ডক্টর ফার্গুসনের একমাত্র বন্ধু যিনি ছিলেন, তিনি ডিক কেনেডি। ধ্যান-ধারণা, প্রবণতা ও স্বভাব দু-জনের একেবারে অন্যরকম, কোনো দিকেই প্রায় মেলে না; কিন্তু তবু তাঁদের ভিতর প্রীতির কোনো অভাব ছিলো না। কতগুলো দিকে আবার দুজনের খুব খাপ খেতো : ডিক কেনেডি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সরলচিত্ত, কোনো ঘোরপ্যাঁচ জটিলতা নেই, একবার যা করবেন বলে ধরেন কখনও তা শেষ না-করে ছাড়েন না। শিকারি হিশেবে গোটা এডিনবরায় তাঁর কোনো জুড়ি ছিলো না। তিনি থাকতেন এডিনবরার লিথি নামক স্থানে। তার টিপ এমনি অব্যর্থ আর অমোঘ ছিলো যে, দূরে একটা ছুরি রেখে তিনি বন্দুকের এক গুলিতে ছুরিটাকে দুই সমান ভাগে টুকরো করে দিতে পারতেন। সুপুরুষ, শাদাসিধে, সরল এবং দুঃসাহসী ডিক কেনেডি তার ডাকাবুকো বন্ধু ফার্গুসনকে খুবই ভালোবাসতেন।
তিব্বত-ভ্রমণের পর ফার্গুসন দু-বছর চুপচাপ বসে ছিলেন, আর-কোথাও ভ্রমণ করতে বেরোননি। তাই দেখে ডিক ভেবেছিলেন, বন্ধুর বেড়াবার নেশা বোধহয় এতদিনে শেষ হলো। তাতে তিনি মনে-মনে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। দেখা হলেই তিনি ফার্গুসনকে কেবলই বলতেন, আর ছুটোছুটি করে কাজ নেই, বিজ্ঞানের জন্যে অনেক করেছো, এবারে দু-দিন ঘর-সংসারে মন দাও দেখি। ফার্গুসন মাঝে-মাঝে এ-কথা শুনে মৃদু হাসতেন, কখনও আবার চুপ করে কী যেন ভাবতেন, বন্ধুর কথার সরাসরি কোনো উত্তর দিতেন না।
ডক্টর স্যামুয়েল ফার্গুসনের সঙ্গে ডিক কেনেডির পরিচয় হয়েছিলো ভারতবর্ষে। সেনাবাহিনীর একই বিভাগে কাজ করতেন দুজনে, কিছুকাল একই শিবিরেও কাটিয়েছিলেন। সবসময়েই শিকার নিয়ে মত্ত থাকতেন ডিক, আর ফার্গুসন কেবলই যতরাজ্যের পোকামাকড় আর নানা জাতের গাছপালার স্বভাব, প্রকৃতি, প্রবণতা এইসবই অনুসন্ধান করে বেড়াতেন। দুজনে দুজনের জন্যে এমন-কোনো কাজই করেননি যা তাদের বন্ধুতার মূল কারণ হতে পারে, কিন্তু তবু-প্রায় সব বিষয়েই দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য সত্ত্বেও—দুজনের মধ্যে গভীর বন্ধুতা হয়েছিলো। অনেকে ভাবতে পারে যে দুজনে যখন একই বাহিনীতে কাজ করতেন, তখন হয়তো পরস্পরকে তারা কখনও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, বা কোনোরকম পারস্পরিক উপকারের সূত্রে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন; কিন্তু তা সত্য নয়। দুজনের মধ্যে দেখাশোনাও হতো কচিৎ কখনও, কিন্তু তবু যখনই ফার্গুসন তার মস্ত এক একটি অভিযানের পর ইংলণ্ডে ফিরে আসতেন, তখনই ছুটতেন ডিক কেনেডির বাড়ি। যতদিন-না সেখানে কয়েকদিন কাটানো যায় ততদিন যেন আর তার মনের অস্বস্তি ও অস্থিরতা কাটবে না।
লামাদের দেশ থেকে প্রাণ হাতে করে ফিরে আসার পর বছর-দুয়েক ফার্গুসন টু-শব্দটি না-করে পড়াশুনো নিয়ে কাটাচ্ছিলেন দেখে ডিক মনে-মনে স্বস্তি অনুভব করছিলেন। এতদিনে তবে সত্যিই ডাকাবুকো বার-মুখো ফার্গুসন ঘরের দিকে মন দিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ ডেইলি টেলিগ্রাফের পাতায় ফার্গুসনের সংকল্পিত অভিযানের কথা পড়ে তার সব ধারণা চুরমার হয়ে গেলো। প্রথমটা অন্য-অনেকের মতো তিনিও খবরটিকে আজগুবি বলে ভেবেছিলেন। কেননা বেলুনে করে আফ্রিকা পাড়ি দেবার মতো ও-রকম একটা ভীষণ সংকল্প কেবল পাগলেই করতে পারে। নেহাৎ যদি মাথায় পোকা না-ঢোকে তো কেউ কোনোদিন বেলুনে করে আভিযানের কথা ভাবতে পারে? তাছাড়া কয়েকদিন আগেই তো ফার্গুসনের সঙ্গে দেখা হয়েছে তার, তখন তো কই এ-রকম কোনো সংকল্পের কথা মুখেও আনেননি ফার্গুসন! খবরটা বিস্তারিতভাবে পড়ার পরে কিন্তু ডিকের ভুল ভেঙে গেলো। তাহলে কি এইরকম একটা মারাত্মক মৎলব আটছিলেন বলেই ফার্গুসন দু-বছর চুপচাপ বসে ছিলেন? এর পরে হয়তো কোনোদিন বন্ধুটি চন্দ্রলোকে যাবার জন্যেও বায়না ধরে বসবেন।
অস্বস্তিতে ভরে গেলেন ডিক। না, যেমন করেই হোক, এই সংকল্প থেকে ফার্গুসনকে নিবৃত্ত করতেই হবে। জীবন যে কখন কোনদিক থেকে অভাবনীয়ের সম্মুখীন করে দেয়, তা কে জানে। হয়তো ফার্গুসন তার সংকল্প থেকে মোটেই টলবেন না, কিন্তু তবু একবার তাকে ফেরাবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? না, আজই যেতে হয় দেখছি।
একটু রাগও হলো ডিকের। এই-ই যদি তার উদ্দেশ্য হবে, তবে আগে সে-কথা ডিককে বলতে কী দোষ হয়েছিলো? বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই খবরটা ডিককে কিনা খবরের কাগজ পড়ে জানতে হলো! এত লোকজানাজানি হবার আগে ডিক যদি একথা একবার জানতে পারতেন, তবে হয়তো অনায়াসেই তাকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে পারতেন। কিন্তু এখন, এত হৈ-চৈ শুরু হয়ে যাওয়ার পর, তা কি আর সম্ভব হবে?
ডিক আর-একটুও দেরি না-করে রেলের টিকিট কেটে সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে গাড়িতে চেপে বসলেন। যথাসময়ে পরদিন সকালবেলায় লণ্ডনে এসে পৌঁছুলেন তিনি, তারপর সোজা গাড়ি করে গ্রীক স্ট্রিটে ফার্গুসনের বাড়িতে এসে হাজির হলেন।
ডিক কেনেডিকে হঠাৎ এসে হাজির হতে দেখে ফার্গুসন যৎকিঞ্চিৎ অবাক হলেও বাইরে তা প্রকাশ করলেন না। মুখে কেবল বললেন, হঠাৎ তুমি যে? কী ব্যাপার? শিকার ছেড়ে হঠাৎ লণ্ডনে কী জন্যে?
ডিক একটু রাগি গলায় উত্তর দিলেন, আচ্ছা, তোমার কি কখনও কাণ্ডজ্ঞান হবে। না, ফার্গুসন? বুদ্ধিশুদ্ধি কি সব লোপ পেয়ে গেছে? কী-সব যা-তা কথা বলে বেড়াচ্ছো? পাগলের মতো তোমার মাথায় পোকা ঢুকেছে বলেই হন্তদন্ত হয়ে আমাকে এই বিচ্ছিরি আর ঘিঞ্জি লণ্ডন শহরে আসতে হলো।
আমার মাথায় পোকা ঢুকেছে বলে? ফার্গুসন একটু হাসলেন। ও, কাগজে বুঝি খবরটা পড়েছো? তা সে নিয়ে পরে কথা হবে, আগে তো মাথা ঠাণ্ডা করে গুছিয়ে বোসো।
সে-সব ভদ্রতা পরে দেখা যাবে। ডিক বললেন, তাহলে সত্যিই তুমি আফ্রিকা যাচ্ছো?
