০২. কাটুস্কা একদৃষ্টে মনিটরটির দিকে

কাটুস্কা একদৃষ্টে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে ছিল। উপগ্রহ থেকে সরাসরি ছবি পাঠিয়েছে- সেই ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে একটা টাইফুন তৈরি হচ্ছে। নীল সমুদ্রের ওপর সাদা মেঘের ঘূর্ণন, কী প্রচণ্ড শক্তি না জানি তার মাঝে জমা হয়ে আছে। টাইফুনটি

এখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াবে, সমুদ্রের নীল পানিকে ওলটপালট করে দিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে ছুটে যাবে! কাটুস্কা মনিটর থেকে চোখ ফেরাতে পারে না, মনে হয় প্রকৃতি ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফুঁসে উঠছে, এই ক্রোধের মাঝেও যে এক ধরনের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে সেটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

ঘরের দরজায় কে জানি টুকটুক করে শব্দ করল। কাটুস্কা মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে বলল, কে?

দরজাটা একটু খুলে কাটুস্কার সমবয়সী একটি মেয়ে ঘরের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, আমি, কানা।

ও! ক্রানা, এস, ভেতরে এস।

তুমি একা একা বসে কী করছ? ভিডি টিউবে ভালো কিছু দেখাচ্ছে নাকি?

না না, সেসব কিছু না। আমি উপগ্রহের একটা ছবি দেখছিলাম। ক্ৰা

না কাটুস্কার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, কিসের ছবি?

টাইফুনের। সমুদ্রের ওপর একটা টাইফুন তৈরি হচ্ছে। তাই দেখছি।

ও! তাই নাকি? ক্রানা ব্যাপারটাতে কোনো কৌতূহল দেখাল না। হাজার হাজার মাইল দূরে সমুদ্রে টাইফুন নিয়ে এখানে কেউ মাথা ঘামায় না। সে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে বসে থাকবে, নাকি বের হবে?

কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুঝতে পারছি না। মনে হয় বের হব।

ক্ৰানা একটু অবাক হয়ে বলল, আচ্ছা কাটুস্কা, তোমার হয়েছেটা কী?

কাটুস্কা জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, কী হবে? কিছু হয় নি।

তোমার বয়সী একটা মেয়ের এ রকম গম্ভীর মুখে থাকার কথা না।

কাটুস্কা গম্ভীর মুখে বলল, আমি মোটেও গম্ভীর মুখে থাকি না।

কাটুস্কার কথা শুনে ক্ৰানা শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, তুমি গম্ভীর মুখে থাক না! এখন চল।

কোথায়?

সাইকাডোমে এডিফাসের কনসার্ট।

এডিফাসটি কে?

ক্ৰানা চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি এডিফাসের নাম শোন নি? তার গান শুনে সব ছেলেমেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি তার নাম শোন নি?

খুব ভালো গান গায়?

তা না হলে মানুষ তার জন্য এত পাগল হবে কেন? গান থেকেও বড় ব্যাপার আছে।

সেটা কী?

পুরো সাইকাডোমে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স তৈরি করে। আমাদের মস্তিষ্কের ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির সাথে মিলিয়ে দেয়, তখন অপূর্ব এক ধরনের অনুভূতি হয়।

কাটুস্কা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ, দ্রীমান বলেছে আমাকে।

কাটুস্কা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, দ্রীমান সব সময়েই একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে কথা বলে। তার সব কথা বিশ্বাস কোরো না।

ক্ৰানা মাথা নাড়ল, বলল, আমি সেটা জানি।

দুই বান্ধবী যখন সাইকাডোমে পৌঁছেছে তখন সেখানে এর মাঝেই হাজারখানেক কমবয়সী ছেলেমেয়ে উপস্থিত হয়ে গেছে। এই বয়সী ছেলেমেয়েরা নিয়ম ভাঙতে পছন্দ করে, তাই তাদের পোশাকে ছিরিছাদ নেই। চোখে-মুখে-চুলে নানা ধরনের রঙ। কথাবার্তা, চালচলনে এক ধরনের অস্থিরতা।

