০২. দিল্লি থেকেই ট্রেনটা ছেড়েছিল

॥ দুই ॥

দিল্লি থেকেই ট্রেনটা ছেড়েছিল চার ঘণ্টা দেরিতে। পরশু দিন বাংলা বন্ধ থাকায় গাড়ি সময়মতো পৌঁছোয়নি, তাই দেরি। বিকেল চারটের ট্রেন ছাড়ল রাত আটটায়। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কপালে দুর্ভোগ আছে। এ সি টু টায়ারের আরামদায়ক নিরাপত্তায়ও কিছু লোক উদ্বেগ বোধ করছে। বিকেল দুটো নাগাদ এ সি ডিলাক্স এক্সপ্রেস হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা। সেটা স্বাভাবিক নিয়মে। চারঘন্টা যোগ করলে দাঁড়াবে রাত দশটা। কিন্তু বিলম্বিত ট্রেনের ভাগ্যও বিড়ম্বিত বলে ভারতীয় রেলের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী আরও দু’-তিন ঘণ্টা দেরি হতে পারে। রাত বারোটা-একটায় হাওড়ায় পৌঁছে একটিও ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, কোথাও পৌঁছানো অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত বসে থাকতে হবে স্টেশনে। কী গেরো।

উত্তেজনায় উদ্বেগে শ্যামল বারেবারে উঠে সিগারেট খেতে করিডোরে যাচ্ছে আর কন্ডাক্টর গার্ড এবং সহযাত্রীদের সঙ্গে কলকাতায় পৌঁছানোর সম্ভাব্য সময় নিয়ে জরুরি আলোচনা সেরে আসছে। তার সঙ্গে বউ-বাচ্চা-লটবহর।

বকুল একটা ধমক দিল, তুমি অত অস্থির হচ্ছো কেন বলো তো! এ ট্রেনে তো আরও হাজার কয়েক প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে, না কি! তাদের যা হবে আমাদেরও তাই হবে। অত চিন্তা কীসের?

শ্যামল যথাসাধ্য শুকনো গলাকে মোলায়েম করে বলে, আহা, তুমি বুঝছ না…

খুব বুঝছি। একটুতেই তোমার অমন টেনশন হয় কেন? আর-একটাও সিগারেট খাবে কিন্তু খাবারের আগে। গত আধ ঘণ্টায় বোধহয় চারবার উঠে গেলে!

হাওড়া স্টেশনে রাত কাটানো মানে বুঝছ তো! হরিবল। টুকুসটার কত কষ্ট হবে। কিছু হবে না। গাদা গাদা বাচ্চা যাচ্ছে এই ট্রেনে। তাদেরও তো কষ্ট হবে।

আহা, আমি সকলের কথাই ভাবছি। মানে, আমাদের সকলেরই কষ্ট হবে!

বাংলা বন্ধ এর কথাটা মাথায় ছিল না, থাকলে…

থাকলে কী করতে? আজকের রিজার্ভেশন ক্যানসেল করতে? এখন পুজোর পর সকলের ফেরার রাশ, আগামী পনেরো দিনেও রিজার্ভেশন পেতে না। পনেরো দিন বসে। থাকতে দিল্লিতে? কী বুদ্ধি।

ওয়েল, আমি তোমার মতো অত স্পোর্টিং নই। এই ঝামেলা এড়াতে অন্তত প্লেনে একটা চেষ্টা করা যেত।

তোমার মাথাটা আজকাল একদম নরম্যালি কাজ করছে না। ট্রেন মাত্র চার ঘণ্টা লেট বলে প্লেনে উঠতে? টাকা এত সস্তা হয়েছে নাকি আমাদের? বছরে চারবার প্লেনের ভাড়া বাড়ে, সেটা জানো?

শ্যামল গুম হয়ে বসে রইল। টুকুস এখনও ঘুমোচ্ছে। নির্বিঘ্ন ঘুম। ট্রেন লেট হোক চাই হোক, ওর কিছু যায় আসে না। এই শিশুকালটাই ভাল, দুনিয়ার এত দিকদারি, টেনশন, ছোটখাটো অশান্তি, ভয় এসব স্পর্শই করে না।

শ্যামল আবার উঠতে যাচ্ছিল। বকুল একটা ধমক দিল, আবার কোথায় যাচ্ছ?

চোরের মতো মুখ করে শ্যামল বলে, একবার মাসিমাকে দেখে আসি।

দেখার কী আছে! মাসিমা স্মার্ট মহিলা, সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। শি ক্যান লুক আফটার হারসেলফ।

একটা কার্টসি তো আছে।

শ্যামল উঠে গেল। বকুল ম্যাগাজিনের ছবি দেখতে লাগল।

মাসিমা আছেন একেবারে শেষ কিউবিকলে। অনেকটা দূর। জায়গা বদল করে একই কিউবিকলে ব্যবস্থার কথা বলেছিল শ্যামল। মাসিমা- হু ইজ এ হার্ড নাট টু ক্র্যাক–মৃদু হেসে বলেছেন, থাক গে, কী দরকার? আমার কোনও অসুবিধে নেই। কম্পার্টমেন্ট তো একই। আমি তো একা একাই দুনিয়া ঘুরে বেড়াই।

মাসিমা–অর্থাৎ বিনয়ের মা–সত্যিই বিশ্বজনীন মানুষ। তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে আছে। শুধু বিদেশ-ভীত বিনয়টাই পড়ে আছে দিল্লিতে। বার দুই বিদেশে গিয়ে দেখেছে, ফরেন তার সহ্য হওয়ার নয়। দিদি ও দাদাদের ছিছিক্কার মাথা পেতে নিয়ে সে দিল্লিতেই থানা গেড়েছে। তার জীবনের প্রবলতম উচ্চাকাঙক্ষা হল কলকাতায় স্থায়ীভাবে ফিরে আসা এবং জমিয়ে আড্ডা দেওয়া। রানীক্ষেত, নৈনিতাল, হরিদ্বার ঘুরে ফেরার পথে বিনয়ের কালকাজির বাড়িতে তিনদিন ছিল শ্যামল। তিনদিন বিনয়ের গাড়িতে আগ্রা-টাগ্রা ঘুরে, দিল্লিতে প্রভূত মার্কেটিং করে, কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আর আড্ডা মেরে সময়টা কেটেছে দারুণ। মাসিমা তখন ওখানে মজুত। তিনিও কলকাতায় আসবেন। স্বামীর ভিটে একবার ভিজিট করেই রওনা দেবেন সুইডেনে, মেয়ের বাড়িতে। ভিটেটা অবশ্য দেখার মতো। আয়রনসাইড রোডে বাগানঘেরা পেল্লায় বাড়ি। কেমন একটা প্যালেস-প্যালেস ভাব আছে। সেখানে থাকে এক বুড়ো কেয়ারটেকার আর মাসিমার এক নিঃসন্তান বিধবা ভাইঝি। প্রকাণ্ড বাড়িটা একরকম স্থায়ীভাবে ফাঁকা। শ্যামল মাঝে মাঝে ভাবে, যাদের আছে তাদের এত বেশি আছে কেন? কলকাতায় এক টুকরো ঘরের জন্য এত মাথা খোঁড়াখুঁড়ি আর এদের অত বড় বাড়ি অবহেলায় ফাঁকা পড়ে থাকে।

শেষ কিউবিকলে মাসিমা ছাড়া তিনজনই পুরুষ। মাসিমার পরনে সাদা ধবধবে থান, চোখে ফিতে-বাঁধা চশমা, চেহারায় সম্রমাত্মক ভাব। ছোটখাটো, ফর্সা, শান্ত চেহারার ভদ্রমহিলা। বয়স সত্তর-উত্তর হবে। ফিট। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ইংরিজি খবরের কাগজ দেখছিলেন।

মাসিমা, কখন যে গাড়ি কলকাতা পৌঁছবে!

