০২. গভীর ঘুমে অচেতন

কিরি। ঘুম থেকে ওঠ, কিরি।

আমি গভীর ঘুমে অচেতন হয়েছিলাম, ঘুম থেকে জেগে উঠতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু কণ্ঠস্বরটি আবার আমাকে ডাকল, ওঠ কিরি। জেগে ওঠ।

আমি কষ্ট করে নিজেকে জাগিয়ে তুলোম। কণ্ঠস্বরটি নরম গলায় বলল, চোখ খুলে তাকাও কিরি।

আমি চোখ খুলে তাকালাম। আমি ধবধবে সাদা একটা বিছানায় শুয়ে আছি। আমার মাথার কাছে কিছু মনিটর, পায়ের কাছে একটা নিচু টেবিলে কিছু যন্ত্রপাতি। শরীর থেকে কয়েক ধরনের টিউব বের হয়ে যন্ত্রপাতিতে গিয়েছে, সেখান থেকে নিচু শব্দ তরঙ্গের একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম, আশপাশে কেউ নেই। কে তা হলে আমাকে ডেকে তুলল? এক ধরনের ক্লান্তিতে আমার চোখ বুজে আসছিল, আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

চোখ বন্ধ কোরো না কিরি। কণ্ঠস্বরটি নরম গলায় বলল, চোখ খুলে তাকাও।

আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম, কে?

আমি।

আমি কে? আমি চারদিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কোথায়?

আমাকে তুমি খুঁজে পাবে না কিরি।

আমার ভিতরে হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে, আমি পুরোপুরি জেগে উঠে ভয়–পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কেন তোমাকে খুঁজে পাব না?

কারণ, আমি তোমার ট্রাকিওশান।

ট্রাকিওশান! আমি ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করলাম, পাজরের এক কোনায় হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা করে ওঠে। মাথার পিছনে একটা ভোঁতা যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করি। অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটি হঠাৎ সুরেলা গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল, বলল, তোমার এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই কিরি। আমি তোমার বন্ধু।

বন্ধু!

হ্যাঁ। তোমার মস্তিষ্কে আমাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তোমার সকল ইন্দ্রিয়কে এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ইচ্ছে করলে তোমাকে আনন্দ দিতে পারি। ইচ্ছে করলে দুঃখ দিতে পারি, কষ্ট দিতে পারি। তোমার সাথে কথা বলতে পারি এখন যেরকম বলছি। তোমাকে

আমি অসহনীয় এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে বললাম, চুপ কর! চুপ কর তুমি।

কেন?

আমি বলছি তাই।

কণ্ঠস্বরটি আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, কিন্তু আমাকে তো সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় নি।

তোমাকে কীভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে?

আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তুমি একজন হত্যাকারী। হত্যাকারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আমি তোমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখব কিরি।

আমি দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। ইচ্ছে করল শক্ত দেয়ালে মাথা ইকে খুলি ভেঙে ভিতর থেকে সবকিছু বের করে ফেলি।

তুমি মিছেমিছি ব্যস্ত হচ্ছ কিরি।

চুপ কর। চুপ কর তুমি।

আমি দুঃখিত কিন্তু আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয় নি। আমাকে নিয়েই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। ব্যাপারটি তুমি যত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করে নেবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল।

আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, আমাকে কী করতে হবে?

তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে।

শুনছি।

তোমাকে সবকিছু স্বীকার করতে হবে।

কী স্বীকার করতে হবে?

তুমি কেন বিনা প্ররোচনায় একটি মানুষকে হত্যা করেছ?

আমি কাউকে হত্যা করি নি।

করেছ।

আমি চিৎকার করে বললাম, করি নি। করি নি।

আমার মাথার মাঝে ট্রাকিওশান খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তুমি নেহায়েত নির্বোধ একজন মানুষ। আমি কখনো শুনি নি একজন তার মস্তিষ্কে গেঁথে রাখা ট্রাকিওশানের কথার অবাধ্য হয়। আমি তোমাকে এমন যন্ত্রণা দিতে পারি যে মনে হবে কেউ তোমার শরীরের চামড়া একটু একটু করে খুলে নিচ্ছে। মনে হবে কানের মাঝে গলিত সীসা ঢেলে দিচ্ছে। মনে হবে সঁড়াশি দিয়ে নখ উপড়ে নিচ্ছে। মনে হবে কপালের মাঝে ড্রিল দিয়ে–

আমি চিৎকার করে বললাম, চুপ কর–চুপ কর তুমি।

আমার কথার অবাধ্য হয়ো না কিরি।

আমাকে একটু সময় দাও। তোমার পায়ে পড়ি আমি। আমাকে একটু সময় দাও। একটু সময়

দেব। নিশ্চয়ই দেব। আমার মাথার মাঝে ট্রাকিওশান নরম গলায় বলল, এখন আমি হচ্ছি তুমি, আর তুমি হচ্ছ আমি। আমি তোমাকে নিশ্চয় সময় দেব। তার আগে তুমি। আমাকে বল কেন ঐ মানুষটিকে হত্যা করেছিলে?

