৃত পুরাতন সূক্ষ্মভাবগুলিই গ্রহণ করা হইয়াছে এবং ঐগুলিকে নীতি-বিধান (Moral Law), আদর্শগত ঐক্য (Ideal Unity) প্রভৃতি নূতন নামে অভিহিত করা হইতেছে এবং ইহা দ্বারা দেখান হইয়াছে যে, এই-সকল সূক্ষ্ম তত্ত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। আমাদের মধ্যে কেহই এ-পর্যন্ত কোন আদর্শ মানুষ দেখে নাই, তথাপি আমাদিগকে এরূপ এক ব্যক্তিতে বিশ্বাসী হইতে বলা হয়। আমাদের মধ্যে কেহই এ-পর্যন্ত পূর্ণ আদর্শ মানুষ দেখে নাই, তথাপি সেই আদর্শ ব্যতীত আমরা উন্নতি লাভ করিতে পারি না। বিভিন্ন ধর্ম হইতে এই একটি সত্যই স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, এক সূক্ষ্ম অখণ্ড সত্তা আছে, যাহাকে কখনও আমাদের নিকট ব্যক্তিবিশেষরূপে, অথবা নীতিবাদরূপে, অথবা নিরাকার সত্তারূপে, অথবা সর্বানুস্যূত সারবস্তুরূপে উপস্থাপিত করা হয়। আমরা সর্বদাই সেই আদর্শে উন্নীত হইবার চেষ্টা করিতেছি। প্রত্যেক মানুষ যেমনই হউক বা যেখানেই থাকুক, তাহার অনন্ত শক্তি সম্বন্ধে একটা নিজস্ব আদর্শ আছে, প্রত্যেকেরই এক অসীম আনন্দের আদর্শ আছে। আমাদের চতুর্দিকে যে-সকল কর্ম সম্পাদিত হয়, সর্বত্র যে কর্মচাঞ্চল্য প্রকটিত হয়, এগুলি অধিকাংশই এই অনন্ত শক্তি-অর্জনের, এই অসীম আনন্দ-লাভের প্রচেষ্টা হইতে উদ্ভূত হয়। কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক অচিরেই বুঝিতে পারে যে, যদিও তাহারা অনন্ত শক্তিলাভের প্রচেষ্টায় নিরত হইয়াছে, তথাপি সেই শক্তি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা লভ্য নয়। তাহারা অবিলম্বে বুঝিতে পারে যে, ইন্দ্রিয় দ্বারা সেই অনন্ত সুখ লাভ করা যায় না। অন্যভাবে এরূপ বলা চলে যে, ইন্দ্রিয়গুলি ও দেহ এত সীমাবদ্ধ যে, সেগুলি অসীমকে প্রকাশ করিতে পারে না। অসীমকে সীমার মধ্য দিয়া প্রকাশ করা অসম্ভব; কালে মানুষ অসীমকে সসীমের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিবার চেষ্টা ত্যাগ করিতে শেখে। এই ত্যাগ, এই চেষ্টা করাই নীতিশাস্ত্রের মূল ভিত্তি। ত্যাগের ভিত্তির উপরই নীতিশাস্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এমন কোন নীতি কোন কালে প্রচারিত হয় নাই, যাহার মূলে ত্যাগ নাই। ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’—ইহাই নীতিশাস্ত্রের চিরন্তন বাণী। নীতিশাস্ত্রের উপদেশ—‘স্বার্থ নয়, পরার্থ।’ নীতিশাস্ত্র বলে, সেই অনন্ত শক্তি বা অনন্ত সুখকে ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া লাভ করিতে সচেষ্ট মানুষ নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে একটা যে মিথ্যা ধারণা আঁকড়াইয়া থাকে, তাহা ত্যাগ করিতেই হইবে। নিজেকে সর্বপশ্চাতে রাখিয়া অন্যকে প্রাধান্য দিতে হইবে। ইন্দ্রিয়সমূহ বলে, ‘আমারই হইবে প্রথম স্থান।’ নীতিশাস্ত্র বলে, ‘না, আমি থাকিব সর্বশেষে।’ সুতরাং সকল নীতিশাস্ত্রই এই ত্যাগের—জড়জগতে স্বার্থবিলোপের উপর প্রতিষ্ঠিত, স্বার্থরক্ষার উপর নয়। এই জড়জগতে কখনও সেই অনন্তের পূর্ণ অভিব্যক্তি হইবে না, ইহা অসম্ভব অথবা কল্পনারও অযোগ্য।
সুতরাং মানুষকে জড়জগৎ ত্যাগ করিয়া সেই অনন্তের গভীরতর প্রকাশের অন্বেষণে আরও উচ্চতর ভাব-ভূমিতে উঠিতে হইবে। এই ভাবেই বিভিন্ন নৈতিক বিধি রচিত হইতেছে; কিন্তু সকলেরই সেই এক মূল আদর্শ—চিরন্তন আত্মত্যাগ। অহঙ্কারের পূর্ণ বিনাশই নীতিশাস্ত্রের আদর্শ। যদি মানুষকে তাহার ব্যক্তিত্বের চিন্তা করিতে নিষেধ করা হয়, তবে সে শিহরিয়া উঠে। তাহারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব হারাইতে অত্যন্ত ভীত বলিয়া মনে হয়। অথচ সেই-সব লোকই আবার প্রচার করে যে, নীতিশাস্ত্রের উচ্চতম আদর্শগুলিই যথার্থ; তাহারা একবারও ভাবিয়া দেখে না, সকল নীতিশাস্ত্রের গণ্ডী, লক্ষ্য এবং অন্তর্নিহিত ভাবই হইল এই ‘অহং’-এর নাশ, উহার বৃদ্ধি নয়।
হিতবাদের (বা প্রয়োজনবাদের) আদর্শ মানুষের নৈতিক সম্বন্ধ ব্যাখ্যা করিতে পারে না, কারণ প্রথমতঃ প্রয়োজনের বিবেচনায় কোন নৈতিক নিয়ম আবিষ্কার করা যায় না। অলৌকিক অনুমোদন অথবা আমি যাহাকে অতিচেতন অনুভূতি বলিতে পছন্দ করি, তাহা ব্যতীত কোন নীতিশাস্ত্র গড়িয়া উঠিতে পারে না। অনন্তের অভিমুখে অভিযান ব্যতীত কোন আদর্শই দাঁড়াইতে পারে না। যে-কোন নীতিশাস্ত্র মানুষকে তাহার নিজ সমাজের গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ রাখিতে ইচ্ছা করে, তাহা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে প্রযোজ্য নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা করিতে অক্ষম। হিতবাদীরা অনন্তকে পাইবার সাধনা এবং অতীন্দ্রিয় বস্তু লাভের আশা ত্যাগ করিতে বলেন; তাঁহাদের মতে ইহা অসাধ্য ও অযৌক্তিক। আবার তাঁহারাই সঙ্গে সঙ্গে আমাদিগকে নীতি অবলম্বন এবং সমাজের কল্যাণসাধন করিতে বলেন। কেন আমরা কল্যাণ করিব? হিত করা তো গৌণ ব্যাপার। আমাদের একটি আদর্শ থাকা আবশ্যক। নীতিশাস্ত্র তো লক্ষ্য নয়, উহা উদ্দেশ্য-সাধনের উপায় মাত্র। লক্ষ্যই যদি না থাকে, তবে আমরা নীতিপরায়ণ হইব কেন? কেন আমি অন্যের অনিষ্ট না করিয়া উপকার করিব? সুখই যদি জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন আমি নিজেকে সুখী এবং অপরকে দুঃখী করিব না? আমাকে বাধা দেয় কিসে? দ্বিতীয়তঃ হিতবাদের ভিত্তি অতীব সঙ্কীর্ণ। যে-সকল সামাজিক রীতিনীতি ও কার্যধারা প্রচলিত অছে, সেগুলি সমাজের বর্তমান অবস্থা হইতেই গৃহীত হইয়াছে। কিন্তু