গল্পগ্রন্থ
উপন্যাস
অগ্রন্থিত
নাটক
ছড়া

০২. কী হয়েছে তারপর থেকে

কী হয়েছে তারপর থেকে?

তাঁর টঙের ঘর থেকে ঘনাদা আর নামাই দিয়েছেন বন্ধ করে। এর আগে যেমন বহুবার হয়েছে, তেমনই বোয়ারি আর রামভুজের বকলমেই আমাদের সামান্য যা-কিছু বিনিময় চলছে।

প্রতিদিন সকালের খবরের কাগজগুলো আগে থাকতে নিজের ঘরে আনিয়ে ঘনাদা তার বাড়িভাড়ার পাতাগুলোতে বেছে বেছে তাঁর মনের মতো ভাড়াবাড়ির বিজ্ঞাপনে লাল কালিতে দাগ মেরেছেন কোথায় কোথায় তিনি উঠে যেতে পারেন তা আমাদের জানাবার জন্য?

না, না। ও সব কিছু নয়। ওরকম কোনও বদমেজাজ কি বেয়াড়াপনার কোনও লক্ষণই তাঁর মধ্যে এবার নেই। বরং বলা যায়, তিনি যেন আরও মোলায়েম, আরও আরও মাটির মানুষ হয়ে উঠেছেন এই কিছুদিন থেকে।

আড্ডাঘরে এসে জমায়েত হয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটির চটপটানির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আর অপেক্ষা করতে হয় না কোনওদিন। আমাদের কেউ সে ঘরে গিয়ে ঢোকবার আগেই দেখা যায় তিনি সেখানে প্রসন্ন মুখে তাঁর মৌরসি কেদারা দখল করে হাজির।

হ্যাঁ, শুধু হাজির নন, একেবারে রীতিমতো হাসিমুখেই তিনি সেখানে উপস্থিত। আমাদের মধ্যে প্রথম যে গিয়ে উপস্থিত হয়, কুশল প্রশ্নটুকু তাকে করতে তিনি ভোলেন না। যেমন, আজ একটু দেরি হল যে? শরীর ভাল তো?

বাহাত্তর নম্বরের ইতিহাসে যা কখনও শোনা যায়নি, আচমকা একেবারে অপ্রত্যাশিত তেমন প্রশ্ন প্রথম শুনে বেশ একটু ভড়কে গিয়ে আমাদের মুখ দিয়ে কিছু অস্পষ্ট অ্যা—মানে হ্যাঁ গোছের অব্যয়ধ্বনি যদি বেরিয়ে যায়, তাতেও কিছু আসে যায় না। কারণ, ঘনাদা তাঁর আগের প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে বিষয়ান্তরে চলে যান। সেই দ্বিতীয় উক্তিটি শুনতে খারাপ না লাগবার হলেও বেশ চমকপ্রদ।

বায়না দিয়ে এলাম, ঘনাদা হয়তো বেশ একটু চমকে দিয়ে বলেন, ওই এক চেঙাড়ি মানে দশ গণ্ডারই বায়না দিয়ে এলাম, বুঝেছ?

বুঝতে আমাদের একটু দেরি হলে তিনি আরও বিশদ হয়ে বলেন, হিঙের কচুরির বায়না হে! ওই শিবু হালুইকরের হিঙের কচুরির। সবে দেখলাম কড়া চাপিয়ে লেচি বেলে ভাজা শুরু করেছে। তাই দিয়ে এলাম এক চেঙাড়ি মানে দশ গণ্ডারই বায়না। কী বলল, ঠিক করিনি?

ঠিক না তা কি বেঠিক কিছু করেছেন? করলেও সে কথা কে বলবে? তাই সানন্দেই তাঁর কথায় সায় দিই।

কিন্তু তারপর?

