কাম্পালা বিমানবন্দরটি উগান্ডা রাজ্যে। ওর পাশেই কেনিয়া। এই উগান্ডাতেই আছে বিশ্ববিখ্যাত জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস চাঁদের পাহাড় এখানকারই একটা পাহাড় নিয়ে লেখা। বিভূতিভূষণ অবশ্য কখনও আফ্রিকায় আসেননি। বই পড়ে লিখেছেন, কিন্তু কী চমৎকার লিখেছেন!
কাকাবাবু যখন আগেরবার কেনিয়ায় এসেছিলেন, তখন এখানকার চাঁদের পাহাড় দেখে যাওয়ারও খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তখন এখানে মারামারি, কাটাকাটি চলছিল খুব, তাই আসা সম্ভব ছিল না। তারপর তো কেনিয়াতেই এমন কাণ্ড হল…!
একটা ঝাকুনি দিয়ে প্লেনটা মাটি স্পর্শ করার পর কাকাবাবু খানিকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। যাক, তবু তো আকাশে থাকতে থাকতেই কোনও দুর্ঘটনা হয়নি। যতই মানুষ প্লেনে চেপে এদেশে-ওদেশে যাক, তবু মাটির সঙ্গেই মানুষের আসল সম্পর্ক।
বন্দুকধারী হাইজ্যাকারটি হুকুম করল, কিপ কোয়ায়েট। সিট টাইট। যেযার জায়গায় বসে থাকো।
এক ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে অনুনয়ের সুরে বললেন, এখন আমার বাচ্চাকে কি একবার টয়লেটে নিয়ে যেতে পারি?
হাইজ্যাকারটি একটু চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, যাও!
তারপর সে বুড়ো ভদ্রলোকটিকে উদ্দেশ করে বলল, হেই, তুমিও এবার যেতে পারো।
লোকটি উঠল না। দুহাতে মাথা চেপে, মুখ নিচু করে বসে রইল। তার পিঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বোধহয় কাঁদছে।
কাকাবাবু ভাবলেন, নিশ্চয়ই ভদ্রলোকটি আর চেপে রাখতে না পেরে প্যান্টেই টয়লেট করে ফেলেছে। বাচ্চারা যেমন করে, তেমন বুড়ো মানুষদেরও এরকম হতে পারে। বাচ্চারা লজ্জা পায় না, বুড়ো মানুষদের তো লজ্জা হবেই। সেই লজ্জাতেই কাঁদছে। ইস!
আর-একজন লোক হাত তুলে বলল, একটু খাবার জল পেতে পারি?
হাইজ্যাকারটি বলল, নাঃ!
লোকটি বলল, খুব তেষ্টা পেয়েছে!
এদের একজন কাছে গিয়ে সেই লোকটির মুখে একবার চাবুকের মতো দড়ি দিয়ে মারল।
তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমাদের দেশে অনেক লোক সারাদিন জল না খেয়েও থাকতে পারে। সাত মাইল হেঁটে গিয়ে জল আনতে হয়।
এই প্লেনে দুশোর বেশি যাত্রী। আর হাইজ্যাকাররা মাত্র চারজন। তবু ওদের কথা না শুনে উপায় নেই। ওদের কাছে আছে মারাত্মক অস্ত্র। ওরা কাউকেই দয়ামায়া করে না। যে-কোনও সময়, যাকে-তাকে মেরে ফেলতে পারে।
কাকাবাবু ঘড়ি দেখলেন। কতক্ষণ ঠায় বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। এই হাইজ্যাকারদের নিশ্চয়ই কিছু দাবি আছে, তাই নিয়ে এখানকার সরকারের সঙ্গে দরাদরি করবে। কয়েক ঘণ্টা লাগতে পারে, কিংবা একদিন-দুদিনও কেটে যেতে পারে। তার মধ্যে খাবার পাওয়া যাবে না, জলও পাওয়া যাবে না। অন্যরা সহ্য করতে পারলেও কয়েকটা বাচ্চা আছে। তারা কী করে সহ্য করবে?
খবরের কাগজে কাকাবাবু অনেক হাইজ্যাকিং-এর ঘটনা পড়েছেন। কিন্তু নিজের কখনও এমন অভিজ্ঞতা হয়নি।
তিনি বুঝতে পারছেন, এখানে প্রতিবাদ জানাবার উপায় নেই। মুখ বুজেই থাকতে হবে। দেখা যাক, এর পর কী হয়!