সাইকাডোমের মাঝামাঝি একটা বড় স্টেজ, সেখানে কিছু মানুষ তাদের শরীরের সঙ্গে ইলেকট্রনিক সিনথেসাইজার লাগিয়ে উৎকট ভঙ্গিতে নাচানাচি করছে, তাদের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে উদ্দাম এক ধরনের সঙ্গীতের সৃষ্টি হচ্ছে। কমবয়সী ছেলেমেয়েগুলোর অনেকেই তার সাথে তাল মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে।

ক্ৰানা ও কাটুস্কার সঙ্গে তাদের ইনস্টিটিউটের আরো কিছু ছেলেমেয়ের দেখা হয়ে গেল। উত্তেজক এক ধরনের পানীয় খেতে খেতে তারা নাচানাচি করছে। দ্রীমানকে দেখে মনে হয় সে বুঝি এক পায়ে ভর দিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরার চেষ্টা করছে। ইনষ্টিটিউটের সবচেয়ে সুদর্শন এবং সবচেয়ে একরোখা উদ্ধত ছেলে মাজুর সঙ্গীতের তালে তালে নাচার চেষ্টা করছিল, কাটুস্কাকে দেখে হাত তুলে ডাকল, কাটুস্কা! এস, এক পাক নাচি।

কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, ইচ্ছে করছে না, মাজুর।

মাজুর অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, সে কী! সাইকাডোমে এডিফাসের কনসার্ট শুনতে এসে তুমি নাচবে না, সেটি কি হতে পারে?

কাটুস্কা উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন স্টেজ থেকে গমগম করে একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার প্রিয় ছেলে এবং মেয়েরা! তোমরা যার জন্য অপেক্ষা করছ, এই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়িকা তরুণ-তরুণীর হৃদয়ের ধন এডিফাস তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হচ্ছে। এ

তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতের তীব্র ধ্বনিতে পুরো সাইকাডোম কেঁপে কেঁপে ওঠে এবং সবাই দেখতে পায় গোল স্টেজের ঠিক মাঝখানে স্বল্পবসনা একটি নারীমূর্তি ওপর থেকে নেমে আসছে। সাইকাডোমের হাজারখানেক ছেলেমেয়ে হাত তুলে চিৎকার করতে শুরু করে। স্বল্পবসনা এডিফাস তার হাতের শক্তিশালী লেজারের আলোতে সাইকাডোমের ছাদটি আলোকিত করে চিৎকার করে বলল, তোমরা কি তোমাদের মস্তিষ্কের ভেতর তীব্র আনন্দের অনুভূতির জন্ম দিতে প্রস্তুত?।

অসংখ্য ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, প্রস্তুত! প্রস্তুত!

তা হলে, চল। আমরা শুরু করি

উদ্দাম সঙ্গীতে পুরো সাইকাডোম প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সাইকাডোমের চারপাশে সাজিয়ে রাখা এন্টেনা থেকে মস্তিষ্কের ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির কাছাকাছি তীব্র ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আসতে শুরু করে।

কাটুস্কা অবাক হয়ে দেখল প্রথমে তার বুকের ভেতর গভীর এক ধরনের বিষণ্ণতা ভর করে। সেই বিষণ্ণতা কেটে হঠাৎ করে তার এক ধরনের ফুরফুরে হালকা আনন্দ হতে থাকে। হালকা আনন্দটুকু হঠাৎ তীব্র এক ধরনের উল্লাসে রূপ নেয়। তার মনে হতে থাকে, পৃথিবীর কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। মনে হতে থাকে তার জন্ম হয়েছে সৃষ্টিছাড়া উদ্দাম বন্য আনন্দে মেতে ওঠার জন্য। সে চিৎকার করে মাথা দুলিয়ে সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে শুরু করে। তার মনে হতে থাকে সাইকাডোমে হাজারখানেক নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণীর উদ্দাম নৃত্যের বাইরে আর কিছু নেই। কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না। তার মনে হতে থাকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে এই সাইকাডোমে উপস্থিত হয়েছে। সব আনন্দ সব উল্লাস সাইকাডোমের চার দেয়ালের মাঝে আটকা পড়েছে। তার বাইরে আর কিছু নেই।

.