সেই তারপর নিয়েই হয়েছে যত গোল।

ঘনাদা রাগ করেন না, মেজাজ দেখান না। আমাদের বর্জন করবার কোনও লক্ষণও তাঁর কোনও কিছুতেই নেই। শুধু তিনি যেন—তিনি যেন—না, সোজাসুজি বলেই ফেলি কথাটা, তিনি যেন সাধ করে আর-এক মানুষ সেজে আমাদের নাক কানগুলো মলে দিচ্ছেন।

আর-এক মানুষ সাজা কীরকম? কীরকম আর, কতকটা ভ্যাবাগঙ্গারামেরই কুটুম-ভাই বলা যায়।

যেন নেহাত ভালমানুষ। রাগ নেই, বিরক্তি নেই, নেহাত ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। কিন্তু ক-এর কোন দিকে আঁকড়ি আর র-এর শূন্যটা কোন দিকে পড়ে, তাও যেন জানেন না।

মুখে একবার ম উচ্চারণ করলে যিনি মহাভারত না-আউড়ে থামতে পারেন না, সেই ঘনাদার কানের ফুটো যেন বন্ধ, আর জিভটা যেন অসাড়।

সাত চড়ে কেন, সাত-সাতে ঊনপঞ্চাশ সিধে আর বাঁকা জেরার খোঁচাতেও তাঁর মুখে রা নেই।

শুধু কি রা নেই! সাড়ই যেন নেই মগজে।

তাঁকে একটু জাগাবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি কি কিছু করেছি? বলতে গেলে বিশ্বকোষের স্বরে-অ থেকে শুরু করে অনুস্বর বিসর্গ পর্যন্ত হরফের কিছু না কিছু একবার করে নাড়া দিয়ে গেছি, কিন্তু ফল যা হয়েছে, তাতে আমাদের প্রায় দেওয়ালে মাথা খোঁড়া না হোক, দু-হাতে মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা!

আড্ডাঘরে মজলিশ শুরু হবার কিছু পরে ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে হাঁফাতে হাঁফাতে ঢুকে গৌর উত্তেজনায় যেন প্রায় তোতলা হয়ে বলেছে, শুনেছেন ঘনাদা, শুনেছেন, কুমেরু অভিযান থেকে কী খবর পাঠিয়েছে আমাদের এবারের কুমেরু অভিযাত্রী-দল?

কী খবর? আমরা উদগ্রীব হয়ে প্রায় ধরা গলায় জিজ্ঞেস করেছি, ভাল খবর, মন্দ?

ভাল খবর কী আর হবে! শিশির যেন এরই মধ্যে হতাশায় কাতর হয়ে বলেছে, খারাপ খবর নিশ্চয়ই। যেখানে ছ-মাসের শীতের রাতের জন্য ডেরা বাঁধা হয়েছিল, সেই গঙ্গোত্রীই বোধহয় ধসে তলিয়ে গেছে বরফের তলায়।

কী যা-তা বলছিস, আমি ওদের ধমক দিয়ে ঘনাদার শরণ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, সত্যি সেরকম কিছু হতে পারে, ঘনাদা? অতসব ঝানু ঝানু বৈজ্ঞানিকের দল বেছে বেছে অমন কাঁচা জায়গায় ডেরা পাততে পারে?

পারে না-পারে সে পরের কথা, শিবু আমায় ধমক দিয়ে থামিয়ে বলেছে, খবরটা কী, তা-ই আগে শোনো না। কী বলেন ঘনাদা, কাকে কান নিয়ে গেছে শুনে কানটা ঠিক আছে কি না, হাত বুলিয়ে না দেখেই কাকের পিছনে দৌড় দেওয়া কেন?

ঠিক, ঠিক, বলে শিবুর কথায় সায় দিয়ে এবার গৌরকে চেপে ধরা হয়েছে, খারটা কী তা জানবার জন্য।

কিন্তু গৌর তা বলতে পারেনি। তার কৈফিয়ত হল এই যে, বাস-এ আসতে আসতে ফুটপাতে বিকেলের বিশেষ খবর বলে এক ফেরিওয়ালাকে সে কুমেরুর জবর খবর! এই বেরিয়ে গেল বলে হাঁকতে শুনে এসেছে।

তা হাঁকতে শুনেও একটা বিশেষ খবরের পাতা কিনে নিয়ে আসেনি কেন?