বোসো।–বলে মাসিমা একটু জানালার দিকে সরে গেলেন, পাশে রাখা বিদেশি হ্যান্ডব্যাগটা সরিয়ে নিলেন।

শ্যামল বসল। ভিতরটা উচাটন। ট্রেনটা যথেষ্ট জোরে চলছে বলে তার মনে হচ্ছে না। টাইম মেক-আপ করার ইচ্ছে কি আছে এদের। যদি অন্তত আধ ঘণ্টাও মেক-আপ করতে পারত তা হলে সাড়ে নটায় পৌঁছনো যেত হাওড়ায়। উঃ, যদি একটু জোরে চালায় এরা। গাড়িটা! যদি রাস্তায় আর লেট না হয়।

টুকুস ঘুমিয়েছে বুঝি?

অ্যাঁ!—বলে চিন্তাকুল শ্যামল যেন চটকা ভেঙে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছে।

তাই ভাবছি। নইলে একবার ঠিক আমার কাছে আসত। তিনদিনেই যা ভাব হয়ে গেছে। আমাদের।

মাসিমা—অর্থাৎ মুক্তিদেবীর ডান হাতে একখানা মস্ত হিরের আংটি। একখানা বিছেহার গলায়। আর কোনও গয়না নেই। হিরের বাজারদর শ্যামলের জানার মধ্যে পড়ে না, সোনার দর সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা আছে মাত্র। কিন্তু তার সন্দেহ মাত্র এই দুই আইটেমেই হাজার ত্রিশ-চল্লিশ পড়ে যাবে।

ইয়ে, মাসিমা, হাওড়া থেকে অত রাতে তো আপনাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়া যাবে না। আমরা কি সঙ্গে যাব?

মনে মনে অপব্যয়টার একটা হিসেবও করে নেয় শ্যামল। তার ফ্ল্যাট কাঁকুড়গাছিতে। মাসিমাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে কাঁকুড়গাছি যাওয়া মানে বিশ-পঁচিশ টাকা বাড়তি খরচ।

মাসিমা অবশ্য হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, তা কেন? আমাকে পৌঁছনোর কোনও দরকার নেই তো! আমার ভাশুরপোর গাড়ি নিয়ে আমাদের কেয়ারটেকার যদু স্টেশনে থাকবে। পুরনো লোক, যত রাতই হোক ঠিক মোতায়েন থাকবে।

শ্যামল একটা শ্বাস ফেলল। ওঃ, তাই এত নিশ্চিন্ত। বড়লোকদের জন্য সব ব্যবস্থাই থাকে। যাদের ভগবান দেয় তাদের এত দেয় যে ভগবানের চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত থাকে না। দিতেই থাকে, দিতেই থাকে। ভগবান-টগবান মানে না শ্যামল, কিন্তু রেগে গেলে, উত্তেজিত হলে সে একজন অদৃশ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ফর দি টাইম বিয়িং ভগবানকে খাড়া করে নেয়। তাতে নিজস্ব লজিকগুলো শানিয়ে নিতে তার সুবিধে হয়। আর এই ভদ্রমহিলা মানে সো কলড মাসিমা ইনিও তো নিজে থেকে একবার বলতে পারেন, বাবা শ্যামল, তুমি বরং আমার গাড়িতেই যেয়ো। নইলে মালপত্র বউ বাচ্চা নিয়ে মুশকিলে পড়বে। কিন্তু বলল না। এই সৌজন্যটুকু এমন কিছু সাংঘাতিক প্রত্যাশা নয়। যখন বললই না তখন শ্যামলেরই কি লজ্জার মাথা খেয়ে বলা উচিত, ইয়ে মাসিমা, আপনার খুব অসুবিধে না হলে… মানে। কাঁকুড়গাছি… কাছেই… মানে বউ-বাচ্চা-মালপত্তর… কলকাতা শহর, বুঝতেই পারছেন। লোকে তো এইভাবেই ম্যানেজ করে, না কি? বলিয়ে-কইয়ে স্মার্ট লোকেরা আরও কত কঠিন পরিস্থিতিকে শুধু বুকনি ঝেড়ে জল করে দেয়। সে এটুকু পারবে না? গলা খাঁকারি দিয়ে তৈরি হল শ্যামল। দ্বিধা সংকোচের যে কর্কটা তার গলায় আটকে গিয়ে সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক কথাটা কিছুতেই বলতে দেয় না সেটাকে খুলে ফেলার জন্য গলাটা আর-একবার ঝেড়ে নিয়ে সে একরকম চোখ বুজে মুখ খুলল। এবং বলেও ফেলল।

কিন্তু যা বলল তা মোটেই তার উদ্দিষ্ট কথা নয়। খুবই অবাক হয়ে সে শুনতে পেল যে, সে বলছে, মাসিমা, কলকাতার বাড়িটা তাহলে ডিমলিশ করে ফেলাই ঠিক করলেন?

কী করব বলো! আমরা কেউ থাকি না, অত বড় বাড়ি মেনটেন করে কে? ট্যাক্সও তো কম নয়। আমার দাদাশ্বশুর তিন ছেলের জন্য তিনটে বাড়ি করে রেখে গিয়েছিলেন, ভাশুরপোরা কবে তাদের বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড করে নিয়েছে। শুধু আমাদেরটাই পড়ে আছে।

কোনও আগ্রহ নেই জানবার তবু কথাটা যখন উঠে পড়েছে তখন কথার ঝোকেই শ্যামল বলল, কীরকম বন্দোবস্ত হল?

হয়নি। সেই সব কথা বলতেই কলকাতা যাওয়া। একজন প্রোমোটার গত জুন মাসে আমেরিকায় গিয়ে বেকার্সফিল্ডে আমার ছেলের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। মোটামুটি ঠিক হয়েছে চার ছেলেমেয়ে আর আমার জন্য পাঁচটা বড় ফ্ল্যাট দেবে, আমার ভাইঝি আর যদুর জন্য দু’খানা ঘর।

কে থাকবে?