আমি কাউকে হত্যা করি নি। রিগা কম্পিউটার আমার ছবি পাল্টে দিয়েছে।

ট্রাকিওশানটি হঠাৎ চুপ করে গেল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম, আমার স্নায়ু টানটান হয়ে রইল অভাবিত কিছু একটা ঘটার জন্য কিন্তু কিছু ঘটল না। আমি ভয়ে ভয়ে ট্রাকিওশানকে ডাকলাম, তুমি কোথায়? 

আমি আছি। তোমার সাথেই আছি।

তুমি কেন চুপ করে আছ?

আমি রিগা কম্পিউটারের সাথে যোগাযোগ করছি। তার সাথে কথা বলছি।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। ট্রাকিওশানটি রিগা কম্পিউটারের সাথে কথা বলছে, আমি কি কারো সাথে কথা বলতে পারি না? কেউ কি নেই এই পৃথিবীতে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমার মতো অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মানুষ আসলেই বড় নিঃসঙ্গ। বড় অসহায়। বড় দুঃখী।

ঠিক এই সময়ে আমার লানার কথা মনে পড়ল। সোনালি চুল এবং নীল চোখের সেই মেয়েটি যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার। যে আমাকে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা বলেছিল, চলে যাওয়ার সময় তার হলোগ্রাফিক মালটিকমিউনিকেশান্স কার্ডটি আমাকে দিয়েছিল। আমি পকেটে হাত দিতেই চতুষ্কোণ কার্ডটির শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। জোর করে আমাকে অচেতন করে আমার মাথায় অস্ত্রোপচার করার সময় এই কার্ডটি ইচ্ছে করলে ফেলে দিতে পারত, কিন্তু তারা ফেলে দেয় নি। আমি কার্ডটি বের করে লাল বোতামটি স্পর্শ করতেই কার্ডটিতে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ হল, ছোট ছোট দুটি বাতি জ্বলে উঠল এবং হঠাৎ করে আমার সামনে ছোট একটি স্ক্রিনে লানার ত্রিমাত্রিক একটা ছবি ফুটে উঠল। লানা উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, কে? কে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে!

আমি। আমি কিরি।

কিরি! কী ব্যাপার? তোমার কী হয়েছে?

আমি–আমি খুব বড় বিপদে পড়েছি লানা।

কী বিপদ?

সেটি অনেক বড় ইতিহাস–তোমাকে কীভাবে বুঝিয়ে বলব জানি না।

চেষ্টা কর।

আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগানো হয়েছে।

ট্রাকিওশান! লানা আর্তনাদ করে উঠল, কেন?

আমি নাকি একজনকে খুন করেছি।

লানা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে অনিশ্চিতের মতো বলল, খুন?

কিন্তু আমি খুন করি নি। রিগা কম্পিউটার মিথ্যা বলছে।

লানা শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে নিচু গলায় বলল, তুমি সত্যি সত্যি খুব বড় বিপদে পড়েছ কিরি।

আমি জানি।

তোমাকে সাহায্য করা যাবে কি না আমি জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব।

লানা!

বল।

যদি খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করা না হয় তা হলে আমাকে আর কেউ কোনোদিন সাহায্য করতে পারবে না।

আমারও তাই মনে হয়।

.

