আগে সন্তু প্রতি বছর গরমকালে সকালবেলায় সাঁতার কাটতে যেত। সাঁতারের প্রতিযোগিতায় দুবার পুরস্কারও পেয়েছে। এখন পড়াশুনোর চাপে আর সাঁতার কাটতে যাওয়া হয় না। সাঁতার ক্লাবের ছেলেরা তাকে মাঝে-মাঝে ডাকতে আসে।
আজ বালিগঞ্জ লেকে সন্তুদের সেই ক্লাবে একটা কবিতা পাঠের আসর হবে। নামকরা কবিরা এসে কবিতা পড়বেন। সন্তু সেই অনুষ্ঠানটা শুনতে যাবে ঠিক করে রেখেছিল, যাওয়ার আগে ভাবল, জোজোকেও নিয়ে গেলে হয়।
জোজো একেবারেই সাঁতার জানে না। জলে নামতেই ভয় পায়। মুখে অবশ্য তা স্বীকার করবে না। সাঁতারের কথা উঠলেই ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, আরে আমি বসফরাস প্রণালী আর কাস্পিয়ান হ্রদে সাঁতার কেটে এসেছি। তোদের এখানকার এইসব ছোটখাটো সুইমিং পুলে কী নামব! আমার ঘেন্না করে?
জোজো খেলাধুলোও কিছু করে না, শুধু বই পড়ে। কবিতা পড়তেও ভালবাসে।
সন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে ডাকতেই জোজো নেমে এল। ওর ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা, একটু-একটু খোঁড়াচ্ছে।
কলেজে এখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে, তাই জোজোর সঙ্গে চার-পাঁচদিন দেখা হয়নি। সন্তু জিজ্ঞেস করল, তোর পায়ে কী হল রে?
জোজো অবহেলার সঙ্গে বলল, এমন কিছু না। হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে একটা পা একটু মচকে গেছে।
সন্তু বলল, হেলিকপ্টার থেকে আবার কোথায় লাফালি?
জোজো বলল, বাঃ, এর মধ্যে আমাকে লাদাখ ঘুরে আসতে হল জানিস? খুব জরুরি কাজে যেতেই হল।
সন্তু বলল, লাদাখ? কাগজে দেখলাম সেখানে এখনও বরফ পড়ছে, সেখানে আবার তোর কী জরুরি কাজ?
জোজো বলল, বাবার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার অরিজিৎ সিং ওখানে পোস্টেড, হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বুকে সাঙ্ঘাতিক ব্যথা। কোনও ডাক্তারই কিছু করতে পারেনি। তখন অরিজিৎ সিং বাবাকে ফোন করে কাতরভাবে বললেন, বন্ধু, তোমার কবিরাজি ওষুধ পাঠিয়ে আমাকে বাঁচাও। বাবা তখন খুবই ব্যস্ত ছিলেন। তাকে একটা গোপন কথা বলে দিচ্ছি সন্তু, কাউকে জানাবি না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন ভোটে জেতার জন্য বাবার কাছে একটা মাদুলি চেয়েছেন, বাবা সেইটা তৈরি করছিলেন। তাই বাবা বললেন, জোজো, তুই ওষুধটা পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবি? একটা লোককে বাঁচাবার জন্য আমাকে যেতেই হল। প্লেনে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর, সেখানে আর্মির হেলিকপ্টার আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
তুই হেলিকপ্টার থেকে লাফাতে গেলি কেন?
আহা বুঝলি না, জীবন-মরণ সমস্যা। আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে অরিজিৎ সিংকে বাঁচানো যেত না। ওখানে তখন খুব বরফ পড়ছে, হেলিকপ্টারটা ল্যান্ড করতে পারছে না। তিরিশ ফুট ওপরে বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে, বরফের জন্য কিছু দেখাই যাচ্ছে না, আমি তখন জয় মা দুগা বলে জাম্প দিলাম। তোকে কী বলব সন্তু, ওষুধটায় ঠিক ম্যাজিকের মতন কাজ হল। একটা ট্যাবলেট খেয়েই অরিজিৎ সিং বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নীচে নেমে এল, গোরিলার মতন নিজের বুক চাপড়ে বলতে লাগল, সব ঠিক হহো গিয়া, বিলকুল ঠিক হো গিয়া!
