০২. জ্ঞান ফিরে ঝা আবিষ্কার করল

জ্ঞান ফিরে ঝা আবিষ্কার করল মাধ্যাকর্ষণহীন একটা ঘরে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। পরে সুমসাম নীরবতা। মাথা ঘুরিয়ে দেখল টুকিও ভাসতে ভাসতে কুলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে, কপালের কাছে খানিকটা জায়গা আলুর মত ফুলে আছে নিশ্চয়ই সেখানে রবোটের বাচ্চা রবোট গদা দিয়ে মেরেছিল। ঝা টুকিকে জাগিয়ে তোলার জন্যে তার কাছে যেতে চাইল কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়। ঝা এক জায়গায় হাড় পাচড় করতে থাকে কিন্তু এক সেন্টিমিটার সামনেও এগুতে পারে না।

আপনি কি ব্যায়াম করছেন? আমি কখনো কাউকে ব্যায়াম করতে দেখিনি।

গলার স্বর শুনে ঝা নিচে তাকাল, সেখানে সোজা হয়ে রবোটটি দাঁড়িয়ে আছে। রাগ চেপে বলল, না আমি ব্যায়াম করছি না। আমি সামনে যাবার চেষ্টা করছি।

সামনে যেতে হলে আপনাকে পিছনে ধাক্কা দিতে হবে। প্রাচীন বিজ্ঞানী নিউটন ভরবেগের সাম্যতার এই সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পিছনে ধাক্কা দিলে প্রতিক্রিয়া হিসেবে সামনে একটি ক্রিয়া হয়। সেই ক্রিয়াতে–

ঝা ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, সাধারণত রাগ করে না, এবারে রেগে উঠে বলল, চুপ কর হতভাগা, না হয় এক রদ্দা দিয়ে ঘিলু বের করে দেব।

রবোটটি তার গলার স্বরে এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে বলল, আপনি কী রাগ করছেন? আমি কখনো কাউকে রাগ করতে দেখিনি। রবোট ফার্মে আমার বন্ধুরা বলেছে মানুষ যখন রাগ হয় তখন নাকী তারা বিচিত্র সব কাজকর্ম করে। সেটা দেখা নাকী অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আপনি আরও একটু রাগ করবেন? আমি আবার দেখি।

ঝা চোখ পাকিয়ে রবোটটার দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে কাছাকাছি একটা দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে টুকির দিকে এগিয়ে গেল। কাছে এসে তাকে বার কতক ঝাকুনি দিতেই সে চোখ খুলে চিৎকার করে বলল, ধরা পরে গেছি? পুলিশ এসে গেছে?

না, ঝা মাথা নেড়ে বলল, ধরা পড়ি নি। কিন্তু ধরা পরলেই অনেক ভাল ছিল। আমরা এখন মহাকাশে।

টুকির সব কথা মনে পড়ে গেল এবং সে সাথে সাথে ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করতে থাকে। শূন্যে ভাসমান অবস্থায় ধড়মড় করে উঠে বসা যায় না। কাজেই টুকি ওলট পালট খেয়ে এক জায়গায় ঘুরতে শুরু করল, তাকে থামাতে গিয়ে ঝাও একই জায়গায় ওলট পালট খেতে লাগল। রবোটটি নিচে দাঁড়িয়ে বলল, মানুষ প্রজাতির নির্বোধ কাজ দেখা বড় আনন্দের।

টুকি কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, ব্যাটা রবোটের বাচ্চা তুই ভাসছিস না কেন? সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেমন করে?

আমার পায়ে রয়েছে বিশেষ সাকশান জুতো।

তাহলে আমাদের সেই জুতো দিচ্ছিস না কেন?

আপনারা চাইছেন না তাই দিচ্ছি না।

ঠিক আছে এখন চাইলাম।

এক্ষুণি এনে দিচ্ছি। আপনাদের পায়ের সাইজ যেন কত?

কিছুক্ষণের মাঝেই টুকি এবং ঝা তাদের পায়ে সাকশান জুতো পরে মেঝেতে স্থির হল। প্রথমেই তারা জানার চেষ্টা করল এই মুহূর্তে মহাকাশযানটা কোথায় আছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে। রবোটটিকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আমি জানি কিন্তু বলব না।

কেন বলবে না?

এটি একটি গোপন প্রজেক্ট।

রবোটের বাচ্চা রবোট—এই গোপন প্রজেক্টে আমরা বসে আছি আর আমরা জানতে পারব না কোথায় যাচ্ছি?

আমি রবোটের বাচ্চা নই–রবোটটি মাথা নেড়ে বলল, আমার নাম রোবি।

ঐ একই কথা।

এক কথা নয়। রবোটের বাচ্চা রবোট সম্পূর্ণ অর্থহীন কথা। রবোটের বিয়ে হয় না এবং রবোটের বাচ্চা হয় না। আমার নাম রোবি।

ঠিক আছে ঠিক আছে। রোবি, তুমি বল আমরা কোথায় যাচ্ছি।

রোবি শান্ত গলায় বলল, এটা বলা যাবে না।

টুকি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, বলা যাবে না?

না। এই প্রজেক্টে যাদের যাওয়ার কথা ছিল আপনারা তাদের ফেলে রেখে চলে এসেছেন। আপনারা বে-আইনী। মনে হচ্ছে অনেক বড় গোলমাল পাকিয়ে দিয়েছেন।

ঝা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?

জানি না। আমি যখন আপনাদের কথা বলেছি তখন পৃথিবীর কন্ট্রোল রুমে বিশাল হৈ চৈ শুরু হয়েছে। যিনি ডিরেক্টর তিনি মাথার চুল ছিড়তে ছিড়তে। বলেছেন, শালাদের কিলিয়ে ভর্তা বানাও।

তাই বলেছেন?

হ্যাঁ। এটাই মনে হচ্ছে অফিসিয়াল নির্দেশ। আমার আপনাদের দুজনকে কিলিয়ে ভর্তা বানাতে হবে। কখন করতে হবে জানালেই কাজ শুরু করে দেব। সেন্ট্রাল ডাটাবেস থেকে শুধু জেনে নিতে হবে কিলিয়ে কথাটার মানে কী আর

ভর্তা কথাটার মানে কী। আপনারা জানেন?

টুকি রোবির শক্ত হাতের মুঠির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমরা জানি। আমরা যদি বলে দিই তাহলেও কী সেন্ট্রাল ডাটাবেস থেকে জানার দরকার আছে?

ভাল করে বুঝিয়ে দিলে দরকার হবে না।

টুকি উদাস গলায় বলল, কিলিয়ে ভত্তা করা মানে যত্ন করে রাখা–কোন অসুবিধা যেন না হয়।

ঝা যোগ করল, বিশেষ লক্ষ্য রাখা যেন খেতে কোন অসুবিধা না হয়। সিনথেটিক খাবার না দিয়ে প্রাকৃতিক খাবার। বড় বড় গলদা চিংড়ি

হ্যাঁ টুকি মাথা নাড়ল, সাথে নরম বিছানা। আর ঘুম থেকে ওঠার পর ভাল পানীয় এবং ক্লাসিক্যাল মিউজিক।।

পরিস্কার কাপড়। সিনথেটিক নয়। একশভাগ কটন।

হাল ফ্যাসন হলে ভাল হয়। ঢিলেঢালা ধরনের।

দুই ঘণ্টা পর পর নাস্তা। মেনু কী হবে আগে থেকে জানিয়ে রাখা।

গোসলের পানি হবে হালকা কুসুম কুসুম গরম।

রোবি চোখ পিট পিট করে বলল, মানুষের ভাষা বড়ই বিচিত্র। কিলিয়ে ভর্তা করা তিন শব্দের একটা বাক্য অথচ এর অর্থ কত ব্যাপক। সত্যিই বিচিত্র।

টুকি এবং ঝা একসাথে মাথা নাড়ল।

 

কিলিয়ে ভর্তা করার ব্যবস্থা হওয়ার পরেও টুকি এবং ঝা মনমরা হয়ে মহাকাশযানে বসে আছে। প্রথম কিছুক্ষণ মহাকাশযানের জানালা দিয়ে নীল পৃথিবীটাকে দেখা গেছে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। মহাকাশযানের বড় বড় ইঞ্জিনগুলো চালু হয়ে সেটাকে পৃথিবী থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। সারাজীবন চুরি-চামারী করে কাটিয়েছে বলে গ্রহ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে দেখে নি। যদি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানটুকুও থাকত তাহলে তারা বুঝতে পারত মহাকাশযানটি মঙ্গল গ্রহের পাশ কাটিয়ে বৃহস্পতির মহাকর্ষ বলকে ব্যবহার করে একটি হাইপার ডাইভ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মহাকাশযানের ছোট ঘরটাতে তাদের কাজকর্ম বিশেষ কিছু নেই। সময় কাটানো একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সময় হলে টুকি এবং ঝা ঝগড়াঝাটি করে সময় কাটাতে পারত কিন্তু এখন সেটাও করতে পারছে না। প্রত্যেকবার তারা একে অপরের উপর রেগে উঠতেই রোবি গলায় তার যান্ত্রিক ধরনের আনন্দ ঢেলে বলে, কী চমঙ্কার! কী চমৎকার! আপনারা নিশ্চয়ই রাগ করছেন। আমি শুনেছি মানুষের রাগের প্রথম পর্যায়ে নাকি একে অন্যের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করে। সেগুলি নাকি শুনতে খুব ভাল লাগে। রাগারাগির দ্বিতীয় পর্যায়ে নাকি একজন অন্যজনের নাকে হাত দিয়ে আঘাত করে। সেটি দেখলে নাকি অনেক আনন্দ হয়। কখন আপনারা একে অন্যকে আঘাত করবেন?

কাজেই যত রাগই হোক টুকি এবং ঝা চুপ করে মুখ শক্ত করে বসে থাকে। খুব যখন মন খারাপ হয় তখন তারা তাদের ঝোলা বের করে চুরি করে আনা হীরার টুকরোগুলোতে হাত বুলায়। হাতের মুঠির মত বড় বড় হীরা, কয়েকটা কাটা হয়েছে, কয়েকটা কাটা হয় নি, হাত বুলাতে তাদের বড় ভাল লাগে। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে এগুলো বিক্রি করে কোন একটা দ্বীপ কিনে নিয়ে মোটামুটিভাবে বাকি জীবনটা আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে যাবে সেরকম কোন আশা এই মুহূর্তে তাদের সামনে নেই। মহাকাশযানটি বৃহস্পতি এবং নেপচুনের মাঝামাঝি এসে হাইপার ডাইভ দিয়ে সৌরজগৎ থেকে অদৃশ্য গেছে, সেটা বের হয়েছে গ্যালাক্সির অন্যপাশে সেখানকার এম সেভেন্টিওয়ান নক্ষত্রপুঞ্জে, যার আশেপাশে বসতিযোগ্য অনেকগুলো গ্রহ উপগ্রহ রয়েছে এবং যে গ্রহ-উপগ্রহগুলোতে একসময় পৃথিবীর মানুষেরা তাদের কলোনী তৈরি করেছিল।

টুকি এবং ঝা সেই কলোনীগুলোর অস্তিত্বের কথাই জানত না, কাজেই সেখানে যে বিগত দুই শতাব্দী থেকে চরম অরাজকতা চলছে সেটা জানারও তাদের কোন উপায়ই ছিল না।