থানার ও সি এসেছেন, শিখেন্দু বললে, দীপাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান উনি স্বাতী।
বীরেন মুখার্জী তাকালেন দীপিকার মুখের দিকে।
কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দীপিকা।
বীরেন মুখার্জী দুপা এগিয়ে গিয়ে একেবারে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ডাকলেন, দীপিকাদেবী?
দীপিকা কোন সাড়া তো দিলই না, তাকালও না বীরেন মুখার্জীর দিকে, যেন শুনতেই পায়নি সে, কোন শব্দই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি যেন।
দীপিকাদেবী, আমি বুঝতে পারছি, আপনার বর্তমান মনের অবস্থা কি! এও বুঝতে পারছি, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করা সমস্ত মানবিকতার বাইরে, তবু বুঝতেই পারছেন আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবার জন্যই আপনাকে, মনের বর্তমান অবস্থাতেও, বিরক্ত করতে হচ্ছে, কারণ আপনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে আপনার স্বামী ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে মৃত রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন।
কিন্তু তথাপি কোন সাড়াই পাওয়া গেল না দীপিকার মধ্যে যেন। কথাগুলো যেন তার কানে প্রবেশই করেনি, প্রস্তরমূর্তির মত যেমন বসেছিল দীপিকা, তেমনই বসে রইল।
দীপিকাদেবী!
বাধা দিল এবারে স্বাতীই, নির্বাণীতোষের বোন। বললে অসহিষ্ণু কষ্ঠে, কেন ওকে বিরক্ত করছেন দারোগাবাবু এভাবে! ওকে এখন প্রশ্ন করে লাভ নেই। কোন প্রশ্নেরই জবাব পাবেন না ওর কাছ থেকে।
আপনার কথাঠিকইস্বাতীদেবী, কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আইনের দিক থেকে আমি নিরুপায়।
না, প্লিজ, ওকে এখন বিরক্ত করবেন না। আমাদের যা-সর্বনাশ হবার তো ইয়েই গিয়েছে, ওকে এখন উত্ত্যক্ত করবেন না।
ঠিক আছে, কাল সকালে আমি কোন এক সময় না হয় আসব, চলুন শিখেন্দুবাবু, বীরেন মুখার্জী বললেন।
শিবতোষের ঘরে এসে যখন ওরা ঢুকল, শিবতোষ তখন কাকে যেন ফোন করছেন।
নির্বাণীতোষের আকস্মিক মৃত্যুটা শিবতোষকে প্রথমটায় সত্যিই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। প্রত্যেককেই একদিন না একদিন মরতে হবেই, মৃত্যু আসবেই, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে না এসে সেই মৃত্যু যখন অচিন্ত্যনীয় আকস্মিকভাবে এসে পড়ে, তখন সত্যিই যেন কেমন বিহুল বিমূঢ় করে দেয়। আবার সেই মৃত্যু যদি স্বাভাবিক না হয়ে নিষ্ঠুর হত্যা হয়, তাহলে যেন কোথাও কোন সান্ত্বনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা অসহায় শূন্যতা যেন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে।
শিবতোষের মনের অবস্থাটাও ঠিক সেই রকমই হয়েছিল।
কিন্তু সহজে একেবারে ভেঙ্গে পড়বার মত মানুষ ছিলেন না শিবতোষ। বরাবরই তাঁর অসাধারণ মনবল।
অনেকখানি আশা ছিল শিবতোষের নির্বাণীতোষের ওপরে। সেই নির্বাণীতোষ চলে গেল গেল না, কেউ নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করেছে।
কে? কে এমন করে তাকে হত্যা করে গেল? নিঃসন্দেহে তার কোন শত্রু। কিন্তু নির্বাণীতোষের কোন শত্রু ছিল, কথাটা যেন আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ছেলেকে আর শিবতোষ ফিরে পাবেন না ঠিকই, কিন্তু যেমন করেই হোক তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে—এ কাজ কার! কে হত্যা করেছে নির্বাণীতোষকে!
কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একসময় একজনের কথা মনের মধ্যে উদয় হয় শিবতোষের। পুলিস হয়ত কোনদিনই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারবে না, তারা হয়ত নিয়মমাফিক খানিকটা অনুসন্ধান চালাবে, তারপর সাধারণত যা ঘটে থাকে তাই ঘটবে, সমস্ত ব্যাপারটাই ফাইল-চাপা পড়ে যাবে।
কিন্তু শিবতোষের তা হলে তো চলবে না। তাঁকে জানতেই হবে হত্যাকারী কে? কেন। সে হত্যা করল? কি অপরাধ করেছিল নির্বাণীতোষ যে তাকে নিহত হতে হল?
