কুন্তল রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে সাধারণের উপভোগ্য নগরোদ্যান। উদ্যান ঘিরিয়া চক্রাকার রাজপথ, রাজপথের অপর পার্শ্বে সারি সারি অট্টালিকা, বিপণি, মদিরাগৃহ পতাকা ও তোরণমাল্যে ভূষিত হইয়া শোভা পাইতেছে।
নগরোদ্যানের কেন্দ্রে একটি অতি সুদৃশ্য মর্মরনির্মিত কন্দর্প মন্দির; মন্দিরের দেয়াল নাই। কেবল চারিটি স্তম্ভ; তাই বাহির হইতে কন্দর্পদেবের ধনুর্ধর মূর্তি দেখা যাইতেছে। স্থানে স্থানে নাগরিকদের উপবেশনের জন্য প্রস্তরবেদিক আছে। উদ্যানের চারি প্রান্তে চারিটি প্রস্রবণ; উহার জল গো-মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়া বৃহৎ শ্বেত জলাধারে পড়িতেছে। একঝাঁক পারাবত উদ্যানভূমিতে বসিয়া নির্ভয়ে উঞ্ছবৃত্তি করিতেছে। কুঞ্জের বিতানবাটিকায় নানা বর্ণের ফুল ফুটিয়া নব বসন্তের জয় ঘোষণা করিতেছে।
আজ মদনোৎসব; তাহার উপর রাজকন্যার স্বয়ংকর। নগরের উত্তেজনা চতুর্গুণ বাড়িয়া গিয়াছে। নানা দিগ্দেশ হইতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং রাজন্যবর্গের সমাগমে নগরী গম্গম্ করিতেছে।
উদ্যান ও রাজপথের মধ্যবর্তী স্থানে অগণিত ফুলের দোকান বসিয়াছে। দারু নির্মিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ, চারিটি দণ্ডের উপর অবস্থিত; তাহার মধ্যে রাশীকৃত ফুল। ফুলের রাশির মধ্যে এক একটি যুবতী মালিনী বসিয়া আছে, তাম্বূলরঞ্জিত বিম্বাধরে হাসিয়া বিলাসী নাগরিকদের পুষ্পমালা পুষ্পের অঙ্গদ কুণ্ডল শিরোভূষণ বিক্রয় করিতেছে।
পথে জনস্রোত আবর্তিত। মাঝে মাঝে উষ্ট্রের সারি বাণিজ্যদ্রব্য বহন করিয়া উত্তুণ্ড অবজ্ঞাভরে চলিয়াছে। দোলা চতুর্দোলারও অভাব নাই, সম্ভ্রান্ত পুরুষ ও মহিলাদের বহন করিয়া স্থান হইতে স্থানান্তরে যাতায়াত করিতেছে।
সহসা এই পথের উপর ক্ষণকালের জন্য এক চাঞ্চল্যকর ব্যাপার ঘটিয়া গেল। প্রধান পথটি হইতে কয়েকটি শাখাপথ বাহির হইয়া গিয়াছিল; এইরূপ একটি পথ দিয়া প্রচণ্ড বেগে একটি উন্মত্ত অশ্ব বাহির হইয়া আসিল। অশ্বের পৃষ্টে একজন আরোহী অতি কষ্টে নিজেকে জুড়িয়া রাখিয়াছে। ক্ষিপ্ত অশ্ব দেখিয়া পথের জনতা সভয়ে চারিদিকে ছিট্কাইয়া পড়িল। একটি ফুলের দোকানের সম্মুখ পর্যন্ত আসিয়া অশ্ব দুই পায়ে দাঁড়াইয়া উঠিয়া গতিবেগ সংবরণ করিল, তারপর গতি পরিবর্তন করিয়া উগ্রবেগে অন্য একটা পথ দিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।
