০২. কুদ্দুস চোখ খুলল

কুদ্দুস চোখ খুলল। অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে চারপাশে ছিল গোলাপি রঙের ধোয়া, এখন বেগুনি ধোঁয়া। আগে কোন শব্দ ছিল না। এখন একটু পর পর সাপের শিসের মতো তীব্র শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শরীরের ভেতরে ঢুকে কলজে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এরচে তো আগেই ভাল ছিল। কুদ্দুস ভেবে পাচ্ছে না সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলবে কি না। চোখ বন্ধ রাখা আর খোলা তো একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে সে মারা গেছে? হার্টফেল করে লিফটের ভেতরই তার মৃত্যু হয়েছে? সে যে জগতে আছে সেটা আর কিছুই না, মৃত্যুর পরের জগৎ। এ রকম তো হয়। কিছু বোঝার আগেই কত মানুষ মারা যায়। সেও মারা গেছে, মৃত্যুর পর তাকে আবার জিন্দা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতর মানকের-নেকের আসবে, তাকে সোয়াল-জোয়াব শুরু করবে—তোমার ধর্ম কী? তোমার নবী কে? এইসব জিজ্ঞেস করবে। এ কী বিপদ।

তুমি কে? কুদ্দুস চমকে চারদিকে তাকালো, কাউকে সে দেখতে পেল না। প্রশ্নটা সে পরিষ্কার শুনলো। তাকেই যে প্রশ্ন করা হচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। কেমন গম্ভীর ভারি গলা। শুনলেই ভয় লাগে।

এই, তুমি কে?

কুদ্দুস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার, আমার নাম কুদ্দুস।

তুমি এখানে কীভাবে এসেছ?

স্যার, আমি কিছুই জানি না। লিফটের ভিতরে ছিলাম। লাফ দিয়ে বের হয়েছি। বাইর হওয়া উচিত হয় নাই। আপনে স্যার এখন একটা ব্যবস্থা করেন। গরিবের একটা রিকোয়েস্ট।

আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি এখানে এলে কী করে?

স্যার আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। কোথায় আসছি নিজেও জানি না। কীভাবে আসছি তাও জানি না। লিফটের দরজা ভালমত খোলার আগেই লাফ দিয়েছিলাম। এটা স্যার অন্যায় হয়েছে। আর কোনদিন করব না। সত্যি কথা বলতে কী—আর কোনদিন লিফটেও চড়ব না। এখন স্যার ফেরত পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করেন। আমি খাস দিলে আল্লাহপাকের কাছে আপনার জন্যে দোয়া করব।

তোমার কোন কিছুই তো আমরা বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা হল-মাত্রা কী করে ভাঙলে? মাত্রা ভেঙে এখানে এলে কীভাবে?

স্যার বিশ্বাস করেন, আমি কোন কিছুই ভাঙি নাই। যদি কিছু ভেঙে থাকে। আপনা আপনি ভাঙছে। তার জন্যে স্যার আমি ক্ষমা চাই। যদি বলেন, পায়ে ধরব। কোন অসুবিধা নাই।

তুমি তো বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছ। তুমি কি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা কী ঘটেছে?

জ্বি না।

তুমি ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছ। এই কাণ্ডটা কীভাবে করেছ আমরা জানি না। আমরা জানার চেষ্টা করছি।

স্যার, ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।

তোমার কথাবার্তাও তো আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। গোলাম হয়ে থাকব মানে কী?

কুদ্দুস ব্যাকুল গলায় বলল, স্যার, গোলাম হয়ে থাকব মানে হল স্যার আপনার সার্ভেন্ট হয়ে থাকব। আমি মুখ দেখতে পারছি না। মুখ দেখতে পারলে ভয়টা একটু কমতো।

আমরা ইচ্ছা করেই তোমাকে মুখ দেখাচ্ছি না। মুখ দেখালে ভয় আরো বেড়ে যেতে পারে।

স্যার, যে ভয় লিফটের ভিতর পেয়েছি, এরপর আর কোন কিছুতেই কোন। ভয় পাব না। রয়েল বেঙ্গলের খাঁচার ভেতর ঢুকে রয়েল বেঙ্গলকে চুমু খেয়ে আসব। তার লেজ দিয়ে কান চুলকাব, তাতেও স্যার ভয় লাগবে না।

তোমার নাম যেন কী বললে-কুদ্দুস?

জ্বি স্যার, কুদ্দুস।

একটা জিনিস একটু বোঝার চেষ্টা করো–তুমি হচ্ছ ত্ৰি-মাত্রিক জগতের মানুষ। তোমাদের জগতের প্রাণীদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছে। এই দেখে তোমরা অভ্যস্ত। আমরা চার মাত্রার প্রাণী। চার মাত্রার প্রাণী সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।

স্যার, আপনি আমার মতো বাংলা ভাষায় কথা বলতেছেন, এইটা শুনেই মনে আনন্দ পাচ্ছি। আপনার চেহারা যদি খারাপও হয়, কোন অসুবিধা নাই, চেহারার উপর তো স্যার আমাদের হাত নাই। এটা হল বিধির বিধান।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমাকে দেখ।

কুদ্দুসের শরীরে হালকা একটা কাঁপুনি লাগল। হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে যে রকম লাগে, সে রকম। তারপরই মনে হতে লাগলো তার চারপাশে যত বেগুনি রঙ আছে সব তার চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আবার চোখের ভেতর থেকে কিছু কিছু রঙ বের হয়ে আসছে। এ কী নতুন মুসিবত হল।

আচমকা রঙের আসা-যাওয়া বন্ধ হল। কুদ্স তার চোখের সামনে কী একটা যেন দেখল। মানুষের মতোই মুখ তবে স্বচ্ছ কাচের তৈরি। একটা মুখের ভেতর আরেকটা, সেই মুখের ভেতর আরেকটা—এই রকম চলেই গিয়েছে। মুখটার চোখ দুটাও কাচের। সেই চোখের যে কোন একটার দিকে তাকালে তার ভেতরে আর একটা চোখ দেখা যায়, সেই চোখের ভেতর আবার আরেকটা…ঘটনা এই শেষ হলে হত, ঘটনা এইখানে শেষ না। কুদ্দুসের কখনো মনে হচ্ছে ভয়ংকর সে এই মানুষটার ভিতরে আছে, আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে ভয়ংকর এই মানুষটা তার ভেতরে বসে আছে। এই কুৎসিত জিনিসটাকে মানুষ বলার কোন কারণ নেই, মানুষ ছাড়া কুদ্দুস তাকে আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

তুমি কি ভয় পাচ্ছ?

জ্বি না, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন—একটু পেসাব করব, পেসাবের বেগ হয়েছে।

কী করবে?

প্রস্রাব করব। আপনাদের বাথরুমটা কোন্ দিকে।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না–কী করতে চাও?

স্যার, একটু টয়লেটে যাওয়া দরকার।

ও আচ্ছা আচ্ছা, বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন। তুমি তো আমাদের মহা সমস্যায় ফেললে। আমাদের এখানে এরকম কোন ব্যবস্থা নেই।

বলেন কী স্যার!

আমরা দেহধারী প্ৰাণী নই। দেহধারী প্রাণীদের মতো আমাদের খাদ্যের যেমন প্রয়োজন নেই তেমনি টয়লেটেরও প্রয়োজন নেই। এখন তুমি টয়লেটে যেতে চাচ্ছ, আমাদের ধারণা কিছুক্ষণ পর তুমি বলবে খিদে পেয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কী স্যার, খিদে পেয়েছে। সকাল বেলা নাশতা করি নাই। মারাত্মক খিদে লেগেছে। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলতে পারি নাই। সকাল থেকে এই পর্যন্ত কয়েক চুমুক চা শুধু খেয়েছি, পত্রিকাও পড়া হয় নাই— আপনাদের এখানে পত্রিকা আছে স্যার?

না, পত্রিকা নেই।

জায়গা তো তাহলে খুব সুবিধার না।

আমাদের জায়গা আমাদের মতো, তোমাদের জায়গা তোমাদের মতো।

আপনাদের তাহলে ইয়ে হয় না?

ইয়ে মানে কী?

পেসাব-পায়খানার কথা বলতেছি—বৰ্জ্য পদার্থ।

না, আমাদের এই সমস্যা নেই। তোমাকে তো একবার বলা হয়েছে। আমরা তোমাদের মতো দেহধারী না। শুধু দেহধারীদেরই খাদ্য লাগে। খাদ্যের প্রশ্ন যখন আসে তখনই চলে আসে বর্জ্য পদার্থের ব্যাপার।

তবু স্যার, আমার মনে হয় বাইরের গেস্টদের জন্য দুই-তিনটা টয়লেট বানিয়ে রাখা ভাল।

দেহধারী কোন অতিথির আমাদের এখানে আসার উপায় নেই।

আপনি তো স্যার একটা মিসটেক কথা বললেন। আমি চলে এসেছি না?

হ্যাঁ, তুমি চলে এসেছ। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কীভাবে এসেছ সেই রহস্য এখনো ভেদ করা সম্ভব হয় নি।

স্যার বিশ্বাস করেন, নিজের ইচ্ছায় আসি নাই। যে দেশে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নাই, পেসাব-পায়খানার উপায় নাই, সেই দেশে খামাখা কি জন্যে আসব বলেন? তাও যদি দেখার কিছু থাকত, একটা কথা ছিল। দেখারও কিছু নাই। স্যার, আপনাদের সমুদ্র আছে?

হ্যাঁ আছে। তবে সে সমুদ্র তোমাদের সমুদ্রের মতো না। আমরা সময়ের সমুদ্রে বাস করি। তোমাদের কাছে সময় হচ্ছে নদীর মতো বয়ে যাওয়া। আমাদের সময় নদীর মতো প্রবহমান নয়, সমুদ্রের মতো স্থির।

মনে কিছু নেবেন না স্যার, আপনার কথা বুঝতে পারি নাই।

সময় সম্পর্কিত এই ধারণা ত্রিমাত্রিক জগতের প্রাণীদের পক্ষে অনুধাবন করা খুবই কঠিন। অংক এবং পদার্থবিদ্যায় তোমার ভাল জ্ঞান থাকলে চেষ্টা করে দেখতাম।

এটা বলে স্যার আমাকে লজ্জা দিবেন না। আমি খুবই মূখ। অবশ্য স্যার মূখ হবার সুবিধাও আছে। মূখদের সবাই স্নেহ করে। বুদ্ধিমানদের কেউ স্নেহ করে না। ভয় পায়। মতিয়ুর রহমান স্যার যে আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করে তার কারণ একটাই আমি মূৰ্খ। বিরাট মূৰ্খ।

ও আচ্ছা।

উনার স্ত্রীও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। গত ঈদে আমাকে পায়জামা আর পাঞ্জাবি দিলেন। পাঞ্জাবি সিল্কের। এই রকম সিল্ক সচরাচর পাওয়া যায় না, অতি মিহি—এক্সপোর্ট কোয়ালিটি সিল্ক। যা তৈরি হয় সবই বিদেশে চলে যায়। উনাদের কানেকশন ভাল বলে এইসব জিনিস যোগাড় করতে পারে। যাই হোক, পাঞ্জাবি সাইজে ছোট হয়ে গিয়েছিল, সেটা আর উনাকে বলি নাই, মনে কষ্ট পাবেন। শখ করে একটা জিনিস কিনেছেন।

