ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব
# বৈদিক ধর্ম
বেদ-বিধানাত্মক ধর্মই বৈদিক ধর্ম। বৈদিক ধর্মের বর্তমান নাম হিন্দুধর্ম। বেদ চারিখানা। যথা –ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। বেদ রচিত হইবার বহু পরে উহার ভাষ্য-অনুভাষ্য, টীকা ইত্যাদি এবং পুরাণ, উপপুরাণ, গীতা, তন্ত্র ইত্যাদি অজস্র শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হইয়া উহা বৈদিক ধর্মে গৃহীত হইয়াছে। সেই সবের মধ্যে কয়েকখানা গ্রন্থের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধীয় মতবাদ এইখানে আলোচিত হইল।
ঋগ্বেদ (পুরুষ সুক্ত) – “পুরুষ (ঈশ্বর) সহস্র মস্তকযুক্ত এবং সহস্র অক্ষি ও সহস্র পদ বিশিষ্ট। তিনি বিশ্বচরাচর সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ও দশদিকে বিরাজমান (১)। যাহা উৎপন্ন হইয়াছে, যাহা উৎপন্ন হইবে, সকলই সেই পুরুষ। তিনি অমরত্বের অধিকারী। তিনি অন্নের (ভাতের) দ্বারা পরিপুষ্ট (২)। সেই পুরুষের মহিমার অন্ত নাই। তাহার এক পদে ভূতসমষ্টিপূর্ণ এই পৃথিবী এবং অপর তিন পদে অমরগণ পরিপূরিত স্বর্গ (৩)। তিনি চেতন, অচেতন সকল সামগ্রীতেই পরিব্যাপ্ত। তাহা হইতেই বিরাট জন্মগ্রহণ করেন। বিরাট হইতে আবার পুরুষ উৎপন্ন হ’ন (৪)। তিনি জন্মমাত্র অগ্রপশ্চাতে ব্যস্ত হইয়া পড়েন; সেই পুরুষকেই হব্যরূপে গ্রহণ করিয়া দেবতারা যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তখন বসন্ত ঘৃত হইয়াছিল, গ্রীষ্ম যজ্ঞকাষ্ঠ এবং শরৎ হবি হইয়াছিল (৫)। সেই যজ্ঞাগ্নি হইতে জল এবং খেচর ও ভূচর, আরণ্য ও গ্রাম্য পশু উৎপন্ন হইল (৬)। সেই যজ্ঞ হইতে ঋক, সাম উৎপন্ন হইল; ছন্দসকল আবির্ভূত হইল; যজু উৎপন্ন হইল (৭)। তাহা হইতে অশ্ব উৎপন্ন হইল এবং দুই পাটি দন্তযুক্ত পশুগণ জন্মগ্রহণ করিল। তাহা হইতে গো-গণ জন্মগ্রহণ করিল, তাহা হইতে ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হইল (৮)। সেই পুরুষ বিভক্ত হইলে … তাঁহার মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, উরু হইতে বৈশ্য এবং পদদ্বয় হইতে শূদ্রের উৎপত্তি হয় (৯)। তাহার মন হইতে চন্দ্র, চক্ষু হইতে সূর্য, মুখ হইতে ইন্দ্র ও অগ্নি এবং প্রাণ হইতে বায়ু বা জীবের প্রাণবায়ু উৎপন্ন হইয়াছিল (১০)। তাহার নাভি হইতে অন্তরীক্ষ, মস্তক হইতে স্বর্গ, চরণদ্বয় হইতে ভূমি, কর্ণ হইতে দিকসকল ও লোকসমূহ উৎপন্ন হয় (১১)।” ইত্যাদি।
শতপথ ব্রাহ্মণ (৬/১/১) –“পুরুষ প্রজাপতি প্রথমে জলের সৃষ্টি করিয়া জলমধ্যে আপনি অণ্ডরূপে প্রবিষ্ট হন। সেই অণ্ড হইতে জন্মগ্রহণ করিবার জন্যই তিনি তাহাতে প্রবেশ করিয়াছিলেন। পরিশেষে তিনি তাহা হইতে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারী ব্রহ্মরূপে আবির্ভূত হন।”
অথর্ব সংহিতা (১১/৪) — “প্রাণ হইতেই অর্থাৎ প্রাণস্বরূপ পরমেশ্বর হইতেই বিশ্বের উৎপত্তি হয়, পরমেশ্বর স্বয়ংই প্রথমসৃষ্টরূপে আবির্ভূত হন।”
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (২/৬) –“ব্ৰহ্ম ইচ্ছা করিলেন, আমি বহু হইব, বহুরূপে প্রকাশমান হইব। অতঃপর তিনি তপস্যায় প্রবৃত্ত হন। সেই তপস্যার ফলে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের সৃষ্টি হয়। বিশ্ব সৃষ্টি করিয়া তিনি স্বয়ং তাহার মধ্যে প্রবেশ করেন এবং সর্বরূপে আবির্ভূত হন।”
ঐতরেয় উপনিষদ (১/১-২; ১/৩/১১) — “সষ্টির আদিতে একমাত্র আত্মাই বিদ্যমান ছিলেন, তিনি ভিন্ন আর কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। তিনি সংকল্প করেন, আমি জগত সৃষ্টি করিব। তদনুসারে তিনি ভূলোক, দ্যুলোক, রসাতল, সমুদ, আকাশ, মৃত্তিকা, জল প্রভৃতি সৃষ্টি করেন। … তখন তিনি চিন্তা করেন, কি করিয়া উহার মধ্যে প্রবেশ করিবেন। এইরূপ চিন্তার পর তিনি শীর্ষ বিদীর্ণ করিয়া সকলের মধ্যে প্রবেশ করেন।”
মনু সংহিতা (১; ৬) –“প্রলয়ান্তে বহিরিন্দ্রিয়ের অগোচর অব্যাহত সৃষ্টিসামর্থ সম্পন্ন ও প্রকৃতি প্রেরক পরমেশ্বর স্বেচ্ছাকৃত দেহধারী হইয়া এই আকাশাদি, পঞ্চভূত ও মহদাদি তত্ত্ব, যাহা প্রলয়কালে সূক্ষরূপে অব্যক্তাবস্থায় ছিল, সেই সমুদয় স্থলরূপে প্রকাশকরত আপনিই প্রকাশিত হইলেন।”
