ছোট শিশুটির বুকে কিছুক্ষণ স্টেথেস্কোপটা ধরে রেখে কিছু একটা শুনে কম বয়সী ডাক্তারটি বলল, “বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।“
শামীম অবাক হল না। সে নিজে ডাক্তার, সে খুব ভালো করে জানে একটা ছোট শিশু মায়ের গর্ভে একটা উষ্ণ পরিবেশে থাকে। জন্ম হবার পর বাইরের জগৎটি তার জন্যে যথেষ্ট ঠাণ্ডা বাচ্চাকে তখন কাপড় জড়িয়ে রাখতে হয়। এই রকম একটা বাচ্চাকে যদি একটা ডোবায় ফেলে দেয়া হয় তার বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম।
কম বয়সী ডাক্তার–যাকে দেখে একটা কলেজের ছাত্রী বলে মনে হয়, শামীমের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি নিজেও তো একজন ডাক্তার, আপনি তো আমার থেকে ভালো জানেন। বাচ্চাটির দুই লাংসেই নিমোনিয়া। অক্সিজেন দিতে হবে।”
শামীম মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাটার চিকিৎসা কী ঠিক করে হবে?”
ডাক্তার মেয়েটি হেসে ফেলল, বলল, “এটা সরকারী হাসপাতাল সরকারী হাসপাতালের অবস্থা তো আপনি জানেন। এই রকম অবস্থায় যেটুকু পারি আমরা ততটুকু চেষ্টা করব।”
শামীম বলল, “একটা ইনকিউবিটারে রাখলে–”
মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের ইনকিউবিটর বেশি নাই। যে কয়টি আছে তার সবগুলো এখন ব্যবহার হচ্ছে। কোনো একটা খালি হলেই নিয়ে যাব।”
“আমার তাহলে করার কিছু নেই?”
“আপনার যা করার তার সবকিছু করেছেন। একটা ডোবাতে মাত্র জন্ম হওয়া একটা বাচ্চাকে ডোবাতে ফেলে দিলে তাকে পেয়ে কেউ তুলে হাসপাতাল পর্যন্ত আনে না। আপনি এনেছেন, তার চিকিৎসা শুরু করিয়েছেন, ওষুধপত্র যা লাগবে কিনে দিয়েছেন। আপনার দায়িত্ব শেষ।”
শামীম ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “বাচ্চাটা যদি শেষ পর্যন্ত না বঁচে–”
“বেওয়ারিশ লাশকে দাফন করার খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। আপনি শুনে খুব অবাক হবেন মানুষকে আমরা অনেক সময় বাঁচাতে পারি না কিন্তু মরে গেলে যথেষ্ট যত্ন করে তাকে দাফন-কাফন করি।”
“আর যদি কোনো একটা ম্যাজিক হয়ে যায়, বাচ্চাটা বেঁচে যায়? তখন তার কী হবে?”
“এরকম ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। এদের পালক নেয়ার জন্য অনেক পরিবার থাকে। যদি বেঁচে যায় তাহলে এই বাচ্চাটি সুন্দর একটা পরিবার পেয়ে যাবে।“
শামীম তবু ইতস্তত করে, “তাহলে আপনি বলছেন এই বাচ্চাটির জন্যে আমার আর কিছু করার নেই?”
“না। আপনার আর কিছু করার নেই?”
“তাহলে আমি চলে যাব?”
“হ্যাঁ। আপনি চলে যেতে পারেন।”
শামীম ছোট শিশুটির দিকে তাকালো। শিশুটির নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ছোট ছোট দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে। নিমোনিয়ার শিশুদের বেলায় যেটা সবসময়ে দেখা যায়। শামীম শিশুটির কপাল একবার স্পর্শ করে মনে মনে বলল, “ভালো হয়ে যাও।”
হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে শামীমের ভেতরে কিছু একটা খচ খচ করতে লাগল। ঠিক কোন ব্যাপারটা তার ভেতরে এরকম খচ খচ করছে সে ধরতে পারল না সেই জন্যে অস্বস্তিটা আরো বেশি পীড়া দিতে লাগল।
.
চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শামীম তার ব্যাকপেকটা নিচে রেখে ভেতরে তাকাতেই দেওয়ালে টানানো শাহানা আর রিতুর বড় ছবিটা চোখে পড়ল। দুইজনই তার দিকে তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ সে বাসায় থাকে ততক্ষণ এই দুজন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। গাড়ী একসিডেন্টে তার শরীরের প্রায় সবগুলো হাড় ভেঙ্গে গিয়েও সে বেঁচে গেল কিন্তু শাহানা আর রিতুর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই কিন্তু তারা দুজনেই মরে গেলবিষয়টা এতোদিন পরেও তাকে অবাক করে দেয়। শামীম কোনোদিন চিন্তা করে নি শাহানা আর রিতু ছাড়া সে একা একা বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু সে একা একা বেঁচে আছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই মাঝে মাঝেই তার মনে হয় শাহানা কিংবা রিতু আসলে মারা যায় নি। তারা বাসাতেই আছে। ডাক দিলেই দরজা খুলে বের হয়ে আসবে। শান্তা চোখ পাকিয়ে বলবে, “কী হলো? চিৎকার করছ কেন? তোমার সমস্যাটা কী?” আর রিতু কোনো কথা না বলে পিছন থেকে ছুটে এসে তার ঘাড়ে ঝুলে পড়বে। একটিবার–শুধু একটিবার রিতুকে দুই হাতে জাপটে ধরার জন্যে তার সমস্ত শরীর আঁকুপাঁকু করতে থাকে। শাহানার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথা বলার জন্যে তার সমস্ত চেতনা মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন। হয়ে যায়।
শামীম সার্টটা খুলতে খুলতে বলল, “বুঝলি রিতু, আজকে ছোট একটা বাচ্চাকে হাসপাতালে রেখে এসেছি। বাচ্চাটা মনে হয় বাঁচবে না।”
শামীম মাঝে মাঝেই এ-রকম করে, জোরে জোরে কথা বলে যেন সত্যিই রিতু কিংবা শাহানা তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাকে এটা করতে দেখে নি, দেখলে নিশ্চিত ভাবেই ধরে নিতো সে একজন বদ্ধ উন্মাদ।
একটু পরে শামীম আবার বলল, “নিমোনিয়া হয়ে গেছে। নিশ্বাস নিতে পারছে না। অক্সিজেন দিতে হবে, তারপরেও লাভ হবে মনে হয়।” বাথরুমে হাত মুখ ধুতে ধুতে বলল, বাচ্চাটা যদি বেঁচে যেতো সেটা একটা অসাধারণ গল্প হতো। কিন্তু মুশকিল কী জানিস?” শামীম একটু থেমে বলল, “মুশকিল হল রিয়েল লাইফে অসাধারণ গল্প নাই। ম্যাজিক নাই। রিয়েল লাইফ খুবই কঠিন। খুবই বোরিং।”
শামীম ফ্রীজ থেকে কিছু খাবার বের করে মাইক্রো ওয়েভ ওভেনে গরম করে খেতে খেতে আবিষ্কার করল তার ভেতরে আবার কোনো একটা কিছু নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি। শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা জিনিস হিসেব মিলছে না, কোথায় সেই হিসাব মিলছে না সে ধরতে পারছে না।
খাওয়া শেষ করে শামীম যখন এক কাপ চা তৈরি করে সোফায় হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে কাপে চুমুক দিচ্ছে তখন সে হঠাৎ করে চমকে উঠল। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল কেন হিসেবটি মিলছে না, হঠাৎ করে সেটা সে বুঝতে পেরেছে কেন তার ভেতরে এতো অস্বস্তি।
গ্রামের সেই ডোবাতে কিশোরী মেয়েটা যখন প্রথমবার এই শিশুটাকে একটা বড় মাছ মনে করে তার বাবাকে ডাকতে গেল তখন থেকে সে ডোবার পাশে বসে ডোবার পানির দিকে তাকিয়েছিল। সে বাচ্চাটিকে দেখে নি-তার কারণ বাচ্চাটা পানিতে ডুবেছিল। একজন মানুষ নিশ্বাস না নিয়ে পানির ভেতরে বড় জোর এক দুই মিনিট থাকতে পারে। কিন্তু এই বাচ্চাটা তার চোখের সামনেই কম পক্ষে টানা পনেরো মিনিট পানিতে ডুবেছিল-এই পনেরো মিনিটি বাচ্চাটা একবারও নিশ্বাস নেয় নি। এটি কীভাবে সম্ভব? সে যখন বাচ্চাটিকে পানি থেকে তুলেছে তখন বাচ্চাটির পুরোপুরি জ্ঞান আছে, বাচ্চাটি তার দিকে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিল। নবজাতকের বিস্ময়কর সেই বুক কাঁপানো দৃষ্টি।
শামীম তার চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেল। তার সামনেই কম পক্ষে পনেরো মিনিট পানিতে ডুবেছিল, সে এখানে হাজির হওয়ার আগে কতোক্ষণ ডুবেছিল কে জানে। তাকে নিশ্চয়ই দিনের আলোতে ডোবায় ফেলে নি, রাতের অন্ধকারে ফেলেছে। যার অর্থ এই শিশুটি নিশ্চয়ই বেশ কয়েক ঘণ্টা পানিতে ডুবে আছে। কিন্তু পানিতে ডুবেও বাচ্চাটি মারা যায় নি। সেটি একটি অসম্ভব ব্যাপার–মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে নিশ্বাস নিতে হয়, শরীরের কোষে কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দিতে হয়। শরীরের সমস্ত জৈবিক কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দিতে পারলে হয়তো নিশ্বাস নেবার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু বাচ্চাটির জৈবিক কাজ তো বন্ধ হয় নি! বাচ্চাটির তো পুরোপুরি জ্ঞান ছিল, মাঝে মাঝে পানিতে খল-বল করে মাছের মতো নড়ে উঠেছিল। বাচ্চাটিকে তোলার পর তার হাতের ভেতর নাড়াচাড়া করেছে, সে পুরোপুরি সতেজ একটা শিশুর মতো ছিল। কোনো নিশ্বাস না নিয়ে-এটি কীভাবে সম্ভব?
শামীম একটু অবাক হল, বিষয়টা কেন তার চোখে এতোক্ষণ পর ধরা পড়ল? যেহেতু এটা অসম্ভব একটি ঘটনা তাই নিজের অজান্তেই সে ধরে নিয়েছে নিশ্চয়ই এটি সত্য নয়, নিশ্চয়ই অন্য কিছু ঘটেছে যেটা তার চোখে পড়ে নি। তা ছাড়া বাচ্চাটাকে প্রাণে বাঁচানোটাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য তখন অন্য কোনোকিছু সাময়িক ভাবে তার মাথায় আসে নি।
শামীম চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। সে হাসপাতালে গিয়ে বাচ্চাটিকে আরো একবার দেখে আসবে। এই রহস্যময় শিশুটিকে আরো একবার নিজের চোখে দেখে আসা দরকার।
শামীম যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে তখন সেখানে অনেক ভীড়। সরকারী হাসপাতালে যে-রকম হয়, রোগীর তুলনায় নার্স ডাক্তারের সংখ্যা খুব কম। হাসপাতালের কোনো নিয়ম কানুন নেই, লোকজন ইচ্ছে মতো ভেতরে ঢুকছে, বের হচ্ছে, রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের ওয়ার্ডে সব বাচ্চার কাছেই তার মা কিংবা কোনো আত্মীয় স্বজন দাঁড়িয়ে আছে। শামীম যে শিশুটিকে হাসপাতালে রেখে গেছে তার কাছে কেউ নেই, নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো ছিল সেটা সরে গেছে কেউ লক্ষ্য করে নি। বুকটা খুব দ্রুত ওঠা নামা করছে, ঠোঁটগুলো নীল। শামীম বুঝতে পারলো বাচ্চাটি এর মাঝে মৃত্যুর দিকে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেছে।
শামীম এদিক সেদিক তাকিয়ে একজন নার্স খুঁজে বের করল, জিজ্ঞেস করল, “এই বাচ্চাটার কী খবর?”
নার্স একটা স্যালাইনের ব্যাগ নিয়ে একদিকে প্রায় ছুটে যাচ্ছিল, বলল, “ডিউটি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন।”
শামীম ডিউটি ডাক্তারকে খুঁজে বের করার জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল তখন পিছন থেকে কেউ একজন ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”
শামীম ঘুরে তাকাল, ধড়ের ওপর মাথা বসানো গাট্টাগোট্টা একজন মানুষ। গায়ে ডাক্তারের এপ্রন, গলা থেকে স্টেথিস্কোপ ঝুলছে তাই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা ডাক্তার। শামীম হাসি হাসি মুখ করে বলল, “না, কোনো সমস্যা নেই। আমি এই বাচ্চাটাকে ভর্তি করে গিয়েছিলাম, দেখতে এসেছি কেমন আছে।”
“ও।” মানুষটা ভুরু কুঁচকে শামীমের দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি দেখে শামীমের মনে হল সে নিশ্চয়ই কোনো একটা ভুল করে ফেলেছে।
শামীম বলল,”আমি নিজেও আসলে ডাক্তার।”
মানুষটা বলল, “ও! রোগী কেমন দেখলেন?”
“ভালো না। খুব ক্রিটিক্যাল মনে হয় আরেকটু কেয়ার দরকার ছিল।”
ডাক্তার মানুষটা বলল, “কেয়ার দরকার মনে করলে কেয়ার দেন। আপনাকে বাধা দিচ্ছে কে?”
শামীম মানুষটার কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল। এ-রকম ভাষায় কেউ তার সাথে কথা বলতে পারে শুনেও সে বিশ্বাস করতে পারে না। মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “তাকে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে?”
“এর জন্যে আপনার এতো দরদ কেন?”
“দরদ?” শামীম হতচকিতের মতো এদিক সেদিক তাকাল। ভর্তি করানোর সময় কমবয়সী কলেজ ছাত্রীর মতো দেখতে মহিলা ডাক্তারটা কী। সুন্দর করে কথা বলেছে, আর এই গরিলার মতো মানুষটা কী শুরু করেছে? মানুষটা এমন ভাবে শামীমের দিকে এগিয়ে এল যে তার মনে হল বুঝি তাকে মারতে আসছে। একেবারে তার মুখের কাছে মুখ এনে হিস হিস করে বলল, “এই বাস্টার্ডের মা তাকে বাঁচাতে চায় নাই, ডোবায় ফেলে দিয়েছে। আপনি কেন তুলে এনেছেন?”
“কী বলছেন আপনি?”
“এই পাপের সন্তানকে বাঁচানো আমার মাথা ব্যথা কেন হবে?”
শামীম পাথরের মতো মুখ করে বলল, “কী বলছেন আপনি? আপনি একজন ডাক্তার। আপনি হিপোক্রেটাসের ওথ নিয়েছেন—”
“গুলি মারি আমি হিপেক্রেটাসকে। ঘেন্না হয় আমার। আমার কেন আবর্জনা ঘাটতে হবে? নর্দমার আবর্জনা কেন তুলে এনেছেন? এইখানে সত্যিকারের মা বাবার সত্যিকার বাচ্চা আছে। আমি তাদের চিকিৎসা করব। পাপের সন্তানকে আমি কেন ছোঁব? যার জন্ম হয়েছে দোজখে যাবার জন্যে তার জন্যে আমার কী দায়িত্ব?”
অসহ্য ক্রোধে শামীমের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। গরিলার মতো মানুষটা হিস হিস করে বলল, “এই বাস্টার্ডের চিকিৎসা করার আমার কোনো সখ নাই। একে বাঁচাতে চাইলে আপনি নিয়ে যান এখান থেকে। এই ওয়ার্ডে অনেক সত্যিকার মানুষের সত্যিকার বাচ্চা আছে যাদের চিকিৎসা দরকার।”
অনেক কষ্ট করে শামীম নিজেকে শান্ত রাখল তারপর শীতল গলায় বলল, “ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। তার আগে আমার একটু প্রিপারেশান দরকার। আমি প্রিপারেশন নিয়ে আসছি। আপনার কাছে অনুরোধ–”
“কী অনুরোধ?”
“আমি প্রিপারেশান নিয়ে আসার আগে আপনি এই বাচ্চাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলবেন না।”
মানুষটা তীব্র দৃষ্টিতে শামীমের দিকে তাকিয়ে রইল। শামীম নিচু গলায় বলল, “যদি মেরে ফেলেন তাহলে আমি গলা টিপে আপনাকে মেরে ফেলব। মানুষ মারলে অপরাধ হয়-জানোয়ার মারলে অপরাধ হয় না।”
.
দুই ঘন্টা পর, শিশুটি শামীমের বাসায় তার ডাইনিং টেবিলে শুয়ে আছে। শামীম ফ্যান থেকে একটা দড়ি ঝুলিয়ে সেখানে একটা স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটিকে একটা কম্বল দিয়ে মুড়ে ঢেকে রেখেছে। মাথার কাছে একটা ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেখান থেকে তার নাকে সরু প্লাস্টিকের নল দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। সে স্টেথিস্কোপ দিয়ে শিশুটির বুক পরীক্ষা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালে টানানো তার মেয়ে রিতুর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি রিতু। বাচ্চাটার অবস্থা ভালো না। যে বাচ্চা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডোবায় ডুবে থাকতে পারে তাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না, কেমন লাগে বল।”
শামীম গলার স্বর নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, “আমার কী মনে হচ্ছে জানিস রিতু? আমার মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি আসলে পানির ভেতর নিশ্বাস নিতে পারে এখন তাকে বাচঁতে হলে পানিতে ডোবাতে হবে। কিন্তু তুইই বল, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য কথা?”
শামীম ওঠে সারাঘরে একবার পায়চারী করল, তারপর টেলিফোনটা হাতে নিয়ে একটা নম্বরে না। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে তার এককালীন সহকর্মী আলেক্সের নম্বর। এই সময়টাতে তার খুব ব্যস্ত থাকার কথা টেলিফোনটা ধরবে তার সম্ভাবনা খুব কম, কিন্তু শামীম অবাক হয়ে দেখল আলেক্স টেলিফোনটা ধরে তার বিচিত্র ইংরেজী উচ্চারণে বলল, “আলেক্স বলছি।”
শামীম ইংরেজীতে বলল, “আলেক্স আমি শামীম।” অন্য পাশ থেকে আলেক্সের আনন্দোচ্ছাস শোনা গেল, “হেই শামীম। লং টাইম নো সি, লং টাইম নো টক, লং টাইম নো ই-মেইল তোমার হয়েছেটা কী? বেঁচে আছ?”
“হ্যাঁ। বেঁচে আছি। তোমার কী খবর।”
আলেক্স চিৎকার করে বলল, “আমার সব রকম খবর আছে। ভালো, খারাপ, মাঝারী রকমের ভালো, মাঝারী রকমের খারাপ, খুব ভালো, খুব খারাপ, কোনটা শুনতে চাও?”
শামীম হেসে ফেলল, বলল, “সবগুলো শুনি। খারাপ থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাও।”
আলেক্স হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। দুই বন্ধু বেশ খানিকক্ষণ পুরানো দিনের কথা বলে একে অন্যের খবর নেয়। এক সময় আলেক্স বলল, “ঠিক আছে শামীম, এখন বল তুমি কেন ফোন করেছ? ধরেই নিচ্ছি তুমি তোমার পুরনো বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড তাকে কী রকম দাগাবাজী করেছে তার খবর নেওয়ার জন্য ফোন করো নাই।”
শামীম বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। আমি তোমার কাছে একটা জিনিস জানার জন্য ফোন করেছি। ইন্টারনেটের হালকা তথ্য দিয়ে হবে না। আমার খাঁটি বৈজ্ঞানিক তথ্য দরকার।”
“ঠিক আছে, বল।”
“মানুষ কী কোনোভাবে তার ফুসফুস ব্যবহার না করে নিশ্বাস নিতে পারে?”
“না। পারে না।”
“শরীরের চামড়া দিয়ে?” ও
“মানুষের চামড়া হচ্ছে, তার শরীরের সবচেয়ে বড় অর্গান। প্রায় তিন কেজি ওজন। প্রায় দুই মিলিওন লোমকুপ। এক বর্গ ইঞ্চিতে চার মিটার রক্তনালী। চামড়ার মৃত কোষ প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে, নূতন কোষের জন্ম নিচ্ছে। এক জীবনে এক মানুষ প্রায় হাজার বার নূতন চামড়ার জন্ম দেয় কিন্তু যত কিছুই করুক এই চামড়া দিয়ে নিশ্বাস নেয়া যায় না। সরি শামীম।”
“কিন্তু কোনো কোনো প্রাণী তো নিতে পারে।”
“হ্যাঁ। পারে। উভচরেরা পারে। কোনো কোনো ব্যাঙ পারে। সালমান্ডার পারে। কোনো কোনো সালমান্ডার আছে যাদের ফুসফুস নেই। তারা তাদের চামড়া দিয়ে নিশ্বাস নেয়। কিন্তু মানুষ তো সালমান্ডার না।”
“কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী পারে না?”
আলেক্স কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, “অস্ট্রেলিয়াতে ইঁদুরের মতো এক ধরনের মার্সুপিয়াল আছে তার নামটা খুবই ফ্যান্সী, জুলিয়া ক্রিক ডুনার্ট! এই ইঁদুরগুলো চামড়ার ভিতর দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে। আমার জানামতে আর কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী পারে না।” আলেক্স এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তুমি কেন আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছ? তুমি কী কাউকে পেয়েছ যে ফুসফুস ব্যবহার না করে চামড়া দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে?”
শামীম হাসার চেষ্টা করে বলল, “না সেভাবে পাই নি, কিন্তু এটা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।”
আলেক্স হঠাৎ করে গম্ভীর গলায় বলল, “দেখ শামীম। মানুষের প্রতি মুহূর্তে বিবর্তন হচ্ছে, মিউটেশান হচ্ছে। তাই ঘটনাক্রমে খুব বিচিত্র কিছু হওয়া অসম্ভব কিছু না। এই মিউটেশানগুলো টিকে থাকে না বলে আমরা এই বিচিত্র উদাহরণগুলো দেখি না। মানুষের চামড়ার প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চার মিটার রক্তনালী, সেগুলো যদি কোনোভাবে চামড়ার কোষের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন এক্সচেঞ্জ করতে পারে সে হয়তো চামড়া দিয়ে নিশ্বাস নিতেও পারে। মাছ তার ফুলকা দিয়ে জানি থেকে অক্সিজেন নেয়—“
শামীম কিছু বলল না। আলেক্স বলল, “চামড়া দিয়ে নিশ্বাস নেবার জন্যে সালমান্ডারের চামড়া ভিজা থাকতে হয়। তুমি তোমার কেসে চামড়া ভিজিয়ে দেখ। দরকার হলে পানিতে ডুবিয়ে দেখ। তুমি বিজ্ঞানী মানুষ তোমার কারো কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। তুমি এক্সপেরিমেন্ট করো, করে দেখো কী হয়।”
শামীম বলল, “দেখব।”
.
কিছুক্ষণের মাঝেই শামীম তার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করল।
শামীম টেবিলে একটা গামলায় পানি রেখে সেখানে খানিকটা গরম পানি ঢেলে কুসুম কুসুম তাপমাত্রায় নিয়ে এল। হাত দিয়ে যখন মনে হল তাপমাত্রাটা আরামদায়ক একটা উষ্ণতায় পৌঁছেছে তখন সে শিশুটিকে কম্বলের ভেতর থেকে বের করে খুব সাবধানে গামলার পানিতে নামাল, শিশুটির মাথার পিছনে সাবধানে ধরে রাখল হঠাৎ যেন গড়িয়ে পানিতে পড়ে না যায়। পানিতে নামানো পর শিশুটির শরীর এক দুইবার ঝাঁকুনী দেয়, তারপর শান্ত হয়ে যায়।
শামীম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, শিশুটি খুব ধীরে ধীরে তার হাত পা নাড়ছে। মনে হয় পানির ভেতরে এই শিশুটি একটু বেশী স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। শিশুটির বুক খুব দ্রুত ওঠানামা করছিল, নিমোনিয়া হলে বাচ্চাদের যা হয়, শামীম অবাক হয়ে দেখল তার বুকের ওঠা নামা কমে আসছে। শুধু তাই না, তার সারা শরীরে ছোট ছোট বাতাসের বুদবুদ জমা হচ্ছে। চামড়া দিয়ে শরীরে অক্সিজেন নিয়ে আবার চামড়া দিয়েই কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দিচ্ছে। কার্বন ডাই অক্সাইড বুদবুদগুলো বড় হওয়ার আগে শরীরে লেগে থাকছে। শামীম হতবাক হয়ে শিশুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। স্টেথিস্কোপ দিয়ে তার হৃদস্পন্দন মেপে দেখে, ছোট শিশুর একটা শক্তিশালী হার্ট ধুকপুক ধুকপুক করে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করছে।
শামীম চাপা গলায় বলল, “রিতু! তুই দেখছিস কী হচ্ছে? দেখছিস তুই?” দেয়ালে রিতুর ছবি কোনো উত্তর দিল না কিন্তু তাতে শামীমের কোনো সমস্যা হলো না, সে ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি রিতু আমি এখন কী করব? আমি এখন খুব সাবধানে এই বাচ্চাটির মাথাটা ছেড়ে দেব যেন তার মাথাটাও পানির ভেতর ঢুকে যায়। তার পুরো শরীর যেন পানির ভেতর থাকে। আমার কী মনে হয় জানিস?” শামীম রিতুকে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার একটু সময় দিল, তারপর বলল, “আমার মনে হয় এই ছোট শিশুটা তখন আরো ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারবে।”
শামীম তখন সাবধানে বাচ্চাটার মাথা ছেড়ে দিল, সাথে সাথে বাচ্চাটা পানির নিচে তলিয়ে যায়, বাচ্চাটার চোখে মুখে বিন্দুমাত্র অস্বস্তির চিহ্ন নেই বরং খুবই স্বাভাবিক ভাবে সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার মুখ থেকে বড় বড় কয়েকটা বাতাসের বুদবুদ বের আসে। শামীম নিশ্বাস বন্ধ করে শিশুটির হৃৎস্পন্দন মাপে, একটা সতেজ কচি হৃৎপিণ্ড বুকের ভেতর ধ্বক ধ্বক করছে। কী বিচিত্র একটা দৃশ্য!
শামীম হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর রিতুর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি রিতু, আমার কি মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় এইবারে আমি এই বাচ্চাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারব। ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিতে হচ্ছে না বলে ফুসফুসটা বিশ্রাম পাচ্ছে, এখন নূতন এন্টিবায়োটিক চেষ্টা করতে পারব। তোর কি বিশ্বাস হচ্ছে রিতু? আমার একটুও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
পরদিন শামীম আলেক্সকে একটা ই-মেইল পাঠালো :
প্রিয় আলেক্স:
আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না, তারপরও আমি তোমাকে লিখছি। বিশ্বাস কর সাথে যে ছবিটা পাঠাচ্ছি সেটা সত্যি। আমার বাজায় বড় একটা একুয়ারিয়ামে ছোট একটি মেয়ে, বয়স সম্ভবত আটচল্লিশ ঘণ্টায় বেশি নয়। সে পানির নিচে শান্ত হয় ঘুমাচ্ছে, সে ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে না, নিশ্বাস নিচ্ছে তার তুক দিয়ে। তার শরীরে একটা রূপালী আভা লক্ষ্য করেছ? এটা এসেছে ত্বকের ওপরে খুব সূক্ষ্ম একটা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের আস্তরণ থেকে, নিশ্বাসের সাথে যেটা বের হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে আমি কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না, একটা পাম্প দিয়ে পানিতে অক্সিজেন মিশিয়ে যাচ্ছি।
মেয়েটির খুব খারাপ ধরনের নিমোনিয়া হয়েছিল, এইটুকুন শরীরে অনেক এন্টিবায়োটিক গিয়েছে। কাল থেকে আজকে সে অনেক খানি ভালো!
তোমার কী মনে হয়? জীব বিজ্ঞান বই কী নূতন করে লিখতে হবে?
শামীম।
পুনঃ ছবিটি, তোমার জন্যে-সাংবাদিকেরা হাতে পেলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
দুই মিনিটের ভেতর শামীম আলেক্সের কাছ থেকে একটা উত্তর পেলো:
প্রিয় শামীম,
আমি আসছি।
আলেক্স
পুনঃ আমার জন্যে বেশি করে ঝাল দিয়ে ভারতীয় কায়দায় মুরগির মাংস রান্না করে রেখো।
পুনঃ পুনঃ মৎস্যকন্যার জন্যে সম্ভাব্য কিছু ওষুধ, এন্টিবায়োটিক হরমোন, স্টেরয়েড, নিউট্রিয়েন্ট আনছি। কাস্টমস আটকালে উদ্ধার করার ব্যবস্থা রেখো।