দুঃশাসনে জিনি তবে নকুল প্রবীর।
কর্ণের নিকটে গেল নির্ভয় শরীর।।
তীক্ষ্ণ বাণ এড়ি বীর কর্ণের উপরি।
সদর্পে নকুল কর্ণে বলে আগুসরি।।
যাহা ছিল কর্ণ তুই করিলি প্রকাশ।
তোমা হতে ক্ষত্রকুল হইল বিনাশ।।
আজি রণমধ্যে তোরে করিব সংহার।
কৃতকৃত্য হইবেন ধর্ম্ম-অবতার।।
হাসিয়া বলিল কর্ণ, তুই অল্পবুদ্ধি।
কিছু না জানিস তুই, বচনের শুদ্ধি।।
কি কর্ম্ম করিয়া প্রশংসহ আপনাকে।
আজি ছন্ন হৈলে দেখি কর্ম্মের বিপাকে।।
নকুলে এতেক বলি রুষে কর্ণবীর।
পঞ্চশত শরে বিন্ধে তাহার শরীর।।
শর হানি কর্ণে তার কাটিলেক ধনু।
আর শত বাণে তার বিন্ধিলেক তনু।।
আর ধনু লয়ে তবে নকুল সুমতি।
ত্রিশ বাণ কর্ণ বীরে বিন্ধে শীঘ্রগতি।।
তিন বাণ সারথিরে মারিল প্রচণ্ড।
ক্ষুরবাণ মারি তারে কৈল খণ্ড খণ্ড।।
ঊণত্রিশ বাণ তারে মারিলেক কর্ণ।
সর্ব্বগাত্রে রক্ত পড়ে, দেখিতে বিবর্ণ।।
ত্বরিত হইয়া বাণ মারিল নকুল।
কর্ণের ধনুক কাটি করিল আকুল।।
আর ধনু নিল কর্ণ সংগ্রাম ভিতরে।
সে ধনুও কাটিল নকুল তীক্ষ্ণশরে।।
আর ধনু লয়ে কর্ণ যুড়িলেক শর।
শরে সমাচ্ছন্ন নকুলের কলেবর।।
শরে শর নিবারয়ে নকুল প্রচণ্ড।
মহাবীর কর্ণ-শর করে খণ্ড খণ্ড।।
কর্ণবাণে নভোমার্গ হৈল অন্ধকার।
সূর্য্যের কুমার বীর সূর্য্য-অবতার।।
কাটিল হাতের ধনু, রথের সারথি।
চিন্তিত হইল তবে নকুল সুমতি।।
চারি ঘোড়া কাটে বীর সমরে প্রচণ্ড।
তৃণবৎ করি রথ করে খণ্ড খণ্ড।।
ধ্বজ পতাকাদি কাটে, কাটে অলঙ্কার।
শর হানি কর্ণবীর করে মহামার।।
নকুল পরিঘ লয়ে ধাইল সত্বর।
পরিঘ কাটিল শরে কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
ভয় পেয়ে মাদ্রীপুত্র চাহে চারিভিত।
পরিহাস করে কর্ণ সংগ্রামে পণ্ডিত।।
গলায় ধনুক দিয়া বান্ধিয়া রাখিল।
অন্তরে নকুল মহা সঙ্কট গণিল।।
হাসিয়া বলয়ে কর্ণ, শুন হীনরথী।
যুদ্ধ না করিহ আর গুরুর সংহতি।।
আপনার সমকক্ষ সহ কর রণ।
বলবান সহ নাহি যুঝ কদাচন।।
কভু না করিহ রণ, চলি যাহ ঘরে।
কহ গিয়া এবে তব যত সহোদরে।।
এত বলি কর্ণবীর নকুলে ছাড়িল।
কুন্তির বচন মানি তারে না মারিল।।
লজ্জিত নকুল বীর কর্ণের বচনে।
চলিল আপন দলে বিরস বদনে।।
পাঞ্চালে দেখিয়া তবে সূর্য্যের নন্দন।
হাতে যমদণ্ড ধায় করিয়া গর্জ্জন।।
পাণ্ডবের সেনাপতি পাঞ্চাল-নৃপতি।
কৌরবের সেনাপতি কর্ণ যে সুমতি।।
দুই দলে মহারণ করে দুই জন।
পশিল সমর মাঝে পাঞ্চাল রাজন।।
তুমুল বাধিল রণ বীর দুই জনে।
সকল পাঞ্চালগণ ধায় এক সনে।।
নিবারিল শরজাল কর্ণ বীরবর।
সন্ধান করিল বাণ নির্ভয় অন্তর।।
একে এক করে কর্ণ বাণের প্রহার।
রথধ্বজ পদাতিক করিল সংহার।।
ভঙ্গ দিয়া সব দল চারিভিতে ধায়।
মৃগেন্দ্র দেখিয়া যেন হরিণী পলায়।।
কেহ কারে নাহি চায়, পলায় সত্বর।
রাখিবারে নাহি পারে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
ক্রোধমুখে ধনঞ্জয় কর্ণ পানে চায়।
ক্ষুধার্ত্ত শার্দ্দূল যেন গজরাজে ধায়।।
কর্ণ বাণ বরিষয়ে, নিবারে অর্জ্জুন।
শিশির পাইয়া যেন শোষেন তপন।।
অর্জ্জুন মারেন বাণ, উঠয়ে আকাশ।
অন্ধকার হৈল, সূর্য্য নাহিক প্রকাশ।।
কোথাও মুষল বৃষ্টি পরিঘ বিশাল।
কোথায় পড়িছে শেল, কোথা ভিন্দিপাল।।
অর্জ্জুনের বাণ পড়ে যমের সোসর।
ভয়ে চক্ষু মুদি রহে যত কুরুবর।।
অশ্ব গজ রথ রথী পরে সারি সারি।
কুরুদল ভঙ্গ দিল সহিবারে নারি।।
যুগান্ত কালেতে যেন প্রলয় তরঙ্গ।
ত্রাস পেয়ে কুরুদল রণে দিল ভঙ্গ।।
দিন অবশেষে হৈল, রজনী প্রবেশে।
সকল কৌরব গেল আপনার বাসে।।
বিজয় দুন্দুভি বাজে পাণ্ডবের দলে।
শিবিরে চলিল রাজগণ কুতূহলে।।
মহাভারতের কথা সর্ব্বধর্ম্ম সার।
কাশী কহে, শুন যদি হবে ভবপার।।