এই বর্ণনাটি আধুনিক নীহারিকাবাদ-এর সহিত বহুলাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মনু (১; ৮) –“সেই পরমাত্মা প্রকৃতিরূপে পরিণত আপন শরীর হইতে নানা প্রকার প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে, কিরূপে সৃষ্টি সম্পাদন হইবে, এই সঙ্কল্প করিয়া, প্রথমত ‘জল হউক’ বলিয়া আকাশাদিক্রমে জলের সৃষ্টি করিলেন ও তাহাতে আপন শক্তিরূপ বীজ অর্পণ করিলেন।”
মনু (১; ৯)— “অর্পিত বীজ সুবর্ণনির্মিতের ন্যায় ও সূর্যসদৃশ প্রভাযুক্ত একটি অণ্ড হইল। ঐ অণ্ডে সকল লোকের জনক স্বয়ং ব্রহ্মই শরীর পরিগ্রহ করিলেন।”
এইখানে বলা হইতেছে যে, জলে অর্পিত শক্তির বীজ হইতে সুবর্ণের ন্যায় বর্ণ ও সূর্যের ন্যায় প্রভাযুক্ত একটি ডিম্বাকার পদার্থের সৃষ্টি হইল, যাহার অভ্যন্তরে নিহিত থাকিলেন সকল সৃষ্টির জনক স্বয়ং ব্রহ্মা। ব্রহ্ম’ মানে তেজ বা অগ্নি। ইহাতে মনে হয় যে, উক্ত ডিম্বটি সূর্য ভিন্ন আর কিছুই নহে। বর্তমানে প্রমাণিত হইয়াছে যে, সূর্য একটি অগ্নিপিণ্ড এবং গ্রহাদির জনক ও পৃথিবীস্থিত জৈবাজৈব যাবতীয় পদার্থের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু জল হইতে সূর্যের উৎপত্তি সম্ভব নহে।
মনু (১; ১২)– “ভগবান ব্রহ্মা সেই অণ্ডে ব্রাহ্ম পরিমাণে এক বৎসরকাল বাস করিয়া, ‘ দ্বিধা হউক’ মনে হইবামাত্র সেই অণ্ডকে দুই খণ্ড করিলেন।”
সেই ব্রহ্ম-অণ্ডটি (সূর্য) খণ্ডিত হইয়া পৃথিবীর জন্ম হইয়াছে –ইহা আধুনিক বিজ্ঞানীগণও বলেন, কিন্তু দুই খণ্ড বলেন না, বলেন দ্বাদশ খণ্ড। যথা –বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন, প্লুটো, ভালকান, পসিডন ও স্বয়ং রবিদেব। আর রবিদেব তাহার এক বৎসর বয়সের সময়ে খণ্ডিত হয় নাই, হইয়াছে কোটি কোটি বৎসর বয়সের সময়ে।
মনু (১; ১৩)– “তিনি দুই খণ্ডের উৰ্ব খণ্ডে স্বর্গ ও অপর খণ্ডে পৃথিবী করিলেন” (কোনো কোনো অসভ্য জাতিও এই মতটি পোষণ করে) এবং মধ্যভাগে আকাশ, অষ্ট দিক ও চিরস্থায়ী সমুদ্র নামক জলাধার প্রস্তুত করিলেন। ব্রহ্ম-অণ্ডটি দুই খণ্ড হইয়া এক খণ্ডে স্বর্গ ও অপর খণ্ডে পৃথিবীর সৃষ্টি হইল এবং মধ্যস্থানটিতে সৃষ্টি হইল আকাশ, অষ্টদিক ও সমুদ্রের। ইহাতে বুঝা যায় যে, সমুদ্র পৃথিবীতে অবস্থিত নহে, উহা শূন্যে অবস্থিত।
মনু (১; ১৫) –“আর সত্ত্ব, রজস্তমো গুণযুক্ত অন্য পদার্থসকল সৃষ্টি করিলেন এবং শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধের গ্রাহক শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা, নাসিকা — এই পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও বাক, পাদ, হস্ত, গুহ্য, উপস্থ –এই পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় সৃষ্টি করিলেন।”
এইখানে দেখা যায় যে, জীবসৃষ্টির পূর্বেই তাহার ইন্দ্রিয়সকল সৃষ্ট হইয়াছে।
মনু (১; ৩২) — “সৃষ্টিকর্তা জগদীশ্বর আপন শরীরকে দুই খণ্ড করিয়া অর্ধাংশ পুরুষ ও অর্ধাংশ নারী হইলেন। ঐ উভয়ের পরস্পর সংযোগে বিরাট নামক পুরুষ উৎপন্ন হইল।”
মনু (১; ৩৩) –“হে দ্বিজসত্তম! সেই বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করিয়া যাহাকে সৃষ্টি করিলেন, আমি সেই মনু। আমাকে সৃষ্টিকর্তা বলিয়া অবগত হও।”
জগদীশ্বরের পুত্র বিরাট জন্মিলেন জগদীশ্বরীর গর্ভে এবং বিরাটের পুত্র মনু জন্মিলেন তাঁহার স্ত্রীর গর্ভে নহে, তপস্যার বলে। মনু সম্পর্কে হন জগদীশ্বরের পৌত্র (নাতি)। এই মনু হইতে উৎপত্তি হইয়াছে মনুষ্য বা মানব –এই নামটির।
মনু (১; ৩৪/৩৫) –“অনন্তর আমি (মনু) প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষে বহুকাল কঠোর তপস্যা করিয়া প্রথমে প্রজাসৃজনে সমর্থ দশজন প্রজাপতির সৃষ্টি করিলাম।”… যথা — “মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ।”
এইখানেও মনু দশজন প্রজা (পুত্র) জন্মাইলেন তপস্যার বলে, কোনো নারীর গর্ভে নহে। বিশেষত কন্যা একটিও জন্মাইলেন না।
মনু (১; ৩৬–৪১) — “মরীচ্যাদি দশ প্রজাপতি আবার সাতজন মনু (মনুষ্য) সৃষ্টি করিলেন এবং সৃষ্টি করিলেন যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ, নক্ষত্র, ধূমকেতু, মানুষ, পশু, পাখি, সরীসৃপ-মৎস্যাদি জলজীব, উদ্ভিদ, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি।”
মরীচ্যাদি দশ প্রজাপতি আবার সাতজন মনু সৃষ্টি করিলেন। কিন্তু এই সকল মনুরা প্রজাপতিদের ঔরসজাত, না হাতে গড়া, তাহার কোনো হদিস নাই। প্রতিমার মতো হাতে গড়া হইলে আবশ্যক ছিল উহাদের প্রাণ প্রতিষ্ঠার এবং ঔরসজাত হইলে আবশ্যক ছিল নারীর। কিন্তু কিছুরই উল্লেখ নাই।
.
