ঘুম থেকে উঠে কী হচ্ছে বুঝতে রুহানের একটু সময় লাগল। লাথি দিয়ে দরজা খুলে তার ঘরে কয়েকজন ঢুকে গেছে। কিছু বোঝার আগেই একজন রুহানকে টেনে বিছানা থেকে তুলে নেয়, তারপর ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। আবছা আলোয় মানুষগুলোর চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, শুধু নিষ্ঠুরতার ছাপটুকু বোঝা যায়। তারা আলগোছে লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ধরে রেখেছে, বুকের উপর গুলির বেল্ট, মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা। পিঠে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঠেকিয়ে যে মানুষটি রুহানকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে সে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষটি রুহানকে ধাক্কা দিয়ে একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে বলল, এত খবরে তোমার দরকার কী?
রুহান হলঘরে এসে দেখল তার মা নুবা আর ত্রিনাকে দুইহাতে শক্ত করে ধরে রেখে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চোখে মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, নুবা ত্রিনার মুখে বিস্ময়। রুহানকে ঠেলে নিয়ে আসতে দেখে মা কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে কী করেছে? তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষগুলো তার কথার কোনো উত্তর দিল না। তখন মা ছুটে এসে একজনের হাত ধরে বলল, কী হলো? তোমরা কথা বলছ না কেন? কী করেছে আমার ছেলে?
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার ছেলে কিছু করে নাই।
তাহলে তাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ? এই সময়ে কিছু না করাটাই অপরাধ।
কম বয়সী হালকা পাতলা একটা মানুষ হা হা করে হেসে উঠল, যেন খুব মজার একটা কথা শুনতে পেয়েছে। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকই বলেছ। সারা দুনিয়াতে মারামারি হচ্ছে আর জোয়ান একটা ছেলে কিছু না করে ঘরে বসে থাকবে মানে?
মা পিছু পিছু এসে বলল, কিন্তু আমার ছেলে তো কখনো মারামারি করে নি। কখনো কোনো অন্যায় করেনি–
হালকা পাতলা মানুষটা বলল, আমরাই কী আগে করেছি নাকি? শিখে নিয়েছি। তোমার ছেলেও শিখে নেবে। যুদ্ধ করার জন্যে যৌবন কাল হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়।
মা মানুষটার হাত ধরে বলল, দোহাই লাগে তোমাদের। আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। তোমাদের পায়ে পড়ি–
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ধাক্কা সামলাতে গিয়ে মা পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে দেওয়াল ধরে। নিজেকে সামলে নেয়। নুবা আর ত্রিনা ভয় পেয়ে ছুটে এসে তাদের মাকে দুই পাশ থেকে জাপটে ধরে ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
রুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তাকে ধাক্কা মেরে বাসার বাইরে নিয়ে এলো। রাস্তায় বড় বড় কয়েকটা লরি হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লরির ইঞ্জিনগুলো ঘরঘর শব্দ করছে। গ্রামের চারপাশে ভয়ঙ্কর ধরনের কিছু মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হেডলাইটের তীব্র আলোতে এই মানুষগুলোকে কেমন যেন অস্বাভাবিক হিংস্র দেখায়। রুহান দেখতে পেল গ্রামে তার বয়সী যত যুবক সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, ভীত মুখে তারা দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই ঘুমের পোশাকে, চুল উষ্কখুষ্ক, চোখে মুখে হতচকিত বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। রুহান গ্রউসকেও দেখতে পেল, তাকেও একজন ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে আসছে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আলগোছে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। তার মাথায় একটা রঙিন রুমাল বাঁধা, পরনে জলপাই রঙের সামরিক পোশাক। বুকের উপর গুলির বেল্ট এবং কোমর থেকে। যোগাযোগ মডিউল ঝুলছে। তার হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল, সেটি হাতে নিয়ে
সে চিৎকার করে বলল, সবাই এক লাইনে দাঁড়াও।
ঠিক কীভাবে সবাই হঠাৎ করে এক লাইনে দাঁড়াবে, লাইনটি কী সামনে পিছনে হবে না পাশাপাশি হবে সেটা নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের মুখে আঘাত মেরে চিৎকার করে বলল, ইঁদুরের বাচ্চার মতো ছুটাছুটি করছ কেন? পাশাপাশি দাঁড়াও সব নর্দমার পোকা।
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সে অপমান কিংবা ক্রোধ অনুভব করে না, তার ভেতরে ভয় বা আতঙ্কও নেই। সত্যি কথা বলতে কী হঠাৎ করে তার বিস্মিত হবার ক্ষমতাটুকুও চলে গেছে। সে একটা অবিশ্বাস্য ঘোরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চারপাশে কী ঘটছে সে যেন ঠিক বুঝতেও পারে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখল তার দুপাশে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়স্ক মানুষটি মশালের আলোতে খুব কাছে থেকে তাদের একজন একজন করে পরীক্ষা করল। যাদেরকে দুর্বল বা রুগ্ন মনে হলো। তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, যাও, নোংরা আবর্জনা, ছারপোকার বাচ্চারা–ভাগ এখান থেকে।
রুহানের সামনে মানুষটা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ রক্তাভ এবং শরীর থেকে এক ধরনের কটু গন্ধ বের হয়ে আসছে। রুহানের মনে হলো মানুষটা একটা কিছু বলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।
সবাইকে এক নজর দেখে মানুষটা আবার সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হতভাগা জানোয়ারের বাচ্চারা, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, বিষ্ঠার সাগরে তোমাদের ড়ুবে মরা উচিত। ছারপোকার বাচ্চাদের মতো তোমাদের টিপে টিপে মারা উচিত। একেকজন এরকম দামড়া জোয়ান হয়ে তোমরা ঘরে বসে আছ, তোমাদের লজ্জা করে না?
মানুষটি সবার দিকে তাকাল, কেউ কোনো উত্তর দিল না।
কথা বলছ না কেন, আহাম্মকের বাচ্চারা?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মাটিতে থুতু ফেলে বলল, এই জঙ্গলের মাঝে থাক, দুনিয়ার কোনো খোঁজ খবর রাখ না। তোমরা কী জান সারা পৃথিবীতে এখন কী হচ্ছে? মানুষটা সবার দিকে একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, জান না! আমি জানতাম তোমরা জানবে না। সারা দুনিয়ায় এখন যুদ্ধ হচ্ছে। সবার সাথে সবার যুদ্ধ। যার গায়ে জোর আছে, যার শক্তি আছে সে টিকে থাকবে। যার জোর নাই, শক্তি নাই সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন তোমরা বল, তোমরা কী টিকে থাকতে চাও নাকি ধ্বংস হতে চাও?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা তখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা বাঁকিয়ে বলল, কেউ কথা বল না কেন?
ভয় পেয়ে কয়েকজন বিড় বিড় করে বলল, টিকে থাকতে চাই।
চমৎকার! মানুষটা তার নোংরা দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমরা তোমাদের টিকে থাকার একটা সুযোগ করে দেব। এই নতুন পৃথিবীতে নতুন নিয়ম। যার জোর আছে, ক্ষমতা আছে সে যেটা বলবে সেটাই হবে। নিয়ম। যার জোর নাই সে মাথা নিচু করে সেই নিয়ম মানবে। বুঝেছ?
রুহান একটু অবাক হয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকাল। গ্রাউস যে কথাগুলো বলেছিল এই মানুষটি ঠিক সেই কথাটাই বলছে। তাহলে কী নতুন পৃথিবীতে এইটাই নিয়ম? যার ক্ষমতা আছে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে? পৃথিবীতে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু থাকবে না? সত্যি-মিথ্যা বলে কিছু থাকবে না? যার ক্ষমতা আছে সে যত বড় দানবই হোক, তার ইচ্ছেটাই হবে সব?
ঠিক তখন কে যেন কিছু একটা বলল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, কে কথা বলে?
রুহান এবারে শুনল গ্রাউস বলছে, আমি। আমি কথা বলছি।
তুমি কী বলতে চাও ছেলে?
গ্রাউস উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি যেটা বলছ আমিও সেটা বলি। আমাদের গ্রামে আমি সেটা শুরু করেছি।
তুমি শুরু করেছ?
হ্যাঁ।
কী শুরু করেছ?
এই গ্রামে আমার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, আমি তাই সবাইকে বলেছি আমার ইচ্ছাটাই নিয়ম। আমি যা খুশি তা করতে পারি।
সত্যি?
হ্যাঁ। তুমি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ–সবাই এখন আমাকে ভয় পায়।
মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, তুমি সামনে এসো।
গ্রাউস তখন সামনে এগিয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মশালের আলোতে গ্রাউসকে ভালো করে দেখে তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আসলেই একে ভয় পাও?
কয়েকজন বিড়বিড় করে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলল, তার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে।
গ্রাউস গলায় একটু উত্তেজনা এনে বলল, আমার সোলার প্যানেলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি একজনের বাসা থেকে সেটা খুলে এনেছি। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। সেদিন কমবয়েসী একটা মেয়েকেও তুলে আনতে গিয়েছিলাম-
চমৎকার! মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে হাসি আরও বিস্তৃত হয়, পৃথিবীর নতুন নিয়মটা তুমি তোমার গ্রামে চালু করে দিয়েছ, জোর যার ক্ষমতা তার?
গ্রাউসের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর হঠাৎ করে হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে গ্রাউসের মাথায় ধরে বলল, দেখি তোমার কতটুকু ক্ষমতা।
মুহূর্তে গাউসের মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে বিস্ফারিত চোখে মধ্যবয়স্ক নিষ্ঠুর মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। খুব বড় একটা রসিকতা হচ্ছে এরকম একটা ভান করে নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়সী মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরে। কর্কশ কান ফাটানো একটা শব্দ হলো, রুহান শিউরে উঠে দেখল গ্রাউসের দেহটা একটু লাফিয়ে উঠে নিচে পড়ে যায়। রুহানের মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা আবার আলগোছে ধরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আর কেউ আছে নাকি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কী শিখলে তোমরা। এই ঘটনা থেকে?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, আসলে তোমরা নতুন কিছু শেখ নাই। আমি যেটা বলেছি সেটা শুধু তোমাদের হাতে কলমে দেখালাম, এর বেশি কিছু নয়। আমার হাতে অস্ত্র তাই আমার কাছে ক্ষমতা। আমি যাকে ইচ্ছা খুন করতে পারি। পৃথিবীর কেউ কিছু করতে পারবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা পা দিয়ে গ্রাউসকে দেখিয়ে বলল, এই আহাম্মকটা দাবি করছিল তার অনেক ক্ষমতা! আসলে তার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। খালি হাতে ক্ষমতা হয় না! ক্ষমতার জন্যে দরকার অস্ত্র। বুঝেছ?
দুই-একজন দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। মানুষটা হাতের মশালটা একটু উপরে তুলে বলল, তোমাদের সবার হাতে আমি অস্ত্র দেব। আমি দেখব তোমাদের কয়জন সেই অস্ত্রের মর্যাদা রাখতে পারে।
রুহান নিঃশব্দে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যিই একজন মানুষ! তার যে কথাগুলো সে শুনছে, সত্যিই একজন মানুষ সেগুলো বলছে।
মানুষটি এবার আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি। এসে নিচু গলায় বলল, তোমরা সবাই এখন এই লরিগুলোর পিছনে গিয়ে ওঠ। আমি ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।
সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একজন ভাঙ্গা গলায় বলল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষটি শীতল গলায় বলল, আমি কী তোমাদের বলেছি যে তোমরা আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে? বলেছি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটি এবারে হুংকার দিয়ে বলল, সবাই গরিতে ওঠ। যে পিছনে পড়ে থাকবে সে পিছনেই পড়ে থাকবে। অকর্মা বেজন্মা আহম্মকদের এই পৃথিবীতে কোনো জায়গা নেই।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সশস্ত্র মানুষগুলো হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো তুলে ২৩স্তত গুলি করতে থাকে। প্রচণ্ড গুলির শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যায়। তার মাঝে ভয়ে আতঙ্কে অধীর হয়ে সবাই ছোটাছুটি করে লরিতে উঠতে থাকে। পায় সাথে সাথেই লরিগুলোর ইঞ্জিন গর্জন করে পাথুরে পথের উপর দিয়ে ছুটে (ঠতে শুরু করে। হৃদের পাশ দিয়ে যাবার সময় রুহান তাদের ছোট বাসাটা দেখতে পেল। বাসার দরজায় মূর্তির মতো তার মা ছোট বোন দুটিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না, রুহান জানে না আর কোনোদিন তাদের সাথে দেখা হবে কি না।
লরির পিছনে পা ঝুলিয়ে চারজন সশস্ত্র মানুষ বসে আছে। একটু আগেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তারা একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। লরি চলতে শুরু করার সাথে সাথে তারা বেশ সহজ ব্যবহার করতে শুরু করল। একজন বেসুরো গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করে, অন্যেরা সেটা নিয়ে হাসি তামাশা করে।
রুহানের পাশে তাদের গ্রামের সবচেয়ে নিরীহ ছেলে কিলি বসেছিল, অন্ধকারে দেখা যায় না কিন্তু রুহান মোটামুটি নিশ্চিত, সে বসে বসে কাঁদছে। এক সময় ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রুহান।
রুহান বলল, আমি জানি না।
তোমার কী মনে হয় রুহান, আমাদের কি মেরে ফেলবে?
কেন? শুধু শুধু মেরে ফেলবে কেন?
গ্রাউসকে যে মেরে ফেলল।
গ্রাউসকে মেরেছে কারণ সে ছিল আহাম্মক। তুমি আর আমি কী আহাম্মক?
কিলি মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা আহাম্মক না। কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমার খুব ভয় করছে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ভয় পাবার কথা তখন ভয় পেতে হয়। যারা কখনো ভয় পায় না তারা স্বাভাবিক না।
কিলি বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে লরিগুলো সারি বেঁধে ছুটে চলেছে। চাঁদ ড়ুবে গিয়ে বাইরে অন্ধকার। শরতের শেষ রাতের হিমেল বাতাসে রহান একটু শিউরে উঠল, এভাবে ধরে নিয়ে যাবে জানলে সে নিশ্চয়ই একটা গরম জ্যাকেট পরে আসত।
কিলি আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুহান।
বলো।
ওরা আমাদের নিয়ে কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, জানি না।
আমাদের অস্ত্র চালানো শেখাবে, যুদ্ধ করতে শেখাবে এটা কী তোমার সত্যি মনে হয়।
হতেও পারে। পৃথিবীতে এখন খুব খারাপ সময়। সব জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধ করার মানুষের খুব অভাব।
কিলি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব অস্থির লাগছে রুহান।
রুহান কিলির ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ধৈর্য ধরো কিলি, দেখবে এক সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক এরকম সময়ে হঠাৎ করে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা চারজন অস্ত্র তাক করে উবু হয়ে বসে গেল। একজন চাপা গলায় বলল, সবাই মেঝেতে মাথা নিচু করে শুয়ে থাক। উঠবে না। খবরদার।
রুহান অন্য সবার সাথে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে থাকে। শুনতে পায় তাদের মাথার উপর দিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে গুলি ছুটে যাচ্ছে। লরিতে বসে থাকা চারজন সশস্ত্র মানুষ ছাড়া ছাড়া ভাবে গুলি করছে, তার শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা।
যেভাবে গুলি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে গুলি থেমে গেল। সশস্ত্র মানুষগুলো আবার পা ঝুলিয়ে বসে হালকা গলায় কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনেই হয় না একটু আগে সবাই এত ভয়ঙ্কর গোলাগুলির ভেতর দিয়ে এসেছে। আর সেই ভয়ঙ্কর গোলাগুলিতে যে কেউ মারা পড়তে পারত।
রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, শোনো। তোমাদের সাথে আমি একটু কথা বলতে পারি।
একজন মাথা ঘুরিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কী কথা?
সাধারণ কথা।
মানুষটি কঠিন গলায় বলল, তোমরা ভেতরে এতজন আছ, নিজেদের ভেতরে কথা বল। আমাদের সাথে কেন কথা বলতে চাইছ?
রুহান বলল, ভেতরে যারা আছে এখন তাদের কারো কথা বলার আগ্রহ নেই।
সে খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভাব করে মানুষটা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, কেন? কথা বলার আগ্রহ নেই কেন?
তোমাদের যদি কেউ মাঝরাতে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেত তাহলে তোমাদেরও কথা বলার কোনো আগ্রহ থাকত না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, এই! এ তো কথাটা মিথ্যা বলে নাই। মনে আছে আমাদের যেদিন ধরে এনেছিল, তখন আমরা কী ভয় পেয়েছিলাম?
রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমাদেরকেও ধরে এনেছিল!
ধরে না আনলে কেউ নিজে থেকে আসবে নাকি?
কেন ধরে এনেছিল?
মানুষটা হাত দিয়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, দুদিন পরে তো নিজেরাই দেখবে। এখন এত কৌতূহল কেন?
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কৌতূহল খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
মানুষটা মাথা নাড়ল, চলন্ত লরি থেকে পিচিক করে নিচে একটু থুতু ফেলে বলল, ব্যবসা।
রুহান বলল, ব্যবসা?
হ্যাঁ। ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
মানুষের। তোমাদের ধরে এনেছি বিক্রি করার জন্যে।
বিক্রি করার জন্যে?
হ্যাঁ।
রুহান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, কার কাছে বিক্রি করবে?
যে ভালো দাম দেবে তার কাছে।
রুহান এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, যারা ভালো দাম দেবে তাদের কাছে বিক্রি করে দেবে?
হ্যাঁ। অনেক বড় বড় পার্টি আছে। এখন সবচেয়ে বড় যে পার্টি তার নাম ক্রিভান।
ক্রিভান?
হ্যাঁ। সে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। রাতকে দিন করতে পারে দিনকে রাত।
তারা আমাদের নিয়ে কী করবে?
যুদ্ধ করার জন্যে অনেক মানুষের দরকার। ভালো যোদ্ধা পাওয়া খুব সোজা কথা না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, সবাইকে তো আর যুদ্ধ করার। জন্যে কেনে না, অন্য কাজেও কেনে।
অন্য কী কাজে কেনে?
যদি কারো ভালো বুদ্ধি-শুদ্ধি থাকে তাহলে তার মগজটা ব্যবহার করা হয়। মাথার মাঝে ফুটো করে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ইমপালস পাঠিয়ে হিসেব নিকেশ করে। তাদেরকে বলে সক্রেটিস।
রুহান নিজের অজান্তে কেমন যেন শিউরে উঠল, সশস্ত্র মানুষটি সেটা লক্ষ্য করল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ক্লোন করার মেশিন তো আজকাল আর পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এইগুলোর জন্যেও বিক্রি হয়। ভালো একজোড়া কিডনির অনেক দাম।
প্রথম মানুষটি বলল, সবচেয়ে বেশি দামে কী বিক্রি হয় জান?
কী?
খেলোয়াড়।
রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়?
হ্যাঁ। একটা খেলোয়াড় মগজে ইলেকট্রড লাগানো সক্রেটিস থেকেও একশ দুইশ গুন বেশি দামে বিক্রি হয়।
কীসের খেলোয়াড়?
মানুষটি হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ করে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সবকিছু আগেই জেনে ফেললে হবে কেমন করে? সময় হলে জানবে।
দ্বিতীয়জন বলল, এখন তোমরা ঘুমাও। অনেক দূর যেতে হবে।
প্রথমজন বলল, এত দামি কারগো নিচ্ছি রাস্তাঘাটে অনেক হামলা হবে। গোলাগুলি শুরু হলেই তোমরা মেঝেতে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকবে। বুঝেছ?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
রুহান তার নিজের জায়গায় ফিরে আসে। পা ছড়িয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মা আর দুই বোন নুবা আর ত্রিনা এখন কী করছে কে জানে। সে কী আর কোনোদিন তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে?
পাহাড়ী একটা পথ দিয়ে গর্জন করে লরিগুলো ছুটে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কত রকম অজানা বিপদ গুড়ি মেরে আছে। রুহান জানে আজ রাতে তার চোখে ঘুম আসবে না।
কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে সে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ল।