কিন্তু কেমন করে হত্যাকারীকে তিনি খুঁজে বের করবেন! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে। বছর দুই পূর্বেপরিচয় হয়েছিল মানুষটির সঙ্গে ঘটনাচক্রেশিবতোষের। তাঁরই এক কর্মচারী তাঁর চেকের, সই জাল করে অনেকগুলো টাকা তাঁর ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়েছিল। একবার নয়, চার-পাঁচ মাস ধরে থোকে থোকে প্রায় হাজার ত্রিশেক টাকা তুলে নিয়েছিল।
যে ব্যাঙ্ক থেকে দ্বিজেন অথাৎ সেই কর্মচারীটি টাকা তুলেছিল তাঁর সই জাল করে, সে ব্যাঙ্ক থেকে বড় একটা টাকা তুলতেন না শিবতোষ। মধ্যে মধ্যেই জমা দিতেন কেবল টাকা। শিবতোষের বিশেষ এক পরিচিত ভদ্রলোকের ছেলে ঐ দ্বিজেন দত্ত। সেই ভদ্রলোক হঠাৎ হাইপারটেনশনে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং শিবতোষকে অনুরোধ করায় তিনি দ্বিজেনকে নিজের অফিসে চাকরী দিয়েছিলেন, বছর দেড়েক অত্যন্ত সততার পরিচয় দিয়েছিল দ্বিজেন, যাতে করে শিবতোষের বিশ্বাস জন্মায় দ্বিজেনের ওপর।
দ্বিজেনের হাত দিয়ে অনেক সময় টাকা জমা দিয়েছেন এবং ব্যাঙ্ক থেকেও টাকা তুলেছেন চেক দিয়ে, হঠাৎই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন শিবতোষ সেই ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট অফ অ্যাকাউন্ট থেকে, অনেক টাকা থোকে থোকে তোলা হয়েছে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে অথচ গত আট-ন মাসের মধ্যে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে কোন টাকাই তিনি তোলেননি, সবই ছিল বেয়ারার চেক, এবং খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ যখন চেকগুলো পেশ করল, তখন তিনি তো হতবাক। অবিকল তাঁরই সই।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন শিবতোষ। কে তাঁর সই জাল করে টাকা তুলল। সেই সময়ই এক পরিচিত ভদ্রলোক তাঁকে কিরীটী রায়ের সন্ধান দেন এবং কিরীটী রায়ই শেষ পর্যন্ত জালিয়াতকে ধরে দেয়।
সেই থেকেই জানা-শোনা ও পরিচয়। মানুষটির অদ্ভুত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিল শিবতোষ। হঠাৎ তাঁরই কথা মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন এবং তাঁর ঘরে যে নিজস্ব ফোন ছিল, তার রিসিভার তুলে ডায়েল করলেন।
রাত তখন প্রায় তিনটে।
কিছুক্ষণ রিং হবার পরই অপর প্রান্ত থেকে সাড়া এল, কিরীটী রায় কথা বলছি।
কিরীটীবাবু, আমি শিবতোষ মল্লিক—
এত রাত্রে কি ব্যাপার মল্লিক মশাই!
একবার এখুনি দয়া করে আমার বেলতলার বাড়িতে আসবেন?
ব্যাপার কি? হঠাৎ কি হল এখন? আজ রাত্রে তো আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়ে এলাম আপনার একমাত্র ছেলের বৌভাতের—
সেই ছেলে—
কি হয়েছে!
তাকে কেউ খুন করে গেছে।
সে কি!
হ্যাঁ, একবার দয়া করে আসুন, পুলিসও এসেছে—
ঐ সময়ই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দু ঘরে প্রবেশ করে।
দেরি করবেন না মিঃ রায়, যদি বলেন তো গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। বললেন শিবতোষ মল্লিক।
না না, তার কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসছি।
শিবতোষ ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হল।
বীরেনবাবু দেখলেন? শিবতোষ প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
কিছু বুঝতে পারলেন?
আজ তো এ বাড়িতে উৎসব ছিল, অপরিচিত অনেক লোক আসা-যাওয়া করেছে, হত্যাকারী তাদেরই মধ্যে কেউ
সেটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় বীরেনবাবু, কিন্তু কে কখন ওকে খুন করে গেল?
বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে এবং আরও অনুসন্ধান না করে এই মুহূর্তে সেটা বলা তো সম্ভব নয় শিবতোষবাবু। বীরেন মুখার্জী বললেন।
শুনুন বীরেনবাবু, ছেলেকে আর আমি ফিরে পাব না কোনদিনই জানি, কিন্তু কে এ কাজ করল সেটা আমাকে যেমন করে যে উপায়ে হোক জানতেই হবে।
আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করব শিবতোষবাবু, কিন্তু একটু আগে ফোনে আপনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?