কে আর থাকবে। এক বিনয় যদি কলকাতায় আসে তো থাকবে। বিদেশে যারা আছে তারা কেউ ফিরবে না এ দেশে। তবে সবাই চায় কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট বা কিছু থাক। ওটা একটা সেন্টিমেন্ট। কলকাতায় আমার একটা আশ্রয় আছে, এটুকু ভেবেই যা সান্ত্বনা। দু-চার বছর পর এসে দু-চারদিন থাকবে হয়তো।

পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল বাড়ি ওঠার সব কাহিনিই প্রায় একরকম, খুব একটা ভ্যারিয়েশন নেই। এত একরকম যে, বস্তাপচা মনে হয়। কাজেই মুক্তিদেবী তথা মাসিমার গল্পেও সেই রিপ্লে। শুধু একটা ব্যাপার শ্যামলের শ্বাসরোধ করে দেয়, এরা কত বড়লোক। যিশুখ্রিস্টই কি বলেছেন কথাটা যে, ছুঁচের ফুটো দিয়ে বরং হাতি গলে যাবে, তবু কোনও ধনী ব্যক্তি কখনও স্বর্গে পৌঁছোবে না! ওয়েল ওয়েল, মাই ডিয়ার জেসাস, এর চেয়ে বড় স্বর্গ আর কোন আহাম্মক চায়? তোমার স্বর্গ তো ঝোপের পাখি ধর্মাবতার। আরও একটা কথা তোমাকে মনে করিয়ে দিই অনারেবল জেসাস, তোমার সর্বশক্তিমান গডই যদি সব কিছুর মূলে আছে, তবে এই যে কিছু বড়লোক এবং তাদের তেলা মাথায় আরও তেল দেওয়া এটাও সেই কীর্তিমান একচোখো লোকটারই কাজ। বুঝলে জেসাস স্যার, তোমার গড হল পক্ষপাতদুষ্ট রেফারি। যে দল জিতছে তাকেই ফের পেনাল্টি পাইয়ে দেওয়া ছাড়া এটা আর কী বলো তো! থাকবে না, তবু পাঁচ-পাঁচটা ফ্ল্যাট তালাবন্ধ কঁকা পড়ে থাকবে। এইজন্যই তো লোকে কমিউনিস্ট হয়।

কমিউনিস্ট লোকে আরও নানা কারণেই হয়, শ্যামলও বার কয়েক হয়েছে। এখনও যে সে কমিউনিস্ট নয় এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ সে এখন কমিউনিস্ট কি না সেটা শ্যামলও জানে না। তবে ট্রেনটা যদি আরও এক কি দুই ঘণ্টা লেট করে তবে ঘুমন্ত বাঘ জেগে উঠতে পারে।

শ্যামল একটা শ্বাস একটু ধীর ও গভীর ভাবে মোচন করে বলে, যাক মাসিমা, আপনার জন্য যে একটা গাড়ি থাকবে এটা জেনে খুব নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, গাড়ি না এলে আপনার তো খুবই অসুবিধে হবে।

মুক্তিদেবী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটা হাসি হেসে বললেন, না না, তুমি একদম চিন্তা কোরো না। গাড়ি ঠিক আসবে। যদু নিজে থাকবে স্টেশনে। ত্রিশ বছরের পুরনো লোক।

তবু একবারও বলল না, আমার তো ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তোমার কী হবে বাবা শ্যামল। আমার গাড়িটা বরং তোমাদের পৌঁছে দিক।

বলল না। পোঁটলা পুঁটলি বাক্স বউ বাচ্চা নিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা হাওড়ার উদোম প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা ছাড়া শ্যামল আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না আশু ভবিষ্যতে। কারণ দিল্লি থেকে ছেড়ে গাজিয়াবাদ পার হয়েই ট্রেনটা আবার থেমেছে। এবং অনেকক্ষণ থেমে আছে। ভোগাবে। খুব ভোগাবে। শ্যামল একটু একটু কমিউনিস্ট হয়ে উঠছে কি?

মাসিমা নিচু হয়ে তার স্যামসোনাইট সুটকেসটা সিটের তলা থেকে টেনে বের হবার চেষ্টা করেছিলেন।

দাঁড়ান মাসিমা।–বলে শ্যামল সেটা বের করে দিল। ঘ্যাম জিনিস। চব্বিশ ইঞ্চি, ষাঁড়ের রক্ত রঙা, কম্বিনেশন লকওলা স্যামসোনাইট। হার্ড টপ। এ দেশের বাজারে যদি বা পাওয়া যায় হেসে খেলে হাজার দুই টাকা দাম পড়ে যাবে।

মাসিমা সুটকেস খুলে এক প্যাকেট লবঙ্গ বের করে শ্যামলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার বউকে দিয়ো। এ দেশে শুনি লবঙ্গর খুব দাম!

লবঙ্গ!—বলে শ্যামল একটা হাঁ করে রইল। লবঙ্গ তাদের কোন কাজে লাগবে সে মোটেই বুঝতে পারছে না।

দারচিনি আর এলাচিও এনেছিলাম, সেগুলো দিল্লিতেই বিলি হয়ে গেছে। ভাল জিনিস তো এখানে পাওয়াই যায় না।

শ্যামলের একবার বলতে ইচ্ছে করল, লবঙ্গ নয় মাসিমা, আই ওয়ান্ট এ লিফট।

এই সময়ে ট্রেন ছাড়ল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বকুল এসে দাঁড়াল, এই, তুমি একটু টুকুসের কাছে গিয়ে বোসো তো। আমি বরং মাসিমার সঙ্গে গল্প করি।

সর্বহারার অর্থহীন দৃষ্টিতে শ্যামল বকুলের দিকে চেয়ে লবঙ্গের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লবঙ্গ!

লবঙ্গ!–বকুলের চোখ যেন ঝলমল করে উঠল, ওমা! মাসিমা দিলেন বুঝি! ইস, কী দারুণ।

বলে শ্যামলের পরিত্যক্ত জায়গায় ঝুপ করে বসে পড়ে বকুল।

দেখি মাসিমা, বিদেশ থেকে আর কী আনলেন!