কাকাবাবু আবার মহাভারত খুললেন। খানিক পর খেয়াল হল, তিনি বইয়ের দিকে তাকিয়েই আছেন শুধু, পড়ছেন না। এই সময় কি বইয়ে মন বসানো যায়?
জানলা দিয়ে দেখলেন, মারাত্মক সব অস্ত্র নিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সৈন্যরা। প্লেনটাকে ঘিরে ফেলেছে। ইচ্ছে করলে ওরা প্লেনটাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু তাতে এত যাত্রীরও প্রাণ যাবে। এই যাত্রীদের প্রাণ নিয়েই দরাদরি চলছে।
এই হাইজ্যাকাররা যে কী চায়, সেটাই তো জানা যাচ্ছে না। সাধারণত ওরা ওদের দলের কিছু বন্দির মুক্তি চায়। তারপর প্লেনটা নিয়ে উড়ে যেতে চায় অন্য দেশে।
কেটে গেল প্রায় একঘণ্টা। কেউ ফিসফিস করেও কথা বলছে না।
আবার একটি লোক উঠে দাঁড়াল। লোকটি বেশ লম্বা আছে, সুন্দর চেহারা।
মাথা নাড়তে নাড়তে সে পাগলের মতো বলতে লাগল, আমি আর পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। আমাকে নামতেই হবে। নামতে দাও!
বন্দুকধারী ধমক দিয়ে বলল, সিট ডাউন! সিট ডাউন!
লোকটি তবু বলল, না, বসব না। বসে থাকতে পারছি না। আই মাস্ট গো!
বন্দুকধারী এবারে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুমি যাবেই। বেশ, তোমাকে যাওয়াচ্ছি।
কাছে এগিয়ে এসে সে লোকটির বুকে বন্দুকটি ঠেকিয়ে বলল, একটা গুলি! তাতেই তোমার প্রাণপাখিটা বেরিয়ে যাবে। তারপর উড়ে উড়ে বাইরে চলে যেয়ো!
লোকটি বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে বলল, তাই করো। আমাকে গুলি করো। তবু আমি বসে থাকব না!
বোঝাই যাচ্ছে, দুশ্চিন্তায় লোকটির মাথার গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে।
অন্য একজন হাইজ্যাকার ওর পিছনে এসে নিজের দড়িটা দিয়ে চট করে ওই লোকটির গলায় ফাঁস পরিয়ে দিল। তারপর প্যাঁচাতে লাগল দড়িটা।
লোকটি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল।
হাইজ্যাকারটি দড়ির প্যাঁচ যত শক্ত করতে লাগল, ততই লোকটির চিৎকারও বাড়তে লাগল। তারপর একসময় ধপ করে পড়ে গেল মেঝেয়।
মরে গেল? কিংবা অজ্ঞানও হতে পারে।
এই দৃশ্য দেখে রাগে কাকাবাবুর শরীর জ্বলছে। তিনি উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, অতি কষ্টে দমন করলেন নিজেকে। প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকেও ওরকমভাবে মারবে।
তিনজন এয়ার হোস্টেস দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছবির মতো। বোধহয় তাদের চোখের পাতাও পড়ছে না একবারও।
একটু পর ককপিট থেকে বেরিয়ে এলেন পাইলট আর কো-পাইলট। তাঁদের পিছনে রিভলবার উঁচিয়ে একজন হাইজ্যাকার।
এবার প্লেনের দরজা খুলে গেল, পাইলট দুজনকে নামিয়ে দেওয়া হল। সিঁড়ি দিয়ে। দরজাটা খোলাই রইল।
কী ব্যাপার হল, বোঝাই যাচ্ছে না। বাচ্চা দুটো কেঁদেই চলেছে, নিশ্চয়ই ওদের খিদে পেয়েছে। আজকাল প্লেনে জলের বোতল নিয়ে ওঠা যায় না। এখানেও জল দেওয়া হচ্ছে না। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কী করে?
দড়ি হাতে হাইজ্যাকার দুটো সিগারেট টেনেই চলেছে। আর যার হাতে এ কে ফর্টি সেভেনের মতো মারাত্মক বন্দুক, সে তার অস্ত্রটা এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে অনবরত। যেন যে-কোনও মুহূর্তে সে যাকে-তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে।
একসময় দড়িধারীদের একজনের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সে কী সব কথা বলল দু-তিন মিনিট ধরে। তারপর সে ফোনটা নিয়ে গেল অস্ত্রধারীর কানের কাছে। সে-ও একটুক্ষণ শোনার পর বলল, ওকে, ওকে!
