০২. তিন চার আটকাও দ্বার
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন পৌনে দুটো। দিবা নিদ্রার সময়। এরকুল পোয়ারো দ্বিপ্রহরিক আহার সেরে সবেমাত্র আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়েছেন। ঠিক তখনই ঝনঝন শব্দে টেলিফোনটা বেজে উঠল। টেলিফোনটা প্রথমে মি. পোয়ারো ধরলেন না। তিনি জর্জের ধরার অপেক্ষায় রইলেন।
জর্জের রিসিভার তুলে কথা বলার ভঙ্গি দেখে মি. পোয়ারো জানতে চাইলেন কার ফোন? কি বলছেন?
জর্জ রিসিভারের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল–চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ, স্যার।
পোয়ারো চিন্তিত মুখে রিসিভারটা হাতে নিয়ে বললেন–হ্যাঁল্লে জ্যাপ। ব্যাপার কি?
–পোয়ারো বলছেন? ও প্রান্ত থেকে কথা ভেসে এল। হ্যাঁ বলছি।
–আপনি আজ সকালে দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের কাছে গিয়েছিলেন নাকি? খবরটা কি সত্যি?
-হ্যাঁ গিয়েছিলাম, কিন্তু এধরনের প্রশ্ন করার কারণ কী?
–আশা করি এই যাওয়ার পেছনে কোনো গোপন রহস্য নেই? নিছকই সৌজন্যের খাতিরে গিয়েছিলেন?
–অবশ্যই নেই। যদি সন্দেহ হয় তবে শুনুন আমি গিয়েছিলাম দাঁতের অসহনীয় যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে।
তার কোনো আচরণ কি আপনাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল? তার হাবভাব কি আর পাঁচটি দিনের মতো স্বাভাবিক ছিল?
না, ঠিকই ছিল। কেন বলুন তো?
জ্যাপ কর্কশ স্বরে জবাব দিলেন–কারণ আপনি চলে আসার কিছুক্ষণ পরেই তিনি আত্মঘাতী হন, নিজের গুলিতেই তিনি মারা যান।
পোয়ারো আশ্চর্য হয়ে বললেন–না, এ হতে পারে না।
জ্যাপ কঠিন স্বরে বললেন–কথাটা শুনে আপনি বোধহয় আকাশ থেকে পড়লেন।
–সেটাই তো স্বাভাবিক।
আমিও একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে চাই। একবার এলে ভালো হয়।
–আপনি এখন কোথায়?
কুইন শার্লট স্ট্রিট।
–আমি এখনই যাচ্ছি বলে পোয়ারো রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
এরকুল পোয়ারো নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলেন ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিটের ওই বাড়িতে। যেখানে মি. মর্লে আত্মহত্যা করেছেন। একজন পুলিশ কনস্টেবল দরজা খুলে সসম্ভ্রমে বলল–আপনি কি মঁসিয়ে পোয়ারো?
–হ্যাঁ আমি, মাথা নেড়ে জানালেন মি. পোয়ারো।
চিফ ইন্সপেক্টর ওপরে দোতলার ঘরে আছেন। ঘরটা আপনার অচেনা নয় নিশ্চয়ই।
না, না, আমি চিনি–আজ সকালেই এখানে এসেছিলাম।
ঘরে তিনজন লোক ছিলেন। পোয়ারো ঘরে গিয়ে হাজির হলেন। তাকে দেখে জ্যাপ বললেন–আপনি আসায় আমার খুব উপকার হল মি. পোয়ারো। এখনও মৃতদেহটা এখানেই আছে সরানো হয়নি। আপনি আগে দেখুন।
ক্যামেরাম্যানও হাজির। তিনি মৃতদেহের পাশে বসে ফটো তুলছিলেন। পোয়ারোকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
পোয়ারো এগিয়ে গেলেন চুল্লির দিকে। সেখানেই মি. মর্লের মৃতদেহটি পড়েছিল।
মি. পোয়ারো ঘুরে ঘুরে মৃতদেহটি জরিপ করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন মৃত্যুর পরও মি. মর্লের শরীরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই আছেন তিনি, যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর ডানদিকের রগের পাশে সামান্য ছোট একটা গর্ত। তার ডান হাতে একটা ছোট পিস্তল। পোয়ারো বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন ঠিক আছে, দেহটা এবার সরানোর ব্যবস্থা করুন।
কাছেই পুলিশের লোক দাঁড়িয়েছিল। তারা এগিয়ে এসে মি. মর্লের দেহ তুলে নিয়ে গেল।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ ও গোয়েন্দা প্রবর পোয়ারো ছাড়া বাকি সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
জ্যাপ বললেন–রুটিনমাফিক সব কাজ করা হয়েছে। পোয়ারো বললেন–এবার ঘটনাটা খুলে বলুন তো।
জ্যাপ ঢোক গিলে বলতে লাগলেন আমার ধারণা মি. মর্লে নিজের গুলিতেই মারা গেছেন। মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা পিস্তলটাতে ওরই হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে আমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।
আপনি কি সন্দেহ করছেন?
আপাত দৃষ্টিতে ওনার আত্মহত্যা করার কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। উনি চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী। অর্থকড়ির অভাব নেই। কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই। বিশেষ করে কোনো মেয়েমানুষঘটিত কিছু ছিল না বলেই শুনলাম। অথবা কোনো কিছু নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেও কেউ দেখেনি তাঁকে। যেহেতু আপনি তাঁকে চেনেন তাই আপনার কাছে তাঁর সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম। আপনি কি আজ সকালে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন বা বেতাল কিছু লক্ষ্য করেছিলেন।
পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–না, তেমন কিছুই না। সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন।
তাহালেই ভাবুন কাজ করতে করতে কেউ এভাবে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে কি না? ব্যাপারটার মধ্যে কোনো একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, যেটা আমাকে ভাবাচ্ছে।
পোয়ারো বললেন বুঝতে পারছি, আপনার সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক। আচ্ছা বলুন তো ঘটনাটা কখন ঘটেছিল।
ঠিক সময়টা বলতে পারব না। কেন না গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ কারো কানে যায়নি। যাওয়া সম্ভবও নয়। এই ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার জন্যে মাঝে বারান্দা ও দুটো দরজা আছে।
দরজায় মোটা পরদা দেওয়া এমনকি একসঙ্গে অনেক রোগী কথা বললেও কেউ শুনতে পায় না বাইরে থেকে।
পোয়ারো স্বীকার করলেন কথাটা। ঠিক তাই। তাছাড়া বাইরে গাড়ি ঘোড়াও চলছে, তাই কোনো কিছু শুনতে পাওয়া কঠিন। মৃত্যুর কথা কে কখন প্রথম জানতে পারে?
প্রায় দুপুর দেড়টা নাগাদ–ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড বিগম প্রথম জানতে পারে। ওর কাছেই শুনলাম সাড়ে বারোটায় একজন রোগী দেখার কথা। মি. মর্লের সেই রোগীটি পৌনে এক ঘণ্টা ধরে বসেছিলেন। শেষে বিরক্ত হয়ে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। তাই অ্যালফ্রেড বিগম ডাক্তারের দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসে না। আবার দরজা ঠেলে ঢোকার সাহসও তাঁর নেই। এর আগে না বলে ভেতরে ঢোকার জন্যে তাকে হেনরি মর্লে বকুনি দিয়েছিল। তাই দ্বিতীয় বার সে আর ভুল করতে চায়নি। ছোকরা চাকরটি নীচে নেমে যায়। পরে সেই মহিলা রোগী ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যায়। তখন সওয়া একটা তাছাড়া ওই মহিলার দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল।
মহিলাটির নাম কি?
জ্যাপ মুচকে হেসে বললেন–ছোকরা ওই মহিলাটিকে মিস মার্টি নামেই চেনে তবে ডাক্তারের খাতায় লেখা আছে ডার্বি।
পোয়ারো জানতে চাইলেন–রোগীদের ওপরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিরকম ব্যবস্থা চালু ছিল?
মর্লে পরের রোগীদের ডাকার জন্যে বেল বাজাতেন।
এরপর ওই চাকরটা পরের জনকে ওপরে নিয়ে যেত।
মর্লে কখন শেষ বেল বাজিয়েছিলেন?
বারোটা পাঁচে। সেই রোগীর নাম মি, অ্যামবেরিওটিস, স্যাভয় হোটেল। ডাক্তারের নথি থেকে জানা গেছে।
ওই ছেলেটা নামটা শুনে কিভাবে উচ্চারণ করল, ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে।
একটা আস্ত গবেট ওকে নানা প্রশ্ন করে আমরা হাসির খোরাক জোগাতে পারি।
ওই রোগীটি অর্থাৎ মি. অ্যামবেরিওটিস কখন চলে গিয়েছিলেন?
মি. অ্যামবেরিওটিস একা বাইরে বেরিয়ে এলিভেটরে উঠেছিলেন। তাই ছেলেটি জানে না। এমন অনেক রোগী আছেন যারা কারো সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না। ইতিমধ্যে আমি একটা কাজ করেছি। স্যাভয় হোটেলে ফোন করেছি। মি. অ্যামবেরিওটিসের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি খুবই সপ্রতিভ, সব কথাই বলেছেন। কোনো কিছু গোপন করেননি। তিনি যখন বেরিয়ে এসেছিলেন তখন ঘড়িতে বারোটা পঁচিশ হয়েছিল।
আমাদের কাজে লাগতে পারে এমন কোনো কথা কি তাঁর কাছে জানতে পেরেছেন?
তিনি বলেছেন–মি. মর্লের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেননি তিনি।
তাহলে ঘটনাটা ঘটতে পারে বারোটা পাঁচ থেকে বিশ মিনিট আর দেড়টার মধ্যে। নীচের সময়টার সম্ভাবনা বেশি।
অবশ্যই কারণ তা যদি না হত……….। পোয়ারো তাকে নামিয়ে দিয়ে বললেন তাহলে তিনি পরবর্তী রোগীকে বেল টিপে ডাকতেন।
এটাই ঠিক। ডিভিশানাল সার্জনের মতও তাই। তিনি দুটো কুড়িতে মৃতদেহ পরীক্ষা করে কিছু বলেননি? তাঁর বয়ান অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে মি. মর্লে একটার পরে নিজেকে গুলি করে থাকতে পারেন, নয়তো সামান্য আগেও হতে পারে। তবে এই ঘটনার সঙ্গে সন্দেহজনক কিছু জড়িয়ে আছে।
পোয়ারো চিন্তিতি মুখে বললেন মি. মর্লে বারোটা পঁচিশেও অত্যন্ত স্বাভাবিক, হাসিখুশি, দক্ষ দন্তচিকিৎসকই ছিলেন। এরপর এমন কি ঘটল? হতাশা–অবসাদ-আর তাই তিনি এপথ বেছে নিলেন। নিজের গুলিতে শেষ হলেন।
ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত না, মি. পোয়ারো?
