কর্নেল সরকার এসে পৌঁছোলেন ঠিক আধঘণ্টা পরে।
তাঁর একটা জিপগাড়ি তিনি নিজেই চালান। বিয়ে করেননি, তাই তাঁর বউ-ছেলেমেয়ে কেউ নেই। একাই থাকেন, গান-বাজনার খুব শখ, তাতেই
সময় কাটে।
জোজো আর সন্তু এর মধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছে। ওদের নিয়ে কাকাবাবু উঠলেন জিপে। তিনি বসলেন কর্নেলের পাশে, সন্তু আর জোজো পিছনে।
কর্নেলের সিটের পাশে একটা রাইফেল।
কাকাবাবু বললেন, একেবারে বন্দুক সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন?
কর্নেল বললেন, বলা তো যায় না, সত্যিই যদি একটা বাঘ এখানে ঘোরাঘুরি করে, আর আমাদের দেখলে দাঁত-মুখ খিচিয়ে তেড়ে আসে, তখন একটা কিছু তো করতেই হবে!
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বাঘকে তো মারতে পারবেন না। বাঘ মারা নিষেধ!
কর্নেল হেসে বললেন, কী মজার ব্যাপার বলুন তো! আমরা তো আর বাঘ মারি না। কিন্তু বাঘেরা তো আর সেকথা জানে না। তারা দিব্যি মানুষ মারে!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখনও বাঘ শিকার করেছেন?
কর্নেল বললেন, করেছি। অনেক বছর আগে। একসময় জঙ্গলে জঙ্গলে খুব ঘুরতাম। এখন বাঘ তো দূরের কথা, কোনও জন্তু-জানোয়ারই মারতে ইচ্ছে করে না। রাইফেলটা সঙ্গে রেখেছি, যদি বাঘ আসে, তাকে ভয় দেখাবার জন্য।
জিপটা রাস্তায় বাঁক নেওয়ার পর কর্নেল বললেন, আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, এই জায়গাটা পুরোটাই একটা দুর্গ ছিল। মাঝে কয়েকটা রাজপ্রাসাদ দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। হিন্দু রাজাদের আমল থেকেই এটা তৈরি হয়, তারপর মুসলমানরা এসে দখল করে নেয়। তারাও অনেক সুন্দর সুন্দর মহল। বানিয়েছে। হাতবদলও হয়েছে অনেকবার।
জোজো জিজ্ঞেস করল, এখানে একটা রাস্তার নাম হাতি চড়াও কেন? ওখানে কি হাতি ঘুরে বেড়াত?
কর্নেল বললেন, বুনো হাতি নয়। রাজা-বাদশাদের তো পোষা হাতি থাকতই। ওখানে রাস্তাটা ঢালু, আর পাশেই হিন্দোল মহল। লোকে বলে, বেগমরা হাতির পিঠে চেপে ওই পথ দিয়ে আসতেন, সোজা মহলের উপরে পৌঁছে যেতেন।
সন্তু বলল, সত্যিই, রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। গাড়িও চলছে না।
কর্নেল বললেন, বাংলায় একটা কথা আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। এখানেও সন্ধে হতে না-হতেই সবাই বাঘের ভয়ে বাড়ি পালিয়েছে।
সন্তু বলল, আমরা যদি হঠাৎ বাঘটাকে দেখতে পাই, তা হলে ভালই হয়। বাঘটা তো আমাদের আক্রমণ টাক্রমণ করতে পারবে না। সঙ্গে জোজো আছে। ও ঠিক একটা কিছু করে বাঘটাকে ভয় পাইয়ে দেবে।
জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আমায় কিছু করতেই হবে না। কাকাবাবু বাঘটাকে হিপনোটাইজ করে দেবেন! ব্যস!