গল্পটা হজম করে নিয়ে সন্তু বলল, বাঃ, ভাল কাজ করেছিস। কিন্তু একটা মুশকিল হল, তুই তো হাঁটতে পারবি না। ভেবেছিলাম তোকে আমাদের সাঁতারের ক্লাবে কবিতা পাঠ শোনাতে নিয়ে যাব।
জোজো চোখদুটো গোল-গোল করে বলল, সাঁতারের ক্লাবে কবিতা পাঠ? এরকম অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি!
সন্তু বলল, কেন, যারা সাঁতার কাটে, তারা বুঝি কবিতা পড়তে বা কবিতা শুনতে পারে না? যারা ক্রিকেট খেলে, তারা কি গান শোনে না? যারা গান গায় কিংবা কবিতা লেখে, তারা কি খেলা দেখে না?
জোজো বলল, বাংলায় একটা কথা আছে, যে রাঁধে, সে কি চুল বাঁধে না?
সন্তু বলল, আমার মা রান্না করেন, চুলও বাঁধেন। চুল বাঁধতে বাঁধতে গান করেন, আর রাঁধতেরাঁধতে উপন্যাস পড়েন।
তা হলে সত্যিই তোদের ক্লাবে কবিতা পড়া হচ্ছে? আমি ভেবেছিলাম, তুই গুল মারছিস!
ভাই জোজো, গুল মারার কায়দাটাই আমি জানি না। ওটা পুরোপুরি তোর ডিপার্টমেন্ট।
হাঁটতে আমার অসুবিধে হচ্ছে, কিন্তু সাইকেল চালাতে পারি। চল, যাই তা হলে!
সন্তুও সাইকেল নিয়ে এসেছে। দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়ল।
খানিকদূর যাওয়ার পরেই জোজো বলল, এই যাঃ, মানিব্যাগটা ফেলে এলাম যে। কী হবে?
সন্তু বলল, তাতে কী হয়েছে? টাকা-পয়সার তো দরকার নেই, ওখানে টিকিট কাটতে হবে না।
জোজো বলল, সেজন্য নয়। একটা করে চিকেন কাটলেট খেয়ে নেওয়া যেত। বিকেলবেলা কিছু খাইনি। খালি পেটে কি কবিতা শোনা যায়?
সন্তু বলল, তাই বল, তোর কাটলেট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। ঠিক আছে, আমার কাছে টাকা আছে।
জোজো বলল, আমি কিন্তু খাওয়াব। টাকাটা তোর কাছে ধার রইল।
লেক মার্কেটের কাছে একটা দোকানের চপ কাটলেট খুব বিখ্যাত। দোকানটায় বেশ ভিড়। ভেতরে বসে খাওয়ার জায়গা নেই। দুখানা কাটলেট নিয়ে ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে খেতে লাগল।
খেতে-খেতে জোজো বলল, আমার পা-টা যখন মুচকে গেল, জানিস, প্রথম দুদিন এমন ব্যথা যে, আমি উঠে দাঁড়াতেই পারছিলাম না। ভয় হয়েছিল, সারাজীবনের মতনই খোঁড়া হয়ে যাব নাকি! তখন কাকাবাবুর কথা খুব মনে পড়ত। কাকাবাবু ওই খোঁড়া পা নিয়েই কতবার পাহাড়ে উঠেছেন, জলে ঝাঁপিয়েছেন, হ্যাঁ রে সন্তু, কবে থেকে খোঁড়া হয়েছেন বল তো?
সন্তু বলল, আমি ঠিক জানি না। ছেলেবেলা থেকেই তো এরকম দেখছি।
কীভাবে পা-টা ওরকমভাবে খোঁড়া হল?