প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমান্ডিং অফিসারদের যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে বলে আমি ধারণা করেছিলাম দেখা গেল তাদের ক্ষমতা তার থেকেও বেশি। কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাকে বিশাল একটা হলঘরে এনে হাজির করা হল। হলঘরটিতে আবছা অন্ধকার, দেয়াল প্রায় দেখা যায় না। অনেক উঁচু ছাদ; সেখান থেকে এক ধরনের স্বচ্ছ নরম আলো বের হচ্ছে। ঘরের মাঝখানে কুচকুচে কালো কৃত্রিম গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের একপাশে উঁচু আরামহীন একটা শক্ত চেয়ারে আমি সোজা হয়ে বসে আছি। আমার সামনে টেবিলের অন্যপাশে তিন জন মাঝবয়সী মানুষ। এক জন পুরুষ, এক জন মহিলা, তবে তৃতীয় জন নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। সে পুরুষ কিংবা মহিলা দুই–ই হতে পারে, আধুনিক কোনো রোবট হলেও অবাক হব না। পুরুষমানুষটি তার সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু একটা দেখছে, স্ক্রিনটা আমার দৃষ্টিসীমা থেকে আড়াল করে রাখা আছে বলে মানুষটা কী দেখছে আমি জানি না। তার। মুখভঙ্গি এবং মাঝে মাঝে সূক্ষ্ম এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকানোর ভঙ্গি দেখে। মনে হচ্ছিল সম্ভবত সেখানে আমার সম্পর্কে কোনো তথ্য রয়েছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ হল এভাবে বসে আছি, নিজে থেকে কথা শুরু করার কথা নয় কিন্তু ভিতরে ভিতরে অধৈর্য হয়ে আছি বলে হয়তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। যদিও গত কয়েক ঘণ্টা আমার মস্তিষ্কে বসানো ট্রাকিওশানটি আমাকে কোনোভাবে উত্ত্যক্ত করছে না কিন্তু আমি ভিতরে ভিতরে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি, ট্রাকিওশানটি হঠাৎ করে চালু হয়ে গেলে আমি স্বাভাবিকভাবে কথাও বলতে পারব বলে মনে হয় না।

আমার সামনে বসে থাকা মহিলাটি হঠাৎ চোখ তুলে বলল, তুমি আমাদের কাছে কী চাও?

আমাকে অন্যায়ভাবে একটা খুনের—

অপ্রয়োজনীয় কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। মহিলাটি অনাবশ্যক রূঢ়তা ব্যবহার করে আমাকে থামিয়ে দিল। আমি আগেও লক্ষ করেছি একজন মেয়ে যত সহজে কোমল ব্যবহার করতে পারে ঠিক তত সহজে রূঢ় ব্যবহার করতে পারে।

মহিলাটি গ্রানাইটের টেবিলে তার চমৎকার নখ দিয়ে শব্দ করে বলল, তুমি ঠিক কী চাও?

আমি একমুহূর্ত চিন্তা করে বললাম, আমার মস্তিষ্কে যে ট্রাকিওশানটি বসানো হয়েছে সেটা সরাতে চাই।

মহিলাটি সহৃদয়ভাবে হাসল, বলল, এই তো চমৎকারভাবে ঠিক বিষয়ে কথা বলতে শিখে গেছ। তবে তোমার এই ইচ্ছাটি পূরণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিরক্ষা দপ্তর বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তে নাক গলাতে পারে না।

পারে।

আমার কথা শুনে পুরুষ এবং মহিলা দুজনেই একটু চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। তৃতীয় মানুষটির কোনো ভাবান্তর হল না, এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, পারে?

নিশ্চয়ই পারে।

তুমি কেন এ রকম কথা বলছ?

কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানি রিগা কম্পিউটার আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবর্তন করেছে। এই ধরনের অন্যায় কাজ বিচ্ছিন্নভাবে হতে পারে না। আমি নিশ্চিত সেটা ইচ্ছাকৃত। যে পদ্ধতিতে একটি অন্যায় কাজ করা হয় সেখানে নিশ্চয়ই আরো অসংখ্য অন্যায় এবং অনিয়মিত কাজ করা হয়।

মহিলাটি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। পুরুষমানুষটি একটু ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলল, তোমার অস্বাভাবিক শারীরিক ক্ষিপ্রতা থাকলেও বুদ্ধিমত্তা নিম্নশ্রেণীর।

আমি এক ধরনের অসহায় অপমানবোধ অনুভব করি, অত্যন্ত রূঢ় কিছু একটা বলার ইচ্ছে খুব কষ্ট করে সংযত করতে হল। শান্ত গলায় বললাম, আমি খুব সাধারণ মানুষ, খুব সাধারণ কাজ করি। আমার নিম্নশ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা দিয়েই বেশ কাজ চলে যায়।

ঠিক চলে না। তা হলে এখানে এসে উপস্থিত হতে না।

হয়তো আমাকে এখানে উপস্থিত করা হয়েছে। হয়তো পুরো ব্যাপারটি পূর্বপরিকল্পিত।

পুরুষমানুষটি এবারে শিস দেওয়ার মতো একটি শব্দ করে হেসে ফেলল এবং হঠাৎ করে তাকে একজন সহৃদয় মানুষের মতো দেখাতে থাকে। মানুষটি তার সামনে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে টোকা দিতে দিতে বলল, আমরা যদি তোমার ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা। মিটিয়ে দিই তুমি আমাদের কী দেবে?