কিরীটী রায়।
তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নাকি?
আছে। তাই তাঁকে আসতে বললাম।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত যদিও হয়নি, কিন্তু ওঁর নাম আমি শুনেছি, শুনে খুব খুশি হলাম তিনি আসবেন।
এ বাড়িতে যাকে যা জিজ্ঞাসা করবার আপনি করতে পারেন বীরেনবাবু, শিখেন্দু আপনার সঙ্গে থাকবে, ঐ আপনাকে সাহায্য করবে। শিখেন্দু আমার বন্ধু-পুত্রই নয় কেবল, ও এ-বাড়ির ছেলের মত, আমার ছেলের ক্লাস-ফ্রেণ্ড। এ বাড়ির কোন কিছুই ওর অজানা নেই। কোন কিছু যদি জানবার দরকার হয় আপনার, ওকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন।
হ্যাঁ, উনি যে আপনার বন্ধু-পুত্র এবং এ-বাড়ির সঙ্গে বিশেষ পরিচিত, আপনার ছেলের ক্লাস-ফ্রেণ্ড, সবই ওঁর কাছ থেকে আমি জেনেছি। বীরেন মুখার্জী বললেন। তারপর একটু থেমে বীরেন আবার বললেন, আপনাকেও আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে—
বলুন কি জানতে চান?
আপনার আর এক স্ত্রী ছিলেন, তিনি আজ মৃত—
একটু যেন চমকে উঠলেন শিবতোষ। বললেন, কার কাছে শুনলেন?
কথায় কথায় শিখেন্দুবাবু বলছিলেন একটু আগে, আগের স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তানও আছে আপনার।
শিবতোষ শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে একবার তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে বেশ বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে যেন সামলে নিয়ে বীরেন মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই শুনেছেন, কিন্তু সে ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনার কোন সম্পর্ক আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে নাকি?
কোন ঘটনার সঙ্গে কোন্ ঘটনার যে কি সম্পর্ক থাকে বা থাকতে পারে, সে কি কেউ বলতে পারে শিবতোষবাবু?.
শিবতোষ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, বিয়ের পর সে স্ত্রী আমার বছর কয়েক মাত্র বেঁচেছিল, আর তার একটি ছেলেও আছে। নির্বাণীর চেয়ে সে বছর চারেকের বড়, কিন্তু সে ছেলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কেন?
ছেলে যদি বাপের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চায়–তো বাপ কি করতে পারে?
তা ঠিক, কিন্তু তার কি কোন কারণ আছে?
আমার দিক দিয়ে অন্ততঃ জানি কিছু নেই, তার দিক থেকে থাকতে পারে।
কিছু অনুমান করতে পারেন না?
না।
একটা কথা—
বলুন?
সে যখন আপনারই ছেলে, আপনার সম্পত্তিতে নিশ্চয়ই তার অধিকার আছে?
সে-সব কথা আমি আজ পর্যন্ত ভাবিনি।
কেন?
ভাববার প্রয়োজন হয়নি বলে। কিন্তু এ-সব অবান্তর প্রশ্ন কেন করছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
এনকোয়ারীর ব্যাপারে আমাদের সব কিছুই জানা দরকার।
ঠিক আছে। আপনার আর কি জিজ্ঞাস্য আছে বলুন?
আপনার প্রথম পক্ষের সেই ছেলে কখনও এ বাড়িতে আসেনি?
সে আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেনি, একটু আগেই তো সে কথা আপনাকে বললাম।
সে না এলেও আপনি তার কোন খোঁজখবর রাখেন না?
না।
বড় হবার পর তাকে দেখেছেন? মানে কখনও আপনাদের পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?
না না, যেন একটু ইতস্ততঃ করেই কথাটা উচ্চারণ করলেন শিবতোষবাবু।
তারপরই যেন একটু রূঢ় অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, নিশ্চয়ই। আর কিছু আপনার জিজ্ঞাসা করার নেই দারোগাবাবু আমার অতীত জীবন সম্পর্কে! প্লিজ, আমাকে যদি একটু একা থাকতে দেন
স্পষ্টভাবে না বললেও একপ্রকার যেন বললেনই শিবতোষবাবু বীরেন মুখার্জীকে অতঃপর ঘর ছেড়ে যাবার জন্য।
বীরেন মুখার্জী শিখেন্দুকে চোখের ইশারা করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। শিখেন্দুও তাঁকে অনুসরণ করল।
বারান্দায় পা দিয়ে বীরেন মুখার্জী বললেন, মিঃ মল্লিক আমাদের পুলিসকে যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।
না না, সে-রকম কিছু নয়, বুঝতে পারছেন পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে উনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন।
তা হয়ত পেয়েছেন শিখেন্দুবাবু, কিন্তু উনি ওঁর ব্যালেন্স হারাননি, যা এক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক।
বরাবরই লক্ষ্য করেছি, অতি বড় বিপর্যয়েও উনি যতই বিচলিত হোন না কেন, ধৈৰ্য্য ও বিচারবুদ্ধি উনি হারান। অদ্ভুত স্ট্রেংথ অব মাইশু!