কাকাবাবু বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা তো আমার নেই।
কনেলসাহেব বললেন, বাঘকে হিপনোটাইজ! কখনও শুনিনি! হা হা হা…।
তিনি খুব হাসতে লাগলেন।
গাড়িটা আস্তে আস্তে চলতে লাগল নির্জন রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে পুরনো আমলের বড় বড় গেট। কোনওটার নাম আলমগির দরওয়াজা, কোনওটার নাম ভাঙ্গি দরওয়াজা, রামপাল দরওয়াজা, জাহাঙ্গির দরওয়াজা। কর্নেলসাহেব এই গেটগুলোর ইতিহাস শোনাতে লাগলেন, একসময় এই মার এত সুনাম ছিল যে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির আর তাঁর বিখ্যাত বেগম নুরজাহান এখানে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতে।
জোজো বলল, এই নুরজাহানের নামেই তো তাজমহল বানানো হয়েছিল, তাই না?
সন্তু বলল, যাঃ! তাজমহল তো বানিয়েছেন শাহজাহান। তাঁর বেগম মমতাজ মহলের নামে। তুই ইতিহাসের কিচ্ছু জানিস না!
জোজো বলল, ওসব পুরনো কথা মুখস্থ করে কী লাভ! আমি জানি ভবিষ্যতের কথা। বল তো মঙ্গলগ্রহের জল তেতো না মিষ্টি?
কাকাবাবু এবং কর্নেল দুজনেই কৌতূহলের সঙ্গে তাকালেন জোজোর দিকে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, মঙ্গলগ্রহে জল আছে বুঝি?
জোজো বলল, নিশ্চয়ই আছে। দারুণ তেতো। নিমপাতার রসের মতো। তাই তো মানুষ মঙ্গলগ্রহে গিয়ে থাকতে পারবে কি না, তাই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।
সন্তু বলল, মঙ্গলগ্রহে যদি জল থাকেও, তা তেতো না মিষ্টি, তা বোঝা যাবে কী করে? মানুষ তো এখনও মঙ্গলগ্রহে নামেনি?
জোজো বলল, মানুষকে খেয়ে দেখতে হবে কেন? কম্পিউটার বলে দিয়েছে। এখন তো কম্পিউটারই সব কিছু বলে দেয়!
কর্নেল হেসে বললেন, খুব ইন্টারেস্টিং! জোজোর কাছে গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে হবে তো!
কাকাবাবু বললেন, জোজোর কাছ থেকে এমন অনেক কিছু জানতে পারবেন, যা কোনও বইয়ে লেখা নেই!
একটু পরে কর্নেল বললেন, বাঘের তো সাড়াশব্দ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। চলুন, আমরা অন্য কোনও জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসি। যাবেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ভালই হয়। এখনই গেস্টহাউসে ফেরার ইচ্ছে নেই। কোথায় যাওয়া যায়?
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা উজ্জয়িনী গিয়েছেন তো?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা তো প্রথমেই উজ্জয়িনী এসেছি। সেখানে একটা কাজ ছিল। তারপর এই মাণ্ডুতে তিন-চারদিন থেকে যাওয়া।
কর্নেল বললেন, আর এখানে সবচেয়ে নাম করা জায়গা হচ্ছে বাঘ গুহা। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।
কাকাবাবু বললেন, অনেক দিন আগে আমি বাঘ গুহা দেখতেও গিয়েছিলাম। সন্তু আর জোজো দেখেনি। ওদের ভাল লাগতে পারে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, বাঘ গুহায় কি বাঘ আছে?
কাকাবাবু বললেন, না, বাঘটাঘ নেই। ওখানে পরপর কয়েকটা গুহার মধ্যে ছবি আঁকা আছে, অনেক পুরনো জন্তুর। অজন্তা গুহার কথা জানো
তো? সেইরকম, তবে অত বড় নয়, অত বেশিও নয়।
সন্তু বলল, ওই গুহার নাম বাঘ গুহা কেন?
কর্নেল বললেন, সেটা আমি বলতে পারি না। তবে ওখানে যে বাঘ থাকে না, সেটা একেবারে শিয়োর।
কাকাবাবু বললেন, এখানে তো বাঘকে কেউ বাঘ বলে না। হিন্দিতে বলে শের। কর্নেল, ওখানে একটা ছোট নদীও আছে, সেটার নামও বাঘ নদী,আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই?
