এ পি সাহেব অফিসে ছিলেন না। জরুরি খবর পেয়ে ড়ুয়ার্সের চাবাগানে চলে গিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হল না কিন্তু কথাগুলো বলা দরকার ছিল। সন্তুদার টেবিলে বসে কিছুক্ষণ ওঁকে কাজ করতে দেখল অর্জুন। একসময় জলপাইগুড়ির টাউন ক্লাবের নামী ফুটবলার ছিলেন সন্তুদা। এখনও শরীর ঠিক রেখেছেন। কাজ শেষ করে সন্তুদা জিজ্ঞেস করলেন, চা খাবে?
মাথা নাড়ল অর্জুন, এ পি সাহেবকে বলবেন, উনি যে সমস্যার কথা বলেছেন সেটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আমি সেটাই বলতে এসেছিলাম।
তাই? ঠিক আছে বলে দেব। সন্তুদা এক মুহূর্ত ভাবলেন, তোমার সঙ্গে সন্দীপের কি দেখা হয়েছে? বোধ হয় হয়নি, তাই না?
ওকে আমি দেখেছি। আচ্ছা চলি।
দাঁড়াও। এ পি সাহেব বলে গিয়েছেন তোমার যদি গাড়ির দরকার হয় তা হলে ব্যবস্থা করে দিতে। অথবা অন্য কোনও সাহায্য-।
না। তার দরকার নেই। ছেলেটা খারাপ সংসর্গে পড়েছে। ওর বন্ধুদের তো সবাই চেনে। খুব বড় কিছু খারাপ করে ফেলার আগে ওকে সরিয়ে ফেলা দরকার, ব্যস, এইটুকু৷ অর্জুন উঠে দাঁড়াল।
সন্তুদা বললেন, তুমি বলছ, আমরাও জানি। কিন্তু ওর বন্ধুরা এই শহরের মানী এবং বড়লোকের ছেলে। তাদের খারাপ ছেলে বলা খুব সহজ নয়।
এই সময় অর্জুন সন্দীপকে অফিসে ঢুকতে দেখল। প্রায় ঝড়ের মতো সে এগিয়ে গেল কর্মরত এক ভদ্রলোকের সামনে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের মালিক অফিসে নেই?
লোকটি উঠে দাঁড়াল, না, সাহেব বাগানে গিয়েছেন।
কবে ফিরবেন?
আগামীকাল।
ননসেন্স!
সন্তুদা গলা তুলে ডাকলেন, সন্দীপ, এদিকে এসো।
সন্দীপ রাগী চোখে তাকাল, আপনি আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না।
সন্তুদা হাসলেন, কী আশ্চর্য? খামোকা জ্ঞান দিতে যাব কেন? তুমি হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠলে, আফটার অল এটা তো অফিস।
সন্দীপ কয়েক পা এগিয়ে এল, আপনি ওঁকে বলে দেবেন আমার পেছনে লোক লাগিয়ে কোনও লাভ হবে না।
তোমার পেছনে উনি লোক লাগাবেন কেন?
লাগিয়েছেন, সেই লোক মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আরে, সব জায়গায় আমার অ্যান্টেনা ফিট করা আছে।
তুমি ভুল করছ। লোক নয়। তুমি কি ওঁকে চেনো না? অর্জুনকে দেখিয়ে দিল সন্তুদা। চোখ ছোট করে অর্জুনকে দেখল সন্দীপ। তারপর হেসে বলল, এঁকে কে না চেনে! ইনি গোয়েন্দা। তা হলে আপনাদের সাহেব আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। চমৎকার। এই যে, শুনে রাখুন, আপনি যত বড় গোয়েন্দা হন, আমার পেছনে ঘুরে কোনও লাভ হবে না। দ্বিতীয়বার যেন আপনার ছায়াও আমার বাড়িতে না পড়ে। আন্ডারস্ট্যান্ড? কথা শেষ করে হনহন করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।
ওর চলে যাওয়াটা দেখলেন সদ্ভুদা। তারপর বললেন, ভুল হল। তোমার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা ঠিক হল না।
সেটা আজ না হলেও কাল তো জানতেই পারত। আচ্ছা, চলি।
চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সে অনেকদিন বাদে রামদাকে কাউন্টারে দেখল অর্জুন। ইদানীং অসুস্থতার জন্যে ভদ্রলোক খুব কম বাড়ি থেকে বের হন। এই সময় দোকানে ভিড় নেই। অর্জুনকে দেখে ওঁর পেটেন্ট হাসিটা হাসলেন, কী খবর?