তাও ঠিক জানি না। কখনও জিজ্ঞেস করিনি।
কেন জিজ্ঞেস করিসনি? তুই বড় হওয়ার আগে কাকাবাবু নিশ্চয়ই একা-একা অনেক অভিযানে গেছেন। সেই গল্পগুলো শুনিসনি?
দু-একটা শুনেছি।
তা হলে এই পা ভাঙা নিয়েও নিশ্চয়ই কোনও গল্প আছে। তুই জিজ্ঞেস করতে না পারিস, আমি করব।
হ্যাঁ, কর না। কাকাবাবু তোকে খুব পছন্দ করেন।
কাটলেট খাওয়া হয়ে গেছে। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে জোজো ডান পাশে তাকাল। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে এক আইসক্রিমওয়ালা।
জোজো বলল, কাটলেটের পর একখানা আইসক্রিম না খেলে কি জমে, বল?
সন্তু বলল, চল, চল, আর আইসক্রিম খেতে হবে না। ওখানে যেতে দেরি হয়ে যাবে।
জোজো অভিমানের ভান করে বলল, সন্তু, আমি পয়সা আনিনি বলে তুই এরকম অবজ্ঞা করছিস? একটা আইসক্রিম খেতে কতটা সময় লাগে? আইসক্রিমের পয়সাটাও তোর কাছে আমার ধার থাকবে।
সন্তু বলল, এটা সত্যিই ধার। আমার হাতখরচ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
আইসক্রিম শেষ করে ওরা এসে পৌঁছল সাঁতার ক্লাবে। সেখানে বেশ ভিড়। কবিতা পাঠ শুরু হয়ে গেছে। একজন লম্বা চেহারার কবি উদাত্ত কণ্ঠে কবিতা পাঠ করছেন।
ওরা দুজনে বসল একেবারে পেছন দিকে। একটু পরেই জোজো ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে সন্তু, এরা আমাকে একটা কবিতা পড়তে দেবে?
সন্তু বলল, না।
জোজো বলল, কেন দেবে না, আমিও কবিতা লিখি।
সন্তু বলল, কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। যে খেলে, সে-ও খেলোয়াড় নয়। যে গান গায়, সেই কি গায়ক?
জোজো ভুরু কুঁচকে একটু চিন্তা করে বলল, তোর কথাটা সত্যি বটে, আবার সত্যিও নয়। এ-নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে।
সন্তু বলল, এখন তর্ক করতে হবে না। মন দিয়ে শোন।
দু-তিনজনের কবিতা শোনার পরই জোজো বলল, ওঠ, উঠে পড়। চল, এবার যাই!
সন্তু বলল, তোর ভাল লাগছে না?
জোজো বলল, হ্যাঁ ভাল লাগছে। সত্যি ভাল লাগছে। কিন্তু ভাল জিনিস বেশিক্ষণ শুনতে নেই। এর পর যদি খারাপ লাগে?
জোজো হাত ধরে টানাটানি করাতে সন্তুকে উঠে পড়তেই হল।
বাইরে এসে জোজো বলল, চল, তোদের বাড়ি যাই। কাকাবাবুর অসুখ, আমার একবারও দেখতে যাওয়া হয়নি।
সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আকাশে জমেছে কালো মেঘ, মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে গুরুগুরু শব্দ। বেশ ঝড়-বৃষ্টি আসছে।
বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নামার পর জোজো গলা নিচু করে বলল, সন্তু, সন্তু, একজন স্পাই! তোদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে।
সন্তু তাকিয়ে দেখল, উলটো ফুটপাথে বেশ খানিকটা দূরে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আপনমনে।
সে বলল, ধুত! তুই সব জায়গায় স্পাই দেখতে পাস। লোকটা নিশ্চয়ই কারও জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখার কী আছে?