পোয়ারো জানতে চাইলেন বন্দুকটা কি মি. মর্লের ছিল?
না, না আমি যতটা জানি তার কোনো বন্দুক ছিল না। তার বোন মিস মর্লেও সেকথা স্বীকার করেছেন। অবশ্য এটা ঠিক, কেউ যদি মনে করেন নিজেকে শেষ করবেন, তাহলে একটা বন্দুক কিনতেই পারেন। আর যদি তাই হয় তাহলে খবরটা আমরা জানতে পারব। আর একটা বিষয় আমাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে, সেটা হল মি. মর্লের পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে আমি একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে কেউ ওভাবে পড়তে পারে না। তবুও ভঙ্গিটা একটু অন্য ধরনের।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন–আপনি কি ওই ছোরাকে এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছেন?
না, তেমন কিছু নয়–এটা আমার অনুমান মাত্র, আমার ধারণা ছোকরাটা মি. মর্লেকে ও ভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়েছিল। তাই সরিয়ে দেখতে চেয়েছিল। সে অবশ্য একথা স্বীকার করেনি।
পোয়ারো ঘরের চারপাশটা ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেন। একে একে তিনি চোখ বুলিয়ে গেলেন দেয়ালের কোণে থাকা হাত ধোয়ার বেসিন, দরজার পাশে থাকা ফাইল ক্যাবিনেট, চুল্লি, রোগীর বসার চেয়ারের ওপর দিয়ে। শেষে তিনি দৃষ্টি রাখলেন যেখানে মর্লের দেহটা শায়িত ছিল সেদিকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল চুল্লি কাছে আরও একটি দরজার দিকে।
পোয়ারোকে অনুসরণ করে জ্যাপের দৃষ্টিও ঘুরে গেল চারদিকে।
দরজাটার দিকে জ্যাপ এগিয়ে গেলেন। দরজাটা খুলে বললেন–এটা ছোট একটা অফিস ঘর। এখানে মর্লের সেক্রেটারি মিস নেভিল কাজ করত। ছোকরা চাকরটার বক্তব্য থেকে বুঝলাম তিনি আজ অনুপস্থিত।
হ্যাঁ মনে পড়ছে, মর্লের কাছে শুনেছিলাম। এই বক্তব্য আত্মহত্যার বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
মিস নেভিলের বসার ঘরটিতে ছোট একটি ডেস্ক, একটা স্পিরিট ল্যাম্প, চায়ের সরঞ্জাম আর কয়েকটা চেয়ার রয়েছে। এখানে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো দরজা নেই।
জ্যাপ নাক চুলকে বললেন আপনি বলতে চাইছেন কৌশলে মেয়েটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে? এটা আত্মহত্যা নয়, খুন? কিন্তু খুনের মোটিভ কি? কে-ই বা তাকে খুন করবে? এমন শান্ত নস্ত্র মানুষটির ওপর কার আক্রোশ ছিল?
পোয়ারো বললেন আপনি ভেবে বলুন তো? কে হতে পারে?
যে কেউই হতে পারে। ওপরের কোনো ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী কিংবা বাড়ির চাকরের কেউ এসেও গুলি করে পালিয়ে যেতে পারে। তার কিছু কাজ পার্টনার রেইনিকেও সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। এমনকি ওই ছোকরারও কাজ হতে পারে। তাছাড়া আজ সকালে আসা রোগীরাই বা বাদ যাবে কেন? তাদের মধ্যে কেউ একজন গুলি করে থাকতে পারে। মি. অ্যামবেরিওটিসও সন্দেহমুক্ত নন। তার পক্ষে একাজ করা সম্ভব।
পোয়ারো মাথা নেড়ে স্বীকার করলেন। তাহলে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।
জ্যাপ বললেন–অবশ্যই, তাহলে আপনিও বলছেন আমার ধারণাটা সঠিক, কিন্তু মি. অ্যামবেরিওটিসের মতো একজন সম্ভ্রান্তধর্মী গ্রিক কেন নিরীহ দন্তচিকিৎসককে খুন করবেন। স্যাভয় হোটেল থেকে এখানে এসে? উদ্দেশ্য কি? এটাই আমাদের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পোয়ারো বললেন–খুব কাঁচা হাতের কাজ। পেশাদারি কোনো খুনি নয়। ভুল লোককে গুলি করেছে। এ যদি কোনো কোটিপতি বা ঝানু গোয়েন্দা হত তাহলে ঠিক ছিল, এদের খুন করলে খুনির লাভ হত। কোটিপতিকে খুন করলে অনেক টাকা–পেত আর গোয়েন্দাকে মারলে দোষীদের সাজা লাঘব হত।
আহা বেচারা মর্লে, যে নাকি কারো কাছেই বিপজ্জনক নয়। অথচ তাঁকেও মরতে হল অপঘাতে। বিষাদের সুর জ্যাপের গলায়। হয়েছে।
পোয়ারো বললেন–সত্যিই আমি বিস্মিত।
জ্যাপ সরাসরি পোয়ারোর মত জানতে চাইলেন।
মর্লের সঙ্গে আজ সকালের কথোপকথন সম্পর্কে জ্যাপকে জানালেন পোয়ারা। মর্লের মুখে শোনা একজন রোগীর নামও বললেন।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন আপনি আজ সকালে মি. মর্লের কাছে আসা অন্যান্য রোগীদের ভালো করে দেখেছিলেন?
পোয়ারো সতর্কভঙ্গিতে বললেন–আজ সকালে আমি ওয়েটিং রুমে একজন যুবককে দেখেছিলাম, যাকে দেখতে অনেকটা খুনিদের মতো।
জ্যাপ সচকিত হয়ে বললেন–কেসটা কি মশাই? পোয়ারো হেসে বললেন না, না সেরকম কিছু না। যুবকটিকে আমার খুব অদ্ভুত লাগছিল। তার ভাবভঙ্গি অপরাধসুলভ।
জ্যাপ বললেন–বুঝতে পারছি, আপনার খুনি যুবকটি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আত্মহত্যা কিংবা খুন যাই হয়ে থাকুক তদন্ত করে আমরা দেখব। এখন চলুন মিস মর্লের কাছে। ওর সঙ্গে আর একবার কথা বলা দরকার, ভাইয়ের মৃত্যু তাঁর পক্ষে খুব শোকের। যদিও তিনি কঠিন মনের মানুষ তাই সহজে মুষড়ে পড়বেন না।
জর্জিনা, মর্লে, জ্যাপও পোয়ারোর কথা শুনলেন।শান্তভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন–এটা অবিশ্বাস অবাস্তব ঘটনা, আমার ভাই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি তাকে ভালোভাবে জানি এমন মানসিকতার মানুষ নয় সে।
পোয়ারো বললেন–এর উল্টোটা কি হতে পারে, আপনি ভাবতে পারেন, মাদামোয়াজেল।
মিস মর্লে একটু ভেবে বললেন–এটা তবে ঠিক আত্মহত্যা না হলে খুন, এই সত্যটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
সেটা অসম্ভব নয়?
না–প্রথম সম্ভাবনার ব্যাপার যদি ধরেন তাহলে আমি আবার বলব, তার আত্মহত্যা করার মতো কোনো কারণ নেই। সে নিজের জীবন শেষ করে দেবার পাত্র নয়।
আজ সকালে আপনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ, প্রাতরাশের সময়।
সে সময় সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ ছিলেন বলে আপনার মনে হয়েছিল? তার মধ্যে কোনো চঞ্চলতা প্রকাশ পায়নি?
হ্যাঁ, সেটাও আমি লক্ষ্য করেছি। সে সামান্য উত্তেজিত ছিল। তবে যা ভাবছেন তা নয়। তার সেক্রেটারি ও সহকারীর ওপর বিরক্ত হয়েছিল এই যা।
কেন তারা কি করেছিল?
আজ সকালে তাঁর ঢের ব্যস্ততা ছিল, আর ওর সেক্রেটারি গ্ল্যাডিস নেভিল ও সহকারী তরুণটি ছুটি নিয়েছিল।
মিস নেভিল মি. মর্লের চেম্বারে কি কাজ করতেন?
সে হেনরির চিঠিপত্র দেখত, অ্যাপয়েন্টমেন্ট বই রাখত, সব চার্ট ভর্তি করত। যন্ত্রপাতি নির্বীজ করত। আর দাঁত ভরাট করার মতো জিনিস তৈরি করে হেনরিকে সহযোগিতা করত।
সে এখানে কতদিন কাজ করছে?
তিন বছর। সে খুব নির্ভরযোগ্য মেয়ে এবং বিশ্বাসী। ওকে আমরা দুজনেই খুব। ভালোবাসতাম।
আপনার ভাই কথায় কথায় আমাকে বলেছিলেন মিস নেভিল কোনো এক আত্মীয়ার শরীর খারাপের খবর পেয়ে চলে গেছে।
হ্যাঁ–ওর দিদিমার স্ট্রোকের খবর দিয়ে কে একজন ওকে টেলিফোন করেছিল। তাই খুব ভোরের ট্রেনে সে সমারমেটে রওনা দেয়।
এই কারণে তার প্রতি আপনার ভাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
মিস মর্লে বললেন–হ্যাঁ, ঠিক তাই। তা বলে আপনি আমার ভাইকে নিষ্ঠুর ভাববেন না। সে ভেবেছিল, পোয়ারো মিস মর্লের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললেন হ্যাঁ বলুন, মি. মর্লে কি ভেবেছিলেন?