কেমন আছেন রামদা?
এই, চলছে। বসুন। চা চলবে?
বয়সে অনেক বড় তবু ভদ্রলোক তাকে আপনি বলেন। এরকম পরিষ্কার মানুষ খুব কম দেখেছে অর্জুন। কাউন্টারের ভেতরে একটা চেয়ার খালি থাকেই, অর্জুন সেটায় বসল। বিভিন্ন অসুখের জন্যে ওষুধ কিনতে মানুষ আসে উদ্বেগ নিয়ে, দেখতে দেখতে ভাল অভিজ্ঞতা হয়। একজনকে ওষুধ বিক্রি করে রামদা বললেন, আজ সকালে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি।
কীরকম? অর্জুন তাকাল।
ডিসপোজাল সিরিঞ্জ কিনছে লোকে। একসঙ্গে এক ডজন।
শুধু সিরিজ? ইনজেকশনের স্মার্শ্বল?
না। শুধু সিরিঞ্জ। আর যারা বিলছে তাদের এর আগে কখনও দেখিনি। অবশ্য আমি এখন দোকানে বসি না, ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
কত সিরিঞ্জ বিক্রি করেছেন আজ?
আশিটা। স্টকেও বেশি নেই। ভাবছি এর পর শুধু সিরিঞ্জ চাইলে বিক্রি করব না।
প্রেসক্রিপশন ছাড়া সিরিঞ্জ বিক্রি করতে পারেন?
হ্যাঁ। এ নিয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
এত সিরিঞ্জ নিয়ে ওরা কী করতে পারে?
জানি না ভাই। একজন তো কেনেনি, তা হলে বুঝতাম স্টক করছে।
রামদা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন খদ্দের আসায়। অর্জুনের অস্বস্তি হচ্ছিল। টেবিলের ওপর রাখা টেলিফোনের চটি বই খুলে শহরের অন্য মেডিক্যাল স্টোর্সের নাম্বার বের করে তার একটীয় ডায়াল করল, আচ্ছা, আপনার কাছে ডিসপোজাল সিরিঞ্জ কত আছে?
বেশি নেই। আজ হঠাৎ পাবলিক দশ-দশটা করে কিনে নিয়ে গেছে।
টেলিফোন রেখে দিল অর্জুন। রামদার হাত খালি হলে সে বলল, ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয় রামদা। শুধু আপনার দোকান থেকে নয়, শহরের অন্য দোকান থেকেও সিরিঞ্জ কেনা হয়েছে। তার মানে এর পেছনে একটা পরিকল্পনা কাজ করছে। আপনার উচিত পুলিশকে জানানো।
পুলিশকে?
হ্যাঁ। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তাই না?
তা তো বটেই। কিন্তু পুলিশকে জানানো মানে হাজার ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। ঠিক আছে, তুমি বলছ, আমি থানায় ফোন করছি। নাম্বার বের করে রামদা থানায় ফোন করলেন। বড়বাবুকে চাইলেন। শুনলেন বড়বাবু এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। মেজবাবু ফোন রেখে তাঁকে ঘটনাটা বলবেন। রিসিভার নামিয়ে রেখে রামদা হাসলেন, কী বলল জানেন? সিরিঞ্জ বিক্রি হয়েছে এতে তো আপনার খুশি হওয়া উচিত। এখন মানুষ আর ট্যাবলেটে ভরসা পায় না, ডাইরেক্ট ইনজেকশন নিয়ে অসুখ সারায়। ডিসপজাবেল সিরিঞ্জ ব্যবহার করছে মানে শরীর-সচেতনতা বেড়েছে। এ নিয়ে আপনি নালিশ করতে চাইছেন?
