ট্রেন ছুটে চলেছে।
গতি একশ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আলট্রাভায়োলেট প্রতিরোধী স্বচ্ছ কাচের জানালার পাশে ইরিনা বসে আছে। বাইরের পৃথিবীর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অরচ লীওন বললেন, তুমি বোধ হয় এই জীবনের প্রথম ট্রেনে চড়লে।
হ্যাঁ। আমি প্রথম শহরের মানুষ। ট্রেনে চড়ার সৌভাগ্য আমার হবে কেন?
তা ঠিক। কেমন লাগছে তোমার?
কোনোরকম লাগছে না।
জানালার পাশে বসে কিছুই দেখতে পাবে না। বাইরে আলো নেই। এখন কৃষ্ণপক্ষ। অবশ্যি চাঁদ থাকলেও কিছু দেখতে পেতে না, আমরা যাচ্ছি। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে। আমাদের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সেটা খুব সুখকর দৃশ্য নয়। এই জন্যেই ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে যেসব ট্রেন চলাচল করে, তা করে রাতে, যাতে আমাদের কিছু দেখতে না হয়।
আপনি শুধু শুধু কথা বলবেন না। আপনার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।
খাবার দিতে বলি?
না।
কিছু খাবে না?
না, আমার খিদে নেই।
আমার খিদে পেয়েছে। আমি খাবার গাড়িতে যাচ্ছি। তুমি যদি মত বদলাও তাহলে চলে এস। করিডোর ধরে আসবে, সবচে শেষের কামরাটি খাবার ঘর। রোবট এ্যাটেনডেন্ট আছে। ওদের বললে ওরা তোমাকে সাহায্য করবে।
ইরিনা যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে রইল। তাদের কামরায় টিভি স্ত্রীনে ধ্বংসস্তুপের বর্ণনা দিয়ে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করছে। অন্য সময় খুব আগ্রহ নিয়ে সে শুনতে, আজ শুনতে ইচ্ছে করছে না। কিভাবে টিভি সেটটি বন্ধ করা যায়, তাও তার জানা নেই। বাধ্য হয়ে শুনতে হচ্ছে। কী হবে শুনে। এর সবই তার জানা। ইতিহাসের ক্লাসে সে পড়েছে। খুব আগ্রহ নিয়েই পড়েছে। টিভির লোকটি বলছে খুব সুন্দর করে। আবেগ-আপুত কণ্ঠ। যেন ধ্বংস হবার ঘটনাটি সে প্ৰত্যক্ষ করছে।
বন্ধুগণ। ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে আজ। আপনারা যারা ঝড়ের গতিতে যাচ্ছেন, তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, আজ থেকে চারশ বছর আগে এখানে কোলাহল মুখর জনপদ ছিল। অঞ্চলটিকে বলা হত এশিয়া মাইনর।
আজ থেকে চার শ বছর আগে দু হাজার পাঁচ সালে পৃথিবী নামে আমাদের এই সুন্দর গ্রহটিতে নেমে এল ভয়াবহ দুৰ্যোগ, আণবিক যুগের শুরুতেই যে দুর্যোগের আশঙ্কা সবাই করছিল। শান্তিকামী মানুষ ভাবত, একসময় না একসময় আণবিক যুদ্ধ শুরু হবে। সেটিই হবে মানব জাতির শেষ দিন। দু হাজার পাঁচ সালে তাদের আশঙ্কাই সত্যি হল। তবে তারা যেভাবে ভেবেছিলেন, সেভাবে নয়। মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে যুদ্ধ হল না। কোনো এক অজানা কারণে জমা করে রাখা আণবিক অন্ত্রের বিস্ফোরণ শুরু হল। হাজার হাজার বছরের সভ্যতা ধ্বংস হতে সময় লাগল। মাত্র এগার মিনিট।
ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী বছরকে বলা হয় অন্ধকার বছর। কারণ সে-বছর সূর্যের কোনো আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছল না। ধূলা-বালি, আণবিক ভস্ম সূর্যকে আড়াল করে রাখল। কাজেই ধ্বংস হল সবুজ গাছপালা। সবুজ গাছপালার উপর নির্ভরশীল জীবজন্তু। পরবতী এক শ বছরের তেমন কোনো ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আমরা শুধু জানি অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে কিছু কিছু মানুষ বেঁচে রইল। তারা শুরু করল নতুন ধরনের জীবন-ব্যবস্থা। প্রথম শহর, দ্বিতীয় শহর ও তৃতীয় শহরভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থা। মানুষের ভবিষ্যৎকে সুনিশ্চিত করতে, সীমিত সম্পদের মধ্যেও তাদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেবার জন্যে এই ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থার কোনো উপায় ছিল না।
প্রিয় বন্ধুগণ, এখন আপনাদের দু হাজার পাঁচ সালে সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পর্কে বলছি। এই কারণগুলোর কোনোটিই প্রমাণিত নয়। সবই অনুমান। প্রথম বলছি মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে বিস্ফোরণ সংক্রান্ত হাইপোথিসিস।
এই পর্যায়ে টিভি পদ অন্ধকার হয়ে গেল। পরীক্ষণেই সেখানে ভেসে উঠল। অরচ লীওনের মুখ।
ইরিনা। এই ইরিনা।
বলুন।
একা-একা খেতে ভালো লাগছে না, তুমি চলে এস।
বললাম তো আমার খিদে নেই।
খিদে না লাগলে খাবে না। বসবে আমার সামনে। কিছু জরুরি কথা তোমাকে বলব।
বলুন, আমি শুনছি।
সামনাসামনি বসে বলতে চাই। তুমি কোথায় যােচ্ছ, এই সম্পর্কে তোমাকে কিছু ধারণা দেব।
অনেক বার আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি, তখন তো কিছু বলেন নি।
এখন বলব। সব সময় সব কথা বলা যায় না। চলে এস। দেরি করো না।
টিভি পর্দায় আবার সেই আগের লোকটির মুখ ভেসে উঠল। সে একটি বোর্ডে কি-সব আকিছে এবং একঘেয়ে স্বরে বলছে- মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে পৃথিবীতে আসে ওজোন স্তর ভেদ করে। ওজোন স্তর হচ্ছে মূলত অক্সিজেনের একটি রূপান্তরিত অণুর হালকা আস্তর। এই অণুগুলোর প্রতিটিতে আছে তিনটি করে অক্সিজেন পরমাণু-।
লোকটির কথা খুব একঘেয়ে লাগছে। ইরিনা উঠে পড়ল। সে খাবার গাড়িতেই যাবে। করিডোরে এ্যাটেনডেন্ট রোবট বলল, ইরিনা, তুমি কোথায় যাবে?
ইরিনা মোটেই চমকাল না। এই রোবটের কাজই হচ্ছে, ট্রেনের সাৰ কজন যাত্রীর খোঁজখবর রাখা। ইরিনা বলল, খাবার গাড়িতে যাব।
আমি কি তোমার সঙ্গে যাব?
দরকার নেই।
তুমি মনে হচ্ছে ট্রেন ভ্ৰমণ ঠিক উপভোগ করছ না।
না, করছি না।
খুবই দুঃখিত হলাম। ট্রেন ভ্ৰমণেকে আনন্দদায়ক করার জন্য আমি কি কিছু করতে পারি?
না।
রোবটটি সঙ্গে সঙ্গে আসছে। ইরিনার অস্বস্তি লাগছে। একটা যন্ত্র যখন মানুষের মতো কথা বলে, মানুষের মতো ভাবে, তখন অস্বস্তি লাগে।
ইরিনা, তুমি কি প্রথম শহরের নাগরিক?
হ্যাঁ, আমি প্রথম শহরের।
তোমাকে অভিনন্দন। খুব অল্প বয়সেই তুমি দ্বিতীয় শহরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছি।
অভিনন্দনের জন্যে ধন্যবাদ। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছ কেন?
একটি কথা বলবার জন্যে আসছি। আমার মনে হয় কথাটা শুনলে তোমার ভালো লাগবে।
বল শুনছি।
তুমি অত্যন্ত রূপবতী।
ইরিনা শান্তস্বরে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
আমি তোমাকে নিয়ে চার লাইনের একটা কবিতা লিখেছি। আমি খুব খুশি হব, কবিতাটি তুমি যদি গ্ৰহণ কর।
বেশ তো, দাও।
রোবটটি একটি কার্ড বাড়িয়ে দিল ইরিনার দিকে। তারপর বেশ লাজুক ভঙ্গিতেই তার জায়গায় ফিরে গেল। ইরিনা কবিতায় চোখ বুলাল–
আদৌ প্রেমের প্রয়োজন আছে কিনা
নিশ্চিত আজো হয় নি। আমার মন।
প্রেম থেকে তবু পৃথক করিয়া ঘৃণা
ভালোবাসিতেই চেয়েছি সৰ্বক্ষণ।।
ইরিনা লক্ষ করল, তার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন খিদেও পাচ্ছে। হালকা ধরনের কোনো খাবার খাওয়া যেতে পারে।
ইরিনা নিঃশব্দে খাচ্ছে।
অরচ লীওন হাসিমুখে তা লক্ষ করছেন। তার হাতে এক মগ ঝাঁঝালো ধরনের পানীয়, অবসাদ দূর করতে যার তুলনা নেই।
ইরিনা।
বলুন।
এখানকার খাবারগুলো কেমন?
ভালো।
তোমাকে খানিকটা প্ৰফুল্ল লাগছে তার কারণ জানতে পারি কি?
কোনো কারণ নেই।
কারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না ইরিনা। আমার মনে হয় ঐ রোবটটার সঙ্গে তোমার প্রফুল্লতার একটা সম্পর্ক আছে। ওর দায়িত্ব হচ্ছে ট্রেনযাত্রীদের সবাইকে প্রফুল্ল রাখা। ও প্ৰাণপণে সেই চেষ্টা করে। ওর নানান কায়দা-কানুনের আছে। তোমার বেলা নিশ্চয়ই সব কায়দা-কানুনের কোনো একটা খাটিয়েছে। তোমার বেলা কী করেছে? গান গেয়েছে না কবিতা লিখে দিয়েছে?
ইরিনা তার জবাব না দিয়ে বলল, আমি কোথায় যাচ্ছি?
খাওয়া শেষ কর, তারপর বলব।
আমি এখনি শুনতে চাই।
তুমি যাচ্ছ নিষিদ্ধ নগরীতে।
ইরিনার গা দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হল, সে ভুল শুনছে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। অরচ লীওন বললেন, তুমি যােচ্ছ নিষিদ্ধ নারীতেতে। আমি তোমাকে তৃতীয় নগরী পর্যন্ত নিয়ে যাব। সেখান থেকে রোবটবাহী বিশেষ বিমানে করে তুমি নিষিদ্ধ নগরীতে যাবে। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারব না, কারণ নিষিদ্ধ নগরীতে যাবার অনুমতি আমার নেই। ইরিনা, তুমি কি বুঝতে পারছি, তুমি কত ভাগ্যবতী?
না, আমি বুঝতে পারছি না।
গত চার শ বছরে দশ থেকে বারো জন মানুষের এই সৌভাগ্য হয়েছে।
তারা কেউ ফিরে আসে নি। কাজেই আমরা জানি না, তা সৌভাগ্য না দুৰ্ভাগ্য।
এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে যারা আবার ঠিক করেছে, পৃথিবীর যাবতীয় শাসন-ব্যবস্থা যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের চোখের সামনে দেখবে। হয়তো তাদের সঙ্গে কথা বলবে। এটা কি একটা বিরল সৌভাগ্য নয়?
এত মানুষ থাকতে আমি কেন?
তা তো জানি না। তবে বিশেষ কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে। নিষিদ্ধ নগরীতে যাঁরা আছেন তাঁরা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে জানেন। তাঁরা নিশ্চয়ই তোমার ভেতর কিছু দেখেছেন।
আমার মধ্যে কিছুই নেই।
তুমি কি পানীয় কিছু খাবে?
না।
তোমাকে সাহস দেবার জন্যে আরেকটি খবর দিতে পারি।
দিতে পারলে দিন।
নিষিদ্ধ নগরীতে তুমি একা যােচ্ছ না, তোমার এক জন সঙ্গী আছে। এই প্রথম একসঙ্গে তোমরা দুজন যাচ্ছি। এবং সবচে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তোমার সেই সঙ্গী এই মুহুর্তে এই ট্রেনেই আছে। তুমি কি তার সঙ্গে আলাপ করতে চাও?
চাই।
সে আছে ছ নম্বর কামরায়। সে এক-একাই আছে। তুমি একাই যাও।
আপনি কি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন না?
না। নিজেই পরিচয় করে নাও।
ইরিনা উঠে দাঁড়াল। অরচ লীওন বললেন, আমি কি কোনো ধন্যবাদ পেতে পারি?
আপনাকে ধন্যবাদ অরচ লীওন।
আরেকটি খবর তোমাকে দিতে পারি। এই খবরে তুমি আরো খুশি হবে।
ইরিনা উঠে দাঁড়িয়েছিল। এই কথায় আবার বসল। অরচ লীওন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন তোমার বাবা-মা ভালো আছেন। তাদেরকে দ্বিতীয় শহরের নাগরিক করা হয়েছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি টেলিফোন করে খোজ নিতে পার। ট্রেন থেকেই তা করা যাবে।
ইরিনা তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে না। অরচ লীওন বললেন, তুমি কি খুশি?
হ্যাঁ, আমি খুশি। এই খবরটি আপনি আমাকে শুরুতে বললেন না কেন?
শুরুতে তোমাকে আমি ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি যাতে ভয়ে, দুঃখে, কষ্টে, তুমি অস্থির হয়ে যাও।
তাতে আপনার লাভ?
লাভ অবশ্যই আছে। বিনা লাভে আমি কিছু করি না। শুরুতে প্ৰচণ্ড ভয় পেলে শেষের আনন্দের খবরগুলো খুব ভালো লাগে। তোমার এখন তাই লাগছে। তুমি আমার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছ। এখন আমি যদি তোমাকে কোনো অনুরোধ করি, তুমি তা রাখবে।
কী অনুরোধ করবেন?
নিষিদ্ধ নগরীতে তুমি কী দেখলে, তা আমি জানতে চাই। কোনো-না- কোনো ব্যবস্থা করে তুমি আমাকে তা জানাবে।
কেন জানতে চান?
কৌতূহল। শুধুই কৌতূহল, আর কিছুই না। এস তোমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলা যাক।
টেলিফোনে খুব সহজেই যোগাযোগ করা গেল। ইরিনার বাবা কথা বললেন। তাঁর গলায় বিন্দুমাত্ৰ উদ্বেগ নেই। তিনি আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললেন, খুব বড় এটা খবর আছে মা, আমি এবং তোমার মা দুজনই দ্বিতীয় শহরের নাগরিক হয়েছে। কাগজপত্র পেয়ে গেছি।
খুবই আনন্দের কথা বাবা।
তোর মা তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। আনন্দে কাঁদছে।
সেটাই তো স্বাভাবিক।
আগামী কাল বাসায় একটা উৎসবের মতো হবে। পরিচিতরা সব আসবে। উৎসবের জন্যে পঞ্চাশ মুদ্রা পাওয়া গেছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। ঘর সাজাচ্ছি, আজ রাতে আর ঘুমাব না।
ইরিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার কথা তো কিছু জিজ্ঞেস করলে না? আমি কোথায় আছি, কী করছি।
এ তো আমরা জানি। জিজ্ঞেস করব কি?
কী জান?
বিশেষ কাজে তোকে নেয়া হচ্ছে। কাজ শেষ হলে তোকেও আমাদের সঙ্গে থাকতে দেবে।
ইরিনা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাবা রেখে দিই।
তোর মার সঙ্গে কথা বলবি না।
না। বেচারী আনন্দে কাঁদছে, কাঁদুক। ভালো থেক তোমরা। শুভ রাত্রি। ইরিনা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। বাবার ওপর সে কিছুতেই রাগ করতে পারছে না। প্ৰথম নাগরিক থেকে দ্বিতীয় নাগরিকের এই সৌভাগ্যে তার বোধ হয় মাথাই এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক।
নাগরিকত্বের তিনটি পর্যায় আছে। সবাইকেই এই তিনটি পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রথম শহরের নাগরিকত্ব। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ। মাঝখানে চল্লিশ মিনিটের ছুটি। সীমিত খাবারদাবার। ছুটির দিনে সপ্তাহের রেশন নিয়ে আসতে হয়। এক সপ্তাহ আর কোনো খাবার নেই। সপ্তাহের রেশন কৃপণের মতো খরচ করতে হয়। খাবারের কষ্টই সবচে বড় কষ্ট। তারপর আছে নিয়ম-কানুন মেনে চলার কষ্ট। একটু এদিকওদিক হবার উপায় নেই। কার্ডে লাল দাগ পড়ে যাবে। পনেরটি লাল দাগ পড়ে গেলে এ জীবনে আর দ্বিতীয় শহরে নাগরিক হওয়া যাবে না। সবাই প্ৰাণপণ চেষ্টা করে কার্ডটি পরিষ্কার রাখতে। সম্ভব হয় না। যেসব ভাগ্যবান ত্ৰিশ বছর বয়স পর্যন্ত তা পারেন, তারা দ্বিতীয় শহরের নাগরিক হিসেবে নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় শহরে প্রচুর খাবার-দাবার। ফেলে ছড়িয়ে খেয়েও শেষ করা যায় না। রেশনের ব্যবস্থা নেই। যার যা প্রয়োজন, বাজার থেকে কিনে আনবে। কাজ করতে হবে মাত্র ছয় ঘণ্টা। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়ি এখানে নেই। বড় রকমের অপরাধের শাস্তি জরিমানা। বছরে এক মাস দেয়া হয়। ভ্ৰমণ, পাস। সেই পাস নিয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়ান যায়। একটি টাকাও খরচ হয় না। আর উৎসব তো লেগেই আছে। দ্বিতীয় শহরের জীবনে ক্লান্তি বা অবসাদ বলে কিছু নেই। এই শহরের নাগরিকরা দুঃখ ব্যাপারটা কি জানেই না, এরা শুধু স্বপ্ন দেখে তৃতীয় শহরের। কুড়ি বছর দ্বিতীয় শহরে বাস করতে পারলেই তৃতীয় শহরে যাবার যোগ্যতা হয়। কিন্তু সবাই যেতে পারে না। ভাগ্যবানদের ঠিক করা হয় লটারির মাধ্যমে। লটারিটা হয় বছরের শেষ দিনে। প্ৰচণ্ড আনন্দ ও উত্তেজনার একটি দিন। এক দল নির্বাচিত হন তৃতীয় শহরের জন্যে, তাদের ঘিরে সারারাত আনন্দ-উল্লাস চলে।
যাঁরা নির্বাচিত হন না, তারাও খুব একটা মন খারাপ করেন না। পরের বছর আবার লটারি হবে। সেই আশায় বুক বাঁধেন।
তৃতীয় শহরের সুখ-সুবিধা কেমন, সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা দ্বিতীয় শহরের নাগরিকদেরও নেই। তাঁরা শুধু জানেন, তৃতীয় শহর হচ্ছে স্বৰ্গপুরী। চির অবসর ও চির আনন্দের স্থান। সবাই ভাবেন— মৃত্যুর আগে একবার যেন তৃতীয় শহরে ঢুকতে পারি।
ইরিনা ছয় নম্বর কামরার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিং বেল থাকা সত্ত্বেও সে দরজায় মৃদু টােকা দিল। ভেতর থেকে একজন কে শিশুর মতো গলায় বলল, কে?
আমি ইরিনা। আপনার সঙ্গে আমি একটু কথা বলতে চাই।
এখন তো কথা বলতে পারব না। আমি এখন ঘুমুব।
প্লীজ, একটু দরজা খুলুন। আমার খুব দরকার।
দরজা খুলে গেল। অসম্ভব রোগা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। লোকটি রুক্ষ গলায় বলল, তুমি কী চাও?
ইরিনা তার জবাব না দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। লোকটি অবাক হয়ে তাকে দেখছে।
ট্রেনের গতিবেগ ক্রমেই বাড়ছে। বাতাসে শিসের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন প্ৰচণ্ড গতি, যেন এই ট্রেন এক্ষুণি মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে যাবে। ইরিনা বলল, আমি কি বসতে পারি?