জর্জিনা মর্লে ইতস্তত করে বললেন–হেনরি ভেবেছিল গ্ল্যাডিস তাকে মিথ্যে বলেছিল। ও ইচ্ছে করে ছুটি নিয়ে ওই যুবকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল। যদিও আমি জানি গ্ল্যাডিস সে ধরনের মেয়ে নয়। হেনরিকে আমি সে কথা বলেছিলাম। তবে কথাটা হল অযোগ্য এক যুবকের সঙ্গে সে ঘোরাফেরা করে সেটা হেনরির পছন্দ নয়। তাই হেনরি ভেবেছিল মিস নেভিল ওই যুবকের পরামর্শে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। দিদিমার অসুস্থতার খবরটা নিছকই বাহানা। ওরা একদিন ছুটি নেওয়ার জন্যে এই মতলব ফেঁদেছিল। তবে আমি নিশ্চিত ও এমন অন্যায় কাজ করতে পারে না। ও কাজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, ওর বিবেচনা বোধ অত্যন্ত প্রখর।
তবে ওই যুবকের পক্ষে এরকম প্রস্তাব করা সম্ভব?
হ্যাঁ–সে সব পারে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি একথা বাধ্য হয়েই বলছি।
পোয়ারো বললেন ওই যুবকের নামটা জানা হল না। তাছাড়া ও আপনার ভাইয়ের কাছে কি কাজ করে?
মিস মর্লে জবাব দিলেন ওর নাম কার্টার! ফ্র্যাঙ্ক কার্টার। হেনরির বক্তব্য অনুযায়ী ও একটি বখাটে ছেলে। ওর সঙ্গে হেনরির আলাপ বীমা করার সূত্রে, ছেলেটি আগে বীমা কোম্পানিতে কেরানির কাজ করত। কোনো কারণে তার চাকরি যায়। সেই থেকে হেনরির চেম্বারে এসে বসত। রোগীদের নাম লিখতো। গ্ল্যাডিসকে বিয়ে করতে চায়। তাই গ্ল্যাডিস জমানো টাকা থেকে কিছুটা কার্টারকে দেয়। সেই কারণে হেনরি খুবই ক্ষুব্ধ।
এতক্ষণ জ্যাপ চুপচাপ বসে ওদের কথা শুনছিলেন। এবার তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–আপনার ভাই কি মিস নেভিলকে বলেছিলেন কার্টারকে বিয়ে না করতে?
হ্যাঁ–হেনরি এই বিয়েতে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল।
তাহলে আপনার ভাইয়ের ওপরে ফ্রাঙ্ক কার্টারের রাগ, বিদ্বেষ থাকতেই পারে? মিস : মলে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন–একথা সত্যি নয়। আপনি কি বলতে চান কার্টার হেনরিকে গুলি করে হত্যা করেছে। যদিও আমার ভাই গ্ল্যাডিসকে পরামর্শ দিয়েছিল কার্টারকে এড়িয়ে চলার কিন্তু মেয়েটা সেই পরামর্শ কানে তোলেনি, সে কার্টারকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছিল।
জ্যাপ আবার বললেন–আপনি কি জানেন আপনার ভাইয়ের আর কোনো শত্রু আছে কিনা?
মিস মর্লে মাথা নেড়ে না বললেন।
মি. মর্লের অংশীদার মি. রেইলি সম্পর্কে আপনি কি জানেন?
মিস মর্লে তিক্তস্বরে বললেন–ওর সম্পর্কে হেনরি যা বলত তা হল, ও একজন আইরিশ। রুক্ষ মেজাজ। সব সময় ঝগড়া করতে পছন্দ করে। আর রাজনীতি নিয়ে তর্ক শুরু করলে তো কথাই নেই। নাওয়া খাওয়া ভুলে যাবে। বিরক্তিকর ব্যক্তিত্ব। তবে তার প্রশংসা করে হেনরি বলত, তার কাজে গাফিলতি নেই। দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম আছে। দাঁতের যে কোনো জটিল অসুখ সে অতি সহজেই সারিয়ে তুলতে পারত।
আপনি যে বললেন–বিরক্তিকর ব্যক্তিত্ব, সেটা কোনদিক থেকে?
মিস মর্লে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন–সে প্রচন্ড নেশাগ্রস্ত। সবসময় মদ পান করত। বদ্ধ মাতাল–তবে দয়া করে একথাটা খবরের কাগজে ছাপিয়ে দেবেন না।
এ নিয়ে তার সঙ্গে আপনার ভাইয়ের কি কোনো ঝামেলা হয়েছিল?
হেনরি তাকে দু-একবার সাবধান করেছিল। বলেছিল–দাঁতের চিকিৎসা, সূক্ষ্ম কাজ, খুব সতর্ক হয়ে করতে হয়। তাছাড়া মদের গন্ধ যে কোনো রোগী অপছন্দ করবে।
জ্যাপ সায় দিয়ে বললেন–আপনার ভাইয়ের টাকা পয়সার ব্যাপারটা একটু বলুন।
হেনরি খারাপ আয় করত না। সে সঞ্চয়ীও ছিল। বেশকিছু টাকা জমিয়েছিল সে। তাছাড়া আমাদের বাবার কাজ থেকে পাওয়া কিছু টাকাও আছে দুজনের নামে।
মি. মর্লে কি কোনো উইল করেছিলেন?
হ্যাঁ–সে উইল করেছিল। তাতে যা লেখা আছে তা হল গ্ল্যাডিস নেভিল পাবে একশো পাউন্ড, বাকিটা আমার।
হুম বলে জ্যাপ চুপ করে গেলেন।
এমন সময় দরজায় একটা শব্দ হল। দরজার পাল্লা খুলে যে মুখ বের করল সে আর কেউ নয় ওই ছোকরা চাকর অ্যালফ্রেড। পোয়ারো আর জ্যাপকে দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঢোক গিলে সে বলল–মিস নেভিল এসেছেন। তিনি শোকে বিহ্বল। তিনি জানতে চাইলেন এখানে আসতে পারেন কি না।
জ্যাপ ইঙ্গিত করতেই মিস মর্লে বললেন–যাও অ্যালফ্রেড, ওকে এখানে নিয়ে এসো।
ঠিক আছে বলে অ্যালফ্রেড বিদায় নিল।
মিস মর্লে জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন।
মিনিট কয়েক পরে বছর আঠাশের একটি তরুণী ঘরে এসে ঢুকলেন। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, দীর্ঘাকায় বুদ্ধিমতী মহিলা। দেখে মনে হবে সত্যিই সে ভেঙে পড়েছে মি. মর্লের আত্মহত্যার খবর শুনে। তবে চটজলদি সামলে নিতে সে সক্ষম হয়েছে।
জ্যাপের ইচ্ছে ছিল না মিস নেভিল, মিস মর্লের মুখোমুখি হয়। তাই তিনি মি. মর্লের কাগজপত্র দেখার অজুহাতে গ্ল্যাডিসকে নিয়ে পাশের ছোট ঘরে গেলেন।
সেখানে যাওয়ার পর মিস নেভিল বারবার বলতে লাগলে–আমি কিছুতেই মানতে পারছি না, মি. মর্লে এমন একটা অবিশ্বাস্য কাজ করতে পারেন। গতকালও সে তার সঙ্গে কাজ করেছে। তার মধ্যে অপ্রত্যাশিত কোনো লক্ষণ দেখেনি সে।
জ্যাপ এই সুযোগে বলে ফেললেন মিস. নেভিল আপনাকে কেউ খবর পাঠিয়ে ডেকেছিল?
গ্ল্যাডিস বলল–আর বলবেন না, পুরোটাই তামাশা, কেউ যে এমন বিশ্রী খবর কাউকে পাঠাতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যি বলছি।
জ্যাপ বললেন–আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না। একটু খোলাখুলি বলুন।
গ্ল্যাডিস বলে চলল, আমার দিদিমার অসুস্থতার খবর দিয়ে আমাকে কেউ টেলিগ্রাম করেছিল। আমিও তাকে দেখতে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি আসলে দিদিমার কিছুই হয়নি। তিনি সুস্থ আছেন। দিদিমাও আমাকে দেখে হতবাক, মিথ্যে খবর দিয়ে টেলিগ্রাম করায় তখন আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল। আবার সত্যি কথা বলতে কি ভালো লেগেছিল দিদিমাকে দেখে। তবে যেই করে থাকুক কাজ হয়েছে। আমি অকারণে স্যারের কাছে খারাপ হলাম।
মিস নেভিল, টেলিগ্রামটা দেখাতে পারেন?
দুঃখিত, স্টেশনে পৌঁছনোর পর ওটা আমি ফেলে দিয়েছি। ওটায় লেখা ছিল, গত রাতে তোমার দিদিমার স্ট্রোক হয়েছে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো এসো।
আপনি কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন এই টেলিগ্রামটা আপনার বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক কার্টার পাঠাননি?
মিস নেভিল অবাক হয়ে বলল—-অসম্ভব! ফ্র্যাঙ্ক এটা করতেই পারে না। আর করবেই বা কেন? ওই! বুঝতে পারছি, আপনি বোধহয় ভেবেছেন আমরা দুজনে পরামর্শ করে এমন কাজ করেছি? আপনার ভাবনা ভুল ইন্সপেক্টর। এমন কাজ আমরা স্বপ্নেও ভাবি না।
মিস নেভিল বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। তাকে সামলাতে জ্যাপের যথেষ্ট বেগ পেতে হল। কোনো রকমে তাকে শান্ত করে জ্যাপ আবার প্রশ্ন করলেন–সকালের রোগীদের নাম, কে, কখন এসেছিল সেগুলি কিছু মনে আছে?
গ্ল্যাডিস নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে শুরু করল–তাদের নাম ঠিকানা সবই খাতায় নথিভুক্ত করা হয়েছে। নিশ্চয় এতক্ষণে তা দেখে নিয়েছেন। তবুও আমি বলছি বেলা দশটায় মিসেস সেমিসকে সময় দেওয়া হয়েছে। তার নতুন দাঁতের প্লেট বসানো হবে। সাড়ে দশটায় আসার কথা লেডি গ্রাটের। মধ্যবয়সি মহিলা। তিনি থাকেন লোন্ডস স্কোয়ারে। এগারোটায় আসবেন এরকুল পোয়ারো, তিনি এখানে প্রায়ই আসেন। ওহ! আপনি যে এখানে আছেন আগে খেয়াল করিনি। দুঃখিত মি. পোয়ারো, দয়া করে কিছু মনে করবেন না। এত গোলমালে মাথাটা ঠিক রাখতে পারছি না। সাড়ে এগারোটায় মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্ল্যাস্ট-ইনিই সেই বিখ্যাত ব্যাঙ্কার।
তারপর আসার কথা মিস সেইনসবারি সীলের। তিনি দাঁতের যন্ত্রণায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাই ফোনের মাধ্যমে নাম লিখিয়েছিলেন। ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের মহিলা। আর বড় বাজে বকেন। কথা শুরু করলে আর থামতে চান না। বেলা বারোটায় মি. অ্যামবেরিওটিস। তিনি থাকেন স্যাভয় হোটেলে। তিনি এই প্রথম এখানে দাঁত দেখাতে আসবেন। তারপর সাড়ে বারোটায় মিস গার্বির পালা। তার ঠিকানা ওয়াদিং। এছাড়া বন্ধু, বিদেশী আমেরিকান রোগীও আসেন মি. মর্লের কাছে।
পোয়ারো এবার মুখ খুললেন। তিনি বললেন আমি যখন এসেছিলাম তখন বিশাল চেহারার একজন সৈনিক পুরুষকে দেখেছিলাম। তিনি কে?