তা কিনতে নামলে আর সেবাস কেন, কোনও বাস-এ কি ফিরতে পারত? গৌর চটপট জবাব দিয়ে জানিয়েছে।

খবরটা কী তাই যদি না জোগাড় করতে পেরে থাকে, তা হলে মিছিমিছি এখানে এসে আমাদের অমন অস্থির করে তোলবার দরকার কী ছিল?

আমাদের এ নালিশের উত্তর যেন গৌরের মুখস্থ ছিল। সে চটপট জবাব দিয়ে বলেছে, বাঃ, কাগজে ছাপা খবরটা না দেখেও ঘনাদা ব্যাপারটা শুনলে সেটা কি

অনুমান করতে পারবেন না? তাই জন্যই তো সেই শুধু জবর খবরটুকু শুনেই ঘনাদাকে সেটা জানাবার জন্যে ছুটে এসেছে।

শাবাশ! শাবাশ! গৌরের অকাট্য যুক্তিতে আমাদের বাহবা দিতেই হয়েছে।

কিন্তু লাভ কি কিছু হয়েছে তাতে? দিনকাল যখন আলাদা ছিল, তখন ওই একটা খেই ধরিয়ে দিলেই ঘনাদা তা থেকে কোন না পঞ্চাশটা ফ্যাঁকড়া বার করে আমাদের একেবারে মাথায় চক্কর লাগানো উপাখ্যান বুনে ফেলতেন!

আর কিছু না হোক, কুমেরুর ক-মাইল পুরু জমা বরফের নীচে থেকে ডাইনোসরদের হার-মানানো এক বিদঘুটে আজগুবি জানোয়ারের ফসিল কি আর আচমকা ঠেলে বার করতেন না দারুণ এক ভূমিকম্পে?

কিন্তু সে সব কেরামতি দূরে থাক, ঘনাদার কাছ থেকে একটু নড়েচড়ে ওঠার লক্ষণও দেখতে পাওয়া যায় না।

তার জন্য একটু খোঁচাতেও আমরা বাকি রাখি না।

জবর খবরটবর সব বাজে কথা, কী বলেন, ঘনাদা? শিশির ব্যাপারটাকে তাচ্ছিল্য করে ঘনাদাকে প্রতিবাদে উসকে দিতে চায়।

কিন্তু লাভ কিছু হয় কি? একেবারেই না।

এ যে ঠাণ্ডা কড়াইয়ে জলের ছিটে দেওয়া। ছ্যাঁক করে একটা শব্দও শোনা যায় না।

একটা বিকেলের জরুরি খবর কিনতে পাঠাব নাকি, ঘনাদা? আমি হাওয়াটা গরম রাখবার চেষ্টায় জিজ্ঞেস করলাম।

কিন্তু কাকে কী জিজ্ঞেস করছি? আমরা যাঁকে জাগাতে চাইছি, তিনি এখন কোমাতেই আচ্ছন্ন বললে অবস্থাটা কিছুটা বোঝানো যায়।

নেহাত জবাব না দিলে ছাড় নেই বুঝে যেন ক্লান্ত, নির্বিকারভাবে বললেন, তা আনাও! তবে—

সত্যিই আনাতে হলে যে বিপদ হত, ওই তবে টুকুর জোরে সেটা এড়িয়ে, তাড়াতাড়ি বলতে হল এবার, হ্যাঁ, আনতে পাঠানোতে লাভ নেই। কী না কী বিশেষ খবর, এতক্ষণ কি আর তা বিক্রি হয়ে যেতে কিছু বাকি আছে? তবে খবরটা ওই দক্ষিণ গঙ্গোত্রীরই নিশ্চয়, কী বলেন আপনি?

গঙ্গোত্রী শব্দটাই যেন প্রথম শুনলেন, এমনভাবে নির্বোধের মতো আমাদের দিকে চেয়ে ঘনাদা শুধু শব্দটা আর একবার উচ্চারণ করে বললেন, গঙ্গোত্রী বলছ? তা সে গঙ্গোত্রী–

সলতে একটু ধরেছে আশা করে উৎসাহভরে বললাম, হ্যাঁ, কুমেরুর যে জায়গাটায় আমাদের অভিযাত্রীরা ছ-মাস দিনের পর ছ-মাস রাতও কাটাবে বলে পাকা আস্তানা তৈরি করেছে, সেটারই ওরা গঙ্গোত্রী মানে দক্ষিণ গঙ্গোত্রী নাম দিয়েছে না!

কী বললেন এবার ঘনাদা। নিভু নিভু সলতেটা একটুও এবার ধরল কি?

না, আমাদের সব চকমকি ঠোকা বৃথা। ঘনাদা যা বললেন, তাতে ভিজে সলতে একটু শুকোবার লক্ষণও নেই।

ও, বললেন ঘনাদা, ওই নাম দিয়েছে ওরা? দক্ষিণ—কী বলে—দক্ষিণ গঙ্গোত্রী।

কী ইচ্ছে করে এর পরে? ঘনাদার এই বেয়াড়া রোগের সূত্রপাত যার জন্য হয়েছে তাকেই এই বাহাত্তর নম্বর থেকে নির্বাসন দিতে ইচ্ছে করে নাকি?

কিন্তু তার দরকার হয় না।

রোগ যার বাধে, দাওয়াইয়ের ব্যবস্থাটাও সেই করে।

দাওয়াইটা বেশ অদ্ভুত। প্রথমে দাওয়াই বলে ধরাই যায়নি।

বাহাত্তর নম্বরের এখনকার নিতান্ত জোলো মজলিশে কদিন আগে হঠাৎ একটা নতুন মুখ দেখা গেছে। কার এ মুখ, কোথা থেকে আমদানি এ সব কিছু জানবার আগে শিবুর কাছে সামান্য দু-একটা ইশারা আমরা অবশ্য পেয়েছি।

শব্দ-কল্পদ্রুম-এর নাম শুনেছ তো? শিবু যেন জনান্তিকে জানিয়েছে আমাদের, এ তা হলে আর-এক নিখিল বিশ্ব শব্দকল্পদ্রুম। এমন কিছু ভূ-ভারতে নেই, যা ওই মানুষটাকে একটু নাড়া দিয়ে বার করতে পারা যায় না। আর একবার মুখ খুললে সে অনর্গল কথার ফোয়ারা বন্ধ করে কে? শুধু একটু বুঝেসুঝে ফোয়ারাটা চালু করতে হয়। মেজাজি মানুষ তো, এমনিতে মুখ যেন খুলতেই চায় না।

যাঁর সম্বন্ধে কথাগুলো বলা হয়েছে, তাঁকে মাত্র একদিনই বাহাত্তর নম্বরে আমাদের দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে। শিবুর সঙ্গে সন্ধের দিকে এসে সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে আড্ডাঘরে খানিক বসে শিবুর সঙ্গে তিনি আবার ঘর ছেড়ে চলে গেছেন।

ওপরে যাঁর কথা লেখা হল, প্রথম দিনের নীরব সাক্ষাতের পর দ্বিতীয় দিনে শিবু যখন প্রথম তাঁর বিশদ পরিচয় দিয়েছে, তিনি নিজে তখন সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। ওপরের টঙের আড্ডাঘরে তাঁকে তখনও দেখা না গেলেও ন্যাড়া ছাদের সিঁড়িতে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটির চটপটানি সিঁড়ি থেকে বারান্দায় পৌঁছবার শব্দ তখন পাওয়া গেছে।

শিবু অবশ্য তার নতুন আবিষ্কার সম্বন্ধে উচ্ছ্বাস যেরকম তারস্বরে প্রচার করেছে, তাতে সিঁড়িতে পা দেবার আগে নিজের টঙের ঘর থেকেই ঘনাদার তা শুনতে খুব অসুবিধে হত না।

বাইরে বারান্দা থেকে ঘনাদা যখন ঘরে ঢুকেছেন, শিবু তখন তার নতুন আবিষ্কারের নামটা আমাদের জানিয়ে বলেছে, ওঁর নামটা ভাল করে জানার সুযোগ অবশ্য হয়নি। হবে কোথা থেকে? এমনিতে থাকেন একেবারে স্ফিংসের মতো বোবা হয়ে, আর কথা যখন একবার শুরু করেন তখন তার মধ্যে তাঁকে নাম জিজ্ঞেস করবার ফুরসত থাকে কখন। তবে নামটা ওই নবীন না নরেশ্বর না নরহরি গোছের কিছু বলে যেন হচ্ছে।

শিবুর কথা শেষ হবার আগে ঘনাদা ঘরের যথাস্থানে এসে তাঁর মৌরসি কেদারাটি দখল করতে করতে বলেছেন, ভাল, ভাল, নামটা ঠিক না-ই জানো, আবিষ্কারটা করেছ তো ঠিক। যা-তা নয়, একেবারে নিখিল বিশ্ব শব্দকল্পদ্রুম। অর্থাৎ ইউনিভার্সাল এনসাইক্লোপিডিয়া। মানে বিশ্বকোষ। শুকনো পুঁথির কাগজের নয়, জীবন্ত বিশ্বকোষ মানে দ্বিতীয় ব্যাসদেব আরকী!

ঘনাদা তখন তাঁর যা বলবার বলেই যাচ্ছেন, আর আমরা ঠিক সজ্ঞানে আছি কি না জানবার জন্য নিজেদের চিমটি কাটব কি না ভাবছি।

চিমটি সত্যি অবশ্য কাটিনি। কিন্তু আমাদের মাঝখানের মৌরসি কেদারায় আসীন মানুষটি যে আমাদের এ ক-দিনের ঘনাদা, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

কী তাঁর হয়েছিল, তা একেবারে অজানা না হলেও, হঠাৎ এ-রূপান্তর কী করে যে তাঁর হল, তার রহস্যটা যে ধরতেই পারছি না।

এ কি আমাদের টঙের ঘরের সেই তিনি, এই গত কালই যাঁকে রাম বলাতে হন্যে হয়ে গিয়ে মরা পর্যন্ত বলাতে পারিনি। হঠাৎ তাঁর বাবা গলায় কথার যেন বান ডেকেছে। সে-বান আবার বাঁধভাঙা হয়ে উঠেছে ঠিক সেই সময়ে শিবুর আবিষ্কার বিশ্ব-শব্দকল্পদ্রুম নরহরি না নরেশ্বরবাবুর ঘরে এসে ঢাকায়।

আসুন, আসুন, নরহরি না নরেশ্বর না দ্বিতীয় ব্যাসদেবঠাকুর, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা। বসুন, বসুন। হ্যাঁ, হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসুন। আপনি নাকি কথা আরম্ভ করলে তার অবিরাম তোড়ে আর কারও কোনও কথা পাত্তা পায় না, তাই আমার কথাটা আগেই বলে রাখছি সেই শব্দকল্পদ্রুম নিয়ে। আমাদের এই বাংলা ভাষায় প্রথম শব্দ-কল্পদ্রুম কবে কে প্রকাশ করেছিলেন তা আপনাকে নতুন করে কী শোনাব? স্যার রাধাকান্ত দেববাহাদুরের সেই আশ্চর্য কীর্তিটি তখনকার হিতবাদী মেশিনের যন্ত্রে মুদ্রিত হয়েছিল বলেও মনে করতে পারছি। শুধু কোন সালে ছাপা হয়েছিল আর মুদ্রাকর কে ছিলেন, তাই নিয়ে মনে যা একটু সংশয় আছে। তা আপনি নিশ্চয় নিরসন করে দেবেন। আপনার অপেক্ষায় সেই আশাতেই আছি

ঘনাদা যেন ভক্তিভরে শিবুর আনা নতুন অতিথির দিকে চেয়ে প্রায় হাত জোড় করে মিনতি করবার ভঙ্গি করেছেন এবার।

কিন্তু শিবুর আনা নরহরি বা নরেশ্বরবাবু কেমন অসহায় অস্থিরভাবে, আজ্ঞে— আমায় বলছেন, মানে—আমি বলতে গিয়ে প্রায় তোতলা হবার উপক্রম হতে, থাক, থাক, আপনি স্বয়ং যখন উপস্থিত তখন যা জানবার সবই ঠিক সময়ে জানব, বলে তাঁকে তখনকার মতো রেহাই দিয়ে ঘনাদা তাঁর লাগাতার একক ভাষণ কোথায় যে নিয়ে গেছেন তা আগেই জানানো হয়েছে।

