গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, কেউ একজন আমার কপালে হাত রেখেছে। শীতল ধাতব হাত, নিশ্চয়ই নিচু শ্রেণীর একটা প্রতিরক্ষা রবোট। আমি চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম একজোড়া সবুজ ফটোসেলের চোখ আমার উপর স্থির হয়ে আছে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কে?
আমি মহামান্য কুশান। কিউ–৪৩। একজন প্রতিরক্ষা রবোট।
কী চাও তুমি?
আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
নিতে এসেছ?
হ্যাঁ, মহামান্য কুশান।
কোথায়? সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনে।
এত রাতে?
হ্যাঁ মহামান্য কুশান, জরুরি অধিবেশন।
আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম, আমি যেতে চাই না, কিউ—৪৩।
আপনি নিজে থেকে যেতে না চাইলে জোর করে নিয়ে যাওয়ার আদেশ রয়েছে মহামান্য কুশান।
ও। আমি বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়ালাম। সামনের স্বচ্ছ দেয়ালে আমি নিজের প্রতিবিম্বটি দেখতে পেলাম, চেহারায় এক ধরনের বিপর্যস্ততার ছাপ। আমি মেঝে থেকে একটা পোশাক তুলে শরীরের উপর জড়িয়ে নিতে থাকি, ঠিক তখন ক্রিশি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, এটি জরুরি অধিবেশনের উপযোগী পোশাক নয়।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি ক্রিশি?
আপনার আরেকটু শোভন পোশাক পরে যাওয়া দরকার।
এই মাঝরাতে তুমি আমাকে জ্বালাতন করছ ক্রিশি।
ক্রিশি আমার অনুযোগে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ধীর পায়ে পাশের ঘরে হেঁটে চলে গিয়ে আমার জন্যে একটি পোশাক নিয়ে আসে। এ ধরনের পোশাকে আমাকে খানিকটা আহাম্মকের মতো দেখাবে জেনেও আমি আর আপত্তি করলাম না। ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তার সাথে কোনকিছু নিয়ে তর্ক করা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে যাবার আগে ক্রিশি বলল, মহামান্য কুশান, আপনার নিশ্চয়ই স্মরণ আছে সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনে অনুমতি দেয়ার আগে আসন গ্রহণ করা চতুর্থ মাত্রার অপরাধ।
না ক্রিশি আমার স্মরণ নেই।
কথা বলার আগে আপনার হাত তুলে অনুমতি নিতে হবে।
ঠিক আছে নেব।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনের সিদ্ধান্ত সবসময় মেনে নিতে হয়। সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবমাননাকর কোনো উক্তি করা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ।
আমি প্রতিরক্ষা রবোট কিউ–৪৩ এর সাথে বাইরে বের হয়ে এলাম, ঘরে দাঁড়িয়ে থাকলে ক্রিশির কথা কখনো শেষ হবে বলে মনে হয় না। তার ঘাড়ের কাছে একটি সুইচ আছে সেটি ব্যবহার করে তাকে স্বল্পভাষী রবোটে পরিণত করে নেয়া সম্ভবত যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, ক্রিশির কথা শুনে এই পোশাকটি পরে আসা বেশ বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম, খোলা দরজায় ক্রিশি অনুগত ভৃত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিউ–৪৩ নিচু গলায় বলল, চলুন মহামান্য কুশান।
চল, যাই।
আমি তখনো জানতাম না যে আর কখনো এই ঘরে ফিরে আসব না।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা সাত জন, তার মাঝে অন্তত চার জন উপস্থিত না থাকলে অধিবেশন শুরু করা যায় না। এই মধ্যরাতে সত্যি সত্যি চার জন সদস্য উপস্থিত হয়েছে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু লিয়ানার ঘরে গিয়ে আমি হতবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি সাত জন সদস্য গম্ভীর হয়ে একটি কালো রঙের টেবিলকে ঘিরে বসে আছে। টেবিলের এক পাশে একটি ধাতব চেয়ার আমার জন্যে খালি রাখা হয়েছে। ঘরে প্রবেশ করার আগে আমি দেখতে পেলাম আরো বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে।
সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা নিচু গলায় কথা বলছিল, আমাকে ঢুকতে দেখে সবাই চুপ করে গেল। সদস্যদের ভিতরে সবচেয়ে বয়স্ক ক্ৰকো আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, বস কুশান।
আমি খালি চেয়ারটিতে বসে সদস্যদের দিকে তাকালাম, সবাই আমার দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে, শুধুমাত্র লিয়ানা এক ধরনের বিষণ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্ৰকো আমার দিকে না তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল, তোমাকে ঘুম থেকে তুলে আনার জন্যে দুঃখিত কুশান।
আমি এই সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং পুরোপুরি মিথ্যা কথাটির কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। ক্ৰকো তার গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা আমাদের স্থানীয় ডাটাবেস পরীক্ষা করে দেখেছি আসছে শীতের জন্যে আমাদের যেটুকু রসদ রয়েছে সেটি সবার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আমি কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম, ক্ৰকো অস্বস্তিতে তার চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে বলল, আমাদের ডাটা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে অন্তত এক জন মানুষকে আমাদের বিদায় দিতে হবে।
বিদায়? আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম, বিদায়?