মি. রেইলির কোনো রোগী হবে হয়তো। লিস্টটা একবার দেখতে হবে। বলেই মিস নেভিল ভেতরের ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এল সে। হাতে একটা নোটবই দেখতে অনেকটা মি. মর্লের নোট বইয়ের মতো।
মিস নেভিল পড়তে লাগল দশটায় ন’বছরের মেয়ে বেটি হিথ, এগারোটায় কর্নেল অ্যাবারক্রমবি।
পোয়ারো নামটা শুনে চমকে উঠলেন। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন, অ্যাবারক্রমবি! সাড়ে এগারোটায় মি. হাওয়ার্ড রেইকস। বারোটায় মি. বার্নেস। এরা সবাই আজ সকালেরই রোগী। মি. রেইলির রোগী সংখ্যা এর থেকে বেশি হয়।
মি. রেইলির রোগীদের আপনি কি চেনেন?
হ্যাঁ, মোটামুটি সকলকে চিনি। এই ধরুন না মি. অ্যাবারক্ৰমবির কথা। তিনি মি. রেইলির পেশেন্ট ছিলেন। বহুদিন তাঁকে দেখিয়েছেন। আর মিসেস হিথ তাঁর ছেলেমেয়েদের দাঁতের কোনো সমস্যা দেখা দিলে আগে মি. রেইলির কাছে যেতেন। মি. রেইকস ও মি. বার্নেসের সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। তবে মি. মর্লের মুখে তাদের নাম শুনেছিলাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা মি. রেইলির সঙ্গে দেখা করতে যাব। মিস নেভিল, এবার আপনি আসতে পারেন। আমাদের সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ।
জ্যাপ পোয়ারাকে বললেন–একমাত্র অ্যামবেরিওটিস মি. মর্লের নতুন রোগী। এছাড়া সবাই পুরোনো। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তার সঙ্গে আমাদের দেখা করা উচিত। হয়তো চমকপ্রদ কোনো কু পেতে পারি তাঁর কাছে। তাঁকে আমরা প্রধান সাক্ষী হিসেবেও ধরতে পারি। কেননা একমাত্র তিনিই মি. মর্লেকে শেষ জীবিত দেখেছিলেন। তিনি বিদায় নেবার সময় দন্তচিকিৎসকের ভাবগতিক কেমন ছিল।
পোয়ারো বললেন তাহলে আপনি এই মৃত্যুর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে তার স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন।
হ্যাঁ–তা জানি। কথা শেষ করে তিনি পোয়াবরার দিকে তাকালেন। দেখলেন তিনি চিন্তামগ্ন। বললেন–কি ব্যাপার? এত গম্ভীর হয়ে কি ভাবছেন মি. পোয়ারো?
স্মিত হেসে পোয়ারো বললেন–ব্যাপারটা হল, এত পুলিশ অফিসার থাকতে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপের ডাক পড়ল কেন? এই ধরণের আত্মহত্যার তদন্ত তাকে ডাকা হয় না।
চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন–আমি সেই সময় কুইন শার্লট স্ট্রিটের কাছেই উইগমো স্ট্রিটের ল্যাভেন হ্যাঁমে ছিলাম। সেখানে একটা জালিয়াতি কেসের তদন্তে গিয়েছিলাম। এখান থেকেই আমাকে ফোন করা হয় এবং তদন্তের ভার দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়।
পোয়ারো সন্দিহান কণ্ঠে বললেন কিন্তু আপনিই বা কেন?
এটার উত্তরও খুব সহজ। এটার কৃতিত্ব দেবো আমি অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে। ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর যখন জানলেন মি. ব্লাস্ট এখানে এসেছিলেন তাই তখন তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছেন মি. ব্লাস্টের মতো ব্যক্তিত্ব। তাকে উপেক্ষা করা কারও সাধ্য নয়। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ব্লাস্ট আর তার অনুগামীরা পাহাড়ের মতো বর্তমান সরকারকে আগলে রেখেছে। নিরাপদ, নিশ্চিন্ত রক্ষণশীল এক অর্থনীতি আর তাই অনেকেই চাইবেন তাকে সরিয়ে দিতে। আজ সকালে এখানে যদি তেমন কোন ঘটনা ঘটে থাকে তা দেখার জন্যে অনুসন্ধান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে।
পোয়ারো জ্যাপের কথায় সমর্থন করে বললেন–এ রকমই কিছু একটা আশঙ্কা ছিল আমার। আমার মনে হয় আসল শিকার ছিলেন অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট। অন্তত সেটাই হওয়া উচিত। হয়তো মনেরও অবতরণের প্রথম ধাপ। আমার স্থির বিশ্বাস, এর মধ্যে বিশাল অঙ্কের অর্থের গন্ধ আছে।
আমার মনে হচ্ছে এর মধ্যে আপনি অনেক দূর এগিয়েছেন।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। বেচারি মর্লে এই ঘটনার নিমিত্ত মাত্র। তিনি কিছু জানতে পেরেছিলেন। তিনি ব্লাস্টকে সব বলে ফেলবেন এই ভয়টা কারও ছিল। তাই তাকে…..ঠিক তখনই মিস নেভিলকে ঘরে ঢুকতে দেখে পোয়ারো কথা থামালেন।
সে ঘরে এসে বলল–মি. রেইলি এখন দাঁত তোলায় ব্যস্ত। দশ মিনিটের মধ্যে তার কাজ শেষ হবে। তখন আপনারা এই ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন।
জ্যাপ বললেন ঠিক আছে, আপনাকে এখন এক ফাঁকে ছোকরা চাকর আলফ্রেডের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।
এ দিকে অ্যালফ্রেডের মনে বদ্ধ ধারণা, যে এ সবের জন্য তাকেই দায়ী করা হবে। সে পনেরো দিন আগে মি. মর্লের কাজে যোগ দিয়েছিল। যেদিন থেকে সে কাজে এসেছিল সেদিন থেকেই তার সবকিছু ভুল হচ্ছিল। সব কিছুই ওলোটপালোট করে ফেলছিল। তাই মি. মর্লের কাছে বকুনিও শুনতে হয়েছে অনেক। এর ফলে নিজের প্রতি বিশ্বাসই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অ্যালফ্রেডের।
পোয়ারো এবং জ্যাপ অ্যালফ্রেডের সঙ্গে দেখা করলেন। তাকে পোয়ারো বললেন–আজ সকালে যা যা ঘটেছে সব কথা পরিষ্কার করে বলো। তুমি একজন অন্যতম সাক্ষী। তোমার থেকে সব কিছু জানতে পারলে আমাদের খুব সুবিধা হবে।
এ কথায় অ্যালফ্রেড যেমন আনন্দ পেল তেমনি ভয়ও পেল। সে এর আগে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপকে সব বলেছিল। তবুও সে বলার জন্য প্রস্তুত হল। সে মুখে কষ্টের ভাব এনে বলতে শুরু করল আজ সকালে আস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। অন্যান্য দিনের মতো আজও সকালে কাজ শুরু করেছিলেন মি. মর্লে।
বাড়িতে অচেনা কেউ এসেছিল?
না–স্যার।
রোগী সেজেও কেউ আসেনি?
আগে থেকে নাম না লিখিয়ে কাউকে দেখেন না মি. মর্লে। তাই সকলকেই নাম লেখাতে হয়।
পোয়ারো আবার প্রশ্ন করলেন বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢুকতে পারে?
না–স্যার, তার জন্য চাবির প্রয়োজন হয়। বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল অ্যালফ্রেড।
তবে কি বাড়ি থেকে বের হবার অন্য কোনো দরজা আছে?
না স্যার। কিন্তু হাতল টেনে দরজা খুলে বাইরে আসা যায়। তার জন্য চাবি লাগে না।
বুঝলাম, এবার বলো তো সকালে প্রথমে কোন রোগী এসেছিল? পরে কে কে। এসেছিল?
অ্যালফ্রেড একটু ভেবে বলল–একজন মহিলা তার বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে প্রথমে এসেছিলেন। তিনি মি. রেইলিকে দেখাতে এসেছিলেন। আর মি. মর্লেকে দেখাতে আসেন মিসেস সোপ।
পোয়ারো বললেন–এরপর।
এরপর আসেন একজন বয়স্ক মহিলা। গোলগাল চেহারা তার। তিনি একটা ডেমলারে চড়ে এসেছিলেন। তিনি চলে যেতেই এলেন একজন সৈনিক ভদ্রলোক। তারপরে এলেন আপনি, পোয়ারোকে দেখিয়ে অ্যালফ্রেড বলল।
ঠিক আছে। বলে যাও।
তারপর আসেন এক আমেরিকান যুবক…
জ্যাপ হাত তুলে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আমেরিকান। তুমি বুঝলে কি করে?