তাই মনে হল। যাক গে, বাড়ির সকলকেই আমি কিছু কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
তাহলে নীচে চলুন, নীচের পারলারে বসেই আপনি যাকে যা জিজ্ঞাসা করবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।
তাই চলুন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওরা এসে পারলারে বসল।
বেশ প্রকাণ্ড আকারের একটি হলঘর। দামী সোফা সেট, মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো। উৎসবের জন্য বোধহয় আরও অনেক চেয়ার পাতা হয়েছিল পারলারে। সেগুলো সরানো হয়নি। যেমন ছিল তেমনি আছে।
আলোও জ্বলছিল ঘরে। গোটা দুই সিলিং ফ্যান তখনও বন্ধ করে ঘুরছিল। ঘরের এক কোণে একটা বিরাট গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক, সেকেলে। রাত সাড়ে তিনটে। ফানের মাঝামাঝি সময়টা, এখনও রাত্রি-শেষের দিকে একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগে।
একটা সোফায় বসলেন বীরেন মুখার্জী।
কাকে কাকে ডাকব বলুন? শিখেন্দু শুধাল।
সবাইকেই, তবে এক সঙ্গে নয়, এক এক করে—
বেশ, বলুন কার্কে প্রথমে ডাকব?
স্বাতীদেবীকে আগে ডাকুন, তারপর তাঁর দিদি স্মৃতিদেবীকে ডাকবেন।
আপনি বসুন, আমি ডেকে নিয়ে আসছি স্বাতীকে। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং একটু পরেই স্বাতীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বসুন স্বাতীদেবী, বীরেন মুখার্জী বললেন।
আমি দাঁড়িয়েই আছি, আপনি কি জানতে চান? স্বাতীর কণ্ঠস্বর অসহিষ্ণু ও বিরক্ত মনে হল।
আজ রাত্রে বৌকে কোথায় বসানো হয়েছিল?
দোতলার একটা ঘরে। স্বাতী বললে।
সেখান থেকে কখন বৌকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়?
বোধ হয় রাত পৌনে বারোটা কি বারোটা হবে তখন।
কে নিয়ে গিয়েছিল বৌকে ওপরে?
আমিই দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে আসি নীচে নেমে।
সে-সময় বারান্দার তিনতলায় কাউকে দেখেছিলেন?
স্বাতী জবাব দেবার আগেই কিরীটী এসে পারলারে ঢুকল। সকলেই কিরীটীর দিকে তাকাল এক সঙ্গে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের মুখের দিকেই পর্যায়ক্রমে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর শিখেন্দুর দিকেই তাকিয়ে বললে, শিবতোষবাবুকে একটা খবর দিতে পারেন?
চলুন ওপরে, কাকাবাবু ওপরে তাঁর ঘরের মধ্যেই আছেন। শিখেন্দু বললে কিরীটীর কথাটা শেষ করার আগেই। বীরেন মুখার্জীর পরনে ইউনিফর্ম ছিল, তাই তাঁর সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও কিরীটী অনুমানেই বুঝতে পারে তিনি একজন পুলিসেরই অফিসার। এবং সেই অনুমানের ওপরেই নির্ভর করে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললে, মনে হচ্ছে আপনি এ এলাকার থানা অফিসার!
জবাব দিল শিখেন্দুই, হ্যাঁ মিঃ রায়, উনিই এখানকার থানা-অফিসার বীরেন মুখার্জী।
নমস্কার, আমি কিরীটী রায়। কিরীটী বললে।
নমস্কার। বীরেন বললেন, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি বটে, তাহলেও আপনার নাম আমি অনেকই শুনেছি আমাদের ডি.সি, চাটুয্যে সাহেব তো আপনার প্রশংসায় একেবারে উচ্ছ্বসিত–
শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাঁর ছেলে ডাঃ নির্বাণীতোষ মল্লিককেও আমি চিনতাম—আজ এখানে আমি নিমন্ত্রণে এসেছিলামও।
আমিও এসেছিলাম কিরীটীবাবু।
আপনিও এসেছিলেন?