এই যে দেখাচ্ছি।

বকুল যদি ম্যানেজ করতে পারে তো প্রবলেমটা ফর্সা হয়ে গেল। রাত্তিরটা ভাল ঘুম হবে তার।

টুকুস–তিন বছরের আদুরে মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, নো প্রবলেম। ঠিক এইরকম একটা বয়সে স্থির থেকে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। মানুষের বয়স বাড়ে, মাথা পাকা হয়, ততই বাড়ে প্রবলেম। এই যে টুকুস এত নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে এবং দুনিয়ার সব বাচ্চাই যে নিশ্চিন্তে খায়-দায়, খেলা করে, ঘুমোয়, কোনও টেনশনে ভোগে না তার কারণ হচ্ছে ওরা টের পায় ঝামেলা ঝঞ্ঝাট, দুশ্চিন্তা পোয়ানোর জন্য ওদের বাবা, মা এবং বড়রা আছে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে তখন আর সে সুবিধে নেই। সেইজন্যই কি লোকে ভগবান নামে একজন বড় বাবাকে খাড়া করে নিয়েছিল। যাতে ঝাট-ঝামেলাগুলো তার ঘাড়ে চাপিয়ে খানিকটা শিশু হয়ে থাকা যায়।

উলটোদিকে দু’জন গম্ভীর লোক। একজন মাড়োয়ারিই হবে বোধহয়, অন্যজন যুবক চেহারার। বাঙালি বলেই মনে হচ্ছে। চুপচাপ বসে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। এ সি টু টায়ারে ডবল কাচ লাগানো থাকে জানালায় এবং কাচ যথেষ্ট ময়লা ও ঘোলা। দিনদুপুরেই বাইরেটা ভাল দেখা যায় না। রাতে তো কথাই নেই। তবু কিছু লোক চেয়ে থাকে। খামোখাই চেয়ে থাকে।

আপনি কি কলকাতা অবধি নাকি?

লোকটা ধীরে মুখটা ফেরাল। শ্যামল সামান্য একটু বিস্মিত হল মুখটা দেখে। খুবই বিষণ্ণ, শোকাহত চেহারা। কেউ মারা-টারা গেছে নাকি? ডেকে কথা বলে কি ভুল করল শ্যামল?

সামান্য ভাঙা এবং ধরা গলায় যুবকটি বলল, আমাকে কিছু বললেন?

সরি টু ডিস্টার্ব, না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম কলকাতা অবধি যাচ্ছেন কি না?

হ্যাঁ, কলকাতা। ট্রেন যা লেট চলছে, কখন যে পৌঁছবে!—বলে কথাটা ছেড়ে দিল।

ছেলেটা মৃদু স্বরে বলল, পৌঁছবে।

ওই যাঃ, বকুল তো জানেই না যে মাসিমার গাড়ি আসবে। না জানলে ম্যানেজ করবে কীভাবে? এখনই ওকে অ্যালার্ট করে দিয়ে আসা দরকার। ভেবে উঠতে যাচ্ছিল শ্যামল। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে, তাড়া কীসের! কাল সারা দিনটা তো হাতে আছে।

আপনি কি দিল্লিতে থাকেন?

ছেলেটা ফের জানালার বাইরে চেয়ে ছিল। বিষণ্ণ সুন্দর মুখখানা ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ, দিল্লিতে।

ছোকরার যে একটা কিছু ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। জখমটা হয়তো একটু গুরুতরই।

সিগারেট চলে তো?

সিগারেট! হ্যাঁ, তা চলে।

কী নুইসেন্স বলুন তো! এত টাকা দিয়ে লোকে এ সি টু টায়ারে ট্রাভেল করছে, কিন্তু সিগারেট খেতে হলে করিডোরে যেতে হবে। আমি একটু বেশি স্মোক করি বলে আরও অসুবিধে হয়। অথচ সেকেন্ড ক্লাসে নো রেস্ট্রিকশন। এ সি ফার্স্ট ক্লাসেও স্মোকিং অ্যালাউড। ওনলি এইসব কম্পার্টমেন্টের জন্যই এ নিয়ম। মিনিংলেস।

বলে শ্যামল উঠে পড়ে।

ছেলেটা স্তিমিত গলায় বলে, আপনার মেয়েটা কি একা থাকবে? বউদি রাগ করবেন না তো একা রেখে গেলে? পড়ে-উড়ে গেলে—

আরে না। শি ইজ এ কোয়ায়েট চাইল্ড। তবু আপনি যখন বলছেন—

বলে শ্যামল সিটের তলা থেকে বড় সুটকেসটা বের করে সিট ঘেঁষে খাড়া করে রাখল, নাউ শি ইজ সেফ। পাশ ফিরতে গেলে পড়ে যাবে না।

কামরার ভিতরটা অনেকটাই শব্দহীন। কিন্তু করিডোরে রেল কাম ঝমাঝম শব্দে কান ফেটে যেতে চাইছে। ট্রেনটা হঠাৎ একটু বেশিই স্পিড দিল নাকি? এত দুলছে যে দাঁড়ানোই কষ্টকর। এত স্পিড তো ভাল নয় বাপু! ভারতবর্ষের রেল লাইনকে বিশ্বাস কী? কোথায় নাটবন্টু আলগা হয়ে রয়েছে কে জানে বাবা। গাড়ি যদি রেল থেকে ছিটকে মাঠে নেমে যায় এই স্পিডে, তবে দলা পাকিয়ে যেতে হবে। উইথ টুকুস। অ্যান্ড বকুল। ভাবতেই কেমন গা শিরশির করে। তার ওপর দেশে যা টেরোরিজম শুরু হয়েছে। কোথায় বোমা মেরে লাইন উড়িয়ে রেখেছে, কি লাইনে টাইম বোমা বা মাইন ফিট করে রেখেছে কে জানে!

সিগারেট ধরিয়ে শ্যামল বুক ভরে ধোঁয়া টানল। ছেলেটা অ্যামেচারিশ। সিগারেট ধরাল আনাড়ির মতো। বোধহয় চান্স স্মোকার।

ট্রেনটা কেমন দৌড়চ্ছে দেখেছেন? কোনও মানে হয় এত স্পিডে রান করার?

ছেলেটা দেয়ালে পিঠ দিয়ে চোখ বুজে ছিল। চোখ খুলে বলল, হ্যাঁ, ভাল। খুব ভাল।

আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, ইউ আর ইন এ শক। এনি মিসহ্যাপ?

ছেলেটা সিগারেটের দিকে চেয়ে ছিল। মাথা নাড়ল, না।

এসি টু টায়ার করিডোরে সর্বদাই কিছু উটকো লোক উঠে পড়ে। উবু হয়ে বসা দু’জন ময়লা জামাকাপড়ওয়ালা হ্যাভ নটস কথাবার্তা বলছে। একজন চাওয়ালা দুই বাথরুম এবং দু’ কামরার যোগাযোগের দরজার কাছে ব্যাবসা করছে। তার সামনে দু’জন হ্যাভস খদ্দের। খাবারের ট্রে হাতে রেস্টুরেন্ট কার থেকে দু’জন বেয়ারা ছিমছাম অভ্যস্ত পায়ে টাল না খেয়ে এসে ঢুকে গেল কামরায়।

কন্ডাক্টরের ফোল্ডিং সিট পেতে চশমাধারী মাঝবয়সী কালো লোকটা চার্ট দেখে কী সব মেলাচ্ছিল।

কন্ডাক্টর সাহেব, লেট কিছু মেক-আপ হবে নাকি? লোকটা মাথা তুলে অতিশয় দার্শনিকের মতো বলল, কুছ হো শকতা। কোই মালুম নেহি।