গভীর রাতে কাটুস্কা যখন নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে আসছিল, তখন মাজুর জড়িত কণ্ঠে বলল, কী মজা হল তাই না, কাটুঙ্কা!

কাটুস্কার মাথা তখনো ঝিমঝিম করছিল, সে অন্যমনস্কর মতো বলল, হ্যাঁ।

মাজুর বলল, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা কী আনন্দের ব্যাপার। আমাদের কী সৌভাগ্য, আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম।

কাটুস্কা হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে যায়। সত্যিই কি তা-ই? সত্যিই কি সাইকাডোমে মস্তিষ্কে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স তৈরি করে উদ্দাম এক ধরনের সঙ্গীতের সঙ্গে লাফালাফি করাই জীবন?

মাজুর পা টেনে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, পৃথিবীতে আনন্দের এত কিছু আছে, একটা জীবনে সব শেষ করতে পারব বলে মনে হয় না।

কাটুস্কা তীক্ষ্ণ চোখে মাজুরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী কী আনন্দের জিনিস আছে পৃথিবীতে?

সব কি বলে শেষ করা যাবে?

তবুও বল শুনি।

সঙ্গীত আছে, শিল্প আছে, সাহিত্য আছে। ভালো খাবার আছে, পানীয় আছে। মাদক আছে, এক শ রকম উত্তেজনা আছে। তবে–

তবে?

আমি শুনেছি, সবচেয়ে আনন্দের জিনিসটি হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে শিকার করা।

কাটুস্কা হাসার ভঙ্গি করে বলল, নির্বোধ মাছকে শিকার করার মধ্যে আনন্দ কোথায়?

মাজুর চোখ মটকে বলল, মাছ শিকার করবে কে বলেছে?

তা হলে কী শিকার করবে?

মানুষ। কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, মানুষ? কোন মানুষ?

জলমানব। ডলফিনের পিঠে করে তারা সমুদ্রের পানিতে ছুটে বেড়ায়। অসম্ভব হিংস্র। খুব ভালো হাতের টিপ না হলে ওদের মারা যায় না।

কী বলছ তুমি? জলমানব আবার কারা?

পৃথিবীটা যখন পানির তলায় ডুবে গিয়েছিল, তখন আমরা এই পাহাড়গুলোতে বসতি করেছি। পৃথিবীতে পাঁচ বিলিয়ন মানুষ তারা কোথায় যাবে? তারা সমুদ্রে গিয়েছে। তারা হচ্ছে জলমানব।

কিন্তু তারা তো সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে।

মাজুর মাথা নাড়ল, সবাই মারা যায় নি। কিছু কিছু মানুষ বেঁচে গেছে।

কীভাবে বেঁচে গেছে? সমুদ্রে তারা কোথায় থাকে? কী করে? কী খায়?

জানি না। তবে তারা আছে। জংলি আর হিংস্র। পানিতে তারা হাঙরের থেকে হিংস্র। দশ হাজার ইউনিট দিলে তাদের শিকার করতে যাওয়া যায়। এর চেয়ে উত্তেজনার আর কিছু নেই পৃথিবীতে। আমি ইউনিট জমাচ্ছি, একদিন আমি যাব জলমানব শিকার করতে। মাজুর কাটুস্কার দিকে তাকাল, বলল, তুমি যেতে চাও?

দশ হাজার ইউনিট অনেক বেশি। আমার এত ইউনিট নেই। তা ছাড়া-

মাজুর হা হা করে হাসল। বলল, আমাদের প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধানের মেয়ে বলছে তার কাছে দশ হাজার ইউনিট নেই? এটা কি বিশ্বাস করা যায়? তোমার এক পাটি জুতো নিশ্চয়ই দশ হাজার ইউনিট থেকে বেশি হবে!

কাটুস্কা মাথা নেড়ে বলল, প্রশ্নটা আসলে দশ হাজার ইউনিটের না।

তা হলে প্রশ্নটা কিসের?