অশ্ব ও অশ্বারোহী আমাদের পরিচিত। তাহারা অন্তর্হিত হইলে পথের কোলাহল ও উত্তেজনা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিল। যে ফুলের দোকানটিকে অশ্ববর প্রায় বিমর্দিত করিয়া গিয়াছিল, তাহার অধিষ্ঠাত্রী মালিনী এতক্ষণে ফুলের স্তূপ হইতে মাথা তুলিয়া চাহিল। দোকানের সম্মুখে তিনটি নাগরিক ছিলেন, ঘোটকের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা কে কোথায় তিরোধান করিয়াছিলেন; এখন তাঁহাদের মধ্যে দুইজন দোকানের নিম্নদেশ হইতে গুড়ি মারিয়া বাহিরে আসিলেন। বেশভূষা কিছু অবিন্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার সংস্কার করিতে করিতে ও জানুর ধূলা ঝাড়িতে ঝাড়িতে এক ব্যক্তি সশব্দে নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, বলিলেন— ‘বাবাঃ! রগ ঘেঁষে গেছে। আর একটু হলেই উচ্চৈঃশ্রবা বুকের ওপর পা চাপিয়ে দিয়েছিল আর কি।’
দ্বিতীয় নাগরিক স্খলিত কর্ণভূষা আবার পরিধান করিতেছিলেন, বিরক্তিভরে বলিলেন— ‘অনেক রাজকুমারই তো স্বয়ংবরে এসেছে কিন্তু এমন বেপরোয়া ঘোড়সোয়ার দেখিনি। ভাগ্যে শ্রীমতীর দোকানের তলায় ঢুকেছিলাম, নইলে মুগুটি পিণ্ড করে দিয়ে চলে যেত।’
দোকানের মালিনী এবার কথা কহিল, উৎসুকভাবে বলিল— ‘নিশ্চয় কোনো রাজকুমার! চিনতে পারলে না?’
এতক্ষণে তৃতীয় নাগরিকটি, যেন কিছুই হয় নাই এমনিভাবে ফুলের পাখার বাতাস খাইতে খাইতে ফিরিয়া আসিলেন। মালিনীর প্রশ্নের উত্তর তিনিই দিলেন; অবজ্ঞায় ভ্রূ তুলিয়া আর দুইজনের প্রতি দৃক্পাত করিয়া বিদ্রূপপূর্ণ স্বরে বলিলেন— ‘চোখ চেয়ে থাকলে তো চিনতে পারবে! ঘোড়া দেখেই শ্রীমানদের পদ্মপলাশ নেত্র কমল কোরকের মত মুদিত হয়ে গিয়েছিল যে!’
দ্বিতীয় নাগরিক বলিলেন— ‘আরে যাও যাও, তুমি তো দৌড় মেরেছিলে। সরু সরু এক জোড়া পা আছে কিনা—’
মালিনী এই দেহতাত্ত্বিক আলোচনায় বাধা দিয়া তৃতীয় নাগরিককে জিজ্ঞাসা করিল— ‘তুমি চিনতে পেরেছ বুঝি?’
তৃতীয় নাগরিক বলিলেন— ‘চেনা আর শক্ত কি? এক নজর দেখেই চিনেছি। মাথায় শিরস্ত্রাণটা দেখলে না!’