এর আগে ক-দিন যাঁর গলা দিয়ে একটা হাঁচিকাশির আওয়াজও আর বার হবে বলে সন্দেহ হচ্ছিল, সেই ঘনাদা হঠাৎ মুখে কেন যে বুকনির বান ডাকাচ্ছেন তা বুঝতে আমাদের তখন আর বাকি নেই। আহাম্মক শিবুকে একটু ভাল করে শিক্ষা দেবার জন্যই তার আমদানি করা পণ্ডিতকে একেবারে ছাল ছাড়িয়ে নেবার কী অবস্থায় যে এনে দাঁড় করিয়েছেন তা আমরা দেখেছি।

কিন্তু ফ্যাসাদ বেধেছে নকল বেদব্যাস সাজানো নরহরি কি নরেশ্বরকে নিয়ে নয়, জলের কলের কনট্রাকটর নেহাত সাদাসিধে নবীনবাবুকে নিয়ে।

সম্পূর্ণ বিনা দোষে অকারণে তাঁকে টিটকিরির শিকার করে তোলার অবিচারে নরহরি বা নরেশ্বর নয়, নেহাত সাদাসিধে নবীনবাবু যখন বিগড়ে গিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়েছেন, তখন ঘনাদা সত্যিই পড়েছেন বিপদে।

আপনি মানে, ঘনাদা বিব্রত অপ্রস্তুত হয়ে বলেছেন, ও সব পণ্ডিতটণ্ডিত, ওই কী বলে, শব্দকল্পদ্রুম গোছের কিছু নন তা হলে? মাফ করবেন, নরহরি, না না, নরেশ্বর, থুড়ি নবীনবাবু, আমি আমার ভুলের জন্য বারান্দা থেকে ন্যাড়া ছাদ পর্যন্ত সব কটা সিঁড়ি নাকখত দিয়ে উঠতে রাজি আছি। আপনি শুধু আমায় ক্ষমা করবেন।

ঘনাদার কথাগুলো শুনব কী, তাঁর কাণ্ড দেখে তখন আমাদের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধোবার অবস্থা।

ঘনাদা তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। শুধু উঠে দাঁড়াননি, বারান্দার দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলেছেন, মিছিমিছি কটা বাজে বুকনি ছেড়ে বাহাদুরি নেবার চেষ্টায় আপনার সময় নষ্ট করেছি বলে আমি সত্যিই আপনার কাছে মাফ চাইছি। আচ্ছা, নমস্কার!

নমস্কার, বলে ঘনাদা সত্যি তখন রওনা দিয়েছেন বারান্দার দরজা দিয়ে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে।

হায়, হায়! একেবারে ঘাটের কাছে এসে ভরাড়ুবি! শিবুকে শিক্ষা দিতে গিয়ে ঘনাদা তো হাজার একের ওপর আরও ক-টা আরব্যরজনী নামিয়ে এনেছিলেন।

সে সব তো গেল গাঢ় অমাবস্যায় হারিয়ে।

এখন ঘনাদাকে আর কি ফেরানো সম্ভব? ছিঁড়ে যাওয়া তার আবার জুড়ে আর কি সুরে বাঁধা যায় ভাঙা সারেঙ্গি?

যায়, যায়। ব্যাপারটা একরকম হোমিওপ্যাথিই বলা যায় নিশ্চয়। রোগ যা ধরায়, দাওয়াই জোগায় তা-ই।

ঘনাদার বিদায়-নমস্কারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ধমকই যেন শোনা গেল। শুধু ধমক অবশ্য বলব না, ধমকেরই সুরে যেন একটা নালিশ, নমস্কারের মানে? নমস্কার মানে চলে যেতে চান আমাদের কী জানো, কী হল, কী হবের ভয়-ভাবনা-সন্দেহের কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলিয়ে? না, না, সেটি হবে না। গণপতি না গজেশ্বরবাবু, এলোপাতাড়ি সন্দেহ-সংশয়ের কাঁটা যা-সব ছড়িয়েছেন, তা সাফ না করে আপনার যাওয়া চলবে না।

আরে, আরে, করেন কী নরহরি, না, থুড়ি নবীনবাবু?