হ্যাঁ–বসুন না।
কিরীটী বীরেন মুখার্জীর আহ্বানে তাঁর সামনেই একটা সোফায় উপবেশন করল। তারপর প্রশ্ন করল, মৃতদেহ দেখেছেন?
হ্যাঁ-মোটামুটি যা দেখবার দেখেছি, ভাবছিলাম এবারে এ-বাড়ির লোকদের জবানবন্দি নেব। বীরেন মুখার্জী অতঃপর যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, সংক্ষেপে বলে গেলেন।
সব শুনে কিরীটী কেবল একটা কথাই বললে, শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে? আগের স্ত্রীর একটি সন্তানও আছে?
তাই তো শুনছি। প্রথমা স্ত্রী সান্ত্বনাদেবীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।
প্রথমা স্ত্রী কি এ বাড়িতে কখনও আসেননি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
জবাব দিল শিখেন্দু, না, আসেননি।
চার বছর তো বেঁচেছিলেন—
তা ছিলেন, তবে রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কাকাবাবুর প্রথমা স্ত্রীকে কোনদিনই স্বীকার করেননি।
স্বাভাবিক। তাঁকে যতটুকু আমি দেখেছিলাম, আভিজাত্য ও অর্থের অহঙ্কার একটু বেশী মাত্রাতেই ছিল। কাজেই তাঁর পক্ষে তাঁর পুত্রের—তাঁর, জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে বিশেষ করে, এক সাধারণ গরীবের ঘরের মেয়েকে পুত্রবধূ বলে স্বীকার করে নেওয়া একটু কষ্টকর বৈকি।
আপনি তাঁকে দেখেছিলেন কিরীটীবাবু? বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন।
দেখেছি, মাত্র বছর কয়েক আগেই তো তিনি মারা গেছেন। কিরীটী বললে।
আমার মনে হয়, শিবতোষবাবুর অতীত জীবনের ব্যাপারে কোথায়ও একটা জট পাকিয়ে ছিল–নচেৎ তাঁর ছেলে জীবনে কখনও এ-বাড়িতে পদার্পণ করল না কেন? বীরেন মুখার্জী বললেন।
থাকাটা কিছু অসম্ভব নয় বীরেনবাবু! যাক, আপনি তাহলে আপনার কাজ করুন। আমি এবার শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করে তিনতলায় মৃতদেহটা দেখে আসি।
ঠিক আছে, আপনি যান। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।
না না—আমার জন্য আপনাকে বসে থাকতে হবে না। আমি না হয় কাল দিনের বেলায় কোন এক সময়ে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাছাড়া আপনার সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করাই সম্ভবপর নয়। বীরেন মুখার্জীর মুখের ভাব দেখে মনে হল কিরীটীর শেষের কথায় তিনি যেন একটু খুশিই হয়েছেন। আমি তাহলে ওপর থেকে ঘুরে আসি!
আসুন।
চলুন শিখেন্দুবাবু, কিরীটী বললে।
চলুন।
বাড়িটা তেমনি স্তব্ধ। সর্বত্র তেমনি তখনও আলো জ্বলছে।
নির্বাণীতোষের মা কল্যাণীদেবীর কান্নার শব্দটা তখন আর শোনা যাচ্ছে না। বারান্দা অতিক্রম করে কিরীটী শিখেন্দুর পেছনে পেছনে এসে শিবতোষবাবুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করল। শিবতোষ তখনো তেমনি করেই তাঁর ঘরের মধ্যে আরামকেদারাটারওপর বসে আছেন মুহ্যমানের মত।
সমস্ত মুখে একটা অসহায় বেদনার ক্লান্তি। পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন শিবতোষ, আসুন কিরীটীবাবু
আপনি উঠবেন না। বসুন মল্লিক মশাই।
শিবতোষ উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটীর কথায় আর উঠলেন না, বসেই রইলেন।
আমি জানি কিরীটীবাবু, আপনি বের করতে পারবেন—কে অমন নিষ্ঠুরভাবে খোকাকে খুন করে গিয়েছে। শিখেন্দু—শিবতোষের গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল।
আজ্ঞে? শিখেন্দু তাকাল শিবতোষের মুখের দিকে।
দারোগাবাবু চলে গেছেন?
না । নীচে এখন সকলের জবানবন্দি নেবেন। স্বাতীর জবানবন্দি নিচ্ছেন।
তুমি তাহলে নীচেই যাও।
শিখেন্দু নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবতোষ বললেন, ভদ্রলোক একটু বেশী মাত্রায়ই যেন ইকুইজিটিভ। যেটা আমার একেবারেই ভাল লাগেনি কিরীটীবাবু!
পুলিস তো সব কিছুই একটু সন্দেহের চোখে দেখবে—প্রশ্ন করবে শিবতোষবাবু!
তা করে করুক না, তাই বলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে অতীতে কার কি ঘটেছে সে ব্যাপারে এত অনাবশ্যক কৌতূহল কেন? আর আমার নিজের অতীতের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে খোকার খুনের সম্পর্কই বা কি! আর ঐ শিখেন্দুই বা যে কেন বলতে গেল আমি আমার বাড়ির অমতে এবং বাবাকে না জানিয়ে প্রথমবার বিয়ে করেছিলাম, সে স্ত্রী নেই—
হয়ত কিছু ভেবেই দারোগাবাবু প্রশ্নটা করেছেন। তারই উত্তর দিয়েছেন শিখেন্দুবাবু। কিরীটী শান্ত গলায় জবাব দিল।
তবু বলব—অহেতুক, অনাবশ্যক কৌতূহল। আমি আমার সম্পত্তির কি ব্যবস্থা করব, সে-বিষয়ে কিছু কখনও ভেবেছি কিনা
সেটাও হয়ত আপনার আর একটি সন্তান আছে জেনেই করেছিলেন তিনি।
সে আমাকে তার বাপ বলেই জীবনে কখনও স্বীকার করেনি, কোন সম্পর্কই আমার সঙ্গে রাখেনি–কাজেই সে থাকা না-থাকা দুই সমান–
তাহলেও আইনের দিক দিয়ে আপনার দুই ছেলে যখন, তখন আপনার সমস্ত সম্পত্তির সমান অংশীদার দুজনে।
আপনি জানেন না কিরীটীবাবু, দিলেও যে একটি সম্পদও সে আমার কখনও স্পর্শ করবে না, আমি খুব ভাল করেই জানি সে আমাকে ঘৃণা করে। তার মামারা, তার মামাদের মধ্যে যেমন সে বড় হয়েছে, একটু একটু করে একটা ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। অবহেলা করে তার মাকে আমি মৃত্যুর মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাবা তাকে কখনও স্বীকার করে নেবেন না বলে, এ-বাড়ির বধূর যোগ্য মর্যাদা দিয়ে, এখানে তার নিজস্ব গৌরবে, তাকে বিয়ে করা সত্ত্বেও, এনে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি কিন্তু তার মৃত্যু
কিরীটী বাধা দেয় না কোনরূপ মন্তব্যও প্রকাশ করে না। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, সম্পূর্ণ ঝোঁকের মাথাতেই জীবনের এক গভীরতম শোকের মুহূর্তে বিহুল বিমূঢ় শিবতোষ মল্লিক তাঁর অতীত জীবনের দুঃখের কথা বলে চলেছেন। যে ব্যথাটা হয়ত নিরুপায়, এত বছর ধরে তাঁর বুকের নিভৃতে গুমরোচ্ছে-আজ জীবনের এক চরম শোকের বিহ্বলতায় সেটা আপনা থেকেই বের হয়ে আসছে।
এ তো কান্নারই নামান্তর ছাড়া কিছুই নয়।
অসাধারণ মনের বল ও সংযম ভদ্রলোকের, তাই এখনও হাউ হাউ করে না চেঁচিয়ে স্থির হয়ে আছেন, যদিও প্রথম মুহূর্তে ঘটনার আকস্মিক আঘাতে সহসা জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
শিবতোষ যেমন বলছিলেন তেমনি বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুটামানে একটু একটু করে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে, সেদিন আমাকে একপ্রকার যেন নিরুপায় হয়ে বসে বসেই দেখতে হয়েছিল।
কি হয়েছিল তাঁর?
সারকোমা–বাঁ হাতের হাড়ে সারকোমা। জানি সে রোগের কোন চিকিৎসাই ছিল না, তবু টাকা হাতে থাকলে তাকে আমি বিদেশে নিয়ে গিয়ে শেষ চিকিৎসাটুকু অন্ততঃ করাতে পারতাম, কিন্তু বাবা তখন বেঁচে, সব তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে। সামান্য মাসোহারা ছাড়া তখন আর কিছুই আমি পাই না। কিন্তু সে আর কত, চার-পাঁচশো টাকা মাত্র!
তারপরই বোধ হয় অতীত স্মৃতির বেদনায় কয়েকটা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে থেকে আবার উদাস কণ্ঠে বলতে লাগলেন শিবতোষ, তবুমাকে দিয়ে আমি বাবাকে বলিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লোহার মত কঠিন মন তাঁর কিছুতেই গলল না।
আপনার স্ত্রীও তো নিজে আসতে পারতেন এ-বাড়িতে, তাঁর অধিকারকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য!
যেমন ভীরু তেমনি কোমল প্রকৃতির ছিল সান্ত্বনা, তা সত্ত্বেও সে দু-দুবার এসে বাবার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছে আমাকে না জানিয়েই, প্রথমবার তার ভাইদের সঙ্গে, কিন্তু বাবা দূর-দূর করে সান্ত্বনাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, শেষবারও অসুস্থ অবস্থাতেই মরার মাস দুই আগে এসেছিল এবং সেবারে আমিও সঙ্গে ছিলাম, ঢুকতে দিলেন না বাড়িতে। সান্ত্বনার ছেলের বয়স, মানে আমার সেই বড় ছেলে, তার বয়স তখন আড়াই বৎসর। তার মামাদেরও আমি দোষ দিই না কিরীটীবাবু। সান্ত্বনার বড় ভাই শশী, আমারই ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল, সেও আমাকে বুঝল না।
একটু থেমে শিবতোষ আবার বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুর প্র আমি আমার কর্তব্য করতে পারিনি কয়েক বছর। বাবাকে অনেক বলেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই আমার প্রথম সন্তানকে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন না। শেষটায় একবার বলেছিলেন, বেশ কিছু অর্থ সাহায্য তাকে করতে পারি, কিন্তু এ বাড়িতে তার স্থান হবে না।
আশ্চর্য কঠিন মন তো ছিল রায়বাহাদুরের!
সে যে কি কঠিন আমিই জানি। তারপর নিজের ইচ্ছেমত যখন খরচ করবার সুযোগ এল আমার জীবনে, ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু সে দেখাও করল না। ভাবতে পারেন কিরীটীবাবু, লক্ষপতি শিবতোষ মল্লিকের ছেলে লেখাপড়া করল না, কিছু না, সাধারণ একটা জুট মিলের শ্রমিক, অর্ডিনারী লেবারার—শিবতোষের গলার স্বর যেন বুজে এল।
চোখে জল নেই, কিন্তু কিরীটীর মনে হচ্ছিল, কান্নায় যেন ভদ্রলোকের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে।
বাবা!
শিবতোষের বড় মেয়ে স্মৃতি এসে ঘরে ঢুকল।
ডাক্তার চৌধুরীকে একবার ফোন করলে হতো না—
কেন?
বৌদি যে জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে বোবা হয়ে বসে আছে, এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলল না। এক ফোঁটা চোখের জলও নেই, আমার যেন কেমন ভাল লাগছে না। বাবা।
বেশ ফোন করে দাও।
কি বলব ফোনে?
আমি ডেকেছি তাই বলল। তোমার মা?
মার তো ঘন ঘন ফিট হচ্ছে।
আমিই ফোন করছি, শিবতোষ উঠে গিয়ে ফোন করতে লাগলেন।
ফোন করে আবার ফিরে এসে বললেন, তোমার মার কাছে গিয়ে বসে থাক।
স্মৃতি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমি একবার তিনতলাটা ঘুরে আসি শিবতোষবাবু।
যান।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল!
নির্বাণীতোষের ঘরের সামনে যে পুলিসটি প্রহরায় নিযুক্ত ছিল, সে চিনত কিরীটীকে, ওকে দেখে বললে, সাব—আপ!
ব্রিজনন্দন, তোমারা ডিউটি হ্যায় হিঁয়া?
জী সাব–আপ অন্দর যায়েঙ্গে?
হ্যাঁ।
যাইয়ে সাব।
কিরীটী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। দুটি নরনারীর জীবনে প্রথম মিলন-উৎসব রাত্রি, আয়োজনের কোন ক্রটিই রাখেননি শিবতোষ। দুটি হৃদয়ও উন্মুখ হয়ে ছিল পরস্পর পরস্পরকে গ্রহণ করবার জন্য, কিন্তু অকস্মাৎ মৃত্যু এসে সে মিলনেছেদটেনে দিয়েছে। পরস্পর পরস্পরের দীর্ঘদিনের পরিচিত, তবে তাদের জীবনের আকাঙিক্ষত রাতটি এমন করে ব্যর্থ হয়ে গেল কেন?