প্রশ্নটা হচ্ছে আমরা মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে শিকার করতে পারি কি না।

মাজুর অবাক হয়ে বলল, পারব না কেন? যুদ্ধে কি এক মানুষ অন্য মানুষকে হত্যা করে না?

এখন কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না।

সব সময়েই যুদ্ধ হচ্ছে। একদলকে টিকে থাকার জন্য অন্য দলের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।

কিন্তু জলমানবদের সাথে আমাদের যুদ্ধ নেই। তারা এত দূরে সমুদ্রের মাঝে ভেসে। থাকে যে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগই নেই।

মাজুর হা হা করে হেসে বলল, মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। আমরা যখন তাদের শিকার করতে যাই তখন যোগাযোগ হয়।

কাটুস্কা কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে মাজুর দিকে তাকিয়ে রইল।

.

ইনস্টিটিউটের ছোট ক্লাসঘরটিতে বসে কাটুস্কা সোনালি চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলাটির কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে। মানবসভ্যতা নিয়ে গুরুগম্ভীর কিছু একটা বলছে, কাটুস্কা মন দিয়ে শুনেও সেটা ভালো করে বুঝতে পারে না।

সভ্যতা একদিনে হয় নি। মহিলাটি প্রায় যান্ত্রিক গলায় বলছে, লক্ষ বছরে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীতে মানুষ প্রজাতির সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তার সভ্যতা। এই সভ্যতাকে ধরে রাখার এবং বিকশিত করে রাখার দায়িত্ব আমাদের_

কাটুস্কা হঠাৎ মহিলার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আমাদের বলতে তুমি কাদের বোঝাচ্ছ? আমরা যারা এখানে আছি তারা, নাকি সমগ্র মানবজাতি?

অবশ্যই সমগ্র মানবজাতি।

তার মধ্যে কি জনমানবেরা আছে?

সোনালি চুলের মহিলাটি থতমত খেয়ে বলল, তুমি একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন তুলেছ, কাটুস্কা। আমরা নিশ্চয়ই একদিন সেটা নিয়ে আলোচনা করব।

কাটুস্কা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, এখন করতে দোষ কী? আমি শুধু জানতে চাইছি জলমানবেরা কি মানবজাতির অংশ?

সোনালি চুলের মহিলাটির মুখ একটু কঠিন হয়ে যায়, বলে, না, তারা মানবজাতির অংশ নয়।

কেন নয়?

মানুষ বলতে কী বোঝায় তার একটি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা আছে। ক্রোমোজমে জিনসের নির্দিষ্ট কোডিং দিয়ে সেটি করা আছে। সেই সংজ্ঞায় অপমানবেরা মানুষ নয়, তারা মানব সম্প্রদায়ের একটা অপভ্রংশ।

কিন্তু সেটা কি একটা কৃত্রিম বিভাজন নয়?

না, কৃত্রিম বিভাজন নয়। আমরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, জলমানবেরা নিচ্ছে।

কাটুস্কা কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, হয়তো তারা সুযোগ পাচ্ছে। সেজন্য পারছে না।

সোনালি চুলের মহিলাটি হেসে বলল, সেটা কি ভালো যুক্তি হল? আমরা তো তা হলে এভাবেও বলতে পারি, চিড়িয়াখানার একটা শিম্পাঞ্জিকে সুযোগ দেওয়া হলে তারাও জ্ঞান বিজ্ঞানের কাজ করত। আমরা যদি তাদের জিনেটিক কোডিংয়ের উন্নতি করার চেষ্টা করতাম

ক্লাসের অনেকে শব্দ করে হেসে উঠল। কাটুস্কা কেন জানি রেগে ওঠে-সে মুখ শক্ত করে বলল, মানুষ আর শিম্পাঞ্জির মধ্যে পার্থক্য আছে।

এক কোনায় বসে থাকা মাজুর গলা উঁচিয়ে বলল, সারা পৃথিবীতে আর কয়টাই বা জলমানব আছে যে তাদের নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে? একটা করে টাইফুন আসে আর তারা ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা যায়। আমার মনে হয় কয়দিন পরে শিকার করার জন্যও জলমানব থাকবে না!