নবীনবাবুর এর আগের প্রাণখোলা বক্তৃতায় আর ব্যবহারে যতই খুশি হয়ে থাকি, এবার তাঁকে সামলাবার জন্য এগিয়ে গিয়ে ধরতে হল।

ধরতে হল তখন তিনি ঘনাদাকে প্রায় জাপটে ধরে আবার বসাবার চেষ্টা করছেন বলে।

কী, করছেন কী, নবীনবাবু! সঠিক নামটা ধরেই তাঁকে শাসন করতে হল এবার, টানাটানি করছেন কেন ওঁর হাত ধরে?

বেশ, হাত ছেড়ে দিয়ে পাই না হয় ধরছি,নবীনবাবু তা-ই করতে গিয়ে ঘনাদা সরে যাওয়ার জন্যই বিফল হয়ে বললেন, আমাদের মনের খোঁচাগুলো উনি শুধু বাড়িয়ে দিয়ে যান। শুধু জিজ্ঞাসাগুলো জানিয়ে উত্তরগুলো চেপে চলে যাওয়াটা কি ওঁর উচিত হচ্ছে?

আচ্ছা বলুন, কোন উত্তরটা চান? ঘনাদাই এবার ফিরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন।

একটাই তো নয়, অনেক জিজ্ঞাসারই উত্তর চাই,নবীনবাবুই আমাদের সকলের মনের কথাটা জানিয়ে বললেন, কিন্তু আপনার কী বলে, একটু বসলে ভাল হত না?

আমাদের সকলকে অবাক করে, লজ্জা দিয়ে নবীনবাবু এবার ঘনাদার মৌরসি কেদারাটাই টেনে তাঁর কাছে এনে পেতে দিলেন।

ঘনাদা কি বিরক্ত? ভেতর থেকে রাগটা কি ফোঁস করে ওঠার উপক্রম করছে?

মুখ দেখে তা অবশ্য বোঝা গেল না। শুধু গলাটা একটু গম্ভীর রেখে ঘনাদা জিজ্ঞেস করলেন, বলুন, কোন উত্তরটা চান প্রথম?

প্রথম? নবীনবাবু বলতে গিয়ে হঠাৎ যেন নিজের কর্তব্যটা স্মরণ করে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, বলুন না আপনারাই, প্রথম কোন জবাবটা শুনতে চান?

না, না, আপনি বলুন, এ-মজলিশের মেজাজ যিনি শুধরেছেন, তাঁকেই অধিকারটা আমরা সানন্দে দিলাম।

তা হলে, অনুমতি পেয়ে নবীনবাবু খুশিমুখে বললেন, ওই যে বিলেতের ওয়েলস-এর কোন খুদে স্টেশনের আটান্ন হরফের এক ঘটোৎকচ-মাকা নামের বানান শোনালেন, সে-বানান যে ঠিক, তার প্রমাণ কোথায় মিলবে?

তার প্রমাণ? ঘনাদার মুখের ছায়াটা একটু হালকা হচ্ছে কি? তার প্রমাণ। মিলবে বিলেতের স্টাউট নামে পানীয়ের জন্য বিখ্যাত কোম্পানির গিনেস বুক অব রেকর্ডস নামের বইতে। সেই বই দেখে এক-এক করে আটান্নটা অক্ষর মিলিয়ে দেখতে পারো। আচ্ছা, এ-প্রশ্ন তো হল, তারপর?

তারপর? তারপর? শিশিরই এবার জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা, মহিষাসুরের মতো বিরাট আর চামচিকের মতো চিমসে যে দু-জন আপনাকে অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত মধ্যোপসাগরের এক প্রায় অজানা জেলেদের দ্বীপে গিয়ে দেখা পায়, তারা কে, কেনই বা আপনাকেই অত করে খুঁজছিল?

কেন খুঁজছিল তা তো আগেই শুনেছ। ঘনাদার স্বর কি একটু ক্লান্ত?