০২. ঘুম ভাঙল খুব ভোরে

আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। ঘুমাতে ঘুমাতে সবসময় আমার দেরি হয়ে যায়, কখনোই আমি ভোরে উঠতে পারি না। আজ কিটি আমাকে ডেকে তুলল, পা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, রিকি, ওঠ। জরুরি দরকার।

কিটি ঠাট্টা, তামাশা, রসিকতা বা রহস্য বোঝে না। কাজেই সে যদি বলে জরুরি দরকার তার অর্থ সত্যিই জরুরি দরকার। আমি ধড়মড় করে চোখ খুলে উঠে বসলাম, কী হয়েছে?

তোমার কাছে দুজন লোক এসেছে।

কোথায়?

বসার ঘরে বসে আছে।

বসার ঘরে?

হ্যাঁ।

আমি বিছানা থেকে নামলাম, কারা এরা?

বিজ্ঞান পরিষদের লোক। মনে আছে কাল রাতে তোমার কাছে ইয়োরন রিসির চিঠি এসেছিল?

কার? আমি প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করলাম, কার?

ইয়োরন রিসির। বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক।

আমি চিৎকার করে বললাম, কোথায় সেই চিঠি? এতক্ষণে বলছ মানে? তোমার কপোট্রনে কি ফুটো হয়ে গেছে?

কিটি শান্ত গলায় বলল, তোমাকে আমি কাল রাতেই বলেছি। তুমি কোনো গুরুত্ব দাও নি। মনে নেই কাল তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলে? এই যে চিঠি।

আমি তার হাত থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে খুলে ফেললাম, চিঠিটা দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক ইয়োরন রিসি নিজের হাতে বিজ্ঞান পরিষদের প্যাডে লিখেছেন,

প্রিয় রিকি :
        তুমি কি কাল সময় করে আমাদের কয়েকজনের সাথে একটু দেখা করতে পারবে?
        –ইয়োরন রিসি।

আমার হাত কাঁপতে থাকে, চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ নিজের হাতে একটা চিঠি লিখে আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন! আমার সাথে? নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হয়েছে। আমি কিটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, নিশ্চয় কিছু ভুল হয়েছে।

কিটি বলল, বাজে কথা বোলোনা। বিজ্ঞান পরিষদ কখনো কোনো ভুল করে না। মহামান্য রিসি কখনো কোনো ভুল করেন না।

কিন্তু কিন্তু আমার সাথে মহামান্য রিসির কী দরকার থাকতে পারে? আমি তখনো একটা ঘোরের মাঝে রয়ে গেছি, শুকনো গলায় বললাম, কী দরকার?

এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? একটু পরেই তো জানতে পারবে। কিটি ঘুরঘুর করে পাশের ঘরে চলে গেল, সম্ভবত আমার জন্যে পরিষ্কার কাপড় জামা বের করবে। তার ভাবভঙ্গি খুব সহজ, দেখে মনে হয় বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালকের আমার সাথে দেখা করা একটা দৈনন্দিন ব্যাপার। নিচু স্তরের রবোটদের অবাক হবার ক্ষমতা নেই ব্যাপারটা আমি আগেও লক্ষ করেছি।

আমি ঘুমের কাপড়েই বসার ঘরে উঁকি দিলাম, ফুটফুটে একটা মেয়ে এবং মাঝবয়সী একজন মানুষ চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। তাদের ভাবভঙ্গি খুব সপ্রতিভ। আমাকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম আমরা?

কী ব্যাপার! আমি শুকনো গলায় বললাম, মহামান্য রিসি কেন দেখা করতে চান আমার সাথে?

লোকটা হো হো করে হেসে বলল, আপনি সত্যিই মনে করেন মহামান্য রিসি নিজে আপনার সাথে দেখা করতে চাইবেন আর আমাদের মতো মানুষ তার কারণটা জানবে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু আমার সাথে?

হ্যাঁ।

যদি আমি কাল বাসায় না থাকতাম? চিঠি যদি না পেতাম?

লোকটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, আপনি মনে করছেন মহামান্য রিসি যদি আপনার সাথে দেখা করতে চান তখন সেটা আমরা কখনো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিই? কখনোই দিই না!