তোমরা যদি ট্রাকিওশানটি বের করে দাও–

মানুষটি হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি ট্রাকিওশান বের করার কথা বলি নি।

আমি থতমত খেয়ে বললাম, তা হলে?

ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি।

পার্থক্যটা কী?

তোমার মস্তিষ্কে যে ট্রাকিওশানটি রয়েছে, তার যে প্রোগ্রাম রয়েছে সেটা হচ্ছে একজন খুনিকে নিয়ন্ত্রণ করার ট্রাকিওশান। আমরা প্রোগ্রামটি পাল্টে দিতে পারি।

কী দিয়ে পাল্টে দেবে?

যদি দেখি তুমি আমাদের সত্যিকার কোনো কাজ করে দিতে পারছ তা হলে নিরীহ কোনো প্রোগ্রাম দিয়ে পাল্টে দিতে পারি। তোমাকে যন্ত্রণা না দিয়ে সেটি বরং তোমাকে সাহায্য করবে–

চাই না আমি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি চাই না আমার মস্তিষ্কের ভিতরে একটা ট্রাকিওশান বসে থাকুক

আমিও চাই না এ রকম চমৎকার একটা দিনে অন্ধকার একটা ঘরে বসে একজন নিম্নশ্রেণীর খুনির সাথে তর্ক করি। কিন্তু তবু আমাকে সেটা করতে হয়।

আমি আবার অসহায় অপমানবোধ অনুভব করতে থাকি। মানুষটা গলার স্বর একটু উঁচু করে বলল, তোমার কিছু করার নেই। যদি আমাদের জন্য ছোট একটা কাজ করে দাও তোমার ট্রাকিওশানের প্রোগ্রাম পাল্টে দিতে পারি। ব্যস, আর কিছু বলে লাভ নেই।

প্রোগ্রামটা—

মানুষটা অধৈর্যের মতো মাথা নেড়ে বলল, আমি আর কিছু নিয়ে কথা বলতে চাই না। যদি রাজি থাক তা হলে বল রাজি আছি, আমাদের তথ্যকেন্দ্রে সেটা গ্রহণ করে নিই। যদি রাজি না থাক তা হলে বল রাজি নই, তোমার নিয়ন্ত্রণটা ট্রাকিওশানের পুরোনো প্রোগ্রামে ফিরিয়ে দিই।

আমি প্রায় মরিয়া হয়ে বললাম, কাজটা কী?

আমি জানি না। যদি জানতামও তোমাকে বলতাম না।

তা হলে–

আমি আর কিছু শুনতে চাই না। মানুষটা হঠাৎ অনাবশ্যকভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, তুমি রাজি থাকলে বল। আমি তোমাকে ঠিক দুই সেকেন্ড সময় দিচ্ছি।

আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, প্রকৃতপক্ষে আমাকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হয় নি। পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা বড় পরিকল্পনার অংশ, আমি কী বলি তাতে মনে হয় কিছু আসে–যায় না। আমাকে নিয়ে যেটা করার কথা সেটাই নিশ্চয়ই করা হবে। আমি ইচ্ছে করলে রাজি না হওয়ার ভান করতে পারি তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। যদি রাজি হওয়ার ভান করি হয়তো ব্যাপারটা বোঝার একটু সময় পাব।

দুই সেকেন্ড অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বললাম, আমি রাজি।

চমৎকার। মানুষটা না–পুরুষ না–রমণী চেহারার মানুষটিকে বলল, ক্লিও, তুমি তা হলে কাজ শুরু করে দাও।

ক্লিও খসখসে গলায় বলল, সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো?

প্রোফাইলটা আরেকবার দেখে নাও। সিস্টেম সাতাই দিয়ে কনফ্লিক্ট হতে পারে।

ঠিক আছে।

ছোট একটা ঘরে সাদা একটা বিছানায় শুইয়ে আমার মস্তিষ্কের প্রোফাইল নেওয়া হল। একটা বড় মনিটরে ঝুঁকে পড়ে ক্লিও কিছু একটা দেখছিল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ক্লিও।

কী হল?

তুমি কি মানুষ না রোবট?

ক্লিও বিরক্ত হয়ে বলল, কাজের সময় তুমি বড় বিরক্ত কর।

আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, ক্লিও মানুষ নয়, রোবট।

.