লেট তো বাড়তেও পারে।

কুছ ভি হো শকতা। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হ্যায় না। লেট হোনা হি ইসকা দস্তুর হ্যায়।

এত স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে শ্যামল নির্বিকার হওয়ার চেষ্টা করল।

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে মাসিমার সেই ভাশুরপোর বাড়িও কাঁকুড়গাছিতেই। গাড়ি মাসিমাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে সেখানেই যাবে! এরকম তো হতেই পারে, তাই না? পৃথিবীতে কত অঘটনই তো ঘটে। সেই যে সে একটা সত্য ঘটনার কথা কোথায় যেন পড়েছিল, অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজ ভিড়িয়ে কয়েকজন নাবিক ফুর্তি করতে নেমেছিল। সেখানে একটি সরল যুবতীর সঙ্গে এক নাবিকের প্রেম হল এবং তারা গির্জায় গিয়ে বিয়েও করে। ফেলল। তারপর নাবিকটি চলে গেল জাহাজে, আর তার কোনও পাত্তা নেই। মেয়েটি অপেক্ষা করে করে ধৈর্যহারা, কিন্তু বোকা মেয়েটা তার ঠিকানাও ভাল করে জানে না। শুধু জানে তার নাম জন, তার বাড়ি লন্ডনে। একদিন মেয়েটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। অতি কষ্টে টাকাপয়সা জোগাড় করে সে একদিন টিকিট কেটে লন্ডনগামী জাহাজে উঠে পড়ল। লন্ডনের জাহাজঘাটায় নেমে সে হারা উদ্দেশ্যে ‘জন! জন! বলে এগোচ্ছে। কী আশ্চর্য, ঠিক সেই সময়ে জনও আসছে উলটো দিক থেকে। দু’জনেই আকুল আবেগে জড়িয়ে ধরল দু’জনকে। টুথ ইজ সামটাইমস স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।

আঙুলে গরম লাগায় সিগারেটের শেষ অংশটা দেয়ালের উপচে পড়া অ্যাশ-ট্রেতে গুঁজে দিয়ে শ্যামল বলে, কলকাতায় আপনি কোথায় থাকেন?

কলকাতা! না, কলকাতায় আমার তেমন কোনও আস্তানা নেই। মাঝে মাঝে অফিসের কাজে আসি, হোটেলে থাকি।

আত্মীয়স্বজন?

কলকাতায় তেমন কেউ নেই। দূর-সম্পর্কের দু’-চারজন আছে।

ছেলেটা সিগারেট তেমন করে খায়নি৷ দুটো-একটা টান দিয়ে ফেলে দিল। শ্যামল আর একটা ধরিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল, আর চলবে?

না, থাক।

প্যাকেটটা বুকপকেটে রাখতে গিয়ে লাইটারটা টুকুস করে পড়ে গেল। ছ্যাত করে উঠল বুকটা। লাইটারটা তার দারুণ প্রিয়। এক বন্ধু হংকং থেকে এনে দিয়েছিল। একটু অসভ্য ব্যাপার আছে জিনিসটার গায়ে। চ্যাপটা ছিমছাম লাইটারটার গায়ে দুটো বিকিনি পরা সুন্দরীর ছবি। আপসাইড ডাউন করলেই বিকিনি অদৃশ্য হয়ে দু’জনেই সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যায়। বকুল কয়েকবারই এটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তোমার রুচিটা কী বলো তো! খুব রস পাও ন্যাংটো মেয়ের ছবি দেখে? টুকুস কিন্তু বড় হচ্ছে মনে রেখো। শ্যামল আজকাল লাইটার বকুলের সামনে পারতপক্ষে বের করে না। জনসমক্ষেও একটু লুকিয়েই রাখতে হয় জিনিসটা। কিন্তু লাইটারটা তার ভীষণ প্রিয়। খুব পাতলা, ছিমছাম, ভিতরে গ্যাস কতটা আছে তা দেখার জন্য উইন্ডো, বেশির ভাগ সময়ে এক স্ট্রোকেই জ্বলে। তাইওয়ান ফাইওয়ানের মতো দেশও আজকাল কত পারফেক্ট প্রোডাকশন করছে। উঠে আসছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, এমনকী ইন্দোনেশিয়াও। কিন্তু ইন্ডিয়া কোথায়? এখনও ইন্ডিয়ায় ভদ্রগোছের ব্যবহারযোগ্য ইলেকট্রনিক লাইটার তৈরি হয় না, ভাবা যায়?

লাইটারটা কুড়িয়ে ট্রাউজারের গায়ে মুছে পকেটে ভরল শ্যামল।

আপনি দিল্লি-বেসড বাঙালি?

ছেলেটা মাথা নাড়ে, না।

দেন হোয়ার আর ইয়োর ফোকস? মানে আপনার নিয়ার রিলেটিভরা সব কোথায়?

ছেলেটা তার আকর্ষণীয় ঈষৎ ভাঙা কিন্তু স্বপ্নালু গলায় বলে, আমার তেমন কেউ নেই। আমি একটু লোনলি।

একদম একা?

একরকম তাই। আমি ওনলি চাইল্ড। মা-বাবা ডিসিসড।

বিয়ে করেননি?

না।

না-টা খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলল না। একটু থেমে থেমে বলল, অনেক কথা ঠিক অফ হ্যান্ড বলা যায় না।

খুব সমবেদনার সঙ্গে শ্যামল বলে, তা তো বটেই। আই অ্যাম বিয়িং এ নোজি পার্কার। ডোন্ট মাইন্ড ব্রাদার। আপনার নামটা জানতে পারি কি?

বিশ্বরূপ।

আপনার নোজি কিন্তু একটু মেলাঙ্কলিক। তাই হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, কোনও মিসহ্যাপ হয়ে গেছে কি না।

মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সি সুন্দর ছেলেটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, অনেকের কাছে এই বেঁচে থাকাটাই একটা মিসহ্যাপ।

কামরার দরজাটা খুলে গেল। বকুল। রুষ্ট মুখ।

এই, তুমি এখানে! বাচ্চাটাকে একা ফেলে এসেছ, আচ্ছা তোক তো!

শ্যামল তাড়াতাড়ি সিচুয়েশন সামাল দিতে গিয়ে বলে, আরে, এ হল বিশ্বরূপ। এ ব্রাইট বয়। একটা আলোচনা হচ্ছিল। আমি তো টুকুনের পাশে সুটকেস খাড়া করে প্রোটেকশন দিয়ে এসেছি, দেখোনি!

বকুল ঝড়াক করে দরজাটা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেল রাগ করে।

ছেলেটার ব্যথাতুর মুখে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটল, বউদি রাগ করবেন বলেছিলাম।

শ্যামল কাঁধ ঝাকিয়ে স্পোর্টসম্যানের মতো বলল, ম্যারেজ হ্যাজ ইটস টোল। বউ তো রাগ করার জন্যই আছে। রাগ ছাড়া অন্য মুড খুব রেয়ার। আমি সিজনড হয়ে গেছি।

ছেলেটা বেশ লম্বা। শ্যামলের চেয়েও ইঞ্চি দুয়েক। শ্যামল পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চি। এ প্রায় ছ’ ফুট। চেহারাটা বেশ পেটানো। দেখতে ভাল। কিন্তু মুখখানায় একেবারে ছাই মাখানো যেন। সামথিং রং। ভেরি মাচ রং।

খুব ঘুরলেন?— যেন কথা বলার ইচ্ছে নেই, তবু জোর করে বলার মতো বলল ছেলেটা।

শ্যামল সিগারেট শেষ করে বলে, আমরা প্রতি বছরই এ সময়টায় বেরোই। গতবার সাউথ ইন্ডিয়া, তার আগেরবার রাজস্থান, তারও আগে কুলু মানালি। ঘোরাঘুরি এবার বন্ধ করতে হবে। যা অবস্থা। কাশ্মীরে লাশ পড়ছে, পঞ্জাবে লাশ পড়ছে, আরও হবে। ভয় হয়, সব জায়গাতেই না বেড়ানোতে কুলুপ পড়ে যায়। আচ্ছা, আপনি কি চাকরি করেন? না কি বিজনেস? চাকরি!

ওঃ হ্যাঁ, বলছিলেন বটে অফিসের কাজে কলকাতা যাচ্ছেন। দিল্লি বেস করে থাকা খুব ভাল। সেন্ট্রাল জায়গা। কী জানি কেন মশাই, আমার দিল্লি শহরটা বেশ লাগে।

হ্যাঁ, ওপর থেকে খুবই সুন্দর।

নিচু থেকে কি অন্যরকম? নীচের দিল্লিও আছে নাকি?

সব শহরেরই থাকে। ওপর থেকে একরকম, নীচের লেভেল থেকে অন্যরকম।

তাও হয় নাকি? দুটো দিল্লি!

বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, দুটো কেন, বড় বড় শহরগুলোর ভিতরে অনেক লেভেল থাকে। যেখান থেকে যেমন দেখায় সেরকমই দেখে মানুষ। পলিটিক্যাল লেভেল, কালচারাল লেভেল, ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল, ক্রাইম লেভেল। আপনি যেটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবেন শহরটাকে সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই বিচার করতে থাকবেন।

ওয়েল বিশ্বরূপ, আপনার লেভেলটা কী? পলিটিক্যাল না কালচারাল?

ক্রাইম।

অ্যাঁ! তার মানে?

আমি পুলিশে চাকরি করি।

মাই গড! আপনাকে আর যা-ই হোক, পুলিশ বলে কিছুতেই মনে হয় না। আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ এ মেলাঙ্কলিক পুলিশম্যান। ওয়েল, ওয়েল, আই অ্যাম ড্যামড।

ক্রাইমের লেভেল থেকে দিল্লি কিন্তু ততটা সুন্দর নয়।

শ্যামল মাথা নেড়ে বলে, সে তো বটেই। আমি ওসব লেভেল-টেভেল থেকে বলছি।। এমনিতে অ্যাপারেন্টলি দিল্লি চমৎকার শহর। অনেকে বলে লাইফ নেই, আচ্ছা নেই, অ্যাজ ইফ ওটা একটা ভাইট্যাল ব্যাপার। বাঙালি যে আড্ডা দিয়ে দিয়ে শেষ হয়ে গেল সেটা কে দেখছে?

বিশ্বরূপ ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে, আপনি ভিতরে যান। বোধহয় এতক্ষণে আপনাদের ডিনার সার্ভ করে দিয়েছে। দেরি হলে বউদি ফের রেগে যাবেন।

ওঃ ইয়েস। নতুন করে রাগবার কিছু নেই। উনি ইন ফ্যাক্ট রেগেই আছেন।

বাথরুম ঘুরে দু’জনেই ফিরে আসে কামরায়। শীতল নিস্তব্ধতা। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। দুটো ঢাকা দেওয়া ট্রে সাজানো রয়েছে টেবিলে। সিটের এক পাশে দুটো বেডরোলও সাজানো রয়েছে। মাড়োয়ারিটি বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বকুল একটা বাংলা উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করছে। মুখটা থমথমে।

গাড়িটা কি পাগল হয়ে গেল? এত জোরে যাচ্ছে কেন? শ্যামল সামান্য উদ্বেগ বোধ করল। একবার তাকাল বকুলের দিকে। ভারী অভদ্র বকুল। সে বিশ্বরূপকে ইনট্রোডিউস করে দিল, বকুল একটা হ্যালো গোছের কিছু বলল না। অত রেগে যাওয়ার কী আছে? এত ন্যাগিং হলে কি চলে?

খাবে?—বইটা রেখে বকুল ঠান্ডা গলায় বলে।

শ্যামল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, খেতে পারি।

হাত ধুয়ে এসো। বাস্কেটে সাবান আছে।

জানি।-বলে শ্যামল একটু গুম হয়ে সাবান নিয়ে হাত ধুয়ে এল।

বিশ্বরূপ কিন্তু খাচ্ছে না। ফের জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে।

মুরগির একটা ঠ্যাং তুলে গন্ধটা শুকে নিয়ে শ্যামল বলে, আপনি কি ডিনার সেরে এসেছেন?

বিশ্বরূপ স্তিমিত গলায় বলে, হ্যাঁ।

খাওয়ার সময় শ্যামলের একটা প্যাশন কাজ করে। এতটাই করে যে সে খেতে খেতে গল্প-গাছা বা টিভি দেখা বা অন্যমনস্ক হওয়া পছন্দ করে না। সে খেতে ভীষণ ভালবাসে। ফলে পঁয়ত্রিশেই তার শরীরে বেশ মেদ জমে গেছে। পেটটায় বিশেষ রকমের। আগে তার কুকুরের মতো চিমসে-মারা পেট ছিল। বকুল আর তার মধ্যে একটা নীরবতার বলয় তৈরি হয়েছে। তাদের দাম্পত্য জীবনে এটা খুবই হয়। যখন-তখন হয় এবং আবার একসময়ে বলয়টা ভেঙেও যায়। মেয়েটা হওয়ার পর থেকেই এটা বেশি হয়েছে। মেয়েকে উপলক্ষ করে তাদের আজকাল বেশ লেগেও যায়।

শ্যামল আর বকুল যখন খাচ্ছে তখন নাঙ্গা সিটের ওপর হাতে মাথা রেখে বিশ্বরূপ একসময়ে গড়িয়ে পড়েছে। খাওয়ার ঝেকে লক্ষ করেনি শ্যামল। খেয়ে আঁচিয়ে এসে সে বকুলকে চাপা গলায় বলে, মাসিমাকে নিতে হাওড়ায় গাড়ি আসবে। একবার বলে দেখবে নাকি গাড়িটা যদি আমাদের একটু পৌঁছে দেয়!