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আপনি আপনার কর্তব্য করেছেন রামদা। চলি।
বাইকে উঠে এঞ্জিন চালু করতেই অর্জুন দেখতে পেল উদভ্রান্তের মতো হাবু দুপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছে। এসময় হাবুর এখানে আসার কথা নয়। অমল নোম ওকে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। বাজার করা ছাড়া ও বাড়ির বাইরে যায় না। তা ছাড়া বোবা এবং কালা বলে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশাও করতে পারে না। দেখামাত্র হাবু ছুটে এল তার কাছে। তারপর হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের করে উত্তেজনা প্রকাশ করল।
এমনিতে হাবুর ইশারা বুঝতে পারে অর্জুন। কিন্তু ও এত উত্তেজিত যে, কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত সে এই অনুমানে পোঁছল যে, বাড়িতে এমন কোনও গোলমাল হয়েছে যে, হাবু তার সাহায্যের জন্যে ছুটে আসতে বাধ্য হয়েছে। সে ইশারায় হাবুকে বাইকের পেছনে উঠে বসতে বলল।
হাবুর মুখ শুকিয়ে গেল। ওর শরীর তাগড়া এবং প্রচুর শক্তি ধরে। কিন্তু বাইকের পেছনে যেভাবে উঠে বসে নড়বড় করতে লাগল তাতে অর্জুন বিপাকে পড়ল। কীভাবে বসতে হবে দেখিয়ে দিয়ে সে বাইক চালু করল। অর্জুন অনেকবার অমল সোমকে প্রশ্ন করতে গিয়েও করেনি। এত লোক থাকতে তিনি হাবুর মতো বোবা কালা মানুষকে কেন বাড়ির পাহারাদার হিসেবে রেখেছেন। অমলদা যখন ছিলেন তখন হাবু রান্নাও করত। সে যে খুব রাগী এবং শক্তিশালী, এটা প্রচারিত হওয়ায় কোনও অবাঞ্ছিত আগন্তুক ওই বাড়িতে ঢোকার সাহস পায় না। হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরে হাবু যেভাবে তার বাইকের পেছনে বসে আছে তা দেখে রাস্তার লোকজন হাসছে। কোনওমতে ওকে নিয়ে অর্জুন হাকিমপাড়ায় চলে এল।
বাড়ির সামনে বাইক দাঁড় করানোর পরও হাবুকে নামতে দেখা গেল না। অর্জুন তাকে নামতে বলে নিজে নেমে দাঁড়াল। হাবু বসে আছে চোখ বন্ধ করে। এবং তারপর বোঝা গেল ওর পা অসাড় হয়ে গেছে। ধরে ধরে মাটিতে নামানোর পরও বসে পড়ছিল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকে অর্জুন দেখল বাইরের ঘরের দরজা বন্ধ। বাগানটা আগের মতো সুন্দর হয়ে আছে। তা হলে গোলমাল কীসের।
ততক্ষণে হাবু ধাতস্থ হয়েছে। ওকে ইশারায় ডেকে নিয়ে এল খিড়কি দরজায়। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢোকার পর দেখা গেল উঠোন বারান্দা জুড়ে সুটকেস বাক্স প্রায় পাহাড়ের মতো পড়ে আছে। এবং তখনই গর্জন কানে এল। বিকট শব্দে নাক ডাকছে কারও। যেখান থেকে শব্দটা ভেসে আসছে সেটা অমল সোমের শোয়ার ঘর। অর্জুন সেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব হয়ে গেল।
মেজর অমল সোমের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। তাঁর দাড়ি গোঁফের জঙ্গল থেকে আওয়াজটা প্রচণ্ড জোরে বের হলেও তিনি তা শুনতে পাচ্ছেন না। কোনও হুঁশই নেই তাঁর।
এতক্ষণে পরিষ্কার হল। মেজরকে হাবু চেনে। তিনি মালপত্র নিয়ে এসে পড়ায় দরজা খুলে দিয়ে সে ছুটেছে অর্জুনকে খবর দিতে। আর এই অবসরে মেজর একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছেন।
মেজর যে এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বেন, অর্জুন ভাবেনি। আর জলপাইগুড়ি শহরে এলে উনি সোজা অমল সোমের বাড়িতে চলে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই বাড়িতে ওঁর পক্ষে কি থাকা সম্ভব? নিজের বাড়ি বলে অমল সোম যা মেনে নেন তা মেজরের পক্ষে বেশ কষ্টকর হবে। অসল সমস্যা হবে খাওয়াদাওয়া নিয়ে। হাবুর হাতের রান্না উনি খেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
