এই যোগের নাম অষ্টঙ্গযোগ, কারণ এর প্রধান অঙ্গ আটটি। যথা-
প্রথম-যম। যোগের এই অঙ্গটি সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি সারা জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে। এটি আবার পাঁচ ভাগে বিভক্তঃ
(১) কায়মনোবাক্যে হিংসা না করা।
(২) কায়মনোবাক্যে লোভ না করা।
(৩) কায়মনোবাক্যে পবিত্রতা রক্ষা করা।
(৪) কায়মনোবাক্যে সত্যনিষ্ঠ হওয়া।
(৫) কায়মনোবাক্যে বৃথা দান গ্রহন না করা(অপ্রতিগ্রহ)।
দ্বিতীয়-নিয়ম। শরীরের যত্ন, স্নান, পরিমিত আহার ইত্যাদি।
তৃতীয়-আসন। মেরুদন্ডের উপর জোর না দিয়ে কটিদেশ, স্কন্ধ ও মাথা ঋজুভাবে রাখতে হবে।
চতুর্থ-প্রণায়াম। প্রাণবায়ুকে আয়ত্ব করবার জন্য শ্বাসপ্রশ্বাসের সংযম।
পঞ্চম-প্রত্যাহার। মনকে বহির্মুখ হ’তে না দিয়ে অন্তর্মুখ ক’রে কোন জিনিস বোঝবার জন্য বারংবার আলোচনা।
ষষ্ঠ-ধারণা। কোন এক বিষয়ে মনকে একাগ্র করা। সপ্তম-ধ্যান। কোন এক বিষয়ে মনের অবিচ্ছিন্ন চিন্তা।
অষ্টম-সমাধি। জ্ঞানের আলোক লাভ করাই আমাদের সকল সাধনার লক্ষ্য।
যম ও নিয়ম সারা জীবন ধ’রে আমাদের অভ্যাস করতে হবে। জোঁক যেমন একটা ঘাস দৃঢ়ভাবে না ধরা পর্যন্ত আর একটা ছেড়ে দেয় না, তেমনি একটি সাধন ছাড়বার আগে অপরটি বেশ ক’রে বোঝা এবং অভ্যাস করা চাই।
আজকের আলোচ্য বিষয়-প্রাণায়াম অর্থাৎ প্রাণের নিয়মন। রাজযোগের সাধনায় প্রাণবায়ু চিত্তভূমির মধ্য দিয়ে আমাদের আধ্যাত্মিক রাজ্যে নিয়ে যায়। প্রাণবায়ু বা শ্বাসপ্রশ্বাস হচ্ছে সমগ্র দেহ-যন্ত্রের নিয়ামক মূল চক্র (Fly-wheel)। প্রাণ প্রথমে ফুসফুসে, ফুসফুস থেকে হৃদয়ে, হৃদয় থেকে রক্ত-প্রবাহে, সেখান থেকে মস্তিষ্কে, সব শেষে মস্তিষ্ক থেকে মনে কাজ করে। ইচ্ছা-শক্তি বাহ্য সংবেদন উৎপন্ন করতে পারে, বাহ্য সংবেদনও ইচ্ছা-শক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে। আমাদের ইচ্ছা দুর্বল; আমরা এতই বদ্ধ যে, ইচ্ছার যথার্থ শক্তিকে আমরা উপলব্ধি করি না। আমাদের অধিকাংশ কার্যের প্রেরণা আসে বাইরে থেকে; বহিঃপ্রকৃতি আমাদের অন্তরের সাম্যভাব নষ্ট করে, কিন্তু আমরা তার সাম্যভাব নষ্ট করিতে পারি না (যেটা আমাদের পারা উচিত)। কিন্তু এ-সবই ভুল, প্রকৃতপক্ষে অধিকতর শক্তি রয়েছে আমাদের ভেতরে।
যাঁরা নিজেদের অন্তরের চিন্তারাজ্য জয় করেছেন, তাঁরাই বড় বড় সাধু ও আচার্য, তাঁদের কথার শক্তিও তাই এত বেশী। উচ্চ দুর্গে আবদ্ধ কোন মন্ত্রীকে তাঁর স্ত্রী গুবরে-পোকা, মধু, রেশমের সুতো, দড়ি ও কাছি দিয়ে উদ্ধার করেছিলেন-এই রূপকের১ সাহায্যে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে-প্রাণের নিয়মন থেকে কি ক’রে ক্রমে ক্রমে মনোরাজ্য জয় করা যায়। প্রাণায়াম-রূপ রেশমসুতোর সাহায্যেই একটার পর একটা শক্তি আয়ত্ত ক’রে আমরা একাগ্রতা-রূপ রজ্জু ধ’রব, আর সেই রজ্জুর সাহায্যে দেহ-কারাগার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে প্রকৃত মুক্তি লাভ ক’রব।
১ এই খন্ডেই ‘রাজযোগ’ গন্থের ২য় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
মুক্তি লাভ ক’রে তার সাধনগুলি আমরা ছেড়ে দিতে পারি।
প্রাণায়ামের অঙ্গ তিনটিঃ ১মঃ পূরক-শ্বাসগ্রহণ। ২য়ঃ কুম্ভক-শ্বাসরোধ। ৩য়ঃ রেচক-শ্বাসত্যাগ।
দুটি শক্তি-প্রবাহ মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে এসে মেরুদন্ড বয়ে তার শেষভাগে পরস্পরকে অতিক্রম ক’রে আবার মস্তিষ্কে ফিরে যায়। প্রবাহ-দুটির একটির নাম সূর্য (পিঙ্গলা), এটি মস্তিষ্কের দক্ষিণার্ধ থেকে বেরিয়ে মেরুদন্ডের বাঁদিকে মস্তিষ্কের ঠিক নিম্নে একবার পরস্পরকে অতিক্রম করে, আবার মেরুর নীচে চার (৪)-এর অর্ধেকের মতো আকারে আর একবার পরস্পরকে অতিক্রম করে যায়।
অন্য প্রবাহটির নাম চন্দ্র (ঈড়া),এর গতি পিঙ্গলার ঠিক উলটো এবং ৪-এর আকার সম্পূর্ণ করে। দেখতে চার(৪)-এর মতো হলেও এর নীচের দিকটা উপরের দিকের চেয়ে অনেকটা লম্বা। এই দুটো প্রবাহ দিনরাত্রি বইছে, আর বিভিন্ন কেন্দ্রে যাকে আমরা ‘চক্র’ (Plexuses) বলি, এরা প্রাণশক্তি সঞ্চয় করে, কিন্তু তা আমরা প্রায় জানতে পারি না। একাগ্রতার দ্বারা এই শক্তিসমূহ এবং সমস্ত শরীরে তাদের ক্রিয়া আমরা অনুভব করতে পারি। এই ‘সূর্য-ও চন্দ্র’-এর প্রবাহ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তাই শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত ক’রে আমরা সমস্ত দেহটাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারি।
কঠ-উপনিষদে দেহকে রথ, মনকে লাগাম, বুদ্ধিকে সারথি, ইন্দ্রিয়গুলিকে ঘোড়া এবং ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়গুলিকে রাস্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রথী আত্মা ও সারথি বুদ্ধি সেই রথে বসে আছেন। সারথি যদি বুদ্ধিরূপ ঘোড়াকে সংযত করতে না পারে, তা হ’লে কখনও লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না, দুষ্ট ঘোড়ার মতো ইন্দ্রিয়গুলি রথকে যেখানে খুশি টেনে নিয়ে গিয়ে রথীকে ধ্বংস করেও ফেলতে পারে। কিন্তু এই দুটি শক্তি-প্রবাহ(ঈড়া ও পিঙ্গলা।) দুষ্ট অশ্বকে দমন করবার জন্য সারথির হাতে লাগামের মতো; এ দুটি(লাগাম) আয়ত্তে রেখে সারথি ওগুলিকে (অশ্ব) নিয়ন্ত্রণ করবে। নীতিপরায়ণ হবার শক্তি আমাদের লাভ করতে হবে, তা না হ’লে আমাদের কর্মগুলিকে আমরা কিছুতেই নিয়ন্ত্রিত করতে পারব না। নীতিশিক্ষাগুলি কি ক’রে কর্মে পরিণত করতে পারা যায়, যোগ সেই শিক্ষা দেয়। নীতিপরায়ণ হওয়াই যোগের উদ্দেশ্য। জগতের বড় বড় আচর্যমাত্রেই যোগী ছিলেন এবং প্রত্যেক শক্তিপ্রবাহকে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে বশে এনেছিলেন। এই প্রবাহ-দুটিকে যোগীরা মেরুর নিম্নভাগে(মূলাধারে) সংযত ক’রে মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে চালিত করেন, আর তখনই তা জ্ঞান-প্রবাহে পরিণত হয়, এ শুধু যোগীর মধ্যেই বর্তমান।
প্রাণায়াম সম্বন্ধে দ্বিতীয় সাধন-প্রণালী-সকলের পক্ষে এক রকম নয়। প্রাণায়াম-একটা ছন্দের তালে তালে নিয়মিতভাবে করতে হবে এবং তা করবার সহজ উপায় হচ্ছে গণনা করা, তবে সেটা একেবারে যন্ত্রের মতো হয়ে পড়ে, তাই গণনায় নির্ধারিত সংখ্যায় আমরা পবিত্র ‘ওঁ’কার মন্ত্র জপ করি।
এই প্রাণায়ামে অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা দক্ষিণ নাসা বন্ধ ক’রে চারবার ‘ওঁ’ জপ করতে করতে বাম নাসায় ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে হয়।
তারপর বাম নাকে তর্জনী রেখে দুটি নাসাই বন্ধ কর, মাথাটিকে বুকের উপর অবনমিত রেখে মনে মনে আটবার ‘ওঁ’ জপ করতে করতে শ্বাস রোধ ক’রে রাখো।
তারপর মাথা ফের সোজা ক’রে দক্ষিণ নাসা থেকে অঙ্গুষ্ঠ উঠিয়ে নিয়ে মনে মনে চারবার ‘ওঁ’ জপ করতে করতে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলো।
যখন শ্বাস ফেলা শেষ হয়ে যাবে, তখন ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বের ক’রে দেবার জন্য তলপেট সঙ্কুচিত করবে। তারপর বাম নাসা বন্ধ ক’রে চারবার ‘ওঁ’ জপ করতে করতে দক্ষিণ নাসা দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে হবে।
তারপর অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে দক্ষিণ নাসা বন্ধ ক’রে মাথা অবনমিত রেখে শ্বাস রোধ ক’রে আটবার ‘ওঁ’ জপ করবে। তারপর আবার মাথা সোজা ক’রে বাম নাসা খুলে দিয়ে চারবার ‘ওঁ’ জপ করতে করতে শ্বাস ত্যাগ করবে। সেই সময় আগের মতো তলপেট সঙ্কুচিত করা চাই।
যখনই বসবে, এইরকম দুবার করবে, অর্থাৎ দক্ষিণ নাসায় দুবার ও বাম নাসায় দুবার-মোট চারবার প্রাণায়াম করবে। বসবার আগে প্রার্থনা ক’রে নিলে ভাল হয়।
এক সপ্তাহ ধ’রে এইরকম অভ্যাস প্রয়োজন। তারপর ধীরে ধীরে প্রাণায়ামের সংখ্যা বাড়িয়ে দাও; সঙ্গে সঙ্গে জপের (শ্বাস-গ্রহন, রোধ ও ত্যাগের) সংখ্যাও সেই অনুপাতে বাড়াতে হবে, অর্থাৎ যদি ছ-বার প্রাণায়াম কর, তা হ’লে শ্বাস নেবার সময় ছ-বার, নিশ্বাস ফেলবার সময় ছ-বার ও কুম্ভকের সময় বারো বার ‘ওঁ’ জপ করতে হবে। এই প্রাণায়াম-অভ্যাসের দ্বারা আমরা আরও বেশী পবিত্র, নির্মল ও আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণ হবো। বিপথে চালিত হ’য়ো না; কোন শক্তি (সিদ্ধাই) চেও না। প্রেমই একমাত্র শক্তি, যা চিরকাল থাকে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। যারা রাজযোগের পথে ভগবানের কাছে আসতে চায়-তাদের মানসিক, শারীরিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে শক্ত সবল হ’তে হবে। প্রতিটি পা ফেলবে আলোকিত পথে।
লক্ষের মধ্যে একজন বলতে পারে, ‘এই সংসার অতিক্রম ক’রে আমি ভগবানের কাছে পৌঁছব।’ সত্যের সম্মুখীন হ’তে পারে, এমন লোক খুব কম, কিন্তু তবু কোন-কিছু করতে গেলে সত্যের জন্য আমাদের মরতেও প্রস্তুত থাকতে হবে।