আদি মনুর পৌত্র সপ্তমনুর মধ্যে কাহারও স্ত্রীর নামোল্লেখ নাই। অথচ তাহাদের বংশাবলীতে নাকি বর্তমান জগত মানুষে ভরপুর।
প্রজাপতিরাই নাকি সৃষ্টি করিয়াছেন একাধারে যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর ইত্যাদি এবং মানুষ, পশু, পাখি, বজ, নক্ষত্র ইত্যাদি সবই! পরেরগুলির অধিকাংশই পৃথিবীতে এখনও দেখা যায়। কিন্তু যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর ইত্যাদি গেল কোথায়?
মানুষ ও অন্যান্য জীবাদির জন্ম হইয়াছে নাকি প্রজাপতিদের ‘বংশে। কিন্তু মেঘ, বিদ্যুৎ, বজ্র, নক্ষত্র উহাদের বংশে জন্মিল কি রকম। বলা যাইতে পারে যে, প্রজাপতিরা জন্মদাতা নহেন, উহারা সৃষ্টিকর্তা। যদি তাহাই হয়, তবে সৃষ্টিকর্তা হন ব্রহ্মা, বিরাট পুরুষ, মনু ও দশ প্রজাপতি সমেত মোট তেরজন। চৌদ্দ ভুবনে চৌদ্দজন হওয়াই উচিত ছিল।
পৃথিবীতে নিত্য-নূতন জীবসৃষ্টি এখনও হইতেছে। কিন্তু প্রজাপতিরা কেহই বাঁচিয়া নাই। উহারা পরলোক গমনান্তে স্বর্গে বাস করিতেছেন। উত্তর আকাশে সপ্তর্ষিমণ্ডল নামে যে। নক্ষত্রমণ্ডলটি আছে, উহা স্বর্গবাসী প্রজাপতিদেরই মণ্ডল। ওইখানেই নাকি নক্ষত্রের আকারে। সাতজন প্রজাপতি বাস করিতেছেন। যথা –মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ এবং তাঁহার স্ত্রী অরুন্ধতীও। কিন্তু উহারা বর্তমান দুনিয়ায় জীবাদি সৃষ্টির প্রতি আদৌ মনোযোগী নহেন। রাত্রিকালে মিটিমিটি চাহিতেছেন মাত্র।
.
# পার্সি ধর্ম
ইরান দেশের পার্সি ধর্মের প্রবর্তক জোরওয়াস্টার এবং প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম জেন্দ-আভেস্তা। ঐ ধর্মে সৃষ্টিকর্তার নাম অহুর-মজদা। জেন্দ-আভেস্তার মতে, অহুর-মজদার ইচ্ছাক্রমে পৃথিবী ও মনুষ্যাদি প্রাণীকুলের সৃষ্টি হইয়াছিল। কিন্তু জেন্দ-আভেস্তার অংশবিশেষে দুইজন সৃষ্টিকর্তার আভাস পাওয়া যায়।
শেষোক্ত মতে– সৎপদার্থের বা সদগুণসমূহের সৃষ্টিকর্তা একজন এবং অসৎপদার্থ বা অসদগুণের সৃষ্টিকর্তা অপর একজন। সংসারে যত কিছু সৎসামগ্রী অর্থাৎ ভালো, তাহা সৃষ্টি করিয়াছেন অহুর-মজদা (আল্লাহ) এবং যত কিছু অসৎসামগ্রী বা মন্দ, তাহার সৃষ্টিকর্তার নাম আহরিমান (শয়তান)।
ইরানীয়গণের ধর্মগ্রন্থে প্রকাশ –ঐ দুই সৃষ্টিকর্তা আপন আপন স্বভাবের অনুরূপ প্রাণীসমূহ সৃষ্টি করেন। তিন সহস্র বৎসরকাল ঐ দুই সৃষ্টিকর্তার দুই রকম সৃষ্ট প্রাণী দুইটি কল্পরাজ্যে অবস্থিত ছিল। তৎপরে অসদাত্মা আহরিমান সদাত্মার সৃষ্ট প্রাণীর সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হয়। সেই বিবাদের ফলে উভয়ের মধ্যে সন্ধিশর্ত ধার্য হইয়াছিল। তাহাতে অহুর-মজদা নির্দেশ করিয়া দেন, সংসারে নয় হাজার বৎসর আহরিমানের প্রাধান্য থাকিবে, তন্মধ্যে তিন হাজার বৎসর তিনি সর্ববিষয়ে প্রাধান্য লাভ করিতে পারিবেন।
পারসিকদের ধর্মগ্রন্থে আরও লিখিত আছে– পবিত্ৰাত্ম অহুর-মজদা একটি বিশেষ মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক শেষোক্ত তিন হাজার বৎসর আহরিমানকে বিপর্যস্ত করিয়া ফেলেন। সেই সময়ে অহুর-মজদা কর্তৃক স্বর্গীয় দূত (ফেরেশতা) সমূহ এবং পৃথিবী সৃষ্ট হয়। সেই সময়েই চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র প্রভৃতিকে অহুর-মজদা সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ইহার পর আপনার সৃষ্ট দৈত্যগণ কর্তৃক উৎসাহিত হইয়া অসদাত্মা আহরিমান পুনরায় অহুর-মজদার সৃষ্ট পদার্থসমূহ ধংস করিতে বদ্ধপরিকর হয়। তখন অহুর-মজদার সৃষ্ট আকাশ, জল, পৃথিবী, গ্রহ-উপগ্রহ, প্রাণীসমূহের আদিভূত বৃষ এবং সৃষ্টির আদিমনুষ্য ‘গেওমাড’ প্রভৃতির সহিত দৈত্যগণের ঘোর যুদ্ধ চলিতে থাকে (শয়তানের দাগা)।
জেন্দ-আভেস্তার মতে– এই পৃথিবী ক্রমে ক্রমে ছয় বারে (দিনে) সৃষ্ট হইয়াছে (ইহা পবিত্র বাইবেল ও কোরানে অনুমোদিত)। প্রথম বারে আকাশ সৃষ্ট হইয়াছিল, দ্বিতীয় বারে জল, তৃতীয় বারে পৃথিবী, চতুর্থ বারে বৃক্ষাদি, পঞ্চম বারে প্রাণীসমূহ এবং ষষ্ঠ বারে গেওমাড নামক মনুষ্য (আদম?) সৃষ্ট হইয়াছিল।
.
# ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্ম
পবিত্র বাইবেল গ্রন্থখানা কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রন্থের সমষ্টি এবং উহা দুই অংশে বিভক্ত। যাহারা প্রথম অংশ মানিয়া চলেন, তাহাদিগকে বলা হয় ইহুদি এবং যাহারা দ্বিতীয় অংশ মানিয়া চলেন, তাহাদিগকে বলা হয় খ্রীস্টান। কিন্তু প্রথমাংশের ‘আদিপুস্তক’ (Genesis) খানা ইহুদি ও খ্রীস্টান উভয় সম্প্রদায়ই মান্য করিয়া থাকেন এবং উভয় সম্প্রদায়ই সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে আদিপুস্তকখানার লিখিত বিবরণে বিশ্বাসী। কাজেই সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মতামত একই। এইখানে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে আদিপুস্তকে লিখিত বিবরণের আলোচনা করা যাইতেছে।
আদিপুস্তক (১; ১) –“আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন।”
সেকালের মানুষ তাহাদের সাধারণ দৃষ্টিতে দেখিত যে, বিশালতায় আকাশ প্রথমস্থানীয় ও পৃথিবী দ্বিতীয়। তাই বলা হইত, প্রথম সৃষ্ট হইয়াছে আকাশ, পরে পৃথিবী। কেননা বৈদিক ও পারসিক গ্রন্থেও অগ্রে আকাশ সৃষ্টির বিবরণ পাওয়া যায় (মনু : ১; ৮)।
এককালে আকাশকে মনে করা হইত কোনো পদার্থের তৈয়ারী, পৃথিবীর উপরে বৃহৎ ঢাকনি। স্বরূপ। মনে করা হইত –চাঁদ, তারা, সূর্য আকাশের গায়ে লটকানো আছে এবং আকাশ হইতেই শিলা, বৃষ্টি, বজ্র ও তদূর্ধের স্বর্গ হইতে উল্কাপাত হইয়া থাকে। বস্তুত আমরা ঊর্ধ্বদেশে যে। নীলবর্ণের দৃশ্যটি দেখিয়া থাকি, উহা মহাশূন্য বটে। চাঁদ, সূর্য ও তারকারা সকলেই মহাশূন্যে অবস্থিত আছে, এমনকি এই পৃথিবীও।
মহাকাশের নীল রংটি সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত হওয়ায় সমুদ্রের জল নীলবর্ণ বলিয়া ভ্রম হয়। সাগরজলের এই বর্ণটি আকাশে দেখিয়া একদল মানুষ মনে করিতেন, আকাশ জলের তৈয়ারী। তাহারা আরও মনে করিতেন –আকাশ প্রথমটি জলের, দ্বিতীয়টি লৌহের, তৃতীয় তারে, চতুর্থ স্বর্ণের ইত্যাদি। তাহারা জানিতেন না যে, সূর্যরশ্মির সপ্তবর্ণের একটি বর্ণ (নীল বর্ণ) বায়ুস্তরে আটকা পড়ায় ঐ নীল বর্ণের সৃষ্টি হইয়াছে।
আদি (১; ২) –“পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন।” (এই বর্ণনাটি মনুসংহিতার ১; ৮-এর বর্ণনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ)।
আলোচ্য সময় পর্যন্ত মাত্র দুইটি বস্তুই সৃষ্ট হইয়াছিল। একটি আকাশ, অপরটি পৃথিবী। অথচ এইখানে বলা হইতেছে যে, “পৃথিবী অন্ধকার জলধির উপরে ছিল”, এই জলধিটি বানাইল কে এবং কোন্ সময়ে, তাহা বুঝা যায় না।
পৃথিবীর সব অঞ্চলেই মাটিতে গর্ত বা কূপ খনন করিলে (বিভিন্ন গভীরতায়) জল পাওয়া যায়। ইহা দেখিয়াই বোধ হয় সেকালের লোকে মনে করিত, পৃথিবী জলের উপর অবস্থিত।
আদি (১; ৩-৫) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, ‘দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম ‘দিবস’ ও অন্ধকারের নাম ‘রাত্রি’ রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল।”
এইখানে দেখা যায় যে, সূর্য সৃষ্টির আগে শুধু ঈশ্বরের মুখের কথায়ই সন্ধ্যা ও সকাল অর্থাৎ দিন ও রাত্রি হইল।
আদি (১; ৬-৮) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান (শূন্য) হউক ও জলকে দুইভাগে পৃথক করুক। ঈশ্বর এইরূপে বিতান করিয়া বিতানের উদ্ধৃস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত জল পৃথক করিলেন। তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।”
এইখানে কি যে বলা হইল, সহজবুদ্ধি মানুষের পক্ষে তাহা বুঝা কঠিন।
আদি (১; ৯-১০) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল সপ্রকাশ হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। তখন স্থলের নাম ভূমি ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন।”
এইখানে বলা হইতেছে যে, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল একস্থানে সংগৃহীত হউক। তাহাই যদি হয় তবে ভিন্ন ভিন্ন সমুদ্র, নদ-নদী ও হ্রদাদির সৃষ্টি হইল কি রকমে!
আদি (১; ১১-১৩) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি, তৃণ, বীজোৎপাদক ওষধি ও সবীজ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের বৃক্ষ ভূমির উপরে উৎপন্ন হউক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ভূমি তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোৎপাদক ওষধি ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ ফলের উৎপাদক বৃক্ষ উৎপন্ন করিল। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা আর প্রাতঃকাল হইলে তৃতীয় দিন হইল।”
এইখানে দেখা যাইতেছে যে, সৃষ্টির তৃতীয় দিনে তৃণ ও গাছপালা জন্মিল। কিন্তু এই সময় পর্যন্ত সূর্য ও বাতাস সৃষ্টি হওয়ার কোনো বিবরণ নাই। অধুনা দেখা যাইতেছে যে, সূর্যালোক ও বাতাস (কার্বন ডাই-অক্সাইড) ভিন্ন কোনো উদ্ভিদ জন্মিতে বা বঁচিতে পারে না। সেই সময় উহা সম্ভব হইল কি রকমে!
আদি (১; ১৪–১৯) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে জ্যোতির্গণ হউক। সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও বৎসরের জন্য হউক এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশমণ্ডলের বিতানে থাকুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ঈশ্বর দিনের উপর কর্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতি ও রাত্রির উপর কর্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এক জ্যোতি, এই দুই বৃহৎ জ্যোতি এবং নক্ষত্রসমূহ নির্মাণ করিলেন। আর পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্তৃত্ব করণার্থে এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ঐ জ্যোতিসমূহকে আকাশমণ্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন এবং ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা আর প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।”
প্রিয় পাঠকগণের স্মরণ থাকিতে পারে যে, আদিপুস্তকের ১; ৩–৫-এ লিখিত আছে, “পরে ঈশ্বর কহিলেন, ‘দীপ্তি হউক; তাহাতে দীপ্তি হইল। … আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন।” এইখানে আবার দেখা যায় যে, চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের দ্বারা দীপ্তি সৃষ্টি করিলেন, দীপ্তি হইতে অন্ধকার ভিন্ন করিয়া পুনঃ দিন ও রাত্রি সৃষ্টি করিলেন।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়, এই তিনটি ‘দিন’-এর সৃষ্টি হইয়াছিল ঈশ্বরের মহিমা বা কুদরতি আলোকে এবং চতুর্থ দিবসটির সৃষ্টি হইল সৌরালোকে। সূর্যের আলো ও কুদরতি আলো– ইহাতে পার্থক্য কি এবং কুদরতি আলোয় দিন হওয়ার নিয়ম বাতিল করিয়া সৌরালোকে দিন হওয়ার নিয়ম কেন কায়েম করা হইল, তাহা বুঝা মুশকিল। কুদরতি আলোকে তাপ ছিল না, তাই উহা জীবজগতের অনুকূলও ছিল না; বোধ হয় এই কারণেই উহা বাতিল করা হইয়াছে।
আজকাল শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, নক্ষত্রগণ কেহই ক্ষুদ্র আলোর বিন্দু নহে। উহারা প্রত্যেকেই এক একটি সূর্য। কোনো কোনো নক্ষত্র সূর্য অপেক্ষা ছোট, কিন্তু অধিকাংশই সূর্য অপেক্ষা বড়। কোনো কোনো নক্ষত্র সূর্য অপেক্ষা হাজার, লক্ষ বা কোটি কোটি গুণ বড়। সূর্যের ব্যাস মাত্র (প্রায়) ৮ লক্ষ ৬৬ হাজার মাইল। কিন্তু মহাকাশে বেটেল জিউস নামক নক্ষত্রটির ব্যাস প্রায় ২১ কোটি মাইল। কয়েক লক্ষ সূর্য উহার পেটের মধ্যে লুকাইয়া থাকিতে পারে। Omicron Ceti নামক নক্ষত্রটি আয়তনে প্রায় তিন কোটি সূর্যের সমান এবং অ্যান্টারেস নামক নক্ষত্রটির আয়তন প্রায় ১০ কোটি সূর্যের সমান। পক্ষান্তরে চন্দ্র এতোধিক ছোট যে, নক্ষত্রদের সহিত উহার। তুলনাই হয় না। যেহেতু ৫০টি চন্দ্র একত্রিত না করিলে পৃথিবীকে পড়া যায় না এবং পৃথিবী হইতে সূর্য প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড়। অর্থাৎ চন্দ্র সূর্যের সাড়ে ছয় কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। অথচ কোটি কোটি অতিকায় মহাজ্যোতিষ্কদের সাধারণ নক্ষত্র বলিয়া, চন্দ্র ও সূর্যকে বলা হইয়াছে “এই দুই বৃহৎ জ্যোতি”। অর্থাৎ মানুষ তাহার সাধারণ দৃষ্টিতে যেরূপ দেখিয়া থাকে, উহা তাহাই।
সৃষ্টিকর্তা চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রদের প্রকৃত অবয়ব সম্বন্ধে নিশ্চয়ই অবহিত ছিলেন বা আছেন; অবগত ছিল না শুধু মানুষ, দূরবীন আবিষ্কারের পূর্বে। উহাদের সম্পর্কে এখন মানুষের ধারণার পরিবর্তন হইয়াছে এবং সঠিক জ্ঞান জন্মিয়াছে। সে যাহা হউক, উপরোক্ত বর্ণনাটি মানবীয় জ্ঞানেরই পরিচায়ক, ঐশ্বরিক জ্ঞানের নহে।
আদি (১; ২০-২৪) — “পরে ঈশ্বর কহিলেন, জল নানা জাতীয় জঙ্গম প্রাণীবর্গে প্রাণীময় হউক এবং ভূমির উর্ধে আকাশমণ্ডলের বিতানে পক্ষীগণ উড়ুক। তখন ঈশ্বর বৃহৎ তিমিগণের ও যে নানা জাতীয় জগম প্রাণীবর্গে জল প্রাণীময় আছে, সে সকলের এবং নানা জাতীয় পক্ষীর সৃষ্টি করিলেন। পরে ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। আর ঈশ্বর সে সকলকে আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, তোমরা প্রজাবন্ত হও ও বহুবংশ হও, সমুদ্রের জল পরিপূর্ণ কর এবং পৃথিবীতে পক্ষীগণের বাহুল্য হউক। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে পঞ্চম দিবস হইল।”