কথাটা অনেকের কাছে কৌতুকের মতো মনে -তারা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।

কাটুস্কা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে সোনালি চুলের মহিলাটি বলল, যে যা-ই বলুক, মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে হলে তাকে একটা স্তরে পৌঁছাতে হয়। তাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে হয়, সভ্যতার বিকাশে অংশ নিতে হয়। যদি সেটা না করে তাদের মানুষ বলা যায় না

কাটুস্কা দুর্বল গলায় বলল, হয়তো তারা করছে। তাদের মতো করে করছে।

মাজুর শব্দ করে হেসে উঠে বলল, কেমন করে করবে? তাদের কি আমাদের মতো একটা কোয়াকম্প আছে? কোয়াকম্প হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছাড়া কি এই যুগে বেঁচে থাকা যায়? তারা তথ্য রাখবে কোথায়? বিশ্লেষণ করবে কী দিয়ে? সিমুলেশন করবে কী দিয়ে? সিনথেসাইজ করবে কী দিয়ে?

সোনালি চুলের মহিলা মাথা নেড়ে বলল, মাজুর ঠিকই বলেছে। এক হাজার বছর আগের জ্ঞান সাধনা আর এখনকার জ্ঞান সাধনার মধ্যে অনেক পার্থক্য! তখন সবকিছু করতে হত মস্তিষ্ক দিয়ে। এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক শক্তিশালী, এখন আমরা জ্ঞান সাধনা করি এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে। সর্বশেষ কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা হচ্ছে কোয়াকম্প। আমাদের মস্তিষ্ক শুধু কোয়াকম্প ব্যবহার করতে শেখে। মস্তিকের মূল কাজ এখন উপলোগ। বিনোদন। সভ্যতার একটা বিশেষ পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি। মানুষ কখনো ভাবে নি আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব…

কাটুস্কা আস্তে আস্তে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সোনালি চুলের মহিলাটি কী বলছে সে ভালো করে শুনতেও পায় না। সভ্যতা, জ্ঞান সাধনা, শিল্প-সাহিত্য এই কথাগুলো মাঝে মধ্যে কানে ভেসে আসে কিন্তু সেই কথাগুলোর কোনো অর্থ আছে কি নেই, কাটুস্কা সেটাও যেন বুঝতে পারে না।

প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন মনিটার একটা ত্রিমাত্রিক নকশার দিকে তাকিয়েছিল, তখন খুট করে দরজা খুলে তার একমাত্র মেয়ে কাটুস্কা ঘরের ভেতরে উঁকি দিল। রিওন হাসিমুখে বলল, কী ব্যাপার, কাটুস্কা?

বাবা, তুমি কি খুব ব্যস্ত?

হ্যাঁ মা, আমি খুব ব্যস্ত। কিন্তু আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন তোমার জন্য আমার সময় আছে। এস।

আমি একেবারেই বেশি সময় নেব না।

তুমি যত খুশি সময় নিতে পার। বল, কী ব্যাপার।

কাটুস্কা ইতস্তত করে বলল, আসলে আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না, কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারছে না। যাকেই জিজ্ঞেস করি সেই প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। প্রশ্নটা জলমানবদের নিয়ে

রিওনের মুখ হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে যায়। সে চেয়ারটা ঘুরিয়ে সোজাসুজি তার মেয়ের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী প্রশ্ন?

জলমানবেরা কি আমাদের মতো মানুষ?

রিওন সরু চোখে তার মেয়ের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে একটা উল্কাপাতে পৃথিবীর সব ডাইনোসর মরে গিয়েছিল, তুমি জান?

জানি।

ডাইনোসরদের জন্য তোমার কি দুঃখ হয়? তোমার কি মনে হয় পুরো পৃথিবীর তারা সবচেয়ে সফল প্রাণী, অথচ তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এটা ভুল?