আমি–আমি কখনো এত বড় মানুষের সাথে দেখা করি নি। কী করতে হয়, কী বলতে হয় কিছুই জানি না। ভালো কাপড়ও মনে হয় নেই আমার

সাথের মেয়েটি এই প্রথমবার কথা বলল, আপনি যেন সেসব নিয়ে মাথা না ঘামান সে জন্যেই আমরা এখানে এসেছি। মহামান্য রিসি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন সেটা হচ্ছে বড় কথা! আপনি যেভাবে সহজ বোধ করেন ঠিক সেভাবে থাকবেন। কোনোকিছু নিয়ে এক বিন্দু মাথা ঘামাবেন না।

আর কে কে সেখানে থাকবে?

আমরা তো জানি না। আমাদের জানার কথাও না!

কোনোরকম কি কিছু আভাস দিতে পারেন?

মধ্যবয়স্ক লোকটি এবারে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, রিকি–আপনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন। ব্যাপারটি কী আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত জানি আর যাই হোক এটা অশুভ হতে পারে না। আপনি যান, হাতমুখ ধুয়ে আসুন! একসাথে নাশতা করা যাক।

আমি ভিতরে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা বলল, একটা মাত্রার রবোট দেখলাম, আপনার রবোট এটা?

হ্যাঁ। কিটি।

কী আশ্চর্য! আমি কখনো সচল চতুর্থ মাত্রার রবোট দেখি নি। আমার ধারণা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

আমি হেসে বললাম, খোঁজ পেলে কিটিকেও সরিয়ে নেবে। আমি খোঁজ দিই নি। অনেকদিন থেকে আছে তাই মায়া পড়ে গেছে।

ও! মেয়েটা মনে হল একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কোনো তাড়াহুড়া করবেন না। আমরাই আপনাকে বিজ্ঞান পরিষদে নিয়ে যাব।

.

আমরা যখন বিজ্ঞান পরিষদে পৌঁছেছি তখনো বেশ সকাল। দরজায় নানা রকম কড়াকড়ি রয়েছে, সবার রেটিনা স্ক্যান করে ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে কিন্তু আমার কিছুই করতে হল না। সাথের দুজন আমাকে ভিতরে নিয়ে এসে অন্য দুজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল, তারা আবার অন্য দুজনের কাছে এবং এই দুজন আমাকে বিশাল একটি হলঘরে নিয়ে হাজির হল। ঘরটির দেয়াল অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের পাথরের তৈরী।

ছাদটি অনেক উঁচুতে, সেখান থেকে হালকা এক ধরনের আলো বের হচ্ছে, সমস্ত ঘরে কোমল এক ধরনের আলো। ঘরে কোনো জানালা নেই, শুধু মাঝখানে বিশাল একটা কালো টেবিল। টেবিলটি ঘিরে রয়েছে খুব সুন্দর অনেকগুলো চেয়ার, সুন্দর চেয়ার সাধারণত আরামদায়ক নয় কিন্তু আমি বসে বুঝতে পারলাম চেয়ারগুলো তৈরি হয়েছে অসম্ভব যত্ন করে, বসতে ভারি আরাম।

ঘরটিতে আমি ছাড়াও আর চার জন মানুষ, দুজন মেয়ে এবং দুজন পুরুষ। সবাই মোটামুটি আমার বয়সী, দেখে মনে হয় আমার সাথে তাদের সবার এক ধরনের মিল রয়েছে, কিন্তু মিলটুকু কোথায় আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। দুজন পুরুষ মানুষের মাঝে একজন খুব ছিমছাম পরিষ্কার, মাথার চুল পরিপাটি, কাপড় জামা সুন্দর এবং মোটামুটি রুচিসম্মত। সে আরামদায়ক চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে খুব শান্তভাবে বসে আছে। এমনিতে। দেখে বোঝা যায় না কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতেই বোঝা যায় মানুষটি ভিতরে ভিতরে খুব উদ্বিগ্ন।

ঘরের দ্বিতীয় মানুষটির মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ের জামাকাপড় যাচ্ছেতাই এবং চেহারাতে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব। তাকে দেখে মনে হয় কোনো কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। মেয়ে দুজনের একজন কোমল চেহারার, রাস্তায় ছোট শিশুর হাত ধরে যেরকম কমবয়সী মায়েদের হেঁটে যেতে দেখা যায় তার চেহারা অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইচ্ছে করলেই একটু সেজেগুঁজে নিজেকে অনেকখানি আকর্ষণীয়া করে ফেলতে পারত, কিন্তু মনে হয় তার সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। মেয়েটি টেবিলে দুই হাত রেখে শান্ত কিন্তু উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। দ্বিতীয় মেয়েটির চেহারা খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝকে। সে অস্থির এবং উদ্বিগ্ন এবং সেটা ঢেকে রাখার একটুও চেষ্টা করছে না। মেয়েটি চেয়ারে না বসে একটু পরে পরেই টেবিলটা ঘুরে আসছে, মসৃণ মার্বেল পাথরের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে ঘরটির একমাত্র শব্দ।

আমি আমার চেয়ারে বসে সবার দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝতে পারি আমাকে মহামান্য রিসি যেভাবে ডেকে এনেছেন, এদের চারজনকেও ঠিক সেভাবে ডেকে আনা হয়েছে। আমার মতোই এরা কেউ জানে না তারা কেন এখানে অপেক্ষা করছে।

ধারালো চেহারার মেয়েটি টেবিলটা আরো একবার ঘুরে এসে হঠাৎ আমার কাছে থেমে জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন জান?

মনে হয় আমরা যেন নিজেরা একটু কথা বলি সেজন্যে।

তাহলে কথা বলছি না কেন?

মনে হয় আমরা সবাই খুব ঘাবড়ে আছি!

আমার কথা শুনে সবাই একটু হেসে ফেলল। হাসি একটি চমৎকার ব্যাপার, মানুষকে চোখের পলকে সহজ করে দেয়। হঠাৎ সবাই সহজ হয়ে গেল। ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষটি বলল, আমাদের এখানে কেন এনেছে তোমরা কেউ আন্দাজ করতে পার?

আমি ভেবেছিলাম সবাই মাথা নেড়ে বলবে, না, পারি না। কিন্তু কেউ সেটি বলল না, একে অন্যের দিকে তাকাল এবং সবার চোখে সূক্ষ্ম বিস্ময়ের একটু ছায়া পড়ল। সবাই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে, ঠিক আমার মতোই! বারবার যে জিনিসটি আমার মাথায় উঁকি দিয়ে উঠছে এবং বারবার আমি যেটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিচ্ছি সেটা হয়তো সত্যি। সেটা সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র একভাবে, আমি আবার সবার দিকে ঘুরে তাকালাম এবং লক্ষ করলাম, সবাই ঠিক আমার মতোই অন্য সবার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে, সবিস্ময়ে!

ঠিক এই সময় নিঃশব্দে একটা দরজা খুলে গেল এবং বুড়োমতো একজন ছোটখাটো মানুষ হাতে ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। মানুষটি ছোট ছোট পায়ে হেঁটে আমাদের কাছে এগিয়ে এল এবং আমরা হঠাৎ করে তাকে চিনতে পারলাম, ইয়োরন রিসি! কতবার হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে এই মানুষটির ছবি দেখেছি কিন্তু কখনোই ভাবি নি তিনি এ রকম ছোটখাটো মানুষ। কেন জানি না ধারণা ছিল তিনি হবেন বিশাল, তার চেহারা হবে কান্তিময়, গায়ের রং হবে উজ্জ্বল, তার পোশাক হবে বর্ণময়–কিন্তু তিনি একেবারে সাধারণ চেহারার মানুষ। কিন্তু তাকে দেখে আমার আশাভঙ্গ হল না বরং বুকের ভিতরে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করতে থাকি। আমার এক ধরনের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চ হতে থাকে।

ইয়োরন রিসি টেবিলের কাছে এসে থেমে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কী! তোমরা সবাই এত দূরে দূরে বসেছ কেন? এস কাছাকাছি এস। এখানে এত বড় একটা টেবিল রাখাই ভুল হয়েছে।

আমি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে হাঁটুতে একটা চোট পেলাম। সে অবস্থাতেই তার যতটুকু কাছে গিয়ে বসা সম্ভব সেখানে বসে গেলাম। এই মানুষটির পাশে বসা দূরে থাকুক কোনোদিন নিজের চোখে দেখব ভাবি নি।

ইয়োরন রিসি আমাদের দিকে তাকালেন। তার মুখে এক ধরনের হাসি, দুষ্ট ছেলের দুষ্টুমি ধরে ফেলে সহৃদয় বাবারা যেভাবে হাসে অনেকটা সেরকম। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমি ইয়োরন রিসি। তোমরা কারা পরিচয় দিতে হবে না, আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালো করে চিনি।

আমরা পাঁচ জন অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমাদের বিস্ময়টুকু মনে হয় তিনি খুব উপভোগ করলেন, হা হা করে হেসে বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তোমাদের? এই দেখ আমি ঠিক বলি কি না—

ইয়োরন রিসি দাড়িগোঁফে ঢাকা জঙ্গুলে চেহারার মানুষটিকে দেখিয়ে বললেন, তুমি হিশান। তুমি একটা ব্যাংকে চাকরি কর। ছোট্ট চাকরি, তোমার কাজে মন নেই। উপরওয়ালা দুদিন পরে পরে তোমাকে হুমকি দিয়ে বলে তোমাকে ছাঁটাই করে দেবে। শীতের শুরুতে তুমি দাড়িগোঁফ রাখা শুরু কর, বসন্তের শেষে যখন একটু গরম পড়তে শুরু করে তখন তুমি দাড়িগোঁফ চুল কামিয়ে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যাও। ঠিক কি না, হিশান?।

হিশান নামের মানুষটি হেসে ফেলল। দাড়িগোঁফে আড়াল হয়ে থাকা মুখ থেকে সহৃদয় হাসিটি বের হতেই আমরা হঠাৎ করে টের পেলাম মানুষটিকে দেখে তিরিক্ষে বদমেজাজি মনে হলেও সে নেহাতই ভালো মানুষ।

ইয়োরন রিসি এবারে ছিমছাম পরিষ্কার মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ইগা। তোমার একটা গোপন ল্যাবরেটরি আছে সেখানে তুমি বিসুবিচারিয়াস বানাও। খোলাবাজারে মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি হয়, এত মজার নেশা আর কি আছে?

ইগার মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ইয়োরন্ রিসি হা হা করে হেসে তার প্যাকেটটা তুলে বললেন, তুমি ভাবছ কেউ জানে না? এই দেখ আমার কাছে তোমার কত বড় ফাইল!

ইগা নামের মানুষটি কী একটা কথা বলতে গেল, ইয়োরন রিসি তার কাধ স্পর্শ করে থামিয়ে দিয়ে চোখ মটকে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই ইগা। পুলিশ কোনোদিন তোমাকে ধরবে না। আমি আছি তোমার পিছনে।

ইগা ভয়ে ভয়ে ইয়োরন রিসির দিকে তাকাল, এখনো সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। বেশ দ্রুত তার মুখ থেকে ভয়ের চিহ্ন কেটে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। ইয়োরন রিসি এবারে ঘুরে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নুবা। তুমি দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াও। তোমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। ছুটির দিনে তুমি হেঁটে হেঁটে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাক। তুমি যে গ্রামে থাক সেখানকার সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করে, যদিও তাদের অনেকের ধারণা ভালো ওষুধপত্র খেলে তোমার চুপচাপ একা একা বসে থাকার রোগ ভালো হয়ে যাবে।

ইয়োরন রিসির সাথে সাথে আমরাও হেসে উঠলাম। তিনি হাসি থামিয়ে এবার খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকমকে চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি য়োমি। একটা খবরের কাগজের অফিসে কাজ কর। অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ, ভিডিও সেন্টারে বসে থাকা, লোকজনের যার যত সমস্যা আছে, অভিযোগ আছে তোমার কাছে বলে। মাঝে মাঝেই কিছু খ্যাপা গোছের মানুষ বের হয়ে যায়–তোমাকে খামখাই যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে। তুমি গত দুই বছর থেকে ভাবছ এই কাজ ছেড়ে দেবে কিন্তু তবু ছাড়ছ না।

ইয়োরন রিসি এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রিকি। তোমার বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই। তোমার অনেকদিনের ভালবাসার মেয়েটিও গতকাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার ধারণা তোমার জীবন নিয়ে খুব উচ্চাশা নেই। সত্যি কথা বলতে কী তোমার পরিচিতদের সবারই তাই ধারণা। এখানে অন্য চার জন কিছু–না–কিছু কাজ করে, তুমি কিছুই কর না। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হচ্ছে চার মাত্রার একটা রবোট!

ইয়োরন রিসি আবার হা হা করে হাসলেন এবং অন্য সবাই সেই হাসিতে যোগ দিল। চার মাত্রার একটি রবোটের সাথে একজন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয় ঠাট্টা করে বলা হয়েছে। ইয়োরন রিসি সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, আমি কি কারো সম্পর্কে ভুল কিছু বলেছি?

আমরা মাথা নাড়লাম, না।

তোমাদের এই পাঁচ জনকে আমি এখানে কেন এনেছি জান?

আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, তোমাদের জানার কথা নয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত তবু তোমরা জান। কারণ তোমরা কেউ সাধারণ মানুষ নও। তোমরা প্রত্যেকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। ঈশ্বর সম্ভবত নিজের হাতে তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরোন সেলগুলো একটি একটি করে সাজিয়েছেন। তোমাদের মস্তিষ্কের যে ক্ষমতা–একজন মানুষের মস্তিষ্ক কেমন করে সেরকম ক্ষমতাশালী হতে পারে সেটা একটা রহস্য।

ইয়োরন রিসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমরা নিজেরা জান যে তোমরা সাধারণ মানুষ নও। তোমাদের প্রত্যেকে অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছ কিন্তু তোমরা সেটা প্রাণপণে সবার কাছে গোপন করে রাখ। শুধু যে অন্যদের কাছে গোপন রাখ। তাই নয়, অনেক সময় তোমরা তোমাদের নিজেদের কাছে পর্যন্ত গোপন করে রাখ। কেন সেটা কর আমাদের কাছে, বিজ্ঞান পরিষদের কাছে তা একটা মস্ত বড় রহস্য। ইচ্ছে করলেই তোমরা পৃথিবীর যত সম্পদ, যত সম্মান, ভালবাসা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবকিছু পেতে। পার। কিন্তু তোমরা সেটা চাও না। হিশান একটা ব্যাংকে কষ্ট করে কাজ কর, ইগা জেলে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নেশার ওষুধ তৈরি কর, নুবা একটা স্কুলে পড়াও, য়োমি খবরের কাগজের অফিসে খ্যাপা মানুষদের অভিযোগ শুনে সময় কাটাও, রিকি ভালবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যেতে দাও। কেন এটা কর আমরা কেউ জানি না। মনে হয় কোনোদিন জানবও না। মানুষের মন খুব বিচিত্র একে কেউ বোঝে না। আমরা তাই তোমাদের কখনো বিরক্ত করি নি। তোমাদের একটু চোখে চোখে রেখেছি, একটু আগলে রেখেছি কিন্তু কখনোই তোমাদের স্বাধীন জীবনে হাত দিই নি। কখনো না।

ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবেছিলাম কখনো দেব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না। তোমাদের মতো মানুষদের একটা ছোট লিস্ট আছে আমার কাছে। সেখান থেকে বেছে বেছে আমি তোমাদের পাঁচ জনকে আজ এখানে ডেকে এনেছি। কেন ডেনে এনেছি জান?

হিশান তার লম্বা চুলে হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমাদের একটা সমস্যা সমাধান করতে হবে?

ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন– হ্যাঁ। কী সমস্যা বলতে পারবে?

ইগা বলল, কঠিন কোনো সমস্যা? যার সাথে

যার সাথে?

যার সাথে পৃথিবীর অস্তিত্ব জড়িত?

হ্যাঁ। হঠাৎ করে ইয়োরন রিসির মুখ কেমন জানি বিষণ্ন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বললেন, পৃথিবীর খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ।

তিনি হঠাৎ ঘুরে নুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, নুবা তুমি বলতে পারবে কী বিপদ?

আমি?

হ্যাঁ।

আমাকে যখন জিজ্ঞেস করছেন তার মানে এর সাথে ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার যোগাযোগ আছে।

ইয়োরন রিসি কোনো কথা বললেন না, আমি দেখতে পেলাম হঠাৎ করে নুবার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, শ্যালন গ্রুন ফিরে এসেছে?

ইয়োরন রিসি অত্যন্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ নুবা। আমাদের খুব দুর্ভাগ্য শ্যালক্স গ্রুন গত সপ্তাহে পৃথিবীতে অবতরণ করেছে।

আমি হঠাৎ আতঙ্কের একটা শীতল স্রোতকে মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যেতে অনুভব করলাম।