আদি (১; ২৫-২৭) –“পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি নানা জাতীয় প্রাণীবর্গ অর্থাৎ স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু, সরীসৃপ ও বন্য পশু উৎপাদন করুক; তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলত ঈশ্বর স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বন্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী গ্রাম্য পশু ও স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী যাবতীয় ভূচর সরীসৃপ নির্মাণ করিলেন। আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল উত্তম। পরে ঈশ্বর কহিলেন, আমরা আমাদের প্রতিমূর্তিতে আমাদের সাদৃশ্যে মনুষ্য নির্মাণ করি। আর তাহারা সমুদ্রের মৎস্যদের উপরে, আকাশের পক্ষীদের উপরে, পশুগণের উপরে, সমস্ত পৃথিবীর উপরে ও ভূমিতে গমনশীল যাবতীয় সরীসৃপের উপরে কর্তৃত্ব করুক। পরে ঈশ্বর আপনার প্রতিমূর্তিতে মনুষ্যকে সৃষ্টি করিলেন, ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতেই তাহাকে সৃষ্টি করিলেন। … আর সন্ধ্যা ও। প্রাতঃকাল হইলে ষষ্ঠ দিবস হইল।”
পূর্বোক্ত বিবরণগুলিতে জানা যায় যে, ঈশ্বর পঞ্চম দিনে সৃষ্টি করিলেন জগতের যাবতীয় জলচর ও খেচর প্রাণী এবং ষষ্ঠ দিনের সম্ভবত সকাল বেলা সৃষ্টি করিলেন যাবতীয় ভূচর প্রাণী। ঐ সমস্ত জীব সৃষ্টি করিতে ঈশ্বর কোনোই উপাদান ব্যবহার করেন নাই, ব্যবহার করিয়াছেন শুধু কথা। বিশেষত কোনো প্রাণী সৃষ্টি করিতেই তাহার একাধিক দিন সময় লাগে নাই। আর অধুনা একটি হস্তী সৃষ্টি করিতে দুই বৎসর, একটি মানুষ বা গরু সৃষ্টি করিতে নয় মাস (চলিত কথায় দশ মাস), একটি ছাগল ছয় মাস, কুকুর তিন মাস এবং একটি মশা সৃষ্টি করিতেও ঈশ্বরের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে।
ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিলেন সম্ভবত ষষ্ঠ দিনের বিকাল বেলা, নিজের আকৃতিতে। এই অনুচ্ছেদে তিনবারই উল্লিখিত হইয়াছে যে, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিলেন নিজের প্রতিমূর্তিতে। ইহাতে বুঝা যায় যে, ঈশ্বর মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট জীব। কেননা আদিপুস্তকের ১; ২-এ লিখিত আছে যে, ঈশ্বরের আত্ম জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন। যে ঈশ্বর মানুষের। আকৃতিবিশিষ্ট এবং আত্মা বা জীবন ধারণ করেন, তিনি হ’ন জীবশ্রেণীভুক্ত এবং তিনি নিরাকার নহেন, নরাকার।
আদি (২; ১/১) –“এইরূপে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং বস্তুব্যুহ সমাপ্ত হইল। পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃতকার্য হইতে নিবৃত্ত হইলেন। সেই সপ্তম দিনে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হইতে বিশ্রাম করিলেন।”
ছয় দিন কাজ করিয়া ঈশ্বর সপ্তম দিনে বিশ্রাম করিলেন। অসীম শক্তিসম্পন্ন নিরাকার ঈশ্বরের পক্ষে না হইলেও নরাকার ঈশ্বরের পক্ষে পরিশ্রমে ক্লান্ত হওয়া স্বাভাবিক, কাজেই বিশ্রাম আবশ্যক। হয়তো কেহ বলিতে পারেন যে, ঐ বিশ্রাম তাঁহার কায়িক বা মানসিক শ্রান্তিজনিত নহে, উহা তাঁহার কার্য হইতে বিরত থাকা।
আলোচ্য ছয় দিনে ঈশ্বর সৃষ্টি করিয়াছিলেন একটি চন্দ্র, একটি সূর্য, একটি পৃথিবী ও হাজার ছয়েক নক্ষত্র (ছয় হাজারের বেশি নক্ষত্র খালি চোখে দেখা যায় না) এবং যাবতীয় জীবের এক এক জোড়া করিয়া জীব মাত্র। আর বর্তমানে মহাকাশে দেখা যাইতেছে দশটি পৃথিবী (গ্রহ), গোটা ত্রিশেক চন্দ্র (উপগ্রহ) ও হাজারো কোটি সূর্য (নক্ষত্র)। হয়তো ঐ সকল সূর্যেরও গ্রহ-উপগ্রহ থাকিতে পারে। ইহাতে দেখা যাইতেছে যে, ঈশ্বর এই সকল সৃষ্টি করিয়াছেন আদিসৃষ্টির পরে এবং এখনও মহাকাশে নূতন নূতন নক্ষত্র ও নীহারিকা সৃষ্টি করিতেছেন। আর জীবসৃষ্টি ঈশ্বর ঐ ছয়দিনে যাহা করিয়াছেন, বর্তমানে প্রতি মিনিটে করেন তাহার চেয়ে বেশি। মশা, মাছি বা পিপীলিার কথা তুলিলাম না। আলোচ্য ছয়দিনে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করিয়াছিলেন মাত্র দুইটি, আর বর্তমানে প্রতি মিনিটে সৃষ্টি করিতেছেন প্রায় ৪২টি। তথাপি সেই দিন হইতে এখন পর্যন্ত ৫,৯৭৪ বৎসরে তিনি দ্বিতীয়বার বিশ্রামের নামও লইলেন না (বাইবেলের মতে, আদম বা জগত সৃষ্ট হইয়াছিল খ্রী. পূ. ৪০০৪ সালে[২] এবং বর্তমানে ১৯৭০ সাল)।
আজ প্রত্যেক ব্যক্তি অবগত আছেন যে, লোকসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে ক. পৃথিবীময় খাদ্যসংকট দেখা দিয়াছে এবং উহার প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রনেতাগণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিধি প্রবর্তনে বাধ্য হইতেছেন। ইহাতে মানব জাতির ভবিষ্যত কল্যাণের পথ পরিষ্কার হইতেছে বটে, কিন্তু গোড়া ধার্মিকগণ ইহাতে ‘মহাপাপ মহাপাপ’ বলিয়া হৈ চৈ করিতেছেন। এমতাবস্থায় ঈশ্বর যদি প্রতি সপ্তাহের বিশ্রামবারে অন্তত মানুষ সৃষ্টির কাজে বিরত থাকিয়া বিশ্রাম লইতেন, তবে বিশ্বমানবের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইত।
ঈশ্বর বিশ্রাম লইয়াছিলেন মাত্র এক রোজ শনিবার আর বনিআদমকে বিশ্রাম লইতে বলিয়াছেন চিরকালের শনিবার। ঐদিন দুনিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম হইতে বিরত থাকার হুকুম দিয়াছেন ঈশ্বর এবং উহা অমান্যকারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ইহুদি জাতি উহা পুরাপুরিই পালন করিতেছেন এবং অন্যান্য সেমিটিক জাতিও কিছুটা পালন করেন, হয়তো একদিন আগে বা পরে। কিন্তু আলোচ্য বিশ্রামবার হাল জামানায় আন্তর্জাতিকভাবে দাঁড়াইয়াছে রবিবারে।