কুদ্দুস।

জ্বি স্যার।

তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে।

এই যে স্যার বললাম—মূখদের সবাই পছন্দ করে। আপনারা বেশি জ্ঞানী, কেউ আপনাদের পছন্দ করবে না। সত্যি কথা বলতে কী স্যার, আপনাদের ভয়ে আমি অস্থির। আপনাদের দিকে তাকাতেও ভয় লাগতেছে।

ভয়ের কিছু নেই আমরা তোমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি।

আপনাদের পা থাকলে স্যার ভাল হত। আপনাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতাম।

তোমার প্রতি আমাদের মমতা হয়েছে যে কারণে আমরা এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি যাতে তোমার নিজের জায়গায় যখন ফিরবে তখন তোমার জীবন আনন্দময় হবে।

বললে হয়তো স্যার আপনারা বিশ্বাস করবেন না, আমি খুব আনন্দে আছি।

আনন্দে থাকলেও তোমার জীবন মোটামুটিভাবে অর্থহীন এটা বলা যায়। জীবন কাটাচ্ছ অন্যের জন্যে চা বানিয়ে।

কী করব স্যার বলেন, পড়াশোনা হয় নাই, ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিতে পারলাম না। ইংরেজি সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার আগের দিন রাতে বাবাকে সাপে কাটল। চোখের সামনে ধড়ফড় করতে করতে মৃত্যু।

আমরা কী করছি মন দিয়ে শোননা, তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি ইংরেজি সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার আগের দিন রাতে। তুমি সেখান থেকে জীবন শুরু করবে। বাবাকে যাতে সাপে না কাটে সেই ব্যবস্থা করবে।

সেটা স্যার কী করে সম্ভব?

সময় আমাদের কাছে স্থির। আমরা তা পারি। তুমি যখন ফিরে যাবে তখন এখানকার স্মৃতি তোমার থাকবে না। তবে তোমার বাবাকে সাপে কাটবে এই ব্যাপারটা তোমার মনে থাকবে। এটা যাতে মনে থাকে সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। নতুন জীবন তোমার শুরু হচ্ছে। সেখানে তোমার বাবাকে সাপে কাটবে না। তোমার বুদ্ধিবৃত্তিও কিছু উন্নত করে দিচ্ছি। পড়াশোনায় তুমি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেবে।

অংকটা নিয়ে স্যার সমস্যা। অংকটা পারি না। খুব বেড়াছেড়া লাগে।

আর বেড়াছেড়া লাগবে না।

এখন কি স্যার আমি চলে যাচ্ছি?

কিছুক্ষণের মধ্যে যাচ্ছ।

ম্যাডামকে আমার সালাম দিয়ে দেবেন। উনার সঙ্গে দেখা হয় নাই।

ম্যাডামকে তোমার সালাম পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তোমাকে আগে একবার বলেছি আমরা দেহধারী নই। আমাদের মধ্যে নারী-পুরুষের কোন ব্যাপার নেই।

জ্বি আচ্ছা। না থাকলে কী আর করা! সবই আল্লাহ্র হুকুম। একটু দোয়া রাখবেন স্যার। এই বিপদ থেকে কোনদিন উদ্ধার পাব চিন্তা করি নাই।

কুদ্দুস হঠাৎ তার বুকে একটা ধাক্কার মতো অনুভব করল। গভীর ঘুমে সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেই তার মনে হচ্ছে সে যেন অতল কোন সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। সেই সমুদ্রের পানি সিসার মতো ভারি, বরফের মত ঠাণ্ডা। পানির রঙ গাঢ় গালাপি। সে তলিয়েই যাচ্ছে। তলিয়েই যাচ্ছে। এই সমুদ্রের কি কোন তলা নেই? না-কি এখন সে মারা যাচ্ছে?

কুদ্দুসের ঘুম পাচ্ছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। সে চোখ মেলে। রাখতে পারছে না। অথচ তার ইচ্ছা জেগে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার কী হচ্ছে। দেখে।