বকুল চুপ করে থেকে রাগের গলায় বলে, তুমিও তো বলতে পারতে?

আহা, সবাই জানে আমার চেয়ে তুমি বেটার টকার।

কাজের বেলায় আমি, না!

প্লিজ! অত রাতে পৌঁছে আমরা স্ক্র্যান্ডেড হয়ে যাব। গাড়ি যখন মাসিমাকে নিতে আসছেই আমাদের ইজিলি পৌঁছে দিতে পারবে।

বকুল সামান্য থমথমে মুখে বলে, আমি পারব না। তুমি যে কেন সামান্য ব্যাপারেই এত টেনশনে ভোগো? তোমাকে নিয়েই হয়েছে মুশকিল। একটা রাত হাওড়ায় বসে থাকলে কী হয়? রাতটাও পুরো নয়। ভোর চারটে সাড়ে চারটেয় ট্যাক্সি চালু হয়ে যাবে। ম্যাক্সিমাম ঘণ্টা তিনেক বসে থাকতে হতে পারে, তাতে এমন কী অসুবিধে বলল তো!

টুকুসটার যে কষ্ট হবে।

কীসের কষ্ট? সুটকেস পেতে শুইয়ে রাখব, অঘোরে ঘুমোবে।

মুখখানা তোম্বা করে শ্যামল বলে, তা অবশ্য ঠিক।

যাও ওপরে উঠে শুয়ে পড়ো। তার আগে আমাদের বেডরোলটা পেতে দাও। কম্বলচাপা দিতে হবে, যা ঠান্ডা ছেড়েছে। ওদের একটু বলল না গো, ঠান্ডাটা একটু কমিয়ে দিতে।

বললেই কি আর দেবে?

বলেই দেখো না।

এত রাতে কি আর মেশিনের লোক জেগে বসে আছে?

তুমি সব ব্যাপারেই বড্ড ফাঁড়া কটো। ঘরের বাঘ, বাইরের বেড়াল। যাও তো, একটু হাঁকডাক করো। পুরুষ মানুষকে একটু হাঁকডাক করতে হয়। মেনিমুখো হয়ে থাকলে চলে না।

যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি।

এইসব ছোটখাটো প্রবলেম কখনওই মেটাতে পারে না শ্যামল। তার কপালটাই এরকম। বউ তাকে যত তাড়না করে ততই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে, ততই গুবলেট হয়ে যায় সবকিছু। এই যেমন এখন শ্যামল করিডোর বা আশেপাশে কাউকে পেল না। মেঝেতে একটা কাপড় পেতে দু’টি লোক গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। কন্ডাক্টরও জায়গায় নেই। শূন্যকে তো আর কিছু বলা যায় না। শ্যামল অগত্যা ফিরে এল।

কেউ নেই। কাকে বলব?

ইস, এত ঠান্ডায় ঠিক সর্দি লেগে যাবে টুকুসের। ওর তো ঠান্ডা একদম সহ্য হয় না।

ভাল করে কম্বলচাপা দিয়ে রাখো না। মনে করে নাও এটা শীতকাল।

শীতকালের ঠান্ডা আর এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডা মোটেই এক নয়। আর্টিফিসিয়াল ঠান্ডা শরীরের পক্ষে ভীষণ খারাপ, বিশেষ করে যাদের সর্দির ধাত আছে। তোমার দ্বারা কোনও কাজ হওয়ার নয়। আমি টুকুসকে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি বিছানাটা তাড়াতাড়ি করে দাও।

ঠিক এই সময়ে বিষণ্ণ বিশ্বরূপ মৃদু স্বরে বলে, দাঁড়ান, আমি ঠান্ডা কমানোর ব্যবস্থা করে আসছি।

বলে উঠে গেল।

দেখলে! সবাই তোমার মতো নয়। তুমি নিজের জন্য যা পারলে না, এ ছেলেটা পর হয়েও কেমন উঠে গেল।

বিছানা পাততে পাততে শ্যামল বলে, তুমি ছেলেটার সঙ্গে কিন্তু বেশ অভদ্র ব্যবহার করেছ। আমি ইন্ট্রোডিউস করে দেওয়া সত্ত্বেও একটাও কথা বলেনি।

বেশ করেছি। যা ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল! সেইজন্যই তো উঠে মাসিমার কাছে গিয়েছিলাম।

তাকাচ্ছিল! ওয়েল, ওয়েল, দ্যাটস এ গুড সাইন।

তোমার মুন্ডু! এখন যাও তো, ওপরে ওঠো। পর্দাটা টেনে দাও।

পায়জামা আর হাওয়াই শার্ট পরা একটা লোক এসে কিউবিকলের ভিতরে উঁকি দিয়ে বলে, ঠান্ডা কমিয়ে দিয়েছি স্যার। বুঝতে পারছেন?

বকুল বলে, না তো। বেশ ঠান্ডাই লাগছে।

আর দশ মিনিটের মধ্যেই টের পাবেন। না হলে বলবেন আমাকে, আমি মেশিনের। কাছেই থাকব।

ঠান্ডাটা বাস্তবিকই একটু কম-কম লাগছিল শ্যামলের। একটু লজ্জাও করছিল। সে পারেনি। বিশ্বরূপ পারল।

ছেলেটা ফিরে আসতেই শ্যামল বলে, থ্যাংক ইউ। আমি লোকটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মেঝেয় পড়ে ঘুমোচ্ছিল, তাই বুঝতে পারেননি।

বকুল একটু কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলে, আপনাকে উঠতে হল, লজ্জা করছে সেজন্য। আসলে আমার কর্তাটি একদম মুখচোরা মানুষ। আমিই ওকে চালিয়ে নিই।

বুঝতে পারছি। আপনাদের আরও একটা প্রবলেম আছে বোধহয়। হাওড়া স্টেশনে বেশি রাতে পৌঁছানোর প্রবলেম।

শ্যামল সোৎসাহে বলে, হ্যাঁ, বিগ প্রবলেম।

বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, নো প্রবলেম। আমার জন্যও স্টেশনে একটা গাড়ি থাকবে। সেই গাড়িই পৌঁছে দেবে আপনাদের। নিশ্চিন্তে ঘুমোন।

ভগবানে বিশ্বাস ছিল না শ্যামলের। এখন মনে হল, বলা যায় না, ওরকম একটা কেউ থাকলেও থাকতে পারে। একটু একচোখো বটে, বড়লোকদের পিছনেই বেশি তেল খরচা করে বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে ঘোর নাস্তিককেও একটু খাতির-টাতির দেখায়।