প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে ফিরে আসার পর দুই দিন কেটে গেছে। এই দুই দিন নতুন কিছুই ঘটে নি। আমার মাথায় ট্রাকিওশানটি রয়ে গেছে এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে সেখানে নতুন একটি প্রোগ্রাম প্রবেশ করানো হয়েছে কিন্তু আমি এখনো তার কোনো সাড়া পাই নি। যেন কিছুই হয় নি সেরকম একটা ভান করে আমি কাজে গিয়েছি, গত দুই দিন কেন অনুপস্থিত ছিলাম সেটা নিয়ে আমাকে একটা ছোট কৈফিয়ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

তৃতীয় দিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগের মুহূর্তে আমার সাথে প্রথমবার যোগাযোগ করা হল। কমবয়সী একটা মেয়ের গলায় একজন আমাকে ফিসফিস করে ডাকল, কিরি।

কণ্ঠস্বরটি কার হতে পারে পুরোপুরি জানার পরও আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কে?

আমি। তোমার ট্রাকিওশান। তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে ইশি বলে ডাকতে পার।

ইশি?

হ্যাঁ। আমি কি তোমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?

তুমি বলতে চাইছ আমি যদি রাজি না হই তা হলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না?

না, বলব না। আমি সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি। আমি পুরোপুরি তোমার নিয়ন্ত্রণে। তোমার না চাওয়া পর্যন্ত আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।

ইশি নামক সিস্টেম সাতানব্বই গ্রুপ বারো পয়েন্ট বি প্রোগ্রামটি তরল কণ্ঠে হাসার মতো শব্দ করে বলল, পরীক্ষা করে দেখ। তুমি বল দূর হও হতভাগা আমি তোমার কথা শুনতে চাই–আমি তা হলে তোমাকে আর বিরক্তকরব না।

সত্যি করবে না? কখনোই করবে না?

সেটা অবশ্য আমি বলতে পারব না। ইশি গলার স্বরে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল, প্রতিরক্ষা দপ্তরকে তুমি কথা দিয়েছ তাদের একটা কাজ করে দেবে। সেটা নিয়ে যদি প্রতিরক্ষা দপ্তর কিছু বলতে চায় তা হলে সেটা তোমাকে জানাতে হবে। তুমি শুনতে না। চাইলেও তোমাকে জানাতে হবে।

ও।

তা হলে কী দাঁড়াল? ইশি বলল, তোমার সাথে কথা বলব নাকি বলব না?

এটা কি প্রতিরক্ষা দপ্তরের আদেশ?

অনেকটা সেরকম।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তা হলে শোনা যাক। ব্যাপারটা নিয়ে আমার নিজেরও একটু কৌতূহল হচ্ছে।

ইশি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমাকে ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমি গত দুই দিন তোমার চিন্তাভাবনাকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আমি দেখতে পেয়েছি তুমি মানুষটা খুব কোমল স্বভাবের। তোমাকে যে কাজটা করতে হবে সেটি তোমার স্বভাবের সাথে একেবারেই খাপ খায় না।

আমাকে কী করতে হবে?

একটা খুন করতে হবে।

খুন? কাকে?

কাকে নয় ‘কী’–কে।

আমি বুঝতে পারছি না। যে জিনিসটা খুন করতে হবে সেটা যদি মানুষ না হয়ে থাকে তা হলে তুমি খুন কথাটা ব্যবহার করছ কেন? একটা যন্ত্র আমরা খুন করি না। আমরা ধ্বংস করি।

আমি যে জিনিসটার কথা বলছি সেটা মানুষের এত অবিকল প্রতিচ্ছবি, মানুষের এত সফল অনুকরণ যে সেটাকে মানুষ বলায় কোনো ক্রটি নেই। তাই আমি খুন কথাটা ব্যবহার করছি। ইশি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তুমি যদি আপত্তিজনক মনে কর আমি এই শব্দটা ব্যবহার করব না।

আমি হাত নেড়ে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললাম, কী শব্দ ব্যবহার করা হল তাতে কিছু আসে–যায় না। কী কাজ করতে হবে সেটাই হচ্ছে আসল কথা।

তা ঠিক।

আমাকে তা হলে একটা রোবট ধ্বংস করতে হবে?

জিনিসটি পুরোপুরি রোবট নয়। এর ভিতরে রয়েছে কিছু যন্ত্র কিছু জৈবিক জিনিস আবার কিছু জিনিস যেটা যান্ত্রিকও নয় জৈবিকও নয়।

এটা কী? কোথা থেকে এসেছে?

ইশি একটু ইতস্তত করে বলল, ঠিক করে কেউ জানে না।

তার মানে তুমি আমাকে বলবে না।

বলতে পার। আমি খুব বেশি জানি না, কিন্তু যেটুকু জানি সেটুকুতেই নিষেধ রয়েছে।

তা হলে তুমি কেমন করে আশা কর কিছু না জেনেশুনে আমি হঠাৎ করে কাউকে খুন করে ফেলব?