মালিনী বলিল— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, শিরস্ত্রণটা নতুন ধরনের— রোদ্দুরে ঝক্ঝ্ক্ করে উঠল—’
তৃতীয় নাগরিক গম্ভীরভাবে বলিলেন— ‘আর্যাবর্তের দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাজার রাজকীয় লাঞ্ছন আমার নখদর্পণে। ইনি হচ্ছেন সৌরাষ্ট্রের যুবরাজ।’
মালিনীর চক্ষু বিস্ফারিত হইল, সে বলিল— ‘নিশ্চয় স্বয়ংবর সভায় গেলেন। তাই এত তাড়া।’
প্রথম নাগরিক হুঁ হুঁ করিয়া আনুনাসিক হাস্য করলেন— ‘যতই তেড়ে যান গুড়্গুড়্ করে ফিরে আসতে হবে। সে বড় কঠিন ঠাঁই, রাজকুমারীর প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না।’
তৃতীয় নাগরিকের নাসা অবজ্ঞায় স্ফুরিত হইল— ‘প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে বিদ্যা এবং বুদ্ধি দুই-ই দরকার— বুঝলে হে? অথচ যে-সব রাজা-রাজড়া রথি-মহারথ যাচ্ছেন, সত্যি কথা বলতে কি, তাদের কোনোটাই নেই।’
দ্বীতীয় নাগরিক শ্লেষভরে বলিলেন— ‘কিন্তু তোমার তো দুই-ই আছে; তুমি গিয়ে সভায় ঢুকে পড় না। চণ্ডাল পামর কারুর তো যেতে মানা নেই।’
তৃতীয় নাগরিক ঈষৎ রুষ্টমুখে চাহিলেন, তারপর সগর্ব মর্যাদার সহিত বলিলেন— ‘যাব। আগে রাজা-রাজড়াগুলো শেষ হয়ে যাক তারপর যাব।’
দ্বিতীয় নাগরিক অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন। প্রথম নাগরিকের মুখে কিন্তু একটু বিমর্ষতার ছায়া পড়িল। তিনি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলিলেন— ‘আমিও যেতাম। কিন্তু সদর দেউড়িতে যে দুটো আখাম্বা হাব্শী খোলা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—’
রাজপ্রাসাদের সম্মুখস্থ তোরণ ও প্রতীহার ভূমি। অতি স্থূল তোরণস্তম্ভের গর্ভে প্রতীহারদের জন্য বিরাম-কক্ষ আছে। স্তম্ভের দুই পাশ হইতে কারুকার্য খচিত উচ্চ প্রাচীর প্রশস্ত প্রাসাদভূমিতে ঘিরিয়া রাখিয়াছে।
দুইজন ভীমকান্তি হাব্শী মুক্ত কৃপাণ হস্তে তোরণ-সম্মুখে প্রহরা দিতেছে। তাহাদের পশ্চাতে প্রায় শত হস্ত দূরে রাজভবনের প্রথম মহল; তাহার পশ্চাতে অন্যান্য যে-সকল মহল আছে সম্মুখ হইতে সেগুলি দেখা যায় না।
দুর রাজভবন হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া একটি লোক তোরণের দিকে আসিতেছে দেখা গেল। লোকটি মহার্ঘ বেশভূষায় সজ্জিত, মস্তকে ধাতুময় শিরস্ত্রাণ। তাহার হাঁটিবার ভঙ্গি হইতে মনে হয় সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছে।
তোরণের বাহিরে আসিয়া লোকটি ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিয়া রুক্ষস্বরে বলিল— ‘নারীজাতি রসাতলে যাক। — আমার ঘোড়া কোথায়?’
হাব্শীদ্বয় উত্তর দিল না, প্রস্তরমূর্তির ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। এই সময় একটি অশ্বের বল্গা ধরিয়া একজন অশ্বপাল তোরণ হইতে বাহির হইয়া আসিল। পূর্বোক্ত ব্যক্তি বিনা বাক্যব্যয়ে অশ্বপুষ্ঠে লাফাইয়া উঠিয়া বায়ুবেগে ঘোড়া ছুটাইয়া অদৃশ্য হইলেন। অশ্বপাল মুচ্কি হাসিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিল, যাইবার সময় হাব্শীদের দিকে একবার চোখ টিপিয়া গেল।
এইবার বোধকরি অশ্বক্ষুরশব্দে আকৃষ্ট হইয়া একটি প্রবীণ ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিলেন। ক্ষৌরিত মস্তকে সুস্পষ্ট শিখা, কর্ণে শরের লেখনী, হস্তে তালপত্রের পুস্তিকা। ইনি রাজ্যের পুস্তপাল।
পুস্তপাল মহাশয় বিলীয়মান অশ্বারোহীর দিকে একবার দৃক্পাত করিয়া নিরুৎসুক কণ্ঠে হাব্শীদের জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বিদর্ভরাজকুমার চলে গেলেন?’