জোজো বলল, এখন থাকুক বা না থাকুক, একসময় নিশ্চয়ই ওখানে অনেক বাঘ ঘুরে বেড়াত। এখনও দু-একটা থাকলেও থাকতে পারে।
সন্তু বলল, আগেকার দিনের বইয়ে লেখা হত ব্যাঘ্র। সেটা সংস্কৃত, তাই না? তার থেকে বাংলায় হয়েছে বাঘ। কিন্তু হিন্দিতে শের কী করে হল?
কাকাবাবু বললেন, অতশত তো জানি না। পরে জেনে নিতে হবে।
জোজো বলল, আমরা বাঘ গুহায় যাব। চলুন, চলুন!
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু সে তো খুব কাছে নয়। আজ পৌঁছোব কী করে?
কর্নেল বললেন, আমি গাড়ি চালিয়ে আপনাদের নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই রাত্তিরে তো গুহার মধ্যে কিছু দেখা যাবে না। তবে এখন তিরিশপঁয়তিরিশ কিলোমিটার দূরে গেলে ধার নামে একটা ছোট শহর পাওয়া যাবে। সেখানে হোটেলে টোটেলে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে দেখতে যাব বাঘ গুহা।
জোজো বলল, রাত্তিরে আমাদের গেস্টহাউসে ফেরা হবে না? তা হলে তো কিছু জামা-কাপড় নিতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিকই বলেছে। আমরা তো তৈরি হয়ে আসিনি। সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নিতে হবে। কর্নেলসাহেব, খানিকক্ষণের জন্য গেস্টহাউসে ফিরে গেলে হয় না? খুব কি দেরি হয়ে যাবে?
কর্নেল বললেন, না, না, দেরির কী আছে? আমি সারারাতও গাড়ি চালাতে পারি। তবে আমার বিশেষ কিছু লাগে না। এই এক জামা-প্যান্টেই আমার তিন-চার দিন চলে যায়।
গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরা হল। অন্য একটা রাস্তা, শর্টকার্ট হবে।
জামি মসজিদের কাছে এক জায়গায় দেখা গেল বেশ কিছু লোককে। তারা উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলাবলি করছে!
কর্নেল সেই ভিড়ের কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থামালেন। কর্নেলকে এখানে অনেকেই চেনে। গাড়ি দেখে ছুটে এসে কয়েকজন লোক চিৎকার করে এখানকার ভাষায় কী যেন বলতে লাগল।
কর্নেল কাকাবাবুর দিকে ফিরে বললেন, মনে হচ্ছে সত্যিই পালে বাঘ পড়েছে। নামুন, দেখা যাক, কী ব্যাপার।
সবাই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।
রাস্তার একপাশে খানিকটা উঁচু-নিচু মাঠের মতন। তার মধ্যে একটা ছোট বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে আরও কিছু মানুষের জমায়েত হয়েছে। সেখানে শোনা যাচ্ছে একটা কোনও প্রাণীর আর্ত চিৎকার।
রাইফেলটা কাঁধে নিয়ে কর্নেলসাহেব সদলবলে হাজির হলেন সেই বাড়িটার কাছে। জনতা দুভাগ হয়ে তাঁর রাস্তা করে দিল।
একটা বড় ছাগল কিংবা ভেড়া মাটিতে পড়ে ছটফট করছে আর চাচাচ্ছে, তার সারা গায়ে রক্ত।
সেটা একটা রামছাগল। শোনা গেল যে, বাঘ এসে ওটাকে আক্রমণ করেছিল, কিন্তু অত বড় প্রাণীটাকে নিয়ে যেতে পারেনি। খানিকটা মাংস খুবলে নিয়েছে শুধু। পাশের খাঁচায় চারটে হাঁস ছিল, দুটো হাঁস নেই। ছাগলের বদলে হাঁস দুটোকেই নিয়ে গিয়েছে বাঘ।
তা হলে বাঘ যে এসেছিল,এবার তার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু কেউই বাঘটাকে চোখে দেখেনি। তিন-চারজন অবশ্য বলল, তারা বাঘের গর্জন শুনেছে, তারপরই লাঠিফাঠি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তাদের কথা কতটা সত্যি আর কতটা মিথ্যে, তা বোঝা মুশকিল।
এই ঘটনাটা ঘটেছে মাত্র আধঘণ্টা আগে।
দু-তিনজন বলল, বাঘটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। হাঁস খেয়ে কি তার পেট ভরবে? নিশ্চয়ই আবার রামছাগলটার মাংস খেতে আসবে। বাঘের তো সেরকমই স্বভাব।
কাকাবাবু বললেন, এত লোকজন দেখে আর বাঘ আসবে না। তার কি প্রাণের ভয় নেই? বাঘটা যখন এসেছিল, তখন রাস্তায় তো কোনও লোকই ছিল না নিশ্চয়ই!
