কূর্ম অবতারের কাহিনী
স্বর্গলোকের নন্দন কাননের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মহামুনি দুর্বাসা। শুনতে পেলেন ঘণ্টা ও শঙ্খের আওয়াজ। সেই আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটে গেলেন। সেসময় ঊর্বশী শ্রী বিষ্ণুর পুজোয় ব্যস্ত ছিল।
দুর্বাসা মুনিকে অতিথি রূপে গ্রহণ করে পরম সমাদরে তাঁর পূজা করল ঊর্বশী। গত রাতে ইন্দ্রের কাছ থেকে সে একটি মালা উপহার পেয়েছিল। অতিথি মুনিকে সেই বাসি মালা দিয়ে সে মুনির পুজো শেষ করল।
দুর্বাসা চললেন এবার ইন্দ্র সমীপে। পথেই তার সাথে দেখা হয়ে গেল। ইন্দ্র তখন ঐরাবতে চড়ে বেড়াচ্ছিলেন। মুনি নিজের গলা থেকে মালাটি খুলে ইন্দ্রের গলায় পরিয়ে দিলেন। ইন্দ্রের চিনতে দেরী হল না যে, এ সেই পারিজাত মালা যা, গতকাল তিনি ঊর্বশীকে দিয়েছিলেন। তার মানে ঋষিও ঊর্বশীর প্রতি টান বোধ করেন। মনে মনে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। গলা থেকে পারিজাত মালা খুলে ছুঁড়ে দিলেন। সেটি গিয়ে পড়ল ঐরাবতের মাথায়। ঐরাবত সেটি মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে থেঁতলে দিল।
ঋষি প্রদত্ত আশীর্বাদী সূচক উপহার অবজ্ঞা ভরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ায় দুর্বাসা মুনি ইন্দ্রের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে শাপ দিলেন–তুমি শ্রীভ্রষ্ট হবে।
ইন্দ্র শ্রীভ্রষ্ট হলে সুযোগ পেয়ে অসুরগণ দেবতাদের সব কিছু অধিকার করল। স্বর্গচ্যুত হয়ে দেবতারা সদলবলে পদ্মযোনি ব্রহ্মার কাছে এসে হাজির হলেন। ব্রহ্মা তাঁদের সকলকে নিয়ে গেল শিবের কাছে। শিব এবং ব্রহ্মা অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে হাজির হলেন ক্ষীরোদ সাগরের তীরে শ্বেতদ্বীপে, সকলে মিলে শ্রীভগবানের স্তব শুরু করলেন।
দেবতাদের প্রতি সদয় হলে শ্রীহরি সেখানে এসে স্বয়ং আবির্ভূত হলেন।
শ্রীহরি বললেন–হে ব্রহ্মা, হে শিব, হে দেবতাগণ শুক্রাচার্যের মন্ত্রণা দ্বারা দানব ও দৈত্যগণ যতদিন পরিচালিত না হবে, ততদিন তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতিমধ্যে তোমরাও কোনো বুদ্ধির হদিস পাবে। তাই বলছি, তোমরা ওইসব অসুরদের সাথে সন্ধি করো। এতে তোমাদের মঙ্গল হবে।
এখন আমি যা বলছি, মন দিয়ে শোন। ক্ষীর সমুদ্রে সমস্ত রকম ওষধি নিক্ষেপ করো, ফলে অমৃত সৃষ্টি হবে। সেই অমৃত তোলার জন্য মন্দার পর্বত দণ্ডরূপে আর বাসুকি রঞ্জুরূপে তোমাদের সাহায্য করবে। আমিও তোমাদের সহায় হব। এই কাজ করতে গিয়ে অসুরগণ ক্লেশ ভাগী হবে আর তোমরা তার সুখফল ভোগ করবে।
এই বলে শ্রীহরি সেখান থেকে চলে গেলেন।
দেবতাগণ এলেন অসুর রাজ বলির কাছে। শ্রীবিষ্ণুর উপদেশ সম্পর্কে অবগত হলে অসুরেরা অমৃত পানের আশায় দেবতাদের সঙ্গে হাত মেলাল।
এইভাবে শুরু হল সমুদ্র মন্থনের কাজ। বহু কষ্টে দেব ও অসুরগণের সাহায্যে মন্দর পর্বর্তকে। উত্তোলিত করা হল কিন্তু ক্ষীরোদ সাগরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। এবার স্বয়ং শ্রীহরি একাজে হাত লাগালেন। এক হাতে তিনি মন্দর পর্বতকে তুলে ধরলেন। এবং গুরুড়ের পিঠে চাপিয়ে দিলেন। গরুড় অনায়াসে এই পাহাড়কে এনে স্থাপন করল ক্ষীরোদ সাগরের বক্ষে। এবার সর্পরাজ বাসুকিকে পর্বতের চারধারে ঘিরে বেঁধে ফেলা হল। অসুররা রঞ্জুর এক প্রান্ত এবং দেবগণ অন্য প্রান্ত ধরে সমুদ্র মন্থন করতে শুরু করলেন।
কিন্তু দেখা দিল বিপত্তি। গুরুভারে পর্বত সমুদ্রের তলায় ঢুকে যেতে শুরু করল। সবাই শুকনো মুখে ভাবতে লাগলেন কি করা যায়। আবার শ্রীহরির স্মরণ নিলেন সকলে। শ্রীহরি এক কুর্মের রূপ ধারণ করে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে পৃষ্ঠদেশে তুলে ধরলেন সেই বিশাল মন্দর পর্বতকে। আবার শুরু হল মন্থনের কাজ।
প্রথমে উঠল তীব্র হলাহল বিষ, যে বিষের জ্বালায় ত্রিভুবনের সব প্রাণ বিনষ্ট হবে। লোকপালগণ অতিশয় ভীত হয়ে শিবের স্মরণ নিলেন। শিব স্বয়ং সেই হলাহল পান করে জগতকে বিষমুক্ত করলেন। নিজে হলেন মৃত্যুঞ্জয়। কণ্ঠে ধারণ করে নাম নিলেন নীলকণ্ঠ।
বিষের বিনাশ ঘটল। সুরাসুরগণ আবার মহোল্লাসে মন্থনের কাজ শুরু করলেন, এবার উঠে এল এক গাভী। নাম সুরভি। যজ্ঞাদির প্রয়োজনে পবিত্র ঘৃত কামনা লাভে ব্রহ্মবাদী ঋষিকুল সেই গাভী গ্রহণ করলেন। এবার উঠে এল এক অশ্ব, শ্বেতবর্ণ উচ্চৈঃশ্রবা। দৈত্যরাজ বলি তাকে সাদরে নিয়ে এলেন। পাওয়া গেল ঐরাবত নামক এক হস্তি। চারি দণ্ড বিশিষ্ট সেই গজ নিলেন স্বয়ং ইন্দ্র। ভগবান হরি কৌস্তুভ নামক পদ্মরাগ মণিটি বক্ষে ধারণ করার বাসনায় সেটি গ্রহণ করলেন। পাওয়া গেল এক কল্প বৃক্ষ, নাম পারিজাত। এবার সমুদ্র উথিত করে উঠে এলেন স্বয়ং মহাদেবী লক্ষ্মী। সেই দেবীর রূপের কাছে অসুর ও দেবগণ কামাসক্ত হলেন। সকলে মিলে তার সেবায় রত হলেন। কিন্তু লক্ষ্মীদেবী কারো কাছে গেলেন না, সদয় হলেন শ্রীহরির প্রতি। তাকেই স্বামী রূপে গ্রহণ করলেন।
এবার মন্থন করে পাওয়া গেল সুরা। অসুরগণ তা পান করে মহাতৃপ্ত হল। অতঃপর উঠে এল এক পুরুষ অপূর্ব তার দেহবল্লরী, অলঙ্কারে বিভূষিত, হাতে তাঁর কলস, অমৃত ভাণ্ডার। সুরাসুরগণ এই অমৃতের জন্যই মন্থন চালিয়ে ছিল। সেই আশা তাদের পূর্ণ হতে চলেছে। অমৃতের ভাণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। দেবতারা পারবে কেন দানবের সাথে? অমৃতের ভাণ্ড চলে গেল অসুরদের হাতে। তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল, খুবই বিশৃঙ্খলা দেখা দিল, দেবতারা মুখ ভার করে শ্রীবিষ্ণুর কাছে হাজির হলেন। শ্রীবিষ্ণু এক অপরূপা নারীর মূর্তি ধারণ করলেন। তাকে দেখে অসুরদেরও মনে কামনা জাগল। তারাও ওই সুন্দরীর পরিচয় জানতে চাইল। এবং সেই অপরূপা মোহিনীকে অনুরোধ করল অসুরদের মধ্য অমৃত বণ্টন করার জন্য।
নারীরূপী শ্রীহরি বললেন– পণ্ডিতরা বলে থাকেন, কামিনীকে কখনও বিশ্বাস করো না। তোমরা আমার প্রতি এত আস্থাশীল হচ্ছো কেন?