এবার সে চেঁচিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশে বলল, হিয়ার ইজ অ্যান অ্যানাউন্সমেন্ট। সবাই মন দিয়ে শোনো। এখন আমরা যাত্রীদের মধ্যে থেকে কুড়িজনের মতো ব্যাচকে ছেড়ে দেব। আমরা যাদের বেছে নেব, তারা ছাড়া আর কেউ সিট ছেড়ে উঠবে না। কেউ কোনও কথা বলবে না! যাদের নামিয়ে দেব, তারাও লাইন বেঁধে যাবে, কেউ দৌড়োবে না। একটু এদিক-ওদিক হলেই আমরা গুলি চালাব। ক্লিয়ার?
এবার সে এলোপাথাড়িভাবে এক-একজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগল, ইউ গেট আপ! ইউ! ইউ!
একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ওয়াইফ, সে যাবে না?
অস্ত্রধারী বলল, শাট আপ! নো ওয়াইফ!
স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে একজন থাকলে আর-একজন যাবে, তা কি হয় নাকি? কিন্তু এরা যে কোনও কথাই শুনবে না।
কাকাবাবু আশা করলেন, বাচ্চার মা দুজনকে নিশ্চয়ই এরা ছেড়ে দেবে! কী আশ্চর্য ব্যাপার, সেই মা দুজনের দিকে অস্ত্রধারী আঙুল দেখাল না, নম্বর গুনতে গুনতে কুড়ি নম্বরে এসে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, অ্যান্ড ইউ! কাম!
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে খুবই বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের একটা অনুরোধ করতে পারি? আমার বদলে যদি ওই বাচ্চাদের মায়েদের ছেড়ে দেন, খুব ভাল হয়। ওরা কষ্ট পাচ্ছে। আমি আরও অপেক্ষা করতে পারি, আমার কোনও অসুবিধে নেই।
লোকটি প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, শাট আপ! বলেছি না, কেউ কোনও কথা বলবে না!
কাকাবাবু তবু দাঁড়িয়ে রইলেন। দড়ি হাতে যে-দুজন কাকাবাবুর পাশে বসে ছিল, তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে বলল, কেন সময় নষ্ট করছিস! বেরিয়ে আয়।
কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো পাশে রাখা ছিল। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্রাচ দুটো নেওয়ার চেষ্টা করতেই সে আবার দাঁত খিচিয়ে বলল, নো! ওসব নেওয়া চলবে না। কেউ হ্যান্ডব্যাগও নিতে পারবে না। লাইনে এসে দাঁড়াও!
কাকাবাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন দরজার দিকে। কয়েকটা রো পরেই অরুণকান্তি বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হল। তাঁর মুখে একটা দারুণ অসহায় ভাব। কাকাবাবু আর বাকি উনিশজন যেন লটারি জিতেছেন। বাকি যাত্রীদের ভাগ্যে যে কী আছে, কে জানে!
কথা বলার উপায় নেই, কাকাবাবুকে সামনের দিকে যেতেই হল।
অস্ত্রধারী আগে নামল, তার পিছনে পিছনে অন্য সবাই। কাকাবাবু সকলের শেষে। তিনি দরজার কাছে এসে দেখলেন, অস্ত্রধারীটি সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে অন্যদের গুনে গুনে নামাচ্ছে।
ক্রাচ ছাড়া কাকাবাবুর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে খুব অসুবিধে হয়। তিনি একটা পাশ ধরে বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগলেন। তাঁর দুপায়ে দুরকম জুতো। খারাপ পা-টায় একটা স্পেশ্যাল অর্ডারি জুতো পরতে হয়, অন্য পায়ে সাধারণ জুতো। কয়েকটা সিঁড়ি নামার পর কাকাবাবুর সেই সাধারণ জুতোটা হঠাৎ খুলে গেল।
সেটা আবার ঠিকমতো পরে নেওয়ার জন্য কাকাবাবু একটু থামলেন।