হ্যাঁ–স্যার তিনি যে আমেরিকান তা ওর কথা শুনে আপনিও বুঝতে পারতেন। তাকে আসতে বলা হয়েছিল সাড়ে এগারোটার পর। সবচেয়ে আশ্চর্য হল তিনি এসেছিলেন আগে কিন্তু না দেখিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তিনি অতক্ষণ অপেক্ষা করেননি।
পোয়ারো বললেন তাহলে উনি আমার চলে যাওয়ার পরে চলে গেছেন। কেন না আমি যতক্ষণ এখানে ছিলাম ততক্ষণ তিনি এখানে ছিলেন।
ঠিক বলেছেন স্যার। আমি পরের জনকে ওপরে পৌঁছে দেবার আগে আপনি বেরিয়ে যান। তিনি হলেন মি. ব্লাস্ট। মস্ত ধনী চমৎকার একটা দামি গাড়ি চড়ে এসেছিলেন তিনি। রোলস গাড়ি। আপনি চলে যাবার পর একজন মহিলাকে ভেতরে নিয়ে আসি। নাম তার বারি সীল মনে হয়। এরপর আমার খাবারের সময় হয়েছিল। তাই আমি খেতে রান্না ঘরে চলে যাই। খেয়ে নিচে আসতেই বেল বাজার শব্দ পাই। সেটা ছিল মি. রেইলির বেল। আমি তড়িৎগতিতে উপরে উঠে আসি। কিন্তু আমেরিকান ভদ্রলোককে খুঁজে পাইনি। ততক্ষণে তিনি চলে গেছেন। হয়তো রাগ করেই তিনি চলে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি মি. রেইলিকে জানালাম। তিনি রাগে বক বক করতে লাগলেন। এটাই তার স্বভাব, একজন পেশেন্টকেও তিনি হাত ছাড়া করতে চান না। অমনি মেজাজ তাঁর গরম হয়ে যাবে।
পোয়ারো বিরক্ত হয়ে বললেন–অত ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুমি বলে যাও। অ্যালফ্রেড মাথা চুলকে বলল–স্যার একটু ভেবে নিই। এরপর কি হয়েছিল ঠিক মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার সে বলতে শুরু করল। া হা মনে পড়েছে। মি. মর্লের বেল বাজতেই আমি মিস সীলকে ডাকতে গেলাম। তখনই দেখতে পেলাম সেই ভদ্রলোক যিনি রোলস চড়ে এসেছিলেন, তিনি চলে যাচ্ছেন। তারপর আমি মিস সীলকে মি. মর্লের ঘরে পৌঁছে দিলাম। এরপর দু’জন ভদ্রলোক এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বেঁটে। চির্চি করে কথা বলছিলেন। নামটা এখন আর মনে নেই। তিনি মি. রেইলির পেশেন্ট। আর একজন স্থুলকায়, তিনি এসেছিলেন মি. মর্লেকে দেখাতে।
মিস সীল অবশ্য বেশি সময় নষ্ট করেননি। কিছুক্ষণ পরেই তিনি মি. মর্লের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাকে বাইরের দরজাটা দেখিয়ে দিয়ে আমি চলে আসি। সেই বিদেশী ভদ্রলোককে মি. মর্লের কাছে এবং দ্বিতীয় জনকে মি. রেইলির ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম যথা সময়।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন–তুমি সেই বিদেশী ভদ্রলোক অর্থাৎ মি. অ্যামবেরিওটিসকে চলে যেতে দেখোনি?
না স্যার, আমি ওই দুজনের কাউকেই বেরিয়ে যেতে দেখিনি। মনে হয় তারা নিজেই চলে গিয়েছিলেন।
বেলা বারোটার পর তুমি কোথায় ছিলে?
না স্যার, আমি কোথাও যায়নি। যতক্ষণ না দু’জায়গার কোথাও বেল বাজা বন্ধ হয় ততক্ষণ আমি এলিভেটরেই বসে থাকি।
পোয়ারো রসিকতা করে বললেন আমার মনে হয় তুমি সেই সময় বই পড়ছিলে, ঠিক না?
এ কথায় অ্যালফ্রেডের মুখ লাল হয়ে উঠল। সে বলল–হ্যাঁ, স্যার, কোনো কাজ না থাকলে আমি বই পড়ি। কেন স্যার, কোনো অন্যায় হয়েছে?
না, না–তুমি কোনো অন্যায় করোনি, যে বই পড়ছিলে তার নাম কি?
অদ্ভুত মজার নাম স্যার ‘পৌনে বারোটায় খুন’। একটা আমেরিকান গোয়েন্দার গল্প। ভালো গল্প স্যার, শুধু বন্দুকের লড়াই। একেবারে বন্দুকবাজদের গল্প।
পোয়ারোর ঠোঁটের কোণে হাসি। তিনি বললেন–তুমি যেখানে বসেছিলে সেখান থেকে বাইরের দরজার বেলের শব্দ শুনতে পাও?
না–স্যার শুনতে পেতাম না। কারণ এলিভেটরটা হল ঘরের পেছনে।
এবার জ্যাপ প্রশ্ন করলেন আর কে ডাক্তার দেখাতে বাকি ছিলেন?
অ্যালফ্রেডের ভ্রু-যুগল কুঁচকালো। মিনিট কয়েক ভাবল। তারপর মনে পড়ে যেতে বলল, ওহ, মনে পড়েছে। মিস সার্ডিই শেষে মর্লের ঘণ্টা ধ্বনির অপেক্ষায় আছি। কিন্তু তিনি ঘন্টা বাজাননি। মিস সার্ডি অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। তিনি অধৈর্য হয়ে গজ গজ করছিলেন।
মি. মর্লে পরের রোগীর জন্য প্রস্তুত কিনা তা জানার আগ্রহ তোমার হয়নি? দেরি হচ্ছে বলে তুমিও একবার দেখে আসতে পারতে।
অ্যালফ্রেড জোরে জোরে মাথা নাড়ল। না–তা কখনোই সম্ভব নয়, স্যার আমি মনে করেছিলাম শেষ যিনি গেছেন তার কাজ তখনও শেষ হয়নি তাই ঘণ্টাও বাজেনি। তবে এটা সত্যি আমি আগে যদি বুঝতে পারতাম যে মি. মর্লে নিজেকে ওভাবে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাহলে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকতাম।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, এর আগে কখনো রোগী নেমে আসার আগেই ঘণ্টা বেজেছিল? অ্যালফ্রেড জবাব দিল–এ্যা, স্যার এরকম মাঝেমধ্যে হয়। বেশিরভাগ সময় রোগী নেমে আসার কয়েক মিনিট পরেই স্যার ঘন্টা বাজাতেন। যদি তার তাড়া থাকে তাহলে তিনি রোগীরা তার ঘর ছাড়ামাত্রই ঘন্টা বাজাতেন।
বুঝতে পারছি, অ্যালফ্রেড আর একটি প্রশ্নের উত্তর দাও তো তুমি কি মি. মর্লের আত্মহত্যার পিছনে আশ্চর্য কিছু দেখতে পাচ্ছ?
অ্যালফ্রেড চোখ বড়ো বড়ো করে বলল–মি. মর্লে কারো হাতে খুন হননি তো স্যার?
ধর, তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি কি খুব অবাক হবে? তা আমি বলতে পারব, না স্যার। কে যে মি. মর্লেকে মারতে চাইবে? কি তার উদ্দেশ্য? আমার যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। তার মতো একজন ভদ্র অমায়িক মানুষ কার শত্রু হতে পারেন?
পোয়ারো ভারিক্কি গলায় বললেন–প্রতিটি সম্ভাবনাই আমরা অনুসন্ধান করব। তুমি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তোমার ওপর নির্ভর করছে এই কেসটা। তুমি মনে করে দেখো সকাল থেকে যা যা ঘটেছে তা সবটাই বলেছ, কিছু বাদ পড়েনি।
না–স্যার, আর কিছু মনে পড়ছে না। কোনো কথা গোপন করিনি স্যার।
বুঝলাম, তোমার কথার সূত্র ধরেই বলছি–বাড়িতে রোগীরা ছাড়া আর কেউই আসেনি আজ সকালে?
কোনো অচেনা লোক আসেনি স্যার। হা একজন যুবক এসেছিল। সে মিস নেভিলের প্রেমিক। আজ নেভিল এখানে আসেনি, তা জানতে পেরে সে খুব রাগারাগি করছিল।
জ্যাপ বললেন–যুবকটি কখন এসেছিলেন?
অ্যালফ্রেড ভ্রু-কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল। বলল–বারোটার কিছু পরে হবে। মিস নেভিলকে না পেয়ে মি. মর্লের অপেক্ষায় ছিল। আমি তাকে ব্যাজার মুখে পায়চারি করতে দেখে বললাম স্যার খুব ব্যস্ত, লাঞ্চের আগে তাকে পাওয়া যাবে না। শুনে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল, এতে কিছু যায় আসে না, তাঁর সঙ্গে দেখা আমাকে করতেই হবে।
পোয়ারো জানতে চাইলেন সে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল?
অ্যালফ্রেড ভয়ার্ত স্বরে বলল–ওই, সেটা তো ভুলে গেছি। পরে ওয়েটিং রুমে তাকে আমি দেখিনি। হয়তো অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে সে চলে গিয়েছিল। ভেবেছিল পরে আরেকদিন আসবে।
অ্যালফ্রেডকে বিদায় দিয়ে জ্যাপ তীক্ষ্ণস্বরে বললেন ছেলেটাকে খুনের কথা বলা আমাদের কি উচিত হয়েছে? ও বাইরের লোকের কাছে এই কাহিনি প্রচার করে দেবে।
পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–প্রিয় জ্যাপ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার ধারণা ছেলেটি তা করবে না। ও গোয়েন্দা কাহিনি পড়ে, সে অপরাধ নিয়ে ভাবে ওর যা মনে পড়বে না এবার সেই সব অপরাধমূলক বিষয়গুলি স্মৃতির ভান্ডার থেকে বের করে আনবে।
হুঁ, মনে হচ্ছে আপনিই ঠিক পথে এগোচ্ছেন। এবার যাওয়া যাক রেইলির চেম্বারে। মি. রেইলির চেম্বার দোতলায়, পাশেই সার্জারি রুম, এই ঘরদুটি মি. মর্লের ঘরের তুলনায় বড়ো। তবে আলো খুবই কম। আর আসবাবপত্রের আধিক্য নেই বললেই চলে।
মি. রেইলির রঙ কিছুটা কালো, মি. মর্লের চেয়ে বয়সে ছোটো, ঘন এক মাথা কালো চুল অবিন্যস্ত হয়ে কপালে এসে পড়েছে। সুমধুর কণ্ঠস্বর, দুচোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
পোয়ারো ও জ্যাপ মি. রেইলিকে নিজেদের পরিচয় দিলেন। এবার জ্যাপ বললেন মি. রেইলি, আপনি নিশ্চয় আপনার অংশীদারের আত্মহত্যার ঘটনাটা শুনেছেন। আর আমরা আশা করি, এ বিষয়ে আপনি আমাদের আশার আলো দেখাতে পারতেন।
মি. রেইলি জবাব দিলেন–দুঃখিত, আপনারা ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি আপনাদের এ ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারব না। শুধু একটা কথা বলতে পারি, হেনরি মর্লে কখনোই এমন অবিবেচকের মতো কাজ করতে পারে না। কাজটা করা আমার ক্ষেত্রে যতটা বিশ্বাস যোগ্যের, তারপক্ষে তা নয়। কারণ নিজের জীবন শেষ করে দেবার মানসিকতাই তাঁর ছিল না।
পোয়ারো জানতে চাইলেন, কেন আপনি একথা বলছেন, মি. রেইলি? কারণ আমার পাহাড় প্রমাণ দেনা, নানা সমস্যায় আমি জর্জরিত। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমি একেবারেই চলতে পারি না, কিন্তু মলে সর্বদা সতর্ক থাকনে। অনুসন্ধান করলে দেখবেন তার কোনো ঋণ নেই বা কোনো সমস্যাও ছিল না। এটা আমি হলপ করে বলতে পারি, মি. রেইলি দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেলেন।
জ্যাপ বললেন, প্রণয় ঘটিত কোনো সমস্যা ছিল না?