সেটা তো একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল।

দুই শ বছর আগে যখন সারা পৃথিবী পানিতে ডুবে গিয়েছিল, সেটাও একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল। আমরা অল্প কিছু মানুষ উঁচু জায়গায় থাকি বলে বেঁচে গিয়েছি। যারা নিচু জায়গায় থাকে তারা সব পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্প কিছু মানুষ নৌকায়, জাহাজে এটা সেটা করে ভেসে ভেসে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল। আমরা সবাই জানতাম, কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছরে তারা শেষ হয়ে যাবে।

রিওন কথা বন্ধ করে আঙুল দিয়ে টেবিল ঠোকা দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কাটুস্কা বলল, কিন্তু তারা কয়েক মাস এবং কয়েক বছরে শেষ হয়ে গেল না।

রিওন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তারা সবাই শেষ হয়ে গেল না। কেউ কেউ দুই শ বছর পরও বেঁচে আছে। তাদের বেঁচে থাকাটা পৃথিবীর জন্য একটা সমস্যা

কাটুস্কা বলল, বাবা, তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। জলমানবেরা কি মানুষ?

রিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীটা পানিতে ডুবে যাওয়ার পর পৃথিবীর সম্পদ বলতে গেলে কিছু নেই। যেটুকু আছে সেটার ওপর আমরা নির্ভর করে আছি। জলমানবদের সঙ্গে সেটা ভাগাভাগি করলে কারো কিছু থাকবে না। তাই

তাই কী বাবা?

তাই আমরা একদিন ঘোষণা দিলাম জলমানবেরা মানুষ নয়। কারণ হিসেবে ক্রোমোজমের কিছু জিনের উনিশ-বিশ দেখানো হল-।

কাটুস্কা বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, তার মানে আসলে জলমানবেরাও মানুষ। আমরা ইচ্ছে করে তাদের মানুষ বলি না।

তুমি ইচ্ছে করলে সেভাবে বলতে পার, কিন্তু তোমার যেন সেটা নিয়ে কোনো অপরাধবোধ না থাকে। পৃথিবীর প্রাণী টিকে আছে বিবর্তন দিয়ে। যারা শক্তিশালী, যারা বুদ্ধিমান, যারা দক্ষ তারাই টিকে থাকবে। সেটাই নিয়ম। আমরা শক্তিশালী, আমরা বুদ্ধিমান, আমরা দক্ষ তাই আমরা টিকে আছি।

তারাও টিকে আছে।

এই টিকে থাকার কোনো অর্থ নেই, কাটুস্কা। এটা মানুষের সম্মান নিয়ে টিকে থাকা নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কিছু নেই, শুধু পশুদের মতো সহজাত একটা প্রবৃত্তি নিয়ে টিকে থাকা। তার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, কোনো তৃপ্তি নেই, কোনো স্বপ্ন নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জলমানবের এই প্রজন্ম যাচ্ছে বিবর্তনের উল্টো দিকে। সভ্য থেকে অসভ্যের দিকে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম হচ্ছে আরো হিংস্র, আরো নিষ্ঠুর।

কাটুস্কা কিছু না বলে চুপ করে রইল। রিওন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমাদের এই বয়সটা হচ্ছে আবেগের বয়স। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তোমরা এসব নিয়ে ভাববে। কিন্তু সব সময় একটা কথা মনে রেখ_

কী কথা বাবা?

দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই বড় কথা। পৃথিবীর এখন খুব দুঃসময়, তাই আমাদের টিকে থাকতে হবে। জলমানব বা অন্যদের কথা ভাবলে আমঝটিকে থাকতে পারব না। বুঝেছ?

বুঝেছি। কাটুস্কা মাথা নাড়ল।

সেজন্য যেন কারো অপরাধবোধের জন্ম না হয়। এটা হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। যে যোগ্য সে টিকে থাকবে। তাই আমরা যোগ্য হতে চাই। টিকে থাকতে চাই। বুঝেছ?

বুঝেছি, বাবা। কাটুস্কা আবার মাথা নাড়ল। বলল, আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, বাবা।