আদি (২; ৭) –“আর সদাপ্রভু ঈশ্বর মৃত্তিকার ধূলিতে আদমকে নির্মাণ করিলেন এবং তাহার নাসিকায় ফুঁ দিয়া প্রাণবায়ু প্রবেশ করাইলেন, তাহাতে মনুষ্য সজীব প্রাণী হইল।”
বাইবেলের (আদিপুস্তকে) সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় বায়ু ও অগ্নি সৃষ্টির কোনো উল্লেখ দেখা যায় না। ঈশ্বর ফুঁ দিয়া আদমের দেহে যে প্রাণ-বায়ু প্রবেশ করাইলেন, উহা বায়ুর ব্যবহার মাত্র, সৃষ্টি নহে। উহাতে মনে হয় যে, হয়তো ঈশ্বর বায়ু ও অগ্নি সৃষ্টি করেন নাই, নচেৎ বাইবেল লেখকের ভুল।
আদি (২; ৮) –“আর সদাপ্রভু ঈশ্বর পূর্বদিকে এদনে, এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন।”
অত্র বিবরণে দেখা যায় যে, আদমের বাসস্থান ‘এদন’ পূর্বদিকে অবস্থিত? কিন্তু কোন্ স্থান হইতে পূর্ব, তাহার উল্লেখ নাই।
আদি (২; ২১-২২)– “পরে সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোরনিদ্রায় মগ্ন করিলেন, তিনি নিদ্রিত হইলেন, আর তিনি তাঁহার একখানা পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পুরাইলেন। সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন ও তাহাকে আদমের নিকটে আনিলেন।”
আদমকে ঘোরনিদ্রায় অভিভূত করিয়া তাহার বক্ষের অস্থি গ্রহণ করা ডাক্তারদের ক্লোরোফরম দ্বারা অপারেশন করারই অনুরূপ। তবে ক্লোরোফরম ব্যতীত সম্মোহন (Hypnotism) শক্তির দ্বারাও মানুষকে গভীর নিদ্রায় অভিভূত করা যায় এবং তদবস্থায় অপারেশন করাও চলে। কিন্তু এইখানে প্রশ্ন থাকিল এই যে, আদমের বক্ষের অস্থি গ্রহণ করা হইল কোনো অস্ত্রের দ্বারা কাটিয়া, ছিঁড়িয়া?
আদমের শরীর গঠন করা হইল ধূলি বা মাটির দ্বারা। কিন্তু অন্যান্য জীবাদিসৃষ্টি কি দিয়া হইল, তাহার কোনো উল্লেখ নাই; বোধ হয় অন্য কিছু। অথচ মানুষ ও পশু-পাখির রক্ত, মাংস, অস্থি-মজ্জা ইত্যাদিতে বিশেষ পার্থক্য লক্ষিত হয় না।
আদম ভিন্ন অন্য কোনো জীব সৃষ্টি করিতেই ঈশ্বরের কোনো উপাদানের দরকার হয় নাই। আদিনারী সৃষ্টির কাজে উপাদান লাগিল কেন এবং উপাদান লাগিলেও মাটি-পাথরাদি নানাবিধ। মশলা থাকিতে আদমের অঙ্গহানি করার আবশ্যক ছিল কি?
বলা যাইতে পারে যে, পুরুষের অঙ্গ হইতে নারীর সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়াই নারী ও পুরুষ এর অগাভি সম্পর্ক। কিন্তু দেখা যায় যে, পশু-পাখিদেরও স্ত্রী-পুরুষে প্রেমের বন্ধন যথেষ্ট এবং মানুষের মধ্যেও স্ত্রী ত্যাগ করা (তালাক) অপ্রতুল নহে।
.
# বৌদ্ধ ধর্ম
বৌদ্ধরা বলেন যে, এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কেহ নাই; জগত অনন্তকাল বিদ্যমান আছে এবং থাকিবে। চিরকালই বিশ্বের আকৃতি একরূপ আছে এবং থাকিবে। কর্মানুসারে প্রাণীসমূহ সংসারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে মাত্র।
.
# ইসলাম ধর্ম
মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরানের মতে, নির্দিষ্ট কালে আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবী সৃষ্ট হইয়াছে। এবং নির্দিষ্ট সময়ে উহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে।
সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে পবিত্র কোরানের বহুস্থানেই বিক্ষিপ্তভাবে অধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা
সুরা সেজদা (১; ৪) –“তিনি আল্লাহ, যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যে যাহা আছে, তাহা ছয় দিনে সৃষ্টি করিয়াছেন।”
সুরা সেজদা (৭ আয়াত) –“তিনিই মৃত্তিকা হইতে মানবসৃষ্টি আরম্ভ করিয়াছেন।”
সুরা সাফফাত (৬)— “নিশ্চয় আমি পার্থিব আকাশকে নক্ষত্রপুঞ্জের শোভায় শোভিত করিয়াছি।”
সুরা হামিম (৯/১০/১২) — “তোমরা কি তাহার প্রতি অবিশ্বাস করিতেছ –যিনি দুই দিনে এই পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন … এবং তিনি তন্মধ্যে উহা হইতে সমুচ্চ পর্বতমালা সৃষ্টি করিয়াছেন এবং চারি দিবসে তন্মধ্যে উহার উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারিত করিয়াছেন। … অনন্তর তিনি দুই দিবসের মধ্যে সপ্ত আকাশ সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন।”
সুরা ক্বাফ (৩৮) –“নিশ্চয়ই আমি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ের অন্তর্গত বিষয়সমূহ ছয় দিবসে সৃষ্টি করিয়াছি।” ইত্যাদি।
মুসলমানদিগের ধর্মগ্রন্থমতে সৃষ্ট প্রাণীর চারিটি স্তর। যথা –ফেরেশতা, জ্বীন, মনুষ্য ও শয়তান।