তোমাকে যেটা জানানো প্রয়োজন সেট আমরা জানাব। তা ছাড়া—

তা ছাড়া কী?

তোমাকে খুন করার জন্য আলাদা করে আমাদের কিছু করতে হবে না। তুমি নিজে তোমার সর্বশক্তি দিয়ে সেটিকে শেষ করার চেষ্টা করবে।

কেন এই কথা বলছ?

তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্র বা প্রাণীটি তোমাকে কোনো সুযোগ দেবে না। তুমি যদি তাকে হত্যা না কর সেটি তোমাকে চোখের পলকে হত্যা করে ফেলবে।

কেন?

এই খেলাতে সেটাই নিয়ম। আমরা খেলোয়াড় মাত্র। নিয়ম তো আমরা তৈরি করি নি।

ও!

.

আমার আরো দুদিন কেটে গেল কোনোরকম যন্ত্রণা ছাড়াই। একদিন বিকেলে পানশালাতে গেলাম নিফ্রাইট মেশানো পানীয় খেতে। কোমের সাথে দেখা হল সেখানে, দুই গ্লাস নিফ্রাইট খেয়ে তার মস্তিষ্কে সিনান্সের খেলা চলছে, আমার দিকে চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল, এই যে প্রতিরক্ষা দপ্তরের রোবট!

আমি ভিতর ভিতরে একটু চমকে উঠলাম। আমার মাথার ভিতরে একটা ট্রাকিওশানে প্রতিরক্ষা দপ্তরের একটা প্রোগ্রাম বসানো রয়েছে আমাকে মনে হয় সত্যি এখন রোবট ডাকা যায়। কোম অবশ্য তার কিছু জানে না, ব্যাপারটি গোপন রাখার কথা। গোপন না রাখলে কী হবে আমি জানি না, কিন্তু ব্যাপারটা আমার পরীক্ষা করার সাহস হল না। কোম নিফ্রাইট মেশানো পানীয়ের তৃতীয় গ্লাসটিতে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, তোমার চকচকে ভাবটি নেই, কেমন যেন ভুসভুসে হয়ে গেছ!

আমি কোমের সামনে খালি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, একসময় চকচকে ছিলাম তা হলে?

ছিলে। তোমার মন ভালো থাকলেই তোমাকে চকচকে দেখায়! তোমার নিশ্চয়ই মন খারাপ। কী হয়েছে বল?

আমি একটু অবাক হয়ে কোমের দিকে তাকালাম, সত্যি কি আমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমি খুব বড় দুঃসময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি! আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল, কোম, তুমি সত্যিই বুঝেছ। আমার খুব মন খারাপ। আমার মাথায় একটা ধুরন্ধর ট্রাকিওশান বসানো আছে, সেটি আমাকে দিয়ে একটি খুন করিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমি সেটা বললাম না, শব্দ করে হেসে বললাম, কোম, তুমি আর যা–ই কর কখনো মনোবিজ্ঞানীর চাকরি নিও না, না খেতে পেয়ে মারা যাবে।

কোম একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি আমার কাছে কিছু–একটা লুকাচ্ছ। বল কী হয়েছে?

আমি কোমের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে বললাম, আমার কিছু হয় নি।

তার মানে তুমি আমাকে বলবে না।

আমি কোনো কথা না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আকাশে চমৎকার মেঘ করেছে। দূরে বনাঞ্চলে ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে, গাছের পাতা নড়ছে বাতাসের ঝাপটায়। কী চমৎকার লাগছে দেখতে! জানালার এই দৃশ্যটি কৃত্রিম তবু সেটিকে সত্যি বলে ভাবতে ভালো লাগে।

চতুর্থ দিন ভোরবেলা আমি কাজে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমার মস্তিষ্কের ভিতর থেকে ইশি বলল, কিরি, তোমার আজকে কাজে যাবার প্রয়োজন নেই।

কেন?

তোমাকে আজ প্রতিরক্ষা দপ্তরে যেতে হবে।

প্রতিরক্ষা দপ্তরে?

হ্যাঁ। তোমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালনা শেখানো হবে। কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হবে।

আমি যদি যেতে না চাই?

কেন চাইবে না? ইশি হাসির মতো একটা শব্দ করে বলল, তোমার জন্য পুরো ব্যাপারটি হবে আশ্চর্য রকম সহজ।

আমি কোনো কথা না বলে একটা নিশ্বাস ফেললাম।

.