বিশদ হাস্যে হাব্শীদ্বয়ের সুকৃষ্ণ মুখমণ্ডল দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গেল; তাহারা যুগপৎ মস্তক সঞ্চালন করিতে লাগিল। পুস্তপাল মহাশয় গম্ভীর মুখে কর্ণ হইতে লেখনী লইয়া পুস্তিকায় লিখিতে লিখিতে অস্ফুটম্বরে উচ্চারণ করিলেন— বিদর্ভকুমার— অর্থাৎ— ঊনপঞ্চাশৎ সংখ্যা—’
অতঃপর আমরা কুন্তলকুমারী হৈমশ্রীর স্বয়ংবর সভায় প্রবেশ করিতে পারি।
বৃহৎ সভাগৃহ। এত বৃহৎ যে পাঁচশত লোক অনায়াসে তাঁহাতে বসিতে পারে। গোলাকৃতি কক্ষ; প্রাচীর সাধারণ কক্ষ হইতে চতুর্গুণ উচ্চ। প্রাচীরের নিম্নভাগে নানাবিধ পৌরাণিক ঘটনার চিত্র অঙ্কিত রহিয়াছে; ঊর্ধ্বে ছাদের প্রায় নিকটে আলিসার মত প্রশস্ত মঞ্চ প্রাচীর বেষ্টন করিয়া আছে। তাহার উপর শূলধারী দুইজন হাব্শী রক্ষী ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিতে করিতে পরস্পর সম্মুখীন হইবামাত্র তাহারা এক বিচিত্র অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিতেছেঃ স্কন্ধ হইতে শূল নামাইয়া যেন পরস্পর আক্রমণ করিবার উপক্রম করিতেছে, তারপর উভয়ে উভয়কে মিত্র বলিয়া চিনিতে পারিয়া শূল স্কন্ধে তুলিয়া আবার বিপরীত মুখে পরিক্রমণ আরম্ভ করিতেছে। তাহাদের অভিনয় বস্তুত অহিংস হইলেও দেখিতে অতি ভয়ঙ্কর।
সভাগৃহের মধ্যস্থলে মণিকুট্টিমের উপর একটি সুবৃহৎ চক্রাকার বেদী, ভূমি হইতে মাত্র এক ধাপ উচ্চ। মূলত ইহা রাজসভায় সিংহাসন রক্ষার জন্য পট্টবেদিকা; কিন্তু রাজসভা স্বয়ংবর সভায় রূপান্তরিত হওয়ায় সিংহাসন অন্তর্হিত হইয়াছে। এই বেদীর সম্মুখে অল্প দূরে আর একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ক্ষুদ্র বেদিকা— ইহা রাজার সহিত ভাষণপ্রার্থী মান্য অতিথির জন্য নির্দিষ্ট। উপস্থিত এই বেদিকা শূন্য।
কিন্তু প্রধান পট্টবেদিকাটি শূন্য নয়, বরঞ্চ কিছু অধিক পরিমাণেই পূর্ণ। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটি সুন্দরী সুবেশা তরুণী এই বেদীর উপর, পদ্মের উপর প্রজাপতির ন্যায় ইতস্তত সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইতেছে। বেদীর স্থানে স্থানে স্বর্ণস্থালীতে মালা পুষ্প চন্দন শঙ্খ লাজ ইত্যাদি সজ্জিত রহিয়াছে। তরুণীরা কলকণ্ঠে গল্প করিতেছে, হাসিতেছে, তাম্বূল চর্বণ করিতেছে; কেহ বা বেদীর উপরে অর্ধশয়ান হইয়া অলস অঙ্গুলি সঞ্চালনে বীণার তন্ত্রীতে মৃদু আঘাত করিতেছে।