জোজো মাথা নাড়তে-নাড়তে বলতে লাগল, উঁহুঃ, উঁহুঃ, আমি স্পাই দেখলেই চিনতে পারি।
লোকটি এবার উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করল। সন্তুও জোজোকে নিয়ে ঢুকে গেল বাড়ির মধ্যে।
মা জোজোকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, জোজো অনেকদিন আসোনি। ভাল হয়েছে আজ এসেছ। আজ মাছের চপ বানিয়েছি, এক্ষুণি ভেজে দিচ্ছি।
জোজো বলল, আঃ মাসিমা, বাঁচালেন, কী খিদেটাই না পেয়েছে।
সন্তু অবাক হয়ে তাকাতেই জোজো আবার বলল, মনে হচ্ছে যেন কতদিন কিছু খাইনি।
ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হচ্ছে জোজোর, সন্তু তাকে ধরে-ধরে তুলল। উঠতে উঠতে জোজো বলল, আমি পেটুক নই, জানিস তো! এক একদিন রাক্ষসের মতন খিদে পায়, আবার সাতদিন কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। একবার আমি অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে তিনদিন একফোঁটা জলও না খেয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছি।
কাকাবাবুর ঘরের দরজা ভেজানো। কাকাবাবু বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছেন। যে, আর কোনও লোককে তাঁর অসুখ দেখার জন্য তাঁর ঘরে আসতে দেওয়া হবে না। যারা এখনও আসছে, তাদের বৈঠকখানা ঘরে বসিয়ে চা-টা খাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একগাদা ওষুধ খেয়ে-খেয়ে কাকাবাবুর শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। বাইরের লোকের সঙ্গে তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
জোজোর কথা অবশ্য আলাদা। তাকে দেখে কাকাবাবু খুশিই হলেন। হেসে বললেন, এসো, এসো জোজো, অনেক দিন তোমার গল্প শোনা হয়নি।
জোজো বলল, কাকাবাবু, অনেকদিন কোথাও অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া হচ্ছে না!
কাকাবাবু বললেন, আমার তো শরীর ভাল নয়। তুমি আর সন্তু কোনও জায়গা থেকে ঘুরে এসো এই ছুটিতে। দ্যাখো, যদি কোনও অ্যাডভেঞ্চার হয়!
সন্তু বলল, জোজো, তোর হেলিকপ্টার থেকে লাফানোর গল্পটা কাকাবাবুকে শুনিয়ে দে!
জোজো বলল, ওটা এমন কিছু না।
কাকাবাবু বললেন, শুনব, শুনব। কিন্তু তার আগে সন্তু বল তো, কালকের ওই লোকটা কে ছিল? মনে একটা খটকা লেগে আছে। আমি চিনি না, আর কেউ চেনে না, অথচ ঘরের মধ্যে গাট হয়ে বসে রইল। আমাকে তুমি-তুমি করে উপদেশ দিয়ে গেল! লোকটার আর হদিস পেলি না?
সন্তু বলল, লোকটি তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটুখানি হাঁটবার পরই একটা গাড়িতে উঠে পড়ল। আর দেখতে পাইনি।
কাকাবাবু একটু ধমকের সুরে বললেন, শুধু এইটুকু দেখেছিস? আর কিছু দেখিসনি? এইটুকু সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু দেখা যায়। লোকটার হাঁটার ভঙ্গি কেমন ছিল? যে-গাড়িটায় উঠল, তার নম্বর কত?
সন্তু লজ্জা পেয়ে গেল। গাড়িটার নম্বর দেখতে সে ভুলে গেছে। কালো রঙের গাড়ি তো অনেক আছে।
সন্তু বলল, হাঁটার ভঙ্গিতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। সোজা হয়ে হাঁটছিল। তবে বাঁ হাতটা কোটের পকেটে ঢোকানো ছিল, একবার-দুবার মাত্র বার করেছিল, সেই হাতে একটা দস্তানা পরা।
কাকাবাবু বললেন, দস্তানা? কীরকম দস্তানা?