প্রতিরক্ষা দপ্তরের অফিসটিকে বাইরে থেকে চেনার কোনো উপায় নেই। ইশি আমাকে না বলে দিলে আমি কোনোদিন সেখানে প্রবেশ করতাম না। বড় কালো দরজার পিছনেই কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিল, একজন এগিয়ে এসে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বলল, আমার নাম বর্কেন। এটা অবশ্য আমার সত্যিকারের নাম নয়। আজকের জন্য আমার নাম বকেন।

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার সত্যিকারের নাম বললে ক্ষতি কী?

নিষেধ রয়েছে। এখানে এটা তৃতীয় মাত্রার অপরাধ।

ও।

আমার সাথে আছে দুই জন, কুন্না এবং ত্রালুস।

এগুলোও কি বানানো নাম?

হ্যাঁ।

তোমরা কি সবাই রোবট?

মানুষটা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু–একটা বলতে যাচ্ছিল আমি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তুমি রোবট কি না তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান আছে সেটা আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমারও নিজেকে রোবট বলে মনে হয়। পুরোপুরি রোবট হয়ে গেলে খারাপ হয় না।

বৰ্কেন নামের মানুষটা মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, বেশ ভালোই হল তা হলে। আমাদের কাজ শেষ হলে তুমি মোটামুটিভাবে পুরোপুরি রোবটই হয়ে যাবে।

আমি চমকে উঠে মানুষটার দিকে তাকালাম, তার চোখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই।

.

ইশি যখন আমাকে বলেছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরে আমাকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র চালানো শেখানো হবে আমার ধারণা ছিল সেগুলো হবে সনাতনধর্মী অস্ত্র, লেজার রশ্মিচালিত বিস্ফোরক বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু প্রতিরক্ষা দপ্তরের মানুষেরা তার ধারেকাছে দিয়ে গেল না। তারা আমার ডান হাতের তর্জনী কেটে সেখানে ছোট একটি টিউব বসিয়ে দিল, তার পিছনে প্রক্ষেপণের জন্য যে যান্ত্রিক অংশটুকু রয়েছে সেটিকে আঙুলের নার্ভের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি তর্জনী টানটান করে সেই যান্ত্রিক অংশটুকু চালু করতে পারি। সাথে সাথে ভয়াবহ টিউবের ভিতর দিয়ে ছুটে যাবে শক্তিশালী বিস্ফোরক। সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত একটি শত্রু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে একমুহূর্তে।

আমার মুখের ভিতরে, জিভের নিচে বসানো হল দ্বিতীয় অস্ত্রটি, দাঁতের সাথে শক্ত করে আটকানো হয়েছে সেটি। ফুঁ দেওয়ার ভঙ্গিতে সেটাকে চালু করে তার যান্ত্রিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মুহূর্তে ছুঁড়ে দেওয়া যাবে ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরক।

সবশেষে অবশ্য আমাকে কিছু পরিচিত অস্ত্রও দেওয়া হল। তার ব্যবহারও শেখানো হল। দুই কিলোমিটার দূর থেকে আমি নিখুঁত নিশানায় ধ্বংস করে দিতে শিখে গেলাম যে কোনো জিনিস। ট্রাকিওশানে অনুপ্রবেশ করানো হল প্রোগ্রাম, উপগ্রহের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হল তার। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে চোখের পলকে যোগাযোগ করা যাবে আমার সাথে। কপালে ফুটো করে সেখানে লাগানো হল ইনফ্রারেড সেল, অন্ধকারে দেখার জন্য চোখের পাতায় সার্জারি করে লাগানো হল মাইক্রোচিপ। আমার রক্তে মেশানো হল বিশেষ হরমোন, নিশ্বাসে দেওয়া হল বিশুদ্ধ অক্সিজেন। আমার চামড়ার নিচে বসানো হল বায়োকেমিক্যাল সেল, শরীরের বিশেষ উত্তেজক ড্রাগ দিয়ে আমার সমস্ত স্নায়ুকে সতর্ক করে রাখা হল সর্বক্ষণের জন্য।

হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত করে প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বিশেষ একটি হলঘরে, সেখানে আমার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল আরো চার জন মানুষ। তাদের দুই জন মধ্যবয়সী, অন্য দুই জন প্রায় তরুণ। তারা স্বল্পভাষী এবং মুখভঙ্গি কঠোর। আমাকে দেখামাত্র তারা শীতল গলায় কথা বলতে শুরু করল। মধ্যবয়স্ক একজন বলল, শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে শত্রুকে চেনা। আমি খুব দুঃখিত যে এই যুদ্ধে তোমার সেই সৌভাগ্য হবে না।

আমার মুখের মাঝে লাগানো বিচিত্র অস্ত্রটিতে আমি এখনো অভ্যস্ত হতে পারি নি, সেটির কারণে আমার কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল, এক ধরনের জড়িয়ে যাওয়া উচ্চারণে বললাম, কেন এ কথা বলছ?

তোমার শত্রুকে চেনা প্রায় দুঃসাধ্য। সে অবলীলায় তার রূপ পরিবর্তন করতে পারে। তার যান্ত্রিক কাঠামোর ওপরে আধা জৈব এক ধরনের টিস্যু রয়েছে, সেটি অবিকল মানুষের ত্বকের মতো। সে ইচ্ছে করলে হুবহু মানুষের রূপ নিতে পারে।

তরুণ মানুষটি কোনো একটি সুইচ স্পর্শ করা মাত্র ঘরের মাঝামাঝি একটি হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে এল। আধা যন্ত্র আধা জৈবিক অত্যন্ত কদাকার একটি রূপ। মুখমণ্ডল আকৃতিহীন, চোখের জায়গায় দুটি গভীর গর্ত যার ভিতর থেকে দুটি লাল বর্ণের ফটোসেল জ্বলছে। তরুণটি উত্তাপহীন গলায় বলল, এটি সম্ভবত এই যন্ত্রটির প্রকৃত রূপ। কিন্তু তুমি তাকে এই রূপে দেখবে না। তুমি সম্ভবত তাকে এই রূপে দেখবে–

তরুণটি সুইচের কোনো এক জায়গায় স্পর্শ করামাত্র কদাকার যন্ত্রটি অনিন্দ্যসুন্দর একজন কিশোরের রূপ নিয়ে নিল।

কিংবা এই রূপে– কিশোরটি একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষে পরিণত হল, উঁচু চোয়াল, গভীর বিষণ্ণ নীল চোখ এবং একমাথা কোঁকড়ানো চুল।

আমাদের শেষ তথ্য অনুযায়ী যন্ত্রটি ইদানীং একটি মেয়ে রূপ গ্রহণ করছে। তার চেহারা সম্ভবত এ রকম।

হলোগ্রাফিক ছবিটি একটি স্বল্পবসনা রূপবতী মেয়ের রূপ গ্রহণ করে। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই অপূর্ব রূপবতী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি তার প্রাণহীন একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, এই যন্ত্রটি বাইরে যে রূপ নিয়েই থাকুক না কেন, তার ভিতরে রয়েছে অসম্ভব জটিল কিছু যান্ত্রিক কলকব্জা। দেশের একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংস্থা কিছু নীতিহীন বিজ্ঞানীদের দিয়ে এই আধা যান্ত্রিক জৈবিক রোবটটিকে তৈরি করেছে। তার কপোট্রনের মেমোরি প্রায় মানুষের কাছাকাছি, চিন্তা করার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। তার শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অনেকগুণ বেশি। সাধারণ রোবট কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী হয়, এই আধা জৈবিক রোবটটি প্রায় সব বিষয়ে পারদর্শী। তার প্রধান শক্তি হচ্ছে অমানুষিক নিষ্ঠুরতা। মানুষের প্রতি এক বিচিত্র ঘৃণা তার ভিতরে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। সেই ঘৃণা যে কী ভয়ঙ্কর আমরা এখনই তার একটা প্রমাণ দেখাব।

ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক ছবিটি পাল্টে গিয়ে সেখানে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্য দেখানো শুরু হয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের এজেন্টদের শরীরে লাগানো ক্যামেরা থেকে তোলা কিছু ছবির পুনর্গঠন। ছবিগুলো স্পষ্ট কিংবা পূর্ণাঙ্গ নয়, ঘটনার বীভৎসতা সে কারণে মনে হয় আরো ঠিকভাবে ধরা পড়েছে। যে দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছে সেগুলো সত্যি ঘটেছে চিন্তা করে আমার সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে ওঠে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, এই অস্বাভাবিক আধা জৈবিক বরাবটের সাথে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করা খুব সহজ নয়। আমাদের চার জন এজেন্ট ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। সম্ভবত তুমিও প্রাণ হারাবে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করেই যেতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি, তার ওপর ভিত্তি করে তোমাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই আধা জৈবিক রোবটটির কাছাকাছি তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন হয় সে তোমাকে হত্যা করবে, না হয় তুমি তাকে হত্যা করবে।

আমি চুপচাপ বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এই ধরনের ভয়ঙ্কর একটা জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল কে জানত?