হ্যাঁ। লেমিংটেনের সমন্বয় পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা গেছে, যে মানুষটিকে বিদায় দিতে হবে সেই মানুষটি হলে তুমি।
আমি?
হা। ক্ৰকো আমার দিকে তাকাতে পারল না, নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে কুশান।
চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ।
আমি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলাম না, সবার দিকে ঘুরে তাকালাম,
সবাই ভাবলেশহীন মুখে বসে আছে। আবার ঘুরে ক্রকোর দিকে তাকিয়ে বললাম, কোথায় যাব আমি?
সেটা তোমার ইচ্ছে। তুমি যেখানে যেতে চাও
আমি কোথায় যাব? আতঙ্কিত গলায় বললাম, কোথায় যাব আমি? সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথায় যাব আমি?
আমি জানি না কুশান। হঠাৎ ক্ৰকোর গলা কেঁপে গেল, সে নরম গলায় বলল, আমি দুঃখিত।
আমি চিৎকার করে কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলাম, কী হবে প্রতিবাদ করে? সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়ে গেছে, আমি সেটা গ্রহণ করি আর না করি তাতে কিছু আসে যায় না। আমি আবার সবার দিকে তাকালাম, সবাই চোখ সরিয়ে নিল। শুধুমাত্র লিয়ানা আমার দিকে তখনো তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, লিয়ানা
লিয়ানা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
রসদ নেই, লেমিংটন সমন্বয় পদ্ধতি এসব আসলেই বাজে কথা। তাই না?
লিয়ানা তখনো কোনো কথা বলল না, শুধুমাত্র তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে হাসিতে কোনো আনন্দ নেই।
গ্রুস্টানকে নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি সেটা আসল কারণ?
লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ কুশান তুমি সেটা বলতে পার। আমাদের গ্রুস্টানের কথা শুনতে হয়। গ্রুস্টানকে আমাদের প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যক্রমে তুমি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলেছ।
কিন্তু আমি মানুষ। সারা পৃথিবীতে কয় জন মানুষ আছে এখন হাতে গোনা যায়।
সেটা যথেষ্ট নয়। লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, তোমার বেলা সেটা যথেষ্ট নয়। বড় কথা হচ্ছে তোমার সম্পর্কে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়ে গেছে। আমি দুঃখিত কুশান।
তোমরা আমাকে চলে যেতে বলেছ—কিন্তু এর অর্থ জান?
জানি।
জান না, জানলে এ রকম একটা কথা বলতে পারতে না। বাইরের বাতাসে ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তা। বিষাক্ত কেমিক্যাল। আমি কি এক সপ্তাহও বেঁচে থাকব? থাকব না। আমাকে তোমরা মেরে ফেলতে চাইছ?