অমনি সেই অস্ত্রধারীটা কাছে এসে কাকাবাবুর গোঁফটা ধরে কয়েকবার জোরে টানাটানি করে মুখ ভেংচে বলল, এই বুড়ো, তুই ইচ্ছে করে দেরি করছিস, তাই না? তুই মহাবদমাশ। নাম।
সে একটা লাথিও কষাল কাকাবাবুর পিছনে।
যাদের গোঁফ থাকে, তাদের গোঁফ ধরে টানা মানে তাদের চূড়ান্ত অপমান করা। এই অস্ত্রধারীটা নিশ্চয়ই তা জানে। সেজন্যই এ কাজটি করে সে হাসতে লাগল।
কাকাবাবু আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন সেই লোকটির দিকে। তাঁর এরকম হিংস্র মুখ কেউ কখনও দেখেনি। তাঁর চোখ দুটি যেন বাঘের মতো জ্বলছে।
তিনি প্রচণ্ড জোরে এক ঘুসি মারলেন লোকটির চোখে।
খোঁড়া মানুষের হাতে যে কত শক্তি থাকে তা অনেকেই জানে না। এই অবস্থায় কাকাবাবু যে মারতে পারেন, তা ওই লোকটি ভাবতেও পারেনি।
ওই ঘুসি খেয়ে সে আঃ চিৎকার করে উলটে পড়ে গেল। গড়াতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে। চোখের যন্ত্রণায় সে এক হাতে চোখ চাপা দিতেই তার অন্য হাত থেকে ভারী অস্ত্রটা খসে পড়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজন যাত্রী লাথি মেরে সেই অস্ত্রটা সরিয়ে দিল। যেসব সৈন্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা ছুটে এল এদিকে। তাদের গুলিতে আহত হয়ে সেই লোকটি কাতরাতে লাগল।
বিমান বন্দরের নানা দিকের ছাদেও পাহারা দিচ্ছে সৈন্যরা। তারা দূরবিন। দিয়ে দেখছেও সব কিছু। তক্ষুনি মাইক্রোফোনে ঘোষণা হল, সবাই শুয়ে পড়ুন, মাটিতে শুয়ে পড়ুন।
পাইলট দুজন আগেই শুয়ে পড়েছেন টারমাকে। তাঁদের কাছে রিভলবার নিয়ে যে দাঁড়িয়ে ছিল, সে ঠিক বুঝতে পারল না কী ঘটছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে গুলি চালাতে শুরু করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে নিজেই গুলি খেয়ে ছটফট করতে লাগল মাটিতে পড়ে।
বাকি রইল প্লেনের মধ্যে দুজন, যাদের কাছে দড়ি ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে এবার তাদের ধস্তাধস্তি শুরু হল। সেই দুজনকে কাবু করতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। রাগের চোটে অনেকে মিলে তাদের এমন পেটাতে শুরু করল যে, আর কিছুক্ষণ দেরি হলে তারা মরেই যেত। এর মধ্যেই কয়েকজন সৈন্য সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে গিয়ে সেই দুজনকে যাত্রীদের হাত থেকে বাঁচিয়ে গ্রেফতার করল।
কাকাবাবু স্থিরভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন সিঁড়িতে। তাঁর পাশ দিয়ে হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। কাকাবাবুর জন্যেই যে তারা মুক্তি
পেয়েছে, তা কেউ এখনও জানে না।
সৈন্যরা সবই দেখেছে। দুজন বড় অফিসার এবার কাকাবাবুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনার কোথাও লাগেনি তো? আপনি আজ যে সাহস দেখালেন…।
কাকাবাবু তক্ষুনি কিছু বলতে পারলেন না। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে। লোকটিকে ঘুসি মারার এক মুহূর্ত আগেও তিনি মারার কথা ভাবেননি। তাঁর শরীরের মধ্যে যত রাগ জমা হচ্ছিল, সব যেন হঠাৎ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে এসেছে।
সেনাবাহিনীর অফিসাররা কাকাবাবুর প্রশংসা করে যাচ্ছেন নানাভাবে, কাকাবাবু তা কিছুই শুনছেন না। একটু পরে তিনি শান্তভাবে বললেন, আপনারা কেউ দয়া করে প্লেনের ভিতর থেকে আমার ক্রাচটা এনে দেবেন?