অসুরদের সঙ্গে কামিনীর পরিহাস ছলে নানা কথা বার্তা হল। দৈত্যরা অমৃতের ভাণ্ড নির্দ্বিধায় ওই নারীর হাতে তুলে দিল।
ভগবান বললেন–আমি যা করব, তা যদি তোমরা মেনে নাও, তাহলে হে অসুরগণ, এই অমৃত আমি ভাগ করে তোমাদের দিতে পারি।
অসুরগণ তখনও পর্যন্ত কামিনীর আসল পরিচয় জানে না। তারা বলল–বেশ তোমার কথাই আমরা মেনে নিলাম।
তারপর সেই মোহিনী রমণী দেবতা ও অসুরদের পৃথক পৃথক সারিতে বসতে বললেন। নানা অঙ্গ ভঙ্গি করে কথায় প্রলোভনে অসুরদের ফাঁকি দিয়ে দেবতাদের সেই অমৃত দান করলেন, জরমরণহারিণী অমৃত সুধা থেকে বঞ্চিত হল দানবরা তাদের ভাগে কিছুই পড়ল না। কিন্তু তারা মুখে কিছু বলল না। বিষণ্ণ বদনে বসে রইল।
কিন্তু রাহু নামে এক অসুর সেই মোহিনী রমণীর ছলাকলা বুঝতে পেরে নিজেদের সারি থেকে সে ঢুকে পড়ল দেবতাদের সারিতে, পরনে দেবতার বেশ। সূর্য ও চন্দ্রের মাঝে একটু জায়গা ফাঁকা পেয়ে সেখানে বসে পড়ল। মোহিনী মূর্তি তাকেও সুধা বিতরণ করল। সে সঙ্গে সঙ্গে তা পান করল। চন্দ্র আর সূর্য ওই দানবের আসল পরিচয় শ্রীহরিকে জানিয়ে দিলেন। শ্রীহরির রাহুর মস্তক সুদর্শন চক্রের সাহায্যে কর্তন করলেন। তখনও পর্যন্ত অমৃত দ্বারা পুষ্ট হয়নি রাহুর দেহ। ফলে তার মুণ্ড ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। অমৃত পানের প্রভাবে তার মস্তকটি অমরত্ব লাভ করল।
দেবতাদের বিষ্ণুর পাদপদ্ম আশ্রয় করেই অমৃত রূপ ফল লাভ করলেন। কিন্তু অসুর ও দানবরা সকল তা থেকে বঞ্চিত হলেন। মানুষ প্রাণ, ধন, কর্ম এবং বাক্যাদি দ্বারা যা কিছু করে সব শ্রীহরিকে নিবেদন না করে পুত্রকন্যা এবং অন্যান্যদের জন্য রেখে দেয়, এ সবই হল অসৎ। আর শ্রীভগবানে অর্জন করে শরীর ইত্যাদি শোষণের জন্য দেবাদির যা কিছু করা হয়, তা হল সৎ। রথের মূল দেশে জল সেচ করলে যেমন গাছের শাখা প্রশাখা পাতা, ফল, ফুল ইত্যাদি যেমন পরিতৃপ্তি লাভ করে ভগবান শ্রীহরিও তেমন সন্তুষ্ট হন।