বেদীর এক পাশে দীর্ঘ স্বর্ণদণ্ডের শীর্ষে দুইটি শুক পক্ষী চরণে শৃঙ্খল পরিয়া বসিয়া আছে। একটি তরুণী মৃণাল বাহু তুলিয়া তাহাদের ধানের শীষ খাওয়াইতেছেন। এই তরুণীর মুখাবয়ব পশ্চাৎ হইতে দেখা না গেলেও তাঁহার দেহের ও গ্রীবার মর্যাদাপূর্ণ ভঙ্গিমা হইতে অনুমান হয় যে ইনিই রাজকন্যা হৈমশ্রী।
আর একটি যুবতী বেদীর কিনারায় বসিয়া গভীর মনঃসংযোগে কজ্জলমসী দিয়া ভূমির উপর আঁক কষিতেছে। অন্য কোনো দিকে তাহার দৃষ্টি নাই; মুখে উদ্বেগ ও শঙ্কা পরিস্ফুট। অবশেষে অঙ্ক শেষ করিয়া যুবতী হতাশাব্যঞ্জক মুখ তুলিল, হৃদয় ভারাক্রান্ত নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল— ‘ঊনপঞ্চাশ—’
যুবতীর কণ্ঠস্বরে রাজকুমারী পক্ষীদণ্ডের দিক হইতে ফিরিলেন। এতক্ষণে তাঁহার মুখ দেখা গেল। এতগুলি সম্ভ্রান্ত কুলোদ্ভবা রূপসীর মধ্যে তিনিই যে প্রধানা তাহা তাঁহার মুখের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিলে আর সন্দেহ থাকে না। অভিমান তীক্ষ্ণবুদ্ধি বৈদগ্ধ্য ও সৌকুমার্য মিশিয়া মুখে অপূর্ব লাবণ্য যেন ঝলমল করিতেছে।
প্রিয়সখী চতুরিকার হতাশ মুখভঙ্গি দেখিয়া হৈমশ্রীও একটু বিষণ্ণ হাস্য করিলেন, তারপর অলসপদে তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন— ‘চতুরিকা, ঠিক জানিস ঊনপঞ্চাশটা? আমার তো মনে হচ্ছে, একশো ঊনপঞ্চাশ।’
চতুরিকা আবার হিসাবের দিকে দৃষ্টি নামাইল, মনে মনে হিসাব পরীক্ষা করিল, তারপর বিমর্ষভাবে মাথা নাড়িল— ‘উঁহু ঊনপঞ্চাশ। এই যে হিসেব— তেরো জন রাজকুমার, সতেরোটি সামন্ত, চৌদ্দজন শ্রেষ্ঠিপুত্র, আর পাঁচটি নাগরিক। কত হল?’
আরও কয়েকটি সখী চতুরিকার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, একজন চট্ করিয়া জবাব দিল— ‘সাতচল্লিশ।’
দ্বিতীয়া সখী বলিল— ‘দূর মুখপুড়ি, তিপ্পান্ন!’
রাজকুমারী হাসিলেন— ‘তোরা সবাই অঙ্কশাস্ত্রে বররুচি।’
চতুরিকা সকৌতুকে ভ্রূভঙ্গি করিয়া রাজকন্যার পানে চোখ তুলিল— ‘শুধু তোমার বুঝি বরে রুচি নেই?’
সকলে হাসিয়া উঠিল। হৈমশ্রীও হাসিতে হাসিতে চতুরিকার পাশে উপবেশন করিলেন। অন্য সকলে তাঁহাকে ঘিরিয়া বসিল। হৈমশ্রী মুখের একটি কৌতুক-করুণ ভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘রুচি থেকেই বা লাভ কি বল্। ঊনপঞ্চাশ জনের একজনও তো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না।’
চতুরিকা রাজকন্যার সবচেয়ে প্রিয় সখী, তাঁহার মনের অনেক খবর রাখে; সে মিটি মিটি হাসিয়া প্রশ্ন করিল— ‘আচ্ছা সত্যি বল পিয়সহি, এদের মধ্যে কেউ উত্তর দিতে পারলে তুমি সুখী হতে?’