সন্তু বলল, খুব পাতলা রবারের। ডাক্তাররা যেমন পরে।
কাকাবাবু বললেন, একহাতে দস্তানা পরে থাকবে কেন? হয় ওই হাতে কোনও ঘা আছে কিংবা একটা-দুটো আঙুল কাটা। তা লুকোতে চায়।
সন্তু বলল, আর একটা ব্যাপার, গাড়িতে ওঠার পর লোকটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়েছিল। পরে আমার মনে হয়েছে, ওর চোখের মধ্যে যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে।
কাকাবাবু বললেন, ওর চোখে কালো চশমা ছিল, তুই কী করে বুঝলি, কটমট করে তাকিয়েছে?
সন্তু বলল, তখন চশমা খুলে ফেলেছিল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে…
কাকাবাবু বললেন, আর-একটু ভেবে দ্যাখ, কেন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল?
সন্তু বলল, কয়েক সেকেন্ডের তো ব্যাপার, গাড়িটা হুশ করে চলে গেল, তার মধ্যেই লোকটা… কাকাবাবু, মনে পড়েছে, ওর দুটো চোখ দুরকম!
কাকাবাবু বললেন, তার মানে? দুচোখের রং আলাদা?
সন্তু বলল, তা দেখিনি। অত তাড়াতাড়ি কি রং বোঝা যায়? তবু এটা আমার ধারণা, দুচোখের দৃষ্টি একরকম নয়!
জোজো জানলার ধার থেকে বলে উঠল, একটা চোখ পাথরের হতে পারে।
কাকাবাবু জোজোর দিকে প্রশংসার চোখে তাকিয়ে বললেন, এটা তো জোজো ঠিক বলেছে। একটা চোখ পাথরের হলে… সেইজন্যই লোকটা ঘরের মধ্যেও কালো চশমা পরে ছিল। কিন্তু… কিন্তু, পাথরের চোখওয়ালা কোনও লোক, এক চোখ কানা, এরকম কোনও লোককেও তো আমি চিনি না! অবশ্য, পাথরের চোখ হলেই যে সে খারাপ লোক হবে, তার কোনও মানে নেই!
বাইরের দিকে তাকিয়ে জোজো বলল, সেই লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, সেই লোকটা মানে কোন লোকটা? তাকে তো জোজো দেখেনি।
সন্তু বলল, জোজোর ধারণা একজন স্পাই আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছে।
কাকাবাবু এবার হেসে ফেলে বললেন, আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখার কী আছে? এটা এমন কিছু আহামরি বাড়ি নয়!
জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কাকাবাবু বললেন, কী? তোমার আবার অনুমতি লাগে নাকি?
জোজো বলল, আপনার একটা পা খোঁড়া হয়ে গেল কী করে? কেউ কি পায়ে গুলি করেছিল?
কাকাবাবু বললেন, ও, এই কথা। না, কেউ গুলি করেনি। প্রায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলতে পারো। একবার আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম একটা কাজে, এক জায়গায় গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলাম পাহাড় থেকে। অনেক চিকিৎসাতেও সারেনি।
জোজো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, শুধু এইটুকু বললে চলবে না। ঠিক কী হয়েছিল, কেন পাহাড় থেকে পড়ে গেলেন, সবটা শুনতে চাই।
কাকাবাবু বললেন, পুরো কাহিনীটা তোমাকে শোনাতে হবে? তাতে যে অনেকটা সময় লাগবে। ঘটনাটা আমি কাউকে সাধারণত বলি না।
জোজো জোর দিয়ে বলল, আমাদের বলুন। সময় লাগুক না!
কাকাবাবু এতক্ষণ বসে ছিলেন। এবার বালিশে মাথা হেলান দিলেন। তারপর বললেন, আফগানিস্তান দেশটা এক সময় কী সুন্দর ছিল। মানুষগুলো লম্বা-চওড়া, কিন্তু ভারী সরল। ওরা যদি কারও বন্ধু হয়, তবে সেই বন্ধুর জন্য অনায়াসে প্রাণ দিতে পারে। আবার কেউ যদি শত্রু হয়, তবে দারুণ নিষ্ঠুরভাবে তাকে খুন করতেও ওদের হাত কাঁপে না। কোনও কাবুলিওয়ালার সঙ্গে আমার শত্রুতা হয়নি, বরং বন্ধু হয়েছিল অনেক।
জোজো জিজ্ঞেস করল, ওখানে আপনি কত বছর আগে গিয়েছিলেন?
