ছাই!
ওই এক পুরিয়া ছাই দিয়ে সব অসুখ সারাবেন!
যে বেয়াড়া রোগের জড় খুঁজতে গোটা একটা হাসপাতালের পরীক্ষা লাগে, ওই ছাই-ই তার দাওয়াই?
আপনার হাতে ওই ছাইটুকু দেখে সে রোগবালাই হাওয়া!
ধুলোপড়া তো জানি, এ আবার ছাইপড়া নাকি?
ছাইটা কীসের? সোনাভস্ম? মুক্তোভস্ম?
ঘনাদার মুখে ছাই কথাটা শোনবার পর মিনিট দুয়েক কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা অবশ্য সরেনি। ওপরের বিস্ময় উচ্ছাস বিদ্রুপ সব তার পর থেকে শুরু। তার আগে হাঁ করা মুখগুলো বোজানোই শক্ত হয়েছে।
বিস্মিত জিজ্ঞাসায় শুরু হয়ে মন্তব্যগুলো যখন বাঁকা টিপ্পনির দিকে যাবার উপক্রম করছে, ঘনাদা তখনই মুখ খুললেন।
বললেন, না, সোনাভস্ম নয়, নেহাত সাদাসিধে কাঠপোড়া ছাই।
ওই কাঠপোড়া ছাই আপনি পুরিয়া করে ঘরে রাখেন? আর তার জোরে বলছেন ডাক্তার বদ্যি সব বিদেয় করে দিতে?
মন্ত্ৰপড়া ছাই তা হলে বলুন?
না, মন্ত্রপড়া নয়। ঘনাদা নির্বোধের বেয়াদপি ক্ষমা করে জানালেন, তবে কাজ করে মন্ত্রের মতোই। তা না হলে বুকের যা রোগ হয়েছিল তাতে সেই লাল বালির রাজ্য থেকে কি আর ফিরতে পারতাম! সেখানেই কবর নিতে হত।
অমন বুকের রোগ নিয়ে বেঁচে ফিরলেন শুধু ওই কাঠছাইয়ের দৌলতে? অসুখটা কী, ঘনাদা? আমরা অত্যন্ত উৎসুক।
ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি নষ্ট হয়ে কার্ডিয়াক রিদম কেটে যাওয়া। অর্থাৎ হৃদয়ের বৈদ্যুতিক বাহিকা শক্তি দুর্বল হওয়ার দরুন হৃদয়স্পন্দনের ছন্দপতন ঘটা—
বুঝেছি! বুঝেছি! মূলের চেয়ে গোলমেলে টীকা থামাতে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলতে হল, কিন্তু রোগটা হয়েছিল কোথায়? রাঙা বালির রাজ্য বলছেন, জায়গাটা রাজস্থান নাকি?
না, না, আর একটু দূর! ঘনাদা আমাদের একটু বুঝি হদিস দিতে চাইলেন।
তা হলে টাকলামাকান? শিবু তার অনুমানটা জানালে।
উঁহুঁ, গৌরই সংশোধন করলে শিবুকে, আর একটু দূর যখন বলেছেন তখন নিশ্চয় সাহারা। তাই না, ঘনাদা?
না, সাহারা নয়। ঘনাদাকে যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় গৌরকে হতাশ করতে হল, হায়গাটার আবার ঠিক নামও নেই। নোডস গরডি আই বলে কেউ কেউ তার বদলে আমিই একটা নাম দিয়েছিলাম—ধাঁধিকা।
আপনি নাম দিয়েছিলেন ধাঁধিকা! আমরা তাজ্জব—এ আবার কী নাম?
আচ্ছা নাম যা-ই দিন, জায়গাটা কোথায়? কত দূর?
দূর? ঘনাদা যেন মনে মনে হিসেব করবার জন্য একটু সময় নিলেন, হ্যাঁ, খুব কম করে ধরলে, মোটামুটি কিলোমিটারের হিসেবে হবে—
ঘনাদাকে কথাটা আর শেষ করতে হল না।
এমন একটা মৌ-কা পেলে ছাড়া যায়!
নিলেম ডাকের মতো আমরা তখন ডাকের পাল্লা শুরু করে দিয়েছি।
মোটামুটি কিলোমিটারের হিসেবে বলে ঘনাদা থেমেছিলেন। তাঁর সেই অসমাপ্ত কথার শেষ ফাঁকটুকু ভরাট করতে গৌর হাঁকল, দশ হাজার।
ত্রিশ, শিবু একলাফে এগিয়ে চলল।
চল্লিশ হাজার, হাঁক দিলাম আমি। আমিই বা পিছিয়ে থাকব কেন?
কিন্তু আমার অমন এগিয়ে যাওয়া কি ওদের সয়! হিংসের জ্বালায় শিবু একটু মুখ বেঁকিয়ে বললে, কত? চল্লিশ হাজার?
হ্যাঁ! চল্লিশ হাজার, আমি চেপে ধরে রইলাম গোঁ, তোমরা ইচ্ছে করলে বাড়তে পারো!
বাড়বে কোথায়, শিবুর হাসিটা বড় বেশি বাঁকা। গোটা পৃথিবীর পরিধি কত জানিস? জানিস তার ব্যাস কত?
এটা কি ঠিক ধর্মযুদ্ধ হল? এমন অন্যায় ল্যাং মারা কি এ খেলা সই? হাতাহাতি লড়াইয়ে কচুকাটা হয়ে আকাশ থেকে বোমা মেরে বাঁধ ভাঙা! এমন অধর্মের খোঁচার যা অব্যর্থ পালটা মার তা-ই দিলাম। সবজান্তার ভঙ্গি করে মুখে একটু বিদ্রুপের হাসি মাখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুই জানিস? না জানিস তো ভূগোলটা আর একবার দেখে আয়।
এই এক জবাবেই যার কাবু হবার কথা সেই শিবুর হঠাৎ হল কী? মুখে আমার চেয়েও দু ডিগ্রি চড়া বিদ্রুপের হাসি মাখিয়ে সে বললে, ভূগোল দেখতে যেতে হবে না। আমার মুখেই শুনে নে। পৃথিবীর কোন দিকের ব্যাস চাস?
কোন দিকের? প্রশ্নটা মনে মনে তখন নিজেকেই করেছি। ব্যাসই জানি না, তার কোন দিকের আবার কী?
কিন্তু ভাঙতে হয় ভাঙব, মচকালে চলবে না।
একেবারে যেন মনুমেন্টের ওপর থেকে তাকে কৃপাভরে নিরীক্ষণ করে বললাম। যে দিক জানিস সেই দিকটাই বলনা।
ব্লাডেপ্রশার সোম আর কার্ডিয়োগ্ৰাম সান্যালদের তখন কিন্তু আর ধৈর্য ধরছে না!
কী বাজে তর্ক লাগিয়েছেন! রক্ত পরীক্ষার গুপ্ত একটু ঝাঁঝিয়েই বললেন, পৃথিবীর ব্যাস আর পরিধি শুনতে এসেছি নাকি? মি. দাস কোথাকার কোন মরুভূমির কথা বলছিলেন, আর তার মধ্যে—
ঠিক আছে! ঘনাদাই বাধা দিয়ে যেন উৎসুক হয়ে উঠলেন আমাদের কথা শুনে, হ্যাঁ, পৃথিবীর ব্যাসের কথা কী যেন বলছিলেন?
বলছিলাম পৃথিবীর দুদিকের দুরকম ব্যাসের কথা! দুই মেরুর দিক থেকে পৃথিবীর ব্যাস যা বিষুবরেখার দিক দিয়ে তো তা নয়। বিষুবরেখার দিক দিয়ে ব্যাস হল বারো হাজার ছ-শো একাশি দশমিক ছয় কিলোমিটার।
শিবুর হঠাৎ হল কী! তার জিভে স্বয়ং সরস্বতী হঠাৎ ভর করেছেন মনে হচ্ছে। ঘনাদারও চক্ষুস্থির করে ছাড়ল বোধহয়।
অবস্থা আমার তখন বেশ কাহিল। তবু রোখ ছাড়লাম না! ঘনাদার নকল করা একটু হাসি হেসে বললাম, তা খুব তো মুখস্থ করেছিস বুঝতে পারছি। কিন্তু তাতে হলটা কী?
হল এই যে, তোমার মাথাটি একেবারে নিরেট বলে প্রমাণ হয়ে গেল!
গায়ে যেন বিচুটি লাগানো এ-মন্তব্যটি শিবুর নয়, শিশিরের। শেষকালে শিশিরও শিবুর দলে গেল!
বিচুটির জ্বালাতেই যেন চিড়বিড়িয়ে উঠলাম তাই। সরেস মাথাওয়ালাদের ব্যাখ্যাটা তা হলে একটু শুনি না। কোথায় আমি হড়কেছি একটু দেখি।
তা দেখতে গেলে একটু ধারাপাত জানা যে দরকার।—শিবুর এখনও সেই খোঁচানো গলা—পৃথিবীর ব্যাস যা বললাম তাতে তার বিষুবরেখার বেড় হয় কত? তিনগুণ করলে দাঁড়ায় আটত্রিশ হাজার চুয়াল্লিশ দশমিক আট কিলোমিটার। যে-কোনও বৃত্তের বেড় তার ব্যাসের মোটামুটি তিন গুণ তা আশা করি জানিস?
হ্যাঁ, মোটামুটি তিন।
অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম মন্তব্যটা স্বয়ং ঘনাদার।
লজ্জায় যখন সত্যিই অধোবদন হবার অবস্থা তখন বিপদ-তারণ শ্রীমধুসূদনের মতোই তাঁর এক-একটি টিপ্পনিতে তখনকার মতো হাওয়াটা অন্তত ঘুরল।
কিন্তু শিবু কি সহজে ছাড়ে? এমন একটা বারট্রাই-এর মৌ-কা তো রোজ আসে না। ঘনাদার সঙ্গেই তাল দিয়ে ভারিক্কি চালে বললে, হ্যাঁ, মোটামুটি তিন মানে, তিনের পর এক, চার, এক নিয়ে কটা দশমিক আছে?
ক-টা নয়, অগুনতি!
জয় দর্পহারী মধুসূদন! ঘনাদার গলা দিয়েই তিনি ফোড়নটি কেটেছেন।
শিবু কি একটু ভড়কাল? বাইরে অন্তত নয়। ঘনাদাকেই যেন শিখিয়ে দেবার জন্য বললে, হ্যাঁ, দশমিক এক, চার, এক-এর পর পাঁচ, আট, দুই নিয়ে আরও অনেক সব সংখ্যা আছে।
দশমিক এক, চার, এক-এর পর পাঁচ, আট, দুই, নয়, ঘনাদা শুধু শিবুকেই যেন লক্ষ্য করে গড় গড় করে বলে গেলেন, পাঁচ, নয়, দুই নিয়ে অঙ্কের মিছিল আছে। বলা যায়। পাঁচ, নয়, দুই-এর পর ছয়, পাঁচ, তিন—
ঘনাদা একটু থেমে আমাদের মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, আরও শুনবে? ছয়, পাঁচ, তিন-এর পর পাঁচ, আট, নয়—তারপর সাত, নয়, তিন, তারপর দুই, তিন, আট, চার, ছয়—
আমাদের সকলের চোখই ছানাবড়া।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি, শিবুই তার মধ্যে প্রথম অস্থির হয়ে উঠে ঘনাদাকে থামালে, কিন্তু দশমিকের লেজুড় যত লম্বাই হোক, তা দিয়ে পৃথিবীর ব্যাসকে গুণ করলে বড়জোর আটত্রিশ হাজার কিলোমিটারের কিছু বেশি হলেও চল্লিশ হাজারে তো পৌঁছয় না। চল্লিশ হাজার কিলোমিটার শুনে তাই হাসছিলাম! সোজা অতদূর যেতে হলে তো এ পৃথিবীতে কুলাবে না।
তা কুলাবে না বটে! ঘনাদা এবার শিবুর কথায় যেন বাধ্য হয়ে সায় দিয়ে বললেন, আরও বেশি দূর হলে তো নয়ই। আমার সে ধাঁধিকা আবার কমপক্ষে আট কোটি কিলোমিটার।
কত? ভুল শুনেছি কি না জানবার জন্যই বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করতে হল। আমাদের গলাগুলো সব তখন প্রায় ধরে এসেছে।
না, ভুল শুনিনি।
ঘনাদা স্পষ্ট স্বরেই সংখ্যাটা আবার জানালেন, আট কোটি কিলোমিটার।