হৈমশ্রীও হাসিলেন— ‘যদি বলি হতুম।’
চতুরিকা মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘তাহলে আমি বিশ্বাস করতুম না। ওদের মধ্যে একজনকেও তোমার মনে ধরেনি।’
সখীদের মধ্যে একজন কৌতুক-তরল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল— ‘শুধু রামছাগলটিকে ছাড়া।’
হাসির লহর উঠিল। একটি হতভাগ্য পাণিপ্রার্থীর ছাগ-সদৃশ দাড়ি লইয়া ইতিপূর্বে অনেক রঙ্গ রসিকতা হইয়া গিয়াছিল; রাজকুমারী একমুঠি ফুল ছুঁড়িয়া রহস্যকারিণীকে প্রহার করিলেন, বলিলেন— ‘রামছাগলটিকে মৃগশিরার ভারি মনে ধরেছে, ঘুরে-ফিরে কেবল তারই কথা। তোর জন্যে চেষ্টা করে দেখব নাকি? এখনো হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে।’
মৃগশিরা রাজকুমারীর নিক্ষিপ্ত ফুলগুলি কবরীতে গুঁজিতে গুঁজিতে বলিল— ‘তা মন্দ কি! আমি রাজী।’
দ্বিতীয়া সখী বলিল— ‘রাজযোটক হবে— মৃগশিরা আর রামছাগল।’
চতুরিকা একটু গম্ভীর হইল, বলিল— ‘ঠাট্টা নয়, ভারি আশ্চর্য কথা। এতগুলো বড় বড় লোক, একটা প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারল না।’
তৃতীয়া সখী বলিল— ‘যা বিদ্ঘুটে প্রশ্ন!’
রাজকুমারী শান্ত কণ্ঠে বলিলেন— ‘প্রশ্ন বিদ্ঘুটে নয় মালবিকা, লোকগুলো বিদ্ঘুটে। ওদের যদি সহজবুদ্ধি থাকত তাহলে সহজেই উত্তর দিতে পারত।’
একটি সখীর কৌতূহল দুর্নিবার হইয়া উঠিয়ছিল, সে রাজকন্যার কাছে ঘেঁষিয়া বসিয়া আবদারের সুরে বলিল— ‘বল না পিয়সহি, প্রথম প্রশ্নের উত্তর কি?’
অন্য একজন তাহাকে সরাইয়া দিয়া বলিল— ‘না না, আমরা সকলে তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর শুনতে চাই— পৃথিবীতে সবচেয়ে মিষ্ট কী?’
রাজকুমারী অলস হাসিয়া বলিলেন— ‘তোরাই বল্ না দেখি।’
সকলে চিন্তান্বিত হইয়া পড়িল। একটি সরলা যুবতী উৎসাহভরে বলিল— ‘আমি বলব? রসাল! রসালের চেয়ে মিষ্টি পৃথিবীতে আর কিচ্ছু নেই।’
মৃগশিরা মুখ তুলিল— ‘আমি বুঝেছি— আখ! ইক্ষুদণ্ড! আখের চেয়ে মিষ্টি আর কী আছে। আখ থেকেই তো যত সব মিষ্টি জিনিস তৈরি হয়।’
বিদ্যুল্লতা আপত্তি তুলিল— ‘তাহলে মধু হবে না কেন? মধুই বা কি দোষ করেছে? হ্যাঁ পিয়সহি, মধু— না?’
হৈমশ্রী হাসিয়া উঠিলেন— ‘দূর হ’ পেটুকের দল। কিন্তু আর তো পারা যায় না। মাথার উপর ঊনপঞ্চাশ পাবনের নৃত্য হয়ে গেল, আর কি সহ্য হবে!’
তিনি ম্রিয়মাণ চক্ষে চতুরিকার পানে তাকাইলেন। বিদ্যুল্লতা সান্ত্বনার সুরে বলিল— ‘এরি মধ্যে হাঁপিয়ে পড়লে চলবে কেন। — এখনো সমস্ত দিন পড়ে রয়েছে।’
হৈমশ্রী অধীরভাবে মাথা নাড়িলেন— ‘তা নয় বিদ্যুল্লতা। কিন্তু আর্যাবর্তের এত অধঃপতন হয়েছে! এক অশিক্ষিতা মেয়ের তিনটে সামান্য প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারছে না!’