তা তো যাচ্ছিই। সব ব্যবস্থাও মোটামুটি হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির ষোলো তারিখে গ্রীনউইচ থেকে রেজোলিউট জাহাজ ছাড়বে—ঐ জাহাজে করেই জানজিবার অব্দি যাবো আমি।
সব ঠিকঠাক করে ফেলেছে তাহলে, না? আর রাগ-চাপতে পারলেন না ডিক। জানো, তোমার সমস্ত ব্যবস্থা আমি লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারি।
অত মাথা-গরম কোরো না, ডিক। ফাণ্ডসন আবার হাসলেন। তোমার এত রাগের কারণ আমি জানি! এই নতুন অভিযানের পরিকল্পনাটি কেন আগে থেকে তোমাকে জানাইনি—তোমার এত রাগের কারণ তো তা-ই!
নতুন অভিযান গোল্লায় যাক। আমি বলছি, তোমার যাওয়া হবে না-স্বাস, সব গোল চুকে গেলো। এর মধ্যে আবার মনস্তত্ত্বের কথা ওঠে কোত্থেকে?
সে-কি! আমি যে এবারে তোমাকেও সঙ্গে নেবো ঠিক করেছি। জানো তো, যে-সে জায়গা নয়, আফ্রিকা। বুনো জানোয়ারদের হাতে পড়ে যে-কোনো মুহূর্তে প্রাণ হারাতে হতে পারে। কাজেই সঙ্গে এমন-একজন লোক চাই, যার বন্দুকের টিপ একেবারে মোক্ষম এবং শিকারে যার কোনোকালেই অনীহা দেখা দেবে না, আর যার সাহসের তুলনা হয় না। আর সে-রকম লোক, আমার হিশেবে, সারা ইংলণ্ডে একজনই আছে—সে তুমি। কাজেই তোমাকে সঙ্গে নেবার কথা গোড়া থেকেই আমি মনে-মনে ভাবছিলুম। আজ যদি তুমি না-আসতে তো আমিই তোমাকে এখানে আসার জন্যে তার করে দিতুম। তাছাড়া, এই তো সেদিন তুমি আপশোশ করে বলেছিলে, এমনএক দেশে আছে যেখানে কোনো শিকার মেলা দুর্লভ, যেখানে শিকার করে আনন্দ নেই; বিপদ-আপদ মৃত্যুর আশঙ্কা—এ-সবই যদি না-থাকলো তাহলে আর শিকার করার মধ্যে উত্তেজনার খোরাক কী আছে। তাই বলছি, চলো আমার সঙ্গে, দেখা যাবে কত শিকার তুমি করতে পারো।
আমি যাবো তোমার সঙ্গে! ডিকের বিস্ময়ের আর সীমা রইলো না। প্রথমটায় তো ফার্গুসনের কথা তার বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিলো না। পরে যখন বুঝলেন বন্ধু তাকে ঠাট্টা করছেন না, বরং একটি সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কথাই প্রকাশ করছেন, তখন জোর দিয়ে বললেন, অসম্ভব, তা হয় না। আমি তো এখনও তোমার মতো পুরোদস্তুর পাগল হয়ে যাইনি, কাজেই ও-সব আজগুবি মৎলব আমার মাথায় খুব-একটা আসে না।
ফার্গুসন কিন্তু তার সংকল্প থেকে একতিলও নড়লেন না। প্রথমটায় ডিক যতই আপত্তি করুন না কেন, ফার্গুসন যখন শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন ডিক তখন অন্যদিক দিয়ে আক্রমণ চালালেন। জেদ কারুই কম নয়, দুজনেই সমান একরোখা। ফার্গুসন তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাবেনই আর ডিকেরও পাহাড়ের মতো অনড় প্রতিজ্ঞা, কিছুতেই তিনি সঙ্গে যাবেন না। পরিকল্পনাটি জনসাধারণের কাছ থেকে যতই হাততালি বা পিঠচাপড়ানি পাক না কেন আসলে এটা কেবল অবাস্তবই নয়, রীতিমতো অসম্ভব। অন্য লোক হলে ডিক এই প্রস্তাবের ভয়াবহতা নিয়ে হয়তো আলোচনা করতেন, কিন্তু ফার্গুসনকে ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই : আগে যিনি প্রাণ হাতে করে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে একা অকুতোভয়ে চলাফেরা করেছেন, তাঁকে সাধারণ লোকের মতো প্রাণের ভয় দেখানো হাস্যকর। কাজেই ডিক যুক্তি-তর্ক দিয়ে ফার্গুসনের প্রস্তাবের অবাস্তবতা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু যুক্তি জিনিশটার উপর তো ডিকেরই কেবল একতরফা অধিকার নেই। ফার্গুসনের বৈজ্ঞানিক মনও যুক্তিকে কোনো অব্যর্থ তীক্ষ্ণ্ণধার ছুরিকার মতো ব্যবহার করতে জানে। ডিকের সমস্ত বিরোধিতাকেই ফাণ্ডসন যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে দিলেন। অনেকক্ষণ ধরে তর্কাতর্কি চলার পর ডিক কেনেডির বিরোধিতায় একটু বিচলিত হলেন। তাছাড়া, সত্যি-বলতে, ছায়াচ্ছন্ন আফ্রিকায় শিকার করতে যাওয়ার প্রস্তাবটা তাকে ভেতরে-ভেতরে কিঞ্চিৎ দুর্বল করে দিয়েছিলো। অমন লোভনীয় প্রস্তাব কি একটুও বিবেচনা না-করে অগ্রাহ্য করে দেয়া যায়, না কি তা কখনও দেয়া উচিত? কিন্তু, তবু বেলুনে করে যাওয়ার কথাটা ডিকের কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছিলো না।
বেশ-তো, যেতেই যদি হয় তাহলে হাঁটা-পথে যেতে আপত্তি কীসের? বেলুনে করে যেতে চাচ্ছো কেন? হঠাৎ তারপর বেলুন কোনোরকমে ফুটো হয়ে যাক, আর মাটিতে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে যাই। এর কোনো মানে হয় না। অন্যকোনো দিক দিয়ে মৃত্যু এলে তবু তার সঙ্গে খানিকক্ষণ লড়াই চালানো যায়, না-যুঝে এত সহজে হার স্বীকার করার কোনো কথাই ওঠে না। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে তো করার কিছুই নেই। অসহায়ের মতো মৃত্যুর হাতে নিজেকে সঁপে দিতে হবে। তার চেয়ে স্থলপথ ঢের ভালো— অন্তত এত সহজে মৃত্যুর হাতে পড়তে হবে না। কেন-যে তুমি মাটির ওপর দিয়ে যেতে চাচ্ছো না, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
স্থলপথে মাটির ওপর দিয়ে এইজন্যে যেতে চাচ্ছি না যে, এর আগে যতবারই হাঁটাপথে যাবার চেষ্টা করা হয়েছে, সবই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফার্গুসন বন্ধুকে বোঝতে বসে গেলেন। আফ্রিকায় যাবার চেষ্টা তো আর আজকেই প্রথম হচ্ছে না, এর আগে ইয়োরোপের অনেকেই সেই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই স্থলপথ বেছে নিয়ে মস্ত ভুল করেছিলেন। জন্তুজানোয়ার, অসুখ-বিশুখে, আফ্রিকার দুর্দান্ত আদিবাসীদের হামলায় ও পথশ্রমে প্রত্যেককেই খামকা ক্লান্ত হতে হয়েছে। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন, কেউ-কেউ প্রায়-মৃত অবস্থায় যখন ফিরে এসেছেন, তখন কঙ্কালটা বাদে মনুষ্য-শরীরের আর-কিছুই তাদের অবশিষ্ট ছিলো না। তা ছাড়া আমাদের যাবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আফ্রিকার ঠিক কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছুনো। পথেই যদি আমাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে গিয়ে আর লাভ কী, হয়তো ফিরে-আসার কোনো ক্ষমতাই তখন আমাদের অবশিষ্ট থাকবে না। কী করে পথের এই বিপজ্জনক ও মারাত্মক শ্রম বাদ দিয়ে আফ্রিকার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছুনো যায় সে-কথা ভাবতে গিয়েই আকাশযানের কথা আমার মনে পড়ে। বেলুনে করে যাওয়ার সুবিধে কত, তা কি আর তালিকা করে বোঝানো যায়। আকাশপথে যাবো বলেই এইসব বিপদ-আপদ আমাদের কোনো নাগালই পাবে না, তার অনেক উপর দিয়ে তার হাত এড়িয়ে আমরা চলে যাবো, তাছাড়া কত তাড়াতাড়ি যাবো, তাও একবার ভেবে দ্যাখো। আগে যে-সব অভিযানকারী যেপথ অতিক্রম করতে এক মাস লাগিয়েছিলেন, আমরা তা অনায়াসেই বেলুনে করে দু-তিন দিনে চলে যাবো, এমনকী নিরাপদেই যাবো। ভ্রমণকারীদের সামনে পথে যেসব বাধা আসে, তার কিছুই আমরা অনুভব করতে পারবো না। দুর্ভেদ্য জঙ্গল, পাহাড়পর্বত, নদী প্রান্তর মরুভূমি, অসুখবিশুখ, অস্বাস্থ্যকর জলবায়ু-কোনোকিছুই আমাদের বাধা দিতে পারবে না, অক্লেশে সবকিছুর উপর দিয়ে সহজেই আমরা পাড়ি দেবো। শূন্যপথে যাবো বলে অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়বে, ঝড়বৃষ্টিকেও এড়িয়ে যেতে পারবো। শুনে নিশ্চয় বুঝতে পারছো পায়ে-চলায় এ-সব কোনোকালেই সম্ভব হত না। বেলুনের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা থাকবে আমারই হাতে-কখনও অনেক উঁচু দিয়ে, কখনও-বা মাটির সামান্য কিছু ওপর দিয়ে, যখন যেভাবে সুবিধে হয়, সেভাবেই আমরা যাবো।
বেলুন তোমার মর্জি-মাফিক চলবে নাকি? তার চলা তো নির্ভর করবে হাওয়ার গতিবেগের ওপর। কাজেই তোমার সুবিধে অনুযায়ী তা চলবে কী করে?
এমন কোনো-একটা প্রশ্নই আশা করেছিলেন ফার্গুসন, কাজেই প্রশ্নটা শুনে তাকে মোটেই বিচলিত দেখালো না। চট করে বললেন, তার ব্যবস্থা ও আমি ঠিক করেছি। আমরা তো পুবদিক থেকে পশ্চিমে যাবো, তুমি নিশ্চয়ই জানো বাণিজ্যবায়ুর গতিও সেই দিকেই—ওই বাণিজ্যবায়ুই আমায় গন্তব্য পথে যেতে সাহায্য করবে। একটু থেমে আবার যোগ করলেন, এতদিন ধরে বেলুনকে যখন-তখন ওপরে ওঠাবার ও নিচে নামাবার জন্যে বহু পরীক্ষা ও গবেষণা হয়েছে, কিন্তু কেউই এমন-কোনো পথ বাৎলাতে পারেনি যাকে বিশেষ সুবিধেজনক বলা চলে। কিন্তু আমি অনেক ভেবেচিন্তে এমন-একটি প্রক্রিয়া বের করেছি, যার সাহায্যে অনায়াসেই যে-কোনো বেলুনকে ইচ্ছেমতো চালানো যায়। তুমি তো জানো গ্যাস যত সম্প্রসারিত হয়, ততই তা হালকা হয়ে পড়ে। বেলুনের গ্যাস সম্প্রসারিত করে আমি তাকে ওপরে ওঠাবো, আর গ্যাস সংকোচন করিয়ে তাকে নিচে নামাবো। প্রশ্ন করতে পারো, এই সংকোচন সম্প্রসারণ আমি ইচ্ছেমতো করবো কী করে? উত্তরে বলবো, অতি সহজেই। গ্যাসের উত্তাপের তারতম্যের ওপরই তার সংকাচন ও সম্প্রসারণ নির্ভর করে। তাপ বাড়িয়ে দিলেই গ্যাস ছড়িয়ে গিয়ে হালকা হবে আর তাপ কমিয়ে দিলেই তা একজায়গায় জড়ো হয়ে ভারি হয়ে যাবে।
সবই না-হয় বুঝলাম, ডিকের গলা খুব হতাশ শোনালো, কিন্তু তবু কিছুতেই আমার মন এতে সায় দিতে চাচ্ছে না, ফার্গুসন।
এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নেই, ডিক। তুমি যে সঙ্গে যাবে, তা আমি অনেক আগেই ঠিক করে ফেলেছি। তুমি আর আমি ছাড়া আর যাবে জো—তুমি তো জানোই, ওকে না-নিয়ে আমি কোথাও যাই না। আর জো যদি বিনা দ্বিরুক্তিতেই যেতে পারে, তাহলে তোমার যেতে এত আপত্তি কীসের, তা আমি বুঝতে পারছি না।