এই কথার উত্তরে মি. রেইলি দরাজ গলায় হেসে বললেন, মি. মর্লে করবে প্রেম? পাগল নাকি? ওর জীবনে আনন্দ বলে কিছু ছিল নাকি কখনো। ও তো ওর দিদির হাতের পুতুল। স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মতো তার মনই ছিল না।
এরপর জ্যাপ আজ সকালে দেখা রোগীদের সম্বন্ধে জানতে চাইলেন, মি. রেইলির কাছে।
প্রথমেই আসে ভারী মিষ্টি দেখতে একটি ছোট্ট মেয়ে। নাম বেটি হিথ। ওর পরিবারের লোকেরা আমার বহুদিনের পরিচিত। ওদের চিকিৎসা আমি করে থাকি, এরপর আসেন সৈনিক পুরুষটি। কর্নেল অ্যাবারোক্রম্ব। তিনিও আমার বহুদিনের পুরোনো রোগী। এরপর একে একে আসেন মি. হাওয়ার্ড রেইকম ও বার্নেস।
জ্যাপ প্রশ্ন করলেন, মি. হাওয়ার্ড কে?
মি. হাওয়ার্ড সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তিনি এর আগে কখনোও আমার কাছে আসেননি। তিনি আজ সকালে টেলিফোন করেছিলেন। আমাকে দেখানোর জন্য আসতে চেয়েছিলেন।
তার ঠিকানা?
হাবনি প্যালেস হোটেল। তার কথা শুনে বুঝলাম তিনি আমেরিকার অধিবাসী। হ্যাঁ, অ্যালফ্রেডও তাই বলেছিল।
অ্যালফ্রেড ভালো জানতে পারে, কেননা ও ভীষণ সিনেমা দেখে।
বার্নেস? উনি কোথায় থাকেন? বেঁটেখাটো একজন মানুষ, মজার মজার কথা বলে লোককে হাসাতে পারে তিনি আগে সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ইদানীং অবসর নিয়েছেন। ইলিং-এ থাকেন।
আর মিস নেভিল? তার সম্পর্কে আপনার মত কি? জ্যাপের মুখে হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল।
গোল গোল চোখ করে মি. রেইলি বললেন মি. মর্লের সুন্দরী সেক্রেটারির কথা বলছেন? যার সোনালি রঙের একগুচ্ছ চুল। না, না, ওকে নিয়ে হেনরির কোনো দুর্বলতা নেই। সেদিক দিয়ে হেনরির মন পরিষ্কার ও পবিত্র। একজন মালিক কর্মচারীর নির্ভেজাল সম্পর্ক ওদের। এ বিষয়ে আমি একশো ভাগ নিশ্চিত।
জ্যাপ এই ধরণের রসিকতা একদম বরদাস্ত করতে পারলেন না। তিনি বললেন–আমি এভাবে বলতে চাইনি মি. রেইলি।
রেইলি বললেন–পরে হয়তো, আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। ক্ষমা চাইছি। আমি ভেবেছিলাম প্রেমঘটিত ব্যাপারে টাকাকড়ির বিষয়টা বেশি থাকে। সেটাই জানার উদ্দেশ্য ছিল আপনার। আপনাদের ভাষাতে কথা বলার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত, মি. জ্যাপ।
জ্যাপ বা পোয়ারো কিছুক্ষণ কোনো কথা বললেন না। মিনিট কয়েক পরে জ্যাপ প্রশ্ন করলেন মিস নেভিল যে ছেলেটিকে বিয়ে করার অঙ্গীকার করেছিলেন তার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন?
ছেলেটির নাম ফ্রাঙ্ক কার্টার। মর্লে ওকে ভালো চোখে দেখত না। ও মিস নেভিলকে ওই তরুণের সংস্রব ত্যাগ করতে বলেছিল। এতে কার্টারের প্রতিক্রিয়া কিরূপ ছিল? স্বাভাবিক কারণেই বিরূপ হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। একটু থামলেন রেইলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যাপ ও পোয়ারোকে নিরীক্ষণ করলেন তিনি। আবার বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছে ধরে নিয়ে তদন্তে এগোচ্ছেন, খুন নয় তো?
জ্যাপ বললেন, যদি মি. মর্লেকে খুন করা হয়, তাহলে সাহায্য করতে আপনি রাজি আছেন? রেইলি তীব্র স্বরে বললেন, না, আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। জর্জিনা পারবে আপনাকে সাহায্য করতে ও বুদ্ধিমতী, শান্ত স্বভাবের মানুষ। তবে সুযোগ পেলে নীতিকথা শুনিয়েও দেয় ও। তবে আমি সবার অলক্ষ্যে দোতলায় গিয়ে হেনরিকে গুলি করে খুন করতে পারতাম। আসলে কে এই গোবেচারাকে খুন করতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে। তবে সে যে নিজে গুলি করে আত্মঘাতী হবে তাও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ওর এইরকম আচরণে আমি সত্যিই দুঃখ পেয়েছি। আমার কথায় অন্য মানে করবেন না দয়া করে। আসলে আমাদের দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। ওর অভাব আমি কোনোদিনই পূরণ করতে পারব না। রেইলির শেষের কথাগুলোতে বিষাদের সুর ছিল।
স্যাভয় হোটেলে মি. অ্যামবেরিওটিসের রুমের টেলিফোনটা বেজে উঠল। তিনি রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল আমি চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বলছি। আপনি কি মি. অ্যামবেরিওটিস?
মি. অ্যামবেরিওটিস সন্দিহান হয়ে বললেন, কি ব্যাপার?
জ্যাপ বললেন, মি. মর্লের মৃত্যু বিষয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই?
দুঃখিত মি. জ্যাপ আজ আমার শরীর খারাপ আজ কারো সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নেই আমার। কথাটা শেষ করেই গম্ভীর মুখে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন তিনি।
এদিকে জ্যাপের মুখে কালো মেঘের আনাগোনা। তিনি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, আমার সঙ্গে দেখা করতেই হবে তাকে। তাকে আমি কিছুতেই পালাতে দেবো না। যে করেই হোক তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মি. পোয়ারো আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ও আমাদের জালে ধরা পড়বেই। আমার একজন অনুচর আছে স্যাভয় হোটেলে। তাকে সব নির্দেশ দেওয়া আছে। সে সর্বদা তাকে অনুসরণ করবে।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন, আপনি মি. অ্যামবেরিওটিসকে মি. মর্লের খুনি ভাবছেন কি? তিনি মর্লেকে গুলি করে পালিয়েছেন।
তা নয়। তবে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখতে পারছি না। কেন না তিনিই মর্লেকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখেছিলেন। তাছাড়া তিনি সেদিনই প্রথম তাকে দেখাতে এসেছিলেন। ওর কথা অনুযায়ী তিনি মর্লের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বারোটা পঁচিশে। তিনি তখন মর্লের হাবভাবে সন্দেহজনক কিছু লক্ষ্য করেননি। আর তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন। কথাটা যদি সত্যি হয় তাহলে অন্য কথা ভাবতে হবে আমাদের। ঘটনার স্রোত কোন দিকে গেছে তার খোঁজখবর নিতে হবে। পরবর্তী রোগীর জন্যে তখন তার হাতে পাঁচ মিনিট সময় ছিল। তাহলে ওই পাঁচ মিনিটের ফাঁকে কেউ কি তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল? কে হতে পারে? রেইলি না কার্টার? এইটুকু সময়ের মধ্যে নিশ্চয় জীবিত ছিলেন না–তাহলে পরের রোগীদের জন্যে বেল বাজাতেন তিনি। অথবা আর রোগী দেখবেন না বলে মেসেজ পাঠাতেন। হয় তিনি তখন খুন হয়েছিলেন, কিংবা কেউ তাকে কিছু কথা বলে উত্তেজিত করেছিল। যার ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একনিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে জ্যাপ দম নেবার জন্য থামলেন।
দুজনেই কিছুক্ষণ নীরবে কাটালেন। আবার জ্যাপ বলতে শুরু করলেন, ঘটনার গতি প্রকৃতি কোন দিকে গড়িয়েছে তা জানার জন্য আমি মর্লের সব রোগীদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আমার স্থির বিশ্বাস কেউ না কেউ সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারবে। হয়তো মলে তাদের কাউকে কিছু বলে থাকতে পারেন।
জ্যাপ ঘড়ি দেখলেন। বললেন–মি. অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট সওয়া চারটের সময় দেখা করতে বলেছেন। চলুন আমরা প্রথমেই তার কাছে যাই। তারপর সাক্ষাৎ করব সেমস বারি সীল-এর সাথে। এরপর যাব গ্রীক বন্ধু অ্যামবোরিওটিসের কাছে। ওর কাছে যাবার আগে আমাদের খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে হবে। সবশেষে আপনার ভাষায় খুনির মতো চেহারা ওই আমেরিকানের সাক্ষাৎ প্রার্থী হবো।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