চতুরিকা মুখভঙ্গি করিল— ‘তুমি অশিক্ষিতা মেয়ে! বাব্বাঃ! চতুঃষষ্টি কলা শেষ করে বসে আছে!’
বনজ্যোৎস্না রাজকুমারীকে আশ্বাস দিবার চেষ্টা করিল— ‘হতাশ হয়ে না পিয়সহি, এখনো অনেক আসবে। কেউ না কেউ ঠিক উত্তর দিয়ে ফেলবেই।’
হৈমশ্রী বলিলেন— ‘উঠন্তি মূলো পত্তনেই চেনা যায়। যাঁরা আসবেন তাঁরা ওই রামছাগলের ভায়রাভাই। তার চেয়ে যদি আমার শুকসারীকে প্রশ্ন করতুম, ওরা ঠিক উত্তর দিতে পারত।’
চতুরিকা বলিল— ‘তবে তাই কর, সব হাঙ্গামা চুকে যাক। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে, শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে না। তাহলে মহারাজকে তাই বলি, কী বল?’ রাজকুমারী বিমনাভাবে মৃদু হাসিলেন।
বাহিরে তোরণের প্রতীহার ভূমিতে কৃপাণধারী হাব্শীদ্বয় পূর্ববৎ দাঁড়াইয়া ছিল। অনেকক্ষণ কেহ আসে নাই। সহসা সম্মুখে চাহিয়া হাব্শীরা আরো সতর্ক হইয়া দাঁড়াইল।
যাহাকে দেখিয়া হাব্শীরা সতর্ক হইয়াছিল সে আর কেহ নয়, আমাদের অশ্বারূঢ় কালিদাস। নগরের বহু স্থান ঘুরিয়া উন্মত্ত ঘোটক অবশেষে রাজপ্রাসাদের দিকে উল্কার বেগে ছুটিয়া আসিতেছে। কালিদাস ঘোড়ার কেশর। ধরিয়া কোনো মতে টিকিয়া আছেন।
ঝড়ের মত ঘোড়া হাব্শীদ্বয়ের সম্মুখে আসিয়া পড়িল। হাব্শীরাও প্রস্তুত ছিল, ডালকুত্তার মত লাফ দিয়া দুই দিক হইতে ঘোড়ার বল্গা চাপিয়া ধরিল। হাব্শীদের কালো দেহে অসুরের শক্তি; ঘোড়া আর অধিক আস্ফালন করিতে পারিল না, শান্ত হইয়া দাঁড়াইল। কালিদাস আমনি পিছ্লাইয়া ঘোড়ার ঘর্মাক্ত পৃষ্ঠ হইতে নামিয়া পড়িলেন।
দীর্ঘকাল একটা উদ্দাম অসংযত ঘোড়ার পিঠে মরি-বাঁচি ভাবে আঁকড়াইয়া থাকিবার পর কালিদাসের মানসিক ক্রিয়াকলাপ প্রায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল, তিনি কেবল ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইতে লাগিলেন। অশ্বপাল আসিয়া অশ্বটিকে লইয়া গেল। পুস্তপাল মহাশয় ব্যস্তসমস্তভাবে প্রকোষ্ঠ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন, কালিদাসকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করিলেন— ‘আসুন আসুন কুমার—’
কালিদাস থাতমত খাইয়া বলিলেন— ‘আমি— আমি—’
পুস্তপাল বলিলেন— ‘পরিচয় দিতে হবে না সৌরাষ্ট্রকুমার, আপনার শিরস্ত্রাণ কে না চেনে? আসতে আজ্ঞা হোক— এই দিকে— এই দিকে— মহামন্ত্রী প্রতীক্ষা করছেন—’
পুস্তপাল আমন্ত্রণের ভঙ্গিতে দুই হস্ত ভিতরের দিকে প্রসারিত করিলেন। হতবুদ্ধি অবস্থায় কালিদাস পুস্তপালের সঙ্গে রাজতোরণ-মধ্যে প্রবেশ করিলেন।