হলে আমার হাঁটতে অসুবিধে হয়।
অরুণকান্তি বিশ্বাস এর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন কাকাবাবুর পাশে। এর মধ্যে একজনকে উপরে পাঠিয়ে দেওয়া হল ক্রাচ দুটো আনার জন্য। অরুণকান্তি সেনাবাহিনীর অফিসারদের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন, ইনি কে জানেন? হি ইজ আ গ্রেট ম্যান। ইন্ডিয়ায় ইনি খুব ফেমাস।
একজন অফিসার বললেন, এঁর অসাধারণ সাহস। এঁর জন্যই আজ এত মানুষ বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, আমি এখন কোথাও গিয়ে একটু বসতে চাই। আমার খুব জলতেষ্টা পেয়েছে।
কাম্পালা বিমানবন্দরটি খুব আধুনিক। মস্ত বড় লাউঞ্জ। উদ্ধার পাওয়া যাত্রীদের বসানো হয়েছে সেখানে। কাকাবাবুকে নিয়ে যাওয়া হল আলাদা একটা ঘরে। জল ছাড়াও, শরবত ও নানারকম খাবারদাবার আসতে লাগল।
এর মধ্যে সমস্ত ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। হাইজ্যাকাররা সোমালিয়ার লোক। তাদের কী একটা দল আছে, সেই দলের এগারোজন সদস্য বন্দি হয়ে আছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তাদের মুক্তির দাবিতেই প্লেন হাইজ্যাক করেছিল। তবে হাইজ্যাকার হিসেবে এরা তেমন পাকা নয়। নইলে এত সহজে ব্যাপারটা শেষ হত না। সেই চারজনের কেউ অবশ্য প্রাণে মরেনি। গুরুতর আহত। কড়া পাহারায় তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে।
রাজা রায়চৌধুরী নামে একজন যাত্রীর জন্যই যে এত মানুষের বিপদ থেকে মুক্তি ঘটেছে, তাও জেনে গিয়েছে সবাই। দলে দলে লোক আসছে। কাকাবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। কাকাবাবু অত কিছু শুনতে চান না, তিনি বিব্রত বোধ করছেন, তাই একসময় বলে দিলেন দরজা বন্ধ করে দিতে।
তবু একসময় জোর করে সেই দরজা খুলিয়ে ঢুকে এলেন এক মহিলা। তাঁর কোলে একটি শিশু আর পিছনে তাঁর স্বামী। দৌড়ে কাকাবাবুর পায়ের কাছে বসে পড়ে বাংলায় বললেন, আপনি কাকাবাবু! আপনার কথা কত শুনেছি। আমার দেওর বাপি, সে সন্তুর সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছে। সন্তু এসেছে। আমাদের কেয়াতলার বাড়িতে। আপনি আমাদের বাঁচালেন। আমার ছেলেটা, একটুও জল দেওয়া যায়নি, তেষ্টায় ওর গলা কাঠ হয়ে গিয়েছিল, হেঁচকি তুলছিল, আর বেশি দেরি হলে…!
মহিলা এসব কথা বলেই চলেছেন, কাকাবাবু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ছিঃ, ওরকম পায়ের কাছে বসতে নেই। আমার পাশে এসে বোসো। আমি এমন কিছু করিনি। অন্যায় দেখলে সবাই কিছু না কিছু প্রতিবাদ করে।
মহিলাটি উঠে পাশের চেয়ারে বসার পরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, শোনো, আমার একটা কথা আগে শোনো। তুমি গান জানো?
মহিলাটি হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, গান? হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, তোমাকে দেখেই মনে হচ্ছে, তুমি একজন গায়িকা। একটা গান শোনাও না! এইসব সময় একটা গান শুনলে মনটা জুড়িয়ে যায়। হাইজ্যাকিং-এর একঘেয়ে কথা আর কত শুনব?
মহিলাটির স্বামী বললেন, হ্যাঁ, হা, ও খুব ভাল গান জানে। সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী ছিল। আপনি ঠিক ধরেছেন।
কাকাবাবু বললেন, শোনাও, একটা রবীন্দ্রসংগীত শোনাও!
মহিলাটি একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আমার বুক এখনও ধড়ফড় করছে। একটা অল্পবয়সি হাইজ্যাকার যখন আপনার চুলের মুঠি ধরল, তখন আমার এমন কষ্ট হয়েছিল। আপনি তো নাইরোবি যাচ্ছেন, ওখানে আমাদের বাড়িতে একদিন আসতেই হবে। তখন আপনাকে গান শোনাব। এখন গলা দিয়ে সুর বেরোবে না।
ওঁর নাম হেমন্তিকা, স্বামীর নাম বিনায়ক ঘোষ। স্বামীটি কাকাবাবুকে নিজের একটি কার্ড দিলেন।
কাকাবাবু এবার গলা তুলে এখানকার একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের প্লেনটা আবার কখন যাবে? একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন না!