কাকাবাবু বললেন, দশ বছর, না, না, এগারো। তখন তোমরা খুব ছোট ছিলে। এখন ওদেশটায় খালি মারামারি চলছে, অন্য দু-একটা দেশ গোলমাল পাকাচ্ছে। এখন তো আর যাওয়াই যায় না। আমার আর-একবার খুব যেতে ইচ্ছে করে।
এই সময় রঘু থালাভর্তি গরম-গরম মাছের চপ নিয়ে এল।
একটা কাগজের প্লেটে দুটো চপ তুলে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, মা আপনাকে আগে খেয়ে নিতে বলেছেন। ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই তো বলবেন, খাব না!
কাকাবাবু বললেন, তা বলে দুটো? পারব না, একটা দে। রঘু বলল, বেশি বড় নয়, দুটোই খান!
এত ওষুধের জন্য কাকাবাবুর মুখে রুচি নেই, কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। মা তাই প্রত্যেকদিন কাকাবাবুর জন্য নতুন-নতুন খাবার তৈরি করছেন।
জোজো দুহাতে দুটো চপ তুলে নিয়ে একটায় কামড় দিয়ে বলল, গ্র্যান্ড, গ্র্যান্ড, দারুণ! আগে খেয়ে নিই, তারপর আফগানিস্তানের গল্পটা শুনব।
সন্তু একটা চপ নিয়ে জানলার কাছে চলে এল। পুরনো আমলের বাড়ি, জানলায় গ্রিল নেই, ফাঁক-ফাঁক লোহার শিক। শুধু এই জানলার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় ছবি তুললে মনে হবে, জেলখানার গরাদের মধ্যে কয়েদি!
সন্তু জোজোর সেই স্পাই-কে দেখার চেষ্টা করল। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা সত্যিই ফিরে এসেছে, আস্তে-আস্তে পায়চারি করছে। বৃষ্টি পড়ছে ফোঁটা-ফোঁটা।
হঠাৎ একটা কালো রঙের গাড়ি এসে থামল। জানলা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা হাত। সেই হাতে একটা বন্দুক। সাধারণ বন্দুকের মতন লম্বা নয়, বেশ বেঁটে, নলটা অনেকটা মোটা। ঠিক গুলির শব্দের মতন নয়, চাপা ধরনের দুপ-দুপ শব্দ হল দুবার।
কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। গাড়ির জানলায় বন্দুকসুন্ধু হাতটা দেখেই সন্তু মাথা নিচু করে বসে পড়েছে মাটিতে, চেঁচিয়ে উঠল, সাবধান!
সঙ্গে-সঙ্গে একটা কিছু ঠং করে জানলার শিকে লেগে পড়ে গেল রাস্তার দিকে, আর-একটা এসে পড়ল ঘরের মধ্যে। সেটা গুলি নয়, একটা ছোট টিনের কৌটোর মতন, তার থেকে ভস-ভস করে বেরোতে লাগল ধোঁয়া।
কাকাবাবু বিদ্যুদ্বেগে নেমে এলেন খাট থেকে। একহাতে নিজের নাক টিপে ধরে তুলে নিলেন কৌটোটা।
লাফাতে-লাফাতে চলে গেলেন বাথরুমে। সেখানে এক বালতি জল ছিল, তার মধ্যে কৌটোটা ড়ুবিয়ে দিলেন।
যেটুকু গ্যাস বেরিয়েছে, তাতেই মাথা ঝিমঝিম করছে সন্তুর। জোজো ঢলে পড়েছে মাটিতে।
অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগে সন্তু শুনতে পেল, বাইরের রাস্তায় গুড়ম-গুড়ম করে শব্দ হল দুবার। এবারে সত্যিকারের রিভলভারের গুলি ছোড়ার শব্দ।
তারপরই একজন মানুষের আর্ত চিৎকার।