বারকয়েক থ্যাংক ইউ বলে বাঙ্কে উঠে পড়ল শ্যামল। এত নিশ্চিন্ত এত ভারহীন লাগছিল তার যে ঘুম আসতে চাইছে না। অথচ, কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম। বাস্তবিকই নিঝুম। হঠাৎ একটু সচকিত হয়ে ওঠে সে, গাড়িটা কি বড্ড বেশি জোরে চলছে না! বড্ড বেশি দুলছে না! ব্রেক-ট্রেক ফেল করেনি তো! এমনও তো হতে পারে যে, কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী ইঞ্জিনে উঠে অ্যাট গান-পয়েন্ট ড্রাইভারকে বাধ্য করছে গাড়ি একনাগাড়ে চালিয়ে নিতে। এ দেশে সবই হতে পারে। কিছু বিশ্বাস নেই।

বাথরুম ঘুরে আসবে বলে বাঙ্ক থেকে নেমে সে দেখল, বকুল আর টুকুস নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওপরের বাঙ্কে মাড়োয়ারি, নীচের সিটে বিশ্বরূপ এবং আশেপাশে কেউ জেগে নেই। সে করিডোরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খেল। ট্যাপ থেকে একটু জলও খেল।

এরপর ঘুমটা হল তার। লম্বা ঘুম। সকাল আটটা পর্যন্ত। তখনও পাটনা জংশন আসেনি। আসতে দেরি আছে। টুকুস শান্তভাবে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। বকুল আধো-জাগা আধো-ঘুমে শুয়ে আছে তখনও। বিশ্বরূপ জানালার বাইরে তেমনি চেয়ে আছে। মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বোধহয় বাথরুমে।

শ্যামল ঘড়ি দেখে বলল, আরও লেট করেছে নাকি ট্রেন?

বিশ্বরূপ মুখ ফিরিয়ে একটু হাসল, করেছে। কিন্তু দারুণ রান করছিল মাঝরাতে। মোঘলসরাইয়ের আগে আটকে ছিল অনেকক্ষণ।

এঃ, তা হলে যা ভয় করছিলাম তাই হল।

কীসের ভয়?

মধ্যরাত্রির ভয়।

বিনা স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। কামরার আবছায়া থেকে করিডোরে বেরিয়ে আসে শ্যামল। হাতে পেস্ট লাগানো টুথব্রাশ, কঁাধে তোয়ালে। ডানদিকের দরজাটা খোলা। দরজার সামনে উবু হয়ে বসে একটা লোক দাতন করছে। আর দরজার ওপাশে হা হা করছে উদোম চাষের মাঠ, রোদে ঝলমল। ঠান্ডা বাতাস আসছে হু হু করে। কী যে অপার্থিব সুন্দর লাগল এই পৃথিবীকে! মুগ্ধ হয়ে শ্যামল চেয়ে থাকে। গাছপালা, খেতখামার, কুটির, বোদ, দিগন্ত সে কি অনেক দেখেনি? তবু মাঝে মাঝে এরা সব এক বিশেষ বিন্যাসে এমন অপরূপ হয়ে যায়, যেন ম্যাজিক। আসলে তার মনটাও বোধহয় আজ ভাল আছে। কোনও টেনশন নেই। কিছুক্ষণের সম্মোহন কাটিয়ে সে বাথরুমে ঢুকে গেল।

সম্মোহন আরও কাটল যখন বেলা তিনটে নাগাদ ঝাঝা স্টেশনের আগে গাড়ি একদম চুপ মেরে গেল। গেল তো গেলই। নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। এক ঘণ্টা বাদে অফ করে দেওয়া হল এয়ার-কন্ডিশনার। শোনা গেল, সামনের লাইনে ফাটল। ট্রেন কখন ছাড়বে ঠিক নেই। কন্ডাকটর আর মেকানিকের সঙ্গে কিছু যাত্রী লড়ালড়ি করল বটে, কিন্তু কন্ডাকটর সাফ জবাব দিল, ট্রেন চালু না হলে এ সি চালানো যাবে না সাহেব। মেশিন বসে যাবে। সুতরাং বদ্ধ কামরা গরম হতে লাগল। ভেপে উঠতে লাগল।

বকুল বলল, কী হবে?

হতাশ শ্যামল বলে, কী আর হবে! সাফার করা ছাড়া আর কী উপায় আছে?

কামরার গরম ভ্যাপসা ভাব সহ্য করতে না পেরে অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বিশ্বরূপ অনেকক্ষণ হল সিটে নেই। মাড়োয়ারিও নেই। শ্যামলও উঠল।

কোথায় যাচ্ছ? সিগারেট খেতে?

আরে না। সিগারেটও শেষ হয়ে এল প্রায়। আর মোটে গোটা পাঁচেক আছে। আদ্রা বা পাটনায় কিনে নিলে হত। বাইরে গিয়ে একটু ভোলা হাওয়ায় দাঁড়াই।

আচ্ছা স্বার্থপর তোক তো তুমি! নিজে গিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াবে! আর আমরা।

এইভাবেই সূচনা হয় এবং লেগে যায়। বিবাহিত জীবনকে কি এখন ভয় পায় শ্যামল? পায় বোধহয়। আবার বকুল ছাড়াও কি তার চলে? প্লাসও আছে, মাইনাসও আছে। পাঁচ বছর বয়সি বিয়েটা শেষ অবধি টিকে থাকবে কি না এ নিয়েও তার সন্দেহ আছে। মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে চলে যায় তাদের ঝগড়া যে শ্যামল সংসার-ত্যাগের কথা ভাবে, ডিভোর্সের কথা ভাবে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে সম্পর্কের কিছু অবনতি হয়েছিল। তারপর থেকে ক্রমাবনতি।

শ্যামল খুব ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বলে, তুমি নামতে চাও? কিন্তু ট্রেন হঠাৎ ছেড়ে দিলে!

মোটেই নামতে চাই না। তুমিও নামবে না। সকাল থেকে মেয়েটাকে আগলে বসে আছি। ওকে একটু রাখো, আমি শোব। মাথা ধরেছে।

অগত্যা মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্যামল বলে, একটু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারি কি? না কি তাতেও আপত্তি আছে?

গাড়ি থেকে নামবে না কিন্তু, খবরদার!

আরে না।

করিডোরে এখন দু’দিকেরই দরজা খোলা। চারদিকে খাঁ খাঁ করছে রোদ। প্রকৃতির দৃশ্য এখন আর তত সুন্দর নেই। রুক্ষ, গরম, ঘোলাটে, বাইরে অন্তত কয়েকশো লোক নেমে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। হকার ঘুরছে। শান্ত মেয়েটিকে কোলে নিয়ে শ্যামল দাঁড়িয়ে রইল। থেমে থাকা ট্রেনের মতো এমন অভিশাপ আর মানুষের জীবনে কীই বা আছে?

ওটা কী বাবা?

শ্যামল হঠাৎ দুর্দশার কথা ভুলে মেয়ের গালে নাক ডুবিয়ে দিল।