ট্রেনটা বাদামপাহাড় স্টেশনে পৌঁছোল ঠিক সন্ধের মুখে।
কাকাবাবুদের সঙ্গে সেই সাধুবাবাও নামলেন এখানে। এখনও চক্ষু বোজা। সেই অবস্থাতেও ট্রেন থেকে নামতে কোনও অসুবিধে হল না। দিব্যি হেঁটে চললেন গেটের দিকে।
বিনয়ভূষণ মহাপাত্র নামে একজন পুলিশ অফিসারের স্টেশনে অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু সেরকম কাউকে দেখা গেল না।
কাকাবাবু বললেন, হয়তো এসে পৌঁছোতে পারেনি। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে দেখা যাক।
প্ল্যাটফর্মে বেশি লোকজন নেই। একজন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সি মানুষ এঁদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাড়াল। কাকাবাবুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে সে বলল, আপনি রাজা রায়চৌধুরী, না?
কাকাবাবু মাথা নাড়লেন।
লোকটি বলল, আপনি এখানে এসেছেন, সাবধানে থাকবেন। আপনার বিপদ হতে পারে, সাবধানে থাকবেন।
তারপরই সে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল।
কাকাবাবু কয়েক মুহুর্ত ভুরু কুঁচকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সন্তু, ওই লোকটাকে ধরে দাড় করা তো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সন্তু আর জোজো দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল। দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটির দুপাশে।
ক্রাচ বগলে নিয়ে ওদের কাছে এলেন কাকাবাবু। ধুতি পরা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? আপনি হঠাৎ আমাকে ভয় দেখালেন কেন?
লোকটি বলল, ভয় দেখাইনি তো! আপনাকে শুধু একটু সাবধান করতে চাইলাম। আমি একজন সাধারণ মানুষ।
কাকাবাবু বললেন, গায়ে পড়ে সাবধান করতেই বা গেলেন কেন?
লোকটি বলল, বাঃ, মানুষ মানুষকে সাহায্য করে না?
কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক, আমার কী বিপদ হতে পারে, তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন?
লোকটি বলল, না, তা জানি না। তবে, আপনি তো বিখ্যাত লোক। আপনার যেমন অনেক ভক্ত আছে, তেমনই বেশ কিছু শত্রুও আছে। তাই আপনাকে এখানে দেখে মনে হল, যদি শত্রুরা আপনার আসবার কথা টের পায়… আমি চলি, আমাকে বাস ধরতে হবে।
সন্তু পকেট থেকে একটা ছোট ক্যামেরা বের করে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি?
লোকটি একটু দ্বিধা করে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, তোমাদের কাকাবাবুর সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলে দাও। ছবিটা আমি বাঁধিয়ে রাখব।
ক্যামেরা ফোকাস করতে করতে সন্তু বলল, কিন্তু ছবিটা আপনাকে দেব কী করে?
লোকটি বলল, সে আমি ঠিক জোগাড় করে নেব। আশাকরি তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে।
ছবি তোলা হয়ে গেলে সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে আর-একটা কথা বলে যাই। আপনি যে কাজের জন্য এখানে এসেছেন, তা সফল হবে না!
কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, যে কাজের জন্য এসেছি মানে? আমি তো কোনও কাজে আসিনি। এমনিই বেড়াতে এসেছি।
লোকটি এবারে শুধু হাসল। তারপর হাত জোড় করে বলল, আচ্ছা চলি, নমস্কার!
সে গেটের দিকে চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, আশ্চর্য! একজন সাধুবাবা বলল, পাঁচদিন পর আবার দেখা হবে। এই লোকটিও বলল, আবার দেখা হবে! এখানে থাকব মোটে তিনদিন, তারপর চলে যাব সম্বলপুর।
জোজো বলল, আমার মনে হয়, এই লোকটি জ্যোতিষী।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কী করে বুঝলি?
জোজো বলল, উনি সব কথা বলছিলেন কাকাবাবুর কপালের দিকে তাকিয়ে। কোনও কোনও জ্যোতিষী মানুষের কপাল দেখেই তার মনের কথা বলে দিতে পারে। আমার বাবা একবার দিল্লি এয়ারপোর্টে বসে ছিলেন, একসময় দেখতে পেলেন সদলবলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী। রাজীব গাঁধীর কপালের দিকে তাকিয়েই বাবা চমকে উঠলেন। অমনি চেঁচিয়ে ডাকলেন, রাজীব, রাজীব, এক মিনিট দাড়াও। ওইভাবে অবশ্য ডাকা উচিত হয়নি। অত লোকজনের মধ্যে, প্রধানমন্ত্রী তো। রাজীব সেই ডাক শুনতে পেয়ে ফিরে তাকালেন, তারপর কাছে এসে বাবাকে প্রণাম করলেন পায়ে হাত দিয়ে। ছেলেবেলায় ওঁর মায়ের হাত ধরে তো অনেকবার এসেছেন আমাদের বাড়িতে। আমার মায়ের হাতের রান্না চিড়ের পোলাও খেয়ে বলেছেন, আর-একটু দিন! বাবা ওঁকে সেদিন জিজ্ঞেস করলেন—
জোজোর গল্প শেষ হল না, পুলিশের পোশাক-পরা একজন লোক হাজির হলেন দৌড়োতে দৌড়োতে। তার সঙ্গে একজন সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা। তাদের মধ্যে একজন বললেন, মাপ করবেন স্যার, আমাদের পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেল। আসলে এই ট্রেনটা কোনওদিন ঠিক সময়ে আসে না। অন্তত দেড়-দুঘণ্টা লেট হয়, আজই এসে পড়েছে ঠিক সময়। আমাদের আবার দেরি হল, রাস্তায় হাতি এসে পড়ে অনেকটা সময় নষ্ট করে দিল।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে।
ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম বিনয়ভূষণ মহাপাত্র, আর এর নাম গুরুপদ রায়।
কাকাবাবু বললেন, এই যে আমার ভাইপো সন্তু আর ওর বন্ধু জোজো। চলুন এবার যাওয়া যাক!
বিনয়ভূষণ বললেন, আগে একটু চা-টা খেয়ে বিশ্রাম নেবেন, না এক্ষুনি রওনা হবেন?
কাকাবাবু বললেন, ট্রেনে এসেছি, পরিশ্রম তো হয়নি কিছু। বিশ্রাম নেওয়ার দরকার নেই। খিচিং পোঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?
বিনয়ভূষণ বললেন, জিপ এনেছি। ঘণ্টাদুয়েকের রাস্তা, তবে আবার যদি হাতি এসে পড়ে, তা হলেই মুশকিল।
সন্তু বলল, হাতি এসে পড়লে তো ভালই। বেশ হাতি দেখা যাবে! ছবি তুলতে পারব?
বিনয়ভূষণ বললেন, হাতির পাল এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে। খুব কাছে তো যাওয়া যাবে না। মেজাজ খারাপ থাকলে জিপগাড়ি উলটে দেয়।
জোজো বলল, হাতি তো এমনিতে খুব শান্ত প্রাণী। তাদের মেজাজ খারাপ হয় কেন?
কাকাবাবু বললেন, জঙ্গল থেকে হাতিরা যখন বেরিয়ে আসে, মাঝে মাঝে তারা খিদের চোটে কোনও ফসলের খেতে ঢুকে পড়ে। তাতে প্রচুর ফসলের ক্ষতি হয়। হাতিরা যত খায়, তার চেয়ে নষ্ট করে বেশি। সেইজন্য ফসল যারা চাষ করে, সেই চাষিরা খেপে যায়। হাতি তাড়াবার জন্য তারা বড় বড় জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে মারে। সেই মশালের আগুনে আহত হলে হাতিরাও খেপে ওঠে। তখন সামনে যা পায়, তাই ধ্বংস করে।
জোজো বলল, ইস, হাতিদের গায়ে মশাল ছুড়ে মারে? ভেরি ব্যাড। ওদের খিদে পেলে তো ওরা ফসল খাবেই!
সন্তু বলল, বা রে, চাষিরা কি হাতিদের খাওয়াবার জন্য ফসল ফলায়? ওই ফসল বিক্রি করে তাদের সারা বছর চলে। ফসল নষ্ট হয়ে গেলে তারাই বা খাবে কী?
জোজো বলল, একেই বলে হর্নস অফ আ ডায়লেমা। আচ্ছা কাকাবাবু, যদি আপনাকে বিচার করতে বলা হয়, হাতিরা যদি খিদের সময় ফসল খেয়ে ফেলে, তারা তো জানে না কার খেত কিংবা কারা চাষ করেছে, খিদে পেয়েছে তাই খেয়েছে। আর ওদিকে চাষিরা তাদের ফসল নষ্ট হচ্ছে দেখে রাগের চোটে জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে মারে। তা হলে কারা বেশি দোষী? হাতিরা, না চাষিরা?
কাকাবাবু বললেন, আসল অপরাধী হচ্ছে, যারা বেআইনিভাবে জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে গাছ বিক্রি করার লোভে। জঙ্গল কমে যাচ্ছে, জঙ্গলে খাবার কমে যাচ্ছে বলেই তো হাতিরা বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু সেই অপরাধীদের ধরা যায় না।
বিনয়ভূষণ বললেন, ঠিক বলেছেন স্যার! আগেকার তুলনায় এদিকে কত জঙ্গল কমে গেছে। জঙ্গল-কাটা ফাঁকা জমিতে শুরু হচ্ছে চাষ। হাতিরা তা বুঝবে কী করে? তাই তারা ফসলের খেতে ঢুকে পড়ে।
এর মধ্যে সবাই মিলে উঠে পড়েছে একটা জিপগাড়িতে।
থানার ড্রাইভার অসুস্থ বলে আসেনি, গাড়ি চালাচ্ছে গুরুপদ রায়। তার মুখোনা অস্বাভাবিক রকমের কালো, মনে হয় যেন কখনও আগুনের ঝাপটা লেগেছিল। সে এ পর্যন্ত একটাও কথা বলেনি।
বিনয়ভূষণের ফরসা গোলগাল মুখ, মাথার অর্ধেকটা টাক। মাঝে মাঝে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাচ্ছেন আর খালি হাতটাই বের করে আনছেন।
কাকাবাবু বসেছেন সামনে। ড্রাইভারের পাশের সিটে। পিছনে বাকি তিনজন। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো, অনবরত লাফাচ্ছে জিপ।
তবে আকাশটা এখন দেখার মতন। দিনের শেষে বিদায় নিচ্ছেন দিনমণি। পশ্চিমের আকাশ ঠিক লাল নয়, সোনার মতন ঝকঝকে। কিছু কিছু মেঘের খানিকটা লাল, খানিকটা কালো হয়ে এসেছে। এক-এক ঝাক পাখি উড়ে যাচ্ছে সেই লাল রং পেরিয়ে কালোর দিকে।
দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়। এক-এক জায়গায় পাহাড়ের চূড়া মিশে গেছে মেঘের সঙ্গে।
বিনয়ভূষণ আর-একবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললেন, রায়চৌধুরীবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু যদি মনে করেন। আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি? আপনি সিনিয়র অফিসার, আপনার অনুমতি না নিয়ে তো খাওয়া যায় না!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, খান। আমি এখন আর অফিসার নই, আসলে আমি সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করতে পারি না। একটার বেশি খাবেন না।
বিনয়ভূষণ বিগলিতভাবে বললেন, না, না, স্যার, একটার বেশি নয়। জানলার বাইরে ধোঁয়া ছাড়ছি।
সন্তু অন্যদিকের জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। দুদিকের গাছপালা অন্ধকারে ঝুপসি হয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে হয় যেন চুপ করে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে একপাল হাতি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখানে বাঘ আছে?
বিনয়ভূষণ বললেন, ঠিক এখানে নেই, তবে সিমলিপাল জঙ্গলে অনেক। বাঘ আছে। মাঝে মাঝে দু-একটা ছিটকে এদিকেও চলে আসে। গত মাসেও একজোড়া এসেছিল, কয়েকটা গোরু মেরেছে।
সন্তু বলল, সিমলিপাল জঙ্গলে এখান থেকে যাওয়া যায় না?
বিনয়ভূষণ বললেন, হ্যাঁ, যাবে না কেন? আমি নিয়ে যেতে পারি। জঙ্গলের মধ্যে ভারী সুন্দর সুন্দর সব জায়গা আছে। চাহালা, নওয়ালা, বহেরি পানি, জেরান্ডা, গুরগুরিয়া, জেনাবিল, যেখানে যেতে চাও।
সন্তু বলল, গুরগুরিয়া নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওখানেই যাব।
কাকাবাবু বললেন, আপনাদের এদিককার ফরেস্ট বাংলো যযাশিপুরে একসময় একটা পোষা বাঘ ছিল, খৈরি। তার কথা আপনার মনে আছে?
বিনয়ভূষণ বললেন, হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? বছর কুড়ি আগেকার কথা। তখন আমি সবে চাকরিতে ঢুকেছি। দু-একবার দেখেছি বাঘটাকে। সেটার শেষ পর্যন্ত কী হল জানেন তো! বাঘটা এমনিতে শান্তই ছিল। ফরেস্ট অফিসার সরোজবাবু সেটাকে অনেকটা পোষ মানিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু বাঘ বলে কথা, অতি পাজি প্রাণী। অতবড় হাতি পর্যন্ত পোষ মানে, সিংহও পোষ মানে, কিন্তু বাঘ কিছুতেই মানুষের কথা শুনে চলতে রাজি নয়। একদিন হল কী, কলকাতা থেকে দুজন বাঙালিবাবু এসেছিলেন ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে। সেইদিনই খৈরি বাঘটার মেজাজ বিগড়ে গেল! প্রথমে এক ভদ্রলোকের কনুই খেয়ে ফেলল আধখানা। অন্য ভদ্রলোক কী যেন বলতে গিয়েছিলেন, অমনি বাঘটা তার দিকে তেড়ে গিয়ে প্রথমে জামাটা ছিঁড়ে দিল ফালা ফালা করে, তারপর ভদ্রলোকের বুকের উপর দুই থাবা রেখে কামড়ে দিল নাকে। কোনওরকমে বাঘটার গলায় শিকল বেঁধে তারপরেই তাকে ছেড়ে দিয়ে আসা হল জঙ্গলে।
কাকাবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
সন্তু আর জোজোর ঠোঁটেও হাসির ঢেউ।
বিনয়ভূষণ একটু আহতভাবে বললেন, আপনি স্যার আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
কাকাবাবু হাসি থামিয়ে বললেন, না, না, বিশ্বাস করব না কেন? তবে, আমিই সেই বাঙালিবাবু। অনেকদিন কেটে গেছে তো, তাই গল্পটা অনেক রং চড়ানো হয়ে গেছে। খৈরি আমার বুকের উপর দুই থাবা রেখে দাঁড়িয়েছিল বটে, কিন্তু মোটেই আমার নাক কামড়ে দেয়নি। এই দেখুন, আমার নাক ঠিকই আছে। আমার জামাটাও ফালা ফালা করেনি, সে জামাটা এখনও রেখে দিয়েছি আমি। আর আমার বন্ধুর আধখানা কনুইও খেয়ে নেয়নি, শুধু একটা সঁাত ফুটিয়েছিল। আমার বন্ধু সেই হাতে এখনও টেনিস খেলে।
সন্তু বলল, তার পরেও তো বাঘটা ওখানে কিছুদিন ছিল।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমাদের জন্যই ওকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। আরও বোধহয় মাস ছয়েক ছিল। কিন্তু আর কয়েকজনকে আক্রমণ করার পর বোঝা গিয়েছিল, ওকে আর রাখা যাবে না।
বিনয়ভূষণ বললেন, বাঘটাঘ দূর থেকে দেখাই ভাল। সিমলিপালে ওয়াচ টাওয়ারের ভাল ব্যবস্থা আছে।
জোজো বলল, আমি বাঘ দেখতেও চাই না, হাতি দেখতেও চাই না। আমি এই কটা দিন শুধু খাব আর ঘুমোব। এই রাস্তায় কোনও কচুরিশিঙাড়ার দোকান নেই? ওড়িশার কচুরি বিখ্যাত।
বিনয়ভূষণ বললেন, একটা ছোটমতন শহর পড়বে মাইলকুড়ি দূরে। সেখানে দু-একটা দোকান আছে।
এখন দুপাশে মিশমিশে অন্ধকার।
শুধু হেডলাইটের আলোতে দেখা যায় সামনেটা। মনে হয় রাস্তার দুধারে ঘন জঙ্গল।
গুরুপদ এতসব কথার মধ্যে একটা মন্তব্যও করেনি। গাড়ি চালাচ্ছে বেশ জোরে।
সে বোবা কি না পরীক্ষা করার জন্য কাকাবাবু বললেন, আপনি বড্ড জোরে চালাচ্ছেন ভাই। যদি রাস্তার উপর হাতিটাতি দাঁড়িয়ে থাকে, ব্রেক কষতে অসুবিধে হবে না?
লোকটি কোনও উত্তর না দিয়ে গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিল।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি এ রাস্তাটা ভাল চেনা আছে?
সে এবার যেন দয়া করে উত্তর দিল, হুঁ।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কি এই জেলায়?
এবারও সে বলল, হুঁ।
কাকাবাবু তার সঙ্গে আলাপ করার আশা ছেড়ে দিলেন।
বাইরে হাত বাড়িয়ে বললেন, একটুও হাওয়া নেই। গুমোট হয়ে আছে। একটু পরেই বোধহয় বৃষ্টি হবে।
সন্তু ভাবল, এই রে, এইবার কাকাবাবু তার প্রিয় গানটা গাইতে শুরু করবেন। তিনি যেন আর অন্য গান জানেনই না। এ গানও তার নিজের সুর দেওয়া।
শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ
টকটক থাকে না কো হলে পরে বিষ্টি
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি!
কিন্তু সন্তুকে অবাক করে দিয়ে গানের বদলে কাকাবাবু বললেন, আঠারোশো আটান্ন সালের জুন মাস। সেদিনও বোধহয় এরকমই গরম ছিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেই দিনটায় কী হয়েছিল?
কাকাবাবু বললেন, কী জানি! এমনিই মনে পড়ল।
বিনয়ভূষণ বললেন, আপনাদের স্যার কী প্ল্যান? কদিন থাকবেন এখানে? আমাদের বলে দিয়েছেন, আপনি যে-কদিন থাকবেন, আপনার দেখাশুনো করার দায়িত্ব আমার। আপনারা যেখানে যেতে চাইবেন, আমি নিয়ে যাব।
কাকাবাবু বললেন, এই রে! তা হলে তো খুব বিপদ! আমাদের মোটেই দেখাশুনো করতে হবে না। কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেওর নাম শুনেছেন তো? তিনি আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন, দিনতিনেক থাকব। সন্তুরা যদি কোথাও বেড়াতে যেতে চায়, ওঁর বাড়ির গাড়িই নিয়ে যাবে।
বিনয়ভূষণ বললেন, কিরণচন্দ্র ভঞ্জদেও তো খুব অসুস্থ।
কাকাবাবু বললেন, তা জানি। সেইজন্যই আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। আমার সঙ্গে অনেকদিনের চেনা। শুনুন বিনয়বাবু, আমি যে এখানে এসেছি, তা খুব বেশি লোককে জানাতে চাই না। পুলিশের গাড়িতে ঘুরলে তো সবারই কৌতূহল হবে। সুতরাং আমাদের পৌঁছে দেওয়ার পরই আপনার ছুটি। কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে আমি অনেক বারণ করেছিলাম, তবু সে জোর করে আপনাদের খবর পাঠিয়েছে।
বিনয়ভূষণ বললেন, স্যার, আপনি এ-রাজ্যের অতিথি। আপনার যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তা আমাদের দেখতে হবে অবশ্যই!
কাকাবাবু বললেন, ভঞ্জদেওদের বাড়িতে অতিথি হচ্ছি, ওঁরাই দেখাশুনো করবেন।
সন্তু বলল, যাঃ, হাতিটাতি তো কিছুই দেখা গেল না। শুধু মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর।
জোজো বলল, আমি মোটেই হাতি দেখতে চাই না। আমার খিদে পেয়ে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, জোজোকুমারের কাছ থেকে আর কোনও গল্প শুনতে পাচ্ছি না।
সন্তু বলল, খিদে পেলে জোজোর গল্প বন্ধ হয়ে যায়।
গাড়ির চালক আবার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে গর্তে পড়ে লাফিয়ে উঠেছে জিপটা।
কাকাবাবু একটু বিরক্তভাবে বললেন, আমাদের গুরুপদবাবুর মনে হচ্ছে। বাড়ি ফেরার খুব তাড়া আছে। খারাপ রাস্তায় জোরে গাড়ি চালানো আমি মোটেই পছন্দ করি না।
পিছন থেকে বিনয়ভূষণ বললেন, ওহে গুরুপদ, স্যার বলছেন আস্তে চালাতে, তবু তুমি জোরে চালাচ্ছ কেন?
গুরুপদ সঙ্গে সঙ্গে খুব জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিয়ে পিছনে। হেলান দিল।
বিনয়ভূষণ বললেন, এ কী, থামালে কেন? থামাতে তো বলিনি, একটু আস্তে চালাতে বলেছি।
গুরুপদ নাক দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কথা বলেন না কেন? বিনয়ভূষণ বললেন, ও এইরকমই। একবার একটা খুব বড় অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিল, তারপর থেকেই! মুশকিল হয়েছে কী, লাস্ট মোমেন্টে আমাদের থানার ড্রাইভার জানাল যে, আসতে পারবে না, তার খুব পেট খারাপ হয়েছে। বাইশ বার নাকি বাথরুম গেছে সারাদিনে। আমি নিজে গাড়ি চালাতে জানি না, তাই ওকে আনতে হল। নইলে আমার সঙ্গে অন্য একজন সাবইনস্পেক্টরের আসার কথা ছিল।
কাকাবাবু বললেন, আমরা কি এখানে থেমেই থাকব?
বিনয়ভূষণ বললেন, না, না, এসব জায়গা মোটেই ভাল না। ও ভাই গুরুপদ, প্লিজ চলো, তোমাকে আমরা খারাপ কথা তো কিছু বলিনি, শুধু একটু আস্তে চালাবার অনুরোধ করেছি। চলো, চলো।
গুরুপদ আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল। একটু পরেই স্পিড বাড়াতে লাগল। আবার আগের মতন।
এক-একজন বোধহয় আস্তে গাড়ি চালাতে জানেই না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ যাওয়ার পর হঠাৎ গুরুপদ হেডলাইট অফ করে দিল। গাড়ি ছুটল সম্পূর্ণ অন্ধকারের মধ্যে। আকাশেও কোনও আলো নেই।
বিনয়ভূষণ বললেন, এ কী, এ কী করলে? হেডলাইট খারাপ হয়ে গেল?
কোনও উত্তর নেই।
কাকাবাবু আদেশের সুরে বললেন, আপনি গাড়ি থামান! আপনার আর চালাবার দরকার নেই।
লোকটি তবু কোনও কথা বলল না, গাড়িও থামাল না।
একটু পরেই গাড়িটা প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল কিছুর সঙ্গে। কাকাবাবু ছিটকে পড়ে গেলেন বাইরে।
পিছনের সিটের তিনজন একবার লাফিয়ে উঠে আবার পড়ল ধপাস করে।
জোজো চেঁচিয়ে উঠল, উঃ, উঃ, আমার হাত ভেঙে গেছে। আমার মাথা ফেটে গেছে!
জিপটা কিন্তু উলটে যায়নি। সেটা ধাক্কা মেরেছে একটা মোটা গাছে।
সন্তু কাকাবাবুকে বাইরে পড়ে যেতে দেখেছে। তাই একটু ধাতস্থ হয়েই সে লাফিয়ে বাইরে নেমে কাকাবাবুকে খুঁজতে গেল। চেঁচিয়ে ডাকল, কাকাবাবু!
কাকাবাবু কয়েক মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর মধ্যেই আবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসেছেন। সন্তুর ডাক শুনে বললেন, এই যে, এখানে আমি!
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবু আন্দাজে সন্তু কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, তোমার কোথায় লেগেছে?
কাকাবাবু বললেন, দাড়া, এক-এক করে মিলিয়ে নিই।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, চটচট করছে না, রক্তক্ত বেরোয়নি, তার মানে মাথা ফাটেনি। চোখ দুটো ঠিক আছে, নাক ঠিক আছে, দাঁত, একটা দাঁত নড়ে গেছে মনে হচ্ছে। হাত দুটোও তো ঠিক আছে দেখছি। শুধু বা হাতের বুড়ো আঙুলে ব্যথা। ও কিছু না, সামান্য।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, পা?
কাকাবাবু বললেন, আমাকে একটু ধর, উঠে দাড়াই, তারপর বুঝব?
দাঁড়িয়ে দুটো পা একবার করে মাটিতে ঠুকে বললেন, ঠিকই তো আছে মনে হচ্ছে। ডান পা-টা ভাঙলেই হয়েছিল আর কী! সারা জীবনের মতন পঙ্গু!
ততক্ষণে অন্যরাও এসে পড়েছে সেখানে। জোজো প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনার কী হয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, কিছু হয়নি, খুব জোর বেঁচে গেছি!
জোজো বলল, আমার মাথা ফেটে গেছে আর হাত ভেঙে গেছে। সন্তু জোজোর চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দেখে নিয়ে বলল, রক্ত নেই। তুই ধাক্কা খেয়েছিস। মাথা ফাটেনি। কোন হাত ভেঙেছে বললি?
জোজো বাঁ হাতটা এগিয়ে দিতে সন্তু সে হাতটা ধরে একটা টান মারল। জোজো চেঁচিয়ে উঠল, উ উ উ, লাগছে,লাগছে, খুব লাগছে!
কাকাবাবু বললেন, কবজিটা মচকে যেতে পারে। যাই হোক, এক্স-রে করে দেখতে হবে।
বিনয়ভূষণ আর সন্তুরও তেমন কিছু আঘাত লাগেনি। তবে সন্তুর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, সেকথা সে কাউকে বলল না।
কাকাবাবু বললেন, ড্রাইভারের কী অবস্থা? তারই বেশি চোট লাগার কথা। তার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্যাখো তো গাড়ির মধ্যে।
বিনয়ভূষণ আর সন্তু অন্ধকারের মধ্যে হাত দিয়ে দেখল, ড্রাইভারের সিটটা খালি।
কাকাবাবু বললেন, হয়তো আমারই মতন ছিটকে বাইরে পড়ে গেছে। সন্তু, আমার হ্যান্ডব্যাগ থেকে টর্চটা বের কর।
টর্চ জ্বেলে দেখা গেল, ওপাশেও ড্রাইভার নেই।
বিনয়ভূষণ অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, গুরুপদ, গুরুপদ!
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। টর্চের আলোয় আশপাশের অনেকটা জায়গা খুঁজেও কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না গুরুপদর।
চিন্তিতভাবে বিনয়ভূষণ বললেন, সে তো আর বেশি দূরে পড়ে যেতে পারে না। গেল কোথায়?
জোজো বলল, এখন কী হবে? আমরা কী করে যাব? বিনয়ভূষণ বললেন, মহাবিপদে পড়া গেল! এখানে বেশিক্ষণ থাকা মোটেই উচিত নয়।
কাকাবাবু বললেন, এ-রাস্তায় আর কোনও গাড়িও তো চলছে না। বিনয়ভূষণ বললেন, সন্ধের পর এসব দিকে গাড়ি চলে না। শুধু দু- একটা ট্রাক যায়। কিন্তু হাতি আসার কথা রটে গেলে তারাও কোথাও থেমে যায়।
জোজো বলল, ওই তো একটা গাড়ি আসছে!
সত্যি দেখা গেল, এতক্ষণ বাদে উলটো দিক থেকে একটি গাড়ি আসছে। তীব্র হেডলাইট জ্বেলে।
বিনয়ভূষণ বললেন, এটা যদি পুলিশের গাড়ি হয়, বেঁচে যাব। অন্য গাড়ি হলে বিশেষ লাভ নেই।
সন্তু আর জোজো রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বলতে লাগল, স্টপ, স্টপ। হেল্প, হেল্প!
সে-গাড়ির চালক কাছে এসে জোরে জোরে হর্ন বাজাতে লাগল। সেটা একটা স্টেশন ওয়াগন। ভিতরে কতজন যাত্রী তা বোঝা গেল না।
হর্ন বাজাতে বাজাতে গাড়িটা একেবারে কাছে এসে গেল, বোঝাই গেল সেটা থামবে না।
সন্তু আর জোজো দৌড়ে সরে গেল পাশের দিকে। বিনয়ভূষণ বললেন, জানতাম, গাড়িটা থামবে না। এই অঞ্চলে ডাকাতির ভয় আছে।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু-জোজোর বয়সি ছেলেরাও ডাকাত হয়?
কী জানি, আজকাল হতেও পারে। যাই হোক, হাতির সঙ্গে যোগ হল ডাকাত।
সাপটাপ?
বিনয়ভূষণ বললেন, হ্যাঁ স্যার, অনেক সাপ আছে।
জোজো বলল, ওরে বাবা! সাপ! আমি গাড়িতে উঠে বসছি।
বিনয়ভূষণ বললেন, গুরুপদকে না পাওয়া গেলে গাড়িটা চালাবে কে?
তিনি আরও কয়েকবার গুরুপদর নাম ধরে ডাকলেন, টর্চের আলোও ঘুরিয়ে দেখলেন চতুর্দিকে।
কাকাবাবু বললেন, আগে দেখা যাক, গাড়িটা ঠিক আছে কি না।
বিনয়ভূষণ বললেন, কিন্তু চালাবে কে? আমি তো পারি না।
কাকাবাবু বললেন, সে না হয় আমিই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আমি খোড়া মানুষ হলেও গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয় না। তিনি ড্রাইভারের সিটে উঠে বসে চাবি ঘোরালেন।
প্রথম কয়েকবার বিদঘুটে শব্দ হল। যেন গাড়িটাও বলতে চাইছে, আমার মাথা ফেটে গেছে। হাত ভেঙে গেছে!
আসলে তেমন কিছু হয়নি। হঠাৎ ইঞ্জিন গরগর করে উঠল। কাকাবাবু ব্যাক করে গাড়িটাকে রাস্তায় তুলে আনলেন।
তারপর বললেন, সবাই উঠে পড়ো। বিনয়ভূষণ বসলেন সামনে, বাকি দুজন পিছনে।
কাকাবাবু বললেন, কী করব, এখন যাব? গুরুপদকে ফেলে রেখে? যদি কোথাও সে অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে?
বিনয়ভূষণ বললেন, আর কোথায় থাকবে বলুন! অনেকখানি জায়গা তো খুঁজে দেখা হল। সেরকম ঝোপঝাড়ও নেই, শুধু বড় বড় গাছ।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর কাকাবাবু হেডলাইট জ্বালালেন। ঠিকই জ্বলে উঠল। শুধু একদিকের কাচ ভেঙে গেছে।
বিনয়ভূষণ বললেন, একী, হেডলাইট তো ঠিকই আছে। তখন নিভে গেল কী করে?
কাকাবাবু বললেন, নিভিয়ে দিলেই নিভে যায়।
জোজো বলল, কাকাবাবু, একটা কথা বলব? আমার মনে হয়, গাড়ির ড্রাইভার ইচ্ছে করে অ্যাকসিডেন্টের একটু আগে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে। তারপর দূরে সরে গেছে। তাই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
কাকাবাবু বললেন, জোজো, তোমার অনুমানটাই বোধহয় ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সে এরকম করল?
খিচিং পোঁছোতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল।
ভঞ্জদেওদের বাড়িটি এককালে এক মস্ত বড় প্রাসাদ ছিল, এখন একেবারে ভগ্নদশা। অনেকখানি অংশ ব্যবহারই হয় না, ছাদ ভেঙে পড়েছে, গাছপালা গজিয়ে গেছে। শুধু সামনের দিকের কিছু অংশ সারিয়ে নতুন রং করা হয়েছে। বোঝা যায়।
গাড়িটা এ-বাড়ির সামনেই রইল। বিনয়ভূষণ হেঁটেই চলে গেলেন থানায়।
গেটের গাছে রয়েছে এক দরোয়ান, সে একেবারে বুড়ো থুথুড়ে, মাথায় আবার একটা ঢাউস পাগড়ি, হাতে একটা বর্শা। তার গোঁফ, দাড়ি এমনকী ভুরু পর্যন্ত তুলোর মতন সাদা।
সে কাকাবাবুদের নিয়ে গেল ভিতরের চাতালে।
সেখানে দুটি চেয়ারে বসে আছে একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে আর একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে। ছেলেটি ধুতি আর হাফ-হাতা সাদা গেঞ্জি পরা, আর মেয়েটি পরে আছে একটা চওড়া লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। সেটা অনেকটা আলুথালু, ঠিক মতন এখনও শাড়ি পরতে শেখেনি বোঝা যায়।
ছেলেটি কাকাবাবুকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন!
তারা দুজনেই কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
কাকাবাবু সন্তুদের বললেন, এ হচ্ছে প্রবীর, এখানকার ছোট রাজকুমার। আর এ তোমার বোন?
প্ৰবীর বলল, হ্যাঁ, আমার বোন কমলিকা। কাকাবাবু, আমাকে রাজকুমার বলে লজ্জা দেবেন না। রাজত্ব বা জমিদারি কিছুই নেই, দেখছেন তো বাড়ির অবস্থা! আমরা সাধারণ মানুষ।
কমলিকা বলল, আমাকে কেউ রাজকুমারী বললে শুনতে ভালই লাগবে। কিন্তু কেউ বলে না। দরোয়ানজি বলে খোকি, আর রান্নার মাসি বলে ছুটকি!
কাকাবাবু, সন্তু আর জোজোর সঙ্গে পরিচয় করাতে যেতেই কমলিকা বলল, দাড়ান, দাঁড়ান, দেখি আমি চিনতে পারি কি না। ওদের সব গল্পই
তো আমি পড়েছি!
তারপর সে সন্তুর গা ছুঁয়ে বলল, এই হচ্ছে সন্তু, আর ও জোজো।
জোজো বলে উঠল, হল না, হল না! আমি সন্তু আর ও জোজো!
কমলিকা বলল, এ জোজো? মুখ দেখে তো মনে হয় না, এ বানিয়ে বানিয়ে এত গল্প বলতে পারে!
সন্তু গম্ভীরভাবে বলল, আমি মোটেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলি না। সব সত্যি ঘটনা। সব ফ্যাক্ট! আমার বাবা একবার ইংল্যান্ডের রানিকে বলেছিলেন, আপনি নিমডাল দিয়ে দাঁত মাজবেন। তাতে আপনার হাসিটা মিষ্টি দেখাবে। রানি এলিজাবেথ তার আত্মজীবনীতেও একথা লিখেছেন।
কাকাবাবু মিটিমিটি হাসছেন। এবার বললেন, চলো, আগে হাতমুখ ধুয়ে নেওয়া যাক। সারা গায়ে প্রচণ্ড ধুলো।
প্রবীর বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উপরে চলুন। বাবা আপনাদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। আপনাদের অনেক দেরি হল। উনি ওষুধ খেয়ে নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। কাল কথা বলবেন।
কাকাবাবু বললেন, এখন আর ওঁকে ডিসটার্ব করতে হবে না। আমাদের পৌঁছোতে খুবই দেরি হয়ে গেল।
প্ৰবীর বলল, আমাদের এক কাকা শুধু থাকেন এ বাড়িতে। তার নাম রুদ্রশেখর। তিনিও আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চান। কাল উনি বাংরিপোসি গেছেন। দু-একদিনের মধ্যেই ফিরবেন।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। আমরা তো দিনতিনেক থাকছি!
প্রবীর জিজ্ঞেস করল, রাস্তা খারাপ ছিল?
কাকাবাবু বললেন, রাস্তা তো খারাপ ছিলই, তার চেয়েও বড় কথা, এক ড্রাইভারের পেট খারাপ, আর-এক ড্রাইভার অদৃশ্য।
প্রবীর ভুরু তুলে বলল, অদৃশ্য? তার মানে?
কাকাবাবু বললেন, এই সত্য ঘটনাটি জোজো পরে বলবে। এখন একটু চা খাওয়া দরকার।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখা গেল, একটা চওড়া বারান্দার একদিকের ভাঙা অংশ বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে। একটা কম পাওয়ারের বা জ্বলছে টিমটিম করে।
সন্তু জোজোকে বলল, এই সন্তু, দেখিস, যেন ভুল করে বারান্দার ওদিকটায় চলে যাস না। ধপাস করে নীচে পড়ে যাবি।
জোজো বলল, তুই-ই তো ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়াস, জোজো!
প্ৰবীর বলল, ওখানে একটা দড়ি বাঁধা আছে।
একটা ঘরের দরজা খুলে সে বলল, এই আপনাদের ঘর। আপনাদের একটু অসুবিধে হবে। বাথরুমটা একতলায়। আগেকার দিনে তো ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম থাকত না। দোতলায় যে একটা মাত্র বাথরুম ছিল, সেটা ভেঙে পড়ে গেছে!
কাকাবাবু বললেন, সে ঠিক আছে। ঘরটা তো দেখছি প্রকাণ্ড!
প্রবীর বলল, আপনারা বসুন, আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি।
ঘরটি সত্যিই প্রকাণ্ড। মাঝখানে একটি পুরনো আমলের খাট পাতা, যাকে বলে পালঙ্ক। তাতে অন্তত পাঁচজন মানুষ শুতে পারে। একপাশে রয়েছে একটা ড্রেসিং টেবিল। তার আয়নাটা অবশ্য ফাটা। আর একদিকে
কয়েকটা বেতের চেয়ার। একটা আলমারি ভরতি বাঁধাই করা মোটা মোটা বই।
এত বড় ঘরে একটি মাত্র জানলা।
জোজো বলল, কাকাবাবু, এরা এত ভাল বাংলা শিখল কী করে।
কাকাবাবু বললেন, ওরা তো কলকাতায় থাকে। প্রবীর পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে। ওর বোনও পড়ে কোনও ইসকুলে। এখানে কেউ থাকে না। সেইজন্যই তো বাড়িটার এই অবস্থা। এই খিচিং ছিল একসময় ময়ূরভঞ্জ রাজাদের রাজধানী। এখন কেওনঝড় এদিককার বড় শহর। প্রবীরের বাবা রাজা ছিলেন না, তবে রাজবংশেরই লোক। ওঁকে কেউ রাজাবাবু বা মহারাজ বললে উনি খুব চটে যান।
জোজো বলল, ভাঙা বাড়ি হলে কী হয়, একখানা যা দরোয়ান রয়েছে, দশজন ডাকাত এলেও সামলে দেবে!
কাকাবাবু হেসে ফেললেন।
সন্তু বলল, কাল সকালে ওর একটা ছবি তুলতে হবে! সান্টা ক্লজ সাজলে ওকে দারুণ মানাবে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুমি আর সন্তু যে উলটো নামের খেলা শুরু করলে, সেটা কি আগে ভেবে রেখেছিলে?
জোজো বলল, না। হঠাৎ মনে হল!
তিনি সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এলিজাবেথের গল্পটা সঙ্গে সঙ্গে বানিয়ে ফেললি!
সন্তু বলল, হ্যাঁ। তবে ওটা গল্প নয়, সত্যি ঘটনা, ফ্যাক্ট!
কাকাবাবু বললেন, তা হলে তোরও তো দেখছি উদ্ভাবনী শক্তি কম নয়। দেখি, তোরা কতক্ষণ এই খেলা চালাতে পারিস! জোজো তো একটা কুকুর দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে! সন্তু আবার কুকুর ভালবাসে।
জোজো বলল, আমি কুকুর দেখলে ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু সিংহ কিংবা গোরিলা দেখলে ভয় পাই না।
কাকাবাবু বললেন, দুঃখের বিষয়, ও দুটোর কোনওটাই এখানে নেই।
তাই পরীক্ষা করে দেখা যাবে না।
একটু বাদে বারান্দায় একটা ঘরর ঘরর শব্দ হল।
সন্তু দরজার কাছে এসে উঁকি মেরে দেখল, একটা ট্রলি ঠেলে ঠেলে আনছে কমলিকা।
তার উপর চায়ের পট, তিনটি কাপ, এক প্লেট সন্দেশ, এক প্লেট বিস্কুট আর এক প্লেট চানাচুর সাজানো।
ট্রলিটা নিয়ে ঘরে ঢোকার পর সে সন্তুকে বলল, ইয়ে, আমি কিন্তু দাদাটাদা বলতে পারব না, তোমাদের নাম ধরে ডাকতে পারি তো?
সন্তু বলল, পারো। কিন্তু আমার নাম ইয়ে নয়। কী বলো তো?
কমলিকা বলল, তুমি তো জোজো। আর ও সন্তু।
কাকাবাবু বললেন, আমি তোমাকে রাজকুমারী বলেই ডাকব। তুমি এসব নিজে নিয়ে এলে? আর কেউ নেই?
কমলিকা বলল, রান্নার মাসি আছে। আর-একজন কাজের লোক জগোদাদা। কিন্তু আমাদের বাড়ির নিয়ম, বাড়িতে অতিথি এলে কাজের লোকের বদলে বাড়ির মেয়েদের নিজের হাতে খাবার দিতে হয়।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ ভাল নিয়ম তো। তোমাকে কলকাতার বাড়িতে কখনও শাড়ি পরতে দেখিনি।
কমলিকা বলল, সেটাও এ-বাড়ির নিয়ম। এখানে সবসময় ছেলেদের শাড়ি আর মেয়েদের ধুতি পরে থাকতে হয়!
সন্তু আর জোজো হো হো করে হেসে উঠল।
কমলিকা লজ্জা না পেয়ে বলল, ভুল বলেছি, না? ছেলেরা ধুতি আর মেয়েরা শাড়ি। মেয়েরাও ধুতি পরে। যখন খুব বুড়ি হয় কিংবা উইডো হয়। উইডোর বাংলা কী?
সে সন্তুর দিকে তাকাতেই সন্তু জোজোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, সন্তু বাংলা ভাল জানে!
জোজো বলল, উইডো হচ্ছে বিধবা। দ্য লেডি হু হ্যাজ লস্ট হার হাজব্যান্ড! পুরুষরা কিন্তু কখনও শাড়ি পরে না।
কমলিকা কাকাবাবুর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বলল, সন্দেশ খান। আর এই যেগুলো বিস্কুট মনে হচ্ছে, এগুলো আসলে নিমকি। এরকম গোল গোল নিমকি কলকাতায় পাওয়া যায় না।
কাকাবাবু বললেন, শুধু চা চেয়েছি, তুমি এত খাবার নিয়ে এলে? রাত্তিরে আর কিছু খেতে দেবে না বুঝি?
কমলিকা বলল, সে অনেক দেরি হবে। এই তো পোলাও রান্না শুরু হল।
কাকাবাবু জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, খাও, খিদে পেয়েছে। বলছিলে!
জোজো বলল, আমার মোটেই যখন-তখন খিদে পায় না। ওই জোজো বলেছিল।
কমলিকা ওদের দুজনের কাছে মিষ্টির প্লেট নিয়ে গিয়ে বলল, খাও। কাল তোমাদের কিচকেশ্বরীর মন্দিরে নিয়ে যাব। আজ মন্দিরে কী হয়েছে। জানো? বলো তো কী হয়েছে?
জোজো বলল, নরবলি দেওয়া হয়েছে।
সন্তু বলল, মূর্তির চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়েছে!
কমলিকা বলল, হল না। পাশের পুকুরটা বুজে গিয়েছিল, তাই ডিগ করা হচ্ছিল কদিন ধরে। ডিগের বাংলা কী?
জোজো বলল, খোঁড়াখুঁড়ি। অত তোমাকে সব কথার বাংলা জানতে হবে না। আমরা বুঝতে পারলেই হল। তারপর?
কমলিকা বলল, আজ মাটির তলা থেকে একটা মানুষের মাথার খুলি আর সাতটা লোহার সিন্দুক পাওয়া গেছে।
কাকাবাবু বললেন, সাতটা লোহার সিন্দুক?
কমলিকা বলল, না, না, একটা লোহার সিন্দুক আর সাতটা মাথার খুলি। সেই সিন্দুকটা খোলা যায়নি। ভিতরে কী আছে, কেউ জানে না।
জোজো বলল, গুপ্তধন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সিন্দুকটা কোথায়?
কমলিকা বলল, এ-বাড়িতেই রাখা হয়েছে। কাল বাবার সামনে সেটা হাতুড়ি মেরে ভাঙা হবে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আর সাতটা মাথার খুলি? সেগুলো কোথায় রাখা হয়েছে? এ-বাড়িতেই?
কমলিকা বলল, ভ্যাট! বাড়িতে কেউ ওসব রাখে? তা হলে তোমরা ভূতের ভয় পেতে না? সেগুলো আছে মন্দিরে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝি ভূতের ভয় পাও না?
কমলিকা ঠোঁট উলটে বলল, আমি কোনও কিছুতেই ভয় পাই না। শুধু…
জোজো বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, বলছি। মাকড়সা? তাই না?
কমলিকা মাথা নেড়ে বলল, টিকটিকি!
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি নীচের বাথরুমে যাব, হাত-মুখ ধুতে হবে। সিন্দুকটাও একবার দেখব, সেটা কোথায় রাখা আছে?
সবাই নেমে এল একতলায়। প্রবীরও যোগ দিল ওদের সঙ্গে।
নীচে অনেক ছোট ছোট ঘর। আগেকার দিনে কর্মচারী আর পাহারাদাররা থাকত। এখন সবই খালি, দেওয়ালগুলোর প্লাস্টার খসে গিয়ে হাড়গোড়
বেরিয়ে পড়েছে। দরজাও ভাঙা।
একটা ঘরে সিন্দুকটা রাখা আছে, সে ঘরে আলো নেই।
কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলেন। সিন্দুকটা বেশ বড় আর চৌকো ধরনের। গায়ে শ্যাওলা ধরে গেছে। কিন্তু কোথাও ফুটোটুটো হয়নি। সামনের দিকে ঝুলছে দুটো পেল্লায় আকারের পেতলের তালা।
সিন্দুকের চারটে পায়ার একটা ভাঙা, তাই একদিকে হেলে আছে। অন্য পায়াগুলো বাঘ কিংবা সিংহের পায়ের মতন।
কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, ভাল করে টর্চটা ধর তো? তিনি একটা রুমাল বের করে উপর দিকটায় ঘষে ঘষে শ্যাওলা পরিষ্কার করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে সেখানে একটা ছবি ফুটে উঠল। অস্পষ্ট হলেও চেনা যায়, গণেশের ছবি। তার তলায় কিছু লেখা আছে।
কাকাবাবু বললেন, মনে হচ্ছে সংস্কৃত লেখা। কাল সকালে ভাল করে দেখতে হবে।
প্রবীর বলল, এটা পাওয়া গেছে পাঁচদিন আগে।
কাকাবাবু বললেন, পাঁচদিন! কমলিকা যে বলল, আজই!
প্ৰবীর বলল, আজ তোলা হয়েছে। দেখা গিয়েছিল পাঁচদিন আগে। মাটির মধ্যে এমনভাবে গেঁথে ছিল যে, তোলাই যাচ্ছিল না। একবার তো খানিকটা তোলার পর ধপাস করে পড়ে গিয়ে আবার গেঁথে গেল অনেকটা। আজ দশ-বারোজন লোক তুলেছে অতি কষ্টে।
কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, পাঁচদিন আগে? তার মানে, অনেক লোক এটার কথা জেনে গেছে।
প্ৰবীর বলল, হ্যাঁ, আশপাশের গ্রামের লোক ছুটে এসেছে দেখার জন্য। আজও প্রচণ্ড ভিড় হয়েছিল। এইসব সিন্দুকটিক দেখলেই লোকে ভাবে, ভিতরে অনেক হিরে-জহরত, চুনি-পান্না আছে।
কাকাবাবু বললেন, তা তো ভাবতেই পারে।
কমলিকা বলল, যদি পান্না থাকে, তা হলে আমি একটা নেব। আমি কখনও পান্না দেখিনি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, পান্না কী রঙের হয় জানো?
কমলিকা বলল, বোধহয় নীল, তাই না?
সন্তু বলল, সবুজ। আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
কাকাবাবু বললেন, হিরে-জহরতের বাক্স অনেক ছোট হয়। এত বড় সিন্দুক ভরাতে গেলে তো সাত রাজার ধন লাগবে! আমার মনে হয়, এইসব সিন্দুকে দলিলটলিল, জমিদারির কাগজপত্র রাখা হত।
জোজো বলল, হয়তো সিন্দুকে কাগজপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হত গয়নার বাক্স।
প্ৰবীর বলল, কাল খুললেই দেখা যাবে। এর মধ্যে যদি দামি জিনিস কিছু থাকে, তা কিছুই আমরা পাব না, বাবা বলে দিয়েছেন। বাবাকে তো জানেন, কোনও জিনিসের প্রতি লোভ নেই। বাবা আগেই বলে রেখেছেন, দামি কিছু পাওয়া গেলে থানায় জমা দিতে হবে। সব গুপ্তধনই গভর্নমেন্টের প্রপার্টি।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে সিন্দুকটাই থানায় জমা রাখা উচিত ছিল।
প্ৰবীর বলল, আমরা তো কিছু বলিনি, মন্দিরের পুরুতরাই এটা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। আসলে কী জানেন, বেশিরভাগ মানুষই পুলিশদের বিশ্বাস করে না। পুলিশের মধ্যে তো অনেক চোর থাকে। এখানকার সবাই জানে, বাবা হান্ড্রেড পারসেন্ট সৎ মানুষ।
কাকাবাবু বললেন, তা আমিও জানি। এই একতলায় রাত্তিরে কে থাকে?
প্রবীর বলল, এ আমাদের দরোয়ান নটবর সিংহ। বুড়ো হয়েছে, কিন্তু বাবা ওকে কিছুতেই চাকরি ছাড়াবেন না। ও-ও কিছু কাজ না করে মাইনে নেবে না। পাহারা দেবেই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সারারাত জাগে?
প্ৰবীর বলল, সেটা কি ওর বয়সে সম্ভব? এ-বাড়িতে চুরি করার মতন তো কিছু নেই আর। দামি জিনিস সব কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের আর-একটা বাড়ি আছে ভুবনেশ্বরে। রুদ্ৰকাকা ওখানে থাকেন, এখানেও থাকেন।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, এখন তো আর কিছু করা যাবে না। দেখা যাক, কাল সকালে কী হয়!
রাত্তিরের খাওয়া দাওয়া সারতে অনেক রাত হয়ে গেল। অনেক রকমের রান্না, তার মধ্যে আছে পোলাও, কোপ্তা, পায়েস। গুরুভোজন যাকে বলে।
তারপর খানিকক্ষণ গল্প হল খাওয়ার ঘরে বসেই। তার মধ্যে হঠাৎ টিক টিক করে একটা টিকটিকি ডেকে উঠতেই কমলিকা ভয়ে জড়িয়ে ধরল তার দাদাকে।
প্রবীর হাসতে হাসতে বলল, দেখেছেন তো, কী ভিতু এই মেয়েটা! প্রত্যেক দিন শোওয়ার আগে সারাঘর আমাকে খুঁজে দেখতে হয়, একটাও টিকটিকি আছে কিনা। পুরনো বাড়ি। টিকটিকি তো থাকবেই।
কমলিকা বলল, এইজন্যই আমি এখানে আসতে চাই না। কলকাতাই ভাল।
সন্তু বলল, কলকাতা শহর বুঝি টিকটিকি শূন্য?
প্ৰবীর বলল, আমি তো জানি, পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই, যেখানে টিকটিকি নেই। এরা খুব প্রাচীন প্রাণী।
কাকাবাবু হাই তুলে বললেন, এবার শুয়ে পড়া যাক!
প্রবীর জিজ্ঞেস করল, আপনারা ওই এক খাটে শুতে পারবেন? আরএকটা ঘরেও ব্যবস্থা করা আছে। তবে সে ঘরের একটা জানলার একটা পাল্লা ভাঙা।
জোজো বলল, না, না, আমরা এক খাটেই শোব। এত বড় খাট, ফুটবল খেলা যায়।
কাকাবাবু আর সন্তু দুপাশে, মাঝখানে জোজো। আলোটা নিভিয়ে দেওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আমরা এখানে কেন এসেছি?
কাকাবাবু বললেন, পুকুরের মধ্যে একটা তালাবন্ধ সিন্দুক, সাতটা মাথার খুলি, এসব কিছুই আগে জানতাম না। সুতরাং ওইসব রহস্য সমাধানে আসিনি। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। এসেছি বেড়াতে। কাছাকাছি অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। প্রবীরের বাবা নেমন্তন্ন করেছেন অনেকবার। ভদ্রলোক খুব অসুস্থ। হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না, তাই এবারেই দেখা করতে আসা।
সন্তু বলল, আর-একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আঠারোশো আটান্না সালের জুন মাসে কী হয়েছিল? তুমি হঠাৎ বলে উঠলে…?
কাকাবাবু বললেন, তুই মনে রেখেছিস দেখছি। আটান্নর এক বছর আগে, আঠারোশো সাতান্ন সালে কী হয়েছিল জানিস?
জোজো বলল, সিপাই বিদ্রোহ!
কাকাবাবু বললেন, সাহেবরা বলত, সিপয় মিউটিনি, তার থেকে বাংলায় লেখা হত সিপাই বিদ্রোহ। পরে অনেকে বলেছে, ওটাই ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ। সিপাইরাই প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেছিল বটে, পরে অনেকেই যোগ দেয়।
সন্তু বলল, শুরু হয়েছিল তো আমাদের ব্যারাকপুরে। মঙ্গল পাণ্ডে…
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই যুদ্ধের প্রধান নেতা ছিলেন মঙ্গল পাণ্ডে, তাতিয়া টোপি, বঁসির রানি লছমিবাই, বিষ্ঠুরের নানাসাহেব, দিল্লির শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। এঁদের মধ্যে মঙ্গল পাণ্ডেকে প্রথমেই মেরে ফেলা হয়, ঝাসির রানি লছমিবাই আত্মহত্যা করেন। লোকে বলে তিনি আঁসির দুর্গ থেকে ঘোড়াসুদ্ধ নীচে লাফিয়ে পড়েছিলেন। তাঁতিয়া টোপি অনেকদিন পর ধরা পড়েন, তাঁকে একটা কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়। বাহাদুর শাহকে পাঠানো হয় নির্বাসনে। কিন্তু নানাসাহেবের কী হল? সেটা আমাদের ইতিহাসের একটা রহস্য। নানাসাহেবের আর কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি।
জোজো বলল, ওসামা বিন লাদেনের মতন!
কাকাবাবু বললেন, ওসামা বিন লাদেন লুকিয়ে আছে, তা তো বেশিদিন হয়নি। এখনও ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু নানাসাহেব তো অনন্তকাল বেঁচে থাকতে পারেন না। কিন্তু তার মৃত্যু সংবাদও পাওয়া যায়নি।
সন্তু বলল, আমাদের নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মতন অনেকটা।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, নেতাজিও এতদিন বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু কোথায় কীভাবে তার মৃত্যু হল, তা আজও রহস্যময়। তাইহোকু বিমানবন্দরে প্লেনে আগুন লেগে গেল, না তিনি জাপানে চলে গেলেন, কিংবা রাশিয়ানদের হাতে বন্দি হলেন, না ইংরেজরা গোপনে মেরে ফেলল, তা জানা গেল না। যুদ্ধ শেষের পর তিনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
সন্তু আবার বলল, নানাসাহেব কোথায় লুকিয়েছিলেন, তুমি বুঝি তা জানতে পেরেছ?
কাকাবাবু বললেন, না। খোঁজাখুঁজি করছি।
জোজো বলল, নানাসাহেব কি এই ঘিসিং-এ এসে লুকিয়েছিলেন? এমন হতে পারে?
সন্তু বলল, ঘিচিং নয়, খিচিং।
কাকাবাবু বললেন, হতেও পারে। তিনি কোনও-না-কোনও স্বাধীন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন অবশ্যই। ইংরেজরা তো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাঁকে কম খোঁজাখুঁজি করেনি! এইসব অঞ্চলে তখন ইংরেজ শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাস্তাঘাটও ছিল দুর্গম। এরকম জায়গায় লুকিয়ে থাকা সম্ভব। অনেকের ধারণা, নানাসাহেব বাকি জীবনটা ছদ্মবেশে নেপালে কাটিয়েছেন। কিন্তু আমি নেপালে গিয়ে অনেক খোঁজ করেছি, সেরকম কোনও প্রমাণ মেলেনি।
সন্তু বলল, এসব তো বহু বছর আগেকার কথা। তুমি এখন খোঁজ করছ কেন?
কাকাবাবু বললেন, এমনিই, কৌতূহল। নেতাজির মৃত্যু নিয়ে তো এখনও তদন্ত চলছে। আমার বন্ধু সাধন রায় সিপাই যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে একটা নতুন বই লিখছেন। তাকে আমি একটু সাহায্য করতে চাই! অনেক কথা হয়েছে। এবার ঘুমো।
জোজো বলল, লোহার সিন্দুকটার মধ্যে কী আছে, তা জানার জন্য খুব কৌতূহল হচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, কাল সকালে প্রথম কাজ হবে আমাদের ড্রাইভার গুরুপদর খোঁজ করা।
এইসময় হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেল। সারাদিন অসহ্য গরমের পর জানলা দিয়ে এল ঠান্ডা হাওয়া। সেইসঙ্গে বৃষ্টির ছাঁট।
প্রথম প্রথম ভালই লাগল, তারপর বিছানা ভিজতে শুরু করায় জানলাটা বন্ধ করতেই হল। তারপর আবার গরম।