মেজরকে নাক ডাকতে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হাবু দাঁড়িয়ে ছিল মালপত্তরের পাশে হাত তুলে দুটো আঙুল দেখাল। তারপর একটা আঙুল ঘরের দিকে নির্দেশ করে দুহাত ওঠালো। বুঝতে পারল অর্জুন। দুজন এসেছে বলে হাবু জানাচ্ছে। মেজরের চিঠিতেও তো ওই খবর ছিল। ওঁর সঙ্গে এক বৃদ্ধের আসার কথা। তিনি কোথায় গেলেন? উঠোনের আশেপাশে তিনি নেই। অর্জুন মালপত্তরগুলো দেখল। এতসব সঙ্গে কেন এনেছেন তা মেজরের সঙ্গে কথা না বললে জানা যাবে না। একটা ঢাউস সুটকেসের দিকে নজর গেল। দেখেই বোঝা যায় খুব দামি সুটকেস।
হ্যান্ডেলের সঙ্গে একটা ট্যাগ লাগানো রয়েছে, তাতে লেখা, গোরান সুলম্যান। অর্জুন আবার চারপাশে তাকাল, না, গোরানসাহেবের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সে ইশারায় হাবুকে ওখানে থাকতে বলে বাগানের দিকে এগোল।
অমল সোমের বাড়ির ভেতরের বাগানটা প্রায় এক বিঘে জমির ওপর। বড় বড় আম কাঁঠাল নারকেল এবং সুপুরি গাছ প্রায় জঙ্গলের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে অমলদার অবর্তমানে হাবু এদিকটায় বেশি নজর দেয়নি।
খানিকটা এগোতেই অর্জুনের কানে এল ওদিকের গাছে গাছে পাখিরা প্রবল স্বরে চেঁচিয়ে চলেছে। এরকম কাণ্ড সাধারণত শত্রু দেখলে ওরা করে থাকে। অর্জুন সেদিকেই এগোল। খানিকটা যেতেই সে মানুষটাকে দেখতে পেল। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছেন। জিনিসটা লোকটির হাতে ধরা। অর্জুন ডাকল, হ্যালো।
গোরান সুলম্যান ঘুরে দাঁড়ালেন ওঁর বাঁ হাতের মুঠোয় হাত তিনেক লম্বা সাপের মাথা শক্ত করে ধরা মানুষটির বয়স হলেও শরীরে যে ভাল শক্তি আছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। চোখের মণি নীল এবং দৃষ্টি অত্যন্ত শীতল। সাপটা লেজ নাড়ছিল। এটি একটি পরিণত বয়সের শঙ্খচূড়, তা একবার দেখেই বুঝতে পারল অর্জুন। এই বিষধর রাগী সাপটাকে ভদ্রলোক খালি হাতে ধরলেন।
ওয়েলকাম। দিস ইজ অর্জুন।
গোরান, গোরান সুলম্যান।
এরকম একটা বিষধর সাপ আপনি খালি হাতে ধরলেন? ইংরেজিতে প্রশ্ন করল অর্জুন। গোরানসাহেব কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর মুঠোর চাপ বাড়ালেন। হঠাৎ সাপটা স্থির হয়ে গেল এবং ওর মুখ থেকে তরল কিছু বেরিয়ে আসতেই গোরানসাহেব কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাঁ হাতের মুঠোর চাপে একটা প্রমাণ সাইজের শঙ্খচূড় সাপকে মেরে ফেলা সহজ ব্যাপার নয়!
প্রথমে গাছের পাতা ছিঁড়ে আঙুলগুলো মুছলেন গোরানসাহেব। এই সময় গোটা তিনেক কাক উড়ে গিয়ে নামল সাপটার পাশে। ওটা মরে গিয়েছে বুঝতে পেরে শরীরের তিন জায়গায় তিনজন ঠোকর দিচ্ছিল আর ভয়ে ভয়ে দুজন মানুষের দিকে তাকাচ্ছিল। অর্জুন গোরানসাহেবের দিকে তাকাল। ওঁর মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। জিভ সামান্য বেরিয়ে। চোখ দুটো বিস্ফারিতা দেখলেই অস্বস্তি হয়। কাকেদের সাপ খাওয়া দেখে উনি এরকম উত্তেজিত হলেন কেন?
অর্জুন বলল, আপনারা অনেকটা জার্নি করে এসেছেন, চলুন, ভেতরে চলুন।
গোরানসাহেব ওর দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যাও, আমি একটু পরেই আসছি।
এই কথার পর দাঁড়িয়ে থাকা অসভ্য। অর্জুন ধীরে ধীরে উঠোনে ফিরে এল। কিন্তু কাকের সাপ খাওয়া দেখার সময় গোরান সাহেবের মুখের অভিব্যক্তি তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না।
হাবু দাঁড়িয়ে আছে, যেমন ছিল। ঘরের ভেতর থেকে নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ল। দ্বিতীয়বারের আওয়াজটা তীব্র হওয়ায় আচমকা নাসিকাগর্জন থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ শুয়ে থাকার পর মেজরের হাত বিছানার ওপর কিছু খুঁজতে চাইল। চশমাটাকে পাওয়ার পর চোখে এঁটে উঠে বসলেন তিনি, তারপর পরিষ্কার বাংলায় চিৎকার করলেন, কে রে?
আমি, অর্জুন।
তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন মেজর। তারপর অদ্ভুত শব্দ করে দৌড়ে এসে অর্জুনকে জড়িয়ে ধরলেন, ও তুমি? দ্য গ্রেট মধ্যমকুমার। ওঃ, কতদিন পরে তোমার গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। কোনও পারফিউম মাখখানি বলে গন্ধটাকে জেনুইন লাগছে। নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রে একধরনের রেয়ার টাইপের সিলমাছের গায়ে এরকম গন্ধ পেয়েছি।
অর্জুন হতভম্ব। কী বলছেন ভদ্রলোক? তার আর সিলমাছের শরীরের গন্ধ এক? সিলমাছের ঘাম হয় নাকি? একে ঠাণ্ডার দেশের প্রাণী, তার ওপর জলে থাকে, মেজর কী করে গন্ধের খবর পেলেন জিজ্ঞেস করলে অন্য কথা বলা যাবে না।
আপনি যে তাড়াতাড়ি এসে যাবেন, ভাবিনি! চিঠি পেয়েছি।
চিঠি লেখার পর এখানে আসার জন্যে উত্তেজনা বেড়ে গেল। তারপর ওই বিষ্টুসাহেব, সকাল দুপুর বিকেলে টেলিফোনে জ্বালিয়ে গেছেন। বুঝলে, জ্বলে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এখানে এসে দেখি মিস্টার সোম নেই। এ ব্যাটা হাবু ততা কোনও কথাই বোঝে না। আচ্ছা, তুমিই বলো, কোনও বুদ্ধিমান লোক ওইরকম কেয়ারটেকারের ওপর বাড়ির দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বাইরে যায়? মেজর কথা বলছিলেন চেঁচিয়ে।
বুদ্ধিমান বলেই বোধ হয় উনি যেতে পারেন।
অ্যাাঁ? ওহো, হো, হো, হো। হাসিতে ফেটে পড়লেন মেজর।
তিনি শান্ত হলে অর্জুন প্রশ্ন করল, বিষ্টুসাহেব এসেছেন?
ইয়েস। বাগডোগরায় নেমে আর তর সইল না। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা কালিম্পং চলে গেলেন। সমাধিতে শুয়ে ওঁর কুকুরটা নাকি কেঁদেই চলেছে, না গেলে শান্ত হবে না। যাক গে, এখন কী করি বলো!
এখানে থাকার ব্যাপারে বলছেন?
ইয়েস। মিস্টার সোম বাড়িতে নেই অথচ আমরা দখল করে বসে রইলাম, এটা তো ভাল দেখায় না। জলপাইগুড়িতে হোটেলের ব্যবস্থা কীরকম?
এখনও এই একটা ব্যাপারে আমরা পিছিয়ে আছি। আসলে এখানে তো টুরিস্ট খুব কম আসে, তাই ভাল হোটেল তৈরি হল না। তবে আমি সার্কিট হাউসে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
এখানে দেখলাম ইন্ডিয়ান স্টাইলের ল্যাট্রিন মিস্টার সোম রোগা মানুষ, তাঁর পক্ষে ব্যায়াম করা সহজ। আমার মধ্যপ্রদেশ যেভাবে বাড়ছে, বুঝেছ। ওই যে গোরান আসছে। তোমাকে লিখেছিলাম ওর কথা। আলাপ করিয়ে দিই। মেজর চটপট চোস্ত আমেরিকান ইংরেজিতে বলে গেলেন, ইনি গোরান সুলম্যান। আত্মাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। আর ইনি হলেন অর্জুন, এঁর কথা বলেছি।
অর্জুন বলল, আমাদের পরিচয় হয়ে গেছে।
মেজর চোখ বড় করলেন, ও গোরান, এখন থেকে অর্জুন আমাদের গাইড। ও বলছে এখানকার সার্কিট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে।
কেন? এই জায়গাটা তো ভালই।
ভাল, কিন্তু যার বাড়ি সে তো নেই।
বাড়িতে না থেকে আমরা এই গাছেদের মধ্যে টেন্ট ফেলে থাকতে পারি। যখন পাহাড়ে জঙ্গলে যাব তখন তো এইভাবেই থাকতে হতে পারে।
মরেছে! মেজর বাংলায় ফিরে এলেন। অর্জুন তাকাল। গোরানের ডান হাতে পাতায় জড়ানো বস্তুটি কি শঙ্খচূড় সাপটার মাথা?