দু-তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল, ছিল স্যার। একজন চোর ছিল।
কর্নেল বললেন, তার মানে? চোর ছিল? তাকে কে দেখেছে?
এবার কয়েকজন লোক কর্নেলদের নিয়ে গেল বাড়িটার ডান পাশে।
এখানে একটা মুদির দোকান। দরজায় তালা বন্ধ। কিন্তু পিছনের জানলা ভাঙা। সেই জানলা দিয়ে একটা চোর ঢুকেছিল ভিতরে। ক্যাশবাক্সে বেশ কিছু টাকা ছিল, চোর কিন্তু তা নিতে পারেনি। কয়েক প্যাকেট বিস্কুট আর দুপ্যাকেট গুঁড়ো দুধ নিয়েছে শুধু। ওইসব নিতে নিতেই বাঘটা এসে পড়ায় সে টাকাপয়সা না নিয়েই পালিয়েছে।
চোর আর বাঘ যে একই সময়ে এসেছিল, তা কী করে বোঝা গেল?
মুদিদোকানের মালিক এগিয়ে এসে বলল, সাহেব, আমি নিজে সাতটার সময় দোকান বন্ধ করেছি। তখন সব ঠিক ছিল।
আর-একজন বলল, জানলা ভেঙে চোর ঢুকবে, আর টাকাপয়সা না নিয়ে পালাবে, তা কখনও হয়? নিশ্চয়ই সে সময়ই বাঘ এসে পড়ে, তাই সে ভয়ে পালিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, কিংবা চোরটাকে বাঘও দেখে ফেলে। তাই সেও ভয় পেয়ে রামছাগলটাকে পুরোপুরি খেতে পারেনি।
জোজো বলল, কিংবা চোর আসেনি, বাঘটাই কাচের জানলা ভেঙে মুদিখানার ভিতরে ঢুকেছে। বাঘের তো টাকাপয়সার দরকার নেই। তাই শুধু বিস্কুট আর দুধ নিয়েছে।
সন্তু বলল, রোজ মাংস খেয়ে খেয়ে বাঘের অরুচি হয়ে গিয়েছে। তাই একদিন দুধ আর বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
কর্নেল বললেন, এখন আর এটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। একটা সত্যিকারের বাঘ এসে ঢুকেছে এখানে। সে একটা ছাগল মেরেছে, এরপর মানুষও মারতে পারে। এর তো একটা ব্যবস্থা করতেই হয়।
তিনি রাইফেলের নলটা আকাশের দিকে উঁচিয়ে একবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলেন। সেই শব্দ কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করিয়ে দিল সবাইকে।
রাইফেলটা নামিয়ে কর্নেল বললেন, যদি কোনও কারণে বাঘটা কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থাকে, তা হলে এই শব্দ শুনে সে পালাবার চেষ্টা করবেই।
সেরকম কিছু ঘটল না, বাঘের আর কোনও চিহ্ন নেই।
কর্নেল বললেন, তা হলে আমাদের আর আজ রাত্তিরে বেরোনো হচ্ছে। না। বাঘটাকে এই মাণ্ডু থেকে তাড়াবার একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। আমারও কিছুটা দায়িত্ব আছে।
কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে আছেন। যেন কিছু একটা ব্যাপার তার পছন্দ হচ্ছে না। তবু তিনি বললেন, তা ঠিক, আজ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।
জোজো হতাশভাবে বলল, এখানকার একটা বাঘের জন্য আমাদের বাঘ গুহায় যাওয়া হবে না?
এই সময় একটা পুলিশের গাড়ি এসে সেখানে থামল।