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা, তারা কি একবারও টের পায় নি তাদের পেছনে পেছনে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলে এগিয়ে আসছে।
ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করল কিরীটী। শুধু শয্যাই নয়, সমস্ত ঘরটাই ফুলে ফুলে সাজানো। এখনও ফুল ও ফুলের মালাগুলো বাসি হয়নি, শুকিয়ে যায়নি। এখনও রজনীগন্ধার গন্ধ ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে আছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে মহার্ঘ্য একটি পালঙ্ক, তার ওপরে দামী শয্যা বিস্তৃত। অন্যদিকে একটি তিন আয়মাওয়ালা ড্রেসিং-টেবিল, নানা প্রসাধন দ্রব্য তার ওপর সাজানো। একপাশে একটি সোফা-কাম-বেড। দুদিককার দেওয়ালে সুদৃশ্য ব্র্যাকেট আলো বসান, টিউব আলো। উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। ঘরের দেওয়াল হালকা ক্রিম কালারের প্লাস্টিক ইমালশন করা, দেওয়ালেগোটা দুইল্যান্ডস্কেপ! আর বাঁ দিককার দেওয়ালে একটি যুগল ফটো। দুটি হাসিভরা মুখ পাশাপাশি।
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা।
খোলা জানলাপথে রাত্রিশেষের হাওয়া ঝিরঝির করে এসে ঢুকছে। বাথরুমের দিকে তাকাল কিরীটী-দরজাটাখোলা, ভেতরে আলো জ্বলছেতখনও। আলোটানেভানো হয়নি। নেভানোর কথা হয়তো কারও মনেও হয়নি।
বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল কিরীটী। ভিতরে পা দিতেই নজরে পড়ল নির্বাণীতোষের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটা। পাঞ্জাবীর উপর থেকেই একটা ক্ষতস্থান নজরে পড়ে।
কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিরীটী ভূলুণ্ঠিত নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে।
বেসিনের ঠিক সামনেই দেহটা একেবারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বেসিনের ট্যাপটার মুখটা খোলা ছিল, বীরেন মুখার্জী বন্ধ করে দেন, কাঁচের গ্লাসটা বেসিনের ওপরেই রয়েছে। একবার বেসিন ও একবার ভূলুণ্ঠিত দেহটার দিকে তাকাল কিরীটী। গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে, পরীক্ষা করতে গিয়ে নজরে পড়ল গ্লাসটার গায়ে চিড় খেয়ে ফেটে গেছে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আবার সামনে তাকাল কিরীটী।
বেসিনের ওপরে একটা আয়না বসানো। কিন্তু বেসিনটা ঘরের দেওয়ালে এমনভাবে বসানো যে শয়নঘর থেকে কেউ বাথরুমে প্রবেশ করলেও বেসিনের সামনে আয়নায় কোন প্রতিচ্ছবি পড়বে না, মেথরদের যাতায়াতের দরজাটার দিকে তাকাল একবার কিরীটী, দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজাপথে কেউ এলেও আয়নায় প্রতিচ্ছবি পড়বে না।
মৃতদেহের অবস্থান দেখে মনে হয়, এই বাথরুমের মধ্যে কেউ নির্বাণীতোষকে পশ্চাৎদিক থেকে ছোরার সাহায্যে চরম আঘাত হেনেছে।
বাথরুমের মেঝেতে একটা কোডোপাইরিন ট্যাবলেটের স্ট্রিপ পাওয়া গিয়েছে। বেসিনের ওপরে একটা কাঁচের গ্লাসও আছে, মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে বন্ধুদের শেষ ব্যাচ খাবার পর নির্বাণীতোষ ওপরে চলে এসেছিল। রাত তখন পৌনে এগারটা। অন্ততঃ শিখেন্দুর কথা যদি ঠিক হয়, ঐ ঘরে তখন কেউ ছিল না, মানে বাড়ির কেউ ছিল না, নতুন বৌ নিচের তলায় তখনও ছিল এবং সেখানেই নতুন বৌকে ঘিরে ছিল ভিড়।
নতুন বৌকে স্বাতী ওপরে ঘরের সামনে যখন ছেড়ে দিয়ে যায়, রাত তখন পৌনে বারোটা কি বারোটা। তার মানে প্রায় একঘণ্টা সময়, পৌনে এগারটা থেকে পৌনে বারোটা, যা কিছু ঘটবার ঘটেছিল, ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কেউ ওপরে এসেছিল কিনা! যদি কেউ এসে থাকে তো সে কে? তারপর শিখেন্দু কখন ওপরে আসে? সম্ভবতঃ বারোটার কয়েক মিনিট পরে ও ওপর থেকে চিৎকারের শব্দটা শোনার পর। শিখে ওপরে এসেও জানায়নি কিছু। চেঁচামেচি বা ডাকাডাকি করেনি কাউকে। শিবতোষ ওপরে এসে দেখেন শিখেন্দু দাঁড়িয়ে আর মেঝেতে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে দীপিকা।