ফেরেশতা বা স্বর্গীয় দূত –তাহারা অগ্নি (নূর) হইতে উৎপন্ন; তাহারা নির্মল এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণে সমর্থ। তাহাদের পানাহারের প্রয়োজন হয় না এবং তাহাদের (মানুষের মতো) জন্ম-মৃত্যু নাই, তাহাদের সন্তান-সন্ততি জন্মগ্রহণ করে না। জেব্রাইল, মেকাইল, এস্রাফিল ও আজরাইল স্বর্গীয় দূতগণের মধ্যে প্রধান স্থানীয়।
জ্বীন –উহাদের জন্ম-মৃত্যু এবং নারী-পুরুষ ভেদ ও সন্তান-সন্ততিও আছে। উহাদের পাপ পুণ্যের ফলাফলস্বরূপ স্বর্গ বা নরকবাসও নির্ধারিত আছে। উহারা নাকি ধূমশূন্য অগ্নির দ্বারা তৈয়ারী। এবং মরুদেশের বাসিন্দা। উহারা দৈত্য-দানবের ন্যায় অনিষ্টকারী।
মনুষ্য –ইহাদের আদিপুরুষ আদম। আদমের সৃষ্টি সম্বন্ধে কথিত হয় যে, আদমকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহ ফেরেশতাদের মতামত জানিতে চাহিলে, “ফেরেশতাদের ন্যায় আদমের বংশধরগণ আল্লাহর অনুগত থাকিবে না” –এই বলিয়া তাহারা আদম সৃষ্টিতে অমত জানায়। তথাপি আল্লাহ আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিছু মাটি লইবার জন্য এস্রাফিলাদি ফেরেশতাগণকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তাহারা আদম সৃষ্টির জন্য মাটি চাহিলে, মাটি এই বলিয়া দোহাই দেয় যে, আদম জাতি আল্লাহর অবাধ্য হইবে এবং তাহাদের দ্বারা দোজখ পূর্ণ করা হইবে। সুতরাং মাটি আদমের দেহের উপকরণ হইয়া দোজখের শাস্তি ভোগ করিতে রাজি নহে। ইহা শুনিয়া একে একে তিন ফেরেশতা খালি হাতে ফিরিয়া যায় এবং শেষে আজরাইল ফেরেশতা পৃথিবীতে আসিয়া মাটির দোহাই অগ্রাহ্য করিয়া জোরপূর্বক কিছু মাটি লইয়া যায়। আজরাইল ফেরেশতার প্রভুর আদেশ পালন, কর্তব্যনিষ্ঠা, অনমনীয় মনোবল ইত্যাদি গুণের জন্য আল্লাহ তাহাকে মানুষের জীবন হরণ (জান কবজ) করিবার কাজে নিয়োগ করেন। অতঃপর বিশ্বসৃষ্টির ষষ্ঠ দিনের বিকাল বেলা বৈকালিক উপাসনার পর পবিত্র মক্কার মাটি দ্বারা আল্লাহ আদমের শরীর তৈয়ার ও তাহাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
অতঃপর আদমের দেহস্থ খানিকটা অংশ লইয়া হাওয়া নাম্নী একটি নারী তৈয়ার করিয়া উভয়কে থাকিবার জন্য আল্লাহ বেহেশতে স্থান দান করেন। বেহেশতে থাকাকালীন আল্লাহর হুকুম অমান্য করিয়া গন্ধম নামক ফল ভক্ষণের অপরাধে আদম সপরিবারে নির্বাসিত হন পৃথিবীতে। সন্ধীপ নামক স্থানে আদম পতিত হন ও বিবি হাওয়া নিপতিত হন জেদ্দায় এবং বহু বৎসর পরে তাঁহাদের পুনর্মিলন হয় আরাফাত-এ। সেখানে থাকিয়া তাহাদের সন্তান-সন্ততি জন্মিয়াছে ১২০টি এবং তাহাদেরই বংশাবলীতে পৃথিবী মানুষে ভরপুর। আদমের বংশজাত বলিয়া মানুষকে বলা হয় ‘আদমী’ (হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, মনুর বংশজাত বলিয়া উহারা মানব’)।
উপরোক্ত ঘটনাবলীর স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ বলা হয় যে, বিবি হাওয়া গন্ধম ফল ছিড়িলে, উহাতে সেই গাছটি ব্যথা পাইয়াছিল ও ছিন্ন বোটা দিয়া কষ ঝরিতেছিল। তাই গন্ধম বৃক্ষ বিবি হাওয়াকে এই বলিয়া অভিশপ্ত করে যে, তাহার দেহ হইতেও প্রতি মাসে একবার কিছু একটা ক্ষরণ হইবে এবং সে সন্তান প্রসবান্তে ব্যথায় কষ্ট পাইবে। বর্তমান মানবীদের ‘মাসিক ঋতু এবং প্রসবান্তে ‘হ্যাতাল ব্যথা’ –উভয়ই নাকি গন্ধম বৃক্ষের অভিশাপের ফল। আরও বলা হয় যে, আদমের বাম পঞ্জরাস্থির দ্বারা বিবি হাওয়াকে নির্মাণ করা হইয়াছিল, সেই জন্য নাকি পুরুষ মানুষের বাম পঞ্জরে একখানা অস্থি কম।
শয়তান— শয়তান পূর্বে ছিল মকরম নামক বেহেসী একজন প্রথম শ্রেণীর ফেরেশতা। মকরম সেখানে খোদাতালার আদেশমতো আদমকে সেজদা না করায় ‘শয়তান’ আখ্যা পাইয়া চিরকাল আদম-বংশকে অসৎকাজে প্ররোচনা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করিয়া পৃথিবীতে আসে। এবং সে অদ্যাবধি মানুষকে অসৎকাজে প্ররোচনা (দাগা) দিয়া বেড়াইতেছে।
কেহ কেহ বলেন যে, শয়তান উভলিঙ্গ জীব। উহার এক উরুতে পুংলিগ এবং অপর উরুতে স্ত্রীলিগ। উরুদ্বয়ের সম্মিলনেই শয়তানের গর্ভসঞ্চার হয় এবং প্রতি গর্ভে সন্তান জন্মে দশটি করিয়া। উহাদের নাম হয় যথাক্রমে –জলিতন, ওয়াসিন, নফস, আওয়াম, আফাফ, মকার, মসুদ, দাহেম, ওলহান ও বার। ইহারা ক্ষেত্রবিশেষে থাকিয়া প্রত্যেকে বিশেষ বিশেষ দাগাকার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। বিশেষত উহাদের মানুষের মতো মরণ নাই। যেদিন মানব জাতি লয় পাইবে (কেয়ামতের দিন), সেই দিন শয়তানদের মৃত্যু ঘটিবে।
পবিত্র কোরানের প্রসিদ্ধ অনুবাদক ডক্টর সেল অনুসন্ধান করিয়া বলিয়া গিয়াছেন, “স্বর্গদূত সংক্রান্ত অভিব্যক্তিতে মোহাম্মদ (সা.) ইহুদিদিগের মতেরই অনুসরণ করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়। এদিকে ইহুদিগণ আবার পারসিকদিগের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছিলেন।” জ্বীন সম্বন্ধে তিনি বলেন, “ইহুদিদিগের মধ্যে শেদিম (Shedim) নামক এক শ্রেণীর দৈত্যের পরিচয় পাওয়া যায়; জ্বীনগণ উহাদেরই রূপান্তর।”