হিতবাদীদের এমন কী অধিকার আছে যে, তাঁহারা সমাজকে চিরন্তন বলিয়া কল্পনা করিবেন? বহুযুগ পূর্বে সমাজের অস্তিত্ব ছিল না, খুব সম্ভব বহুযুগ পরেও থাকিবে না। খুব সম্ভব উচ্চতর ক্রমবিকাশের দিকে অগ্রসর হইবার পথে এই সমাজ-ব্যবস্থা আমাদের অন্যতম সোপান। শুধু সমাজ-ব্যবস্থা হইতে গৃহীত কোন বিধিই চিরন্তন হইতে পারে না এবং সমগ্র মানব-প্রকৃতির পক্ষে পর্যাপ্ত হইতে পারে না। অতএব হিতবাদ-সম্ভূত মতগুলি বড়জোর বর্তমান সামাজিক অবস্থায় কার্যকর হইতে পারে। তাহার বাহিরে উহাদের কোন মূল্য নাই। কিন্তু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা হইতে উদ্ভূত চরিত্রনীতি ও নৈতিক বিধির কার্যক্ষেত্র বা পরিধি সমষ্টি মানবের সমগ্র দিক্। ইহা ব্যষ্টির সম্পর্কে প্রযুক্ত হইলেও ইহার সম্পর্ক সমষ্টির সহিত। সমাজও ইহার অন্তর্ভুক্ত, কারণ সমাজ তো ব্যষ্টিনিচয়ের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। যেহেতু এই নৈতিক বিধি ব্যষ্টি ও তাহার অনন্ত সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সেহেতু সমাজ যে-কোন সময়ে যে-কোন অবস্থায় থাকুক না কেন, ইহা সমুদয় সামাজিক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এইরূপে দেখা যায় যে, মানব-জাতির পক্ষে আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন সর্বদাই আছে। জড় যতই সুখকর হউক না কেন, মানুষ সর্বদা জড়ের চিন্তা করিতে পারে না।
লোকে বলে, আধ্যাত্মিক বিষয়ে বেশী মনোযোগ দিলে আমাদের ব্যাবহারিক জগতে প্রমাদ ঘটে। সুদূর অতীতে চৈনিক ঋষি কন্ফ্যুসিয়াসের সময়ে বলা হইত—‘আগে ইহলোকের সুব্যবস্থা করিতে হইবে; ইহলোকের ব্যবস্থা হইয়া গেলে পরলোকের কথা ভাবিব।’ ইহা বেশ সুন্দর কথা যে, আমরা ইহ-জগতের কার্যে তৎপর হইব, কিন্তু ইহাও দ্রষ্টব্য যে, যদি আধ্যাত্মিক বিষয়ে অত্যধিক মনোযোগের ফলে ব্যাবহারিক জীবনে কিঞ্চিৎ ক্ষতি হয়, তাহা হইলে তথাকথিত বাস্তব-জীবনের প্রতি অত্যধিক মনোনিবেশের ফলে আমাদের ইহলোক ও পরলোক উভয় লোকেরই ক্ষতি হইয়া থাকে। এই ভাবে চলিলে মানুষ জড়বাদী হইয়া পড়ে, কারণ প্রকৃতিই মানুষের লক্ষ্য নয়—মানুষের লক্ষ্য তদপেক্ষা উচ্চতর বস্তু।
যতক্ষণ মানুষ প্রকৃতিকে অতিক্রম করিবার জন্য সংগ্রাম করে, ততক্ষণ তাহাকে যথার্থ মানুষ বলা চলে। এই প্রকৃতির দুইটি রূপ—অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিঃপ্রকৃতি। যে নিয়মগুলি আমাদের বাহিরের ও শরীরের ভিতরের জড় কণিকাসমূহকে নিয়ন্ত্রিত করে, কেবল সেগুলিই প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়, পরন্তু সূক্ষ্মতর অন্তঃপ্রকৃতিও উহার অন্তর্ভুক্ত; বস্তুতঃ এই সূক্ষ্মতর প্রকৃতিই বহির্জগতের নিয়ামক শক্তি। বহিঃপ্রকৃতিকে জয় করা খুবই ভাল ও বড় কথা; কিন্তু অন্তঃপ্রকৃতিকে জয় করা আরও মহত্তর। যে-সকল নিয়মানুসারে গ্রহ-নক্ষত্রগুলি পরিচালিত হয়, সেগুলি জানা উত্তম, কিন্তু যে-সকল নিয়মানুসারে মানুষের কামনা, মনোবৃত্তি ও ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেগুলি জানা অনন্তগুণে মহত্তর ও উৎকৃষ্ট। অন্তর্মানবের এই জয়, মানব-মনের যে-সকল সূক্ষ্ম ক্রিয়াশক্তি কাজ করিতেছে, সেগুলির রহস্য জানা—সবই সম্পূর্ণরূপে ধর্মের অন্তর্গত। মানব-প্রকৃতি—আমি সাধারণ মানব-প্রকৃতির কথা বলিতেছি—বড় বড় প্রাকৃতিক ঘটনা দেখিতে চায়। সাধারণ মানুষ সূক্ষ্ম বিষয় ধারণা করিতে পারে না। ইহা বেশ বলা হয় যে, সাধারণ লোকে সহস্র মেষশাবক-হত্যাকারী সিংহেরই প্রশংসা করিয়া থাকে, তাহারা একবারও ভাবে না যে, ইহাতে এক হাজার মেষের মৃত্যু ঘটিল, যদিও সিংহটার ক্ষণস্থায়ী জয় হইয়াছে; তাহারা কেবল শারীরিক শক্তির প্রকাশেই আনন্দ অনুভব করে। সাধারণ মানব-মনের ধারাই এইরূপ। তাহারা বাহিরের বিষয় বোঝে এবং তাহাতেই সুখ অনুভব করে; কিন্তু প্রত্যেক সমাজে একশ্রেণীর লোক আছেন, যাঁহাদের আনন্দ—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর মধ্যে নাই, অতীন্দ্রিয় রাজ্যে; তাঁহারা মাঝে মাঝে জড়বস্তু অপেক্ষা উচ্চতর কিছুর আভাস পাইয়া থাকেন এবং উহা পাইবার জন্য সচেষ্ট হন। বিভিন্ন জাতির ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করিলে আমরা সর্বদা দেখিতে পাইব যে, এরূপ সূক্ষ্মদর্শী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতির উন্নতি হয় এবং অনন্তের অনুসন্ধান বন্ধ হইলে তাহার পতন আরম্ভ হয়, হিতবাদীরা এই অনুসন্ধানকে যতই বৃথা বলুক না কেন। অর্থাৎ প্রত্যেক জাতির শক্তির মূল উৎস হইতেছে তাহার আধ্যাত্মিকতা, এবং যখনই ঐ জাতির ধর্ম ক্ষীণ হয় এবং জড়বাদ আসিয়া তাহার স্থান অধিকার করে, তখনই সেই জাতির ধ্বংস আরম্ভ হয়।
এইরূপ ধর্ম হইতে আমরা যে-সকল তথ্য ও তত্ত্ব শিক্ষা করিতে পারি, যে-সান্ত্বনা পাইতে পারি, তাহা ছাড়িয়া দিলেও ধর্ম অন্যতম বিজ্ঞান অথবা গবেষণার বস্তু হিসাবে মানব-মনের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক কল্যাণকর অনুশীলনের বিষয়। অনন্তের এই অনুসন্ধান, অনন্তকে ধারণা করিবার এই সাধনা, ইন্দ্রিয়ের সীমা অতিক্রম করিয়া যেন জড়ের বাহিরে যাইবার এবং আধ্যাত্মিক মানবের ক্রমবিকাশ-সাধনের এই প্রচেষ্টা—অনন্তকে আমাদের সত্তার সঙ্গে একীভূত করিবার এই নিরন্তর প্রয়াস—এই সংগ্রামই মানুষের সর্বোচ্চ গৌরব ও মহত্ত্বের বিকাশ। কেহ কেহ ভোজনে সর্বাধিক আনন্দ পায়, আমাদের বলিবার কোন অধিকার নাই যে, তাহাদের উহাতে আনন্দ পাওয়া উচিত নয়। আবার কেহ কেহ সামান্য কিছু লাভ করিলেই অত্যন্ত সুখ বোধ করে; তাহাদের পক্ষে উহা অনুচিত—এরূপ বলিবার অধিকার আমাদের নাই। তেমনি আবার যে-মানুষ ধর্মচিন্তায় সর্বোচ্চ আনন্দ পাইতেছে, তাহাকে বাধা দিবারও উহাদের কোন অধিকার নাই। যে-প্রাণী যত নিম্নস্তরের হইবে, ইন্দ্রিয়সুখে সে তত অধিক সুখ পাইবে। শৃগাল-কুকুর যতখানি আগ্রহের সহিত ভোজন করে, কম লোকই সেভাবে আহার করিতে পারে। কিন্তু শৃগাল-কুকুরের সুখানুভূতির সবটাই যেন তাহাদের ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে কেন্দ্রীভূত হইয়া রহিয়াছে। সকল জাতির মধ্যেই দেখা যায়, নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকেরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে সুখভোগ করে এবং শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন লোকেরা চিন্তায়, দর্শনে, বিজ্ঞানে ও শিল্পকলায় সেই সুখ পাইয়া থাকে। আধ্যাত্মিকতার রাজ্য আরও উচ্চতর। উহার বিষয়টি অনন্ত হওয়ায় ঐ রাজ্যও সর্বোচ্চ এবং যাহারা উহা সম্যকরূপে ধারণা করিতে পারে, তাহাদের পক্ষে ঐ স্তরের সুখও সর্বোৎকৃষ্ট। সুতরাং ‘মানুষকে সুখানুসন্ধান করিতে হইবে’—হিতবাদীর এই মত মানিয়া লইলেও মানুষের পক্ষে ধর্মচিন্তার অনুশীলন করা উচিত; কারণ ধর্মানুশীলনেই উচ্চতম সুখ আছে। সুতরাং আমার মতে ধর্মানুশীলন একান্ত প্রয়োজন। ইহার ফল হইতেও আমরা তাহা বুঝিতে পারি। মানব-মনকে গতিশীল করিবার জন্য ধর্ম একটি শ্রেষ্ঠ নিয়ামক শক্তি। ধর্ম আমাদের ভিতর যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চার করিতে পারে, অন্য কোন আদর্শ তাহা পারে না। মানব-জাতির ইতিহাস হইতে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে অতীতে এইরূপই হইয়াছে, এবং ধর্মের শক্তি এখনও নিঃশেষিত হয় নাই। কেবল হিতবাদ অবলম্বন করিলেই মানুষ খুব সৎ ও নীতিপরায়ণ হইতে পারে, ইহা আমি অস্বীকার করি না। এ জগতে এমন বহু মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, যাঁহারা হিতবাদ অনুসরণ করিয়াও সম্পূর্ণ নির্দোষ, নীতিপরায়ণ এবং সরল ছিলেন। কিন্তু যে-সকল মহামানব বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের স্রষ্টা, যাঁহারা জগতে যেন চৌম্বকশক্তিরাশি সঞ্চারিত করেন, যাঁহাদের শক্তি শত সহস্র ব্যক্তির উপর কাজ করে, যাঁহাদের জীবন অপরের জীবনে আধ্যাত্মিক অগ্নি প্রজ্বলিত করে, এরূপ মহাপুরুষদের মধ্যে আমরা সর্বদা অধ্যাত্মশক্তির প্রেরণা দেখিতে পাই। তাঁহাদের প্রেরণাশক্তি ধর্ম হইতে আসিয়াছে। যে অনন্ত শক্তিতে মানুষের জন্মগত অধিকার, যাহা তাহার প্রকৃতিগত, তাহা উপলব্ধি করিবার জন্য ধর্মই সর্বাপেক্ষা বেশী প্রেরণা দেয়। চরিত্র-গঠনে, সৎ ও মহৎ কার্য-সম্পাদনে, নিজের ও অপরের জীবনে শান্তিস্থাপনে ধর্মই সর্বোচ্চ প্রেরণাশক্তি; অতএব সেই দৃষ্টিকোণ হইতে ইহার অনুশীলন করা উচিত। পূর্বাপেক্ষা উদার ভিত্তিতে ধর্মের অনুশীলন আবশ্যক। সর্বপ্রকার সঙ্কীর্ণ, অনুদার ও বিবদমান ধর্মভাব দূর করিতে হইবে। সকল সাম্প্রদায়িক, স্বজাতীয় বা স্বগোত্রীয় ভাব পরিত্যাগ করিতে হইবে। প্রত্যেক জাতি ও গোষ্ঠীর নিজস্ব ঈশ্বর থাকিবেন এবং অপর সকলের ঈশ্বর মিথ্যা—এই-জাতীয় ধারণা কুসংস্কার, এগুলি অতীতের গর্ভেই বিলীন হওয়া উচিত। এই ধরনের ধারণাগুলি অবশ্য বর্জনীয়।
মানব-মনের যতই বিস্তার হয়, তাহার আধ্যাত্মিক সোপানগুলিও ততই প্রসার লাভ করে। এমন এক সময় আসিয়াছে, যখন মানুষের চিন্তাগুলি লিপিবদ্ধ হইতে না হইতে পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। বর্তমানে আমরা শুধু যান্ত্রিক উপায়ে সমগ্র জগতের সংস্পর্শে আসিয়াছি, সুতরাং জগতের ভাবী ধর্মসমূহকে একদিকে যেমন সর্বজনীন, অপরদিকে তেমনি উদার হইতে হইবে।
জগতে যাহা কিছু সৎ ও মহৎ, তাহার সবই ভাবী ধর্মাদর্শের অন্তর্ভুক্ত হওয়া আবশ্যক এবং সেই সঙ্গে উহাতে ভাবী উন্নতির অনন্ত সুযোগ নিহিত থাকিবে। অতীতের যাহা কিছু ভাল, তাহার সবই অবশ্য রক্ষা করিতে হইবে, এবং পূর্বে সঞ্চিত ধর্মভাণ্ডারে নূতন ভাবসংযোগের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখিতে হইবে। অধিকন্তু প্রত্যেক ধর্মেরই অপর ধর্মগুলিকে স্বীকার করিয়া লওয়া আবশ্যক; ঈশ্বর-সম্বন্ধীয় অপরের কোন বিশেষ ধারণাকে ভিন্ন মনে করিয়া নিন্দা করা উচিত নয়। আমার জীবনে আমি এমন অনেক ধার্মিক ও বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি দেখিয়াছি, যাঁহাদের ঈশ্বরে—অর্থাৎ আমরা যে-অর্থে ঈশ্বর মানি, সেই ঈশ্বরে আদৌ বিশ্বাস নাই, হয়তো আমাদের অপেক্ষা তাঁহারাই ঈশ্বরকে ভালরূপে বুঝিয়াছেন। ভগবানের সাকার বা নিরাকার রূপ, অসীম সত্তা, নীতিবাদ অথবা আদর্শ মনুষ্য প্রভৃতি যত কিছু মতবাদ আছে, সবই ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়া চাই। সকল ধর্ম যখন এইভাবে উদারতা লাভ করিবে, তখন তাহাদের হিতকারিণী শক্তিও শতগুণে বৃদ্ধি পাইবে। ধর্মসমূহের মধ্যে অতি প্রচণ্ড শক্তি নিহিত থাকিলেও ঐগুলি শুধু সঙ্কীর্ণতা ও অনুদারতার জন্যই মঙ্গল অপেক্ষা অমঙ্গল অধিক করিয়াছে।
বর্তমান সময়েও আমরা দেখিতে পাই, বহু সম্প্রদায় ও সমাজ প্রায় একই আদর্শ অনুসরণ করিয়াও পরস্পরের সহিত বিবাদ করিতেছে, কারণ এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় যেভাবে করিতেছে ঠিক সেইভাবে নিজের আদর্শগুলি উপস্থাপিত করিতে চায় না। এইজন্য ধর্মগুলিকে উদার হইতে হইবে। ধর্মভাবগুলিকে সর্বজনীন, বিশাল ও অনন্ত হইতে হইবে, তবেই ধর্মের সম্পূর্ণ বিকাশ হইবে, কারণ ধর্মের শক্তি সবেমাত্র পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কখনও কখনও এইরূপ বলিতে শোনা যায় যে, ধর্মভাব পৃথিবী হইতে তিরোহিত হইতেছে। আমার মনে হয়, ধর্মভাবগুলি সবেমাত্র বিকশিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। সঙ্কীর্ণতামুক্ত ও আবিলতাশূন্য হইয়া ধর্মের প্রভাব মানব-জীবনের প্রতি স্তরে প্রবেশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। যতদিন ধর্ম মুষ্টিমেয় ‘ঈশ্বরনির্দিষ্ট’ ব্যক্তিদের বা পুরোহিতকুলের হাতে ছিল, ততদিন উহা মন্দিরে, গীর্জায়, গ্রন্থে, মতবাদে, আচার-অনুষ্ঠানে নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু যখনই আমরা ধর্মের যথার্থ আধ্যাত্মিক ও সর্বজনীন ধারণায় উপনীত হইব, তখন এবং কেবল তখনই উহা প্রকৃত ও জীবন্ত হইবে—ইহা আমাদের স্বভাবে পরিণত হইবে, আমাদের প্রতি গতিবিধিতে প্রাণবন্ত হইয়া থাকিবে, সমাজের শিরায় শিরায় প্রবেশ করিবে এবং পূর্বাপেক্ষা অনন্তগুণ কল্যাণকারিণী শক্তি হইবে।
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের উত্থান বা পতনের প্রশ্ন যখন একসঙ্গে গ্রথিত, তখন প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদা হইতে উদ্ভূত সৌভ্রাত্র, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমানে অনেক ধর্ম যেভাবে অপর ধর্মের প্রতি সানুগ্রহ, কৃপাপূর্ণ ও কৃপণোচিত সদিচ্ছা প্রকাশ করেন তাহা চলিবে না। সর্বোপরি দুই প্রকার বিশেষ মতবাদের মধ্যে এই ভ্রাতৃভাব স্থাপন করা অত্যন্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে; ইহার মধ্যে প্রথম দলের ধর্মের বিবিধ বিকাশ মনস্তত্ত্বের আলোচনা হইতে উদ্ভূত হয়; দুরদৃষ্টবশতঃ এই দল এখনও দাবী করেন যে, তাঁহাদের ধর্মই একমাত্র ‘ধর্ম’ নামের যোগ্য। দ্বিতীয় আর একদল আছেন, যাঁহাদের মস্তিষ্ক স্বর্গের আরও রহস্য উদ্ঘাটন করিতে ব্যস্ত, কিন্তু তাঁহাদের পদতল মাটি আঁকড়াইয়া থাকে—এখানে আমি তথাকথিত জড়বাদী বৈজ্ঞানিকদের কথাই বলিতেছি।
এই সমন্বয় আনিতে হইলে উভয়কে কিছু ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে; কখনও এই ত্যাগ একটু বেশী রকমের দরকার, এমন কি কখনও যন্ত্রণাদায়কও হইতে পারে, কিন্তু এই ত্যাগের ফলে প্রত্যেক দল নিজেকে এক উচ্চতর স্তরে উন্নীত ও সত্যে অধিকতর প্রতিষ্ঠিত দেখিতে পাইবেন। এবং পরিণামে যে-জ্ঞানকে দেশ ও কালের মধ্যে পরিচ্ছিন্ন রাখা হইয়াছে, তাহা পরস্পর মিলিত হইয়া দেশকালাতীত এমন এক সত্তার সহিত একীভূত হইবে, যেখানে মন ও ইন্দ্রিয়সমূহ যাইতে অক্ষম, যাহা সর্বাতীত, অনন্ত ও ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’।