লিয়ানা টেবিলের উপর থেকে চতুষ্কোণ একটা কমিউনিকেশন মডিউল হাতে নিয়ে বলল, এই যে আমার কাছে লেমিংটন সমন্বয় পদ্ধতির রিপোর্ট। কী লিখেছে তোমাকে পড়ে শোনাই। কুশান কিশুনুক, পরিচয় সংখ্যা চার আট নয় তিন দুই দশমিক দুই সাত। সমন্বয় পদ্ধতি মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করার সময় আট ঘণ্টা। গুরুত্ব মাত্রা চার। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরী করার সম্ভাব্য পদ্ধতি : হাইড্রোজেন সায়নাইড। মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি : ক্রায়োজেনিক। ডাটাবেস সংশোধনী তিন মাত্রা চতুর্থ পর্যায়–লিয়ানা হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, আরো শুনতে চাও?
আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে থাকি। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? মৃত্যুদণ্ড? একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামকে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলার জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে।
লিয়ানা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাইরের পৃথিবী খুব ভয়ঙ্কর, কোনো মানুষ সম্ভবত বেঁচে থাকতে পারবে না। তোমাকে হাইড্রোজেন সায়নাইড না দিয়ে তাই বাইরে পাঠানো হচ্ছে। গ্রুস্টান সম্ভবত এটা পছন্দ করবে না, কিন্তু আমি নিজের দায়িত্বে এই ঝুঁকি নিচ্ছি।
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, কিছুই আর বুঝতে পারছি না, কিছুই আর শুনতে পাচ্ছি না।
ক্ৰকো গলা নামিয়ে বলল, রাত্রি শেষ হবার আগে তোমাকে চলে যেতে হবে কুশান।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বুকের ভিতর ভয়ঙ্কর এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করি। কার উপর এই ক্রোধ? অসহায় মানুষের উপর নাকি কূটকৌশলী হৃদয়হীন কোনো যন্ত্রের উপর? ইচ্ছে করছিল চারপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
দরজার কাছে তোমার জন্যে একটা ব্যাগ রাখা আছে। সেখানে তোমার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে।
কোনো অস্ত্র? এটমিক ব্লাষ্টার?
না। কোনো অস্ত্র নেই।
আমি কি একটি বাই ডার্বাল নিতে পারি?
আমি দুঃখিত তোমাকে আর কিছু দেয়া সম্ভব নয়।
আমি কি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি?
লিয়ানা শান্ত গলায় বলল, সেটা জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
আমার একটা রবোট রয়েছে। ক্রিশি। তার কাছে বিদায় নিতে পারি?
ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তার কাছে বিদায় নেয়ার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি অনুনয় করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। কার কাছে আমি অনুনয় করব? এই মানুষগুলো বিশাল একটি শক্তির হাতের পুতুল। তার বিরুদ্ধে যাবার এদের কোনো ক্ষমতা নেই।
লিয়ানা নরম গলায় বলল, বিদায় কুশান।
বিদায়।
তোমাকে অন্তত এক শ কিলোমিটার দূরে চলে যেতে হবে। এর ভিতরে তোমাকে পাওয়া গেলে প্রতিরক্ষা রবোটদের গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আমি লিয়ানার দিকে তাকালাম, কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে হঠাৎ আমার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। লিয়ানা কেন জানি আমার হাসিটুকু সহ্য করতে পারল না, হঠাৎ করে আমার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে হেঁটে বের হয়ে আসি। দরজার কাছে রাখা ব্যাগটা। নেব কি না ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, শেষ মুহূর্তে তুলে নিলাম। লিয়ানার ঘরের বাইরে অনেকে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে কৌতূহলী মুখে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আমি তাদের দিকে না তাকিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
একবার পিছনে তাকিয়ে আমি সোজা সামনে হেঁটে যেতে থাকি। বড় হলঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে আমি ভাঙা ফ্যাক্টরির কাছে এসে দাঁড়াই। সামনে একটি বিপজ্জনক ভাঙা ব্রিজ, সাবধানে সেটার উপর দিয়ে হেঁটে আমি আমাদের বসতির বাইরে পৌঁছালাম।
সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্তূপ। ক্রোমিয়ামের ধসে পড়া দেয়াল, বিবর্ণ রং ওঠা জঞ্জাল, কালো কংক্রিট–এক বিশাল জনমানবশূন্য অরণ্য। যার কোনো শুরু নেই, যার কোনো শেষ নেই।
এই বিশাল অরণ্যে আজ থেকে আমি একা।