জ্যাপ আবার বললেন–তাছাড়া আমার মিস নেভিল ও তার তরুণ বন্ধুর সম্পর্কেও আরও ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিশ্চয়ই আমরা একটা সমাধান সূত্রে পৌঁছতে পারব।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট, যিনি কখনোই প্রচারের আলোয় আসেননি। তিনি অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। তিনি একাকী জীবন কাটাতে অভ্যস্ত। তাই তিনি রাজা না হয়েও রাজপরিবারের সদস্য হিসেবেই জীবন কাটিয়েছেন।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের স্ত্রী রেবেল ম্যানসেভেরেটো। তাকে লোকে আর্মহোল্ট নামেও চেনে। তিনি লন্ডনে প্রথম আসেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। অর্থের অভাব নেই। প্রচুর সম্পত্তি, টাকাপয়সা পেয়েছিলেন তিনি বাবা ও মায়ের থেকে। রেবেলের মা ইউরোপীয়ান। তিনি রোদারস্টাইন পরিবারে জন্মান। তাঁর বাবা আমেরিকার সুপ্রসিদ্ধ ব্যাঙ্কার। আমেরিকার সন্তান রোবেল আর্নহোল্টের দুই ভাই। তারা বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর ওই পরিবারের বিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র দাবিদার হন তিনি। ইউরোপের এক বিখ্যাত ব্যক্তি দ্য ম্যানসেভেরেটোর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, অবশ্য সে বিয়ে স্থায়ী হয়নি। তিন বছর পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। একমাত্র মেয়ে ও বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া অর্থ নিয়ে তিনি চলে আসেন, এক শয়তানের প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লোকটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দু’বছর পর চলে আসতে বাধ্য হন তিনি। কয়েক বছর পর তিনি মেয়েটিকেও হারালেন। সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেন। তার সমস্ত অর্থ ও মস্তিষ্ক পিতার ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় লাগালেন।
ইত্যবসরে রোবেলের পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অর্থনৈতিক জগতে এক ধনী মহিলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তার প্রতিভা ও ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। লন্ডনে আসার পর আলাপ হয় অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে। তখন মি. ব্লাস্ট লন্ডন হাউসের একজন জুনিয়ার অংশীদার ছিলেন। তিনি কিছু কাগজপত্রসহ দেখা করতে এসেছিলেন রোবেলের সঙ্গে। ইতিমধ্যে দুছ-ছটি মাস কেটে গেছে। হঠাৎ একদিন সারা লন্ডনের মানুষ জানতে পারল রেবেল ম্যামসেভেরেটো অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টকে বিয়ে করছেন। আরও বেশি মুগ্ধ হন সবাই এই কথা শুড় ব্লাস্টের থেকে তিনি প্রায় কুড়ি বছরের বড়।
যথারীতি এ খবর সকলের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। রোবেলের বন্ধুরা বলাবলি করতে লাগল, রোবেল অত্যন্ত মুখ, সে এখনও পুরুষ চিনতে শেখেনি। ব্লাস্ট ওকে টাকার লোভে বিয়ে করেছে। আবার একটা চরম আঘাত না পেলে ওর শিক্ষা হবে না।
আবার অনেকের অনুমান ব্লাস্ট রোবেলের টাকাপয়সা অন্য নারীর পেছনে খরচ করবে। সকলের ভবিষ্যৎ বাণী বৃথা হয়েছিল। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখেই কেটেছিল। ব্লাস্ট স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্ত্রীর প্রতি অনুরাগের ঘাটতি ছিল না। রেবেলের মৃত্যুর পর তার বিপুল ঐশ্চর্য সযত্নে রক্ষা করে চলেছেন। কোনো ভাবেই নষ্ট হতে দেননি। অথবা তিনি রোবেলকে ভুলে আরেকজনকে বিয়েও করেননি। এত অর্থকড়ি হাতে পেয়েও তিনি উচ্চুঙ্খল জীবন যাপন করেননি। অর্থনৈতিক বিষয়টা তিনি ভালোই বুঝতেন। বিচারবুদ্ধি ও কার্য ক্ষমতায় বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্লাস্ট আমহোস্ট ও রোদারস্টাই নের বিশাল সম্পদ দক্ষতা ও নিপুন হাতে বজায় রেখেছেন। তাই তিনি এত সুনাম অর্জন করেছেন।
ভেল্টে ও নরফোকে বাড়ি ছিল। সেখানে তিনি ছুটির দিনগুলি কাটাতেন। তিনি হৈ চৈ বেশি পছন্দ করতেন না। কারো সঙ্গে বেশি মেলামেশাও করনে না। তার গুটিকয়েক বন্ধু ছিল। তিনি অল্প খেলতে ভালোবাসতেন। এছাড়া বাগান পরিচর্যার কাজেও তিনি সমান দক্ষা ছিলেন। এমনই একজন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎপ্রার্থী হতে চলেছেন দু’জনে চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ এরকুল পোয়ারো।
তারা একটি ট্যাক্সিতে চড়ে এসে হাজির হলেন বেলমির সাগরবেলায়। তীরবর্তী বিশাল প্রাসাদটি সত্যিই মনোরম নয়নাভিরাম। এর ভেতর সহজসরল হলে কি হবে প্রাচুর্যের অভাব নেই এখানে। হয়তো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি কিন্তু খুবই আরামপ্রদ খুবই জনপ্রিয় এই প্রাসাদটি।
তারা প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মি. ব্লাস্ট এসে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করলেন।
জ্যাপ ও পোয়ারোর পরিচয় পর্ব শেষ হলে ব্লাস্ট বললেন, মি. পোয়ারো, আপনার নামের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছে। তবে কোথায় যেন আপনাকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছি, ঠিক মনে পড়ছে না। পোয়ারো হেসে উত্তর দিলেন, আজ সকালেই আমাকে দেখেছেন, মঁসিয়ে। দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লের ওয়েটিং রুমে। এবার মনে পড়ছে? ব্লাস্টের মুখেও হাসি ফুটেছে। তিনি বললেন, তাইতো, আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম। দেখেছি দেখেছি মনে করতে পারছিলাম না। জ্যাপের দিকে নজর পড়ল তার। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি মি. জ্যাপ। মর্লের ব্যাপারে আমি শোকাতুর।
জ্যাপ বললেন, আপনি কি এরকম দুঃসংবাদ আশা করেননি? মি. ব্লাস্ট?
একদম না, অবশ্য ড. মর্লের সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। আহাম্মকের মতো নিজের গুলিতে শেষ হবার মানুষতো তিনি নন। অন্তত যেটুকু সময় আমি তাকে দেখেছি তাতে ভাবা যায় না; যমন ঘটনাও ঘটাতে পারেন তিনি। আজ সকালে তাকে কেমন দেখেছিলেন? বেশ হাসিখুশি, খোলা মেজাজেই ছিলেন, অবশ্য ডাক্তারের চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আমার শরীরে কাঁপন জেগেছিল। তাছাড়া ওই বিশ্রী ড্রিল চালানো। ওটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই পারিপাশ্বিক কিছু লক্ষ্য করিনি। তবে কাজ শেষ হবার পর তার বেশ স্বচ্ছন্দ্য বোধ হয়েছিল।
আপনি এর আগেও কি মর্লের কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তিন-চারবার গিয়েছিলাম। আসলে গত বছর থেকে আমি দাঁতের যন্ত্রণায় ভুগছি। কার মারফত আপনি তার কাছে গিয়েছিলেন, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন। ভাববার জন্য সময় নিলেন মি. ব্লাস্ট। বিড় বিড় করে বললেন, আমার দাঁত ভেঙে যাওয়ায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখন কে যেন কুইন শার্ট স্ট্রিটের ঠিকানা দিয়েছিল? কে বলেছিল মি. মর্লের কাছে যেতে? দুঃখিত, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
পোয়ারো তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, বেশ, মনে পড়লে আমাদের জানাতে দ্বিধা করবেন না। অবশ্যই। এটা কি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সূত্র? ব্লাস্ট অবাক হয়ে বললেন। হলেও হতে পারে। আমরা সবকিছু গুরুত্ব সহকারে দেখছি, পোয়ারো বললেন। কোথায় কি লুকিয়ে আছে বলা মুশকিল। ব্লাস্টের কাছে বিদায় নিয়ে জ্যাপ ও পোয়ারো প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রাসাদের সামনে দাঁড়ানো একটি গাড়ি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অদ্ভুত ধরনের স্পোর্টিং গাড়ি।
একটি অল্প বয়সি তরুণী সেই গাড়ি থেকে নেমে এল। সে চোখ তুলতেই তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি বিনিময় হল। তারপরেই মেয়েটি চেঁচিয়ে বলল–এই যে শুনছেন? একটু শুনুন না? দুজনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাদের দুজনের চোখে জিজ্ঞাসা, মেয়েটি এগিয়ে এল। মেয়েটি কৃশকায়, দীর্ঘাঙ্গী। হাত-পায়ে একটা অবিনত্ব আছে। গায়ের ত্বক কিছুটা তাকাটে। জীবনী শক্তিতে ভরপুর। তাই কুশ্রী চেহারা চাপা পড়ে গেছে। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, আপনাকে আমি চিনি–আপনি সেই রহস্য সন্ধানী এরকুল পোয়ারো। তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হল।
পোয়ারো বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি ঠিক ধরেছেন, মাদামোয়াজেল। আমিই সেই অধম। আর ইনি চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ। পোয়ারো জ্যাপের পরিচয় দিলেন। তরুণীর নেত্রযুগল ভয়ে বিস্ফারিত হল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, আপনারা এখানে? আমার কাকার কি কিছু হয়েছে? মেয়েটির কথায় মার্কিনী টান আছে। পোয়ারো আবার প্রশ্ন করলেন, আপনার একথা মনে হওয়ার কারণ কি, মাদামোয়াজেল? মেয়েটি পোয়ারোর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, ওঃ বাঁচা গেল। কাকা সুস্থই আছেন। জ্যাপ পোয়ারোর প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করলেন। আপনি কি আশা করেছিলেন, মি. ব্লাস্টের কোনো অঘটন হবে? মেয়েটি এবার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি জেন অলিভেরা। এটা আমার কাকার বাড়ি। অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট আমার কাকা হন। বাড়িতে গোয়েন্দার উপস্থিতি মনে তো ভয়ের উদ্বেক করবেই স্যার। মি. ব্লাস্টার সম্পূর্ণ সুস্থ ও বহাল তবিয়তে আছেন। আমরা এসেছিলাম অন্য কাজে। আজ সকালে কুইন শার্ট স্ট্রিটে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সে ব্যাপারে মি. ব্লাস্ট কিছু জানেন কিনা জানতে, মিস অলিভেরা।
জেন চিৎকার করে জানতে চাইল, কে করেছে আত্মহত্যা? কেন করেছে? মি. মর্লে নামে এক দন্তচিকিৎসক। কেন করেছেন সেটা এখন বলা যাবে না। জেন অলিভেরা চিন্তাক্লিষ্ট কণ্ঠে বলল, ওহ! জ্যাপ বললেন, অদ্ভুত মহিলা তো। বাদ দিন ওসব কথা, এবার যাওয়া হবে সেইনসবারি সীলের আস্তানায় তারপর আমাদের গন্তব্য হবে স্যাভয় হোটেল। প্লেনগেরি কোর্ট হোটেল। স্বপ্নলোকিত লাউঞ্জ। কথা ছিল মিস সেইনসবারি সীল এখানে থাকবেন। জ্যাপ ও পোয়ারা হোটেলের ভেতরে ঢুকতেই দৃষ্টি গোচরে হলেন। চেয়ারে বসে চা পান করছিলেন। তাদের দুজনকে মিস সীল আগে থেকেই চিনতেন। তাই সাদা পোশাকে ওদের দুজনকে আসতে দেখে তিনি একটু সচকিত হলেন। জ্যাপ ও পোয়ারো তার সামনে যেতে তিনি বললেন, অফিসার, কথা বলার মতো নিরাপদ জায়গা এটা নয়। আপনারা কি চা পান করবেন? জ্যাপ হাত তুলে বললেন, আমি নই, মাদাম, ধন্যবাদ।
মিস সীল বললেন, ঠিক আছে। চলুন ড্রয়িংরুমে। একটা কোণ দেখে বসা যাবে। কথাটা শেষ করেই মিস সীল ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। জ্যাপ ও পোয়ারো তাকে অনুসরণ করলেন। কোণের দিকে দুটি সোফা তাদের নজরে পড়ল তারা সেখানে গিয়ে বসলেন। মিস সীল বলতে লাগলেন, তাহলে ইন্সপেক্টর-না, না চিফ ইন্সপেক্টর ঘটনাটা খুবই মনস্তিক তাই না? বেচারা মি. মর্লে। তিনি কি অবসাদগ্রস্ত মানসিক রোগী ছিলেন? আপনি কি তার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন, মিস সীল? মিস সীল চুল ঠিক করতে করতে বললেন, মানে–আমি ঠিক লক্ষ্য করিনি, তবে দেখে মনে হয়েছিল ভালই আছেন তিনি। তাছাড়া আমি ভীষণ ভীতু।
আপনি একটু মনে করে বলুন তো, সে সময় ওয়েটিং রুমে কাকে কাকে দেখেছিলেন? আমাকে একটু ভাবতে দিন–আমার যাওয়ার আগে এক তরুণ সেখানে বসেছিল। বসে থাকতে থাকতে সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। তারপর হঠাৎ সে লাফ দিয়ে চলে গেল। তখন আমার মনে হয়েছিল সে দাঁতের যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল।
সে যে ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল সেটা কি জানেন? না, সেটা জানি না। তবে আমার অনুমান ডাক্তার দেখতে না পেয়েই ও চলে যায়। তখন মি. মর্লের ওকে ডাকার কথা নয়। সে সময়টা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। তাই তার চাকর আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় কি আপনি আবার ওয়েটিং রুমে গিয়েছিলেন মিস সীল?
না। আমার টুপি ব্যাগ সঙ্গে নিয়েই মি. মূর্লের ঘরে গিয়েছিলাম। এইরকম একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল আমার বন্ধুর যে বেচারার নতুন টুপির ওপর একটা বাচ্চা বসে পড়েছিল। আর তাতেই টুপিটা চ্যাপ্টা হয়ে গিয়ে বিশ্রী দেখতে হয়েছিল। সেই থেকে আমি কখনো টুপি হাতছাড়া করি না।
পোয়ারো নরম সুরে বললেন, খুবই দুঃখের। মিস সীল আবার বললেন, এর জন্য কিন্তু ওই বাচ্চাটির মা দায়ী। কারণ বাচ্চাকে নজরে রাখা তার কর্তব্য। জ্যাপ বললেন, তাহলে আপনি বলছেন, ওই ঘরে একমাত্র ওই যুবকই ছিলেন? না, না, আর একজনকে দেখেছিলাম। মি. মর্লের ঘরে যখন আমার ডাক পড়েনি তখন এক বিদেশী ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে পোয়ারো বলে উঠলেন, ওই ভদ্রলোকটি আমি, মাদাম। ওহ মাপ করবেন, সেই সময় আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি। ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি। ড. মলের মুখে অ্যামবেরিওটিস নামে কোনো রোগীর কথা শুনেছিলেন কি? না, না, দাঁতের ডাক্তারেরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে থাকেন তিনিও তাই বলেছিলেন। পোয়ারোর স্মরণ এল কতগুলো কথা যা মি.মর্লে বলে থাকেন। মুখ খুলুন…………কুলকুচো করুন……..এবার আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ করুন বেশি কথা বলবেন না……..।
জ্যাপ মিস সীলকে ইনকোয়েস্ট সাক্ষ্য দেবার কথা বলতেই তিনি দেখে বললেন। তার আপনিও দেখে বললেন। তার আপত্তি দেখে জ্যাপ নানাভাবে বোঝালেন। শেষে অনেক কষ্টে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হলেন তিনি। জ্যাপ দেখলে মিস সীলের জীবনের নানা কথা জেনে নিলেন। মিস সীল আগে ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। মাত্র ছ’মাস আগে ইংল্যান্ডে এসেছেন। নানা হোটেল বদল করে করে শেষে এসে উঠেছেন প্লেনগোরি কোর্টে এখানকার জলহাওয়া তার খুব পছন্দ। ভারতে বেশির ভাগই তিনি কলকাতায় কাটিয়েছেন। সেখানে মিশনের হয়ে কাজকর্ম করতেন। ছোটবেলায় অভিনয় শিখেছিলেন। শেকসপীয়ার বানডি শ র লেখা কাহিনিচিত্রে ছোট ছোট রোলে মঞ্চে অভিনয়ও করেছেন। অনর্গল ইংরাজি লিখতে ও বলতে পারতেন। অপেশাদার নাট্যদল গঠন করেছেন কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছেন। প্রেম করে বিয়ে করেছেন। আবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। একবন্ধুর কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে একটা আবৃত্তির স্কুল তৈরি করেছেন। তিনি তার কিছু কাগজপত্র জ্যাপ ও পোয়ারোকে দেখালেন। মিস সীল উৎসাহিত হয়ে বললেন, যদি সাক্ষ্য দিই তাহলে আমার নাম নিশ্চয়ই সংবাদপত্রে ছাপা হবে? তবে দয়া করে দেখবেন নামের বানানটা যেন ঠিক লেখা হয়। আমার পুরো নাম ম্যাবেল সেইনসবারি সীল। আমি যে কোন এক সময় শেক্সপীয়ারের অ্যাজ ইউ লাইফ ইট-এ অভিনয় করেছি, তা যেন ওরা লেখে। তাহলে আমি ভীষণ খুশি হব………….। ।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, তাই হবে–বলতে বলতে জ্যাপ কোনো রকমে সেখান থেকে পালিয়ে এলেন, এর বিপজ্জনক দিকটাও তার অজানা নয়। জ্যাপ সোজা এসে ট্যাক্সিতে উঠলেন। কপালের ঘাম মুছলেন। তারপর বললেন–ওই মহিলা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া মনে হয় কষ্টের হবে না। যদি সত্যি কথা বলে থাকেন। পোয়ারো মাথা ঝাঁকালেন। চিফ ইন্সপেক্টর আবার বলতে লাগলেন আমার আশঙ্কা ছিল ইনকোয়েস্টের কথায় উনি ভয় পাবেন। সব বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। উনি অভিনেত্রী বলেই প্রচারের আলোয় আসতে চেয়েছেন। তাই আমাদের কথায় সম্মতি জানিয়েছেন। পোয়ারো বললেন আপনি কি সত্যিই ওকে সন্দেহের তালিকায় রাখলেন? সম্ভবত না। তবে আমি নিশ্চিত এটা আত্মহত্যা নয়, খুন।
যদি তাই হয়, তাহলে মোটিভ কি বুঝতে পারছেন? না, এখনও আন্দাজ করতে পারিনি। নানা কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে একটা হল, কোনো এক সময় মর্লে অ্যামবেরিওটিসের মেয়েকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন? পোয়ারোর মুখে কথা নেই। তিনি কল্পনার মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন মি. মর্লে মদিরক্ষি এক গ্রীক সুন্দরীকে তার প্রেম স্বরে জর্জরিত করছেন। পরমুহূর্তের তার ঘোর কাটল। তিনি জ্যাপকে বললেন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন মর্লের অংশীদারের কথা। তিনি বলেছেন মলের জীবনে আনন্দ বলে কিছু ছিল না। জ্যাপ বললেন, দেখি অ্যামবেরিওটিস কোনো আলোর দিশা দিতে পারেন কিনা? ট্যাক্সি এসে থামল স্যাভয় হোটেলের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে দুজনে প্রবেশ করলেন হোটেলের ভেতরে। কাছাকাছি। কাউকেই দেখতে পেলেন না তারা। তারা রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কেরানি গোছের একজন ভদ্রলোককে সেখানে দেখতে পেলেন। তিনি আপন মনে নিজের কাজ করছেন।
জ্যাপ তাকে জিজ্ঞেস করলেন মি. অ্যামবেরিওটিস কত নম্বর ঘরে আছেন? আমরা তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেই ভদ্রলোক উদাস চোখে তাকিয়ে বললেন, মি. অ্যামবেরিওটিস? দুঃখিত স্যার। তার সঙ্গে দেখা হবে না। জ্যাপ রাগত স্বরে বললেন, কেন হবে না, নিশ্চয়ই হবে। এই বলে তিনি নিজের পরিচয়পত্র দেখালেন। কেরানি ভদ্রলোক বলল, আমার কথার ভুল মনে করেছেন আপনি স্যার। তিনি আর ইহ জগতে নেই। আধ ঘন্টা আগে মারা গেছেন। জ্যাপ হতাশ হয়ে বসে পড়লেন আর পোয়ারোর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল।