০২. গাড়ি ছেড়ে দিল

হাতলে হাত রাখবার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।

এত অল্প সময়ে কী করে যে গতি এমন বেড়ে যায় ভাবতে ভাবতে লী বাতাসের ধাক্কা সামলাতে লাগল। হাতল খুব শক্ত করে বা আছে, তবু দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। বা হাতে মস্ত একটা ব্যাগ থাকায় সে হাতটা অকেজো। দেরি করবার সময় নেই, টুরিষ্ট ট্রেনগুলি অসম্ভব গতিতে চলে। কে জানে হয়তো এরই মধ্যে ঘণ্টায় দুশো মাইল দিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে হাতের কালো ব্যাগটা ছুটে বেরিয়ে যাবে,।

এই মেয়ে, ব্যাগ ফেলে দু হতে হাতল ধর।

বুড়োমতো একজন ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছেন। ঠিক কখন যে তিনি দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, লী লক্ষই করে নি। সে চেঁচিয়ে বলল, ব্যাগ ফেলা যাবে না। আপনি আমার কোমরের বেল্ট ধরে টেনে তুলুন না। দয়া করে।

লীর ধাতস্থ হতে সময় লাগল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ধন্যবাদ। আরেকটু দেরি হলে উড়েই যেতাম।

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। লঔজ্জতভাবে বললেন, এই কামরার-বিপদ সংকেতের বোতামটা আমি খুঁজে পাই নি, পেলে এত অসুবিধা হত না।

ঐ তো বোতামটা, কী আশ্চৰ্য, এটা দেখেন নি!

উঁহু। বুড়ো মানুষ তো।

লীর মনে হল এই লোকটি তার খুব চেনা। যেন দীর্ঘকালের গভীর পরিচয়। অথচ কোথাস, কী সূত্রে, তার কিছুই মনে নেই।

লী বলল, আপনাকে চিনি চিনি মনে হচ্ছে।

হচ্ছে নাকি?

আপনি সিনেমায় অভিনয় করেন? সিনেমার লোকদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে খুব চেনা চেনা মনে হয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আপনি কখনো সিনেমার অভিনেতাদের রাস্তায় দেখেন নি?

না।

আমি দেখেছি। হাপারকে দুদিন দেখেছি।

তুমি কি নিজেও সিনেমা কর?

না। কেন বলুন তো?

খুব সুন্দর চেহারা তোমার, সেই জন্যেই বলছি।

যান! বেশ লোক তো আপনি 1

কী নাম তোমার?

লী।

শুধু লী?

হ্যাঁ, শুধু লী।

লী চুলের ক্লিপ খুলে চুল আঁচড়াতে লাগল। বুড়ো ভদ্রলোক হাসতে হাসতে পা নাচাতে লাগলেন। লী বলল, এই সম্পূৰ্ণ কামরা আপনি রিজার্ভ করেছেন?

হ্যাঁ।

আপনি খুব বড়লোক বুঝি?

হ্যাঁ।

সত্যি বলছি, আমারও খুব বড়লোক হতে ইচ্ছে করে!

কী কর তুমি?

প্রাচীন বই বিভাগে কাজ করি। জানেন, আমি অনেক প্রাচীন বই পড়ে ফেলেছি।

বেশ তো।

জানেন, হিতার বলে একটা বই পড়ে আমি কত যে কেঁদেছি।

তুমি দেখি ভারী ছেলেমানুষ, বই পড়ে বুঝি কেউ কাঁদে?

আপনি বুঝি বই পড়েন না?

পড়ি, তবে কাঁদি না। তাছাড়া বাজে বই পড়ার সময় কোথায় বল?

লী বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার মনে হল বুড়ো ভদ্রলোকটি তাকে খুব ভালো করেই চেনেন। কথা বলছেন এমনভাবে, যেন কতদিনের চেনা। অথচ কথার ভিতর কোনো মিল নেই। লী বলল, পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এতে আপনার খারাপ লাগে না?

না।

কেন?

ধবংস তো একদিন হিন্তই।

কিন্তু আপনি যে মরে যাবেন।

আর পৃথিবী ধ্বংস না হলেই বুঝি আমি অমর হয়ে থাকব?

লী চুপ করে থাকল। হুঁ হুঁ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ভদ্রলোক শুয়ে শুয়ে নিবিষ্ট মনে কী যেন পড়ছেন, কোনো দিকে হুঁশ নেই। কী এমন বই এত আগ্রহ করে পড়া হচ্ছে, দেখতে গিয়ে লী হতবাক। শিশুদের একটা ছড়ার বই। আরোল-তাবোল ছড়া। লী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ছড়ার বই পড়তে আপনার ভালো লাগছে?

খুব ভালো লাগছে। পড়লে তোমারও ভালো লাগবে, এই দেখ না। কী লিখেছে–

করা ভাই হল্লা
নেই কোনো বল্লা
চারিদিকে ফল্লা

লী বিস্মিত হয়ে বলল, বল্লাই বা কী আর ফল্লাই বা কী? আরোল-তাবোল লিখলেই হল?

ভদ্রলোক বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, না, কোনো অর্থ অবশ্যি নেই, তবে শুধু মাত্র ধ্বনি থেকেই তো একটা অর্থ পাওয়া যাচ্ছে।

কী রকম?

ছড়াটা শুনেই কি তোমার মনে হয় নি যে, কোনো অসুবিধে নেই, হল্লা করে বেড়াও। তাই না?

লী মাথা নাড়ল। সে ভাবছিল, লোকটা কে হতে পারে, এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেন? তাকানির ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি, সমস্ত যেন কত চেনা, অথচ কিছুতেই মনে আসছে না।

নিঃশব্দে ট্রেন চলছে। সন্ধা হয়ে আসায় হলুদ বিষন্ন আলো এসে পড়েছে ভেতরে। এ সমযটাতে সবকিছুই অপরিচিত মনে হয়। জানালা দিয়ে তাকালেই দ্রুত সরে সরে যাওয়া গাছগুলি কেও মনে হয় অচেনা। সঙ্গী ভদ্রলোক কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। লী কিছু করার না পেয়ে ধুসর রঙের টেলিভিশন সেটটি চালু করে দিল। সেই একঘেয়ে পুরনো অনুষ্ঠান। ঘন ন জরুরী নির্দেশাবলী, গুজব ছড়াবেন না। বিজ্ঞানীরা আপনাদের সঙ্গেই আছেন। মহাসংকট আসন্ন, সেখানে ধৈর্য হারান মানেই পরাজয়।

এই জাতীয় খবর শুনলে মন খারাপ হয়ে যায় লীর। ভূতুড়ে টাইফা গ্রহ সবকিছু কেমন পাল্টে দিল। লীর কতই বা বয়স, কিছুই দেখা হয় নি। মঙ্গল গ্রহে নয়, বুধে নয়, এমন কি চাঁদে পর্যন্ত যাস নি। এমনি করেই সব শেষ হয়ে যাবে? লীর চোখ ছলছল করতে থাকে। একবার যদি দেখা করা যেত মাথুর কিংবা ফিহার সাথে। নিদেনপক্ষে সিরান-পল্লীর যে কোনো এক জন বিজ্ঞানীর সঙ্গে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা কারো সঙ্গেই দেখা করবেন না। তাঁরা অসম্ভব ব্যস্ত! চেষ্টা তো লী কম করে নি।

কী হয়েছে লী?

লী চমকে বলল, কই, কিছু হয় নি তো।

কাঁদছিলে কেন?

কাঁদছি, না তো।

পৃথিবীর জন্যে কষ্ট হয়?

পৃথিবীর জন্যে নয়, আমার নিজের জন্যেই কষ্ট হয়।

আচ্ছা আমি তোমার মন ভালো করে দিচ্ছি, একটা হাসির গল্প বলছি।

বলুন।

ভদ্রলোক বলে চললেন, জীববিদ্যার এক অধ্যাপক প্রতিদিন দুপুরে বড়সড় একটা মটন চাপ খেয়ে ক্লাস নিতে যান। একদিম। তিনি ক্লাসে এসে বললেন, আজ তোমাদের ব্যাঙের হৃৎপিন্ড পড়াব। এই দেখি একটি ব্যাঙ। ছেলেরা সমস্বরে বলল, ব্যাঙ কোথায় স্যার, এটি তো একটি চপ। অধ্যাপক বিব্রত হয়ে বললেন, সে কী! আমি তাহলে কী দিয়ে লাঞ্চ সেরেছি?

লী স্নান হেসে চুপ করে রইল। ভদ্রলোক বললেন, তুমি হাসলে না যে? ভালো লাগে নি?

লেগেছে। কিন্তু টেলিভিশন দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছা হয় একবার মাথুর কিংবা ফিহার সঙ্গে দেখা করি।

তাদের সঙ্গে দেখা করে তুমি কী করবে?

আমার কাছে একটি অদ্ভুত জিনিস আছে। একটি খুব প্রাচীন বই। পাঁচ হাজার বছর আগের লেখা, মাইক্রোফিল্ম করা। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ পেয়েছি।

কী আছে সেখানে?

না পড়লে বুঝতে পারবেন না। সেখানে ফিহার নাম আছে, সিরান-পল্লীর কথা আছে, এমন কি পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সে কথাও আছে।

বুড়ো ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, আরে, থাম থাম। পাঁচ হাজার বছর আগের বই, অথচ ফিহার নাম আছে!

লী উত্তেজিত হয়ে বলল, সমস্ত না শুনলে আপনি এর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন না।

আমি এর গুরুত্ব বুঝতে চাই না! আমি উদ্ভট কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না।

লী রেগে গিয়ে বলল, আপনি উদ্ভট কোনো কিছুতে বিশ্বাস করেন না, কারণ আপনি নিজেই একটা উদ্ভট জিনিস।

ভদ্রলোক হা হা করে হেসে ফেললেন। লী বলল, আমি যদি মাথুর কিংবা ফিহা কিংবা সিরান-পল্লীর কারো সঙ্গে দেখা করতে পারতাম, তবে দেখতেন কেমন হৈচৈ পড়ে যেত।

ভদ্রলোক বললেন, তুমি কোথায় নামবে?

স্টেশন ৫০০৭-এ।

তৈরি হও। সামনেই ৫০০৭। বেশ আনন্দে কাটল তোমাকে পেয়ে। তবে তুমি ভীষণ কল্পনাবিলাসী, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।

কল্পনাবিলাসীরা তো অল্পতেই রাগে, জানেন না?

ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল টেন। ব্যস্ত হয়ে ভদ্রলোক একটা ওভারকোটের পকেট থেকে নীল রঙের ত্রিভুজাকৃতির একটা কার্ড বের করে লীকে বললেন, তুমি ভীষণ রেগে গেছ মেয়ে, নাও তোমাকে খুশি করে দিচ্ছি। এইটি নিয়ে সিরান–পল্লীর যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবে, যার সঙ্গে ইচ্ছা কথা বলতে পারবে। খুশি হলে তো? রাগ নেই তো আর?

লী দেখল। নীল কার্ডে জ্বলজ্বল করছে তিনটি লাল তারা। নিচে ছোট্ট একটি নাম–ফিহা। স্বপ্ন দেখছে না তো সে? ইনিই মহামান্য ফিহা! এই জন্যেই এত পরিচিত মনে হচ্ছিল?

লীর চোখ আবেগে ঝাপসা হয়ে এল!

ফিহা বললেন, নেমে যাও মেয়ে, নেমে যাও, গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে।